অরিত্রী দে

দশম  পর্ব

স্বার্থ

মানুষের কি লোভ তাই ভাবি।”- পোর্তুগিজ নাবিক বংশীয় অভিযাত্রী আত্তিলিও গাত্তি উনিশ শতকের আফ্রিকায় উৎকৃষ্টতম হীরের খোঁজে গিয়ে এমন উক্তি করতে পেরেছিলেন। শঙ্কর আর আলভারেজ তাদের যাত্রাপথে আফ্রিকান মাটাবেল জাতির রাজ্যে এসে পড়লে তারা সন্দেহ করেছিল যে আলভারেজরা ওদের দেশে হীরের খনির খোঁজে এসেছে। ভারত, আফ্রিকার মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে তাদেরই প্রাকৃতিক সম্পদ অধিকার করে ভোগ-লুন্ঠন তো বটেই, আবার অধিবাসীদের উপর পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ রেখে দেশকে উপনিবেশ বানিয়ে রাখার প্র‍্যাকটিস আমাদের সকলের জানা। উনিশ শতকের শেষ দিকে এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা, অস্ট্রলেশিয়া যেমন পশ্চিমী দেশকে কাঁচামাল সরবরাহ করতো, সেরকমই ভারতও পুঁজিবাদী বিশ্ব অর্থনীতির বিশেষ খোপে ঢুকে পড়ে তার প্রাকৃতিক ধনসম্বলের বিনিময়ে। গোটা অষ্টাদশ শতক জুড়ে ভারতের প্রাকৃতিক ভূ-সম্বল এবং তাকে কেন্দ্রে রেখে জমিদার-রায়তের আন্ত:সম্পর্ককে মূলধন বা অর্থে সংশ্লেষিত করছিল ব্রিটিশ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি। কোম্পানির স্বার্থে ও সুবিধার জন্য ১৭৬৫ সালে বাংলার কৃষিপণ্যের বাণিজ্যীকরণ হয়। প্রয়োজনে প্রাকৃতিক সম্পদকে গুদামজাত করাও হল। ওই শতকে

ইউরোপীয় বণিকরা আরেকটি পণ্যের কথা ভেবেছিল। পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ থেকে নীল চাষ ও নীল উৎপাদনের প্রযুক্তি ভারতে এনে ফরাসি বণিক লুই বোন্নাদ চন্দননগরে নীলকুঠি স্থাপন করেন (১৭৭৭)। ক্রমে ১৭৯৭ নাগাদ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সমর্থনে নীল চাষ শুরু হয়। বাধ্যতামূলক চুক্তিচাষে বাধ্য করা হত কৃষকদের, তাদের উর্বর ধানী জমি অনাবাদী পতিত জমিতে পরিণত হত। কখনো কখনো বছরে দু’বার নীল চাষ করনোর ফলে জমিতে আর অন্য কোনো ফসল ফলত না। ব্রিটিশরা আগে ‘ঔড’ (Woad) নামক একপ্রকার গাছ থেকে নীল তৈরি করত। ভারতবর্ষে বাণিজ্য শুরু করার পর ব্রিটিশ বণিকরা পশ্চিম ভারত থেকে নীল কিনে নিয়ে যেত ইউরোপে। দেশীয় আদি পদ্ধতিতে তৈরি এই নীলই ইউরোপের বাজার থেকে ঔডের রংকে সরিয়ে দেয়, এনে দেয় সন্তোষজনক মুনাফা। ভারতীয় উপনিবেশে খুড়োর কল ঝুলিয়ে দেখানো হলো যে অনাবাদি কিন্তু আবাদযোগ্য জমিকে চাষের আওতায় নিয়ে আসাটাই সভ্যতার অগ্রগতি। ফলে অরণ্য ধ্বংস করে কৃষির প্রসারণ চলল, বিতাড়িত হল জঙ্গলনিবাসীরা, শিকারি, খাদ্যসংগ্রাহক ও পশুপালকেরা। 

উনিশ শতকে (১৮০৬ সালে) নেপোলিয়নের সঙ্গে যুদ্ধের সময় ব্রিটিশদের রাজকীয় নৌবাহিনীর রণতরী তৈরির কাজে নরম কাঠের জন্য প্রয়োজনীয় অরণ্যের চাহিদাও বেড়ে যায়। অবশ্যম্ভাবী নজর পড়েছিল উপনিবেশ ভারতে এবং অচিরেই ভারতীয় অরণ্যে সেরকম নরম কাঠের বৃক্ষের অভাব দেখা দেয়। শতাব্দীর গোড়াতেই বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে ওই ধরনের গাছ সংরক্ষণে, তত্ত্বাবধানে প্রথম ফরেস্ট অফিসার হিসেবে ডিয়াট্রিস ব্রান্ডিস নিযুক্ত হয় মালাবারে। এছাড়াও সেনাছাউনি, কাগজ-কল তৈরি ও রেলপথের স্লিপার বসানোর জন্য বিপুল পরিমাণে কাঠ লাগত। এই সময়ে কয়েকজন ব্রিটিশ প্রকৃতিচর্চাকারী, মূলত কোম্পানির কাজে নিযুক্ত শল্যচিকিৎসকেরা অরণ্য সংরক্ষণের দাবি তোলেন। ১৮৩২ সালে রাজ্য পরিচালনায় ‘মাদ্রাজ বোর্ড অফ রেভিনিউ’ কর্তৃক স্থানীয় অরণ্য সংরক্ষণ কার্যক্রমে নিয়মিত বন সংরক্ষণ কর্মসূচি শুরু হয় পেশাদার উদ্ভিদবিদ আলেকজান্ডার গিবসনের নেতৃত্বে। আর ১৮৬৪ সালে ডিয়েট্রিস ব্রাভিসের অধীনে সর্বভারতীয় স্তরে অরণ্য বিভাগ স্থাপিত হয় (পূর্ব বার্মার পেগু বিভাগের সমুদ্র তীরবর্তী এলাকায়)। অরণ্যের কোনো ক্ষতি না করে তার সঙ্গে পারস্পরিকতায় অরণ্য-সম্পদ ব্যবহারের জন্য (অরণ্যচারী আদিবাসীদের স্বার্থে) গবেষণা, প্রশিক্ষণ দানের প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন তিনি। বলা যায় ‘সাস্টেনেবল’ (sustainable) উপায়ে অরণ্য-সম্পদ নিষ্কাশন করতে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছিলেন ব্রান্ডিস। এই প্রচেষ্টাই আর দু’দশক পরে বিকাশলাভ করে ‘ইম্পেরিয়‍্যাল ফরেস্ট স্কুল অফ দেরাদুন’ প্রতিষ্ঠায় (১৮৭৮)। বাংলার বনভূমি সম্পর্কে খোঁজ নেওয়ার উদ্যোগ কলকাতায় বন সংরক্ষকের দপ্তর প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগেই শুরু হয়েছিল। সরকারের তরফে প্রতিটি বিভাগীয় অঞ্চলে বনের ধরন ও এলাকার সম্পর্কে জানতে চাওয়া হত। ছোটনাগপুরের   বিভাগীয় কমিশনার এই প্রসঙ্গে  পালামৌ অঞ্চলের শালগাছ পূর্ণ অরণ্য ব্যবহারের লক্ষ্যে নতুন রাস্তা নির্মাণের প্রয়োজনীয়তার কথা জানিয়েছিলেন। তখন ভাগলপুর বিভাগের অন্তর্ভুক্ত ছিল ভাগলপুর, মুঙ্গের এবং দার্জিলিং অঞ্চল। ওই বিভাগের কমিশনারও দার্জিলিং সম্পর্কে তাঁর প্রতিবেদনে জানিয়েছিলেন যে এখানকার অরণ্যভূমি মূল্যবান ও মূল্যহীন উভয় ধরনের গাছে পূর্ণ এবং সরকারি আয়ত্তাধীন। ভুটান, আসাম, কাছাড় চট্টগ্রাম ও বিহারের নতুন বনবিভাগ গঠনের প্রস্তাব রেখেছিলেন অ্যান্ডারসন সাহেব। ১৮৭৪ সালে আসাম পৃথক প্রদেশে রূপান্তরিত হওয়ার পর চট্টগ্রাম বনভূমি প্রশাসনিক দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে বহুমূল্যবান গাছের জন্য। এই বনভূমিকে বাঁশ গাছ, ঘাস জমি ও পার্বত্যখন্ডে ভেঙে নেওয়া হয়েছিল। 

উনিশ শতকের মধ্য ভাগে বাংলায় যখন রেলগাড়ি সম্প্রসারণসহ নানা কারণে বন সংরক্ষেণর ভাবনা-চিন্তা চলছিল, তখনই ভারতে অরণ্য সম্পর্কিত সর্বভারতীয় আইন পাশ হয় (১৮৬৩)। এই আইনের তিনটি বিষয় সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। 

প্রথমত, বৃহৎ বৃক্ষসমৃদ্ধ অরণ্য ও ঝোপজঙ্গলকে সরকারি বনাঞ্চলে রূপান্তরিত করা যাবে। তবে এই ব্যবস্থা করতে গিয়ে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর বনের উপর যে অধিকার প্রতিষ্ঠিত রয়েছে তা কেড়ে নেওয়া যাবে না। 

দ্বিতীয়ত, বন-সংরক্ষণের জন্য প্রদেশ-ভিত্তিক প্রয়োজনীয় আইন তৈরি করা যাবে। কিন্তু তা রূপায়িত করতে হবে সর্বভারতীয় আইনের প্রেক্ষিতে। তৃতীয়ত, আইন ভঙ্গকারীকে উপযুক্ত শাস্তিদান করা যাবে। 

ভারতে ঔপনিবেশিক সরকারের বন-নীতি স্পষ্ট রূপ পরিগ্রহ করতে শুরু করল, যা প্রযোজ্য হল বাংলা অঞ্চলেও। এর কিছুকাল পরে ঔপনিবেশিক ভারতে ১৮৬৫ ও ১৮৭৮ সালে যথাক্রমে ‘সুরক্ষিত’ ও ‘সংরক্ষিত’ অরণ্য আইন চালু হয়। প্রথম আইনে বিশেষ কিছু গাছ কাটা নিষিদ্ধ হলেও প্রয়োজনের জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ, পশু চরানো ও অন্যান্য সম্পদ আহরণের অধিকার বজায় ছিল। দ্বিতীয় আইনে উক্ত সব অধিকার ছিনিয়ে নিয়ে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণকে ব্যাপক করা হয়, গাছে কোপ মারাও অপরাধ হয়ে ওঠে। আগে জঙ্গলের পচা পাতা স্থানীয় কৃষিক্ষেত্রে সার হিসেবে ব্যবহৃত হতো; অধিকৃত হওয়ায় তা তো বন্ধ হলোই, এমনকি ফসল কাটার পর চষা জমিতে যে পশু চরিয়ে পশুমলে খেতের উর্বরতা বাড়ানো হতো, সেই মেষপালক ও রাখালদের অবাধে চলাফেরার অধিকারের উপরেও আইনি চাপ বাড়লো। অরণ্য, চারণভূমি আর সুস্থিত কৃষিব্যবস্থার মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগের ঐতিহ্য এভাবে ভেঙে পড়ে। স্থানীয় জনসাধারণ, যারা অভাবের সময়ে মূল খাদ্যশস্য ভাত পেতনা, তারা সম্পূরক খাদ্য পেত বনাঞ্চল থেকেই; মিটত পুষ্টির ঘাটতি। আগে চাষবাসে (Subsistence farming) উৎপাদিত ফসল ও পশুসম্পদ কৃষকের পরিবারের রক্ষণাবেক্ষণ করত। যা যৎসামান্য থেকে যেত, উদ্বৃত্ত রূপে পরের বছরের জন্য বা অপরকে বিক্রির জন্য। ঔপনিবেশিক শাসনে এই দীর্ঘ স্থাপিত ব্যবস্থাটাই নষ্ট হয়ে গেল। উনিশ শতকে রেলের যে সম্প্রসারণ ঘটেছিল, তা মূলতঃ ভারতের শস্য সম্পদ উপকূলীয় শহরে পরিবহনের জন্য। অর্থাৎ উপনিবেশ থেকে সাম্রাজ্যবাদী দেশে সবটাই চলে যেত। স্থানীয় প্রকৃতি-সমাজ-মানুষের মধ্যে সুষ্ঠু বিপাকীয় চক্রটি আর সম্পূর্ণ হয়নি। ফলে দেশের মানুষের অপুষ্টিতে ভোগা থামেনি, ১৮৭০ ও ১৮৯০ সালের দুর্ভিক্ষে মানবতার চরম অপমান ঘটে।  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *