শরদিন্দু সাহা
বাংলা কথা সাহিত্যের সুপরিচিত লেখক শরদিন্দু সাহা। লেখক সত্তা ও জীবনকে বিচ্ছিন্ন করে দেখতে তিনি অভ্যস্ত নন। নিছক লেখক হওয়ার জন্য তিনি কলম ধরেননি, সামাজিক দায়বদ্ধতাই তাঁকে সৃষ্টিকর্মে উদ্বুদ্ধ করে। শৈশব থেকে সৃষ্টিশীল মন লালন করে প্রস্তুতি পর্ব সারলেও নয়ের দশকের গোড়া থেকে তাঁর লেখালেখি শুরু। এ-পর্যন্ত শতাধিক গল্প, গোটা কয়েক উপন্যাস এবং অন্যান্য গদ্য মুদ্রিত হয়েছে। দশটি উপন্যাস আর সাতটি গল্পগ্রন্থ সহ মোট গ্রন্থের সংখ্যা ষোলো। ১৯৯৮ সালে ‘কাটোয়া মহকুমা গ্রন্থাগার পুরস্কার’ পান। ২০০৪ সালে ‘পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি প্রদত্ত সোমেন চন্দ পুরস্কার’ পান। ওই বছরেই কাটোয়া লিটল ম্যাগাজিন মেলা কর্তৃক সংবর্ধিত হন। ইন্ডিয়ান অয়েল কর্তৃপক্ষ তাঁকে ‘হল্ অব্ ফেম’-এ সম্মানিত করেন। ২০০৫ সালে ‘ভাষা শহিদ বরকত স্মরণ পুরস্কার’ পান। ২০০৭ সালে সাহিত্য আকাদেমি’র আমন্ত্রণে গৌহাটিতে বাংলা-অসমীয়া গল্পকার সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। ২০১৩ সালে ‘আমি’ পত্রিকা তাঁর সাহিত্যকর্মের জন্য বিশেষ সম্মান দেন। প্রসার ভারতী’র আমন্ত্রণে নানা সময়ে সাহিত্য-সংস্কৃতি অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহণ করেছেন। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, মিলিয়ে অনেক উল্লেখযোগ্য সাহিত্য পত্রে ও ওয়েব ম্যাগাজিনে লিখে চলেছেন। ইতিমধ্যেই নিজস্ব এক ঘরানা সৃষ্টি করে তিনি পাঠকের মন জয় করেছেন।
(নিত্য সমাজ সংসারের যে স্রোত আমরা চাক্ষুষ করছি তার অন্দরমহল জুড়ে ঘুমিয়ে রয়েছে কত তো কথাকাহিনী, যার পরতে পরতে তন্দ্রাচ্ছন্ন থাকে গোপনে কত তো নারীর জীবনযন্ত্রনা, ধারক বাহক হয়ে গোটা সমাজকে যাঁরা ছাতার মতো আগলে রেখেছে, নিজের পরিচয় খুঁজে নিয়েছে, সকল ঝড়ঝঞ্ঝা থেকে দিচ্ছে মুক্তি যুগ যুগ ধরে। কয়জনের কথাই বা আমরা মনে রাখি। তাঁদের গোপন ব্যথা, অনুচ্চারিত কথা গুমড়ে মরে যায়, চোখের জল কেউ মুছিয়ে দেয় না, গণ্ডীবদ্ধ শৃঙ্খলিত জীবনই তাঁদের বেঁচে থাকার একমাত্র ভরসা। এমনই এক সাধারণ গ্রাম্য নারীর কথকতা ও চেতনায় চেনা জীবন ও সমাজপিষ্ট অব্যক্ত যন্ত্রনার পাঁচালি ‘দেশের গর্ভে স্বদেশ’ উপন্যাস।)
হায়ের তলায় মাঢি সরে
দ্যাশের মাইনষে কাঁদি মরে
ঢেউয়ের হরে ঢেউ আইয়ের, বেগ্গাইন ধুই মুছি লই যাইব মনে হর। এইবারের ঢেউয়ের রঙটা লালচে রংয়ের। এমনটা কেন হর বুঝি উইঠতাম হারিয়েন না। শহর তুন মোতালেব মিঞা অনেকদিন বাদে গ্ৰামে ফিরছে। চোয়ে মুয়ে এক অজানা আতঙ্ক। আঙ্গ বাড়ির দরজার সামনে আই খোঁজ খবর লর কে কেমন আছে। বড্ড দিলদরিয়া মনের মানুষ। ভালোবাইসতে যেমন জানে, গাল দিতেও ছাড়ে না। আহারে কতদিন বাদে আইছে। মোতালেব মিঞা কাঁচারি বাড়িতে আই বয়েন না। এক গ্লাস জল আর গুড় দিই চাট্টি মুড়ি খান। আগে তো কতবার আঙ্গ বাড়িতে আইতেন, এখন এতো লজ্জা হানের কিয়ের লাই। ‘না গো বইন, লজ্জা হাইয়ুম কিয়ের লাই ! আমনেদের লগে কত কালের সম্পর্ক, শহরে চাকরি করি বলি হিগাইন ভুলি যাইয়ুম এইঢা ক্যামন কথা কন দেহি।’ চারধারে শোরগোল হোনা যার। আমনের কাছে কোনো খবর আছে নি! বড় ভয় ভয় লাগে। কোন মুই তুন আগুন ছড়ায় কে কইত হারে। ‘এইডা আমনে দিদি ভুল কন ন। দ্যাশের অবস্থা অন হালটি যার। বুকের মধ্যে ধুকপুক করের হারাক্ষণ। ছাত্ররা টগবগ করি হুঢের।’ হেইডা তো আমনেরে দেই বুইঝতাম হাইরছি। মুখটা কেমন হুয়াই গেছে। আগে যন গ্ৰামে হিরতেন, মনে হইত হাঁঢেনেন না, দৌড়ানের। কত কত সুখের কথা মন খুলি কইতেন। আঁর অন কেমন বেজার মুখ। হুইনছি শেখ মুজিবুর যে আগের বছর ছয় দফা দাবি পেশ কইরছে, বেগ্গাইন ফের উথলাই উইঠছে বুঝি। ছাত্রগো এগারো দফা যোগ হইছে হের লগে। কী রে হর, এই আন্দোলন কোন দিকে যে যাইব কে জানে। মোতালেব মিঞা আমনে জানেন নি? চুপ করি থাইকলে তো হইত না। ভেতরের কথাগাইন জাইনত হইব, না হইলে দুনিয়াদারি চইলব ক্যামনে! দ্যাশটা স্বাধীন হইল কত আশা লই, মাইনষে আর না খাই মইরত ন, মন খুলি কথা কইরত হাইরব, যিয়ানে খুশি যেমনে খুশি যাইত হাইরব, গোরা সৈন্য আর গুঁতাইত ন। ওমা হুরাঢাই উল্টি ছারখার হই যার। এই আমরা কোন দ্যাশে আছি, নিজের দ্যাশ, না হরের দ্যাশ! মানুষগুনরে কথা কইত গেলে ধরি ধরি হাতকড়া হড়ার। ছালিমাটির সরকার, কোন তুন আইল, এই যে দ্যাইখছি পরাধীন দ্যাশের তুন খারাপ। মোতালেব মিঞা আঁর কথা হুনি ভুরু কুঁচকায়, কয়, ‘ দিদি এই কথাখান আমনে ষোল আনা হাঁচা কথা কইছেন।’ দ্যাশের মাইনষে আর সুখে নাই, ছিল সিংহের রাজত্বে অন আই হইড়ছে বাঘের খাঁচায়।
মোতালেব মিঞার মাথায় যে এত কথা জমা ছিল এত কথা কী আঁই জাইনতাম। দুঃখে দুঃখে হরান যায়। আরও গ্ৰামের মানুষ যারা রুটি রোজগারের আশায় আশায় শহরে ছুটি গেছিল, একে একে ঘরে হিরের। কারণটা প্রথমটায় বুইঝতাম হারি ন, হরে হরে বুইঝলাইম হুরা শহর জুড়ি কারফিউ জারি হইছে, কোনও আন্দোলন টান্দোলন চইলত ন, পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের হুকুম তামিল করাই নাকি এই প্রাদেশিক সরকারের কাম। ‘পাঞ্জাবীদের ষড়যন্ত্র হুরাটা ধরা হরি গেছে, আর বোকা বানাইত হাইরত ন,বুইঝলাইম দিদি, এইবারে যা হইব সব সামনাসামনি হইব, দরকার হইড়লে রাস্তায় নামি সংগ্ৰাম কইরত হইব।’ মিঞা তুমি দেইখছি কত কিছু জানি বুঝি হালাইছ, ক্যমনে শিখলাম তুমি এইসব! ‘কী যে কন দিদি, এইসকল কথা কই আর লজ্জা দিয়েন না। যদি কিছু শিখি থাকি, তবে মাইনষের তুন শিখছি, মাইনষের চলা বলাই আঁরে সব শিখাই দিছে।’ আঁর বুইঝতে বাকি রইল না, এই দ্যাশের লোকের জীবন বড় সঙ্গীন হই আইছে, একটা বাজ ভাঙি তো হইরবই। জ্বালা ধরছে গ্ৰামের মাইনষের মনেও। আজকাইল আবার গণতান্ত্রিক সংগ্ৰামি পরিষদের লোকেরা মাইকে করি রাস্তার মোড়ে মোড়ে মাইনষেরে মিটিং মিছিলে যাইবার লাই ঘোষণা করি যার। একবার না হুইনলাম দুইবার, দুইবার না হুইনলে তিনবার। শহরের নেতারা যেমন করি কয়, হেরাও তেমন করি কয়, ময়না হাখির বুলির মতো – এই সরকারের আদেশ আমরা মাইনতাম ন, মাইনতাম ন। দেশরক্ষা আর বিদেশ নীতি ছাড়া বাকি ক্ষমতা অঙ্গ-রাষ্ট্ররে দিত হইব। ছয় দফার স্বীকৃতি দিত হইব, না হইলে আন্দোলন চইলব। হেথাগো হক্কল কথার অর্থ আঁই বুঝি না। তবে আগুন যে জ্বইলব, এইটা হরিষ্কার। গ্ৰামের মাইনষে বুইঝত হারের বালিতে মুখ গুঁজি হড়ি থাইকলে আর চইলত ন। হেথেনরা আরও বুইঝত হাইরল যেমন পরাধীন হেরা ছিল আগে তেমনই আছে, শুধু জায়গাটা হাল্টি গেছে, ব্রিটিশরা আর লণ্ডন শহর যাই পাঞ্জাবীরা আর রাওয়ালপিন্ডি শহরে আইছে। কত কথা আই মাথা চাড়া দেয়, ভারত ভাগ না হইলে কি এমন সর্বনাশ হইত। এখন দ্যাশটা কোন মুই যাইব আর কারাই হাল ধরইব কিছুই তো বুঝন যায় না। হায় হায় রে বাঙালি জাতের কী দুরবস্থা! এর তুন মুক্তি ক্যামনে মিলব। এই কথাখান লই আঙ্গ ঘরে আঁর স্বামী আর মাইয়ার সঙ্গে কথা কাটাকাটি। হেথেনের কয়, ‘কিছুদিনের গন্ডোগোল, দেইখবানি সব ঠিক হই যাইব, এই দ্যাশের দাবিগাইন পশ্চিম পাকিস্তানের সরকাররে আইজ না হয় কাইল মানি লইত হইব।’ হেথেনের কথাগাইন মানতাম হাইরলাম না। আন্দোলন সংগ্ৰাম যে হতে আগার, শেখ মুজিব যেইভাবে ক্ষেপি গেছে একখান ফয়সালা করি ছাইরব। মুজিব তো কই দিছে আঙ্গরে এই পূর্ব পাকিস্তান চালাইবার অধিকার দিত হইব, আঙ্গ প্রদেশ তুন হক্কল কিছু লুটি লই যাইবা এঢা আমরা হইতাম দিতাম ন। হুঁশিয়ার খাই হেথাগো কী দশা হয় একবার দেখেনই না। আঁই মাইয়া মানুষ হইতাম হারি, কথাগাইন ভাবি দেইখবেন।
ইসকুল তুন দল বাঁধি ছাত্ররা ঘরে আইবার সময় হেগুনে নিজেদের লগে কত কথাই না বলাবলি করে। হিগাইন আঙ্গ বাড়ির হোলারা আঁরে আই কয়। হেগুনে নিজেরাও ফুসুর ফাসুর করে। কথার মধ্যে কতগাইন নতুন শব্দ উড়ি আই জুড়ি বয়। কারে যে কী কমু, এক নতুন উত্তেজনা আই আঁর মধ্যে চাপি বয়। হেগুনরে জিগাই তোরা ইগাইন কোত তুন শিখছস ? ‘ উঁচা ক্লাসের দাদারাই তো আঙ্গরে হোনাই হোনাই হক্কল কথা কয়।’ কী কয় ওরা ? ‘কয় ১৪৪ ধারা হাল্টাইত হইব, ভাষা আন্দোলনে যাগোরে জেলে ঢুকাইছে হেগোরে মুক্তি দিতে হইব, বাংলারে সরকারি ভাষা কইরত হইব, পুলিশের অত্যাচারের তদন্ত কইরত হইব আরও কত দাবির কথা কয়, জোরে জোরে কয়, গলা হাঢাই কয়।’ তোগো হড়ালেয়া বন্ধ করি বুঝি তোরা হিগাইন হোনস। ওগো কথা হুনি বুইঝলাইম দ্যাশ জুড়ি যে আগুন জ্বইলছে হের আঁচ আই হইড়ছে ইস্কুলের ছাত্রগুনের ভিতরে। কখন না এগোরে ডাকি না চলি যাই, এদের আগলাইয়ুম কী করি। বড় একখান চিন্তা আই চাপি বইছে। হেগুনরে সাবধান কইরলেও কি আঁর কথা হোনে। উল্টা কথা হওনআয় আঁরে। সব্বনাশের কথা, ‘ দ্যাশের কামের লাই ডাক দিলে যাইতানন বুঝি।’ মনে মনে ঠিক করি হালাইলাম হেগুনের বাপ মায়ের লগে ভালা করি কথা কইত হইব। ওগোরে যদি মিছিলে ডাক দিই লই চলি যায়, তন কী হইব! পাঞ্জাবীদের বিশ্বাস নাই কখন মিছিলে গুলিগালা চালাই দিব, বেঘোরে হরান যাইব। হেগুনে আঁরে সান্ত্বনা দেয় ‘এত চিন্তা করিয়েন না তো জেঠি’। এগুনেরে আঁই একসময়ে হড়াইছি, অন কত বোঝনদার হইছে। শুধু কী ওরা, অন্য গ্ৰামের হোলারাও একই সুরে কথা কয়। আঙ্গ বাড়িতে যেগুনে কামকাজের সুবাদে আইয়ে, হেগুনের কথাতেও পাঞ্জাবীদের আঙ্গ দেশ কব্জা করি রাইখবার কথা চালাচালি হয়।
আঁর স্বামী দুঃখ করি কয়, ‘ওরিও হুইনছনি দেশের অবস্থা দেই একটা কথা মনে হড়ের বারে বারে। ১৯৪৮ সালে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র কথাখান, ২১শে মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কইছিলেন, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’। সেইদিন প্রতিবাদে হাঢি হইরছিল আঙ্গ দেশের লোক। আঁর অনুমান কইরতে অসুবিধা হয়নি এর ফল ভালা হইব না, হেথাগোরে এই সিদ্ধান্তর ফল ভোগ কইরত আজ না হয় কাইল, দ্যাশের লোক এই কথাখান কিছুতেই মানি লইত ন। আইজ দেইখছনি দ্যাশের লোক কিরকম ক্ষ্যাপি গেছে। বেবাক শহরে মাইনষে রাস্তায় নামি মিছিল কইরছে, শ্লোগান দের, পাঞ্জাবীদের হুকুম মাইনতে অস্বীকার করের, বাঙালিদের লগে বৈষম্যর বিরুদ্ধে নেতারা জোটবদ্ধ হর। আঙ্গ অফিস আদালতেও আন্দোলনের আঁচ লাইগছে। মাইনষে দিশাহারা কে কোনদিকে যাইব বুঝি উঠতি হারেন না।’ স্বামীর কথাগাইন হুনি আঁর ভেতরটা গুলাই উইঠল, বমি বমি ভাব হইল, গা গুলাই উইঠল। পাঞ্জাবীদের এমন ব্যবহারে মনটা বিষাই উইঠল। ভাইবলাম এইঢা তো সহজে শেষ হইবার বিষয় নয়। এর পরিণামের কোপ আই হইড়ব আঙ্গ মতন ছাপোষা গ্ৰাম গঞ্জের মাইনষের উপর। পাঞ্জাবীরা যা বজ্জাত, ওরা তো ছাড়ি কথা কইত ন। রোজই তো হুনিয়ের ওরা একটা কড়া জবাব দিব। আঙ্গ এদিকে খবরের কাগজ আইয়ে না। কেউ কেউ মাঝে মাঝে ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ পত্রিকা দূর তুন লই আইয়ে। আঁর স্বামীও শহর তুন আসার সময় আনে। বাড়ি ঘরের কামে হড়ার সময় করি উঠতি হারি না। একটা সুবিধা হইছে অন আঁর দ্যাশের খবর জানার আগ্ৰহ দেই একখান রেডিও কিনি আইনছে। কী আনন্দ যে হইছে, বইলতাম হাইরতাম ন। উল্টা কামও হইছে। আঙ্গ বাড়ির বউঝি হোলামাইয়ারা জড় হই উঠানে বয় আর কান খাড়া করি খবর হোনে। কত কথার অর্থ জাইনত বুইঝত চায়। দ্যাশের হালচাল হেগুনে বুঝি উইঠত হারে না। কোন দিকে যে জল গড়াচ্ছে কইত হারে না। গন্ডোগোলের ভয়ে ঠক ঠক করি কাঁপে। হেগুনে কোনোদিন ঘরের বার হয় না। বইয়ের হাতা উল্টাই দেয় নি। বিচারবুদ্ধির কোনো বালাই নেই। ঘরের কোনায় ঢুকি থায়। কেন্নে দ্যাশের হালচাল বুইঝব। আঁরে খোঁচাই খোঁচাই জাইনত চায় ‘তা হইলে কি দ্যাশটা উচ্ছন্নে যাইব? দ্যাশের জনগণের কি দশা হইব? ইসকুল কলেজ হক্কল কিছু বন্ধ হই যাইব। দিদি গো আমরা কি মাঠে মারা যাইয়ুম?’ হেগো আগ্ৰহটা বাড়ি যাইতে আঁর বেশি মুশকিল হইল। কিছুতেই কিছু বুঝাইতাম হারি না কী উত্তর হাইলে ওরা সন্তুষ্ট হইব। এইটা বুইঝতাম হারিয়ের জল যখন গড়াইছে এর একখান বিহিত হইবই। কত শত হথ আছে, কোন হথটা আসল আর কোন হথটা নকল, আঁর বাপের সাধ্য নাই বুঝার, কি বোঝানোর। একদিন হইল কি, হুরা গ্ৰামের লোক আঙ্গ উঠানে আই হাজির দল বাঁধি। ভিড়ের ধাক্কার চোটে ভাঁড়ার ঘরটাই হুড়মুড় করি ভাঙ্গি হড়ি গেল। আঁর জেঠাহৌড় তো রাগিমাগি অস্থির – হ্যাঁরে এইঢা তোরা কী করলি? উন্মাদের মতো কোনো কামই ভালা নয়। দ্যশের মাইনষে অস্থির হইছে বলি তোরাও অস্থির হবি। চাষাভুষা মানুষ তোরা, নেতারা তোদের লোম দিও হুইচত ন, হেঁটে ভাত নাই, দ্যাশ দ্যাশ করি মরের। এই দলের মধ্যে হিন্দু মোসলমান কামার কুমোর ধোপা নাপিত তাঁতি বেক জাতের মানুষই ছিল। হেগুনে রেডিও হুইনত আইছে না মুজিবের কথা হুইনত আইছে কে জানে। এই মানুষটার মনের ভিতর আছেঢা কী! হুরা দ্যাশ হ্যাথেনরে লই নাচের। তাইলে কি কালে কালে আর একটা দ্যাশ হইব।
রেডিও হুইনতে হুইনতে একটা শব্দ হক্কলের কানের কাছে আই বার বার করি ধাক্কা মারের। আওয়ামী লীগের ডাকা হরতালে কত মানুষ মরি গেছে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ টঙ্গীতে। হক্কলে এই কথা হুনি মাথায় মাথা লাগাই ফিসফিস করে – বুইঝঝনি পুলিশ আর ইপিআর এর গুলি খাই মইরচ্ছে। দেইখছনি অবস্থাখান। হালারা মোটেই ভালা মানুষ না। দ্যাশের শত্তুর। ইগাইন আমরা জাইনতাম হাইরতাম না, রেডিওটা ছিল বলিই না এত কথা আঙ্গ গ্ৰামের ঘরে ঘরে হৌঁছি যার। আমরা ভাবিয়ের ইস্কুলের হোলামাইয়ারা হড়ালেখা হালাই কিয়ের লাই রাস্তার মোড়ে মোড়ে জড় হই হট্টগোল করের। অন তো বুঝিয়ের ওরা কয়, ‘সিলেটের মনু মিয়ারে মারছে আমরা ছাড়ি কথা কইতাম ন। দরকার হইড়লে দল দলে ঢাকার মিছিলে যামু, দেই না হালার পাঞ্জাবীরা আঙ্গ কয়জনেরে মাইরত হারে। আঙ্গ দ্যাশের মাইনষেগো অত্যাচার করা বার কইরছি, সুযোগ হাইলে বেটাগো মাজা ভাঙুম, খাবাই দিমু আঙ্গ জিনিস হাতাই লই যাওয়া।’ গ্ৰামের মাইনষে এমন করি যে ক্ষেপি যাইব, স্বপ্নেও কল্পনা করি ন। হঠাৎ করিই হাওয়ার দাপট শুরু হইল। তাইলেও ওরা এক পা-ও লড়ে না জায়গা তুন, কান পাতি হুনিই গেল। বুইঝলাইম মাইনষের মধ্যে একটা হরিবর্তন আইছে, কেউ দমাইত হাইরত ন। জীবন যে মাঝে মাঝে এইরকম করি কথা বলি উঢে তা ক্যামনে কইয়ুম। তন আর জাত ধর্ম লই এত কচকচানি মনে হইতে লাগে ফ্যাকাসে হই গেছে। এইঢা বুইঝতাম হারিয়ের দ্যাশটাই সব, দ্যাশেরে ভালোবাসইলে আর জাত ধর্ম কিছু থাকে না। কারও লাঢি উঁচাই কইবার দরকারও হয় না – এই হথ দিই হাঁঢিস না, হোঁচট খাই হড়ি যাবি, সময় থাইকতে সাবধান হ। কথাগাইন হুনি ওরা বুইঝত হারে আর বেশি দেরি নাই, সংগ্ৰামের আঁচ দুদিন বাদে আই হেথাগো ঘরের দুয়ারে আই লাইগব, দরজা জানলা বন্ধ রাইখলে আর চইলত ন। মানুষগুন এক এক করি উঢি যার, হেছনে ফিরি শব্দের আগুনে হইড়ত চায়। শুদ্ধ হইবার এমন ইচ্ছা কে আর কবে দেইখছে। হেথারা অন্য মানুষগুনরে দেই বলাবলি করি শান্তি হাইত চায়। ঘরে বউ বিবি হোলা মাইয়া আছে, এমন কথা ওগো লগে ভাগাভাগি না কইরলে কি চলে। দিন যায় আর দিন আয়ে, সময়টা ক্যামনে ক্যামনে হালটি যার, গাছগাছালি হলুদ হাখি এই বেগ্গাইনের লগে সাথ দের লুকাই লুকাই। আঁর কেমন আশ্চর্য লাগের হক্কল কিছু। নদীনালা খালবিল গরুগোতান কী মাইনষের তুন দূরে থাইকত হারে! খালি খালি মনে হয় ওরা আঁর লগেও তো কথা কয়। কয় কয়, না হইলে আঁঙ্গ ঘরের চালের উপরে দোল খায় ক্যামনে, কন না? হুরাটা মিলাই তো একটা দ্যাশ, একটা আন্দোলন।
একটা শব্দ কদ্দিন ধরি আই আঁর কানের মধ্যে বাজের। এই শব্দরা জন্মায়, দূরে যাইত চায় না, কাছ দিই ঘুরি ঘুরি মরে। শব্দের মধ্যে কী ভেলকি আছে, না বেবাক মায়া? কথাখান আমনাআমনি চলি আইয়ে। এই যে বড় আজব কাণ্ড। একদল হোলাপাইন সদর দরজার সামনে দিই মিছিল করি চলি যার, মুয়ে ওদের একটাই বুলি – বঙ্গবন্ধু জিন্দাবাদ। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা মাইনতাম ন, মাইনতাম ন। আইয়ুব খানের শয়তানি চইলত ন, চইলত ন। এত জোরের লগে আওয়াজ আগে কনও হুনি ন। একটা কথা বুইঝতাম হারিয়েন না কারে হেথারা বঙ্গবন্ধু কয়। এমন ভাব কইরছে যেন হরানঢাও হাইসতে হাইসতে দিই হালাইতে হারে। হক্কল কিছুর একটা মাপজোক আছে, এইঢা যেন বেবাক ছাড়ান দিই হালাইছে। রেডিওটা মাঝখানে এক কোনায় হড়ি ছিল, কেউ অত গা করে ন। আবদুল মাঝি চেঁচাইতে চেঁচাইতে আই নৌকা ভিড়াইছে হেছনের খালে। কইলাম, ‘কিয়া হইছে মাঝি?’ হানা ভর্তি খালের তুন উঠি আই আর কথা কইত হারেন না। খানিক চুপ করি থাই দম টানি কয়, ‘তেমাথার মোড়ে লোকে লোকারণ্য, ডরে আই অদ্ধেক হই গেছি, থানার দিক তুন মিছিলের উপরে হামলা কইরছে পুলিশ, লাঠিসোঁটা দিই পিঢাপিঢি শুরু করি দিছে। কোনরকমে সামলাই উঢি দেই, মাইনষে যে যেমুই হারে দৌড়ার, কারও কোনও হুঁশ নাই।’ তুমি শান্ত হই বও আবদুল, হরে বাকিটা হুনুম। বুইঝলাম যে আগুনটা টিম টিম করি জ্বইলছিল, হেইডা এখন দাউ দাউ করি জ্বলি উইঠছে, সরকার আর সামলাইতে হাইরত ন, বড় কিছু একটা তো হইবোই। হুইনলাম শেখ মুজিব নাকি পশ্চিমা শাসকদের ষড়যন্ত্র ধরি ফালাই আন্দোলনে নাইমছে বিধায় তেনারে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ফাঁসাই দিছে। আবদুল কয়, ‘ ভাবি, দ্যাশের মানুষ কইতে আছে মুজিব এখন হক্কলের নেতা, বঙ্গবন্ধু উপাধি দিছে। উনি যে হথ দেয়াইব, হেই হথেই হক্কলে যাইব, হেছনে হিরে আর তাকাইত ন যতই গ্ৰেফতারি পরোয়ানা জারি করুক।’ হেথেনরা স্বায়ত্বশাসন দাবি করায় জনগন ঝাঁপাই হড়ি সাড়া দিছে। বুকের পাটা আছে, এমন করি দ্যাশের মাইনষেরে লই লড়াই করা কি মুয়ের কথা! কদ্দিন বাদে দেই আঙ্গ গ্ৰামেও পুলিশ আইছে। কোনায় কোনায় তল্লাশি চালার। এতদিন হুইনছি শহরে ধরি ধরি জেলে পোরের, এয়নতো দেই আঙ্গ ইয়ানেও ধরা শুরু করছে। এগুনের মতলব খানা তো বুঝি উইঠতাম হারিয়েন না। আঙ্গ গ্ৰামের মাইনষে তো কম যায় না, চড়কি নাচন নাচার। পুলিশও নাকানিচুবানি খার, আরে বাপ, গ্ৰামের মাইনষেরে কম বুদ্ধির মানুষ ভাবি হেথেনরা এখন ভ্যাবাচ্যাকা খাই যার। এই মামলা যে এমন করি কোনায় কোনায় ঢুকি যাইব, কেউ ত ভাইবত হারে ন। এমন হইছে বাইরে কামকাজ হালাই যুবক হোলারা গোলাঘরে, টঙের ভেতরে লুকাই রইছে, পুলিশ টোকাইও হাইত ন। হেথেনরা ভাইবছে শুধু শিক্ষিত হোলারা এই আন্দোলনে যোগ দিছে, হেইডা তো নয়, চাষবাস করি খায়, রোজের কাম করে, খেজুর গাছ কাটে, মাছ ধরি খায় হেথেরাও হেছনে আছে, এটা বুইঝত হারে ন। গরীব মাইনষের ক্ষমতা হেথেনরা টের হায় না, একবার যদি জাগি যায়,চেয়ার তুন টানি নামাই দিব। হাঁচা কথাখান এই যে দ্যাশের মাইনষে জাগি গেছে, ভালা মন্দ বুইঝত শিখি গেছে, কেউ আর বাঁধি রাইখতে হাইরত ন। পশ্চিমাদের জারিজুরি আর টিকত ন। উর্দু চাপানোর ফল হাড়ে হাড়ে টের হাইছে, তবু শিক্ষা হয় ন। এমন অস্থিরতা বাপের জম্মে দেই ন। এইটা বুঝিয়ের, হেরা চুপ করি থাকার লোক না, ঝোপ বুঝি কোপ মাইরব। আঙ্গ নেতাদের এই আন্দোলন দ্যাশের ভিতরেও কেউ কেউ ভালো চোয়ে দেয়ের না, শত্রুতামি করের। তবে এটা ঠিক হেথেরা সুবিধা কইরত হাইরত ন। হরের ধনে হোদ্দারি করন যায় না যে। হক্কল কিছুর একটা ধর্ম আছে, নিশানা ঠিক থাইকলে কারও বাপের সাধ্যি আছে নি কাবু কইরব। মুজিব কইছে পূর্ব পাকিস্তানের উপরে পশ্চিমারা মাথা মাইরত হাইরত ন। চোয়ের নিমিষে এট্টু এট্টু করি হিন্দু মুসলমান ব্যাকের চলন বলন যেন হাল্টি যার। কেউ কোনও প্রশ্ন কইরলে ফিরতি জবাব দের, আগে দেইখছি ক্যামন চুপ মারি থাইকত। মাইনষে জাগি গেলে ক্যামন হয়, আঁই টের হাইয়ের। আঁর মাইয়াও আঁর তালে তাল মিলায়। বাপ ভাইদের লগে চোপা করে। হেথির ভাবনা চিন্তার সমর্থন না করি হারি না। ক্যামন সোন্দর করি দ্যাশের হালচাল ব্যাখ্যা করে – এই মাইয়া তুই এত কথা জানলি কত্তুন। ‘ওমা নিজের দ্যাশটা কোন দিকে আগার, না ভাইবলে চইলবে ক্যান। ভাই আঁরে ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ কাগজ চুপি চুপি আনি দিছে। তাইতে জাইনতে হাইরলাম শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা আর ছাত্রদের এগারো দফারে লই ‘গণতান্ত্রিক সংগ্ৰাম পরিষদ’ হইছে। সব জেলায় জেলায় আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন শুরু হইছে। এই কাগজ যে আঁর কাছে আছে কারোগে কইয়েন না। এই কাগজ হড়া সরকারের নিষেধ আছে।’ সব্বনাশ, এই মাইয়া দেই ডুবাই ছাইড়ব। ও মাইয়া তোরে মনে ভয় ডর নাই, একে তো মাইয়া মানুষ, তার উপরে হিন্দুর মাইয়া, সরকারি পুলিশ কি ছাড়ি কথা কইব। আঁর কথা হুনি উল্টা হেথি চোখ টিপি টিপি হাসে।
আগুন কি এট্টু হইলেও নিভল, কি জানি। দিন যত যায়, কোন দিকে যে বেক কিছুর মোড় ঘুরি যার। কারে আর কি কইয়ুম, নিজের কাছেই উত্তর খুঁজি। ঈশ্বরের কাছে কই কনডাই গেলে এট্টু শান্তি হাইয়ুম, এক ঝড় থাইমলে আর এক ঝড় শুরু হই যায়। দ্যাশ বাঁচাইব শত্তুরের হাত তুন, না হেট বাঁচাইব, বেগ্গুনে এই চিন্তায় মরে। এই সময় গরুরা ডাকে ক্যান, হেঢে দানাপানি হড়ে ন, এই কথা জানাইত চায় বুঝি। আঙ্গ বাড়ির কয় ঘরে যাগো রোজগারপাতি নাই, এক বেলা খায় তো, আর এক বেলা হেঢে হাত দিই হড়ি থায়। হেই ঘরের হোলামাইয়ারা আঁঙ্গ ঘরে আইলে মুখ হিরাই তো থাইকতাম হারি না, এক বাডি মুড়ি দিই বইয়ায় খাইতে দিই। হেগুনের মুয়ের আনন্দ দেই আঁর মনের আনন্দ চার গুণ বাড়ি যায় – খা, হেঢ ভরি খা। হেগুনের মা মাথায় করি মাঠেঘাটে গোবর কুড়াই ঝুড়ি করি লই ধপাস করি উঠানের এক কোনায় হালায়। গরুর ঘরের বেড়ায় গুটে দেয়। ওই গুটে কিনি লই যায় আসমতির মা। হেথি আবার ঘরে ঘরে বেঁচেই দু’পয়সা রোজগার করে। মতির বাপ হুক্কা খায় জোরে জোরে আওয়াজ করি। বুয়ের মধ্যে সুরুত করি টিক্কার গন্ধটা টানি লয়। ঘন ঘন টানে। হেথেনের টানার ভঙ্গি দেই আঁর চোখ জুড়াই যায়। কেন জুড়াই যায় আঁই নিজেও জানি না। মাঠে মাঠে গরু চড়াই, নাড়া কাটি হরান হই গেলে ভর দুপুরে কাঁচারি বাড়িতে আই এট্টু ঝিমায়, ফের গরু চড়াইবার আগে সুখটান দিই লয়। হেইডা দেইতো ভাবি কত খাটনি খাডিও তো মতির বাপ কেমন করি সুখ খুঁজি লয়। আঙ্গ দ্যাশের মাইনষের তবুও দ্যাশ দ্যাশ লই এত চিন্তা। রটন্তি খুড়োর যত চিন্তা গ্ৰামের মানুষগুনরে লই। হোমিওপ্যাথির বাক্স লই বাড়ি বাড়ি ঘুরে মরে। মাইনষের চিন্তা ছাড়া তেমন হেথেনের আর কোনো চিন্তাই নেই। খালি খবর নিয়ে মরে আর গটগট করে হাঁটে এমন করি যেন দু’মিনিট দেরি হই গেলে আকাশ ভাঙি হইড়ব। মানুষটা বোধ হয় জীবনের ধম্মটা পাশ করা ডাক্তারের তুন কয়েক গুণ বেশি জানে। হাশ দিই যে কত পাল তোলা নৌকা চলে যায়, কত জেলে জাল ফালায় খালে, কত চাষি লাঙ্গল কাঁধে লই মাঠে যায়, খেয়ালই নেই। ‘এত হন্তদন্ত হয়ে কনডাই যান, কারও অবস্থা সংগিন বুঝি।’ ‘কথা কইবার সময় হাতে নাই, উত্তরটা সময় হলে দিমু, এখন আমনের পথে যান।’ হাঁঢে তো হাঁঢে, কোনো দিকে চায় না, সামনের দিকে চায়। কান পাতি হোনে, কার ঘরের তুন কান্দনের আওয়াজ আইয়ে। রটন্তি খুড়ো কথার পিঠে কথা কই হিঢে হাত বুলাই দিই সান্ত্বনা দের – সারি যাইব মা হেঢের ব্যথা। মাইনষের রোগ সারাইবার ঔষুধ আঁর কাছে আছে। দিন রাইত আঁই হড়ি থাইয়ুম তোঙ্গ ঘরে, ঘাবড়াইও না, মন শক্ত কর। মনের রোগ সারি গেলে শরীলের রোগ অর্ধেক সারি যাইব। আঁর কথার উপরে এট্টু ভরসা রাখ। রটন্তি খুড়োর কথাগাইন আঁর মনে ধরে। এই সময়টা বড্ড বেআক্কেলে সময়, এইদিক ধরি রাইখলে কী হইব, সুরুৎ করি অন্য দিকে পলায়। মাইনষের মন খাঁ খাঁ করে। গ্ৰামের হথঘাটে খালি বাতাসের গোঙানি, কেউ নাই যে হথ দেখাইব, কে দিব সুরাহা। মাইনষে ঘাটে মাঠে হোলের ধারে জড় হই পরামর্শ করে। বঙ্গবন্ধুর দফাগাইনরে লই কত ব্যাখ্যা করে। পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের হাতের পুতুল হই থাইকলে গ্ৰামগঞ্জের কী দশা হইব! চিন্তায় চিন্তায় ঘুম নাই। তবে দ্যাশটা যে ভাগ হইছে ঠিক কাজ হয়নি বুঝি, এই প্রশ্নখান মনে জাগে। মুয়ের ভাষাখান যদি চুরি করি লই যাই শুধু ধর্মের রেষারেষি করি কি দ্যাশ বাঁচইব। মুজিব তো হেই কথাখানই তো কয়, প্রদেশের অধিকার প্রদেশের মাইনষের হাতে তুলি দিত হইব, না হইলে জান কবুল, দেই না হালার পাঞ্জাবীরা কী কইরত হারে, ব্যাটাদের চোখ রাঙানি বন্ধ কইরতেই হইব, তবেই না এই দ্যাশের মাইনষেরে মাথা তুলি বাঁইচত হাইরব, না হইলে কুত্তার বাচ্চাগুন আঙ্গরে হায়ের নিচে মাড়াই চলি যাইব। এই দুঃসময়ে যে কোনো ভালা চিন্তা কইরব তার সুযোগ নাই। বাচ্চাগুলারে যে কীভাবে মানুষ করি তুইলব, ঘরদোর সাজাইগোছাই তুইলব সেই ভাবনা মরি গেছে, রাস্তাঘাটের ছিরি দেইখচস, ছাল চামড়া উঢি গেছে, হাঁইটতে গেলে হোঁচট খাই হড়ি যায়। ইস্কুলঘর পোষ্ট আফিসের কী মরণ দশা, চোখ তুলি তাকান যায় না। কারে আর কইয়ুম আঙ্গ কোয়াল মন্দ, না হয় সোনার বাংলা পূর্ব পাকিস্তান হয়, কচ না!
আর কত কইয়ুম। গালে হাত দিই বই থাই। যত দিন যায়, মন খারাপের দুনিয়ায় সাঁতার কাঢি কাঢি এপার ওপার করি। আইজ একখান খবর হাইয়ের, তো কাইল একখান। বেগ্গাইন দ্যাশের হাল হকিকত লই লড়াচড়া করে। একখান ভালা দিকও আছে, মাইনষেগো গলার স্বর তুন বার হই আইয়ের একই কথা, একই দাবি। এক বছর আগের মতো আর নাই, আরও জোরে, আরও ক্ষোভে। ভিন্ন ভিন্ন ছিল তো এদ্দিন, অন এক লগে, হিন্দু আর হিন্দু নাই, মুসলমান আর মুসলমান নাই, হক্কলে বাঙালি, বাংলায় কথা কয়, বাংলায় কাঁদে, বাংলায় হাসে, জাতে জাতে মিশি যাওনের এক শক্তপোক্ত ইচ্ছা জাপটাই ধরে। যেনারা ভিতরে ভিতরে অন্য রকম হইবার লাই ছটফট কইরছিল, তেনাগোও হালানোর হথ নাই। আঁর মাইয়ার মনে কী যে খুশি, লাফাই ঝাপাই বাড়ি মাথায় করি তোলের। ‘ মা গো মা, দৈনিক ইত্তেফাক’ কাগজ অন আর লুকাই লুকাই হড়ন লাইগত ন। সরকারের বাপের ক্ষমতা হইত না আঙ্গ দ্যাশের মাইনষেরে ধমকায় চমকায়, বুইঝঝনি।’ কেন কি হইছে, তোর এত উল্লাশ কেন রে? কাগজ একখান না হয় সপ্তাহান্তে হইড়তে হারবি, তার জন্য এত! ‘ মা, তুমি যদি বুইঝতা, এই কাগজ আঙ্গরে কন্নাই লই যার, দ্যাশের মাইনষেরে জাগাই তোলের, আরে হিয়ের লাই তো পশ্চিমা সরকার এদ্দিন ব্যান করা রাইখছে।’ তুই এত কিছু বোঝছ, আইজ যদি আঙ্গ গ্ৰামে মাইয়াদের দল তাইখত তুই মাইয়া নেতা হই যাইতি। ‘আমনে হইতেন দিতাম আঁরে!’ কেন দিতাম না, তুই মাইয়া বলে? তোরে কি এমনি হড়তাম দিছি, তোর ভাইদের লগে কাঁধে কাঁধ মিলাই লড়তি হারবি বলিই না। অন সমাজ অনুমতি দিচ্ছে না তো কী হইছে, একদিন দিব, দেই রাইচ। ‘কাগজে কী লিখছে দেয়েন, যে আইয়ুব খান বাঙালিদের উপরে রোলার চালাইছে, তার কী দশা হইছে। ভয়ে কাবু হই গেছে, কারফিউ উঠাই নিছে। হের আগের মতো আর এত ক্ষমতা নাই।’ তাহলে আঙ্গ দ্যাশের ভালা হইব ক। ‘হেইঢা তো জানি না মা, কবে ভালা হইব, মোটেই ভালা হইব কিনা, ঈশ্বর জানে।’ কথাটা যে আঁর মাইয়া ভুল কইছে, ক্যামনে কই। দ্যাশ কোন মুই যাইব, আঙ্গ দ্যাশের নেতারা কেবল কইত হারে। আরও মানুষ মাইরব কিনা, আরও মানুষ গ্ৰেফতার হইব কিনা, কদ্দুর অত্যাচার চালাইব, হেঢা তো পশ্চিমা সরকার আর হেথাগো পুলিশই কেবল কইত হারে। তবে কিনা, শেখ মুজিব যেরকম তেজ দেখাইতে আছে, সামনে তুন লড়াই চালার, ইট মাইরলে হাটকেল ছোড়ের, আর বেশিদিন ওরা সুবিধা কইরত হাইরত ন, আঁই একক্কারে কই রাইখলাম। আঁর মাইয়াও আঁর লগে ঘাড় নাড়ি সায় দেয়। আইজকাল আঁর ধ্যান ধারনার লগে মাইয়াটার চিন্তাটা ক্যামন মিলি যায়। আঁই আগাই আছি, না হেথি এক জায়গায় দাঁড়াই আছে, কে জানে।
বেদেরা সাপ ধইরবার লাই বনে বাদাড়ে ঘোরে। ঘুইরতে ঘুইরতে আঙ্গ বাড়িতে ঢুকি হড়ে। আঁই তো জম্মেও ভাবিনি এমন দিন আইব যে আঙ্গ ঘরের হাশে এমন বিষধর সাপ ঘাপটি মারি থাইকব। বাপরে বাপ জাত গোখরো। ঢোঁড়া সাপ, মাইঢ্যা সাপ ঘরের চৌহদ্দিতে ঘুরি বেড়ায়। বিষ নাই বিধায় তেমন ডরায় না কেউ। শয়তান হোলারা লেজ ধরি ঘোরায়। চড়কির মতো ঘুরি ঘুরি পাক খাই বেচারা হুমড়ি খাই হড়ে হুইরের জলে। কিন্তু এর বেলা! থর থর করি কাঁপে, দশ হাত দূর দিই হলায়। বেদে বেঢার তাই দেখি কী নাচন ঠাট্টা তামাশা। ‘অন বুইঝঝনি ক্যামন সাপের লগে ঘর কইরছিলা, ছোবল মাইরলে আর রক্ষা ছিল না, বড় বাঁচেন বাঁইচা গেলেন। আঁই আইলাম বলিই না।’ কথাটা মিথ্যা না। গর্তের মধ্যেই আঁধারে ঘাপটি মারি থায় শত্রুর বাচ্চারা। কে মিত্র আর কে শত্রু কেন্নে বুঝুম, হেরা তো সুযোগ বুঝি এক পা দু’পা করি আগাই আইছে গুটি গুটি, বোঝার কী কোনও উপায় রাখছে, আঁই ঘরে বই বই ভাবি কাইলা আঁর দিনটা কেমন করি যাইব, ওমা হুইনতে পাই হেরা নাকি একশ বছর আগে তুন ভাবি রাইখছি আঁর কাইলার দিনটায় কী করি থাবা বসাইব। দিনটায় ভাবি তো হুরা আলো, আসলে যে কত টুকরা টুকরা আঁধার আই আলোর মধ্যে ঢুকি হড়ি কেরামতি দেয়ার আঁই তো বুঝিই না, আঁর দ্যাশের মাইনষেও বোঝে না, যেমনে নাচার তেমনে নাচে, যেমনে ক’র, তেমনে হোনে। আচ্ছা কন চাই শত্রুর লগে ঘর কইরলে ক্যামন লাগে। শেখ মুজিব কী মসীহা, নাকি পূর্ব পাকিস্তানের মাইনষে মিলে হেথেনরে মসীহা বানাই দিছে। মানুষটার কথার মধ্যে কী মধু আছে, হক্কলে ঝাঁপাই হড়ি হরান দের, জেলের ঘানি টানের, ১৪৪ ধারা উডাইতে বাধ্য হর পশ্চিমা সরকার, আইয়ুব খানের গদি টলমল হই যার। মাইনষে ভাইবছিল পাকিস্তান তো হই গেছে পূর্ব আর পশ্চিম এইটাই খালি ফারাক, দোসর ভাই। এক ধর্মের দ্যাশ, ধর্মের জয় হইছে, দুধে ভাতে থাইকব। যন টের হাইল, দেরি হই গেছে, বাড়া ভাতে ছাই দিছে। হাত মিলান তো দূরের কথা, হাত দিই চুলের মুঠি ঘুরাইলে ভালা হয়। বেদে গর্ত তুন বার করি গোখরোরে যন নাচার, আঁর কথাটা আর চাপি থাইকতাম হাইরলাম না – কোথা তুন শিখলেন এই খেলা? ‘এইডা তো আঙ্গ জাত ব্যবসা, বাপের লগে থাই থাই শিখি হালাইছি। আমনে শিখতে চাইলে আমনেরে শিখাই দিমু।’ ডর লাগে না? ‘ডর লাইগব ক্যান! হইলা হইলা বরং লাইগত। যন বুইঝলাইম হেডের ভাত জুটাইতে গেলে সাপের বিষ দাঁত ভাঙি দিত হইব, বিদ্যাটা রপ্ত কইরত হইব, যেমন করি হোক, হেই তুন সাপ আঁর কথা হোনে। কেমন করি বশে আইনলাম, চোয়ের সামনেই তো দেইখলেন।’ তাইলে বঙ্গবন্ধু যা কইতে আছে সব ঠিক, আমরাও হারুম পাঞ্জাবিগুনরে তাড়াইতে, কও। ‘মা, কথা বাড়াইওনা, হেরে বিদায় কর।’ কী করস রে, কত বড় বিপদ তুন আঙ্গরে বাঁচাইছে হেথে, না হইলে কবে ঘরে ঢুকি আঙ্গরে ছোবল মারি চলি যাইত। তন তোরা আঁরে দেইখতি হাতি, না আঁই তোদের দেইখতে হাইতাম। হেথেরে এক কোটা চাইল আর চাইর আনা হয়সা দিই দে। শুধু কী সাপ ধইরল, কত দামী কথাগাইন শিখাই দিই গেল।
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)