তাপস সরকার
লেখক পরিচিতি
( সৃজনশীল সাহিত্য কর্মে নিয়োজিত কিশোর বয়স থেকেই। প্রথম পঠিত গ্রন্থ রামায়ণ, মহাভারত ও গীতা। গদ্যসাহিত্য ও উপন্যাসেই সাবলীল। যদিও শতাধিক গল্প ও দশ-বারোটি উপন্যাসের রচয়িতা কিন্তু সেসব হারিয়ে গেছে অপ্রীতিকর কারণে। প্রিয় বিষয় মহাকাশবিদ্যা। কল্পবিজ্ঞান ও কিশোর সাহিত্য প্রিয় লেখা।কিছু গল্প নব্বইয়ের দশকে বাণিজ্যিক ও অবাণিজ্যিক পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত। উন্মীলন নামে প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকায় নিজের গল্প ও দুটি উপন্যাস ছাপা হলেও সেই উদ্যোগ থেমে যায়।প্রতিভাস সাহিত্য ম্যাগাজিন চলছে পনের বছর যা মায়ের নামে। সেখানে মায়ের উদ্দেশ্যে নিবেদিত লেখা স্মৃতিচিত্রণ ও বেশ কিছু ছোটগল্প। নব্বইয়ের দশকে কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে কিছুদিন লিটল ম্যাগাজিন গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত থেকে জেলায় জেলায় সাহিত্য আসরে ঘোরাঘুরি। বিশ্বকে নিজের ঘর বলে ভাবতে অভ্যস্ত। মায়ের মৃত্যুর পর অবসাদে দীর্ঘদিন লেখায় বিরত। তারপর আবার লেখা শুরু কিশোর সাহিত্য ‘গাছবাড়ির বাসিন্দা ‘ দিয়ে। পাঁচ বছরের প্রচেষ্টায় কোভিড পরিস্থিতিতে লেখা ইংরেজি ভাষায় ‘ইটস মাই আইল্যান্ড ‘ প্রকাশের অপেক্ষায়। স্বউদ্যোগে প্রকাশিত একমাত্র উপন্যাস ‘অন্তরালোকে ‘ নিজের জীবনের এক বিশেষ অধ্যায় ও মাকে নিয়ে লেখা। ভারতীয় প্রাচীন দর্শনের ওপর একনিষ্ঠ বিশ্বাস ও আধুনিক প্রযুক্তির ওপর বিরক্তি ‘অনন্ত জীবন ‘ উপন্যাসের পাতায় পাতায় প্রতিফলিত। পেশায় অর্থনীতি বিষয়ের অধ্যাপক। )
মূলাংশ
(মরজগতে মানুষ চলেছে অমরত্বের সন্ধানে। অনাদি অতীত থেকে তার এই যাত্রারম্ভ। অনন্ত জীবন তারই এক প্রকাশ। তাই অমৃতের অধিকার নিয়ে সুরাসুরে এত অশান্তি, কারণ অমৃত নাকি অমর করে। অমরত্বের ব্যাখ্যা আবার দ্বিধাবিভক্ত, দৈহিক অমরত্ব এবং আধ্যাত্মিক অমরত্ব। দানব ও সর্বসাধারণ বোঝে প্রথম মতবাদটিকেই। কোনটি সঠিক? সবাই ছোটবেলায় হারিয়ে যায় মানুষের মেলাতে, সেখানে সে বন্ধু খুঁজে পায় যাকে সে তাকে হাত বাড়িয়ে দেয়, বোঝাতে চায় মানুষ ও বিশ্বজগতের উদ্দেশ্যবিধেয়। যে তাকে চেনে সে বোঝে সব। শৈবাঙ্কন আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর সভ্যতাকে অস্বীকার করে চলে যায় স্পিতি ভ্যালিতে। সেখানে সে আবিষ্কার করে সর্বজনীন ভাষা যাতে বাক্যালাপ চালাতো সনাতন মুনি-ঋষিরা কীটপতঙ্গ, পাহাড়-পর্বত, নদী-জঙ্গল, পাথর-প্রান্তর এবং অদৃশ্য দেবতাদের সঙ্গে। স্পিতি ভ্যালির পটভূমিকায় স্পিতি নদী ও প্রাকৃতিক উপাদানসমূহ এবং মানুষের সঙ্গে কথোপকথনে সে খুঁজতে থাকে অনন্ত জীবন বা অমরত্ত্বের ব্যাখ্যা। কী পেল সে শেষ পর্যন্ত ? )
অধ্যায় : কুড়ি
তাবো ছাড়িয়ে আসার কিছুক্ষণের মধ্যে গাড়ি চলতে লাগল মালভূমির সমতলীয় পথ ধরে। এখন স্পিতি নদী প্রবাহিত ডানধারে রাস্তার সঙ্গে সমান্তরাল রেখায়। বাঁ ধারে পাহাড়ের শ্রেণি দেখা যাচ্ছে অনেকটা দূরে, দেখে মনে হচ্ছিল তার কাছাকাছি হতে অনেকটাই দেরি। রাস্তা ধুলোয় ভরা, গাড়ি চলছে রীতিমত ধুলো উড়িয়ে পিছনে। ঝাঁকুনিও মন্দ হচ্ছিল না যেহেতু রাস্তা ততটা মসৃণ নয়। স্পিতি নদীর ওপাশটাতে আবার ঢেউখেলানো পাহাড়ি দেয়ালের সারিবদ্ধ অবস্থান, সেইসব নানাবর্ণ-শোভিত বৈচিত্র্যময় টিলাসমূহেরই ধারাবাহিকতা। তাদের গায়ে পাললিক শিলারাশির ঢাকনা আবার কর্দমাক্ত পলিমাটির প্রলেপ। সূর্য এতক্ষণে অনেকটা এগিয়ে এসেছে প্রাথমিক সীমানা ছাড়িয়ে, তার আলো ভরিয়ে দিয়েছে চারধার যেহেতু কুয়াশাচ্ছন্নতা মিলিয়ে গেছে। প্রান্তরের রুক্ষ প্রকাশে শুষ্কতা মাটির আস্তরণকে ভঙ্গুর করে রাখার জন্য এতো ধুলো তার গায়ে, কোন গাছপালা বা ঝোপঝাড় কিংবা ঘাসের চিহ্ন নেই কোনস্থানে। রাস্তার বাঁ ধারে বিছিয়ে থাকা অসমান প্রান্তরের গায়ে কেবলই নানা ভঙ্গিমায় রয়েছে নানা আকৃতি-প্রকৃতির বোল্ডারের মেলা। প্রথম দর্শনে মনে হয় এইসব বোল্ডার এলোমেলো আর ছন্নছাড়া এবং এভাবেই থেকে আসছে দিনের পর দিন। যখন অস্থায়ী হিমবাহগুলি শীতের শেষে গলতে গলতে ঝরনাজলের ঢল নামায় তাতেই তাদের স্থানচ্যুতি ঘটে কিছু কিছু হলেও অথবা পাহাড়ের গা থেকে খসে নেমে আসে গড়াতে গড়াতে এবং যেখানে সেখানে জমা হতে থাকে একের পর এক আর শেষপর্যন্ত দলবদ্ধ অবস্থান রচনা করে। অথবা ভূগর্ভস্থ গাঠনিক স্তরের চলতে থাকা অবিরাম অস্থিরতা ভূপৃষ্ঠে যখন নিজের প্রকাশ ঘটায় ভূকম্পনে তখনও শিলারাশির বিচ্যুতি ও স্থান পরিবর্তন ঘটে। যাই হোক না কেন বা যেভাবেই হোক প্রান্তরের বুকে নিজেদের বাসস্থান খুঁজে পায় ওই শিলাখণ্ডসমূহ। যদি কেউ আন্তরিক চোখ নিয়ে পর্যবেক্ষণ করে তো সে কখনও একথা ভাবতেই পারে যে ওইসব বিছিয়ে থাকা বোল্ডারগুলি নানাজাতীয় কাঠামো তৈরি করে রেখেছে, প্রান্তর জুড়ে তাদের শুয়ে থাকা কেবলই ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নয়। সৈন্দর্যপিপাসু মানুষ তাদের বিছিয়ে থাকা দলবদ্ধতায় খুঁজে পেতে পারে সুন্দরের প্রকাশ, নান্দনিক মাধুর্য। যদি প্রান্তর জুড়ে বোল্ডারের এমন দলবদ্ধ অবস্থান না থাকত তো প্রান্তরের চেহারাটাই হয়ে যেত অন্যরকম। এক সাধারণ প্রায় দিগন্তজোড়া প্রান্তর বোল্ডারগুলির সরব উপস্থিতির জন্য সমগ্র পরিবেশ চিত্রকল্পতায় সাজিয়ে দিয়েছে।
