শরদিন্দু সাহা

বাংলা কথা সাহিত্যের সুপরিচিত লেখক শরদিন্দু সাহা। লেখক সত্তা ও জীবনকে বিচ্ছিন্ন করে দেখতে তিনি অভ্যস্ত নন। নিছক লেখক হওয়ার জন্য তিনি কলম ধরেননি, সামাজিক দায়বদ্ধতাই তাঁকে সৃষ্টিকর্মে উদ্বুদ্ধ করে। শৈশব থেকে সৃষ্টিশীল মন লালন করে প্রস্তুতি পর্ব সারলেও নয়ের দশকের গোড়া থেকে তাঁর লেখালেখি শুরু। এ-পর্যন্ত শতাধিক গল্প, গোটা কয়েক উপন্যাস এবং অন্যান্য গদ্য মুদ্রিত হয়েছে। দশটি উপন্যাস আর সাতটি গল্পগ্রন্থ সহ মোট গ্রন্থের সংখ্যা ষোলো। ১৯৯৮ সালে ‘কাটোয়া মহকুমা গ্রন্থাগার পুরস্কার’ পান। ২০০৪ সালে ‘পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি প্রদত্ত সোমেন চন্দ পুরস্কার’ পান। ওই  বছরেই কাটোয়া লিটল ম্যাগাজিন মেলা কর্তৃক সংবর্ধিত হন। ইন্ডিয়ান অয়েল কর্তৃপক্ষ তাঁকে ‘হল্ অব্ ফেম’-এ সম্মানিত করেন। ২০০৫ সালে ‘ভাষা শহিদ বরকত স্মরণ পুরস্কার’ পান। ২০০৭ সালে সাহিত্য আকাদেমি’র আমন্ত্রণে গৌহাটিতে বাংলা-অসমীয়া গল্পকার সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। ২০১৩ সালে ‘আমি’ পত্রিকা তাঁর সাহিত্যকর্মের জন্য বিশেষ সম্মান দেন। প্রসার ভারতী’র আমন্ত্রণে নানা সময়ে সাহিত্য-সংস্কৃতি অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহণ করেছেন। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, মিলিয়ে অনেক উল্লেখযোগ্য সাহিত্য পত্রে ও ওয়েব ম্যাগাজিনে লিখে চলেছেন। ইতিমধ্যেই নিজস্ব এক ঘরানা সৃষ্টি করে তিনি পাঠকের মন জয় করেছেন।

(নিত্য সমাজ সংসারের যে স্রোত আমরা চাক্ষুষ করছি তার অন্দরমহল জুড়ে ঘুমিয়ে রয়েছে কত তো কথাকাহিনী, যার পরতে পরতে  তন্দ্রাচ্ছন্ন থাকে গোপনে কত তো নারীর জীবনযন্ত্রনা, ধারক বাহক হয়ে গোটা সমাজকে যাঁরা ছাতার মতো আগলে রেখেছে, নিজের পরিচয় খুঁজে নিয়েছে, সকল ঝড়ঝঞ্ঝা থেকে দিচ্ছে মুক্তি যুগ যুগ ধরে। কয়জনের কথাই বা আমরা মনে রাখি। তাঁদের গোপন ব্যথা, অনুচ্চারিত কথা গুমড়ে মরে যায়, চোখের জল কেউ মুছিয়ে দেয় না, গণ্ডীবদ্ধ শৃঙ্খলিত জীবনই তাঁদের বেঁচে থাকার একমাত্র ভরসা। এমনই এক সাধারণ গ্রাম্য নারীর কথকতা ও চেতনায় চেনা জীবন ও সমাজপিষ্ট অব্যক্ত যন্ত্রনার পাঁচালি ‘দেশের গর্ভে স্বদেশ’ উপন্যাস।)

পথের দিশা পথই চিনে

কখন জড়ায় আপন জনে

সিন্ধুবালা হত্যেক দিন কাঁধে এক গাঁট্টি কাপর লই হক্কলের ঘরে ঘরে ঢুঁ মারে আর জিগায় ‘দিদিগো ধোপার বাড়ি দিবার লাই কিছু আছে নি।’ কেউ হেথির কথা হোনে আবার কেউ হোনেও না। বাড়ির বউরা কামকাজ করি ফুরসত হায় না, হেথি আঁর ঘরের দুয়ারে আই চুপচাপ বই থায় দুই একটা সুখ দুঃখের কথা কইব বলে। কথায় কথায় আঁরে জিগায় ‘আচ্ছা দিদি কন চাই, মাইনষের কোয়ালে এত দুঃখ লেয়া থাকে ক্যান!’  সিন্ধুবালা মনের আবেগে এইসব কথা কয়, মনের ভেতরে কোনো প্যাঁচঘোচ নাই, নিন্দামন্দ করা, কারও কান ভাঙানো হেথির স্বভাবে নাই। এঘরের কথা আর এক ঘরে চালাচালি করার সুযোগ ছিল, একটুও হিগাইন কয় না। কত কথা হেঢের মধ্যে জমা করি রায়, আঁই খোঁচা মাইরলে কেবল ইনাই বিনাই গপ্প করে। বাটি করি খই মুড়ি দিলে গালে তোলে, ঢক ঢক করি এক গেলাস জল খায়, তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলে। হেথির চুলগাইন ঢেউ খেলানো, উদোম গা, হরনের কাপরগাইন ছেঁড়া। কিয়ের লাই কি জানি আঁর লাই হেথির মনের মধ্যে ভিন্ন একখান জায়গা করি রাইখছে যতন করি। সিন্ধুবালারে আঁই অনও বুঝি উঠতাইম হারি না। হেথি কি বুঝি হালাইছে এই জীবনে আর কিছু কইরত হাইরত ন, হিয়ের লাই  ক্যামন আড়াল তুন নিজেরে জানান দেয়। আঁই কতবার চেষ্টাচরিত্র কইরছি ধইরবার লাই কিছুতেই হারি ন, হিছল খাই চলি যায়। ধরা আর দিব কি, হেথির নিজের ধারণা, হারা জীবন সংসারের ঘানি টানি ও তিল তিল করি শেষ হই গেছে। নাতিপুতি লই হেথির সংসারটা কম বড় ন। মনে কম কষ্ট ন । আঁই একদিন কইলাম, তোর বাড়িতে একদিন যাইয়ুম। কথাটা হুনি খুশিতে ডগমগ। ‘দিদি আমনেদের ঘরের মানুষ আঙ্গ বাড়িতে হা রাইখলে আমরা ধন্য হই যাইয়ুম।’ আমার হায়ের উপর কোয়াল ঠুইকল। আঁই তো আকাশ তুন হইরলাম – কী করস কী করস হায়ের মধ্যে কত কী লাগি আছে। ঈশ্বর উল্টা আঁরেই পাপ দিব।

‘দিদি গো সব্বনাশ হই গেছে। একবারে মরণ দশা। আমনেগো উত্তর বাড়ির চরণ জেঢা এই যায় তো হেই যায়।’ হেথির দুঃখে হরান যায়। কত বছর ধরেই না কত কাপড়জামা ধোয়াহালি কইরছে, ডাকখোঁজ কইরছে, এমন অসময়ে যে এমন দশা হইব, বিলাপ কইরতে শুরু করে সেইসকল কথা লই। সিন্ধুবালারে বোঝা এত সোজা নয়। ওর মনের ভেতরটা এত থলথলে, বাইরে তুন টের হাওন যায় না। ও নিজেও কী জানে হাড়াহড়শির জন্য কেন ওর এত দরদ, কেন হরানঢা এত ছটফট করে। ঝরঝর করি কাঁদি ওঢে। আঁই সান্ত্বনা দিই কই এত নরম মন লই তুই সংসার করচ ক্যামনে। ‘মাইনষের যে এত কষ্ট চোয়ে দেওন যায় না।’ সিন্ধুবালার মন বুঝার লাই আঁই ঠিক করি এবার ঘরে ঘরে যাই পরখ করি দেখুম মানুষগুন ক্যামনে বাঁচি আছে। বাড়ির মধ্যেই এতদিন চরকির মতো ঘুরি বেড়াইতাম, ভাইবতাম এইডাই বুঝি জীবন। সিন্ধুবালা আঁর ভাবনারে জাগাই দিল – না গো দিদি ঘরে বই থাইও না, দুনিয়াদারি দেইখবে চল। হেথি আঁরে লই চলি যায় অনেক দূর, যিয়ানে মাইনষে আর গরু ছাগল এক ঘরে থায়। খড়ের চাল আর গোবর লেপটানো হর্মূলের বেড়ার ঘরে দিন কাটায়। ওরা আধা লেংটা আর হেঢে ক্ষিদে লই আঁর হা দুইখান জড়াই ধরি কয়, ‘মা ঠাকরুন, এই তো নিজের চোখে দেইখছেন আঙ্গ অবস্থা।’ হেথাগো উনুনের উপর হাঁড়ি তুন ধোঁয়া গলগল করি উঢের। চাল হুঁঢের কি হুঁঢের না ঈশ্বর জানে। আঁই হা ছড়াই হিড়ির উপর বসি বসি দেই দুই তিন বছরের হোলাপাইন নেংটা পোদে ঘুরি বেড়ার, হেগুনের কোমরে তাগা হারানো, দুই একখান তাবিজ ঝোলে ঝনঝন আওয়াজ করে। মুখের দিকে ক্যামনে তাকাইয়ুম, হুকনা মুয়ে কথা বার হয় না। জীবনের রঙটা কনও তিতা লাগে। কত কষ্টের জীবনে লাগি রইছে রক্তের দাগ। নিজেরাও জানে না কনমুই গেলে এট্টু ঘুরি দাঁড়াইত হাইরব। হোলামাইয়াগুনের মুয়ে হাসি ফুইটব। সূর্যের আলো হেথাগো ঘরের বারান্দায় আই হইড়লে গোবর লেপানো মাটিটা চকচক করি ওঠে। ঘরের চালটা ফুটা। জল চৌকিতে বই তাকাই দেই নিম গাছের ডালটা উবুড় হই ফুরফুরে বাতাসে দুইলছে আর খড়ের চাল খড়গাইন উড়ি উড়ি হড়ের। কবুতররা নাচি নাচি বেড়ায়, শালিক চড়ুইরা হিচন হিচন ঘোরে। সিন্ধুবালা ওর দুই ছেলের বউ আর নাতি নাতনীর লগে আঁর হরিচয় করায়। মুখে ওর আনন্দে খই ফোটে, কয় পেন্নাম কর, পেন্নাম কর। আঁরও কি কম আনন্দ হর, হেগুনেরে জড়াই ধরি। দূর তুন হেথাগো রান্নাঘরের ছ্যাঁৎছুৎ আওয়াজ হুনি। দুইটা কাক আঁর হার কাছে আই ঘুরঘুর করে। কিরম একটা গন্ধ নাকের আছে আই সুড়সুড় করে। গন্ধটা চিনি চিনি যেন। গন্ধের কত রকম সকম। ভাতের মাড় নীল সাবান সোডা জলের গন্ধ নাকের চারপাশে আই বাতাসের তালে তালে মোচড় খায়। আঁর কাছে অন্যরকম লাইগলে কী অইছে, সিন্ধুবালাদের রোজের কাজের ঘোরে নাক সয়া হই গেছে, ফুলের গন্ধ, ফলের গন্ধ শুঁকতে যাইলেই শরীরের ভেতরটা কেমন করি ওডে। কেন হয়, হেই আন্দাজ ওরা কইরত হারে না। সকাল হইতে রাইত তক ওই গন্ধতেই ভাইসতে ভাইসতে ওগো সময় কাবার হয়। ডোবার নীল জলে শরীর ডোবে। সিন্ধুবালা আঁর চোয়ে চোয়ে কথা কয় আর হাসে।

সিন্ধুবালার এত যে চেনাজানা হথ আঁই আর কেমনে চিনুম। হেথি সামনে হাঁইটলে আঁই হিছনে হাঁটি। মাটির যে এত রঙ হেইঢা কী আগে জাইনতাম। মাটি চিনতে চিনতেই হথ চলি। সবুজ ঘাসের রঙ  হলুদ মরা ঘাসের রঙে গা ঘেঁষাঘেষি করি মুখ তুলি চাই থায়। আঁই হাঢি চলি পা ফেলি ফেলি।  আঁশশেওড়া গাছেরা হালকা বাতাসের ছোঁয়ায় রাস্তার উপর ঢুলি হড়ে। ফাঁকফোকরে থায় গিরগিটির দল। চোয়েরে ঘুরাই ঘুরাই চায় কে আসে কে যায়। বেতইন গাছের ফল ডালের ফাঁকে ফাঁকে মুখ বাড়ায়। আঁর শ্বাসের টানে লাগে গাছগাছালির ঘ্রাণ। খোলা আকাশ আর মাটির আলো যে এত মিঠা হয় কনও তো ভাবিনি। সিন্ধুবালা আঁরে কয় দিদি হা চালান। দুই একটা ছাগল ছানা ধুলা উড়াই চলি গেলে শূন্যে উঢি ঘুইরত থায়ে গোল গোল হই। এই হথে না আইলে ক্যামনে বুইঝতাম এমনও একটা গাছ-মাটি-জঙ্গলের চেহারা হয়।  মাইনষে এই পথ মাড়ায় কালেভদ্রে। কোথা তুন আইয়ে, কোথা তুন যায়, কেউ কইত হারে না, সিন্ধুবালা আঁচ কইরত হারে চেহারাখান দেই। মাইয়াগুলানের মুখে ফাটা ফাটা দাগ, মাথার চুলে কদ্দিন তেল লাগায়নি, ছিঁড়া ছিঁড়া, রঙ চটা ব্লাউজের উপর গায়ের কাপড়খানা গলার কাছে ঢুলি হড়ি যায়। যুগি বাড়িখান দেইখবার সখ ছিল কদ্দিন ধরি। দূর তুন ঠক ঠক শব্দ হুনি চমকাই উঠলাম। কেমন যেন ওগো বাড়ির দরজা। নাইরকল সুয়ারি বাগান হার হই ডান দিকে মোড় ঘুরলেই সারি সারি দোচালা টিনের বাড়ি। ঘরে ঘরে তাঁতকল। হুতার ভিতর দিই মাকু যায় আর আয়ে। তাঁতির হাত দুইটা তালে তালে নাচে। ঘরের বউঝিরা হাত বাটায়। গাছের হাতা কুড়াই আনি জমা করে। ওরা হক্কলে জোর গলায় চেঁচাই চেঁচাই কথা কয়। দুই তিনটা কুত্তা আঁরে দেই ঘেউ ঘেউ করে। আঁই কতা কইতাম গেলেও কেউ সাড়াশব্দ করে না। কী জানি কোন অভিমান পুষি রাইখছে কিনা ভিতরে ভিতরে, হেইডাইবা কোনকালের  ক্যামনে কমু। ওরা আঁরে দেই হলাই যায়, এমন করি হলাই যায় ইঁদুর যেমন করি গর্তে ঢোকে।  বাড়ি ভরতি কত রঙ বেরঙের হুতা, মোটা মোটা লাস্যি ছড়াই ছিটায় আছে। সিন্ধুবালা হেথাগো মাইয়াগুলানের লগে গালগপ্পো জুড়ি দেয়। ওরা সিন্ধুবালারে হাই আহ্লাদে আটখানা। বুইঝতাম হাইরলাম মানুষ যারে আপন করি লয়, তারে আর সহজে ছাইড়ত চায় না। ওরা আসলে আঙ্গরে অনেক দূরের মানুষ ঠাওরায়। তবুও বাড়ির বুড়া কর্তা ছুঢি আয় কয়, ‘ খাড়াই আছেন ক্যান, আমনেদের খাতির যত্ন যে কইরব, তেমন সাধ্যি কি আমাগো আছে। এই জলচৌকিটায় বহেন।’ কোথা তুন আই ছাগলের ছানাটা আঁর আঁচল ধরি টান মারে। আঁর মাথার উপর বন বন করি এক দল চিল গোল হই ঘুইরত থায়। একটা লম্বা ধোড়া সাপ লম্বা হই রোদ ফোয়ায়। ‘ ভয় হাইয়েন না মা ঠাউরাইন, ও কামরায় না, আঙ্গরে মাঝে মাঝে চাইত আয়ে, ঘুরি ঘুরি উধাও হই যায়, ও আঙ্গরে চিনে, আমরাও ওরে চিনি।’ জীবনটা আঁর কাছে বিচিত্র লাগে। কত অভাব টানাটানি ঘরে ঘরে, ঠোঁটের কোনায় হাসি লাগিই থায়। মাইনষে মাইনষে মেশামেশিতে যে এত আনন্দ, আগে তো কনও বুঝি নি। 

অভিমুন্য পাল কিয়ের লাই ইয়ানে আইছে। হেথে দুই একবার আঁর কর্তার কাছে আইছে কি কামে। তোঁগো বাড়ি কনডাই, আঁরে লই যাইবা নি। ‘সিন্ধুবালাদি তুঁই মা ঠাউরাইনরে আঙ্গ বাড়ির হথ চিনাও নি!’ হথের আর দোষ কি। কত মুই যে ছোটে। মেঘনার খাল পার হই তবে না ওই পারে পালেদের ঘরের দুয়ারে পা ফেলা। ঢেউয়ের হরে ঢেউ আই ছলাৎ ছলাৎ করে। মাঝি নৌকা বাইতে বাইতে চলি যায়। নদীর এঁটেল মাটি লই কুমোরদের কাজ কারবার। হাতে মাটি, পায়ে মাটি, গায়ে মাটি, মাটির সোঁদা গন্ধ হুরা বাড়ি। চাকা ঘোরে মেঝেতে, হাতও ঘোরে।  অর্ধেক পাতিল তৈরি হয়। বাকি অর্ধেকের কাজ কুমোরদের বউরা করে। ঢিবির উপর কাদা বসাই পিটুনি দিয়ে পেটায়, গোল প্লেট হইলে পাতিল ও কলসির নিচে বসায় কায়দা করে। রোদে হুয়ায়, চুলায় হোড়ায়। মাটির হাঁড়ি সরা পাতিল মালা চরচর করি তৈরি হয় যায়। এই দৃশ্য ক্যামনে ভোলা যায়। বাঁশের ধারালো চোঁছ ছুরির মতো করি ধরি কাদা কাটি মসৃণ করে।  হারা বাড়িতে হাঁড়ি কলসি হাতিল ঢুকসা সার বাঁধি হড়ি রয়। লোকে আই চাইল ডাইল সবজি দিই কিনি লই যায়। অভিমুন্য খাটে, ওর হোলা খাটে, বউ জান প্রান দিই হালায়। জাত ব্যবসা, ছাইরত হারে না। অন্য কাম করি যে খাইব হেই বিদ্যাও তো জানা নাই। হরের পিড়ির হোলারা আজকাইল কুমোরগিরি কইরত চায় না। চাষবাস দোকানদারি করে। ষ্টিলের হাড়ি গ্লাস বাজার দখল করি নিচে। মাটির খেলনা কে আর হছন্দ করে। বড় দুঃখ করি কয় অভিমুন্য আর চোয়ের জল হালায়। বাড়ি ভর্তি কাদামাটি এঁটেলমাটি চিনেমাটি জায়গায় জায়গায় হড়ি আছে। মাইয়াগুলা বাদ যায় না, মুয়ে চোয়ে হাতে পায়ে ওই হুকনা মাটির দাগ লই ঘর বাইরের কাম সারে। মাটির লগে ওরা ঘর করে, শোয়া বসা ওই মাটির গন্ধ শুঁকে শুঁকে। এই জীবনে আনন্দ আছে কিনা জানি না, তবে কিনা ষোলো আনা দুঃখ আছে। হেঢের ভাতও জোটে না। সিন্ধুবালা কি যেন খোঁজে। ঘুরে ঘুরে মরে মাইয়াটা। মাইনষের হকল দুঃখগাইন নিজের মধ্যে হজম করে। কতকাল আমরা অচ্ছুত করি রাইখছি। থুথু ছিটাইছি। হেগুনেরে আপন করি নিবার কথা একবারও তো ভাবিনি। আইজ এত কাছ তুন হেথাগো খাটাখাটনি দেই মনের ভেতরটা কেন জ্বলি পুড়ি যার। হরের কথা নিজের হই গেলে বুইঝতাম হারিয়ের কেমন দুঃখ লাগে। ওরা হাঁড়িতে ভাত চড়ায়। ভাত ভট ভট করি উথলাই হড়ে। বিক্রিবাট্টা হইলে তবে না চোয়ের কোনায় ঝিলিক মারে, খাওনের স্বপন দেইখত চায়। জুইটলে ভালা, না হইলে কোয়ালের দোষ ভাবি মাথা চাপড়ায়। ভাগ্যিস সিন্ধুবালা আঁরে মাইনষের দুঃখের লগে হরিচয় করাইবার লাই লগে লগে লই আইছে, না হয় কি এমন সুযোগ হইত। এমন করি ঘরের বার হইবার লাই কত কথা যে হুইনত হইব, বাড়ির মানুষ ক্ষেপি আগুন হই যাইব, হেই কথা আর বইলতে। হেগো আনন্দের বহরই দুঃখের বোঝারে নরম করি দেয়। 

ছুতোর বাড়ি কোনদিন যে আইয়ুম ভাবি ন। জীবন কোন মুই ধায় কেউ জাইনত হারে না। মাইনষের মনের ভাবগতিক বোঝা দায়। রামচন্দ সূত্রধর আঙ্গ বাড়ি আইত, কোনদিন দেই ন। আঁর স্বামীর লগে কথা কই চলি যাইত। কী কথা হইত আঁই ক্যামনে জানুম। আম গাছের চেরাই কইরবার লাই লোক লস্কর লাগাই মাঝে মাঝে মুখ দেখাইত। হেথাগরে লই কোনো ভাবনাপাতি মনে জায়গা হায় ন। লোকে আঁরে যা কয় কক। কী আর কইব, বাড়ির বউ হাড়া চড়ি বেড়ার। হেথেরা কী করি বুইঝব এর মর্ম, হেথাগো কী দোষ আঁই নিজেও তো বুঝি নি। কত লোক আইছে গেছে, কত ঘটনা ঘইটছে, কতদিন চলি গেছে কোনদিন মনেও তো হড়েনি সেই দিনগুনের কথা। কালের মতো কাল চলি গেছে, অন মনে হয় হেই সময়টারে টানি তুলি। কত কথা মনে জাগে, মাইনষে মাইনষে কোনো মিলমিশ নাই কেন? এই প্রশ্নখান অবান্তর মনে হইলেও হইত হারে। মাইনষের ধর্ম মাইনষের কাছে, আঁই ভাবি করুম কী! তবুও আশা কইরতে দোষ তো নাই। রামচন্দ কেন্নে কেন্নে বংশ বিস্তার কইরছে, স্বপ্নেও তো ভাবি ন। খালি মনে মনে ভাইবছি দুইঢা হইসার লাই কত খাটনিই না খাটে। হারাদিন হাতুড়ি বাটালি করাত ছেনি রেঁদা ড্রিল লই হেথাগো কাজকারবার, হাত গুটাই বসি থাওনের জো আছে নি। কাঠের গুঁড়া ছড়াই রইছে কোনায় কোনায়, শিরীষ কাগজের ঘষাঘষি আর যেন থামতেই চায় না, তারপিন তেলের গন্ধে ভূত পালায়। গালা লাগায় কাঠের আলমারির গায়ে। সিন্ধুবালা হেথাগো ঘর দুয়ারে ঢুকি যায়। আঁই ভাবি ওগো মধ্যে কোনো ভাবের অভাব নাই। কে যেন আঁর হা টানি ধরি রায়। আঁই চাইলেও ওগো মনের কথা বুইঝতাম হারি না। ওরা যে ক্যামনে ডুবে আছে ঈশ্বর জানে। দুই চাইর জন লোক আইয়ে দূর গাঁ তুন। ওরা মাইয়ার বিয়ার খাট আলমারির বায়না করে। হুরা সেগুন কাঠ দিই করা চাই। ওদের বাবুর কড়া হুকুম। ওরা মাথা নীচু করি হুকুম তামিল করে। এতক্ষণ জড় হই কথা হুইনছি, হরে হরে যে যার কামে লাগি যায়। বায়নার জিনিস যেমন করি হোক, তৈরি করি দিতে হইব, এর অন্যথা হইলে বাবু মশাইয়ের গোঁসা তুন কেউই রেহাই হাইত ন। ওরা মাথা উঁচু করি না দাঁড়াইবার লাই আঁর মনটা খচখচ করি ওঠে। অপরাধের বহরটা বাড়ি যায়। হ্যাঁ আমাগো ব্যবহারই দায়ি, দূরে সরাই রাইখছি গরু ছাগলের মতো। হেই কারণেই তো আঙ্গরে আপন কইরত হারে না। সিন্ধুবালা কত সহজ করি কথা কয়, আঁই কইতাম হারি না। ভাইবলে নিজেরে দোষারোপ কইরতে ইচ্ছা করে – হেথেরা আঙ্গ কত বংশ ধরি দরজা জানালা আসবাবপত্র বানাই আইছে। হেথাগো বাড়ির সামনে বই নিজেরে একবার ঝাঁকাই লই মানুষ হইয়া জন্মাই কী লাভ হইল! এগো বাড়িতে কোনো ধানের পুঁজি নাই, খড়ের গাদা নাই, গরু নাই, ছাগল নাই। ডোবা নালা আছে, হানা হুইর আছে। হাঁসের দল প্যাঁক প্যাঁক করে। মাইনষের মুয়ে কোনো শব্দ নাই, মুখ গুজি ছেনি বাটালি চালায়। ধপাস ধপাস করি গরুর গাড়ি আই  গাছের গুঁড়ি আনি গোলা ঘরের সামনে আনি হালায়। এমন দৃশ্য আগে কনও দেই ন।

ওদের ঘর দেই হরান যায়। আয়নাল হাড়ার ঘরবাড়ির রকমসকম চোয়ে লাগে না। এদিকে পানে চাই তো ওদিকের বারান্দা ঢাকা হড়ি যায়। খড়ের ছাউনি তো, গায়ে গায়ে লাগানো তাল পাতার ছাউনি, ফাটা ফাটা, বাতাসের ধাক্কায় মচমচানি শুরু হয়। পাখিদের কলকলানিতে চুপচাপ থাকা বাড়িটা চনমনে হয়ে উঢে। কোনও পুরুষ মানুষ ঘরে নাই, ক্ষেতে হালচাষ কইরত গেছে। মাইয়ারা চুলায় আঁচ দেয়। ধুলা উড়াই উঠানে ঝাঁট মারে। মোরগ মুরগী ঘুরি বেড়ায় কেমন সুন্দর। আঁরে দিবার লাই কোন কোনার তুন দুই তিনটা ডিম টুকরিতে করি লই আইয়ে। ওদের হরনে সবুজ রঙের ফুল ফুল ছাপা কাপড়। আঁচলের কাছে ছেঁড়া জায়গায় রিপু করা। হিন্দুর বাড়ির বউ হেথাগো বাড়িতে দেই চমকাই উঢে। কালেভদ্রে হা হড়ে না। কেমন করি  আদর যত্ন কইরব তা লই ব্যতিব্যস্ত হই যায়। কি খাইতে দেয় এই লই নিজেদের মধ্যে শলা পরামর্শ করে। হিন্দুর বাড়ির বউ আইছে হেথাগো বাড়িতে চিন্তার অন্ত নাই। কত গাছগাছালি বাদি গাছ,আম গাছ, জাম গাছ, সুয়ারি গাছ বসত বাড়ি ঘিরে। রোদ আই ছায়াদের টপকাই কত না ছবি আঁকি রাইখছে মাটির দেয়ালে দেয়ালে। আঁর খালি ইচ্ছা হয় একটু আধটু ফাঁকফোকর খুঁজি। কেন খুঁইজতাম চাই হেই তো আমিও জানি না। মনের মধ্যে ঘুটঘুট করে। কী একটা আই যেন মিলাই গেল, আবারও আই চোয়ের পাতায় পকপক করে। একটা কিছু যা আমি দেইখতাম চাই আধাআধি দেখি, হুরোহুরি দেইখতে চাইলেও সর্বনাশ। ইয়ান তুন হিন্দুর বাড়ি দেয়ন এতই কী সোজা, যেন শত যোজন দূরে। কেন এমনটা হইল এই প্রশ্নের উত্তর হাওন এত সোজা কথা নয়। চোয়ের দৃষ্টি ঘুরাই ঘুরাই আঁই দেইখতাম চাই, হক্কলকিছু অন্ধকার লাগে। আঁর বাড়ি কনডাই  বুইঝতাম হারি না। ঘর ছাইড়লেই বোঝন যায় হরের ঘরগাইন নিজের ঘরের চাইতে কত বড়, কত চওড়া। এই দুইয়ের মাঝখানে কত লতাপাতা কত খাল কত বিল, কত ঘেউ, কত মাঠঘাট, কত জঙ্গল, কত মানুষ, কত বনমানুষ, হেথাগো রোজ আওন যাওন। শঊন্যতআ আই গিলি খায় দিনরাত। মুনিয়া বানু, রশিদা বিবি, আমিনা খাতুন আঁর চারহাশে কথার হরে কথা সাজায়। আঙ্গ বাড়ির কত রাজ্যের গুনগান করে। হেগুনে আঁরে প্রশ্ন করে, ‘আমনেরা আঙ্গরে এত ঘেন্না করেন ক্যান? আমরা কি মানুষ নই?’ হেগুনের কথার কী উত্তর দিমু! উত্তর খুঁইজত যাই আঁই নিজেও কোনো কূলকিনারা হাই না। এই পৃথিবীতে অনেক প্রশ্নের উত্তর এরকম করি মাটিতে চাপা হড়ি যায়। আঁই ওগো মুয়ের তুন চোখ হিরাইতে হারিয়েন না। ওরা আমারে অনেক প্রশ্ন কইরব বলে নিজেদের গুছাইতে থায়। ওরা কত করি চায়, আঁরে হেথাগো রসুইঘরে লই যায় আঁরে ভালোমন্দ খাওয়াইব। আঁর মনের মধ্যে কত রকমের ভাবনা আই গুড়গুড় করে। যদি হাঁচাই ওরা টানি লই যায় সামলাইয়ুম কী করি! তবু এক প্রকার স্থিরই করি হালাইলাম যেমন করি হোক মনের বাধা বিপত্তি ঠেলায় হালায় ভেতরে যামুই যামু। আঁই যন হা বাড়াইলাম হেগুনে খুশিতে ডগমগ। সিন্ধুবালা আঁরে সাবধান করি দেয় – দিদি আমনের কিন্তুক জাত যাইব, একবার চিন্তা করি দেইখবেন হিন্দুর উঁচু জাতের মাইয়া হই এটা মানানসই হইব তো। হেথির কথা আঁই গেরাহ্যির মধ্যে ধরি ন। এত ভাবনাচিন্তা কইরলে চইলত ন গটগট করি ঢুকি যাইত হইব। শুধু কে যেন কইল ‘পঞ্চমী, হেথেরা গরুর মাংস খায়, মুরগি পোষে, প্রায়শ্চিত্ত কইরত হইব কিন্তু।’ দম বন্ধ করি ঢুকি গেলাম রসুইঘরে। আঙ্গ মতনই মাটির চুলা, হোড়া হোড়া হরমুল, হুকনা গাছের ডাল, হাঁড়ি পাতিলের গায়ে কালি লেপটানো, টেপ খাওয়া। দুই চারখান আরশোলা ফুরুৎ করি ছুটি চলি গেল। আঁরে একখান ছেঁড়া কাপড়ের সেলাই করা হিড়িতে বইসতে দিল। মাথার মধ্যে কি একখান পাক খাই গেল আবারও – তুই না হিন্দুর মাইয়া। বেড়ার ফাঁক দিই দেইখলাম খালের উপর দিই একখান পাল তোলা নৌকা চলি যার তর তর করি। নৌকাটা সরি গেলেই বালির স্তূপ। মাথা উঁচু কইরলে দূরে দেইখলাম আঙ্গ হাড়াখান লজ্জ্বায় ঢলি হড়ি আছে। মোসলমানদের হাড়াখান যেন উদোম গায়ে দাঁড়াই আছে। এক ঘর তুন দুই ঘর, দুই ঘর তুন তিন ঘর, এইরকম করি বারো চৌদ্দ ঘর জড়াই জড়াই আছে। আগে কোনোদিন আই না বিধায় এট্টুখানি দুঃখ হর। কতগুন হাখি উড়ি আই হেথাগো চালে বইছে, এগুনে উড়ি উড়ি আঙ্গ উঠানে চরিবরি খায়। এইভাবেই না এক দেশের মানুষ অন্য দেশে চলি যায়। ওই তো মোসলমানদের কবরখানা। হজরতের বাপরে ইয়ানেই তো কবর দিছে। আহা! কতদিন আঙ্গ জমিজমা চাষ কইরছে। মরার আগে বুয়ের হাড়গুন বার হই গেছিল, কইত, ‘ভাবি, আঁর বেশিদিন বাঁইচতাম ন। আঁর হোলামাইয়ারে হাইরলে এট্টু সাহায্যআন্তি করিয়েন।’ কইতে কইতে চোয়ের জল হড়ি যাইত। মাইয়াগুন আঙ্গরে আগাই দেয়। এই হথে কোনোদিন হায়ের ধুলা হড়ে ন, এই গাছের ছায়া কোনোদিন মাড়াই ন, এই জলের গন্ধ কোনোদিন গায়ে মাখি ন, গালে হাত দিই কোনোদিন চুমু খাই ন, এই এতগুন কেনোর উত্তর আঁরে কে দিব, আর কেন্নেই বা দিব, কেউ যে কারোগে চিনে না, জানে না, বোঝে না। আজ কিয়ের লাই আত্মীয় আত্মীয় লাগে, ছাড়ি আইতে ইচ্ছা করে না। ডানা ঝাপটাই আইত চায়, হায়ে যে বেড়ি হরাই রাইখছে কারা যেন, কবে তুন।

সিন্ধুবালারে আঁর ভাগ্যবান মনে হয়। বয়সে আঁর ছোট হইলেও জীবনটাকে কতদিন ধরি দেইখছে, কতরকম করি দেইখছে, হেথিরে দেই হিংসা হইত ন, তো কারে দেই চোখ টাটাইয়ুম।  হেথি আঁরে কত কিছু চিনায়, আঙ্গুল উঁচাই চিনায়, বেগ্গাইন যে গুলি খাইছে। হেথিরে মানুষ মনে হয় না, এক লম্বা গাছ, জল দিই সার দিই কারা যে লম্বা বানাই দিছে, নিজেও জানে না ও আড়ে বহরে কতটা বাড়ি গেছে। হেথির চিনতাম চাই আঁই আছাড় খাই হড়ি যাইয়ের। আঁর কাণ্ড দেই পেট হাডাই হাসে। কোনও দুঃখ যেন ছুইত হারে না, দুঃখের ভার জমাট বাঁইধলে তাড়াই ছাড়ে। কত কথা নিজের মনে কয়। মানুষের গল্পগআইন ও রসিয়ে রসিয়ে আঁরে হুনায়। আঙ্গুল উঁচাই দেয়ায় – ওই মাঠ দেইখছেন দিদি কত কম বয়সী হোলারা মাথা ঝোঁকাই নাড়া তোলে মুঠা মুঠা করি চড়া রোদ মাথায় করি। সাতসকালে আইয়ে বিয়াল হইলে যার যার ঘরে চলি যায়। কী সোন্দর যে লাগে হেগুনের হা নাচাই নাচাই ঘর যাওন দেই। ওই নাড়া দিই চুলায় আঁচ লাগায়, রস জ্বাল দেয়, ভাত তরকারি রাঁধে, লাকড়ির খরচ বাঁচি যায়। হেইঢাতেই সুখ দুঃখের গোনা গুনতি করে। কী আনন্দ মনে, হেন্নেই কত খুশি হই লাফ ঝাপ করে। হেগুনের মা বাপের কাছে কোনো দাবি দাওয়া নাই। তুই এতগাইন খেয়াল ক্যামনে করছ? ‘এই যে মাঠের আল ধরি হাঁঢি, গাছের ছায়ার নিচে বই হরানডা জুড়াই আর হেগুনের দিকে চাই থাই।’ সিন্ধুবালা যন এই কথাগাইন কয় ওর মুয়ের হাবভাব হাল্টাই যায়, হেথি নিজের মধ্যে নিজে থায় না, অন্য মানুষ হই যায়। আঁই এককারেই চিনতাম হারি না। মাইনষের চেহারা যে এইভাবে হাল্টি যায়, ওরে না দেইখলে বুইঝতাম হাইরতাম না। মাইনষের আঁইডা খাই যারা দিনদুপুরে টই টই করে ঘোরে, তাঁগো  ক্যামনে দরদ হয় অন্যের লাই বুইঝতাম হারি না। কবুতররা বাক বাকুম বাকুম করে, সিন্ধুবালা নিজেরে স্থির রাইখত হারে না, কি জানি ছানারা হড়ি ছটফট না করে। হেথি মানুষ আর হাখিরে এক করি হালাই। হিয়ের লাই কোনো ভিন্ন হথ দিই হাঁইটত হয় না। যে হথ দিই মানুষ হাঁটে, সেই পথের ধুলাই মাথায় তুলি লয়। তাই তো ওর চোয়ের আলো কত সহজেই না আঁর চোয়ে চলি আয়ে। আঁর এতকালের দেয়াটা কেমন করি নিমেষে হালটি যায়। কত প্রশ্নই তো হাঁকপাঁক করে। এই আঁই কি দেইয়ের! এই ঘর তো সেই ঘর নয়, এই বাড়ি সেই বাড়ি নয়, এই রাস্তা সেই রাস্তা নয়। হেথেনরা নিজের মতো সাজাই গওছআই রাইখছে, নিজেরা যেমন করি বাঁইচত চায়, হুইত চায়, বইসত চায়, ভালোবাইসত চায়। হেই কারনেই আঁর মনে হইতে থাকে, এত কালের ভাবনাগুলি দোমড়াই মোচরাই শেষ করি হালাই। হেথাগো আমাগো মিলাই মিশাই এক নতুন জগত তৈরি করি। সিন্ধুবালা তেমন করি চাই, আঁই কেন তেমন করি চাইতাম হারি না।

আঁই আর বাড়ি চলি আই, ঘরে ঢুকি তাই। ঘরে ঢুকি নিজের ঘরটাতে চিনতাম হারিয়েন না। বিষম খাই।   আঁরে কী নতুন কোনো রোগে হাইছে?  হাইলে কেন হাইছে এর উত্তর আঁরে খুঁজি বার কইরত হইব। ঘরের লগের ঘরের মধ্যে যে মনের ভাগাভাগি শুরু হইছে, ছাল ছাড়াইবার খেলা শুরু হই গেছে মনের মধ্যে এর একটা কারণ তো আছে। যদি কথার পিঠে কথা বসাই একে অন্যরে নরম সুরে ডাইকত, আঙ্গ বাড়ির চেহারাখান হাল্টি যাইত রাতারাতি। অন এমন এক অবস্থা হইছে হক্কলে যে যার ঘরমুখো হয়, কারও দিকে হিরেও তাকায় না, এক হাত জমি লই মারামারি চিল্লাচিল্লি, হাইরলে এ ওর চুল ছিঁড়ি হালায়। মনের দুঃখের কথা কারে আর কমু, এমন দিন যে আইব কোনোদিন ত ভাবিনি। চারদিকের বাঁচি থাওনের লড়াই দেই কত যে নতুন নতুন স্বপ্ন আই ঘিরি ধরে, আঁই শত চেষ্টা করিও জট ছাড়াইতাম হারি না। তবু ভাইবতাম শেষ চেষ্টা করি দেই। এর মধ্যে কত কথা উঠইছে, আঁই ছোট লোকদের দলে নাম লেখাইছি, হেথাগো রসুইঘরে বই পাত পাড়ি খাইছি, গা গলাগলি করি গালগপ্পো কইরছি, উঁচু জাতের ঘরের বউ হই সিন্ধুবালারে লই টইটই করে ঘোরা, মোটেও ঠিক কাম করি ন। যারা এত কথা কর আঁই জানিনা সিন্ধুবালারে ওরা কতজনে চিনছে। মাইনষের বাইরের চেহারা দেই ভেতরটা কি চেনা যায়! সিন্ধুবালা তো হাঁক দিই যায় ‘ধোয়াহালা কাঁচাকাঁচি করার কাপড়জামা আছেনি দিদিরা?’ হক্কলে ডাক হুনি ওর গাঁট্টির মধ্যে ছুড়ি ছুড়ি হালায়, হারিও তাকায় না, সিন্ধুবালার মুখটা কেমন, চোয়ের কোনায় কালি হইড়ছে কি হড়েনি। মনের মতো কথা বইলতে চায় কি চায় নি। আসলে হেথিরে সিঁড়িতে বইসতে দিলেও ঘরের ভেতরে আমরা ঢুকতে দিই নি। আজ আঁই ভালোমন্দ খানা বানাইছি, সিন্ধুবালারে কইলাম আইজ আঙ্গ ঘরে চাট্টি ভাত খাই যা। হেথি আর দিকে অবাক হই চাই থায় এমন করি যেন আকাশ থুন হইড়ল। আঁই বুইঝতাম হাইরলাম না কোন দিকে ঘাড় নাইড়ল। আঁই কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করি হেথিরে ঘরের ভিতরে টানি আনি বসাইলাম। কইলাম লজ্জা হাস না, হেট ভরি খান। বুইঝতে আঁর দেরি হইল না, সিন্ধুবালারে লই কানাঘুষা শুরু হই গেছে। খেজুরের রস দিই মিষ্টান্ন বানাইছি, হেথি খাই কী খুশি। আঁর দেওরদের হোলাপাইনদের লাই হেথাগো ঘরেও বাটি করি হাঢাইছি। ওমা কিছুক্ষণ হরে দেখি হেগুনে বাটিগুন ফেরত হাঢাই দিছে। সিন্ধুবালা বুইঝত হাইরছে কেন মিষ্টান্ন ফেরত আইছে। ‘দিদি, আমনেরে কইছিলাম এমন অনাসৃষ্টি কাণ্ড করিয়েন না, আমনে তো হুইনলেন না। আঙ্গ মতো নীচু জাতের ঘরের লোকেরে কে আর আমনের মতো ভালোবাইসতে চায়, শেষমেশ দেইখবেন আমনেরে না এক ঘরে দেয়। আর যদি জাইনত হারে আমনে মোসলমানদের রসুইঘরে হা রাইখছেন, বাঁধাই দিব লঙ্কাকান্ড।’ সিন্ধুবালার বোধজ্ঞান দেই আঁই তো আকাশ তুন হইড়লাম। কেন্নে হেথি আঙ্গ মনের ভাব বুঝি গেছে। আঁই মনে মনে ভাইবলাম, ধর্মের লাই মোসলমানদের আঙ্গ ঘরের চৌকাঠে জায়গা মেলে না, হিন্দুদের মধ্যেও কত ভেদভাব, কবে এগুনে মাইনষের মতো মানুষ হইব। অন যদি হেথিরা অন্য দিকে ঝুঁকি যায়, তাইলে কী মোসলমানদের দোষ দেয়া উচিত হইব !

সিন্ধুবালা কাঁদিকাঢি চোখ ভাসাইল। আঁই হেথিরে আগাই দিতে গেলাম। ‘আমনে হিরি চলি যান, বিপদ আর বাড়াইয়েন না দিদি।’ কি জানি হেথি কী ভাইবল। মনের মধ্যে নতুন কোনো ভাবনা জাইগবার সময় সুযোগ হায় না। এমন করি তুচ্ছতাচ্ছিল্য এইটাই যে রীতিনীতি, এইটাই চলনসই হাবভাব হক্কলের মনের মধ্যে গাঁথি আছে, এর তুন বার হইবার রাস্তা কারও যে জানা নাই। আঁই তাকাই তাকাই দেই হেথি চলি যার হিঢের হিছনে কাপড়ের গাঁট্টি হালাই। কোনোদিকে তেমন ভুরুক্ষেপ নাই। শ্মশান হার হই যাইবার সময় হিরি হিরি চায়। আঙ্গ বাড়ির মরা ইয়ানে হোড়ায়, হেথির দশ বছরের নাতিরে এই শশ্মানেই হোড়াইছে। আঙ্গ বাড়ির মরা মাইনষের স্মৃতির লাই মঠ বানাই রাইখছে। পঞ্চাশ একশ দেড়শ বছরের হুরান। আমরা দূর তুন মাথা ঠুকি যার যেমন মন চায়। সিন্ধুবালাদের মরার স্মৃতি রক্ষা কইরবার তেমন সুযোগ নাই। তবু কি মনে করি শ্মশানের বুকের মাঝখানে ছুটি চলি আইয়ে। আপন মনে ঠাঁ ঠাঁ রোদের মধ্যেও বিড়বিড় করে, গুনগুন করে, বুক চাপড়ায় । কী কয় ঈশ্বর জানে। জেলেরা জাল ফেইলতে ফেইলতে যায়। হাওয়ার মধ্যেও তন কত কথা ভাসি ভাসি যায়। সিন্ধুবালার সঙ্গে কথা কয় কিনা বোঝার উপায় নাই। তবু কিনা মাইনষের গলা হোনা যায়। সিন্ধুবালারেই তো ডাকে। কত তো ফিসফিসানি। জেলেরা ইশারা করি ডাইকলে নৌকায় চড়ি বয়। ঘুরি ঘুরি চলি যাইব অনেক দূর। পথের মধ্যিখানে হাঁকের মধ্যে নামাই দিলে হাঁঢি হাঁঢি যাইব এই আশায়। আউলা চুলে নৌকার গলুইতে হাখান মেলি জল ছিটায়। আঁর মনে মনে আশা জাগে যদি সিন্ধুবালার মতো হই যাইতে হাইরতাম যন যেমন খুশি যার তার লগে কথা কইতে হাইরতাম। কারা যেন আঁর হায়ে বেড়ি হরাই রাইখছে। আঁর স্বামীরে হিয়ের লাই দোষ দিই না। তবে কারে দোষ দিমু হের উত্তর আঁর জানা নাই। সিন্ধুবালা বেশ বুইঝত হারে হেথি কেন যন তন যিয়ানে খুশি যাইত হারে। কাউকে কৈফিয়ৎ দিবার কিছু নাই। আঙ্গ বাড়ির অনেকেই আঁরে বাঁকা চোয়ে দেহে। যত দোষ নন্দ ঘোষ  সিন্ধুবালার বাঁকা চোখ। তবে কী হেথির আনা যানার উপর শমন জারি হইছে। তাই যদি হবে এত বড্ডা রাবণের গুষ্টির কাপড়জামার কী গতি হইব! চিন্তার বিষয়খানা বটে। শেষমেশ ঠিক হইল কাউরে দিই কাপড়জামাগাইন ধোপার বাড়ি পৌঁছাই দিবে। এতে সিন্ধুবালার এমন কী ক্ষতি হইল! হেথিরে না দেই আঁর হরানডা যে যায়। হেথির চোখ দিই যে অচ্ছুতদের ঘরবাড়ি দেই। হেগুনে বাঁচি আছে কি নেই কে আর খবর রায়, নিজেরা বহাল তবিয়তে থাকলেই হইল। দলভারি কইরবার বেলায়ই না সিন্ধুবালাদের ডাক হড়ে।

(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *