দীপান্বিতা

ফ্রানজ কাফকা 

একটি মাত্র ছোটগল্পের জন্য কোন লেখকের পরিচিতি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা কাফকা ছাড়া আর ক’জনের ক্ষেত্রে ঘটেছে সন্দেহ। কাফকা বললেই একসঙ্গে মনে হয়, দা মেটামরফোসিস, সেই অবিশ্বাস্য ছোটগল্পটির কথা। একচল্লিশ বছরের হতাশাগ্রস্থ জীবনে কাফকা দু’-একটি উপন্যাস আর কয়েকটি মাত্র ছোট গল্প লিখেছিলেন, প্রত্যেকটিই নিজস্ব ঔজ্জ্বল্যে অবিস্মরণীয়। অবশ্য আর একটি মাত্র শব্দ না লিখে কাফকা কেবলমাত্র দা মেটামরফোসিস লিখলেও পারতেন, খ্যাতি কিছুমাত্র কম হত না। ১৯১৫ সালে প্রকাশিত এই একটিমাত্র ছোটগল্প বিশ্বসাহিত্যে নজিরবিহীন আলোড়ন তুলেছে, রীতিমত সাহিত্যের এক নতুন ধারার জন্ম দিয়েছে। অথচ গল্পটি যখন প্রকাশ পায় তখন কেউ বুঝতেই পারেনি এর রূপকধর্মী বিষয়বস্তুর অন্তরালে আধুনিক জীবনের কী নির্মম সত্যি লুকিয়ে আছে। গল্পের মূল চরিত্র গ্রেগর সামসা নামের একজন সেলসম্যান। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে গ্রেগর দেখে, সে একটা বিশাল আর বিকটদর্শন পোকায় পরিণত হয়ে গেছে। সে আর কথা বলতে পারত না, ক্রমশ তার অঙ্গবিকৃতি বাড়তেই লাগল, অথচ বোধবুদ্ধি সবই তার যেমন ছিল তেমনই থেকে গেল। মানবিক চেতনা অবিকৃত অবস্থায় বাহ্যিক চেহারার এই যে অমানবিক কদর্য পরিণতি এবং তার যে যন্ত্রণা তাই নিয়েই মেটামরফোসিসের গল্প। গ্রেগরকে শেষপর্যন্ত এই অপরিসীম মানসিক কষ্ট থেকে মুক্তি দিতে তার বাবা তাকে মেরে ফেলে। আধুনিক বিশ্বে ব্যক্তি চরিত্রের উন্মত্ততা বা পরস্পরকে বোঝার অক্ষমতা এই গল্পে প্রকাশ পায়, একই সঙ্গে আধুনিক মানুষ কিভাবে প্রতিকূল পরিবেশের বাসিন্দা হতে বাধ্য হয় তাও এই গল্পের মূল বক্তব্য।

তাঁর প্রতিটি লেখারই বিষয়বস্তু এমন সব রূপকাঙ্গিক কঠিন বাস্তব, যার রসদ কাফকা নিজের জীবনের প্রতি বিন্দু থেকে আহরণ করেছেন। তাঁর বাবা হেরম্যান কাফকা ছিলেন এক অত্যাচারী পুরুষ, নিজের ঘরে প্রায় সন্ত্রাস চালাতেন। তিনি তাঁর জীবনের সমস্ত রাগ আর হতাশা ঝাড়তেন ছোট্ট কাফকার ওপর। ছোটবেলায় বাবার কাছে পাওয়া এসব অত্যাচারের ভয়ংকর স্মৃতি সারা জীবন কাফফাকে তাড়া করেছে। তাঁর সাহিত্য সৃষ্টির মূল রসদ তিনি জোগাড় করেছেন এখান থেকেই যেখানে বাবা ও ছেলের বিরোধ দেখা গেছে, আর দেখা গেছে নিরীহ মানুষ ক্ষমতাশালী কর্তৃত্বের কাছে সব সময় নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ১৯২৫ সালে প্রকাশিত দা ট্রায়াল উপন্যাসেও এই বিষয়টি স্পষ্ট। উপন্যাসের নায়ক জোসেফকে একদিন অকারণে গ্রেপ্তার করা হয় আর দিনের পর দিন তাকে নিয়ে চলতে থাকে বিচারের প্রহসন। জোসেফ কোনদিন বুঝতেই পারল না কেন তাকে গ্রেপ্তার করা হলো বা আইনের জটিল ব্যাখ্যাগুলি আসলে কী।  তার এই অপরিসীম ভোগান্তি আসলে বিচার ব্যবস্থার অসারত্বই ঘোষণা করে। 

জীবদ্দশায় কাফকা  তাঁর প্রতিভার কোন স্বীকৃতি পাননি। তাঁর জন্ম হয়েছিল চেক প্রজাতন্ত্রের প্রাগ শহরে ১৮৮৩ সালে।  বাবা একটা ছোটখাটো ব্যবসা করতেন। কাফকারা ছিলেন ইহুদি, মাতৃভাষা ছিল জার্মান। প্রাগ শহরে এ ধরনের পরিবার সংখ্যায় অল্পই ছিল আর এদের অন্য সবাই ভালো চোখে দেখত না। প্রকৃতপক্ষে ইহুদিদের প্রাগে একঘরে হয়ে থাকতে হত, নিম্নশ্রেণির নাগরিক হিসেবে ছিল তাদের পরিচিতি। ঘরে বাবার অত্যাচার আর বাইরে ইহুদি বলে হেনস্থা কাফকার শৈশবকে দুঃসহ করে তুলেছিল। 

১৯০৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট উপাধির সঙ্গে আইনের স্নাতক হন তিনি। কাজ শুরু করেন আইন বিষয়ক কেরানি হিসেবে ১৯০৪ সাল থেকে। তখনই তাঁর লেখালেখির সূত্রপাত। তাঁর কাজ ছিল শিল্পক্ষেত্রে স্বাস্থ্যহানির বিপদ ও তার আইনগত ব্যাখ্যা সংক্রান্ত রিপোর্ট তৈরি করা। দিনের বেলাটা কাটত তাঁর এইসব কাজে, রাতে কাফকা লিখতেন প্রাণ যা চায়। তাঁর সাহিত্য সৃষ্টির কাজ চলতে থাকে এভাবেই, নিজের আনন্দে। সুদীর্ঘ, কখনো কখনো অদ্ভুত সব কাহিনী লিখতে থাকেন তিনি। ১৯০৭ সাল থেকে ১৯২৩ সাল পর্যন্ত কাফকা বীমা ব্যবসার কাজ করে যথেষ্ট সাফল্য পান। তবে এই সময়েই দুর্ভাগ্যও তাঁকে নানাভাবে ঘিরে ধরে। ১৯১৭ সালে তিনি যক্ষারোগে আক্রান্ত হন। শরীরের রোগ নিয়েও অক্লান্তভাবে কাজ করতে থাকেন। দু’বছর পর অবস্থা আরও শোচনীয় হয় যখন মারাত্মক ইনফ্লুয়েঞ্জা রোগ তাঁকে আক্রমণ করে। একইসঙ্গে প্রকাশকদের কাছ থেকেও তিনি একের পর এক প্রত্যাখ্যান পেতে থাকেন। কেউ তাঁর বই প্রকাশ করতে রাজি হয়নি, পান্ডুলিপি নিয়ে গেলে কপালে জোটে অবজ্ঞা আর অপমান। এতেই সব শেষ নয়, বেশ কয়েকজন মহিলার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেও সফল হননি। এখানেও বারবার জুটেছিল কেবল প্রত্যাখ্যান। শেষপর্যন্ত প্রাগের প্রাচীনপন্থী ইহুদি পরিবারের মেয়ে ডোরা ডায়ামন্টকে বিয়ে করেন তিনি, মৃত্যুর দেড়-দু’বছর আগে। বিয়ের পর তাঁরা বার্লিনে চলে যান।  ততদিনে তাঁর প্রাণবায়ু ফুরিয়ে এসেছে, বিছানায় শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছেন তিনি। শুয়ে শুয়েই নানা পত্রপত্রিকার জন্য লেখা তৈরি করেন আর চিঠির পর চিঠি লেখেন বন্ধুবান্ধব ও প্রিয়জনদের। ১৯২৪ সালে ভিয়েনার কাছাকাছি একটি স্যানাটোরিয়ামে তাঁকে ভর্তি করা হয়। সেখানেই তাঁর মৃত্যু ঘটে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে, মৃত্যুর বাহ্যিক কারণ যক্ষারোগ। 

কাফকার দ্বিতীয় উপন্যাসটির নাম দা কাসেল, প্রকাশিত হয় ১৯২৬ সালে। এটি একটি অসম্পূর্ণ উপন্যাস, কিন্তু সাহিত্য জগতে এর মূল্য অসামান্য। উপন্যাসের নায়কের নাম কে, সে সরকারের জমি জরিপের কাজ নিয়ে একটি ছোট গ্রামে যায় যেখানে একটি রহস্যময় দুর্গ ছিল। কে নানাভাবে চেষ্টা করেও দুর্গের অধীশ্বর ক্লাম-এর দেখা পায় না। দুর্গ আসলে আমলাতন্ত্র, ভালোবাসা, অপরাধ আর আইনকানুনের প্রতীক—- এ সমস্ত বিষয় মিলিয়ে দুর্গ এক এমন পরিবেশ রচনা করে যেখানে ব্যক্তিবিশেষের কোন অস্তিত্ব থাকে না, কে-যে দুর্গে ঢুকতে পারেনা বা ক্লাম-এর দেখা পায় না এটাই তার প্রমাণ। 

এই মাত্র দেড়খানা উপন্যাস, কয়েকটি ছোট গল্প আর কিছু চিঠিপত্র ও ডায়েরি নিয়ে কাফকার সমস্ত সাহিত্যসৃষ্টি—- অধিকাংশই মৃত্যুর পর প্রকাশিত। লেখক বন্ধু ম্যাক্স রডকে মৃত্যুর আগে কাফকা অভিমানে আর হতাশায় বলে গিয়েছিলেন যেন মৃত্যুর পর তাঁর সমস্ত পান্ডুলিপি নষ্ট করে ফেলা হয়। ম্যাক্স রড বন্ধুকে বড়ই ভালবাসতেন, বন্ধুর জন্য অনেক কিছু করতেনও। তবে বন্ধুর শেষ অনুরোধটি তিনি অমান্য করেছিলেন। ভাগ্যিস করেছিলেন, আর তাই আধুনিক সাহিত্য ও সর্বকালের সাহিত্যের অন্যতম সেরা স্থপতিকে পৃথিবী শেষ পর্যন্ত খুঁজে পেল। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *