প্রীতন্বিতা

জেনোর কূটাভাস

জেনো ছিলেন একজন গ্রীক দার্শনিক বা চিন্তাবিদ। তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল অংকশাস্ত্রে। পঞ্চম খ্রিস্টপূর্বাব্দে তিনি এলিয়া অঞ্চলে বসবাস করতেন। বলা হয় যে তিনি ছিলেন সক্রেটিসের শিক্ষাগুরু। কূটাভাস শব্দটির ইংরেজি হচ্ছে প্যারাডক্স, যা প্রচলিত ধ্যান-ধারণার বিরুদ্ধাচরণ বোঝায়।

সুপ্রাচীন কাল থেকেই গ্রীকরা সংখ্যাতত্ত্বের রহস্য নিয়ে মাথা ঘামাতে শুরু করেছিল। তাদের নজরে এসেছিল অসীম সংখ্যাটি। এখনো সাধারণ লোকরা মনে করে যে অসীম সংখ্যা হচ্ছে এমন একটি সংখ্যা যা যেকোনো সংখ্যার চেয়ে বড়।  আসলে অসীম সংখ্যা বা ইনফিনিটি কোন সংখ্যাই নয়, একটি ধারণা মাত্র। তবে এই ধারণা এমনই শক্তিশালী যার থই আজও খুঁজে পাওয়া যায়নি। জার্মান গণিতজ্ঞ ডেভিড হিলবার্ট অঙ্কশাস্ত্রের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছিলেন যে অংকশাস্ত্র হচ্ছে অসীম সংখ্যা সম্পর্কিত বিজ্ঞান। গ্রীকরাও গণিতশাস্ত্রের মূল বিষয় হিসেবে অসীম সংখ্যার গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিল।  অসীম সংখ্যা নিয়ে গ্রীকদের গবেষণা এমন অনেক বিভ্রান্তির জন্ম দিয়েছিল যার সদুত্তর খুঁজে পেতে গণিতজ্ঞরা পরবর্তী দু’হাজার বছর ধরে হিমশিম খেয়ে গিয়েছিলেন। গ্রীকরা অসীম সংখ্যাকে বেশ অপছন্দ করত। অংকশাস্ত্রে অসীম সংখ্যাকে যে কোন মূল্যে এড়িয়ে চলতে চাইত তারা। স্বয়ং গ্যালিলেও পর্যন্ত পরামর্শ দিয়েছিলেন যেন অসীম সংখ্যাকে গণিতের গবেষণা থেকে বাদ দেওয়া হয়। গ্রীকদের এই অসীম সংখ্যা-ভীতি গণিতশাস্ত্রের অগ্রগতিকে অনেকটাই পিছিয়ে দিয়েছিল। 

সুযোগ পেলেই গ্রীকরা প্রমাণ করে দেখাতে চাইত অসীম সংখ্যা কতটা অবাস্তব। এই প্রচেষ্টা থেকেই তৈরি হয়েছিল জেনোর কূটাভাস।  চারটি কূটাভাসের সাহায্যে জেনো দেখিয়েছিলেন যে অসীমত্বের ধারণা ভিত্তিহীন। তাঁর যুক্তি মেনে নিলে স্থান-কালকে কখনোই অসীম বলে ভাবা ঠিক হবে না। 

দৌড়বীরের কূটাভাস, অ্যাকিলেস ও কচ্ছপের কূটাভাস, তীরের কূটাভাস, স্টেডিয়ামের কূটাভাস—- এই চারটি হল জেনোর সুবিখ্যাত কূটাভাস। প্রত্যেকটিই উপস্থাপনার গুণে বেশ আকর্ষণীয় আর হাজার হাজার বছর ধরে পন্ডিতদের বোকা বানিয়েছে। আমরা অনেকেই এগুলি সম্পর্কে কিছু না কিছু জানি। এখানে প্রথম দু’টি কূটাভাস উল্লেখ করা হল। 

দৌড়বীরের  কূটাভাসে জেনো একটি উদাহরণের সাহায্যে দেখিয়েছিলেন যে কোন ব্যক্তি কোন নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছনোর জন্য দৌড় শুরু করে কখনো তার গন্তব্যে পৌঁছতে পারবেনা যদি অসীমত্বের ধারণাটি আমরা মেনে নিই। এই যুক্তি অনুযায়ী দৌড়বীর কেন, কোন ব্যক্তি বা কোন বস্তু কোন অবস্থাতেই কোন সময় তাদের গন্তব্যে যেতে পারবে না।  ব্যাপারটা একেবারেই বাস্তবতা বিরোধী, অথচ যুক্তি না মেনে উপায় নেই। আমি বাড়ি থেকে বার হলাম বাজারে যাব বলে, যদি অসীম সংখ্যার অস্তিত্ব থাকে তো জেনোর যুক্তি অনুযায়ী কোনদিনই বাজারে পৌঁছতে পারব না। বাজারে পৌঁছনো তো পরের ব্যাপার, জেনো দেখিয়েছেন যে অসীম সংখ্যা আছে মেনে নিলে আমার পক্ষে যাত্রা শুরু করাই সম্ভব হবে না। 

দেখা যেতে পারে জেনো কিভাবে এই অবাস্তব ব্যাপারটাকে যুক্তিগ্রাহ্য করে তুলেছেন। মনে করা যাক দৌড়বীর ১০০ মিটার অতিক্রম করবে। প্রথমে তাকে এই দূরত্বের অর্ধেক বা ৫০ মিটার যেতে হবে। তারপর সে যাবে বাকি অংশের অর্ধেক বা ২৫ মিটার। সেটুকু যাওয়ার পর দৌড়বীরকে যেতে হবে বাকি অংশের অর্ধাংশ বা ২৫ মিটারের অর্ধেক অংশ এবং এভাবে দৌড়বীরের সামনে সমগ্র দূরত্বের কিছু না কিছু অংশ অতিক্রম করা বাকি থেকেই যাবে। অনন্তকাল ধরে দৌড়েও দৌড়বীর কিছুতেই ১০০ মিটার দূরত্ব পার হতে পারবে না, সে ক্রমশ কেবল তার গন্তব্যের নিকটবর্তী হতে থাকবে। এই অদ্ভুতরে ব্যাপারটা ঘটছে যেহেতু সসীম দূরত্বকে অসীম অংশে ভাগ করা যাচ্ছে। অসীম সংখ্যার অস্তিত্ব মেনে নিলে এই অবাস্তব ব্যাপারটাকে অস্বীকার করার কোন উপায় নেই।

জেনোর  দ্বিতীয় কূটাভাস হচ্ছে অ্যাকিলেস আর কচ্ছপের দৌড়ের সমস্যা। কচ্ছপ খুব আস্তে দৌড়য়, আর অ্যাকিলেস ছোটে দুরন্ত বেগে। তাদের দু’জনকে একটা দৌড় প্রতিযোগিতায় ছেড়ে দেওয়া হল। অ্যাকিলেস যেহেতু কচ্ছপের চেয়ে জোরে ছোটে, অন্তত দশ গুণ জোরে তাই প্রতিযোগিতার শুরুতে কচ্ছপকে ১০০ মিটার আগে রাখা হল।  আর এখানেই সমস্ত গন্ডগোল। দেখা যাবে, অনন্তকাল ধরে কচ্ছপের চেয়ে দশগুণ জোরে ছুটেও অ্যাকিলেস কোন জন্মে কচ্ছপকে ধরতে পারবে না। ব্যাপারটি বড়ই অবাস্তব। এমন যদি সত্যি হয় তো রাস্তায় কোন গাড়িকে কখনো পিছনে থেকে এসে সামনের গাড়িকে ডিঙিয়ে যেতে দেখা যাবে না। অথচ জেনোর যুক্তি মেনে নিলে অবাস্তব হলেও ব্যাপারটা সত্যি। কিভাবে ?

অ্যাকিলেস যখন ১০০ মিটার দৌড়ে কচ্ছপকে ধরতে যাবে কচ্ছপ ততক্ষণে ১০ মিটার এগিয়ে যাবে। এই ১০ মিটার যতক্ষণে দৌড়বে অ্যাকিলেস, কচ্ছপ সেইসময়ে আরো এক মিটার এগোবে, অ্যাকিলেস তারপর এক মিটার ব্যবধান অতিক্রম করতে থাকলে কচ্ছপ চলে যাবে এক-দশমাংশ আরো সামনে, অ্যাকিলেস যতক্ষণে এই এক-দশমাংশ দৌড়ে কচ্ছপকে ধরতে চাইবে কচ্ছপ ততক্ষণে আরও এক-শতাংশ এগিয়ে যাবে এবং এভাবেই চলতে থাকবে। দেখা যাবে, ইহজীবনে অ্যাকিলেস কখনো কচ্ছপকে ধরতে পারবেনা, কচ্ছপ সবসময়ই একটু হলেও অ্যাকিলেসের তুলনায় এগিয়ে যাবে। সসীম দূরত্বকে অসীম অংশে ভাগ করার জন্যই এই অবাস্তব ব্যাপারটা ঘটবে। 

জেনোর কূটাভাসগুলির সমাধান খুঁজে পেতে পরবর্তী ২০টি শতাব্দী কেটে গিয়েছিল। কেন্দ্রাভিসারী অসীম শ্রেণীর সীমা সংক্রান্ত গণিতের বিশেষ ধারণাটির জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই সমস্যার উত্তর মিলেছে। গণিতজ্ঞরা এই ধারণার সাহায্যে প্রমাণ করে দেখাতে পেরেছেন যে একটি অসীম শ্রেণীতে সীমাহীন পদ থাকলেও সেসব পদের যোগফল সসীম হতে পারে। সীমাহীন সংখ্যা বিশিষ্ট কোন অসীম শ্রেণীর যোগফল যে নির্দিষ্ট সসীম সংখ্যা হওয়া সম্ভব এ ব্যাপারটা জেনো বা অন্যান্য গ্রীক দার্শনিকরা জানতেন না। গণিতের এই সত্যি মেনে নিলে দেখা যাবে, কোন নির্দিষ্ট স্থান-কালকে সীমাহীন অংশে ভাগ করা সম্ভব, তাতে বাস্তবতা বিঘ্নিত হয় না। অ্যাকিলেস আর কচ্ছপের দৌড়ের ক্ষেত্রে যে অসীম শ্রেণীটি পাওয়া যায় তা গণিতের নবাবিষ্কৃত ধারণা অনুযায়ী সমাধান করলে দেখা যাবে যে একটি সসীম দূরত্বের হিসেব আসছে যা ১১১ মিটারের একটু বেশি। অ্যাকিলেস এই দূরত্বটুকু অতিক্রম করলেই কচ্ছপকে ডিঙিয়ে যেতে পারবে। প্রথম কূটাভাসটির ক্ষেত্রে দূরত্বটুকু সসীম, সমস্যা হল সময় নিয়ে। দেখা যাচ্ছে, নির্দিষ্ট দূরত্বটুকু অতিক্রম করতে দৌড়বীরের সময় বেড়ে বেড়ে অসীম শ্রেণী তৈরি করছে। এখানেও অসীম পদবিশিষ্ট শ্রেণীটি এক নির্দিষ্ট সসীম সংখ্যাকে যোগফল হিসেবে দেখাবে আর এই নির্দিষ্ট সময়টুকু পেরোলেই দৌড়বীর গন্তব্যে পৌঁছতে পারবে। 

জেনোর কূটাভাসের সদুত্তর নাহয় মিলল, তা বলে অসীম সংখ্যা নিয়ে অংকশাস্ত্রের সব সমস্যা কিন্তু মিটে গেল না। অসীম সংখ্যা এখনো গণিতে এক বিরাট রহস্য, অধিকাংশ রহস্যের কোন জবাব কবে পাওয়া যাবে কেউ জানে না। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *