রাজীব তন্তুবায়
“মাছ লিবে গো, মাছ…”
নতুন কলোনির জল ছিপছিপে রাস্তায় হাঁক পাড়তে পাড়তে হাঁটছে বাসনা। রবারের চটির ফটফটানিতে কাদা ছিটকাচ্ছে এদিক সেদিক। খাটো করে পরা শাড়ির পিছনটাতেও ছিটকে এসে লাগছে কাদা। যেদিকে তাকায় সেদিকেই কাদা। কাদায় যেন টানছে তাকে। সেসব উপেক্ষা করেই গুটি গুটি পায়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে বাসনা। বাঁদিকের কাঁখে বাঁশের ঝুড়ি। ঝুড়ির ভিতর মাছ, নীল ত্রিপলে মোড়া। সাথে দাঁড়িপাল্লা, কয়েকটা বাটখারা, আর এক পাশে লেতিয়ে পড়া একগোছা কচুপাতা। মাঝখানে উঁকি দিচ্ছে আঁশ-রক্ত লেগে থাকা ধারালো একটা বঁটি। যেন উপরে ঝুলে থাকা জামরঙা মেঘটার দিকে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টে।
একটু আগে বৃষ্টি হয়েছে এক পশলা। মাঝখানে থেমেছে সবে। সেই সুযোগে মাছ নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে বাসনা । আবারও ফোঁটা ফোঁটা শুরু হল বলে। সকালে যখন ঘর থেকে বের হয়, আকাশে তখন মেঘ ছিল ঠিকই। কিন্তু এইরকম দফায় দফায় যে ঝরতে থাকবে আন্দাজ করতে পারেনি। হোক বৃষ্টি। মাছগুলো তো বেচতে হবে। এখনও অর্ধেকটার মতো বাকি। মুল টাকাটাও উঠেনি পর্যন্ত। বৃষ্টিকে কি আর পরোয়া করলে চলে?
গত দু’দিন খুব মন্দা গেছে বাসনার। সব মাছগুলো বেচতে পারেনি ঠিক মতো। শেষমেষ বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রায় যেচে যেচে লোককে ধরে লস করেই বেচতে বাধ্য হয়েছে । নইলে এ বেলার টাটকা মাছ, ও বেলায় পচা। এমনিতেই আড়তে কিছুটা ধার পড়ে আছে। ওদিকে আবার মালিকের ছেলে ছোটন কুন্ডু সাফ বলে দিয়েছে, আজ যদি মেটাতে না পারে, পরের দিন আর ধারে মাছ দেবে না তাকে।
মিতা বৌদিও মাছ নিচ্ছিল তখন। কথা শুনে আড়ালে ডেকে চোখ টিপে বলেছিল, “ছোটোবাবুর সনে টুকু হাসি-হাসি করে কথা কইবি, দেখবি বিক্কি না হওয়া মাছ বাবু ঠিক ফেরত লিয়ে বরফের তলে রাখে দিবেক। মূল টাকাটা ত বাঁচবেক। আমারও কি আর প্রতিদিন সব মাছ বিক্কি হয়? কই ছোটোবাবু ত আমাকে ঘুরায় নাই! পচা জিনিসের ব্যাবসা। দিন দিন লস হলে ব্যাবসা টিকাতে পারবি? “
ছোটোবাবুর সাথে হেসে হেসে কথা বলার মানেটা যে কী, বাসনা তা প্রথম দিনের চাউনি দেখেই বুঝে নিয়েছে। তাই হয়তো মিতা বৌদির কথামতো হাসতে পারেনি বাসনা। পারেনি বলেই তাকে পচে যাওয়ার আগে লসে বেচতে হয়।
কতবার মনে হয়েছে, কুন্ডুদের আড়ৎ ছেড়ে পালদের আড়তে মাছ নেবে সে। কিন্তু ওরা তো তার মতো ছোট ব্যাবসায়ীকে ধারে মাছ দেয় না। নইলে কবে এ আড়ৎ ছেড়ে দিত বাসনা। আজ যেভাবেই হোক মাছগুলো সব ঠিকমতো বেচতে হবে। যতটুকু ধার আছে সব মিটিয়ে দিয়েই বাড়ি ফিরবে। ভাবতে ভাবতে আবারও হাঁক পাড়ে জোরে, “মাছ লিবে গো….”
ছাতা মাথায় রাস্তায় বেরিয়েছেন সনাতন হালদার। বয়স্ক মানুষ। মিহি সুরে জিজ্ঞেস করেন, “কী মাছ এনেছো গো?”
“লাউ দাদা, রুই, তেলেপিয়া আর চারাপোনা।” ব্যস্ততার সঙ্গে বলে উঠে বাসনা।
“কই নিয়ে এসো দেখি এই গাছ তলাটায়। রাস্তার যা অবস্থা!” বলতে বলতে সনাতন বাবু একটা কদম গাছের তলায় গিয়ে দাঁড়ান। “দেশী মাছ তো?”
গাছটার দিকে এগিয়ে যায় বাসনা। বলে, “সে আর বইলতে দাদা। একেবারে টাটকা। লাল টকটক্যা ফুলকাটা দেখলেই বুঝতে পারবে।”
ঝুড়ি নামিয়ে হাঁটু ভাঁজ করে পিছনটা মাটিতে না ঠেকিয়ে আলগা মতো বসে পড়ে সে। প্লাস্টিক সরাতে বেরিয়ে আসে মাছ। ধপধপে সাদা।
ঝুপঝাপ করে দু-তিনটে পাখি এসে বসে কদম গাছের ডালে । জলের ভারে নুয়ে পড়া ডালটা নড়ে উঠে তাতে। ঝরঝর করে বেশ কয়েক ফোঁটা জল ঝরে পড়ে বাসনার আধভেজা গায়ে, মাছের ঝুড়িতে — সনাতন হালদারের ছাতায়। ফড়ফড় করে উঠে ছাতা। মাথায় কাপড়টা টেনে নিয়ে একটুখানি নড়েচড়ে বসে বাসনা।
দরদাম করে একটা রুইমাছ বেছে নিয়ে সনাতন বাবু বলেন, “দাও, এটাই ওজন করে কেটে দাও তবে।”
সাইকেল নিয়ে পেরিয়ে যাচ্ছিল একটা ছোকরা। রাস্তার কাদা দু’ফাঁক হয়ে ছিটকে পড়েছিল চাকা থেকে। ক্রিং ক্রিং করে বার কয়েক বেল বাজিয়ে কাছ ঘেঁষে যেতে যেতে বলল, “কী দাদু, এই বাদলে মাছ খাতে মন যাচ্ছে? খাও খাও, এমন পারা মাছ পালে কার না খাতে মন যায়?”
কথাটা শেষ হতে না হতেই গাছের ডালে ‘ক্যাক্ ক্যাক্’ করে ডেকে উঠে পাখিগুলো। আবারও গাছ থেকে কয়েক ফোঁটা জল ঝরে পড়ে বাসনার উপর। বাসনা তখন পায়ের নিচে বঁটি চেপে মাছ কাটছে সুকৌশলে। বঁটি বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে রক্ত। সনাতন হালদার সেদিকেই তাকিয়ে ছিলেন একভাবে। সঙ্গে সঙ্গে চোখ সরিয়ে গা ঝাঁকিয়ে বিড়বিড় করে বলে উঠেন, “ছিঃ ছিঃ, কী ভাষা!” কান করে না বাসনা। মেয়ে মানুষ ব্যাবসায় নামলে পাঁচ জনে যে পাঁচ রকমের কথা বলে, বাসনা তা জানে। জানে বলেই সব কথা কানে যায় না তার। এ সময় কেবল একটা কথাই কানে যায়, “মাছ? কী মাছ?” এই যেমন একটু আগে সনাতন হালদার বলেছিলেন।
মাছটা কাটতে কাটতে আরও দু’চার জন খদ্দের এসে জড়ো হয় কদম তলায়। মুখের হাসিটা চওড়া হয় বাসনার। হঠাৎ বুকের কাছে রাখা ছোট্ট মোবাইলটা বেজে উঠে ঝনঝন করে। তড়িঘড়ি মাছ রেখে হাত ঢোকায় বুকের ভিতর। একটা চেইন দেওয়া ভেলভেটের ছোট্ট ব্যাগ বের করে আনে। তার মধ্য থেকেই বহু পুরানো স্ক্রিন ফেটে যাওয়া কি-প্যাড ওয়ালা ফোনটা বের করে কানে ঠেকায়।
এই কলটার জন্যই বিশেষ করে ফোনটা কেনা। সেদিন ডাইরি করে ফেরার সময় থানার বড়বাবু পরামর্শ দিয়েছিলেন, “একটা ফোন নম্বর থাকলে খবরাখবর দেওয়াটা সহজ হবে। পারলে একটা ফোনের ব্যাবস্থা কর বাসনা।”
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ব্যবস্থা করে সে। সেই তখন থেকেই ফোনটা সবসময় নিজের কাছে কাছেই রাখে ।
কথা শেষ হলে ফোনটা আবার গুঁজে নেয় বুকের ভিতর । কাটা মাছের পিসগুলো কচুপাতায় মুড়ে ধরিয়ে দেয় সনাতন হালদারের হাতে। টাকাটা ঠিকমতো বুঝে নিয়ে সব কিছু গুটাতে শুরু করে চটপট। বাকিদের বলে, “কিছু মনে কইরো না দাদারা, আমাকে এখুনি যাতে হবেক। এখন আর মাছ দিবার সময় নাই।”
সবাই যখন অবাক হয়ে এর ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে, ততক্ষণে সব গুটিয়ে নিয়ে আবার কাঁখে ঝুড়িটা চাপিয়ে ফিরতি পথে হাঁটা শুরু করেছে বাসনা।
এখান থেকে থানাটা মাত্র দেড়-দু’ কিমির হাঁটা পথ। রাস্তা যেন ফুরায় না তবু। এতোদিন পর মানুষটার একটা সন্ধান পেয়েছে। চুলোয় যাক মাছ। চুলোয় যাক খদ্দের। টিপটিপ বৃষ্টি গায়ে মাখতে মাখতে পড়িমরি করে হাঁটছে বাসনা। না, ছুটছে বাসনা। ছুটতে ছুটতে চোখের সামনে স্পষ্ট হয় উঠছে আপন মানুষটার চোখ— মুখ — হাসি। প্রায় সাত মাস হয়ে গেল, শেষ দেখেছে যে হাসি।
কীভাবে যে এমন হয়ে গেল বুঝতে পারে না বাসনা । নকুল তো মোটেও তেমন মরদ ছিল না তার। সংসারের চাপ এতটুকুও কোনোদিন বুঝতে দিত না তাকে। যতটুকু প্রয়োজন সাধ্যমতো ঠিক জুটিয়ে আনত রান্নাশালে। পাড়ার আর সব মেয়ে-বউরা মাছের ব্যাবসায় নামলেও, বাসনাকে কোনোদিন ওসব করতে দেয়নি নকুল। বললেই বলত, “যে শালা বউয়ের রোজগারে খায়, সে শালা মরদ কীসের? আমার কি গতর নাই যে বউকে ব্যবসায় নামাব?”
সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সারাদিন যে মানুষটা শুধু কাজ আর কাজ নিয়ে পড়ে থাকত, সেই মানুষটা কীভাবে আজ সাত সাতটা মাস বেপাত্তা হয়ে থাকতে পারে?
সামনের পাথর খাদানে কাজ করত নকুল। অসুরের মত বলিষ্ঠ শরীরে হাতুড়ির ঘায়ে টুকরো টুকরো করে দিত বড়ো বড়ো পাথরের চাঁই। ম্যানেজারও সুনাম করত তার কাজের। সরকারি অফিসে নতুন অফিসার আসায় হঠাৎ একদিন বন্ধ হয়ে গেল খাদান। কাজ হারিয়ে বসে গেল খাদানের শ্রমিকরা। নকুল তো ঘরে বসে থাকার লোক ছিল না। বাঁকুড়ায় গিয়ে রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ ধরল সে। বলল, “বিদিশা নগরে নতুন নতুন বাড়ি উঠছে। এখন বেশ কয়েক বছর যাতে পারলে কাজের অভাব হবেক নাই।” রোজ সকালে বাস ধরে যেত, ফিরত সেই সন্ধ্যায়।
মাঝে মাঝে রাগ করত বাসনা। নকুল পাশে এসে শুলে মুখ ভার করে বাসনা বলত, “কী দরকার রোজ রোজ অত দূরে কাজে যাওয়ার? উঁচু উঁচু বিল্ডিংয়ে কাজ? কিছু হয়ে গেলে তখন?”
“ধুর পাগলি, কী আর হবেক? এত এত লোক কাজ করছে ঠিকাদারদের আন্ডারে, কার কী হচ্ছে, হ্যাঁ?” বলেই বেশি করে জড়িয়ে ধরত বাসনাকে। চুপ করে যেত বাসনা। তারপর বলত, “ছেলাটার কথাটা একটু ভাব। সে বেচারা তুমাকে দেখতে পায়নাই ভালো করে। যখন যাও তখন সনুর ঘুম ভাঙে নাই। আর যখন রাতে ফির, তখন উ ঘুমায় যায়। উয়ার কি ভালো লাগে? সব সময় বলে, বাবা কখন আসবেক গো মা? কত আর বুঝাব তুমাকে!”
নরম জ্যোৎস্নার মতো হাসত নকুল। বলত, “সনুর জন্যই ত আরো বেশি করে খাটতে হবেক। মানুষ করতে হবেক নাই ছেলাটাকে! উ কি আমার মত লেবার খাটবেক নকি?”
নকুলের কথা শুনে চোখে খুশি জ্বলজ্বল করে উঠত বাসনার। তবুও আদর করে বলত, “নিজের শরীরটাও ত দেখতে হবেক। একদিন-আধদিন ত বিশ্রামও লিতে হয়!”
বাসনাকে আদরে ভাসিয়ে দিতে দিতে বলত, “ইটা আমার পরিশ্রমের শরীর গো। বিশ্রামের ধার ধারে নাই। উ লিয়ে তুই কিছু ভাবিস না।”
সত্যি সত্যিই নকুল পাশে থাকলে বেশি কিছু ভাবত না বাসনা। আরও বেশি করে কীভাবে আদরে, সোহাগে, যত্নে মানুষটার সেবা করা যায় সেই নিয়েই বিভোর হয়ে থাকত সারাক্ষণ।
একদিন বাদল করল খুব। হাজার বারণ সত্তেও কথা শুনল না নকুল। একটা ফুটো ছাতা মাথায় দিয়ে প্রায় ভিজতে ভিজতে বেরিয়ে পড়ল কাজে। সেই যে গেল আর ফিরল না। কত খোঁজাখুঁজি, কত থানাপুলিশ। কোথাও কোনো হদিস পাওয়া গেল না মানুষটার।
আজ যখন এতদিন পর থানা থেকে ফোন করে ডেকেছে তখন নিশ্চয়ই খোঁজ পেয়েছে ওরা। এই খবর শুনে কি আর আস্তে আস্তে হাঁটতে পারে বাসনা?
প্রথম প্রথম থানায় আসতে যতটা আড়ষ্ট বোধ করত, এখন আর সেই আড়ষ্টতা নেই। এই কটা মাসে এতোবার যাওয়া আসা করেছে, থানার প্রায় সব স্টাফই ওকে ভালোভাবে চিনে গেছে। এখন আর অফিস ঢুকতে কোনো অসুবিধা হয়না তার। সেইমতো অনায়াসে করিডোরের বেঞ্চের পাশে মাছের ঝুড়িটা নামিয়ে দিয়ে সোজা এসে অফিসারের টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ায় । টপটপ করে জল ঝরে পড়তে থাকে গা বেয়ে। অফিসার টেবিলে বসে কী যেন লিখছিলেন। তাকে এইভাবে হন্তদন্ত হয়ে আসতে দেখে জিজ্ঞেস করেন, “কী ব্যাপার, তুই! হঠাৎ বৃষ্টিতে ভিজে…?”
এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে বাসনা বলে, “উ কুথায় বড়বাবু?”
“কে কোথায়?” নাকটা কুঞ্চিত হয়ে যায় অফিসারের। ভিজে কাপড়ের সাথে মাছের আঁশটে গন্ধ মিশে বিকট একটা গন্ধ বেরোচ্ছে বাসনার গা থেকে।
—আমার বর?
“উফ্!” বিরক্তি ফুটে উঠে অফিসারের চোখে মুখে। “তোকে তো বলেছি, আমরা চেষ্টা চালাচ্ছি। খোঁজ পেলে জানাবো। বারবার এভাবে আসার কী দরকার?”
“মানে?” চোখদুটো ঝাপসা হয়ে আসে বাসনার। “তবে যে ফোন করে বইলল, থানাতে উয়াকে বসায় রাখেছে। এখুনি আয়…”
—কে ফোন করেছিল তোকে?
—থানা থাকেই ত!
—কখন?
—এইমাত্র, একটু আগে। সেই লাগেই ত ছুটে ছুটে আসছি।
—কই দেখি নম্বরটা?
বুকের ভিতর থেকে আবার ছোট ব্যাগটা বের করে বাসনা। ভেজা হাতে মোবাইলটা বের করে এগিয়ে দেয় অফিসারের দিকে। ফোনটা হাতে নিয়ে রিসিভ কলে নম্বরটাতে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলেন, ” যতদূর মনে হচ্ছে, এটা থানার কারো নয়। টাকা আছে ফোনটাতে?”
ভাবলেশহীন ভাবে ঘাড় নাড়ে বাসনা। কল ব্যাক করেন অফিসার। সুইচড অফ। আবারও চেষ্টা করেন। আবারও সুইচড অফ। অফিসার বলেন, “মাঝে মাঝে উল্টোপাল্টা ফোন আসে কি?”
— কই না ত… তেমন ত ফোন আসে নাই।
— নতুন কাউকে নম্বর দিয়েছিস ইদানিং?
— না।
— যাকে তাকে নম্বর দিস না।
ঘাড় নাড়ে বাসনা। অফিসার বলেন, “এখন কিছু করছি না। নম্বরটা নোট করে নিচ্ছি। পরে যদি আবার এমনি মিথ্যে করে ফোন করে তো আমাকে জানাস। বেটাকে লক আপের ভাত খায়িয়ে ছাড়ব।” বলতে বলতে দাঁতগুলো কিড়মিড়িয়ে উঠে অফিসারের।
মাথাটা ঝিমঝিম করতে থাকে বাসনার। অফিসারের শেষের কথাগুলো অস্পষ্ট কিছু শব্দ হয়ে ঠোক্কর খেতে থাকে কানের ভিতর। মানুষের দুর্দিনে মানুষ মানুষকে নিয়ে যে কেন এতো তামাশা করে, ভেবে পায় না সে। যতটুকু আশা নিয়ে নকুলের সন্ধানে ছুটে এসেছিল থানায়, এখন ততটাই হাতাশ লাগছে তার। বিশেষ করে এতোগুলো মাছ পড়ে আছে ঝুড়িতে। এই সবে খদ্দের লেগেছিল নতুন কলোনির গলিতে। চোখের জল আর ধরে রাখতে পারে না বাসনা। সঙ্গে সঙ্গে হাত দিয়ে মুছে অফিসারের কাছ থেকে ফোনটা নিয়ে বেরিয়ে আসে বারান্দায়। মাছের ঝুড়িটা আবারও তুলে নেয় মাথায়। তড়িঘড়ি বেরিয়ে পড়ে থানা থেকে।
বাইরে তখন অঝোর বৃষ্টি। রান্না ঘরের দেওয়ালের মতো কালো মেঘ ঢেকে দিয়েছে আকাশ। রাস্তা উপচে কাদা-ধোয়া জল বইছে পা-তলায়। ভিজতে ভিজতে কলোনির দিকে হাঁটছে বাসনা। ভিজুক যত খুশি। মাছগুলো বেচতেই হবে তাকে। ঝুড়ি বেয়ে গড়িয়ে পড়া বৃষ্টির জলের সাথে চোখের জল মিশে গিয়ে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে তার। যেখানে ছোটন কুন্ডুর বিকৃত চাউনিটা ভেসে উঠে স্পষ্টভাবে । থানার অফিসারের দাঁত কিড়মিড়িয়ে উঠা মুখটাও ভেসে আসে পিছু পিছু। সঙ্গে সঙ্গে অস্পষ্ট হয়ে অদৃশ্য হয়ে যায় ছোটন কুন্ডু। জোরে জোরে শ্বাস নেয় বাসনা। চোখদুটো আবারও ছলছলিয়ে উঠে। দেখতে পায় আরও একটা মুখ, নরম হাসির। যে হাসির সন্ধানে বহুদূর হেঁটে যেতে চায়। হাঁটতে হাঁটতে গৃহস্থের বাড়ির কাছে এসে গলা ছেড়ে হাঁক পাড়ে, “মাছ লিবে গো…”
বঁটির গায়ে লেগে থাকা রক্তের দাগ বৃষ্টিতে ধুয়ে গিয়ে চকচক করে উঠে আবার।