তপোপ্রিয়

গান, চেনা গান  

গান শেখাতে নিয়ে গিয়েছিলাম ছোট্ট উমুমতুমুমকে। কত আর বয়স তার, তিন হবে বড়জোর। হারমোনিয়াম দেখে সে কী কান্না তার ! বড়ই ভয় পেয়ে গিয়েছিল। আর এখনও চার বছরেও দেখি হারমোনিয়াম সম্পর্কে তার একটা অদ্ভুত সংকোচ। তার প্রশিক্ষিকা তাকে ফিঙ্গারিং যখন শেখান দেখি সে কেমন যেন আড়ষ্ট হয়ে থাকে। আর উনি যখন নিজের মতো বাজান সে তখন অবাক বিস্ময়ে পলকহীন চোখ ফেলে রাখে হারমোনিয়ামের ওপর। 
আমি একটু দূর থেকে দেখি ছোট্ট উমুমতুমুমের চোখের বিস্ময়, আর হারিয়ে যেতে থাকি অনেক অনেক দূরে। দেখি ওরই মত এমনই আরেকজনের শৈশব, হারমোনিয়াম তারও কাছে বড়ই বিস্ময়ের। সেই ফেলে আসা অবাক চোখ দুটির দৃষ্টি আমাকে কেমন বিবর্ণ করে দেয়। নিজেকে বড় বেশি সম্পৃক্ত মনে হয়, কারণ সে আমার নিজেরই শৈশব। 

ন’মাস-ছ’মাস পর পর মা ঘরের পুরনো জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করতে গেলে হারমোনিয়ামটা বেরত কোন এক কোণ  থেকে। কোন সূত্রে ছিল সেটা আমাদের ঘরে। পুরোপুরি অক্ষত ছিল না। এখনো চোখে ভাসে মা যখন নামাতো গা থেকে তার কাঠের কাঠামো খুলে খুলে যেত আর ভিতরের গোপনীয়তা উন্মুক্ত হয়ে পড়ত। ওই ভিতরটাকে দেখার ছিল আমার প্রচন্ড শখ।  বেঁকানো লোহার শিক দেখতাম পরপর সাজানো রয়েছে। ওই শিকগুলোর নামা-ওঠা যে অদ্ভুত আওয়াজ বার করত তার উৎস খুঁজে পাওয়ার জন্য আমি উদগ্রীব হয়ে পড়তাম। মা কিন্তু আমাকে নাড়াঘাটা করতে দিত না একদমই।  হাত দিতে গেলে হাঁ-হাঁ করে উঠত। যতই পুরনো হোক কাঠামো মা অবহেলা করত না কিছুমাত্র। যত্ন করে সাজিয়ে-গুছিয়ে তুলে রেখে দিত। মায়ের আমার এই এক স্বভাব, কোনকিছুই ফেলে দিতে দেখিনি কোনদিন। একটুকরো সুতোও দেখতাম সযত্নে তুলে রাখত। আর প্রায়ই মা বলতো, ‘তৃণটিও লাগে কাজে রাখিলে যতনে।’

পরে মনে আছে সেই হারমোনিয়ামকে উপলক্ষ করেই মাকে কিছুদিন পরপর ঘর গুছোতে হত। সে ভারি মজার ব্যাপার। হারমোনিয়ামের মধ্যে থেকে শোনা যেত কিচ-কিচ আওয়াজ, সে হারমোনিয়ামের নিজস্ব আওয়াজ নয় মোটেই। আর ফেলে রাখলে হারমোনিয়াম এমনি এমনি বাজবেই বা কেন ? ওই কিচ-কিচ আওয়াজ শুনলেই মা ঘরের কোণ থেকে রাজ্যের জিনিস নামিয়ে ফেলত, টেনে বার করত হারমোনিয়ামটাকে। 

