নাফিস আনোয়ার
[প্রাককথন: ২০৪৭ -এর মার্চ মাসের এক অপরাহ্নে রোজকার মতো বসে আছি গ্র্যান্ড স্কোয়ারের উত্তরদিকে চেনা রেস্তোরাঁর পরিচিত সিটটায়। রাস্তার ওপারে গ্র্যান্ড স্কোয়ারকে আলো করে দাঁড়িয়ে আছে সুপ্রিম কমান্ডারের যে বিশাল স্ট্যাচুটা, এই সিটটায় বসলে শুধু তার কালো চকচকে নিতম্বটা দেখা যায়—এটাই বোধহয় এই সিটটার জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ। কিন্তু আজ সকাল থেকে শুরু হওয়া অবিশ্রান্ত তুষারপাতে রাস্তাঘাট বাড়িঘরের মতো সুপ্রিম কমান্ডারের নিতম্বটাও হারিয়ে গেছে বরফের মাঝে। রেস্তোরাঁও আজ একেবারে ফাঁকা। টিভিতে আইন মোতাবেক সুপ্রিম কমান্ডারকে দেখানো হচ্ছে এই মুহূর্তে। অবশ্য সাউন্ড সিস্টেম মিউট থাকায় কমান্ডারের হাত পা নাড়ানোর অঙ্গভঙ্গিকে সার্কাসের ক্লাউনের মতো লাগছে। তবে কেন যেন আজ এসবে মজা পাচ্ছি না। তাই সামনের টেবিলে রাখা বিয়ারের গ্লাসে মনোযোগ দিয়েছি। সঙ্গে রোস্টেড আমন্ড। এমন সময় রেস্তোরাঁর দরজা ঠেলে প্রবেশ করল লোকটা। গায়ে ওভারকোট, মাথার টুপি মুখের উপর আবছা ছায়া ফেলেছে। হাতে কালো রঙের একটা ছাতা। দ্রুত আমার দিকে এগিয়ে এলো সে। সামনে এসে অভিবাদন জানালো প্রথমে। তারপর চারপাশটা একবার সন্দেহের দৃষ্টিতে চোখ বুলিয়ে নিয়ে আমার হাতে সবুজ এনভেলাপে মোড়া একটা প্যাকেট তুলে দিয়ে বলল– মিঃ রাইটার, আপনার জন্য উপহার এনেছি স্যার। খুব সাবধানে রাখবেন। আপনার যাত্রা শুভ হোক। ঘটনার আকস্মিকতায় সামান্য হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। সম্বিত ফিরে পেয়ে কিছু প্রশ্ন করতে যাব, দেখলাম রেস্তোরাঁর বাইরের তুষার ঝড়ে মিলিয়ে যাচ্ছে সে। আমার তো কোথাও যাওয়ার নেই, তাহলে ‘যাত্রা শুভ হোক’ কেন বলল লোকটা! আমার লেখালেখির সম্বন্ধে জানে, এটা বুঝলাম। কিন্তু কতটা জানে!
অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে এনভেলপটা ছিঁড়ে ফেলতেই ভিতর থেকে উঁকি দিল নীল রঙা ছোট্ট একটা নোটবুক। সেটা খুলতে চোখে পড়ল পাতার পর পাতা জুড়ে ক্ষুদে অক্ষরে কীসব লেখা আছে যেন। তবে কি কোনও ক্লাসিফায়েড সিক্রেট ডায়েরি হাতে এসে পড়ল! উত্তেজনায় হৃৎস্পন্দন দ্রুত বাড়তে থাকল আমার। অতি দ্রুত লেখা, খাপছাড়া এই বয়ানের পাঠদ্ধার বেশ দূরূহ ব্যাপার—বুঝতে পারলাম একটু পরেই। তবে কি এই কারণেই আমার হাতে তুলে দেওয়া হলো নোটবুকটা? কিন্তু কেন? কারা করল এই কাজ? আমার ওপরেই বা তারা ভরসা করছে কেন! এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর আপাতত না থাকায়, আমার মনে হলো, এই মুহূর্তে এই আশ্চর্য বয়ানকে নিজের মতো করে লিপিবদ্ধ করে রাখাটাই আমার প্রথম কাজ।]
…
আমার নাম জেফ। যদি এই নোটবুক কারো কাছে পৌঁছায় সে অবশ্য এই নাম দেখে আমায় চিনবে না। চিনবে না আমাদের অঞ্চল কিংবা নদীটার নামও। মানচিত্রে এর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। খোঁজ মিললেও আসল সত্যিটা জানার তো কোনও উপায় অবশিষ্ট রাখেনি ওরা। তাই এই নোটবুক।
আসল কথা হলো, এই মুহূর্তে আমি খুনের দায়ে কারাগারে বন্দি। আক্ষরিক অর্থেই বন্দি। যদিও আমি জানি না আমার বন্দিদশার সূচনা ঠিক কবে, কোন মুহূর্তে। এই কারাগার থেকে বেঁচে ফেরেনি কেউ। আমিও ফিরব না বলাই বাহুল্য। দ্রুত শেষ হয়ে আসছে আমার দিনগুলো। সত্যি কি কেউ কোনওদিন জানতে পারবে আমাদের পরিণতির কথা?
নদীর ব্যাপারটা বলছিলাম। তুন্দ্রা অঞ্চলের নদীর সম্বন্ধে আপনাদের ধারণা নেই হয়তো। সে জল কম বরফ বেশি, বিশাল তার বপু। অধিকাংশ ক্ষেত্রে নদীগুলো সমুদ্রে মেশার আগে খাঁড়ির কাছে উপসাগরের রূপ ধারণ করেছে। আমাদের বসবাস এরকমই এক উপসাগরের ডগাতে অবস্থিত দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্ভুক্ত ছোট্ট এক দ্বীপে। যাকে বাকি তিন দিকে ঘিরে রেখেছে দুর্লঙ্ঘ এক সাগর যা সুমেরু মহাসাগরের একটি অংশমাত্র।
বছরের বেশির ভাগ সময় বরফে মোড়া এই দ্বীপাঞ্চল সুমেরু বলয়ের অন্তর্গত হওয়ায় দিনরাতের হিসেব বেশ গোলমেলে এখানে। বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে ভৌগলিক কারণে আমাদের যোগাযোগ ভীষণ ক্ষীণ। অবশ্য তার দরকারও পড়ে না। কারণ এখানে বসবাসকারী কয়েকশো মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত জিনিসপত্রের প্রাচুর্য অবাক করে দেওয়ার মতো। একটি বিশুদ্ধ ফ্লোরাইটের খনি, আর রাষ্ট্রীয় জিনোম ইনস্টিটিউটের এক বিশেষ গবেষণাগার—এই দ্বীপের উল্লেখযোগ্য দ্রষ্টব্য বলতে এই দুটোই।
…
আমি আমার মাকে দেখিনি। বাবা ছিলেন অত্যন্ত রাশভারী মানুষ। বিশেষ কথা বলতেন না। মনে পড়ে, খুব ছোটবেলায় আমাকে কোলে নিয়ে মাঝেমধ্যে শুধু একটা শব্দ বিড়বিড় করে যেতেন তিনি। সেই শব্দটা জীবন না মৃত্যু, সেই শৈশবে বুঝে উঠতে পারিনি আমি। আমাদের ভাষায় এই দুটো শব্দের উচ্চারণ প্রায় একই।
আমার বাড়িতে প্রায়ই আসতেন বাবার বন্ধু কর্নেল বালাখ। তিনি সেনাবাহিনীর খুব উচ্চপদে কাজ করতেন। তাঁকে আঙ্কেল সম্বোধন করতাম আমি। এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো এই দ্বীপে যে কয়েকশো সাধারণ অধিবাসীর বাস, তাদের থেকে এখানে উর্দিধারীদের সংখ্যা অনেক বেশি। এখানকার সব কিছুতে তাদেরই নিয়ন্ত্রণ। বস্তুত এই দ্বীপ একটা আর্মি বেস হিসাবে পরিচয় পেলে বেশি মানানসই হতো। কিন্তু সেনাবাহিনী বলত— অবাধে বিচরণ করা যায় এমন এক সিভিলিয়ান এলাকা এটা। তারা আছে শুধুমাত্র সাধারণের নিরাপত্তার জন্য। সত্যি সত্যিই প্রতিটা কাজে তাদের সাহায্যের দরকার হতো আমাদের। ভীষণ অমায়িক ও শান্ত ছিল তাদের ব্যবহার।
আমাদের স্কুল ও কলেজ ছিল একটাই ক্যাম্পাসের ভিতর এবং মিলিটারি পরিচালিত। প্রিন্সিপালের নাম ছিল মেজর পেড্রো। ছুটির দিন তিনি সেনাদের সঙ্গে ছাত্রদের ফুটবল ম্যাচের আয়োজন করতেন। নিজে হতেন রেফারি। প্রতিবার স্টুডেন্টরা জিতত। ম্যাচ শেষে প্রত্যেককে টফি দিতেন প্রিন্সিপাল।
…
আঙ্কেল বালাখের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল ভীষণ মধুর। তিনি ছিলেন এমন একজন, যাকে আমি যে-কোনও বিষয়ে প্রশ্ন করতে পারতাম। তিনি বলতেন
– এই দ্বীপে লুকোনো আছে এমন এক গোপন অস্ত্র যা আমাদের দেশের সবথেকে বড়ো হাতিয়ার।
– কী সেই অস্ত্র আঙ্কেল?
– সুপার হিউম্যান। অতিমানুষ। চাপা কণ্ঠে নামটা উচ্চারণ করতেন কর্নেল বালাখ।
কিন্তু সেটা আসলে যে কী তার কোনও হদিস দিতে পারতেন না তিনি। কথা ঘুরিয়ে বর্ণনা দিতেন কী ভয়ঙ্কর শ্যেনচক্ষুতে এই দ্বীপের দিকে তাকিয়ে আছে শত্রুরা। এদেশের কিছু দেশদ্রোহী টাকার লোভে কীভাবে বিক্রি হয়ে গেছে তাদের কাছে। আমাদের সেনারা বিপুল শক্তিতে কীরকম পাল্টা মার দিচ্ছে তার উদাহরণও দিতেন বিস্তারে।
– তাহলে আমিও বড়ো হয়ে আপনার মতো মিলিটারি হব আঙ্কেল। শত্রুদের ঢিসুম ঢিসুম করে মেরে ফেলব। শৈশবসুলভ সরলতায় আমি বলে উঠতাম এরপর।
– হাহাহা। না জেফ, তুমি বিজ্ঞানী হবে। গবেষণা করবে। আরো শক্তিশালী সুপার হিউম্যান বানাবে…
ঠিক এই সময়ে আমাদের কথোপকথনে বাধা দিতেন আমার পিতা।
– প্লিজ কর্নেল, আজগুবি কথা বলে ছোট বাচ্চাটার মাথা খেও না আর।
– তুমি নিজে বিজ্ঞানী। তোমার সন্তানও বিজ্ঞানী হবে, এ তো ভবিতব্য ডক্টর! হাহা করে ফের হেসে উঠতেন কর্নেল বালাখ।
আমি বড়ো হয়ে আঙ্কেলের কথা মতো বিজ্ঞানী হয়েছিলাম।
…
আমার বাবা কর্নেলকে সহ্য করতে পারতেন না। তাদের মধ্যে তর্কাতর্কি লেগেই থাকত। আমি অবশ্য বুঝতাম না কী নিয়ে ঝামেলাটা। ঝগড়া শুরু হলে আমাদের চাকর স্যাম আমাকে অন্য ঘরে নিয়ে চলে যেত। একদিন স্যাম রান্নাঘরে কোনও কাজে ব্যস্ত থাকায় দরজায় কান পেতে তীব্র কথা কাটাকাটির আওয়াজ পেয়েছিলাম।
–দেশদ্রোহীর সাজা জানো তো ডঃ নেড?
–আমি দেশদ্রোহী!
–হ্যাঁ দেশদ্রোহী। তুমি বিশ্বাসঘাতক। আমার ঘরে তার প্রমাণ আছে।
– ও আমি বিশ্বাসঘাতক! আর তোমরা যা করছ সেটা?
–চুপ করো। যা হচ্ছে দেশের জন্য হচ্ছে। আর তুমি তো সব জেনেই এসেছ এখানে। মুচলেকায় সই করে এসেছ।
– ভুল করেছি। খুব ভুল করেছি। আমি আর এসব সহ্য করতে পারছি না কর্নেল। আর কতদিন? এরপর কী করতে চলেছ তোমরা? জেফকেও কী তোমরা…!
– জেফের জীবন ভীষণ দামী ডঃ নেড। তুমি সেটা ভালো করেই জানো। ওর কিচ্ছু হবে না।
– আমার সন্তান…
– বেশি চিন্তা না করে বিশ্রাম নাও ডক্টর। তোমার বিশ্রাম দরকার।
এর কয়েকদিনের মধ্যেই আকস্মিকভাবে গবেষণাগারে এক দুর্ঘটনায় আমার বাবা মারা গেলেন। কিন্তু অনাথ হলাম না আমি। আমার সমস্ত ভরণপোষণের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিলেন কর্নেল বালাখ। বাবার জন্য তেমন মন খারাপ করেনি। আঙ্কেল বালাখের স্নেহ আমায় সে সুযোগ দেয়নি।
তিনি আমায় তাঁর বাড়ি নিয়ে গেলেন। মিসেস বালাখ আমার মা হলেন। তিনি ছিলেন আরেকজনের মা—দিনা… দিনা আমার প্রেমিকা। স্ত্রী। বন্ধু। দিনা আমার সব। আমার চোখের সামনে ছটফট করতে করতে দিনা মারা গেছে।
…
আমি আর দিনা একসঙ্গে বড়ো হচ্ছিলাম। দিনার প্রতি মিসেস বালাখের ব্যবহারে যতটা উষ্ণতা ছিল, ততোধিক শীতলতা তিনি দেখতেন আমার প্রতি। দিনা অবশ্য আগলে রাখত আমায়। কর্নেলের স্নেহও তাতে সহায় হতো। দিনা আর আমি একসঙ্গে স্কুলে যেতাম। তারপর কলেজ। মিলিটারি অনুশাসনের ফলে খুব বেশি বন্ধু হয়নি আমাদের। তার দরকারও পড়েনি। কারণ ততদিনে আমরা একে অপরের প্রেমে পড়েছি। কলেজ পাশ করে গবেষণা শুরুর আগেই বিয়ের প্রস্তাব দিলাম দিনাকে। শুনেই ভীষণ ক্ষেপে উঠলেন মিসেস বালাখ। যেনতেন প্রকারে চেষ্টা করতে লাগলেন আমাদের বিয়েটা বন্ধ করার। এই একটিবার দিনা তার মায়ের কথা অমান্য করেছিল। এবং বরাভয় হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন কর্নেল বালাখ স্বয়ং। বিয়ে গেল আমাদের।
এরপরেই ঘটে গেল এক দুর্ঘটনা। খাবারে বিষক্রিয়ায় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন মিসেস বালাখ। দিন কয়েকের মধ্যেই মৃত্যু হলো তাঁর। মৃত্যুর আগে দিনাকে কাছে টেনে নিয়ে কানে কানে তিনি শুধু বলতে পেরেছিলেন— পালাও। পালাও।
…
দিনা বদলে গেল এরপর। ভীষণ মনমরা হয়ে থাকত সবসময়। মায়ের জিনিসপত্রের মধ্যে কী যেন খুঁজতে থাকত। জানতাম, মা ওর ভীষণ কাছের ছিল। আর কর্নেলের সঙ্গে ছিল আশ্চর্য এক দূরত্ব। তবু ব্যবহারের এতটা পরিবর্তন আশা করিনি আমি।
ইতিমধ্যে আমার গবেষণাগারে যোগদানের ব্যবস্থা পাকা হয়ে গেল। জিনোম ইনস্টিটিউটের সুমেরু বৃত্তীয় এই শাখাটি তৈরি হয়েছিল বছর পঁচিশ আগে—অত্যন্ত শীতল আবহাওয়ায়, সাব জিরো তাপমাত্রার মধ্যে বিভিন্ন রকমের পরীক্ষা নিরীক্ষা চালানোর জন্য। ইনস্টিটিউটের সফেদ বিল্ডিং, তাকে ঘিরে কড়া প্রহরা, অল্প বয়স থেকেই নজর কাড়ত আমাদের। কীভাবে যেন আমাদের অনেকের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল ওখানে কাজ করার। মিলিটারি আকাদেমিতে থাকতে থাকতেই কিছু ছাত্রছাত্রীদের বেছে নিয়ে বিশেষ ট্রেনিং শুরু হয়ে যেত। সেখানে ভালো ফল করলে তবে সুযোগ পাওয়া যেত ওখানে কাজ করার। আমি ট্রেনিং নেওয়ার সুযোগ পেলাম আঙ্কেল বালাখের সৌজন্যে।
আমাদের জানানো হলো ক্যান্সার, এইডস, ইবোলার মতো মারণ রোগের ভ্যাক্সিন তৈরি হয়েছে এই ইনস্টিটিউটেই। এখানকার গবেষণায় জিনোম সিকোয়েন্স বদলে দিয়ে বার্ধক্যকে পিছিয়ে দেওয়া গেছে অনেকটাই। তাই তো আমাদের সুপ্রিম কমান্ডারের বয়স একশো পেরোলেও, দেশকে দিশা দেখাতে তিনি বেঁচে থাকবেন আরো দীর্ঘকাল। ট্রেনিং-এ এ.আই-এর মাধ্যমে আমাদের প্রাথমিক পাঠ দেওয়া হলো ক্রিসপার-ক্যাস, ফ্যানজর প্রভৃতি প্রোটিন সিস্টেমের মাধ্যমে ডিএনএ কাটিং ও এডিটিং-এর। এভাবেই উন্নততর খাদ্যশস্যের উদ্ভাবন প্রক্রিয়া চলছে ইনস্টিটিউটে, যা অদূর ভবিষ্যতে সারা বিশ্বের খাদ্য সমস্যার স্থায়ী সমাধান হবে। ট্রেনিং-এ এসবই শেখানো হলো আমাদের।
কিন্তু সুপার হিউম্যান প্রোজেক্টের কোনও খবর কারো কাছে ছিল না। যদিও আমাদের ছাত্রদের মধ্যে কানাঘুষো এ খবর খুব চালু ছিল যে ইন্সটিটিউটে অতি গোপনে সেই প্রোজেক্টের কাজ এগিয়ে চলেছে দ্রুত গতিতে। দেশের সমস্ত সমস্যার সমাধান হিসাবে অচিরেই সুপ্রিম কমান্ডারের সহয়তায় অবতীর্ণ হবে অতিমানুষেরা।
প্রথম যেদিন জিনোম ইনস্টিটিউটের গেট পেরোলাম, খুব গর্ব হয়েছিল। পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করতে চলেছি, আনন্দ স্বাভাবিক। আর ঠিক সেই সময়েই আমার বাড়িতে এলো চরম এক সুসংবাদ।
দিনা অন্তঃসত্ত্বা, বাবা হতে চলেছি আমি—যেদিন এই খবর শুনেছিলাম, প্রচণ্ড খুশিতে কোলে তুলে নিয়ে ভীষণ আদরে ভরিয়ে দিয়েছিলাম ওকে। খুশি ছিল দিনাও। আমার মনে হচ্ছিল আমাদের সন্তানের আগমনবার্তা দিনাকে ওর মায়ের মৃত্যুর শোক ভুলিয়ে দিতে পারবে। ফের স্বাভাবিক হয়ে যাবে ও। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যে হঠাৎ সব কিছু বদলে গেল।
শীতের সময় সেটা। দুপুরবেলা সামান্য কিছু সময়ের জন্য গোধূলির আলো ছড়িয়ে অন্ধকার নামে চারপাশে। নিরবিচ্ছিন্ন দীর্ঘ একটা রাত। যার পোশাকি নাম সিভিল পোলার নাইট। এমনটা এখানে চলবে দু’মাস। ইনস্টিটিউটে আমার কাজ শুরু না হওয়ায় মধ্যাহ্নে বাড়ি ফিরে আসি আমি। দিনার সঙ্গে সময় কাটাই। সেদিনও বাড়ি ফিরেছি। দেখি দিনা জানলার দিকে মুখ করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। ঘর অন্ধকার। আলো জ্বালাই আমি। ঘুরে দাঁড়ায় দিনা। ওর মুখের অবস্থা দেখে হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যায় আমার। ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে দিনার মুখমণ্ডল। চোখ দিয়ে নেমেছে জলের ধারা। আমাকে দেখে থরথর করে কেঁপে ওঠে ও।
– কী হয়েছে তোমার! এরকম করছ কেন? দ্রুত কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরি ওকে।
– বড়ো ভুল হয়ে গেছে জেফ। খুব ভুল হয়ে গেছে। আমাকে আঁকড়ে ধরে ভীষণ উত্তেজিত কণ্ঠে বলে ওঠে ও।
– কী ভুল? কীসের ভুল? লক্ষ্মীটি তুমি শান্ত হও। তোমার এখন বেশি উত্তেজিত হওয়া ঠিক নয়।
– আমরা কেন পালাতে পারলাম না জেফ? তাহলে অন্তত আমাদের সন্তানটা বেঁচে থাকত। হিস্টিরিয়া রোগগ্রস্তের মতো বলে ওঠে দিনা।
– কী পাগলের মতো কথা বলছ দিনা! কেন বেঁচে থাকবে না আমাদের সন্তান?
– তুমি এখনও বুঝতে পারছ না জেফ? কী বিরাট ষড়যন্ত্রের জালে আটকা পড়ে গেছি আমরা। সেই শৈশব থেকে আমাদের জীবনের রিমোট কন্ট্রোল যে অন্য কারো হাতে। সে-ই নিয়ন্ত্রণ করছে সবকিছু।
– কে? কার কথা বলছ তুমি?
– এখনও চেনোনি তাকে! কে তোমার বাবার বন্ধুর বেশে তার সর্বনাশ করেছে? কে তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছে যাতে তোমার সঙ্গে আমার মেলামেশার সুযোগ হয়? কে আমাদের দাঁড়িয়ে থেকে বিয়ে দিয়েছে?
– আঙ্কেল বালাখ! অস্ফুট দুটো শব্দ আমার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে। কিন্তু কেন? আবার প্রশ্ন করি আমি।
– এক এবং একমাত্র কারণ ওই সুপার হিউম্যান জিনোম প্রোজেক্ট। জিন বদলের মাধ্যমে তৈরি হবে নতুন সংকর মানুষ। অতিমানুষ। আসুরিক শক্তিতে বলীয়ান হবে সে, বুদ্ধিতে সুপার কম্পিউটারের থেকে তীক্ষ্ণ। রোগ ব্যাধি জরা মৃত্যু ছুঁতে পারবে না তাকে। নির্মম আবেগহীন হিউম্যান মেশিন। সেই অতিমানব তৈরির প্রক্রিয়ায় বলি প্রদত্ত আমরা সবাই।
– কর্নেল বালাখ যে তোমার বাবা!
– বালাখ আমার বাবা নয় জেফ। ওই মূর্তিমান শয়তানটা আমার বাবা হতে পারে না। একজন পিতা কখনও পারে নিজের মেয়ের পেট চিরে ভ্রুণ বার করে তাকে নিয়ে গবেষণার কাজে লাগাতে!
– কী বলছ তুমি! এ কী করে সম্ভব!
– খুব সম্ভব জেফ। আমাদের সবাইকে যে এই গবেষণার জন্যই তৈরি করেছে রাষ্ট্র। জন্মের আগেই জিন এডিটিং করে বদলে দেওয়া হয়েছে আমাদের প্রত্যেকের জিনোম। তারপর নিয়ে আসা হয়েছে এখানে। এই দ্বীপ, এটা গোটাটাই আসলে একটা গবেষণাগার। এখানে সাধারণ মানুষ বলতে কেউ নেই জেফ। সবাই আছে সিক্রেট মিশনে। তাই কেউ কারো সঙ্গে কথা বলে না। কোনও বন্ধুত্ব হয় না। আর বন্ধুত্ব যখন হয় তখনও তা হয় পরিকল্পনা করে, আমাদের মতো। দীর্ঘ পঁচিশ বছর ধরে এভাবেই গোপনে গবেষণা চলছে এখানে। আর পাহারা দিচ্ছে আর্মি। কাউকে একটু সন্দেহ হলেই পোকামাকড়ের মতো মেরে ফেলে তারা। তোমার বাবা আমার মাকে মারা হয়েছে যেভাবে। জিনোম ইন্সটিটিউটে মাটির তলার ল্যাবে চলছে আমাদের নিয়ে কাটাছেঁড়া, পরীক্ষা নিরীক্ষা। যখন যাকে দরকার তুলে নিয়ে যাওয়া হয় সেখানে। তোমার মনে আছে জেফ, শৈশবে স্কুল থেকে হঠাৎ হঠাৎ হারিয়ে যেত আমাদের কিছু সহপাঠী। তারপর তাদের হদিস পাওয়া যেত না আর। আমাদের দুজনকে অবশ্য এক্ষেত্রে সৌভাগ্যবান বলতে হবে। আমাদের জন্য প্রথম থেকেই তৈরি ছিল প্ল্যান বি। গবেষণাকে আরো সুদূরপ্রসারী করে নেক্সট জেনারেশনে নিয়ে দিতে তৈরি হয়েছি আমরা। দুজন সংকর মানুষের মিলনে তৈরি হওয়া সন্তানের উপর পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু হবে এবার। জন্মের আগেই বলি চড়ানো হবে আমাদের সন্তানকে সুপার হিউম্যানের নামে। অনেক কথা একসঙ্গে বলে হাঁফাতে থাকে দিনা।
আমার তখন সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। শৈশবের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলি একে একে মনে পড়ে যাচ্ছে সব। দিনা যা বলছে তা অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে না তো। বরং নিজের নির্বুদ্ধিতার জন্যই চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে যেন। এই জন্যই কি আমার পিতার শেষ সময়ে আমাকে খুব দামী বলেছিলেন কর্নেল বালাখ! কিন্তু আমায় কেন ইনস্টিটিউটে কাজ করার সুযোগ করে দিলেন কর্নেল? আমি নিজের সন্তানের ওপর পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাব, এও কী সম্ভব?
– সেটা করতে ওরা তোমায় বাধ্য করবে জেফ। আমি যে সব টের পেয়ে গেছি। তাই খ্যাপা কুকুরের মতো ছুটে আসছে তোমাকে আমাকে আলাদা করার জন্য। কে জানে হয়তো আমাদের তিনজনকে নিয়েই শুরু হবে ওদের নতুন গবেষণা! ওহ্ জেফ! মায়ের কথামতো যদি তোমায় বিয়ে না করতাম তাহলে এই দিন দেখতে হতো না। গলা ধরে আসে দিনার।
– আমি তোমার বড্ড ভালোবাসি দিনা। খুব ভালোবাসি তোমায়। বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বোকার মতো বলে উঠি আমি।
– আমিও যে তোমায় খুব ভালোবাসি জেফ। সেজন্যই ওরা যা চায় আমি কিছুতেই তা হতে দিতে পারি না। তাই একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। পারলে আমায় ক্ষমা ক’রো। হঠাৎ কেমন যেন বদলে যায় দিনার গলার আওয়াজ।
বাইরে সিঁড়িতে বুটের শব্দ পাওয়া যায়। আমাকে সজোরে জাপটে ধরে আমার ঠোঁটে গভীর চুম্বন এঁকে দেয় দিনা। তারপর আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে ছুটে যায় কর্নেল বালাখের ঘরের দিকে। হঠাৎ পুরো ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যায় আমার কাছে। ওর পিছনে দৌড়াতে থাকি আমি। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। দরজা খুলে ওই ঘরে ঢোকার মুহূর্তে গুলির আওয়াজে কেঁপে ওঠে চারপাশ। আমি শুধু দেখতে পাই আমার থেকে হাত পাঁচেক দূরে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে দিনা।