‘এই জায়গাটা আমার খুব সুন্দর বলে মনে হয়। কেমন এক অপার্থিব জগতের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি যেন।’
জানলার কাচ দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতে মন্তব্য করল গেরহার্ট। গাড়ির চলাচল বাইরে ধুলো উড়িয়ে দিচ্ছিল বলে কাচ তোলা ছিল। তার কথা শুনে দলের অন্য এক সদস্য জানাল,
‘আমারও বেশ লাগছে জায়গাটা। কেমন এক আকুল করা পরিবেশ। এখানে আমি যদি থাকতে পারতাম তো থেকে যেতাম চিরজীবন।’
তারপর সে শৈবাঙ্কনের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘তোমার পছন্দটাকে তারিফ করতেই হয়। আর তোমার মনোভাবকে। এভাবে তুমি সভ্য সমাজ-শহর ছেড়ে দিনের পর দিন এখানে থাকতে পারছ, সত্যি আমি ভাবতেই পারি না পৃথিবীতে এখনও তোমার মত এমন নির্লোভ নির্মোহ কেউ আছে। ছিল আগে এমন মানুষ অনেক, এখন তারা বিলুপ্ত প্রজাতি। তোমাদের হিন্দু দর্শনেই বলা আছে বানপ্রস্থের কথা। তোমাদের ধর্ম সত্যিই আমার মনে হয় পৃথিবীর মানুষকে অনেক কিছু শেখাতে পারে। এতো উদার, এতো ঋদ্ধ দর্শনসমৃদ্ধ ধর্ম আমি পৃথিবীতে কোনটি দেখিনি। তোমরা ভাগ্যবান, তোমরা এমন এক সুসমৃদ্ধ ধর্মের আবহে মানুষ হতে পেরেছ। আর এমন এক আশ্চর্য স্থানে থাকার যে সাহস তুমি দেখাতে পেরেছ সভ্যসমাজের বিলাস ও প্রয়োজন হেলায় বর্জন করে, তার জন্য তোমাকে কুর্নিশ। সত্যি বলছি, বিশ্বাস কর, সারাজীবনে আমি তোমার মত মানুষ আর একজনকেও দেখিনি। তোমার সঙ্গে দেখা হল বলে আমি নিজেকে ভাগ্যবান বলে ভাবছি।’
কথাগুলি বলল যে তার নাম ডেসমন্ড, সে বিদেশের একটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ও অধ্যাপক বৈজ্ঞানিক দর্শন বিভাগের। তার খ্যাতি যথেষ্ট জানিয়েছে গেরহার্ট, যেহেতু সে তার বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন একদল গবেষকের নেতৃত্বে রয়েছে যাদের গবেষণার অভূতপূর্ব গবেষণাপত্র বিখ্যাত জার্নালগুলিতে প্রকাশিত হলে জ্ঞানীগুণী সমাজে সবসময় আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। তার এমন স্বীকারোক্তি অবশ্যই ফেলনা না হলেও সে শুনেও নিরুত্তাপ ও নিরুত্তর থেকে গেল, কারণ সে জানে এখানে সে বসবাস করে তার নিজস্ব ভালো লাগার জন্য, করোও প্রশংসা বা কোনো প্রচার পাওয়ার জন্য নয়। তবে ডেসমন্ডের কথা শুনে সরব হল গেরহার্ট,
‘আমিও তোমার সঙ্গে একমত ডেসমন্ড। ওর গল্প যখন তোমাদের শুনিয়েছিলাম তোমরা নিশ্চয় ভেবেছিলে যে আমি বাড়িয়ে বলছি। তোমরা নিজেদের চোখেই দেখছ এখন ওকে। দেখে নিশ্চয় বুঝতে পারছ যে আমি কিছুই অতিরিক্ত বলিনি তোমাদের ? ও আমারও দেখা একজন আশ্চর্য মানুষ।’
গাড়ি বেশ মন্থর গতিবেগে এগিয়ে যাচ্ছিল যেহেতু আরোহীরা তেমনই বলেছিল চালককে। কেউ চাইছিল না এমন অপরূপ পরিবেশকে তাড়াতাড়ি পেরিয়ে যেতে। সমস্ত সৌন্দর্য যত বেশি উপভোগ করা যায় সেটাই ছিল লক্ষ্য।
চলতে চলতে একসময় আবার অনন্ত জীবন বা অমরত্বের কথা চলে এলো আলোচনায়। গেরহার্ট তাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘দেখ, তাবো মনাস্ট্রি ঘুরতে গিয়ে আমি কিন্তু অনন্ত জীবন বা অমরত্বের অন্য আরেকটি প্রকাশ চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠতে দেখেছি। আমার বিশেষ এই দেখাটা তোমাকে না জানিয়ে শান্তি পাব না। আমার এই নতুন দর্শন কতটা সঠিক তা একমাত্র তুমি বলতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস। তাই তোমাকে বিষয়টা জানাবার এতো আগ্রহ। তুমি একটু মন দিয়ে শোন আমার কথা, কারণ আমি তোমার মতামত জানতে চাই। দেখ, এই যে বুদ্ধদেব, তোমার কি মনে হয়না তিনি অমর হয়ে আছেন ? তাঁর জীবন ছিল একটাই, তা গত হয়েছে সহস্র বছর আগে, তা সত্বেও তিনি অনন্ত জীবনের অধিকারী হয়ে গেছেন। তিনি অমর, অমরত্ব পেয়েছেন তাঁর প্রচারিত ধর্মমত ও পৃথিবীব্যাপী সমস্ত বৌদ্ধ শিষ্যমণ্ডলীর জন্য। তাঁর ধর্মমত বলে, জন্ম জন্মান্তরে মানুষ এক জীবন থেকে অন্য জীবনে পরিভ্রমণ করে এবং এভাবেই নিজের বহু জীবনের কথা বলে গেছেন তিনি জাতক কাহিনীতে। বিশ্বাস করতেন যে এভাবেই মানুষ বহু জন্মের মধ্যে দিয়ে অনন্ত জীবন পেয়ে অমর হয়ে থাকে। তোমাদের হিন্দুধর্মের দর্শনও জন্মান্তরবাদকে স্বীকার করে। একটা কথা কিন্তু ঠিক, বৌদ্ধধর্মে হিন্দুধর্মের নির্যাস রয়েছে অনেকটাই। প্রকৃতপক্ষে, বৌদ্ধধর্মকে দেখলে মনে হবে যেন হিন্দুধর্মটাকেই অন্য চেহারায় দেখছি। যেটা ডেসমন্ড বলল একটু আগে, আমিও সেটা মানি যে তোমাদের হিন্দুধর্ম অবশ্যই পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠত্বের জায়গা অর্জন করে আছে অনেক দিক থেকেই। এমন উদারতা আর কোন্ ধর্মে আছে ? এমন দর্শন ? আর একইসঙ্গে একথাও বলতে হবে যে পৃথিবীর অনেক ধর্মমত হিন্দুধর্মের নির্যাস থেকেই নির্মিত। যাই হোক, হিন্দুধর্ম বল আর বৌদ্ধধর্ম, জন্মান্তরবাদকে মেনে নেওয়ার হেতুটা কী ? কারণ মানুষ মরতে চায় না, জীবনকে ভালোবাসে, নিজেকে অমর ভাবতে পছন্দ করে—- আমার যে এক অনন্য আমি সে থাকবে না মৃত্যু হবে এটা মানুষের খুবই অপছন্দ। সেই কারণেই মিশরীয়রা বা ইনকা সভ্যতার মানুষরা মৃতজনকে মমি বানিয়ে রেখে দিত এই বিশ্বাসে যে মৃত্যুই জীবনের সব শেষ নয়, জীবন চলে তার পরেও, মৃত্যুর পরও থেকে যায় মানুষের অস্তিত্ব। এ সমস্ত কিছুই এই কারণে