অম্বরীশ ঘোষ
বিষয় পরিচিতি
প্রকৃতিকে আঁকড়ে ধরে অরণ্য, পাহাড়, নদী আর চা-বাগিচার পরিধি জুড়ে সমগ্র ডুয়ার্সে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন নানান জনগোষ্ঠীর মানুষ। স্বতন্ত্র তাদের লড়াই, স্বতন্ত্র তাদের ইতিহাস। এই লড়াই আর ইতিহাসের একটি বৃহৎ পরিসর জুড়ে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন জনগোষ্ঠীর নারীদের কর্মতৎপরতা আর নিপুণতার অধ্যায়গুলো। তাদের নিয়েই এই ধারাবাহিক নানান জনগোষ্ঠীর বীরাঙ্গনা।
প্রতিকূলতা বনাম প্রত্যয় : আশিকা ওঁরাও
‘একদিন মঁয় বহুত উপরে ডেকবু। বাদরি ছোঁকে আবু। দেশ লাগিন পুরস্কার লেইকে আবু’। এই কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে ফেললেন যে মেয়েটি, তার নাম আশিকা ওঁরাও। কথাগুলো বাংলায় অনুবাদ করলে যা দাঁড়ায় তা হল, একদিন সবচেয়ে উঁচুতে লাফাব, আকাশ ছুঁয়ে আসব, দেশের জন্য পুরস্কার নিয়ে আসব। সাদ্রি ভাষায় নিজের মনের ইচ্ছাটা প্রকাশ করছিলেন আশিকা ওঁরাও। বলার সময় সামনের শ্রোতাদের মুখের দিকেও তাকাননি আশিকা। নজর ছিল দূরের দিগন্তে। চোখ মুখে কষ্ট, দৃঢ়তা, সংকল্প জেদ সমস্ত কিছুর একটা মিশ্র ভাব ফুটে উঠেছিল আশিকার চোখে মুখে। কে এই আশিকা ওঁরাও? ওঁরাও জনগোষ্ঠীর লড়াকু একজন নারী যিনি ২০২৩ সালে ভোপালের জাতীয় স্তরের ক্রীড়ায় অংশ নিয়েছিলেন।
আলিপুরদুয়ার জেলার ফোস্কারডাঙ্গা বলে একটি ছোট্ট গ্রামে জন্ম আশিকার। কষ্টের এবং লড়াইয়ের জীবনটা যেন শুরু হয়েছিল ভূমিষ্ঠ হবার আগেই। হ্যাঁ, ভূমিষ্ঠ হবার আগেই। তার জন্মের আগেই চিকিৎসক আত্মীয়-স্বজনকে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে হয় শিশু নয়তো মা যে কোনো একজন হয়তো বেঁচে থাকবে। এমনি এমনি তো আর চিকিৎসক কথাগুলো বলেননি! আশিকা যখন মায়ের পেটে তখনই তার মা আক্রান্ত হন টিবি রোগে। ফলে নানান ঔষধপত্র খেতে হয়েছিল তাকে। তাকে ঔষধগুলো না দেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। মা দু’চোখে জল নিয়ে খেতেন ওষুধগুলো। বুঝতেন যে জঠরের সন্তানের কত বড় ক্ষতি হতে পারে এর জন্য! আশিকার ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় যতই এগিয়ে আসছিল, বাবা দিদি এবং অন্যান্য পরিজনদের দুশ্চিন্তা যতই বাড়ছিল। তারা প্রার্থনা করছিলেন সর্বশক্তিমান ধর্মেশের কাছে। পরিবারের যারা খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছিলেন, তারা প্রার্থনা করতে শুরু করলেন যিশুবাবার কাছে। অবশেষে জন্ম হলো আশিকার। ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলেন তার মা ।
বাড়ি থেকে এক কিলোমিটার দূরেই হাই স্কুল। প্রথমেই বুধু এস. কে. প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং তারপর ফোস্কারডাঙ্গা উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে দ্বাদশ শ্রেণীর পরীক্ষা দেন আশিকা। খেলাধুলায় মনোযোগ ছিল শৈশব থেকেই। শৈশবে ফুটবল খেলতেন, আকর্ষণ ছিল তীরন্দাজির প্রতিও। তীরন্দাজির প্রতি আসক্তি থাকার একটি কারনের নাম সাঞ্চি টোপ্পো। আশিকার এই আত্মীয় নিজেও ২০১৫ সালে তীরন্দাজিতে জাতীয় পর্যায়ে অংশ নিয়েছিলেন। আশিকার বয়স তখন সাত কি আট। তখন থেকেই আশিকা সাঞ্চি দিদির সাথে নানা স্থানে যাতায়াত করেন। ফুটবল এবং তীরন্দাজিতে সুনাম থাকলেও অন্যান্য ওঁরাওদের মতই সর্বপ্রাণবাদী প্রকৃতি উপাসক আশিকার ক্যারিয়ারে বিশেষ আলো ফুটলো যখন তার লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ালো লাফিয়ে আকাশ ছোঁয়া। তার দেবতা ধর্মেশ যেখানে অবস্থান করেন অর্থাৎ সূর্যের দিকে লাফ দেওয়া। উচ্চ লম্ফনের অনুশীলন শুরু করলেন আশিকা। বুঝতে পারলেন যে তার অভীষ্ট লাভ হবে এই বিভাগটির ধারাই। এ্যথলিট হিসেবে হাইজাম্পই তার দাঁড়াবার জায়গা। তার লক্ষ্য হবে উঁচু, উঁচু, উঁচু, অনেক উঁচু …..
সংসারের আর্থিক লড়াইতে টিকে থাকাই দায় হয়ে ওঠে তার পরিবারের। বাবার অসহায় উদাস দৃষ্টি উঁচু নয় বরং নিচে। শরীকি ভাগ বাটোয়ারার পর এক চিলতে চাষের জমির মালিক হলেন আশিকার বাবা। তার ওপর নির্ভর করে সংসার চালানো অসম্ভব। ফলে দিনমজুর হিসেবে দিন পার হচ্ছিল তার। আর অনটনের মধ্য দিয়ে দিন পার হচ্ছিল পরিবারের তিন সন্তান, স্ত্রীর। প্রতিদিন দু’বেলা ভর পেট খাওয়া আর দু’একটা করে মোটা কাপড়ের পোশাকের মালিক হওয়াই চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় তাদের। আশিকার বাবার ভগ্ন দেহে এই কঠিন দৌড় দীর্ঘ হলো না। আশিকার বয়স যখন পনেরো, বাবা স্ট্রোক করলেন। আপন করে নিলেন ইহলোক ছেড়ে পরলোককে।গৃহবধূ আশিকার মা যেন একসমুদ্র জলে পড়লেন। আর্থিক টানাপোড়েন কাকে বলে তা হাড়ে হাড়ে টের পেলেন আশিকা আর তার পরিবার। দিন কয়েকের মধ্যেই মাও যুক্ত হয়ে গেলেন দিনমজুরির কাজে। দিদির বিয়ে হয়ে গিয়েছিল বাবার মৃত্যুর আগেই। স্কুল যাওয়ার আগে কখনো দাদুর বাড়িতে, কখনো দিদির বাড়িতে কখনো বা না খেয়েই ছুটতেন কিশোরী আশিকা। আশার এক টুকরো আলো বলতে সুমন ঘোষ নামের একজন শিক্ষক দশম শ্রেণী পর্যন্ত কোন পারিশ্রমিক না নিয়ে পড়াশোনায় সহযোগিতা করতেন আশিকাকে। ওঁরাদের খাদ্যাভ্যাসও সামান্য সঙ্গী হয়েছিল আশিকার। নানা পশুপাখির মাংস, কচ্ছপ, বাইম, কাঁকড়া প্রকৃতি যা কিছু যখন সংগ্রহ হতো, তখন সেটাই সেই দিনের মেনুতে মুখ্য হিসেবে স্থান পেয়ে যেত। ওঁরাওদের বাড়ি ঘরের দেয়ালের নিম্নাংশ রঙ্গিন করা হয়। চারচালা ঘরের চার ধারে থাকে বারান্দা। ঘরের দেয়ালে গাছ, লতাপাতা, পাখি আঁকা থাকে। এ’কথা নতুন করে বলার অপেক্ষা থাকে না যে এর কোন কিছুই আশিকাদের বাড়িতে নেই। চাল ও চার দেয়াল টিনের। ছোট্ট ঘর। একইভাবে তৈরি রান্নাঘরটা আরো ছোট। দুটো ঘরই দুই দুই বার আক্রান্ত হয়েছে হাতির দ্বারা। ধানের গন্ধে পাগলের মত ছুটে এসে হাতি ভেঙ্গে দিয়েছে তাদের ঘরবাড়ি। ঝড় বৃষ্টির মাঝে মৃতপ্রায় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে বাড়িটা। ভেতরে আতঙ্কে প্রহর গোনে আশিকারা।
ওঁরাও মহিলারা কারমা শিকড়ি বা নাকফুল, খংশ্ বা খোপার রুপোর কাঁটা, পায়ের নখে মুদদী প্রকৃতি নানান অলংকারে সেজে ওঠেন তাদের নানান পরব বা সামাজিক আয়োজনগুলোতে। সামর্থ থাকুক বা নাই থাকুক, আশিকার মন কখনো অলংকারে সেজে ওঠার দিকে যায়নি। বরং মাঠ ফেরত মুখের ওপর জমে থাকা ঘামবিন্দুগুলোকেই তার অলংকার বলে মনে হয়েছে। ঢোল, মাদল, বাঁশি, খঞ্জনি, নাগরা ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্রের সুমিষ্ট আয়োজনের মাঝে বসেও তার মন ছটফট করে মাঠের জন্য। প্রতিদিন তিন থেকে চার ঘন্টা অনুশীলন করেন আশিকা। জেলার অপরপ্রান্তে কামাখ্যাগুড়ি ইউথ ক্লাবের হয়ে যখন খেলতেন আশিকা, তখন এক ক্রীড়া আয়োজনে আশিকার দেখা হয় সুপরিচিত ক্রীড়াবিদ ও শিক্ষক পরাগ ভৌমিকের সঙ্গে। তালিম নেওয়া শুরু করেন পরাগ স্যারের থেকে। প্রতিযোগিতার স্তর পেরোতে পেরোতে ডাক আসে কলকাতা থেকে। কিন্তু সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় আর্থিক অনটন। মায়ের অনুরোধে প্রতিবেশী তথা পরিচিতজনেরা অনেকেই পাশে দাঁড়ান সহযোগিতার জন্য। কলকাতা পর্যন্ত পৌঁছে দেবার দায়িত্ব গ্রহণ করেন দুই প্রতিবেশী কাকু। কলকাতায় থাকাকালীনই ডাক আসে ভোপালে আয়োজিত জাতীয় পর্যায়ের ক্রীড়া অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের জন্য। অন্যান্য শিক্ষকদের অনুরোধ করা হয় আশিকাকে ভূপাল এ নিয়ে যাবার জন্য। যা কিছু হাতে ছিল তাই নিয়েই দাঁতে দাঁত চেপে আশিকা রওনা হলেন ভোপালে। আশিকা বিশ্বাস করেন যে তার অধ্যবসায় ও অনুশীলন তাকে একদিন আরও অনেক বড় সাফল্য এনে দেবেই। কিন্তু অগণিত মানুষ যারা আশিকার লড়াইটা দেখেছেন, তারা সাফল্যের এই ধাপটা দেখেও বড্ড খুশি। তারাও বিশ্বাস করেন যে ধর্মেশ এর আশীর্বাদে এবং সকলের শুভাকাঙ্ক্ষায় আশিকা একদিন ঠিক আকাশ ছুঁয়ে ফেলবেন।