তাপস সরকার

লেখক পরিচিতি 

( সৃজনশীল সাহিত্য কর্মে নিয়োজিত কিশোর  বয়স থেকেই। প্রথম পঠিত গ্রন্থ রামায়ণ, মহাভারত ও গীতা। গদ্যসাহিত্য ও উপন্যাসেই সাবলীল। যদিও শতাধিক গল্প ও দশ-বারোটি উপন্যাসের রচয়িতা কিন্তু সেসব হারিয়ে গেছে অপ্রীতিকর কারণে। প্রিয় বিষয় মহাকাশবিদ্যা। কল্পবিজ্ঞান ও কিশোর সাহিত্য প্রিয় লেখা।কিছু গল্প নব্বইয়ের দশকে বাণিজ্যিক ও অবাণিজ্যিক পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত। উন্মীলন নামে প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকায় নিজের গল্প ও দুটি উপন্যাস ছাপা হলেও সেই উদ্যোগ থেমে যায়।প্রতিভাস সাহিত্য ম্যাগাজিন চলছে পনের বছর যা মায়ের নামে। সেখানে মায়ের উদ্দেশ্যে নিবেদিত লেখা স্মৃতিচিত্রণ ও বেশ কিছু ছোটগল্প। নব্বইয়ের দশকে কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে কিছুদিন লিটল ম্যাগাজিন গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত থেকে জেলায় জেলায় সাহিত্য আসরে ঘোরাঘুরি। বিশ্বকে নিজের ঘর বলে ভাবতে অভ্যস্ত। মায়ের মৃত্যুর পর অবসাদে দীর্ঘদিন লেখায় বিরত। তারপর আবার লেখা শুরু কিশোর সাহিত্য ‘গাছবাড়ির বাসিন্দা ‘ দিয়ে। পাঁচ বছরের প্রচেষ্টায় কোভিড পরিস্থিতিতে লেখা ইংরেজি ভাষায় ‘ইটস মাই আইল্যান্ড ‘ প্রকাশের অপেক্ষায়। স্বউদ্যোগে প্রকাশিত একমাত্র উপন্যাস ‘অন্তরালোকে ‘ নিজের জীবনের এক বিশেষ অধ্যায় ও মাকে নিয়ে লেখা। ভারতীয় প্রাচীন দর্শনের ওপর একনিষ্ঠ বিশ্বাস ও আধুনিক প্রযুক্তির ওপর বিরক্তি  ‘অনন্ত জীবন ‘ উপন্যাসের পাতায় পাতায় প্রতিফলিত। পেশায় অর্থনীতি বিষয়ের অধ্যাপক। ) 

মূলাংশ       

(মরজগতে মানুষ চলেছে অমরত্বের সন্ধানে। অনাদি অতীত থেকে তার এই যাত্রারম্ভ। অনন্ত জীবন তারই এক প্রকাশ। তাই অমৃতের অধিকার নিয়ে সুরাসুরে এত অশান্তি, কারণ অমৃত নাকি অমর করে। অমরত্বের ব্যাখ্যা আবার দ্বিধাবিভক্ত, দৈহিক অমরত্ব এবং আধ্যাত্মিক অমরত্ব। দানব ও সর্বসাধারণ বোঝে প্রথম মতবাদটিকেই। কোনটি সঠিক? সবাই ছোটবেলায় হারিয়ে যায় মানুষের মেলাতে, সেখানে সে বন্ধু খুঁজে পায় যাকে সে তাকে হাত বাড়িয়ে দেয়, বোঝাতে চায় মানুষ ও বিশ্বজগতের উদ্দেশ্যবিধেয়। যে তাকে চেনে সে বোঝে সব। শৈবাঙ্কন আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর সভ্যতাকে অস্বীকার করে চলে যায় স্পিতি ভ্যালিতে। সেখানে সে আবিষ্কার করে সর্বজনীন ভাষা যাতে বাক্যালাপ চালাতো সনাতন মুনি-ঋষিরা কীটপতঙ্গ, পাহাড়-পর্বত, নদী-জঙ্গল, পাথর-প্রান্তর এবং অদৃশ্য দেবতাদের সঙ্গে। স্পিতি ভ্যালির পটভূমিকায় স্পিতি নদী ও প্রাকৃতিক উপাদানসমূহ এবং মানুষের সঙ্গে কথোপকথনে সে খুঁজতে থাকে অনন্ত জীবন বা অমরত্ত্বের ব্যাখ্যা। কী পেল সে শেষ পর্যন্ত ? )

অধ্যায় : উনিশ

সে দেখছিল সুবিপুল মহাকাশটাকে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ সে দেখতে পেল সুবিশাল এক আলোকমালার  উপস্থিতি, দেয়ালসদৃশ, এত প্রকাণ্ড বর্ণবৈচিত্র্যের সমাহার মহাবিশ্বের কোথাও আর নেই। সে জিজ্ঞেস করল, 

‘ওটা কী ?’

তার হতভম্ব প্রশ্নের উত্তরে কোটিকল্প জানাল,

‘ওটা তোদের জানা মহাবিশ্বের বৃহত্তম এক আশ্চর্য, নাম রাখা হয়েছে হারকিউলেস করোনা বোরিয়ালিস গ্রেট ওয়াল, বলা যায় একটা গ্যালাকটিক ফিলামেন্ট, সুবিশাল এক গ্যালাক্সি ক্লাস্টার, মহাকর্ষ বলে জুড়ে আছে একত্র। লম্বা কতটা জানিস ? হাজার কোটি আলোকবর্ষ। এমনিতে একটা গ্যালাক্সির বিস্তার এক হাজার আলোকবর্ষ থেকে কয়েক লক্ষ আলোকবর্ষ হতে পারে। আর নেব্যুলা বা নীহারিকার মেঘ হতে পারে বিস্তারে দশ থেকে একশ’ আলোকবর্ষ। আসব তাদের কথায় তারপর। সবচেয়ে দূরে একটা গ্যালাক্সির কথা জানা গেছে যার বারোশ’ আশি কোটি দূরত্ব এবং তাতে জলের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেছে। অতটা দূরে তার মধ্যে এমন তারকার সন্ধান পাওয়া গেছে যার জন্ম বিশ্ব সৃষ্টির একশ’ কোটি বছরের মধ্যেই, নাম রাখা হয়েছে ইয়ারেনডেল। জেনে রাখ্, ওই দূরত্বের প্রাচীনতম গ্যালাক্সির কথা যেখানে নিয়মিত তারকার জন্ম ঘটে চলেছে। এগুলি সবই মহাকাশের বিস্ময়। এমনই একটি হল মহাকাশের সর্বোচ্চ ভরসম্পন্ন বস্তুটি, কোয়াসার টল সিক্স ওয়ান এইট গ্যালাক্সির কেন্দ্রস্থল, এক ব্ল্যাক হোল, ডার্ক ম্যাটার, যেখানে লুকিয়ে আছে ছ’ হাজার ছ’শ কোটি সৌরভর বা সূর্যসমান বস্তুদেহের সমস্ত পদার্থ। এটিও এক পরম বিস্ময়। যেমন গ্রেট অ্যাট্রাক্টর বা মহা আকর্ষক। এটি ল্যানিয়াকিয়া গ্যালাক্সি সুপারক্লাস্টারের কেন্দ্র যেখানে মিল্কি ওয়ের সঙ্গে এক লক্ষ গ্যালাক্সির বসবাস। বলা হচ্ছে এটি হল ডার্ক এনার্জির সঙ্গমস্থল। অনেকে বলে, এটি অতিরিক্ত ঘনত্ব জমার ফল, অবিশ্বাস্য অভিকর্ষ বলসম্পন্ন অতিঘন বস্তুপিণ্ড থাকার কারণে। তেমনি এক বিস্ময় হল গ্লোবিউলার ক্লাস্টার, গ্যালাক্সি নয়, মহা তারকাপুঞ্জ যারা মহাকর্ষ বলের অধীনস্ত থেকে মিল্কি ওয়ের মত গ্যালাক্সিকেন্দ্র প্রদক্ষিণ করে এবং কম ভরসম্পন্ন। এর ভর এক লক্ষ সূর্যের সমান, মিল্কি ওয়ে যার তুলনায় এক কোটি বেশি ভর মজুত রেখেছে। গ্লোবিউলার ক্লাস্টারের তারকাগুলি খুবই কাছাকাছি পরস্পরের, সাধারণত সূর্য বা স্বাভাবিক তারকা অন্যদের চেয়ে তার পঞ্চাশ গুণ বেশি দূরে থাকে। এই অতি ঘনত্বে থাকার জন্য গ্লোবিউলার ক্লাস্টারে তারকারা গ্রহের জন্ম দিতে পারে না পারস্পরিক অত্যধিক বিকিরণের কারণে। এজন্যই এর কথা বলা। আরও বিস্ময়ের কথা ভাবা হয়েছে মহাকাশ ও মহাবিশ্ব গবেষণায়। তার একটি মাল্টিভার্স তত্ত্ব, একাধিক মহাবিশ্বের ধারণা। কত হতে পারে তার সংখ্যা ? একের পর একশ’ কোটি কোটি শূন্য বসলে যে সংখ্যা পাওয়া যাবে বলা হচ্ছে ততগুলি মহাবিশ্ব আছে আমাদের জানা এই মহাবিশ্বের সঙ্গে। এমন অনেক সম্ভাবনার মধ্যে আছে ওমনিভার্স, যা হল প্রত্যেকটি মহাবিশ্ব এবং  মাল্টিভার্স ও মেটাভার্সের এক সমন্বয়। হাইপারভার্স হল অত্যধিক মাত্রাবিশিষ্ট জগৎ যা এগারো মাত্রাসম্পন্ন জগতেরও উর্দ্ধে। এদের মধ্যে মাল্টিভার্স তত্ত্বই বহু আলোচিত যদিও তার কোন বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই। এখানে একগুচ্ছ সমান্তরাল মহাবিশ্বের সহ অবস্থানের কথা ভাবা হয়, স্থানিক অস্থায়ীভাবে, যারা একে অন্যের ওপর কোন প্রভাব ফেলে না বা ফেলতে পারে না, এমন অসংখ্য মহাবিশ্বের একটি সেট বা আর্কাইভ। যাবতীয় মহাজাগতিক রহস্যের কথাই তোকে শোনালাম ও দেখালাম। এবার আসব আসল প্রসঙ্গে।’  

এখানে সে কোটিকল্পকে থামিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করল,

‘কিন্তু আমি একটি বিষয় বুঝতে পারছি না। তুমি তো বললে এবং দেখতে পাচ্ছি আমিও মহাবিশ্বের বিস্তার, তেরোশ’ আশি কোটি আলোকবর্ষ দূরত্বে গিয়ে যার পরবর্তী সমস্তকিছু নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে চিরকালের জন্য, যার খবর এখন পর্যন্ত জানার কোন উপায় নেই। তবে কেন আমি আবার দেখতে পাচ্ছি এ মহাবিশ্বের যেকোন স্থানিক পর্যবেক্ষণ বিন্দুতে দাঁড়িয়ে যে কোন প্রান্তে মহাবিশ্ব চার হাজার ছ’শ পঁয়ষট্টি কোটি আলোকবর্ষ পর্যন্ত দৃশ্যমান বা আমার জানার সীমানাভুক্ত ?’

‘হুঁ,’ কোটিকল্প শান্তস্বরে বলতে লাগল, ‘প্রশ্নটা স্বাভাবিক। উত্তরটা কিন্তু একটু ভাবলে নিজেই বুঝতে পারবি। যত মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে ক্রমবর্ধমান গতিবেগে অবিরাম ততই দূরবর্তী ও প্রবীণতম আলোক উৎসগুলি যারা তেরোশ’ আশি কোটি বছর আগে আলো বিতরণ করে দিয়েছিল তারা এখন ওই পর্যবেক্ষণ বিন্দু থেকে ততটাই দূরে সরে গেছে ওই ক্রমবর্ধমান ত্বরণে যা চার হাজার ছ’শ পঁয়ষট্টি কোটি আলোকবর্ষ দূরত্ব। এটাই হল ওই রহস্যর উত্তর। কিন্তু এখন মূল প্রসঙ্গে আয়।’

‘সেটা কী ?’

‘মানুষের মেলা তুই দেখেছিস। জাদুজগতে জেনেছিস তাদের উদ্দেশ্যবিধেয়র কথা। প্রশ্ন হল, ব্রহ্ম জীব ছাড়া জড়বস্তুতেও থাকে। তাই প্রথিবীর জড়বস্তুগুলিকে কেবল নয়, গোটা ব্রহ্মাণ্ড জগৎটাকে ও তার সমস্ত বস্তুসমূহকে জাদুজগতে নিয়ে এসেছি। এবার এখানে দ্যাখ্ সমস্ত জড়বস্তুসমূহের মেলা। কিন্তু এখানে এখনও দেখা বাকি এই সমস্ত বস্তুসমূহ কেন জগৎজুড়ে মেলায় সামিল। কোন্ উদ্দেশ্য নিয়ে সবাই ঘুরে মরছে মেলাতে ? তাও তোকে জানতে হবে।’ 

‘সেটা জানাও। দেখাও।’

‘এখন সেই ব্যাপারটাই ঘটবে তোর চোখের সামনে। তুই মহাবিশ্বের প্রাথমিক ও মূল উপাদানগুলির জীবনযাপন ও আচার-আচরণ দেখতে পাবি। তারকাজগৎ অথবা গ্যালাক্সি নয়, তুই এখন দেখবি তারকাদের প্রত্যেককে, কারণ তারাই হল প্রাথমিক সদস্য যদিও তাদের গঠনকারী অতিক্ষুদ্র কণা প্রোটন, নিউট্রন ইত্যাদিরা রয়েছে আরও মূলে, তবুও অতটা গভীরে না গেলেও চলবে। গ্রহ-তারকাদের গতিবিধি ও জীবনধারণ দেখলেই হবে।’

তার সম্মুখে হাজির গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড, তা সত্ত্বেও বেশি মুখরিত  হয়ে উঠল একেকটি গ্যালাক্সির পরিমণ্ডল, বিশেষ করে, আকাশগঙ্গা বা মিল্কি ওয়ে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর চেহারা নিয়ে উপস্থিত হল চোখের সামনে। প্রত্যেকটি তারকা এবং তারকমণ্ডল যারা তাদের কুণ্ডলীপাকানো বাহুগুলি ছাড়াও হাজির ছিল গ্লোবিউলার ক্লাস্টারে, সবাইকে দেখা যাচ্ছিল পরিষ্কার। পৃথিবীর বুকে সে দেখেছে মানবজীবন ও মানবসভ্যতার বিবর্তন, মহাব্রহ্মাণ্ডে তাকে দেখানো হয়েছে সমগ্র বিশ্বজগৎটার বিবর্তন, আর এবার সে দেখবে তারকাদের বিবর্তন—- তারা কী বা কেমন জীবনযাপনে অভ্যস্ত। গ্যালাক্সির মধ্যে সে আরও অন্যকিছু দেখতে পেল। তারা ধীরগতিসম্পন্ন ও ঘূর্ণায়মান সুবিশাল মেঘমালা, অত্যধিক শীতল গ্যাস ও ধূলিকণায় পরিপূর্ণ, যাদের নাম নীহারিকা অথবা নেব্যুলা। একেকটি মেঘমালার ভর অকল্পনীয়, এক লক্ষ থেকে কুড়লক্ষ সৌরভরের সমান এবং ব্যাস বা বিস্তৃতি পঞ্চাশ থেকে তিনশ’ আলোকবর্ষ, যেখানে আলো বা ফোটন কণিকা এক বৎসরে দশ লক্ষ কোটি কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে পারে। কাছেই সে দেখতে পেল মনোরম বর্ণমালায় সুসজ্জিত অপূর্ব গাঠনিক কাঠামো অলংকৃত ত্রিবিধ উচ্চতাসম্পন্ন তিনটি অপুরূপ স্তম্ভ, তাকিয়ে রইল সে তাদের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে। তাকে এমন মুগ্ধ নির্বাক তাকিয়ে থাকতে দেখে কোটিকল্প জানাল, 

‘এরাই হল থ্রি পিলার্স অব ক্রিয়েশন, দৈত্যাকার হাইড্রোজেন গ্যাসের স্তম্ভসদৃশ মেঘ সুবিখ্যাত তারকাদের সূতিকাগার হিসেবে যেখানে প্রচুর তারকার জন্ম হয়ে চলেছে নিয়মিত। এদের একটি কালপুরুষ বা ওরিয়ন কনস্টেলেশন যা তারামণ্ডলে অবস্থিত নীহারিকা। এতটাই ভরসম্পন্ন এরা যে নিজস্ব অভিকর্ষের টানেই ধসে যেতে পারে যেকোন সময়। আসলে কী জানিস, নীহারিকারা প্রায় সবাই তারকাদের জন্মস্থান। বিপুল ভরের কারণে ধসে গিয়ে যখন মেঘপুঞ্জ সংকুচিত হতে থাকে, দ্যাখ্ না তা ঘটছে তোর চোখের সামনেই, তখন গ্যালাক্সির কুণ্ডলীপাকানো বাহু অতিক্রিম করে ওইসব মেঘমালা যেতে থাকলে গতি ধীর হওয়ার জন্য সংকোচন বেড়ে গিয়ে বহু তারকার জন্ম ঘটতে থাকে এবং সে কারণেই অধিকাংশ তারকার জন্ম হয় কুণ্ডলীপাকানো বাহুগুলির কাছেই। চল্, দেখতে থাক্ কালপুরুষ নীহারিকাকেই।’

তার পরামর্শক্রমে সে সেটাই করতে লাগল। দেখছিল সেখানে গ্যাস ও ধূলিকণার প্রকাণ্ড মেঘ সময়ের এগিয়ে চলার সাপেক্ষে, যেখানে সময় এগিয়ে যাচ্ছিল জাদুকাঠির ছোঁয়ায় দ্রুতলয়ে, কিভাবে সেই মেঘ সংকুচিত হয়ে ঘনত্বপ্রাপ্তি ঘটিয়ে উত্তপ্ত হয়ে যাচ্ছে। দেখা গেল প্রকাণ্ড মেঘেরা আবার ভেঙে টুকরো টুকরো ঝোপ বা ঝাড় সৃষ্টি করছে। সেইসব ঝাড়  নিজের অভিকর্ষজ আকর্ষণে আরও ছোট হয়ে চ্যাপটা বা সমতলীয় ডিস্কের আকৃতিতে পরিণত হচ্ছিল। প্রত্যেকটি ঝাড়ের কেন্দ্রস্থল সর্বশেষে তারকার চেহারা নেয় যার বাহ্যিক গ্যাস ও ধূলিকণার ঘনীভূত ডিস্ক গ্রহ-উপগ্রহের জন্মস্থানের ভ্রূণ। কালপুরুষের নীহারিকামণ্ডলে দেখা গেল নানা ধরনের প্রোটোস্টার বা প্রায় তারারা ঘেরা রয়েছে গ্যাস ও ধূলিকণার অন্ধকার ডিস্কের আবরণে। এই ডিস্কের ঘেরাটোপের নাম প্রোটোপ্ল্যানেটোরি ডিস্ক যার সবশেষ কেন্দ্রীয় তারকাটির চারপাশে গ্রহ সৃষ্টি করতে পারে। সংকোচিত হতে থাকা মেঘের ঝাড় উত্তপ্ত হতে থাকলে কেন্দ্রে সৃষ্টি হচ্ছিল প্রোটোস্টার যা গ্যাসের ঘন বর্তুলাকৃতি বল যার কেন্দ্র তখনও ততটা উত্তপ্ত নয় বলে পারমাণবিক বিক্রিয়া শুরু হয়নি। এই প্রায় তারাই হল তারকার ভ্রূণ, জানাল কোটিকল্প। মোটামুটি পাঁচ কোটি বছর কেটে গেল এই কাজে  যে সময়ে অভিকর্ষজ টানে আভ্যন্তরীণ ধসে যাওয়া চলতেই থাকে যাতে প্রায় তারাটির ভর বেড়েই যায় ক্রমান্বয়ে এবং তার ফলে আরও চাপ বৃদ্ধির কারণে সংকোচন বস্তুটিকে আরও ঘনীভূত করে তাপমাত্রা বাড়িয়েই দিতে থাকে। শেষে সে কেন্দ্রস্থলকে দেখতে পেল এত পরিমাণ মহাভরসম্পন্ন যে তাপমাত্রা বেড়ে হয়ে গেল এক কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াস। তখন দেখা গেল তারকাটির কোর অঞ্চলে চালু হয়েছে পারমাণবিক বিক্রিয়া। প্রায় তারা এবার হয়ে গেল প্রকৃত তারা, হল তখন সত্যি এক তারকার জন্ম। ওরিয়ন বা কালপুরুষ নীহারিকা ও তারাজগৎ নতুন তারকার জন্মদানের একটি মূল কেন্দ্র, আর এই ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য দেখা গেল আরেকটি অঞ্চল করোনা অস্ট্রেলিয়াস নামে যার কেন্দ্র উজ্জ্বল করে ছিল করোনা ক্লাস্টার। দেখা গেল এটিও পৃথিবীর কাছাকাছি তারকাসৃষ্টির একটি সক্রিয় সূতিকাগার। তার কেন্দ্রেও দেখা যাচ্ছিল শিশু ও নবীন তারকাদের ঘিরে থাকা গ্যাস ও ধূলিকণার চিত্রবিচিত্র বিবরণ। করোনেট ক্লাস্টার পরিপূর্ণ নানা বয়সী নবীন তারকার  মেলাতে। তারা হিসেবে জন্ম নিল যে সে কী করে ? তাও সে দেখতে পাচ্ছিল চোখের সামনেই। শিশু বা যুবক তারকার অভ্যন্তরে শুরু হয় পারমাণবিক বিক্রিয়া, ফিউশন বা তাপ সংযোজন প্রক্রিয়াতে হাইড্রোজেন পরমাণুরা একে অন্যের সঙ্গে জুড়ে বা সেঁটে গিয়ে হিলিয়াম উৎপন্ন করতে থাকে আর তার ফলে প্রবল তাপ ও আলো তৈরি হয়ে বিকীর্ণ হতে থাকে অনন্ত মহাকাশে এবং ছড়িয়ে যেতে থাকে অনন্ত যাত্রায় আর এভাবে শক্তি কেন্দ্র থেকে উৎপন্ন হয়ে বেরিয়ে আসার প্রক্রিয়াতে তারকাটির কেন্দ্রাভিমুখী সংকোচন বলে বাধা দেয়। তারকার তাপ ও আলো বিকিরণের ধাক্কায় তাকে ঘিরে রাখা গ্যাস ও ধুলোর ডিস্ক ধীরে ধীরে হাওয়া হয়ে উৎক্ষিপ্ত হতে থাকে মহাকাশে, থেকে যায় কেবল গ্রহ-উপগ্রহ যদি তারা গঠিত হতে পারে। শোনাল আর দেখাল তাকে বিষয়টি কোটিকল্প। সৌরঝড়ে সূর্যও এভাবে তার বস্তুকণা হারাতে থাকে স্টেলার উইন্ড তারকাবায়ু হিসেবে যেমন তা ঘটে অন্য তারকাদের ক্ষেত্রেও। সে দেখল, মিল্কি ওয়ের নিকটতম লার্জ ম্যাগেলানিক ক্লাউড গ্যালাক্সিতে উত্তপ্ত নবীন তারকাদের জন্ম উজ্জ্বল গ্যাস ও কৃষ্ণকায় ধূলিকণার মেঘ থেকে। এই গ্যালাক্সিটির বাঁ দিকের উর্ধাংশে দেখা গেল একগুচ্ছ নীল শ্বেতকায় নবীন তারকা, সবাই অসম্ভব উত্তপ্ত এবং তাদের মধ্যে কিছু মহাবিশ্বের অতিকায়তম তারা। 

‘তারকাদের জন্মের কাহিনী তো দেখলি এবং জানলি। এবার শোন্ তাদের জীবনকাহিনী বা জীবনযাপনের গল্প। মূল জীবনপর্যায়কাল হল শৈশব থেকে বার্ধক্য, তার ভিন্ন ভিন্ন চেহারা, ভিন্ন বিবর্তনের ধারা ও জীবনকাল। এই বিভিন্নতার কারণ তাদের ভিন্ন ভিন্ন ভর এবং জানবি তাদের বেঁচে থাকার সময়সীমা ভরের ওপরই নির্ভরশীল। এবার তোকে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা জানাই। এই যে তারকা, জড়পিণ্ড, এর মধ্যে কি তুই ব্রহ্মের প্রকাশ ঘটতে দেখলি ? জীবধর্ম বা তদ্রূপ আচরণ দেখতে পেলি ?’

‘বুঝতে পারলাম না ঠিক।’

‘বুঝতে পারলি না ?’ কোটিকল্পের গলায় বিস্ময়, ‘সেকিরে! এত স্পষ্ট বিষয়টা বুঝতে পারলি না ? তুই দেখতে পেলি না তারকার জন্মগ্রহণ করার কী প্রবল আকাঙ্খা ? তার জন্য কত কাণ্ড করল সে, কত ঘটনা ঘটাল। নিজেকে নিজে প্রবল টানে ভেঙেচুরে ধস ঘটিয়ে ঘন থেকে ঘনতর হয়ে মহাউত্তপ্ত কামনা অন্তরে পোষণ করে অন্তস্থলের কণাসমূহকে মিলন ঘটিয়ে জুড়ে দিয়ে লেপ্টে দিয়ে জন্ম ঘটাল নিজের। এর মধ্যে তুই তার জন্ম নেওয়ার প্রবল আর্তি দেখতে পেলি না ? এখন থেকে খেয়াল রাখবি, রাখলে দেখতে পাবি তার মধ্যে বেঁচে থাকার এবং দীর্ঘায়ু হওয়ার সেই একই প্রবল আর্তি একইভাবে বিদ্যমান। বিশ্বজগতের নব্বই শতাংশ তারকা সূর্যের মত যাদের নাম মেইন সিক্যুয়েন্স স্টার। তারা কী করে দ্যাখ্।’

কোটিকল্পের পরামর্শ অনুসরণ করে সে এবার দেখল তারকার অন্তর, তার কেন্দ্রস্থলের পরিবর্তে। সে দেখতে পেল নিউক্লিয়ার ফিউশন তার অন্তর্দহন ঘটিয়ে তার জন্মের লগ্ন থেকে তাকে বেঁচে থাকার রসদ যোগান দিচ্ছে। সে মেইন সিক্যুয়েন্স স্টার, তার অন্তরের বেঁচে থাকার আগ্রহ বা জ্বালা হাইড্রোজেনকে প্রবল তাপমাত্রায় গলিয়ে হিলিয়ামে পরিণত করে তাকে এনার্জি বা শক্তি উপহার দিচ্ছে যা জীবনধারণের জন্য অবশ্য দরকার, যা থেকে সে পায় আলো ও উত্তাপ বেঁচে থাকার প্রমাণস্বরূপ। জীবনের বেশির ভাগ সময়টা এভাবেই অতিবাহিত করে এমনই সব লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি তারার দল। তবুও তারা সবাই এক নয়, ভিন্ন ভিন্ন চরিত্র তাদের, ভিন্ন বেঁচেবর্তে থাকার পদ্ধতি ও জীবনকাল। তাদের ভিন্ন ভিন্ন ভর, সেটা কতটা হবে তা নির্ভর করে জন্মকালে নীহারিকা থেকে সে কতটা প্রাণশক্তি পরিমাপক সম্পদ করায়ত্ত করতে পারে, তার ওপর। আয়তনে মেইন সিক্যুয়েন্স তারারা সূর্যের এক দশমাংশ থেকে দু’শ গুণ বেশি ভর পেতে পারে বা হতে পারে তার সমান ভরের। তাদের রংরূপও বিভিন্ন। ভরের বিচারেও তাদের অনেকেই সূর্যের এক দশমাংশ থেকে দু’শ গুণ। তাদের পৃষ্ঠতলের তাপমাত্রা নির্ধারণ করে তাদের গায়ের রং। রক্তিম বর্ণ তারকাদের উপরিতলের তাপমাত্রা তিন হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস, সর্বাধিক প্রায় ত্রিশ হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে গায়ের রং নীল হয়ে যায়। পৃষ্ঠতলের তাপমাত্রা অনুযায়ী অন্য সব বর্ণবৈচিত্র্য এরকম—- চার হাজার পাঁচশ’ সেলসিয়াস হলে কমলা, ছ’ হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে হলদে, দশ হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে সাদা এবং চল্লিশ হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস মানে নীল। সাধারণ নিয়মে লাল হলে গরম ও নীল হলে ঠাণ্ডা বোঝায়, তারাদের ক্ষেত্রে নিয়মটি উল্টো—- এখানে যত নীল তত বেশি উষ্ণতা, যত লাল তত শীতল ও বয়স্ক। নীল রং মানে ছোট দৈর্ঘ্যসম্পন্ন আলোর ঢেউ যা উচ্চ কম্পাঙ্কযুক্ত এবং তাতে থাকে বেশি শক্তি ও তাপমাত্রার প্রকাশ। সূর্যের এক দশমাংশ ভরের তারারা লাল বামন বা রেড ডোয়ার্ফ, অন্যদিকে বিশাল নীল বামন তারাদের আছে সূর্যের চেয়ে আটগুণ বেশি ভর, আর সূর্য নিজে হলদে বামন। কালপুরুষ তারামণ্ডলে সে দেখতে পেল ওরিয়নের কাঁধে বেটেলজিউস তারকাকে, যা বিশালদেহী ও রক্তিম বর্ণের। অথচ সেখানেই থাকা রিগেল নীলবর্ণ হওয়ায় বেশি উত্তপ্ত তার পৃষ্ঠতল। কোটিকল্প জানাতে লাগল,    

‘মেইন সিক্যুয়েন্স স্টারদের জীবনকাল নির্ভর করে তার আকার-আয়তনের ওপর। বেশি বড় তারকা জীবনের পর্যায় দ্রুত পার করে কম বড় তারাদের তুলনায়। বেশি ভর যে তারাদের তাদের তাপমাত্রাও অত্যন্ত বেশি হয় আর তাই তাদের বেঁচে থাকার সময় তুলনামূলকভাবে কম, খুবই দ্রুত তারা তাদের দেহে থাকা রসদ শেষ করে মৃত্যুর দিকে ঢলে পড়ে। সঞ্চয়ভাণ্ডারে প্রচুর খাদ্য থাকলেও বেশি তাপমাত্রার জন্য তাদের প্রচণ্ড খিদে, সব খেয়ে শেষ করে দেয় খুব কম সময়ের মধ্যে। সূর্যের মত ভরসম্পন্ন তারার জীবনকাল হাজার কোটি বছর, কিন্তু তার চেয়ে দশগুণ বড় তারা বেঁচে থাকবে মাত্র দু’ হাজার কোটি বছর, দশ হাজার কোটি বছর নয়। আবার একটি লাল বামন তারার ভর সূর্যের এক-দশমাংশ হলেও সে বেঁচে থাকবে আট থেকে দশ হাজার কোটি বছর, এমনই সব মজার কাণ্ড। তারকার সঞ্চয়কেন্দ্রে হাইড্রোজেন জ্বালানি শেষ হলে কোর অঞ্চল কুঞ্চিত ও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, কিন্তু তার বাহ্যিক আবহমণ্ডলে বা আবরণে তখনও হাইড্রোজেন মজুত থাকার জন্য তার দহন তারকাটির আয়তন বাড়িয়ে দিতে থাকে। তার আকার ও ঔজ্জ্বল্য দু’টি বেড়ে যায় এবং পাশাপাশি পৃষ্ঠতলের তাপমাত্রা কমতে থাকার জন্য সেটি রক্তবর্ণ ধারণ করে। আকারে সুবৃহৎ এই রক্তিম তারকার নাম রেড জায়ান্ট বা লাল দানব। যেমন, বেটেলজিউস। তাকিয়ে দ্যাখ্ তাকে আর দ্যাখ্ মিল্কি ওয়ের একটি ক্লাস্টারে রয়েছে লক্ষ লক্ষ এমন রক্তিম ও বৃদ্ধ তারা। এটিরই নাম গ্লোবিউলার ক্লাস্টার, আগেই বলেছি এর কথা, তাকিয়ে দ্যাখ্।’ 

সে দেখল গ্লোবিউলার ক্লাস্টারকে, যেখানে লক্ষ লক্ষ তারা বিরাজমান, রক্তিম বর্ণ আর বিশাল দেহ প্রায় সবার। সবারই বয়স অবশ্যই হাজার থেকে দেড় হাজার কোটি বছর হতে বাধ্য। সেই হিসেবে তাদের মধ্যবয়স পেরিয়ে গেছে এবং প্রৌঢ়ত্বের পর তারা বার্ধক্যে উপনীত। তারপর সে দেখতে পেল, তারাদের অন্তরে তবুও বেঁচে থাকার প্রবল ইচ্ছে এবং জীবন শেষ হওয়ার আগে সেই ইচ্ছের প্রবল চাপ ও তাপ তার ভিতরে আবার তৈরি করে উত্তপ্ত পরিবেশ। দীর্ঘায়ু লাভের প্রবল বাসনার তাড়নায় আবার সে অন্তরের গভীরে তাপসংযোজন প্রক্রিয়া ঘটাবার উপযুক্ত পরিস্থিতি নিয়ে আসে এবং শুরু করে আবার পারমাণবিক বিক্রিয়া। এই জীবনের প্রচণ্ড উত্তাপ তার অন্তস্থলের হিলিয়াম পরমাণুদের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটায় এবং তাদের সংযোজিত করে জন্ম দেয় আরও ভারী পদার্থ কার্বন ও অক্সিজেন। তার জীবনকাল এভাবে আরও বেড়ে যায় যতদিন হিলিয়াম জ্বালানি বা রসদ মজুত থাকে। একসময় সেই জ্বালানি ফুরোলে তার ভাগ্যে কী ঘটবে শেষপর্যন্ত তা নির্ভর করে তার ভরের ওপর, জানাল কোটিকল্প। 

‘সূর্যসমান মধ্যমানের তারাদের জীবনীশক্তি এখানেই ফুরিয়ে যায়। আরও বেঁচে থাকার ইচ্ছে থাকলেও ক্ষমতায় কুলোয় না। তারা আর পারে না তাদের অভ্যন্তরে আবার পারমাণবিক বিক্রিয়া শুরু করতে যাতে কার্বন ও অক্সিজেনকে আবার জুড়ে দিতে দিতে আরও ভারী পদার্থ বানাবার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তারা আরও বেশিদিন বেঁচে থাকতে পারে। তাদের বিবর্তন থেমে যায় এখানেই। লাল দানব পর্যায়কাল পেরিয়ে তারাটি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। এভাবেই আরও পাঁচশ’ কোটি বছর পর সূর্য হয়ে যাবে লাল দানব এবং পৃথিবীকে গ্রাস করে তারপর একদিন সে মৃত তারায় পরিণত হবে।’

দেখছিল সে তারাদের জীবনযাপন, তাদের বেঁচে থাকার ও দীর্ঘায়ু হওয়ার আগ্রহ ও কার্যকলাপ। কোন অংশেই তা মানুষ ও জীবকুলের তুলনায় ভিন্ন নয়। সে বুঝল, সত্যিই বিশ্বজগতে সবারই প্রধান লক্ষ্য নিজেকে টিকিয়ে রাখা যতদিন  পারা যায়। কোটিকল্প বলল, 

‘এবার দ্যাখ্, তারাদের মৃত্যু। এখানেও তুই দেখবি একই সুর বর্তমান।’ 

সে দেখল জীবনের শেষ পর্বে উপনীত লাল দানবদের, তাদের দেহ বারবার প্রসারিত ও সংকুচিত হয়ে চলেছে। দৈহিক অবয়বে অস্থিতিশীলতা, আর এই ক্রমাগত প্রসারণ ও সংকোচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বহিঃস্তরের সমস্ত গ্যাস বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। তারপর তার কোর অঞ্চল বা অন্তরের চারপাশে তৈরি হয় এক প্রসারিত খোলস যাকে প্ল্যানেটোরি নেব্যুলা বা নীহারিকা বলা হয়। অন্তরের নির্গত শক্তি শুষে নিয়ে এটি এক মনোরম দ্যুতিময় অঞ্চল সৃষ্টি করে। দেখতে গ্রহাকৃতি বলে এই নাম যা কিছু তারার অন্তিম পরিণতি। এমন কিছু উদাহরণ হিসেবে সে দেখল বর্ণবৈচিত্র্যময় রিঙ নেব্যুলাকে। এছাড়াও অপরূপ দৃশ্য রচনা করে থাকতে দেখল ব্যুমেরাং, ডাম্বেল, বাটারফ্লাই, হেলিক্স নেব্যুলাগুলিকে। কখনো বাইরের খোল মহাকাশে হারিয়ে যাওয়ার সময় অন্তস্থলের জ্বালানিও ফুরিয়ে যায় এবং তারাটি তখন মরতে থাকে। সেই মৃত্যুর কান্না সে দেখতে পাচ্ছিল। তখন কেন্দ্রাভিমুখী আকর্ষণে তারার গোটা দেহটিকে সে দেখছিল নিজের মধ্যেই ধসে যেতে। এভাবে সে গুটিয়ে আকারে হয় প্রথিবীর মত যাতে থাকে অবিশ্বাস্য ঘনত্ব। এরই নাম শ্বেত বামন বা হোয়াইট ডোয়ার্ফ। হেলিক্স নেব্যুলার এভাবেই জ্বালানি ফুরিয়ে তার গোটা দেহকে সংকোচিত করে গড়ে তুলেছে এক শ্বেত বামন যা অত্যন্ত ঘন ও উত্তপ্ত। এতটাই সে উত্তপ্ত মৃত্যুশোকে যে তার রয়েছে চোখধাঁধানো শুভ্রতা, অন্তরের তাপ অথবা পরিতাপ আরও প্রবল। সিরিয়াস বা লুব্ধক তারকার মৃতদেহ আকারে দেখা গেল প্রথিবীর চেয়েও ছোট, নেই অভ্যন্তরে পারমাণবিক বিক্রিয়া, উত্তাপ ও আলো হিসেবে নির্গত হয় দেহের অবশিষ্ট শক্তি। কালক্রমে তাও একদিন শেষ হবে, তার আর তখন নিজেকে দেখাবারও ক্ষমতা থাকবে না। দৈহিক সমস্ত শক্তি নিঃশেষিত হলে তারাটি নিভে যায় ও কালো বামন হয়ে থেকে যায় চিরকাল। শ্বেত বামন অবস্থা হল তারকার মৃত্যুর আগের দশা, তখন তার ঘনত্ব এত বেশি যে এক চামচ তারকাদ্রব্যের ওজন হবে এক লক্ষ কিলোগ্রাম, বার্ধক্য ও মৃত্যুর করাল গ্রাস তাকে এমনই ভারাক্রান্ত করে দেয়। সূর্যও এভাবেই মরে যাবে পাঁচশ’ কোটি বছর পর যদিও সে এখন মধ্যবয়সী। বার্ধক্যে এলে সে হবে লাল দানব এবং পৃথিবীকে গ্রাস করে পরিণত হবে প্ল্যানেটোরি নেব্যুলাতে। তারপর শ্বেত বামন হিসেবে মৃত্যুর  পর থেকে যাবে, সব আলো নিভিয়ে হয়ে যাবে একদিন কালো বামন বা ব্ল্যাক ডোয়ার্ফ। তার অর্থ, প্ল্যানেটোরি নেব্যুলা হল বৃদ্ধ তারার বহিরঙ্গের গ্যাসের খোলস। নেব্যুলা থেকেই যার জন্ম নেব্যুলা হয়েই তার মৃত্যু। শিশু ও বৃদ্ধের একই দশা। 

‘সূর্যসমান তারাদের শেষ পরিণতি দেখলি। সব তারার মৃত্যু কিন্তু একরকম নয়। বিভিন্ন তারার মৃত্যু হয় বিভিন্ন উপায়ে। সূর্যের চেয়ে বড় যেসব তারা তাদের মৃত্যুটা কেমন দ্যাখ্ এবার। এই যে তারকা, এর ভর সূর্যের তুলনায় আটগুণ বেশি। দ্যাখ্, কিভাবে তার মৃত্যু হয়।’ 

কোটিকল্পের কথা শেষ হলে সে তারকাটিকে দেখতে লাগল। তার অন্তর বা কোর অঞ্চলের হাইড্রোজেন জ্বালানি শেষ। সে এবার স্ফীতকায় লাল সুপারজায়ান্ট। এই অবস্থায় সে দীর্ঘায়ু হওয়ার প্রবল বাসনায় সমস্ত শক্তি একত্রিত করে যেভাবেই হোক পারমাণবিক বিক্রিয়া সচল রাখল এবং তাপ সংযোজন প্রক্রিয়াতে ভারী থেকে ভারীতর পদার্থ বানাতে বানাতে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে যতক্ষণ না তার অভ্যন্তর লোহাতে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। এরপর তার ক্ষমতা থাকল না আরও পারমাণবিক বিক্রিয়া চালিয়ে যাওয়ার। এবার সে নিজস্ব অভিকর্ষের টানে নিজের মধ্যেই দ্রুত ভেঙেচুরে  ধসে গেল। ধসতে থাকা বাইরের খোল এতো প্রবল আঘাত করল ছোট কেন্দ্রীয় কোরকে যে তার প্রত্যাঘাতে বাইরের স্তর ভেঙে গেল প্রবল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে। সেই মহা বিস্ফোরণের প্রচণ্ড আলোয় আলোকিত হয়ে থাকল চারপাশ এবং এরই নাম সুপারনোভা। তারার অন্তর্গত পদার্থ এভাবে প্ল্যানেটোরি নেব্যুলা বা সুপারনোভার প্রকারে নিজের মৃত্যু ঘোষণা করে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে উড়ে গেল মহাকাশে। এই স্টারডাস্ট রিসাইকেল হয়ে আবার নতুন প্রজন্ম তারকার জন্ম দিতে কাজে লাগবে। ক্র্যাব নেব্যুলাতে সে দেখতে পেল দৈত্যাকার উজ্জ্বল গ্যাসের মেঘ যা হল বহিরঙ্গে সুপারনোভার অবশেষ। তার কেন্দ্রে দেখা গেল ঘূর্ণায়মান একটি নিউট্রন তারকা। হাজার বছর আগে জাপান ও চীনের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা ক্র্যাব নেব্যুলাতে এই সুপারনোভা বিস্ফোরণকে দেখেছিল।   

‘সেটা হাজার চুয়ান্ন সাল। সপ্তাহখানেকের বেশি সময় ধরে সেই মহা বিস্ফোরণের আলো গ্যালাক্সির আর সমস্ত আলোকে ম্লান করে রেখেছিল। দিনের বেলাতেও দেখা যাচ্ছিল তাকে।’

জানাল কোটিকল্প। তারপর সে যোগ করল,

‘সুপারনোভা বিস্ফোরণে নিজের মৃত্যু ঘটিয়ে তারাটির কেন্দ্রস্থল ভরে যায় নিউট্রনে এবং এভাবেই তার মৃতদেহ হয় নিউট্রন তারকা। আর যদি আরও বড় হয় তারাটির আয়তন তো মৃত্যুর পর সে হয়ে যায় ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণ গহ্বর। প্রসারিত খুবই উত্তপ্ত গ্যাসের মেঘ ঘিরে রাখে ব্ল্যাক হোল বা নিউট্রন তারাকে।’

তারাদের মৃত্যু দেখে তাদের বড়োই অসহায় মনে হচ্ছিল। সে বুঝল, মৃত্যু জগতের অনিবার্য পরিস্থিতি। তার হাত থেকে রেহাই পাওয়ার কথা ভাবছে কে ? সে জীব ও জড় কাউকেই ছেড়ে দেয় না। কিন্তু তারারা কি জড় ? তার এখন দৃষ্টিকোণ পাল্টে গেছে। সে জেনেছে, তারাদেরও প্রাণ রয়েছে। এ বড়োই আশ্চর্যের কথা। জগতের এমন চেহারা সে এতদিন জানত না। কোটিকল্প জানাল,

‘উনিশশ’ সাতাশি সালে এমনই এক সুপারনোভা বিস্ফোরণ দেখা যায় লার্জ ম্যাগেলানিক ক্লাউড গ্যালাক্সিতে যা এক লক্ষ আটষট্টি হাজার আলোকবর্ষ দূরে। বিস্ফোরণটি হয় এক লক্ষ ছেষট্টি হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দে যার কথা আলোর মাধ্যমে পৃথিবীতে এসে যায় পঁচিশ বছরের মধ্যে। তার বাইরের স্তর সুদৃশ্য রিঙের মত শোভিত। ষোলশ’ চার সালে বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ জোহান্স কেপলার ওই গ্যালাক্সিতেই এমনই আরেক সুপারনোভা বিস্ফোরণ দেখে ভেবেছিলেন বুঝি তা কোন নতুন তারকার জন্ম। তা যে আসলে তারকার মৃত্যু তা তিনি জানতেন না।’

বিশ্বজগৎটাকে সে চিনল এতদিনে অন্যভাবে। এতো রহস্য রয়েছে তার অঙ্গে অঙ্গে বুঝবে কে ? সে জিজ্ঞেস করল,

‘জীবন তাহলে বিশ্বজগতের সর্বত্রই নানারূপে প্রকাশিত ?’

‘আর সেই জীবনের মূল লক্ষ্য বেঁচে থাকা যার আনুষঙ্গিক আকাঙ্খা হল দীর্ঘায়ু লাভ। জীব ও জড় বস্তুর মধ্যে এই উদ্দেশ্য সমানভাবে উপস্থিত। ব্রহ্ম এভাবেই সর্বভূতে বিরাজমান। যে তা বুঝতে পারে সেই প্রকৃত জ্ঞানী।’

কোটিকল্পের ব্যাখ্যার জবাবে সে প্রশ্ন তুলল,

‘কিন্তু সেই দীর্ঘায়ু তো সীমায়িত ?’

‘অবশ্যই। অমরত্ব মানে অনাদিকাল নয়, তার সীমা থাকতে বাধ্য।অনন্ত জীবন মানেও তাই, কখনোই তা তেরোশ’ আশি কোটি বছরের বেশি নয় এখন পর্যন্ত যেহেতু বিশ্বজগতের বয়সও তাই। পৃথিবীতে থাকলে কোন জীব বা জড়ের বয়স হাজার কোটি বছরের বেশি হবে না, কারণ সূর্যের জীবনকাল ততটাই। আর পৃথিবীর কেউ যদি আজ থেকে অনন্ত জীবনের অধিকারী হয়ও সে বড়জোর বাঁচবে পাঁচশ’ কোটি বছর, কারণ সূর্যও বেঁচে থাকবে ততদিনই।’ 

তার এখন বুঝতে কোন সমস্যাই হল না কী জীবনের লক্ষ্য এবং জীব ও জড় নির্বিশেষে কেন কিভাবে ধাবমান আপন উদ্দেশ্যসাধনে। কোটিকল্প জানাল, 

‘জানবি কোন তত্ত্ব বা মতবাদই চূড়ান্ত নয়, কোন জ্ঞানই চিরস্থায়ী হতে পারে না। যে বিশ্বজগৎ দেখলি এতক্ষণ, যে নিয়মে দেখলি তার চলাচল তাকেও তুই ভাববি না চিরকালীন সত্য। জীব আর জড়, সবাই দেখলি বেঁচে থাকতে চায় অনাদিকাল। সেই অনাদিকালের কোন স্পষ্ট প্রকাশ নেই। মানুষ বাঁচে হয়তো একশ’ বছর, তারকার বেঁচে থাকা হাজার কোটি বছর।মানুষের তুলনায় তারকার জীবনকাল কতটা বিপুল ভেবে দ্যাখ্। তবুও তারকারা অনন্ত জীবনের অধিকারী বলা যায় না। দেখলি মৃত্যু তাদেরও অনিবার্য পরিণতি। সেই তুলনায় মানুষের দীর্ঘজীবন অথবা অমরত্ব লাভের চিন্তা হাস্যকর নয় কি ? তবুও মানুষ অমরত্ব লাভের মোহে ব্যতিব্যস্ত। কিন্তু তার কি কোন যুক্তি আছে ? অমরত্ব বলে কিছু হতে পারে না, চিরস্থায়ী হওয়াকে বোঝায় তা। কিন্তু দেখলি তুই, চিরস্থায়ী হয় না কিছুই জগতে। হ্যাঁ, অনন্ত জীবন তবুও তুই ভাবতে পারিস, কিন্তু সেই অনন্ত মানে সীমাহীন কোন ধারণা নয়। অনন্ত মানে যার অন্ত তুই দেখতে পাচ্ছিস না, কিন্তু তারও অন্ত আছে। তুই দেখলি খানিকটা, তোর চেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তি দেখল আরও একটু বেশি, অন্য কেউ আরও একটু, কিন্তু তবুও তার অন্ত খুঁজে পাবে না কেউ, তল পাবে না কেউ পার্থিব জ্ঞানের নিরীখে, তার জন্য চাই বিশেষ চোখ, অন্য অতিরিক্ত মাত্রাধীন প্রাপ্ত অনুভূতি বা উপলব্ধি বা অন্য বিশেষ ইন্দ্রিয়জাত দর্শন। সেই ইন্দ্রিয় মানুষের নেই, থাকতে পারে অন্য প্রাণিকুলের, সে হতে পারে যাকে তোরা বলিস দেবতা, অন্য একাধিক ইন্দ্রিয় থাকা তাদের ক্ষেত্রে বিচিত্র নয়। তারা দেখবে অনেক দূর, প্রকৃতির অনেক দৃশ্যাবলী যা মানুষের ধারণাতেও নেই, দেখা বা জানা তো দূরের কথা। সে তোকে কী বোঝাবে ? তুই কি ঘোড়াকে বোঝাতে পারবি বর্ণমালা বা বইপুস্তক ? পিঁপড়েকে পিকাসোর চিত্র, ক্যাঙারুকে ম্যাজিক রিয়্যালিজম বা জলহস্তিকে কোয়ান্টাম ফিজিক্সের তত্ত্বসমূহ বোঝাতে পারবি তুই ?’ 

কোটিকল্প থেমে গিয়ে তার প্রতিক্রিয়া শুনতে চাইল। সে নিরুত্তর দেখে প্রশ্ন করল,

‘তাহলে বুঝলি কি অনন্ত জীবন বা অমরত্ব কাকে বলে ?’

‘বুঝলাম।’

‘কী বুঝলি ?’

‘বুঝলাম, অনন্ত জীবন বা অমরত্বকে সময় বা জীবনকাল দিয়ে মাপা যায় না। সে এমন এক ধারণা যা কাল নিরপেক্ষ।’

(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *