অভিষেক বোস
এটা সম্ভবত এই দিকের শেষ রেলস্টেশন। এরপরেই অন্য দেশ শুরু হয়ে যায়। নামে স্টেশন হলেও, টিকিট কাউন্টার নামের ঘরটার সাথে সামান্য টিনের ছাউনি ছাড়া পুরোটাই ফাঁকা। স্টেশন ঢোকার মুখে যে লোকটা সেদ্ধ ছোলা বিক্রি করছে , তার পাশেই একটা পরিত্যক্ত ঘরে সাইকেল, মোটরসাইকেল জমা রাখা আছে । উলটো দিকে একটা লালরঙা এঁদো পুকুরও দেখা যাচ্ছে । আশেপাশে বনজুঁই ফুলের ঝোপে ভরা । পুকুরের সামনে দাঁড়ালে বুনো গন্ধ টের পাওয়া যায়।
এই সময় শুধু স্টেশন থেকে বেরোনোর ভিড় দেখা যাচ্ছে । ফেরার ট্রেনটা ফাঁকা ফিরে যাবে । সকাল বেলায় এলে হয়তো উলটোটা দেখা যেতো । অপূর্ব এখানে আগে কখনো আসেনি। আসলে ভুল করে উল্টোডাঙা থেকে উঠে পড়েছিল। যখন বুঝতে পারলো যে ট্রেনটা ডানকুনির দিকে যাচ্ছেনা তখনও ও নির্বিকার ভাবে ট্রেনে বসে ছিল।
শেষ স্টেশন যখন এলো, তখন হঠাৎ কামরার দিকে তাকিয়ে খেয়াল হল, ট্রেনটা নিজের গন্তব্যে পৌঁছে গেছে। ট্রেন থেকে নেমে বাইরে বেরিয়ে খানিকক্ষণ পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে ওর মনে হল, বেশিক্ষণ এখানে থাকা যাবেনা। আর এদিক থেকে ফেরার ট্রেনও সম্ভবত খুব বেশি নেই।
এবারে ফেরার টিকিট কেটে প্ল্যাটফর্মের সিমেন্টের চেয়ারটায় বসে পড়ল। ভেতরে চা আর তেলেভাজা ছাড়া তেমন কোনো খাবার দোকান নেই। শিয়ালদার ট্রেন এখুনি ছাড়বে। ঘোষনাটা শোনার পরও ও নিরুত্তাপ হয়ে বসে রইলো।
একটা বছর পঞ্চাশের লোক প্ল্যাটফর্মে বেতের ঝুড়িগুলো খুলে রেখে তাবিজ, কবচ, জড়িবুটি বিক্রি করছে। অপূর্ব শিয়ালদা যাওয়ার ট্রেন চলে যাওয়ার আগে অবধি অলস ভাবে সিমেন্টের চেয়ারটায় বসে বসে ট্রেনের ভিড়ের ওঠানামা দেখছিল। সবাই ব্যস্ত, সবাই ছুটছে। যেন, এরপর আর কিছু নেই। এই মুহূর্ত্তটাই শেষ মূহুর্ত। ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে বেরোনোর পরই পুরো জায়গাটা কোনো অচেনা ছবি আঁকিয়ের ক্যানভাসের মতো হয়ে গেল । সবকিছু ধীরে ধীরে চলছে। তুলির ছোঁয়ার মতো। কোনো তাড়াহুড়ো নেই।
ঐ ক্যানভাসের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে ও প্রথমবার লোকটাকে দেখতে পেলো । ডজন খানেক মানুষকে সামনে দাঁড় করিয়ে অনবরত কথার ফুলঝুড়ি ছড়াচ্ছে। বেতের ঝুড়িগুলো সামনে থেকে দেখবে বলে অপূর্ব এবার এগিয়ে এসে ভিড়ের মাঝে এসে দাঁড়ালো । তাবিজ – কবচের খরিদ্দারিতে ওর কোনো মাথা ব্যাথা নেই। ঝুড়ির মধ্যে যে হলদে কালো মোটা সাপটা দেখা যাচ্ছে, ওটাই ওর এগিয়ে আসার কারণ।
চন্দ্রবোড়া। কী সুন্দর দেখতে! একটাতে কালাচও আছে। আর একটাতে লাউডগা।
অপূর্ব মোবাইলটা বের করে ছবি তুলতে যাবে, লোকটা ওকে হাতের ইশারায় মানা করল। ও বেরিয়ে চলে আসতো, কিন্তু হঠাৎ ওর কানে এলো, সাপুড়েটা বলছে — এই তাবিজ সাথে থাকলে কোনো সাপ সামনে আসবে না, তবে ব্যবহার করতে করতে কখনো ‘পাওয়ার ‘ কমে যাওয়ার পর যদি সাপে কামড়ে দেয়, মুখে এই শিকড়টা রেখে সোজা হাসপাতাল চলে যাবেন। অ্যান্টিভেনাম ইঞ্জেকশন ছাড়া কোনো উপায় নেই। ‘অ্যান্টিভেনম’ কথাটা হয়তো এত স্বচ্ছন্দ উচ্চারণে বলতে পারেনি, তবে বলেছে ঐ কথাটাই।
অপূর্ব বেশ অবাকই হল । সাপ খেলা দেখাচ্ছে। জড়িবুটি বিক্রি করছে। অথচ সাপে কামড়ালে হাসপাতাল দৌড়তে বলছে। আবার একটা ট্রেন ছাড়ার ঘোষনা হতেই ভিড়টা ফাঁকা হয়ে গেল। অপূর্বও ফিরে আসতে যাবে, সাপুড়েটা ওকে ইশারা করে বলল — ছবি তুললে তুলুন ।
কয়েকটা ছবি তোলার পর সাপুড়ে ওকে জিজ্ঞেস করল — ‘বাড়ি যাবেন না?’
মিনিট দশেকের মধ্যেই দু’জনের বেশ আলাপ হয়ে গেল। ভোলাদাস ওঝার বাড়ি একদম ভারত বাংলাদেশ সীমান্তে। কল্যানীর আশে পাশে যে সারি সারি কারখানা, গুদামঘর আছে , ওখানে সাপ ঢুকলে ভোলাকে তলব করা হয়। ওদিক থেকে ডাক না পেলে জড়িবুটি আর দু-এক জোড়া পোষা সাপ নিয়ে স্টেশন চত্বরে চলে আসে। অপূর্ব ওর ফোন নম্বরটা চেয়ে নিল। হয়তো কোনোদিনও ফোন করবেনা। তাও মানুষটাকে ওর ভালো লেগেছে। হাবিজাবি মাদুলি বিক্রি করে লোক ঠকাচ্ছে ঠিকই , তবে বুকের বাঁ পাশে একটা নরম মন আছে।
ফেরার ট্রেনটাতে উঠতেই ও আবার অন্যমনস্ক হয়ে উঠল। আবার কালকে ডানকুনি লাইনে যেতে হবে। দেখা হোক আর না হোক, ওকে আবার ট্রেনে উঠতে হবে। ভিড়ের মাঝে ঐ চেহারাটাকে খুঁজে বের করতেই হবে।
ট্রেনটা এখন প্রায় ফাঁকা বললেই চলে। দু তিনটে লোক কামরার মধ্যে বসে ঝিমোচ্ছে। তার মধ্যে একটা পরিচিত মুখ। ওর সাথেই উলটোডাঙা থেকে উঠেছিল। উনি নাকি উনিশ বছর ধরে ট্রেনের কামরাতে চিকিৎসা করছেন। জনস্বার্থে একটি চটি বইও লিখেছেন। পুরনো ঘা থেকে লিভার ক্যান্সার সবকিছুর ঘরোয়া পথ্য আছে ৷ ভদ্রলোককে এখন নিজেই অসুস্থ লাগছে। অপূর্ব নিজেও খানিকটা অসুস্থ বোধ করছে। রোজ রোজ ভরদুপুরে ট্রেনে ট্রেনে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে, একটু হতাশও হয়ে পড়েছে। তার থেকে সেদিন যদি একবার চোখ ফিরিয়ে দেখে নিতো…
অপূর্ব মনে প্রাণে বিশ্বাস করতে চাই ওটা দুর্ঘটনা। কিন্তু ওর চাওয়ার সাথে ওর মন সায় দেয় না। ও জানে ওটা নিছকই দুর্ঘটনা নয়। বরং ইচ্ছাকৃত অপরাধ। কতই বা বয়স ছিল ছেলেটার। বাইশ তেইশ কী সামান্য বেশি! ভিড় কি সেদিন একটু বেশিই ছিল ট্রেনটায়? বাইশ-তেইশ বছরের ছেলে মেয়েরা তো এরকমই হয়। একটু ঔদ্ধত্য, একটু দেখনদারি, শরীরী ভাষায় সামান্য অবজ্ঞা। ও নিজেও তো তাই ছিল বাইশ বছর বয়সে। অথচ সেদিন ওর এসব কথা একবারও মাথায় এলো না। গত পনেরো বছরেও আসেনি। তবে যেদিন অরিত্রর একুশ বছর বয়স হল। সেদিন থেকে কেন জানো ও নিজের ছেলের মধ্যে পনেরো বছর আগের ঐ ট্রেনের ছেলেটার মুখ দেখতে পেয়েছিল। একই রকম ঔদ্ধত্য , শরীরী ভাষায় কিছুটা অবজ্ঞা। অরিত্রর মুখের দিকে আজকাল ও তাকাতে পারেনা। ছেলেটার কথা বারবার মনে পড়ে যায়। অরিত্রও তো আজকাল ভিড় ট্রেনে করে শহরতলির দিকে কাজে যায়। কখনও কখনও হয়তো জায়গা না পেয়ে দরজার সামনে হাতল ধরে ঝুলতে ঝুলতেও যায়। যদি কখনও ওর মতো কোনো মানুষ ওর পাশে ভিড়ের মধ্যে মিশে থাকে। অফিস, বাড়ির হাজারো ঝামেলায় বিষিয়ে থাকা মন নিয়ে!?
একবার যদি ডানকুনি লাইনে ট্রেনের ভিড়ে ঐ ছেলেটাকে দেখতে পাওয়া যায় ! পনেরো বছর পেরিয়ে গেলেও, শরীরী ভাষায় হাজার পরিবর্তন হলেও ও ঠিক চিনে নিতে পারবে, সেদিনের বাইশ বছরের মুখটাকে।
ফাঁকা ট্রেনের কামরার জানলার পাশে বসে এখন কিছুক্ষণ সব কিছু ভুলে গিয়ে অপূর্বর সদ্য পরিচিত ভোলাদাসের কথা মনে পড়ছে। মানুষের মনে বিষাক্ত সাপ ঢুকলে কোনো সাপুড়েকে তলব করা যায়না। মানুষের মনে যে বিষ থাকে তার জন্য কোনো অ্যান্টিভেনম ইঞ্জেকশনও হয়না।
ভাললাগে এই টুকুই বলার।
এর বেশি বলার ভাষা নেই।
তবে হ্যাঁ, অভিষেক এর লেখা গুল অনেকটা শ্রী মতি নন্দীর কে মনে করিয়ে দেয়।
আজকে হঠাৎ link টা খুলে দেখলাম। অনেক বড় নামের পাশে আমার নামটা বেমানান । ভালোবাসা জেনো পার্থ।