মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস 

নবম পর্ব

আমাদের পুরোনো পাড়ার উঁচু উঁচু রোয়াকওয়ালা বাড়ির কথা খুব মনে পড়ে। আমাদের বাড়ির ঠিক উল্টো দিকে ছিল এমন দুটি উঁচু রোয়াকের বাড়ি যাদের ঠিক মাঝে একটি দু তিন ধাপের সিঁড়ি ছিল। সিঁড়ি দিয়ে উঠে সরু পথ দুই বাড়ির দরজাকে নাগালে এনে দিত। হয়ত একই মালিকের ছিল। এর একটিতে ঝর্ণা জেঠিমা ভাড়া থাকতেন জেঠু আর দুই মেয়েকে নিয়ে। ছোটদের তখন অঢেল সময় থাকত পাড়ার সব্বাইকে বিরক্ত করার৷ আমিও করতাম৷ অর্থাৎ পাড়ায় সবার বাড়ি বকবক করে বেড়াতাম৷ ঘরে ঘরে চকোলেট আইসক্রিম না থাকলেও নিমকি নাড়ু এসবও জুটতো৷ তখনকার দিনের মা জেঠিমা কাকিমাদের এসব কিছু মনে হত না৷ তাই ঝর্ণাজেঠিমাও নিশ্চয়ই বিরক্ত হতেন না৷ দিদিরা ভালো গান গাইত। নিচের একটা ঘরে আবার দলিল লেখার কাজ হতো। সামনের চ‌ওড়া বারান্দায় ভিড় করতো কিছু মানুষ জন। 


আস্তে আস্তে ছেলেমানুষ আমিটা বড় হতে হতে জেঠিমার মধ্যে একটা অন্য বিষয় খেয়াল করলাম৷ বিশেষতঃ প্রায় সন্ধ্যেবেলা আমি যখন বইপত্র নিয়ে রোজকার পড়ার অছিলায় বসতাম, রাস্তার উল্টোদিকের দোতলার ঘরটাতেও ফাঁকিবাজ চোখ বার বার চলে যেত৷ টিউব জ্বলা ঘরে বেতের চেয়ার টেবিলে বসে জেঠিমা বইপত্রে ঝুঁকে আছেন৷ বাবার কাছে পরে জানলাম, উনি লেখেন৷ কি লেখেন? গল্প, কবিতা। স্হানীয় পত্রিকা, কাগজে তখন নজরে এল ওনার নাম, ওনার লেখা৷ জেঠিমাকে সেটা অন্য রকম চেনা৷ আমিও যে ইস্কুলের খাতার পেছনে অন্তমিলের চেষ্টা চালাই বাবার মত! কিন্তু উনি কাগজ বইএ লেখেন! লীলা মজুমদার বা কামিনী রায়ের লেখা পড়ছি বইয়ে। কিন্তু কোনো মহিলা লেখককে চোখের সামনে সেই প্রথম যেন দেখলাম। আজ থেকে তিরিশ চল্লিশ বছর আগে মফস্বলি মেয়েদের কাছে এটা কতটা অনুপ্রেরণা, আমি আজ অনুভব করি৷ হয়ত খুব বড় মাপের লেখক হয়ে উঠতে পারেন নি, হয়ত যতটা আত্মপ্রচারের দরকার ছিল তা উনি করেন নি৷ তবু কালনার পুরোনো পত্র পত্রিকার পাতায় চিরস্হায়ী হবে ঝর্ণা ঘোষের নাম৷ জানি না, কোনো সংকলন হয়েছে কি না তাঁর লেখার৷
শেষের দিকে কালনার বাস তুলে জেঠু জেঠিমা বিবাহিত মেয়েদের মমতাছায়ায় চলে যান। বড় আফশোষ আমার কাছে ওনার কোনো ছবি নেই ৷


এর লাগোয়া বাড়িটা ছিল অনিরুদ্ধ মুখোপাধ্যায়ের। বাড়িটা স্কুল শিক্ষক জেঠু কিনে নিয়ে ছিলেন। জেঠুর সকাল সন্ধ্যা অনেকটা সময় কাটত অঙ্কে দুর্বল ছাত্র ছাত্রীদের পোক্ত করার কাজে। আমিও দু এক বছর জেঠুর কাছে টিউশুন পড়েছি।


এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে, আমাদের ছোটবেলায় পাড়ার বেশিরভাগ কাকু জেঠুরা আশেপাশের ভাইপো ভাইঝিদের স্বনিযুক্ত শাসক ও শিক্ষক ছিলেন। তেমন একজন ছিলেন, হাম্বা দিদার ছেলে অসিত স্যান্যাল। আমরা তাকে কোকিল (উকিল) জেঠু বলে ডাকতাম। উকিল বলেই কিনা জানি না, দেবভক্তিও একটু বেশি ছিল। দেব দেবীর বাঁধানো ফটো খুব সুন্দর করে চন্দনের আল্পনায় সাজিয়ে তুলতেন। আমাদের বাড়িতে ওনার সাজানো একটা বড়সড় গো-পালনরত কৃষ্ণের ফটো ঝুলতো। শণি মঙ্গলবার আমাদের বাড়ি নীল থোকা অপরাজিতার খোঁজে আসতেন। এসেই খোঁজ পড়তো আমার। মাধ্যমিকের আগের কয়েকটা বছর আমাকে মিডল টার্ম ফ্যাক্টরের প্যাঁচে ফেলেছিলেন।


আর একজন ছিলেন শশীবাবু (মজুমদার)। কালনা সংস্কৃতি জগতের উল্লেখযোগ্য নাম। ভাইকে তবলার তালিম দিতেন আর আমার গানের সাথে সঙ্গত করতেন। আর তারপর বসতেন ভূগোলের অঙ্ক নিয়ে। সেটা অবশ্য আমার ভালোই লাগতো। বর্তমানে এই রকম মানুষের দেখা মেলে কিনা জানিনা, যারা নিজেদের ছাত্রাবস্হায় ভালোলাগার বিষয়টি পরিচিত ছোট ছেলে মেয়েদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে আনন্দ পেতেন।
অনিরুদ্ধ জেঠুর বাড়ির কথা ভাবলেই মনে পড়ে ওনার ছেলে অসীমদার ঘুড়ির জন্য পাগলামির কথা। তখন‌ দুই অশোকদা, কার্তিকদা, অসীমদা আর জ্ঞান পাল বাড়ির সব ছেলেরা ঘুড়ির দিনগুলো পাড়া মাতিয়ে রাখতো। অসীমদার দুঃখজনক আত্মহত্যার পর জেঠু জেঠিমাও খুব তাড়াতাড়ি পরপারে চলে গেলেন। সেই বাড়িটিও এখন হাত বদল হয়ে নতুন রূপ নিয়েছে।


এই বাড়িটার ঠিক পাশের তিনতলাটা বর্মণ ডাক্তারখানা মোড়ের শেষ বাড়ি। একতলার একদিকে ছিল হক সাহেবের বিখ্যাত চশমার দোকান। সেই জন্ম ইস্তক এই দোকানে কাচের শো কেসে কত রকম চশমা আর সানগ্লাস দেখেছি তার ইয়ত্তা নেই। হক জেঠুর বাড়ি ছিল রাজরাজেশ্বরী তলায়। ঈদের দিন সুস্বাদু খাবার পেতাম ওনাদের বাড়ি থেকে। হক জেঠু এই দোকানঘর ছেড়ে দেবার সময় ওই কাচের শো কেসের একটা আমার বাবা কিনে আমাদের বাড়ির দেওয়ালে টাঙানোর ব্যবস্হা করেছিলেন বই রাখার জন্য।
চশমা দোকানের পাশে সিঁড়ি দিয়ে উঠে যাওয়া যেত বেশ উঁচু একটা বারান্দায়। এই বারান্দার লাগোয়া ঘরটা বন্ধই থাকতো। হঠাৎই একদিন দেখি সেখানে টেলিফোন বুথ হয়েছে। বাড়িটা হাবু সাহাদের মালিকানায় ছিল। ওনারাই বুথ খুললেন।


তখন‌ পাড়ায় পাড়ায় বুথ হচ্ছিল। টেলি যোগাযোগের বিপ্লবের সময়।‌ ল্যাণ্ড ফোন তখন মোটামুটি শহুরে স্বচ্ছল পরিবারে অত্যাবশ্যক হয়ে গেছে। কিন্তু সবার তো আর তা ছিল না। বুথগুলো চালু হতে খুব সুবিধা হলো। আর অন্যের বাড়িতে গিয়ে‌ লজ্জার মাথা খেয়ে কাউকে জরুরি ফোন করতে হয় না।‌ গোপন কথা অন্যের শুনে ফেলারও কোনো ভয় নেই। বুথে কাচঘেরা চেম্বারে কথা বললে কেউ শুনতে পেত না। অবশ্যই ফেল কড়ি মাখো তেল। কথা বলার সময় অনুয়ায়ী বিল পে করতে হতো। অবশ্যই এখানকার সেল ফোন প্রজন্ম এই উত্তেজনাটা অনুভব করতে পারবে না। কিন্তু যারা বাড়ির বাইরে পড়তে বা কাজে আসতো তারা কিন্তু নিকট জনের খবরাখবর পাওয়ার জন্য এই টেলিফোন বুথের কাছে আজও ঋণী। অঞ্জন দত্তের ‘বেলা বোস’ তাই কালজয়ী।

(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *