অম্বরীশ ঘোষ
বিষয় পরিচিতি
প্রকৃতিকে আঁকড়ে ধরে অরণ্য, পাহাড়, নদী আর চা-বাগিচার পরিধি জুড়ে সমগ্র ডুয়ার্সে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন নানান জনগোষ্ঠীর মানুষ। স্বতন্ত্র তাদের লড়াই, স্বতন্ত্র তাদের ইতিহাস। এই লড়াই আর ইতিহাসের একটি বৃহৎ পরিসর জুড়ে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন জনগোষ্ঠীর নারীদের কর্মতৎপরতা আর নিপুণতার অধ্যায়গুলো। তাদের নিয়েই এই ধারাবাহিক নানান জনগোষ্ঠীর বীরাঙ্গনা।
সমাজসেবা যার রক্তে-মজ্জায় : লিম্বুদের ফুলমায়া সুব্বা
গ্লোবালাইজেশন বা এইরকম কঠিন উচ্চারণের উন্নতি সূচক শব্দগুলো যেমন দিয়েছে অনেক, তেমনই নিয়েছে বহু কিছু। নগর, শহর, মফ:স্বল শহর, গ্রাম, বনবস্তি সর্বত্রই আছড়ে পড়েছে এর প্রভাব। এই জন্যই পাহাড়- জঙ্গল- ঝর্ণায় বসবাস করা মঞ্চে লামার মতন অসংখ্য মানুষ ভুগছেন ডিপ্রেশনে। প্রকৃতির ঢেলে দেওয়া সত্তাও হার মানছে প্রায়শই। অনিদ্রা, খাবারে অরুচি প্রভৃতি সমস্যায় জর্জরিত এই মানুষটির পাশে যিনি দাঁড়িয়েছেন এবং অনেকটা সুস্থ স্বাভাবিক করে তুলেছেন, তিনি ফুলমায়া সুব্বা। লিম্বু জনগোষ্ঠীর এই মানুষটি এমনই অসংখ্য মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন, তাদের জীবনমুখী করে তুলছেন। পঞ্চে লামা বারো বছর ধরে নানান চিকিৎসা করাচ্ছিলেন, কিন্তু লাভ হচ্ছিল না কিছুই। অবশেষে ফুলমায়া সুব্বার নজরে এলো বিষয়টি। তিনি আধ্যাত্মিক জ্ঞান এবং বিশ্বাসের দ্বারা পঞ্চমে লামার মনের গিঁটগুলো ছাড়িয়ে দেন। একই কথা শোনা যায় মঞ্জু লামা, সোনিয়া রাই প্রমুখের মুখ থেকেও। তারা বলছেন যে ফুলমায়া দিদি আমাদের অন্তঃশক্তিটাকে জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করেছেন, পাশে থেকেছেন। ফুলমায়া সুব্বা এটা গভীরভাবে বিশ্বাস করেন যে আমাদের মনকে শুদ্ধ রাখা বিশেষ জরুরী। নানান উপায়ে মনকে শুদ্ধ ও সুন্দর করে তুলতে হবে। প্রকৃতিকে ভালবাসতে শিখতে হবে। প্রকৃতিতে লেপটে থাকলেই ঈশ্বরকে পাওয়া যাবে, আর ঈশ্বরের সান্নিধ্য পাওয়াই তো আমাদের জীবনের লক্ষ্য। আত্মা, মন, শরীর এরা একে অপরের সাথে আন্তঃসম্পর্কে সম্পর্কযুক্ত। এই সম্পর্ক গুলোর মধ্যে সুমধুর ভাব বজায় রাখতে মানুষের খাদ্যাভ্যাসকেও লাগাম পরানো জরুরী। তবেই পথ সুগম হবে। ক্রোধ এবং আক্রোশকেও লাগাম দিতে পারবে মানুষ। এভাবেই নানান মানুষকে জীবনের রাস্তার সন্ধান দিয়ে চলেছেন ফুলমায়া সুব্বা। সহজ সরল ভাষায় তিনি বলেন যে সামাজিক জীব মানুষ অথচ জীবনের ইঁদুর দৌড়ে সেই মানুষ যদি সমাজকেই ভুলে যায়, তবে তার চেয়ে যন্ত্রণার বিষয় আর কিই বা হতে পারে!
ডুয়ার্সের রাজাভাতখাওয়াতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ফুলমায়া সুব্বা। শৈশব থেকেই সঙ্গী হিসেবে পান দারিদ্র্যকে। চরম অভাব অনটনের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠা তার। স্থানীয় বামনি বস্তি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু হয়। চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনার পর চলে যেতে হয় অসমে। শিলং এর একটি নেপালি স্কুল থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেন এবং ফিরে আসেন রাজাভাতখাওয়াতে। নানান সমস্যায় আর এগোলো না লেখাপড়া। শৈশব থেকেই ‘দাদিমা’ এবং মায়ের সাহচর্যে বেড়ে ওঠেন তিনি। মায়ের পেটে তার বয়স যখন আড়াই মাস তখনই বাবা পরলোকগমন করেন। মায়ের জীবনের একটি ট্র্যাজিক দিকের কথাও তুলে ধরতে হয় তাকে নিয়ে আলোচনায়। তার মায়ের বয়স যখন বারো তখন মায়ের দাদারা জোর করে বিয়ে দেন মায়ের। পাত্র রিটায়ার্ড আর্মি। ফলে খাওয়া পরার অভাব হবে না বোনের, এটাই ছিল তাদের যুক্তি। অথচ যুক্তির কোন পাশে কিভাবে যেন বাদ চলে গেল ভয়ংকর একটি দিক। পাত্রের আগের পক্ষের বিয়েতে চৌদ্দটি সন্তান এবং পাত্র বেশিরভাগ সময়ই নেশায় বুদ হয়ে থাকে। মায়ের যন্ত্রণা, কষ্ট, অপুষ্টি আর অশান্তির গল্পগুলো শৈশব থেকেই মনোযোগ দিয়ে শুনতেন ফুলমায়া। মনে জেদ চেপে যায় যে বড় হয়ে যন্ত্রণাক্লিষ্ট মানুষদের পাশে সাধ্যমত দাঁড়াবেন। বিধবা হওয়ার সময় মায়ের বয়স ছিল একেবারেই কম ফলে সকলের কথা ও মতামতের মান্যতা দিয়ে চব্বিশ বছর বয়সে দ্বিতীয়বার আবদ্ধ হন বিবাহ বন্ধনে। আগের থেকে আরো বেশি বেশি করে ‘দাদিমা’র স্নেহ যত্নে বেড়ে উঠতে থাকেন ফুলমায়া। নিজেদের ছোট্ট জমিতে ফসল ফলাতে ব্যস্ত থাকতে হতো মাকে। খাদ্যশস্য, সবজি, পাট প্রভৃতির পরিচর্যার পাশাপাশি দু ‘চারটি পশুপালনের কাজে সব সময় ব্যস্ত থাকতেন মা। মায়ের আদর্শ আর নিষ্ঠা খুব স্পর্শ করত তার মনকে। যতটুকু যা আছে তাতেই সন্তুষ্ট আর তৃপ্ত থাকতে চাইতেন মা। মানসিক প্রশান্তির মৌখিক পাঠ দিতেন মেয়েকে।
মাতৃগর্ভ থেকেই যেই মেয়েটি মৃত্যুকে দেখে বড় হলেন, মৃত্যু তাকে খুব বেশি বিচলিত করতে পারেনি। না হলে এভাবে জীবনের জয়গান গেয়ে মানুষের পাশে সুখে দুঃখে দাঁড়াতে পারতেন না ফুলমায়া। অনেক মৃত্যু দেখেছেন ফুলমায়া। প্রিয়জনেরা একের পর এক পাড়ি জমিয়েছেন মৃত্যুর দেশে। তবুও এই জীবনটাকেই সত্য বলে ভালবেসেছেন তিনি। একত্রিত বছর বয়সে পরলোকে পাড়ি জমান মা। মায়ের মৃত্যুর তিন মাসের মাথাতেই মাত্র বারো বছর বয়সে কলেরার কাছে পরাজিত হয়ে মৃত্যুর বুকে ঢলে পড়লো ভাই। উনিশ বছরের ফুটফুটে দিদি সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে হারিয়ে গেল মৃত্যুর দেশে। নেপালে মামীকে পৌঁছে দিতে গিয়ে হারিয়ে গেল দাদা, আজও ফিরে এলো না আর। তাছাড়াও মামা, মামি, কাকু প্রমুখ পরিজনদের মৃত্যু মিছিল দেখেছেন তিনি। অশ্রুগ্রন্থি থেকে অঝোরে ঝরেছে জল। তবুও জীবনের প্রতি বিশ্বাস রেখেছেন ফুলমায়া। শৈশব থেকেই পূজা পাঠ, ভক্তি শ্রদ্ধা দেখে অবাক হতেন প্রতিবেশীরা। বাড়িতে মাছ- মাংস আনলে অস্বস্তি বোধ করতেন তিনি। প্রতিবেশী এবং আত্মীয়-স্বজনেরা বলতো, এই মেয়ে বড় হয়ে সন্ন্যাসিনী হয়ে যাবে। খিলখিলিয়ে হাসতেন ফুলমায়া। বলতেন যে সাধু হয়ে হিমালয়ে চলে যাব।
যারা সঙ্গ দোষে ভুল জীবনসঙ্গীর সান্নিধ্যে কিংবা আরও নানান প্রতিকূলতায় জীবন থেকে সরে গেছে কিংবা ভুল পথে চলতে শুরু করেছে, তাদের সঠিক পথে এনে জীবনকে উৎসবে পরিণত করার দায়িত্বে আত্মনিয়োজিত রয়েছেন ফুলমায়া সুব্বা। তবে শুধু সমাজ সেবার দিকটিকেই আলোচনায় রাখলে অন্যায় করা হবে তার প্রতি। আলোচনায় অবশ্যই উঠে আসা উচিত সংগীতশিল্পী ফুলমায়া সুব্বার কথাও। ১৯৮৯ সালে অল ইন্ডিয়া রেডিওতে অডিশন দেবার সুযোগ আসে এবং ১৯৯৩ সালে প্রথম সুযোগ আসে অল ইন্ডিয়া রেডিওতে সংগীতশিল্পী হিসেবে উপস্থাপনার। কন্ঠে যেন জাদু আছে ফুলমায়ার। অসংখ্য নেপালি গান এবং নিজ সংস্কৃতির গান তার কন্ঠ নিক্ষিপ্ত হয়ে পৌঁছায় শ্রোতাদের কানে। নানান সংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মঞ্চেও দেখা গিয়েছে তাকে। ১৯৯৪ সালে কালিম্পং টাউন হলে অনেক গুণীজনের সামনে গান গেয়েছিলেন তিনি। যদিও নেপথ্যে ছিল অল ইন্ডিয়ার রেডিও। এখনও সূর্য যখন অস্ত যায়, শেষ বিকেলের ফুরিয়ে যাওয়া আলোটুকুর এপারে বসে গুনগুনিয়ে ওঠেন ফুলমায়া:
কৌলি সুনৌলি
সিন্দুরে জান শুনিলৌ বট্টা
তিওলাউনু পাইনানি সখি
তিওলাউনু পাইনা …..
গান গেয়ে হাততালি পেয়ে খুশি থাকেন ফুলমায়া কিন্তু অনেক বেশি খুশি থাকেন সেইসব মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে, যারা জীবনের আলোর দিকটির থেকে ক্রমশ সরে সরে আসছিলেন নানা প্রতিকূলতায়। যারা মন থেকে দুর্বল হয়ে পড়েন, তাদের একান্তে গান শোনান ফুলমায়া। প্রকৃতি, মানুষ, ঈশ্বরের যোগসূত্র বোঝান। প্রেম বোঝান। এই প্রেম না থাকলে সংসারই যে ধ্বংস হয়ে যাবে! গৃহে শান্তি রাখার বিষয়ে বোঝান মানুষকে। পাশাপাশি লিম্বু জনগোষ্ঠীর মানুষরা যাতে এক সুন্দর যোগসূত্রে বাঁধা থাকে, সেদিকেও তিনি অতন্দ্র প্রহরী। লিম্বু সংস্কৃতির একজন আদর্শ ধারক বাহক হিসেবে মানুষ তাকে শ্রদ্ধা করে। কিন্তু তার আক্ষেপ যে তিনি তাদের নিজস্ব বর্ণমালা অর্থাৎ কিরাত-সিরিজংগা লিপির বিষয়ে তরুণ প্রজন্মের লিম্বুদের সেভাবে ওয়াকিবহাল করে উঠতে পারেন না। তবুও তাদের নৃত্য সংগীত প্রভৃতি দিকগুলো নিয়ে তিনি অত্যন্ত যত্নশীল। বিভিন্ন পূজার আর্চ্চা যেমন উদৌলি উবৌলি, মাংহিম প্রভৃতিতে তার আস্থা রয়েছে। আস্থা রয়েছে কর্তব্যপরায়ণতায়। আর সেই জন্যই তিনি মানুষের পাশে দাঁড়াতে ছুটে যান বাগড়াকোট, আঠাশ বস্তি, জয়ন্তী, বক্সা প্রভৃতি স্থানে। জয়গান করেন মনুষ্যত্বের।