যে মরণকে মানুষ পছন্দ করে না, সে চায় অমরত্ব বা অনন্ত জীবন। কিন্তু মজাটা দেখ, জাতকের কাহিনীগুলি রচনা না করলেও বুদ্ধদেব অমর হয়ে যেতেন। বুদ্ধদেব নিজেও বুঝি তাঁর এমন ভবিষ্যৎটাকে দেখতে পাননি যে তাঁর দৈহিক মৃত্যুর হাজার বছর পরও এভাবে অনন্ত জীবন পেয়ে যাবেন। জাতকের কাহিনী বানিয়ে নিজে যুগে যুগে অমর এই প্রচারটা নিজের এমন অমর ভবিষ্যৎটাকে বুঝতে পারলে হয়তো করতেও যেতেন না, বা হয়তো বা বুঝতে পারলেও করতেন নিজে অমর এটা মনেপ্রাণে নিজেকে বুঝিয়ে নিজেকেই সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য। যাই হোক, বুদ্ধের মতোই নিজের ধর্মমতের জন্য জগতে অমর হয়ে আছেন যিশুখ্রিস্টও। কেবল ধর্মমতের প্রবক্তা অবতাররাই নন, অনন্ত জীবনের অধিকারী হয়ে আছেন স্বনামধন্য বহু ব্যক্তি যুগ যুগ ধরে, নানান কীর্তি অথবা অনন্য প্রতিভার কারণে। যেমন তোমাকে আগে বলেছি, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির কথা। এই তালিকায় আছেন কোটি কোটি খ্যাতনামা ব্যক্তি। কে যে এভাবে অমর হয়ে যাবে একথা আবার অনেক ব্যক্তির ক্ষেত্রেই বোঝাও যায় না যখন জীবিত থাকে। যেমন, কাফকা বা হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান আন্ডারসেন। তাঁরা যে অনন্ত জীবনের অধিকারী হয়ে থেকে যাবেন পৃথিবীতে সমসাময়িক মানুষরা তা বুঝতেও পারেনি। আবার এর উল্টোটাও আছে। এখন প্রচণ্ড দাপট দেখে যাকে মনে হচ্ছে সে অমর হয়ে বেঁচে থাকবে দেখা যাবে সে হয়তো মৃত্যুর দু’-চার বছর পরই প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে মুছে যাবে মানুষের স্মৃতি থেকে। এমনটা বেশি ঘটে রাজনৈতিক নেতা ও স্বৈরাচারী শাসকদের ক্ষেত্রেই। তারা যখন ক্ষমতার শীর্ষে থাকে তখন তাদের প্রচণ্ড দাপট, সে এবং তার পদলেহনকারী চাটুকাররা ভাবে সে অমর হয়ে বেঁচে থাকবে। পরে দেখা যাবে সে অভাবনীয়ভাবে অত্যন্ত অল্পকালের মধ্যেই একেবারে মুছে গেল, যখন নিজের দাপট হারাল ও যখন মরে গেল। মজা কী জান, অনেক ক্ষেত্রেই মানুষ অপছন্দ করে বা মানুষের ঘৃণিত ব্যক্তি, তারাও মৃত্যুর পর অবর্তমানে অমর হয়ে যেতে পারে এভাবেই। যেমন, হিটলার। এভাবে অবতার, কীর্তিমান মানুষ, প্রতিভাধর ব্যক্তি মৃত্যুর পর নিজেদের অবর্তমানেও আগামী প্রজন্মের সভ্যতার বুকে বেঁচে থাকে চিরস্থায়ী হয়ে। অনন্ত জীবনকে এভাবেও ব্যাখ্যা করা যায়। যায় না কি, তুমি কী মনে কর ?’
দীর্ঘসময় ধরে নিজের ধারণাটা ব্যাখ্যা করে থেমে তার দিকে সপ্রশ্ন চোখে তাকাল গেরহার্ট। সে বলল,
‘তার মানে তুমি বলছ যে মানুষ অনন্ত জীবন পেয়ে যেতে পারে পৃথিবীতে কেউ বিখ্যাত বা কেউ কুখ্যাত, এভাবে ?’
‘ঠিক তাই। সেজন্যই মানুষ খ্যাতির পিছনে ছোটে, নামযশ চায়, এমন কিছু কীর্তি স্থাপন করে যেতে আগ্রহী যাতে সে চিরকাল বেঁচে থাকতে পারে আগামী পৃথিবীতে মৃত্যুর পরও।’
গাড়ি চলছিল স্বর্গীয় প্রান্তরের মধ্য দিয়ে ধুলো উড়িয়ে। এই পরিবেশ এমনিতেই অবশ করে দিতে পারে চেতনাকে। যাত্রীদের অন্যরা কেউ আর বিশেষ কিছু বলছিল না। তারা শ্রোতা আর মুগ্ধচোখে সবাই বাইরের দৃশ্যাবলী দেখে যাচ্ছিল। গেরহার্টের কথা শুনে সে মৃদু গলায় বলল,
‘আর তাই সাধারণ মানুষ সংসার স্থাপন করে যাতে সে বেঁচে থাকতে পারে পুত্র-কন্যা ও উত্তরপুরুষের মাধ্যমে।’
‘একদম ঠিক। তুমি জানলে কিভাবে এই গূঢ় রহস্য ?’
গেরহার্টের অবাক প্রশ্নের উত্তরে সে মৃদু হেসে জানাল,
‘অনেক ছোট বয়সে আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম, মেলার মাঠে। শুনেছিলাম, প্রত্যেকেই নাকি এভাবে মেলার মাঠে হারিয়ে যায়।’
‘যায় তো। এই বিশাল পৃথিবীতে এতো এতো জনতার ভিড়ে হারিয়ে না গিয়ে থাকতে পারে কে ? হারিয়ে যাই, হারিয়ে গেছি আমরা সবাই। কিন্তু তুমি দেখছি হারিয়ে গিয়েও তোমার মধ্যেই থেকে গেছ। সেটা কী রহস্য ?’
আজ সে সব জানাতেই চায়। যে বুঝবে তাকে জানানোই উচিত। তাই বলল,
‘কারণ সেই মেলার মাঠে আমি দেখা পেয়েছিলাম এক বন্ধুর। তাকে আমি চিনতে পেরেছিলাম। তার হাত তখন থেকেই শক্ত করে ধরতে পেরেছিলাম বলেই সে আমার জীবন থেকে হারিয়ে যায়নি। আমাকেও হারাতে দেয়নি।’
‘বারে বা, তুমি তো সত্যিই ভাগ্যবান আর বুদ্ধিমান। সেই বন্ধুই নিশ্চয় এসব গূঢ় তত্ত্ব তোমাকে জানিয়েছে যা নিয়ে আমি সারাজীবন গবেষণা করে মরছি ?’
গেরহার্টের বিস্মিত প্রশ্নের জবাবে সে ধীরস্থির গলায় জানাল,
‘ঠিক ধরেছ।সে আমাকে জানিয়েছিল, এই যে পৃথিবী যেখানে আমরা সবাই আছি সেটা আসলে একটা মায়াপ্রকল্প। এখানে মোহাচ্ছন্ন মানুষ ছুটে মরছে দিনরাত কী করছে কেন করছে না জেনে না বুঝেই। তারা কেউ জানে না এতো এতো কাজকর্ম করে কী প্রাপ্তি ঘটবে শেষে। কিন্তু একটা উদ্দেশ্য সবার সব কাজের পিছনেই সুপ্ত থেকে যায়, তার অজানা টানেই ছুটে মরে সবাই। সেই সুপ্ত বা গুপ্ত উদ্দেশ্যটা কী প্রত্যেক মানুষের সেটা দেখাবার জন্য সে আমাকে নিয়ে গিয়েছিল একটা জাদুজগতে।সেখানে গিয়ে আমি জেনেছিলাম, মানুষকে কোন্ লক্ষ্য তাড়িয়ে বেড়ায় এবং কেন মানুষ সব পেয়েও কিছুই পায় না শেষপর্যন্ত। কারণ আমার সেই বন্ধু জানিয়েছিল যে কোন মানুষই চিনতে পারে না তাকে, বুঝতে পারে না একথা যে সে সবারই স্বাভাবিক বন্ধু। সময়মত ধরতে পারে না তার হাত। সে আমাকে কেবল মানুষকেই দেখায়নি, দেখিয়েছিল গোটা জীবজগৎটাকে এবং আমি দেখেছিলাম সমস্ত জীবমাত্রেই এক ও অভিন্ন উদ্দেশ্যে চলছে জীবনপথে। তারপর সে আমাকে দেখিয়েছিল জড়জগৎ। গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড জাদুজগতে সে আমার সামনে উপস্থিত করেছিল। গ্রহ-তারা-তারাজগৎ, অণু-পরমাণুতে আমি সবসময় দেখেছিলাম সেই একই উদ্দেশ্য সঞ্চারিত। বিশ্বজগৎ একই উদ্দেশ্যে সৃষ্টিলগ্ন থেকে ধাবমান আজ পর্যন্ত। আমার হাত ধরে আমার সেই বন্ধু সব আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল ওই ছোটবেলাতেই।’
সে বলল। গেরহার্ট চরম কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করল,
‘কে তোমার সেই বন্ধু যার হাত ধরতে পেরেছিলে তুমি ?’
সেই প্রশ্নের সরাসরি উত্তর না দিয়ে শৈবাঙ্কন জানাতে লাগল,
‘সে আমাকে অনন্ত জীবন বা অমরত্ব কী তারও উত্তর জানিয়েছিল। তার কাছেই আমি জানতে পেরেছিলাম, অমরত্ব বা অনন্ত জীবনকে সময়ের ব্যাপ্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। অমরত্ব বা অনন্ত জীবন কাল-নিরপেক্ষ বিষয়।’
‘তোমার সেই বন্ধুটি কে /’
আবার গেরহার্ট প্রশ্ন করল আকুল আগ্রহে। সে এবার বলল,
‘তাকে আমি তখন চিনতাম কোটিকল্প নামে। এখন জানি সে আসলে কে।’
এটুকু বলে সে থেমে গেল। কোটিকল্প বলে সে যাকে চিনেছিল তার কথা কি আর বেশি বলে দেওয়া উচিত হবে ? ভাবছিল সে। গেরহার্ট কিন্তু জানার জন্য আকুল হয়ে উঠছিল। আবার জিজ্ঞেস করল,
‘আসলে সে কে ? তুমি তো জান এখন বলছ।’
সে তবুও নিরুত্তর থেকে গেল। ভাবছিল একমনে।
‘বল, সে কে ?’
গেরহার্ট ভয়ানক উৎসুক জানার জন্য। পাগলের মত প্রশ্ন করেই যাচ্ছিল বারবার। তার এতো আগ্রহ দেখে সে ভাবল, বলে দিলে ক্ষতি কী আর এমন। তার এই বিদেশি বন্ধুটি অনেক উদার, অনেক বেশি তার জ্ঞান। অন্তত বৌদ্ধ সন্ন্যাসী জীবাক্ষর তুলনায় তার বিবেচনা ও দর্শন অনেক অনেক উন্নত। তাকে বলাই যায় গূঢ় রহস্যের কথা। সে প্রশান্ত চোখ মেলে তাকাল গেরহার্টের উৎসুক মুখের দিকে। ধীরস্থির ভঙ্গিতে স্পষ্ট উচ্চারণে বলতে লাগল,
‘সে জগতের চতুর্থ স্তম্ভ। সে আমাকে নিজেই ধরা দিয়েছিল। সবাইকে তাই দেয় জীবনের শুরুতে। নিজেই আমার হাত ধরে শিখিয়ে দিয়েছিল কিভাবে তার মধ্যে দিয়ে চলতে হয় এগিয়ে পিছিয়ে, কিভাবে তাকে কেউ নিজের আয়ত্তে বা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে।’
সে একটু থামল। হতভম্ব হয়ে থাকা গেরহার্টের বিস্মিত কণ্ঠস্বর শুনল সে,
‘তার মানে, তুমি বলতে চাইছ, সে হল……’
গেরহার্ট তার কথা শেষ করল না, থেমে গেল। তার বিস্ময়বিমূঢ় মুখ থেকে চোখ না সরিয়ে শৈবাঙ্কন স্পষ্টভাবে বলল,
‘সময়।’
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)