আমার সেই দৃশ্যটা এখনও স্পষ্ট চোখে ভাসে। খুব সতর্ক ভঙ্গিতে মা দুহাতে হারমোনিয়াম বুকে আগলে চৌকি থেকে নেমে আসছে, হারমোনিয়ামের ভারে মা কুঁজো। ওই কুঁজো হয়েই দুর্-দার কয়েক পা এসে ঘরের মেঝের ঠিক মধ্যিখানে হারমোনিয়াম নামিয়ে রাখল। তারপর নারকোল কাঠির ঝাঁটা হাতে এসে হারমোনিয়ামের সামনে উবু হয়ে তার গায়ের আলগা কাঠের কাঠামো আচমকা টেনে খুলে ফেলল। অমনি ভিতর থেকে তিরিং-বিরিং লাফিয়ে ছিটকে বেরিয়ে এলো দু’- তিনটে নেংটি ইঁদুর আর তারা যে যেদিকে পারে ছুট লাগাল।  মা-ও ঝাঁটাপেটা করতে করতে ছুটছিল একবার এদিকে আবার ওদিকে, যেদিকের ইঁদুর নাগালে পায়। হয়তো একটা ইঁদুরও ঝাঁটার আওতায় এলো না, খাটের তলা বা অন্য কোথাও দুরন্ত বেগে অদৃশ্য হয়ে গেল। মা তখন ইঁদুরগুলোর বাপান্ত করতে করতে ঝাঁটাটা ফেলে হারমোনিয়ামের পাশে এসে বসল। আমার ভারি উৎসাহ, জানতাম মা এবার পুরো হারমোনিয়ামটাকে খুলবে। ভিতরে কোথায় সুরের উৎস দেখার যে কী কৌতুহল আমার !একটা একটা করে কাঠের ঢাকনা খুলত মা আর আমি ক্রমশ ঘন হতাম আরো কাছে।  মায়ের কিন্তু আমার আগ্রহের দিকে নজর নেই, তখনও ইঁদুর গুলোর চোদ্দপুরুষ উদ্ধার করে চলেছে হারমোনিয়াম খুলতে খুলতে। আমি খুব কাছে চলে আসায় হয়তো অসুবিধে হল, খানিকটা বিরক্তভাবে এক ফাঁকে বলল আমাকে, ‘দেখি, সর্’— পরক্ষণেই আবার মুষিকবংশ উদ্ধার !আমার উৎসাহ আর উত্তেজনা কিছুই চোখে পড়ছিল না তার। আমি নিজেও জানতাম না কেমন ছিল সেই আমার উৎসাহের রং। আজ সেই কৌতূহল উদ্ধার করলাম মেয়ের চোখে। এমনই নিষ্পলকে উমুমতুমুমের মত আমিও নিশ্চয় তাকিয়েছিলাম সেই সুদূর অতীতে। 

হারমোনিয়াম বাজাতে দেখিনি মাকে কোনদিন। মা নিশ্চয়ই জানতই না বাজাতে। মায়ের সব গান ছিল খালি গলায়।  মাকে আমি গান ছাড়া ভাবতে পারতাম না। যখন-তখন কারণে-অকারণে মাকে কেবল গান করতে শুনতাম। হাড়ভাঙ্গা খাটনি চলুক বা বিশ্রাম, মায়ের গলায় সবসময় থাকত গান। পরে বুঝেছি, গান আসলে ছিল মায়ের কাছে ছিল এক মন্ত্র যা সমস্ত হা-হুতাশ ভুলিয়ে দিতে পারত। 

ত্রিপুরায় থাকার দিনগুলি আমার মনে পড়ে। তখন মা যতই শোকাচ্ছন্ন থাকুক শরীর পূর্ণ সক্ষম। কাজে মায়ের চিরকালই খুব উৎসাহ। দুপুরে ঘুমোনো দূরের কথা, শুয়ে বিশ্রাম নিতেও দেখিনি কোনদিন। সারাদিন একটানা কাজ চলত মায়ের, সেই ভোর পাঁচটা-ছটা থেকে, সন্ধেবেলাও কিছু না কিছু কাজ থেকেই যেত। একটু রাতের দিকে কাজ থামত মায়ের। খাওয়ার আগে শুয়ে এক-দেড় ঘন্টা বিশ্রাম। তখন শুয়ে শুয়ে শুরু হত গান গাওয়ার পর্ব। 

সমস্বরে শেয়ালদা ডেকে সন্ধে নামাতো। রাত বাড়তো আর কিছুটা সময় পরপর শেয়ালগুলো হঠাৎ হঠাৎ ডেকে উঠত পিলে চমকে দিয়ে। জোৎস্না রাতে অদূরে দেখতাম খোলা মাঠগুলিতে অলৌকিক রিমঝিম, গাছ-গাছালির গায়ে ঝুলে থাকত থোকা থোকা অন্ধকার। ওখানে আমি এখন বুঝি সব কিছুই ছিল নিখাদ। কৃষ্ণপক্ষের কালো রাতগুলিও ছিল সত্যিই কালো। এখানে দেখি অমাবস্যার অন্ধকারও কেমন শ্বেতিরোগীর মত। দেখে আমার জ্বর-জ্বর বোধ হয়, গা বমি বমি লাগে। 

আমাদের পুরনো বাড়ির ঠিক পাশটিতে ছিল দু’-দু’টি বাঁশ ঝাড়, ব্যবধান খুব বেশি হলে ত্রিশ-চল্লিশ হাত। বাঁশ ঝাড়ের মাঝখান দিয়ে রাস্তা ঢালু হয়ে নেমে গিয়েছিল কুয়েতলার দিকে, ওখানে আবার পেয়ারা গাছের জঙ্গল। দু’টি বাঁশঝাড়ের চরিত্র আর চেহারা ছিল দু’রকম, যদিও বাঁশগুলি জাতে এক। খুব ভালো বেত তৈরি হত ওই বাঁশ দিয়ে, নামই ছিল বেতের বাঁশ, কথ্য ভাষায় বলত সবাই ‘বেতির বাঁশ। সরু-পাতলা লম্বা লম্বা বেত ছাড়িয়ে তা দিয়ে তৈরি হতো ঝুড়ি, ঝাঁকা, ধামা, কুলো। ঝাঁকা বা ধামা নামগুলি বলত না কেউ। কুলোকে বলতো সবাই কুলা। ঝুড়ি বলতে বুঝতাম বাঁশের তৈরি বড় গামলার মত এক পাত্রকে যার গায়ে বড় বড় ফোকর, গরুর ঘাস কেটে ভরে আনার জন্য ছিল তার ব্যবহার। আর ছিল ওড়া, তার গায়ে কোন ফোকর থাকত না, সারা গা গোবর দিয়ে লেপা। ওড়া হত পাঁচ  সেরি, দশ সেরি—- নানা আকারের। ওড়ার চেয়ে ছোট আয়তনের হত সাজি, অনেকেই বলতো তাকে পুরা। ধান রাখার জন্য গোলাও তৈরি হতো বাঁশ দিয়ে। আরেকটি বাঁশের পাত্র ছিল ডোল, চেহারা অনেকটা কালির দোয়াতের মত। ডোল হত বড় বড় আয়তনের, দু’-পাঁচ মণ ধান ধরত অনায়াসেই। আবার ছোট আয়তনেরও হতো। ধান ছাড়াও তাতে মুড়ি বা খই থাকত। ডোলের গা-ও ছিল গোবর দিয়ে নিপুণভাবে লেপা। 

সন্ধের পর রাত বাড়তে থাকলে শেয়ালগুলো ডাকতে ডাকতে ঘরের পাশে বাঁশঝাড়ে চলে আসত। ওই বাঁশঝাড়ের পাশেই কোন গাছে বসে ডাকত নানারকম পেঁচা। কোন কোন পেঁচার ডাকে বুকের মধ্যে অজানা আতঙ্ক গুড়গুড় করে উঠত, শরীর জুড়ে বেজে যেত অদ্ভুত শিহরণ। কোন পেঁচা ডেকে রাতটাকে করে তুলত ভাবগম্ভীর। আমার কানে বাজে অন্য একটা পাখির ডাক, কোনদিনই চিনতে পারিনি পাখিটাকে। সে রোজই সন্ধের পর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত নিয়ম করে ডেকে যেত একটানা। বিরামহীন সুরে ডাউক-ডাউক ডাউক-ডাউক। ধ্বনিচিত্র শুনে মা বলত ওটাকে ডাহুক পাখি, পরে আমার মনে হয়েছিল ওটা অন্য কিছু। অন্তত ডাহুক পাখি নয়। মা আবার বলত মজা করে, ওই পাখিটা আমার বাবা, মৃত্যুর পর আমাদের এসে পাহারা দিচ্ছে। মায়ের কথায়, ‘বলছে, তোমরা ভয় পেয়ো না গো। আমি আছি।’

এমনই নৈশ প্রেক্ষাপটে মায়ের কন্ঠে গান বাজতে থাকত, একের পর এক। কত যে বৈচিত্র্য সেসব গানের আজও অবাক হয়ে ভাবি। কোন্ ছোটবেলায় মা গানগুলি বেশিরভাগ শুনেছিল তার ঠাকুমার গলায়, সব মুখস্থ করে নিয়েছিল। ওইসব গানের অনেকগুলি রামপ্রসাদী আর ছিল এমন সব আশ্চর্য গান যা অন্য কোথাও শুনিনি কখনো। 

‘যন্ত্র যদি পড়ে থাকে লক্ষ জনার মাঝে 

যন্ত্রী না হলে যন্ত্র কেমন করে বাজে। ‘

অথবা, 

‘ওগো রানী মন্দোদরি, তুমি মিছে আমায় মন্দ বলো 

আমার অশোক বনে লক্ষ্মী আছেন দ্বারে বাধা আছেন হরি….. 

যদি বলো সীতে এনেছি লঙ্কাতে 

আমার রাক্ষস দুরাচার বংশ উদ্ধার করিতে….. 

রামের সীতে রামকে ফিরিয়ে দিতে পারি 

কিন্তু বিভীষণ অরি     দিবে টিটকারি 

আমার সহেনা সহেনা প্রাণে…..’

গানের ওপর মায়ের টান ছিল অন্তরের। গান শুনতে বড়ই ভালোবাসত মা। অনেক অনেক পরে নানা রকম অসুখে যখন বিধ্বস্ত ঘুম আসতো না মায়ের। ডাক্তার লিখত ঘুমের ওষুধ প্রেসক্রিপশনে। ঘুমের ওষুধ খাওয়াতে মায়ের ছিল খুব আপত্তি। আমি টেপ রেকর্ডারে গান চালিয়ে দিতাম। ওটাই ওষুধের কাজ করত।  গান শুনতে শুনতে মা ঘুমিয়ে যেত। 

যত কাজেই ব্যস্ত থাকুক না কেন রেডিওতে যখনই কোন ভালো-লাগা গান হত হাতের কাজ ফেলে শুনত বসে মা। মায়ের চরম দুর্দশার দিনগুলিতে দেখতাম কিভাবে গানকে আশ্রয় করে মা সব দুঃখ ভুলে থাকত। গান শোনার কোন বেশি ব্যবস্থা ছিল না তখন, রেডিও কেনারও সঙ্গতি ছিল না, দুঃসহ সেই দিনগুলিতে মা নিজেই নিজেকে গান শুনিয়ে ভুলিয়ে  রাখত। শেয়াল, পেঁচা আর রাতচরা পাখিদের ডাকের সঙ্গে মিশে যেত হওয়ার শব্দ। পৃথিবীর নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস ঘন থেকে ঘনতর হতে থাকত। রাতকে মনে হত কোন্ মায়াপুরীর কুহকজাল। আর বিছানায় শুয়ে শুয়ে মা গাইত অবিস্মরণীয় সেই সব গান :

‘শুন ব্রজরাজ   স্বপনেতে আজ 

দেখা দিয়ে গোপাল কোথা লুকালো !’

কোনদিনও মাকে বেসুরো গাইতে শুনিনি, বড় নিখুঁত ছিল তালজ্ঞান। এত এত গান মা কোন প্রথাগত রেওয়াজ ছাড়াই দীর্ঘকাল মুখস্থ রেখেছিল। 

শহরের রাতগুলিতে আমি আর সেইসব ফেলে আসা রাতকে খুঁজে পাই না। তবুও যতই বিবর্ণ হোক আকাশে তারার ভিড় ঠিকই বুঝতে পারি। ওখানে কোথায় আছে আমার মা প্রায়ই অন্ধবিশ্বাসে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা চালাই। নিজেকে বড় একা লাগে, বড় নিঃসঙ্গ। আপাদমস্তক এই শূন্যতা রাতের পর রাত আমাকে ঘিরে রাখে, ঘর অন্ধকার করে ঘুমোতে গেলেই গিলে খেতে আসে, রাতে ঘুমোবার কথা ভাবলে তাই আতঙ্কে কাঁপি। ঘুম আমারও হারিয়ে গেছে। ভাবি, মায়ের মত চেষ্টা করে দেখলে হয় গান শুনে ঘুমাতে পারি কিনা। ভাবিই কেবল, চেষ্টা করতে যাই না ভয়ে। আমি আর গান শুনতে পারি না। গান শুনতে গেলে বড় বেশি মনে পড়ে মায়ের কথা, বুকে শ্বাসকষ্ট হতে থাকে। যদি সেইসব গান আবার শুনতে পেতাম মায়ের গলায় যা শুনতাম ফেলে আসা দিনে তাহলেই বুঝি এই কষ্ট কিছুটা কমত। মাকে আবার ফিরে পাই না। ঘুম নেই চোখে। 

স্মৃতির ভারে ক্রমশ অচল হয়ে যেতে থাকি। হারানো দিনগুলি কি পুনরুদ্ধার করা যায় ? পৃথিবী আমাকে আজীবন অনেক কিছু শিখিয়েছে, কেবল এই একটি ব্যাপারে সবাই দেখি নির্বাক। রাত্রির সর্বগ্রাসি বিষণ্ণতা দিনেও আমাকে অথর্ব বানিয়ে রাখে। চলি-ফিরি, নিজের মধ্যে নিজে থাকি না। 

তবুও জীবনকে অস্বীকার করা যায় না। এযে কী অমোঘ বাস্তবতা বুঝি যখন উমুমতুমুম কচি কচি হাতে স্টিলের আলমারি বাজিয়ে আধো আধো বুলিতে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে গায় আপন মনে, ‘বাঁশের সাঁকোয় পা দিয়ে পেরিয়ে ছোট্ট নালাটা।’

কেন জানিনা মনে হয় বুঝি শুনছি সেই বিস্মৃত রাতে আবার মায়ের গলা ! আমি তাকিয়ে থাকি কিছুটা অচেনা চোখে। মনে হয় : এই মেয়েটিকে আমি কি চিনি ? কোথায় যেন দেখেছি, কোথায় যেন ? মুখটা বড়ই চেনা চেনা লাগে। আমার হারিয়ে যাওয়া বিগত দিনগুলিতে ছিল কি তার উপস্থিতি ? দু’হাতে আলমারিতে বাজনা বাজায় আর টলোমলো গলায় সুর তোলে, 

‘বনের ফাঁকে ফাঁকে  রবির কিরণ ডাকে 

সোনালি স্বপন আঁকে 

বনছায়ায় মিশিয়ে 

আমি চলি সেখান দিয়ে দিয়ে।’
তখন নিশ্চিত লাগে, আমার শৈশব আবার ফিরে এসেছে। ফিরে এসেছে তার সব মাধুর্য নিয়ে। মাকে মনে হয় কিছুটা হলেও পুনরুদ্ধার করতে পেরেছি। যদি না হত তাহলে এত ছোট্ট মেয়েটি শিখলো কোথায় এমন জটিল সুর-তাল-মাত্রা ?

হারমোনিয়ামটা মা তারপর পুরোপুরি খুলে ফেলত। আমার সামনে তখন প্রচলিত জগতের বাইরে অন্য একটা জগতের রহস্য উন্মোচিত। ময়ূরপঙ্খী মেঘ নীল পাখনা মেলে উড়ে বেড়াচ্ছে হাতের কাছে। মহাসমুদ্রে দেখছি ছায়া ভাসিয়ে হতভম্ব শঙ্খচিলের সবুজ উল্লাস ! হারমোনিয়ামের একেবারে তলা থেকে মা একের পর এক লালচে চামড়া দিয়ে ঢাকা ইঁদুর ছানা বার করে রাখত মেঝের ওপর। চোখ ফোটেনি তখনও ওদের। মেঝের ওপর ছেড়ে দিলে তারা চি-চি আওয়াজ তুলে অন্ধের মত বুক ঘষটে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। তাই দেখে মায়ের আবার মায়া হয়। আমি প্রচন্ড উত্তেজিত হয়ে ছানাগুলির আরও কাছাকাছি যেতে চাইলে মা আমাকে আটকায়, আগলে রাখে ছানাগুলিকে। 

‘সর্, ওদের গায়ে পা লাগবে। অবোলা জীব !’

হারমোনিয়ামটা এভাবেই আমাদের জন্য একটা ইঁদুর-কল হয়ে গিয়েছিল। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *