তপোপ্রিয়

অপ্রতিভ কুয়াশায়

কেউ বুঝতে চায় না। এই শোকাতুর বিবশতা, আমার এমন অকূল শূন্যতা, অন্তঃস্থলের এই বোবা কান্না, ধিকি ধিকি তুষের আগুন।

চারপাশে অনুল্লেখ্য বলয়াকৃতি গণ্ডিতে আবদ্ধ যাদের উপস্থিতি তারা বর্তমানে এমনই সম্পৃক্ত যে অতীত আর ভবিষ্যতের প্রয়োজনীয়তা ভুলে যেতে হয়। ছোট ছোট স্বার্থ আর আত্মপ্রচারের গন্ডিগুলি সংকীর্ণ থেকে সংকীর্ণতর হয়ে উঠতে থাকে।

মাতৃবিয়োগের শোকাতুরতা প্রকাশ করতে গেলে তাদের চোখের ভঙ্গিমা আমাকে অপ্রস্তুত করে দেয়। আমাকে ঘিরে রাখা জনসমাজকে দেখে তখন মনে হয় আমি নিতান্ত অসামাজিক। বাধ্য হয়ে আমাকে ক্রমশ অন্তর্লীন করে তোলা ছাড়া আর তো কোন উপায় নেই।

অথচ আমার এই শোকাতুরতা আমার কাছে কী ভীষণ স্বাভাবিক! বলয়াকীর্ণ যে জগত আমাকে ঘিরে থাকে তার অস্তিত্ব কেমন মিথ্যে লাগে। তারা শোক-দুঃখ-বিষাদ ভুলে থাকতে উন্মুখ, ভুলিয়ে দিতে চায়। এক অতিরঞ্জিত বাস্তবতার কুহক জড়িয়ে থাকে জগতের আপাদমস্তকে। এই নিষ্ঠুরতার নিষ্পেষণে আমি আখ-মারাই হতে থাকি।

সপ্রতিভ জগতের কাছে যতই তুচ্ছ হোক না কেন, ভূমিকা কিছু না থাকলেও আমি কখনো ভুলতে পারি না আমার মায়ের করুণ দুটি চোখের প্রকাশ। কোন শিথিল দুপুরে জানলায় বসে আকাশে যখন দেখি নীলের গায়ে মেঘের বর্ণমালা অক্ষর বিন্যাসে ব্যস্ত আমার মনে হয় মা আর বসবে না এমন সময় কখনো পাশটিতে । পড়াশুনা বড় ভালবাসত মা। যেকোন মূল্যে আমাদের শিক্ষা সম্পূর্ণ করতে তৈরি ছিল। মায়ের যে খুব লেখাপড়া হয়েছিল এমন নয়। মাধ্যমিক পাশও করতে পারেনি। একদিন আমাকে কথায় কথায় বলেছিল, ‘খুব ইচ্ছে ছিল রে বাবা অন্তত ক্লাস নাইনটা পাশ করি। পড়াশোনা করার আর সুযোগই পেলাম না।’

তাই আমাদের পড়াশোনা শেখাতে মায়ের কী যে প্রতিজ্ঞা ছিল! বাবার অকালমৃত্যুর পর মা সর্বস্ব পণ করেছিল কেবল আমাদের উচ্চশিক্ষার জন্য। তখন পূর্ব পাকিস্তানে থাকি, আমার জন্মও হয়নি। দিদি যে মেয়েদের স্কুলে পড়ত সেখানে উর্দু শেখা বাধ্যতামূলক। দিদিকে পড়াবার জন্য মা নিজে উর্দু শিখে নিয়েছিল। পুজোতে আমি পুজোসংখ্যাগুলি কিনলে আমার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পড়ত মা। ভালোবাসতো এডভেঞ্চার আর গোয়েন্দা কাহিনীগুলি। বড়দের লেখা প্রিয় ছিলনা মায়ের। আমারও একই ধাত। আমি কিনতাম সব ছোটদের পুজো সংখ্যা। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাকাবাবুর কাহিনী খুবই পছন্দ করত। পড়ত আর আমাকে বলত, ‘কাকাবাবুর কি সাহস রে বাবা!’

আসলে প্রতিবন্ধকতাকে তুচ্ছ করে প্রতিকূলতাকে ডিঙিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা মায়ের নিজের জীবনেও বাস্তব বলেই এই ভালোলাগা। আর ভালোবাসত মা শরৎচন্দ্রের লেখা। চরিত্রহীন উপন্যাসের কথা কতবারই বলেছিল। বঙ্কিমচন্দ্রও পড়েছিল মা। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে মুগ্ধতা থাকলেও তাঁর রচনা বিশেষ প্রিয় ছিল না, কিছু কিছু কবিতা ছাড়া। শরৎচন্দ্র-প্রীতি মায়ের অসম্ভব, বলতে গেলে উচ্ছ্বাসে অধীর হয়ে যেত, ‘গ্রামের যা বর্ণনা দিয়েছেন না শরৎচন্দ্র ভাবা যায় না! গ্রামের লোকগুলিকে একেবারে তুলে এনে বসিয়ে দিয়েছে বইয়ের পাতায়।’

আমার পঠনপাঠনের আগ্রহ জেগেছিল মায়ের কাছ থেকেই। ত্রিপুরায় থেকে চলছে তখন জীবনযুদ্ধ। বাবা মারা গেছে। সারাদিনের খাটনি ছেড়ে দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর মা বড় ঘরের পিছনের দরজার কাছে জলচৌকিতে রামায়ণ নিয়ে বসত। তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। আম-কাঁঠালের ডালপাতায় হাওয়া খেলা করছে মিহি গলায়। মায়ের সুর করে রামায়ণ পড়া কি যে কবিতা বুনত! বাঁশঝাড়ের মাথায় বসে ডাক ছেড়ে জটলা পাকাত সাদা বকেরা। কাছাকাছি জঙ্গল থেকে ভেসে আসত অবিশ্রাম ঝিঝিঁপোকার কান অসাড় করে দেওয়া সাড়া । অনেক দূরে অকারণে ক্লান্ত স্বর তুলত ঘুঘুপাখি। এসবকিছুর সঙ্গেই মিশে যেত মায়ের রামায়ণ পাঠ। শ্রোতা আমি আর দিদি। আমার তখনও অক্ষরজ্ঞান ছিল না। কিন্তু রামায়ণের রঙিন ছবিগুলি আমাকে নিশির ডাক দিত। মায়ের পড়া হয়ে গেলে আমি রামায়ণ ঘাটাঘাটি শুরু করতাম। মা আপত্তি জানাত, কিন্তু কেড়ে নিয়ে যেত না। আমি আপ্রাণ চেষ্টা করতাম কিভাবে অক্ষর চিনে পড়া যায়। তারপর সত্যি সত্যি পড়তে শিখে গেলাম। আমার পড়াশুনার সূত্রপাত ঘটেছিল ওই রামায়ণ দিয়ে।

দিদি তখন বি.এ. পড়ছে, প্রাইভেটে পরীক্ষা দেবে। পড়তে শুরু করেছিল কলকাতায়, কিন্তু হঠাৎ বাবা মারা যাওয়ায় মায়ের কাছে চলে আসে। মা তবুও তাকে কলকাতা রেখেই পড়াতে চেয়েছিল, কিন্তু দিদি রাজি হয়নি। ত্রিপুরার সেই অখ্যাত গ্রামের নাম কাকারাবন, সেখানে কোন ডিগ্রী কলেজ ছিল না। পড়তে হলে দিদিকে যেতে হতো রাজধানী আগরতলায়, আমাদের বাড়ি থেকে অন্তত সত্তর-আশি কিলোমিটার, থাকতে হতো হোস্টেলে। মা তাতেও রাজি ছিল, যতই কষ্ট হোক না কেন, কিন্তু দিদি মাকে আর আমাকে ফেলে দূরে যেতে চাইলো না। দিদি বাড়িতে থেকেই পড়াশোনা করত, তার পড়াশোনার সঙ্গী হতো মা। পড়াবার এমন অদ্ভুত পদ্ধতি ভাবলে আজও অবাক লাগে। দিদি পড়ছে, মা কোন কাজ নিয়ে পাশে বসে শুনছে একমনে। আবার একটু পর পর জিজ্ঞেস করছে, তারপর কী হলো। ইতিহাসের কোন একটা অধ্যায় দিদি হয়তো আজ পড়ে রাখল খানিকটা, কাল মা তাকে পরের অংশটা পড়ে শোনাবার জন্য তাড়া দিয়ে বসালো। মাকে শোনাতে গিয়ে দিদির পড়া হয়ে যেত। তখন আমি খুবই ছোট, তবুও স্পষ্ট মনে আছে দিদি সন্ধের পর হারিকেনের আলোয় বসে ইলতুৎমিসের রাজ্যশাসন পড়ছে আর মা প্রতিমুহূর্তে তার উৎসাহ প্রকাশ করছে নানারকম মন্তব্য দিয়ে। হাজার কাজের মধ্যেও মা অনবরত দিদির সঙ্গে থেকে তাকে দিয়ে পড়াশোনা করিয়ে নিত।

বিস্মৃতির অন্ধকূপ থেকে আমি বহু চেষ্টায় খুঁজে বার করি কোন টুকরো ছবি—- দেখি দিদি বসে বসে মধুসূদন দত্তের মেঘনাদবধ কাব্য পড়ছে। এক একটি স্তবক পড়ার পর পঠিতাংশ নিয়ে মায়ের সঙ্গে তার চলছে আলোচনা, আবার কৃত্তিবাসের কাহিনীর সঙ্গে তার তুলনাও হচ্ছে। মাটির মেঝেতে পাতা বিছানায় আমি তখন শুয়ে আছি। বিদ্যুৎ আসেনি গ্রামে, লণ্ঠনের আলোয় বসে পড়ছে দিদি। মা পাশে বসে হয়তো কুটনো কুটছে, পরদিনের জন্য। বাইরে হঠাৎ ঝাঁক বেঁধে শেয়ালরা হুক্কা-হুয়া ডাক জুড়ে দিল। অনেক দূরে বড় রাস্তা ধরে হাটুরে লোকেরা হয়তো দল বেঁধে ঘরে ফিরছে, তাদের কারো গলায় গানের চিৎকার। আর টানা আর্তনাদ ঝিঁঝিঁ পোকার। দিদি মাকে পড়ে শোনাচ্ছে ইন্দ্রজিতের যজ্ঞাগারে লক্ষণের প্রবেশ। মায়ের মন্তব্য কানে ভাসছে আমার, ‘আসলে ইন্দ্রজিৎ খুব বীর ছিল। লক্ষণের একা তাকে মারা কিছুতেই সম্ভব হতো না।।’

অথচ মা আমার কৃত্তিবাসের রামায়ণ পড়তেই অভ্যস্ত, মধুসূদনের কাব্যে মায়ের এই প্রীতি আজ আমাকে অবাক করে।

সপ্রতিভ জগতের রাজনীতি, বিজ্ঞান, দর্শন, বাণিজ্য, কেরিয়ার-ভাবনা, চলন-বলন আমার কাছে জোলো হয়ে যেতে থাকে। আলোকোজ্জ্বল শহরের আকাশে চোখ রেখেও দেখি সপ্তর্ষিমণ্ডল তবুও আপন গৌরবে নির্বিকার। জগতের সপ্রতিভ বড়াই তাকে অগ্রাহ্য করলেও মুছে দিতে অপারগ। তার উপস্থিতিতে আমি দেখি মিটিমিটি কৌতুক। মাকে এখন পেলে জানাতাম, আমাদের অপ্রস্তুত হওয়ার কারণ নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *