অরিত্রী দে
নবম পর্ব
জল-চক্র : পর্ব তিন
নদী তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ’
“এ নদী সে নদী একখানে মুখ,
ভাদুলি ঠাকুরানি ঘুচাবেন দুখ
এ নদী সে নদী একখানে মুখ,
দিবেন ভাদুলি তিনকুলে সুখ”
নদীমাতৃক এই নিভৃত নীড়ের আশায় ব্রতকথা সংগ্রহ করেছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। টলটলে জল ভরা নদী, তার কূল ছাপিয়ে জল আর বাহিত পলি – মাটিকে উর্বর করে সোনার ফসল ফলায়; সাধারণ পল্লীপ্রধান দেশে উপচে পড়ে সুখ। হিমালয়, আরাবল্লী, বিন্ধ্য, সাতপুরা, পশ্চিমঘাট, পূর্বঘাট, নীলগিরি পাহাড়-পর্বতশ্রেণীর প্রাকৃতিক সুরক্ষা কবচ দিয়ে ঘেরা যে দেশে নদী-উপনদী, শাখানদীর শিরা উপশিরা রয়েছে, সে দেশ খাদ্য বিষয়ে পরনির্ভরশীল ছিল এ কথা সাম্প্রতিক কিছু মুষ্টিমেয় বর্গের মধ্যে চর্চিত হতে দেখে মোটেও ভালো বোধ হয়না। আর ভারতে ত শুধুমাত্র জমি না, রীতিমতো আবাদযোগ্য জমি ছিল তার চিরকালীন জলজীবনকে ঘিরে। বুন্দেলখন্ড মালভূমি, পূর্ব ভারতের ছোটনাগপুর ও দন্ডকারণ্য মালভূমি, শিলং, দাক্ষিণাত্য, কর্ণাটক, তেলেঙ্গানা, মালবা মালভূমি এবং উত্তর ভারতের গাঙ্গেয় সমভূমির ওপর দিয়েই নদীদের সংসার। উত্তর ভারতের গাঙ্গেয় সমভূমি পূর্বদিকেও বিস্তৃত হয়েছে। রাজ্যের উত্তরে যেমন হিমালয়ের সুউচ্চ শৃঙ্গ, তেমনি দক্ষিণে উপকূলীয় সমভূমি, পশ্চিমে মালভূমি ও পূর্বদিকে গাঙ্গেয় বদ্বীপ, অর্থাৎ মালভূমি এবং সমভূমির সহাবস্থান দেখা যায়৷ পার্বত্য, মালভূমি ও সমভূমি এলাকা ভেদে ভূমির ঢাল বাড়া কমা অনুযায়ী জলপ্রবাহ, তার ধারণক্ষমতা, ক্ষয়ক্ষমতা ইত্যাদি নির্ভর করে, এ আমাদের সকলের জানা। নদীর উচ্চগতিতে প্রধান কাজ ক্ষয়কাজ, মধ্যগতিতে মূলতঃ বহনকাজ এবং নিম্নগতিতে সঞ্চয়। সিন্ধু নদী কৈলাসের সেনগগে খাবাব হিমবাহ থেকে জন্ম নিয়ে পশ্চিমে প্রবাহিত হয়েছে এবং লাদাখ হয়ে দক্ষিণে বেঁকে পাকিস্তানে প্রবেশ করেছে৷ বোঝা যায় এই নদীর পার্বত্য গতি ভারতের ওপর দিয়ে এবং আরব সাগরের কাছে নিম্নগতিতে সঞ্চয় কাজের মাধ্যমে ব-দ্বীপ তৈরি করেছে। বামতীরে আর ডানতীরে বিছিয়েছে ধানসিঁড়ি, ঝিলম, ইরাবতী, শতদ্রু, বিপাশা, চন্দ্রভাগা, কামেং, মানস, তিস্তা, সঙ্কোশের মত নদী। উত্তরাখন্ড রাজ্যে উৎপন্ন হয়ে গঙ্গা, হরিদ্বার পর্যন্ত পার্বত্য অবস্থা এবং বিহারের রাজমহল পর্যন্ত মধ্যগতিতে সমভূমি অবস্থার মধ্যে দিয়ে গেছে। এরপর পাহাড়ের পূর্বদিক দিয়ে দক্ষিণমুখী হয়ে গঙ্গানদী পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করেছে ও মূর্শিদাবাদের কাছে পদ্মা আর ভাগীরথীতে বিভক্ত হয়ে দ্বিতীয় শাখায় ভাগীরথী-হুগলি বদ্বীপ গঠন করেছে৷ সুদীর্ঘ গতিপথে যমুনা, শোন, গোমতী, ঘর্ঘরা, রামগঙ্গা, গন্ডক, কোশী উপনদীগুলোর নিজের কাহিনী ত আছেই। আবার ব্রক্ষ্মপুত্র চীনের চেমায়ুং দুং থেকে জন্ম নিয়ে আসামের ডিহংয়ে ঘরবাড়ি বানিয়ে বাংলাদেশে পদ্মার সঙ্গে মিশে মেঘনা নামে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে৷ এখন ভারতের ঊর্ধাংশ থেকে কিছু নীচে মধ্যভাগের দিকে চোখ সরালে বোঝা যায় মহারাষ্ট্র, কর্ণাটকের বেশিরভাগ ও অন্ধ্রপ্রদেশের কিয়দংশ নিয়ে গঠিত দাক্ষিণাত্য মালভূমির ঢাল অনুযায়ী মহানদী, গোদাবরী, কৃষ্ণা, কাবেরী প্রভৃতি দক্ষিণ ভারতের নদীগুলি পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়ে গতিপথ রচনা করেছে। ভারতের পশ্চিম উপকূল চ্যুতি যুক্ত হওয়ায় আরবীয় পাতের চাপ প্রতিরোধ করতে গিয়েও পশ্চিম উপকূল পূর্ব দিকে বেঁকে ঢাল যুক্ত হয়। আবার পূর্ব উপকূল অগভীর ও সমতল অংশ, ফলে পূর্ববাহিনী নদীগুলো মধ্যভাগের মালভূমি থেকে উৎপন্ন হয়ে দীর্ঘপথ অতিক্রম করে প্রচুর পলি সঞ্চয় করে সমতলে বদ্বীপ গঠনে সক্ষম। উপকূলের বালুকাময় সমভূমি, গঙ্গার বদ্বীপ অঞ্চল ও সুন্দরবন অঞ্চল এর অন্তর্গত। অন্যদিকে পশ্চিমদিকের ভূমি কঠিন শিলাভিত্তিক। পশ্চিমঘাট, বিন্ধ্য, সাতপুরার গুণে এই দিকের ঢালও খাড়া। ফলে নর্মদা, তাপ্তির মত পশ্চিমবাহিনী নদীগুলো দ্রুতগতিতে মোহনায় পড়ে সঞ্চয়কাজের সুযোগ পায়না, এমনকি বহনও করতে পারেনা বেশি কিছু। বোঝা যায় নদীর স্বল্পতা ও ভূ-প্রাকৃতিক কারণে পূর্বদিকের তুলনায় পশ্চিমদিক অনেক বেশি পাথুরে, রুক্ষ ও শুষ্ক। এই এলাকাগুলির কথা মাথায় রেখে পূর্ববাহিনী নদীগুলির কয়েকটির গতিপথ পশ্চিমবাহিনী করার কথা ভাবা হচ্ছে। এখান থেকে শুরু হয় আরেক প্রসঙ্গের- প্রাকৃতিক জলবন্টন প্রণালীকে দম্ভ ভরে পরিবর্তন করার চেষ্টা।
আগে জলব্যবস্থা যে গ্রামগত ভাবে সম্মিলিত প্রচেষ্টার অন্তর্গত ছিল, তাকে কেন্দ্র করে কিছু চর্যা ছিল, সেসব প্রশাসনিক আওতাধীন হওয়ায় বর্তমানে জলব্যবস্থা কয়েকটি সরকারি প্রকল্পের আওতাধীন হয়েছে মাত্র। পূর্বেই জেনেছি গ্রামে কুন্ড বা পুকুর তৈরি করা হলে প্রস্তুতকর্তা তার দায়িত্ব দিতেন গোটা গ্রামকে, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার দায়িত্ব থাকত ঐ পুকুর বা কুন্ডের সামনে বাসকারী পরিবারের। কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতবর্ষে জল নিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণতার বদলে দেখতে হল জল’কে কিভাবে সমান ভাবে ভাগ করে দেওয়ার সম্পত্তিতে পরিণত করেছি। কাবেরী নদীর খরাপ্রবণ অববাহিকার ৩৬.৯০ শতাংশ এলাকা তামিলনাড়ুতে এবং ৬৩.১০ শতাংশ কর্ণাটক রাজ্যে অবস্থিত। সুতরাং পানীয় জল ও কৃষিতে জলসেচের পর্যাপ্ত জোগানোর জন্য দুটি রাজ্যের মধ্যে জল বন্টন নিয়ে বিবাদ ঘটলো। যে এলাকায় নদী অববাহিকার বেশিটা বর্তমান, সেই এলাকা দাবি করল নদীর অতিরিক্ত কিউসেক জল। কৃষ্ণা নদী মহারাষ্ট্র কর্ণাটক তেলেঙ্গানা অন্ধ্রপ্রদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় কৃষিকাজের জন্য জল সেচ ও পানীয় জলের উৎস জন্য এই চারটি রাজ্যকে অনেকাংশে কৃষ্ণার উপর নির্ভর করতে হয়। ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে কৃষ্ণা জল বন্টন সংক্রান্ত প্রথম ট্রাইবুনালের চুক্তিতে ৫৬০ বিলিয়ন কিউসেক, কর্নাটকের জন্য ৭০০ মিলিয়ন কিউসেক ও পূর্বতন অন্ধ্রপ্রদেশের জন্য ৪০০ বিলিয়ন কিউসেক জল নির্ধারিত হয়। কিন্তু ২০১৪ সালে অন্ধ্রপ্রদেশ ভেঙে তেলেঙ্গানা রাজ্য তৈরি হলে কৃষ্ণার জল বন্টন নিয়ে নতুন করে বিবাদ তৈরি হয়। একইভাবে গোদাবরীর জল নিয়ে চারটি রাজ্যের মধ্যে বিবাদ শুরু হলে পচামপাড়ু বাঁধ তৈরি করে এই বাঁধের ঊর্ধ্ব অববাহিকা ও নিম্ন অববাহিকার জল কে দুটি অংশে ভাগ করে বিলির ব্যবস্থা করা হয়। ইরাবতী, বিপাশার জল নিয়ে পাঞ্জাব ও হরিয়ানা আর নর্মদার জল নিয়ে গুজরাট, মধ্যপ্রদে, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান বিবদমান। সিন্ধু তার উপনদীগুলো নিয়ে যে নিম্নগতিতে পাকিস্তান হয়ে আরব সাগরে পড়েছে, তাতে তার জলবন্টন নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বোঝাপড়ার অভাব হচ্ছে। ভারত পরিমাণে কম জল পাচ্ছে ভাগে আর এই নদী অববাহিকাটি থর মরুভূমি সংলগ্ন হওয়ায় সেচের একমাত্র উৎস। শুধুমাত্র দলাদলির কারণে সিন্ধুর গতিপথ কৃত্রিমভাবে পরিবর্তন করার কথা ভাবা হচ্ছিল! আবার ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সর্ববৃহৎ জলবন্টন সংক্রান্ত কমিশন আছে। গঙ্গা নদীর সামান্য অংশ পশ্চিমবঙ্গে অবস্থান করলেও তার মূল শাখা নদী পদ্মা বাংলাদেশের অন্তর্গত এবং বাংলাদেশের কৃষি কাজের অধিকাংশ পদ্মার উপর নির্ভরশীল। নিয়ম অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে গঙ্গা নদীর উপর ফারাক্কা ব্যারেজ নির্মাণের ফলে প্রয়োজনীয় জলসেচের খুব সামান্য অংশই বাংলাদেশ সরকার পায়। আবার তিস্তা নদীর নিম্নগতি বাংলাদেশ, এখানে এই নদী ব্রক্ষ্মপুত্র তথা যমুনার সঙ্গে মিলিত হয়েছে। ফলে সম পরিমাণ জলের দাবি নিয়ে দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে দড়ি টানাটানি খেলা চলছে, যে জিতবে জল তার। যে জল আমাদের প্রাকৃতিক ধন-সম্বল, তা কি করে যেন একদিন এরকমভাবে ভাগযোগ্য সম্পত্তিতে পরিণত হয়ে টুকরো হয়ে গেল! এই যে গঙ্গা-সিন্ধু-ব্রক্ষ্মপুত্রের লীলাভূমি, এখানেই গত কয়েক বছরে মজে গেছে একের পর এক অসংখ্য নদী। অবৈজ্ঞানিক কার্যকলাপে, অত্যাধুনিকতার দম্ভে পালটে দিতে চেয়েছি নদীর প্রাকৃতিক গতিপথকে। ইতিমধ্যে প্রায় সবাই জানেন, জলপাইগুড়ি জেলায় ডুয়ার্সের অন্যতম বড় নদী মাল-এর গতিধারার মাঝখানে মাটি পাথর ইত্যাদি দিয়ে আড়াআড়ি বাধা নির্মাণ করে পাশে খুঁড়ে দেওয়া নতুন ধারাতে দুর্গাপ্রতিমা বিসর্জনের ব্যবস্থা হয়েছিল। তা সেই বিসর্জনের বেশ কিছু আগে থেকেই বৃষ্টিপাত হচ্ছিল, হঠাৎ নদী বেয়ে ঝড়ের গতিতে বিপুল জল নেমে আসলে কয়েক মিনিটের মধ্যে কোনও প্রস্তুতি নেওয়ার আগেই প্রচণ্ড ধারার মুখে সব ভাসান আয়োজন ভেসে যায়। নদীর যাতায়াতের পুরোনো জায়গা নদী কখনও ভোলে না, সে ইচ্ছেমত সেই খাত দিয়ে একদিন বয়ে যেতে পারে, নদীরও হাত পা ছড়ানোর ইচ্ছে হতে পারে তার তীর বরাবর। সেসব ভাবনাকে তুড়ি দিয়ে বা ‘কব্জা করতে পারব’ ভেবে উড়িয়ে দেওয়া গেছে। ‘হড়পা বান’ ডুয়ার্সের নদীগুলির স্বভাব। মধ্য বা নিম্ন হিমালয়ে প্রচুর বৃষ্টিপাতের জল এরা তীব্রধারায় নীচে অপেক্ষাকৃত সমতলে পৌঁছে দেয়। ঢাল কমে আসার দরুন সমতলে জলস্রোতের তীব্রতা হ্রাস পায়, তা অনেকটা জায়গা ধরে ছড়িয়ে স্বাভাবিক বন্যার কারণ হয়। সমতলে নেমে আসা এই জল গচ্ছিত থেকে হিমালয়জাত নদীদের প্রবাহকে অক্ষুণ্ণ রাখে। কিন্তু প্রকৃতির সূক্ষ্ম শৃঙ্খলাকে বোঝার চেষ্টামাত্র না করে প্রযুক্তিদম্ভ দেখিয়ে ফেলেছি প্রবল ভাবে। এর মর্মান্তিক ফলশ্রুতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা ভাবতেও গা শিউরে ওঠে। আর যাই হোক মানুষের নৃতত্ত্বগত বিচারে যে হাত তার প্রধান প্রযুক্তিবল, তা দিয়ে জলকে কোনোদিন ধরা যায়নি আর যাবেওনা, তাকে ক্রমাগত বইতে দিতে হয়।
১৯৭১ সালে বিশ্বব্যাপী জৈবপরিবেশ রক্ষার সম্মিলিত প্রয়াসের ফলশ্রুতিতে ইরানের রামসারে জলাভূমি নিয়ে আন্তর্জাতিক চুক্তি হয়। কোনো অঞ্চল প্রাকৃতিক বা প্রায় প্রাকৃতিক বিরল অথবা অন্যান্য উদাহরণ যুক্ত জলাভূমি কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠলে সে জলাভূমি আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয়। উলার লেক, ভেম্বনাদ কয়াল জলাভূমি, রেনুকা হ্রদ, চিল্কা হ্রদ সহ ভারতের রামসার সাইট ঊনপঞ্চাশ টি। পশ্চিমবঙ্গের দশটি রামসার সাইটের মধ্যে সুন্দরবন ও পূর্ব কলকাতার জলাভূমি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভের তুলনায় জলাভূমিসংক্রান্ত সমস্যাই মূল। সাম্প্রতিক গবেষণা অনুযায়ী সুন্দরবন উপকূল অঞ্চলের মাটি ক্রমান্বয়ে বসে যাচ্ছে, কিন্তু বেড়ে চলেছে সমুদ্রের জলের উচ্চতা। সঙ্গে সুন্দরবন এলাকার নদীগুলিতে ধারাবাহিক পলি জমার কারণে জলধারণ ক্ষমতা কমছে। বাঁধ নির্মাণে প্রচুর টাকা যাচ্ছে অথচ প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতিতে জর্জরিত হয়ে পড়ছে উপকূলের নদী, সমুদ্র-বাঁধের গুণগত মান। আবার পূর্ব ভারতের জলাভূমি কলকাতা শহরের কিডনির মত কাজ করে জানি। ভৌগলিক ভাবে কলকাতা ভারতের অন্যতম নিচু শহর, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাপলে চার-পাঁচ মিটারও হবে না। কলকাতার পশ্চিমে গঙ্গা, অথচ শহরের ঢাল পূবে। প্রতিদিন শহরে প্রায় সাতশো মিলিয়ন লিটার তরল বর্জ্য উৎপন্ন হলেও সেগুলো সব, এমনকি বৃষ্টি হলেও জল না জমে পূর্ব কলকাতার জলাভূমিতে পড়ত। আটের দশকের একজন সরকারি অফিসার ধ্রুবজ্যোতি ঘোষ চারিদিকে অনুসন্ধান চালিয়ে কলকাতার বর্জ্য জলের নিকাশি কোথায় খুঁজে বের করেন। ৯৫ শতাংশ জল এবং ৫ শতাংশ জীবাণু নিয়ে বর্জ্যজল পূব কলকাতার বিশাল জলাভূমিতে পড়ে শৈবাল ও মাছের খাদ্যে পরিণত হয়। ফলে স্রেফ প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রেই সূর্যালোকের অতিবেগুনি রশ্মির সাহায্যে ও সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়ায় পুরো জল পরিশুদ্ধ অবস্থায় চলে আসে, বিপুল মাছের ভাণ্ডার তৈরি করে—পুরোটাই সম্পূর্ণ বিনামূল্যে—বিন্দুমাত্রও শোধন করাতে হয় না! ১৯৯০ সাল নাগাদ জ্যোতিবাবুর সরকার ঘোষণা করেন—ওই জলাভূমি বুজিয়ে একটা বিশাল বড় বাণিজ্যকেন্দ্র স্থাপন করা হবে। ধ্রুবজ্যোতি বাবু ও PUBLIC নামের এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের দ্বারা হাইকোর্টে মামলা করে বন্ধ করা হয় এই রায়। প্রায় তিরিশ হাজার মানুষের জীবিকা সরাসরিভাবে জড়িত এই জলাভূমির সঙ্গে। আজও আমরা জানিই না, রোজ গরম গরম ভাতের সঙ্গে পাতে যে মাছের ঝোল বা ঝাল খাই, তার বেশিরভাগটাই আসে আসলে এই জলে গড়ে ওঠা ভেড়ি থেকে। পাশাপাশি, বিপুল পরিমাণ শাকসবজির জোগান দেয় এই এলাকা। স্রেফ এই কারণেই ভারতের সমস্ত মহানগরের মধ্যে বাজার খরচের ব্যাপারে সবচেয়ে সস্তা আমাদের কলকাতা। বিপুল পরিমাণ অক্সিজেনের জোগানও দেয় এই জলাভূমি। কার্যত একটি পয়সাও খরচ না করে দূষিত জল নিয়ে সে ফেরত দেয় টাটকা জল, মাছ, শাকসবজি, অক্সিজেন। এবং যে বিপুল পরিমাণ জলে প্রতিদিন ভেসে যেতে পারত কলকাতা, তার বেশিরভাগটাই টেনে নেয় এই জলাভূমি, তারপর অবশিষ্ট চলে যায় বিদ্যাধরী নদীতে। তাই অন্তত বছর দশেক আগে অবধি মুম্বই বা চেন্নাই নিয়মিত বন্যায় ভেসে গেলেও দিব্যি টিকে যেত কলকাতা। আজ ভেঙে পড়েছে পুরো ব্যবস্থাটাই। চলছে যথেচ্ছ প্রোমোটিং, জলাভূমি ভরাট, নগরায়ণ। চলছে দূষণ। ফলে নজিরবিহীন সংকটের মুখে পূর্ব কলকাতার এই জলাভূমি। প্রকৃতি সামান্য রুষ্ট হলেই আজ ভেসে যাচ্ছে কলকাতা। জমা জলে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে, জলবাহিত ও মশাবাহিত রোগ বাড়ছে। নদীয়ার বুক থেকে জলঙ্গী প্রায় উধাও। জলঙ্গী মূর্শিদাবাদে গঙ্গার শাখানদী হিসেবে রয়েছে, আবার ভাগীরথীতে মিশে তার নিম্নভাগকে শক্তিশালী করেছে রীতিমতো। এই জলঙ্গী আর চূর্ণীর (রাণাঘাটে) মধ্যে সংযোগ ঘটায় অঞ্জনা। বিসর্জন ঘাট হিসেবে ব্যবহৃত হতে হতে, পাশে ইটভাটা গজিয়ে উঠে এবং শহরের অরক্ষিত নিকাশী নালা নদীর জলের সাথে সংযুক্ত থাকার ফলে দুই নদীই মজে গেছে। নদীয়ার এই দিকটায় মৎস্য চাষীরা সংখ্যায় বেশি, অথচ মাছের ঐতিহ্য শেষ। অঞ্জনায় পলি পড়ে চর তৈরি হয়ে গেছে। যে অঞ্জনা কৃষ্ণনগরের মাঝখান দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সৌন্দর্য বিধান করত, সেই অঞ্জনা আর নেই। আমরা শহর গড়তে গিয়ে ভুলে গেছি জলাভূমিও শহরের সৌন্দর্য্য বিধান করতে পারে, তাকে নিয়েও শহরের সংস্কৃতি হতে পারে। আসলে প্রকৃতি’র মধ্যেই আমরা, ‘আমি’র দাম্ভিকতায় সেখানে সম্পর্ক বানাতে গেলে হবেনা, দরকার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা।