শরদিন্দু সাহা

বাংলা কথা সাহিত্যের সুপরিচিত লেখক শরদিন্দু সাহা। লেখক সত্তা ও জীবনকে বিচ্ছিন্ন করে দেখতে তিনি অভ্যস্ত নন। নিছক লেখক হওয়ার জন্য তিনি কলম ধরেননি, সামাজিক দায়বদ্ধতাই তাঁকে সৃষ্টিকর্মে উদ্বুদ্ধ করে। শৈশব থেকে সৃষ্টিশীল মন লালন করে প্রস্তুতি পর্ব সারলেও নয়ের দশকের গোড়া থেকে তাঁর লেখালেখি শুরু। এ-পর্যন্ত শতাধিক গল্প, গোটা কয়েক উপন্যাস এবং অন্যান্য গদ্য মুদ্রিত হয়েছে। দশটি উপন্যাস আর সাতটি গল্পগ্রন্থ সহ মোট গ্রন্থের সংখ্যা ষোলো। ১৯৯৮ সালে ‘কাটোয়া মহকুমা গ্রন্থাগার পুরস্কার’ পান। ২০০৪ সালে ‘পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি প্রদত্ত সোমেন চন্দ পুরস্কার’ পান। ওই  বছরেই কাটোয়া লিটল ম্যাগাজিন মেলা কর্তৃক সংবর্ধিত হন। ইন্ডিয়ান অয়েল কর্তৃপক্ষ তাঁকে ‘হল্ অব্ ফেম’-এ সম্মানিত করেন। ২০০৫ সালে ‘ভাষা শহিদ বরকত স্মরণ পুরস্কার’ পান। ২০০৭ সালে সাহিত্য আকাদেমি’র আমন্ত্রণে গৌহাটিতে বাংলা-অসমীয়া গল্পকার সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। ২০১৩ সালে ‘আমি’ পত্রিকা তাঁর সাহিত্যকর্মের জন্য বিশেষ সম্মান দেন। প্রসার ভারতী’র আমন্ত্রণে নানা সময়ে সাহিত্য-সংস্কৃতি অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহণ করেছেন। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, মিলিয়ে অনেক উল্লেখযোগ্য সাহিত্য পত্রে ও ওয়েব ম্যাগাজিনে লিখে চলেছেন। ইতিমধ্যেই নিজস্ব এক ঘরানা সৃষ্টি করে তিনি পাঠকের মন জয় করেছেন।

(নিত্য সমাজ সংসারের যে স্রোত আমরা চাক্ষুষ করছি তার অন্দরমহল জুড়ে ঘুমিয়ে রয়েছে কত তো কথাকাহিনী, যার পরতে পরতে  তন্দ্রাচ্ছন্ন থাকে গোপনে কত তো নারীর জীবনযন্ত্রনা, ধারক বাহক হয়ে গোটা সমাজকে যাঁরা ছাতার মতো আগলে রেখেছে, নিজের পরিচয় খুঁজে নিয়েছে, সকল ঝড়ঝঞ্ঝা থেকে দিচ্ছে মুক্তি যুগ যুগ ধরে। কয়জনের কথাই বা আমরা মনে রাখি। তাঁদের গোপন ব্যথা, অনুচ্চারিত কথা গুমড়ে মরে যায়, চোখের জল কেউ মুছিয়ে দেয় না, গণ্ডীবদ্ধ শৃঙ্খলিত জীবনই তাঁদের বেঁচে থাকার একমাত্র ভরসা। এমনই এক সাধারণ গ্রাম্য নারীর কথকতা ও চেতনায় চেনা জীবন ও সমাজপিষ্ট অব্যক্ত যন্ত্রনার পাঁচালি ‘দেশের গর্ভে স্বদেশ’ উপন্যাস।)

ঘরের কথা ভালো মন্দ ঘরেই ছিল

মনের ঘরে ভাঙন ধরি বাইরে আইল

দুনিয়াদারি হাল্টি যে যার তিল তিল করি টের হাইয়ের। হিয়ার আঁচ বাড়িঘরে লাইগত ন, হেইঢা ক্যামনে হয়। তবুও তো আঙ্গ দিন চলি যায়, যেমনে যায় আর কি। কাউকে কিছু কইবার নাই, কত কথাই যে মনের মধ্যে পুষি রাইখতে হয়। মনের নাম বাবাজি যেমনে সাজাও তেমনে সাজি। সুখে দুঃখে ঘর গেরস্তি কইরলে কিছু কইবার তো থায় না। বিভ্রাট বাঁধে যন চাইবার জিনিসগুলা হাতের কাছে হাওন যায় না, মনের কথা কইবার মতো মানুষ থায় না তন যিয়ানে সুযোগ হায় মনের কথা উগরাই দেয়, বিপত্তিও শুরু হয় হিয়ান তুন। যিয়ানে হিয়ানে মাথা গলাই বানাই বানাই কথা কয়। কথার ঝোল টানি ফেলাইনা কথারে লই রামায়ণ মহাভারত বানায়। যারে কথা কয় হেও হোনে, যিগাইন লই কথা কয় আগা মাথা থায় না। কথায় কথায় ঠোকাঠুকিতে কত টক ঝাল, একসময়ের জায়ে জায়ে বইনে বইনে মন্ডা মিঠাইয়ের মতো সম্পর্কটায় তেঁতুলের গন্ধ নাকে লাগের। কী যে কারণটা বুইঝতাম হারিয়েন না। টের হাইলাম দুই একটা বাসন কোসন ঝন ঝন করি ঘরের মেঝেতে হড়ি ভাঙি টুকরো টাকার হই গেছে। কিয়ের লাগি হইছে ক্যামনে হইছে হেই কথা থাক। কত কথা হক্কলের মনে মধুর চাকের মতো জমা হইছিল, ভালা না লাগাইনা কথা, অপছন্দ আর মন খারাপের কথা কেউ আগের তুন বুইঝত হারেনি ক্যান, প্রশ্নটা আঁরে কুরি কুরি খার। আঁর ভাবনার কথাটা কইব কইব করি কইতে হারলাম না। এখন আঁর ভেতরটা কারণে অকারণে খাঁ খাঁ করে। কারও মুয়ের দিকে তাকাইলে মনে হয় ঘুণ ধরি ঝাঁঝরা করি হালাইছে কোনায় কোনায়। জড়াই জড়াই থাওনের সুখ চলি গেছে মন তুন, আর কি কোনদিন ফেরত আইনত হাইরব? আর ভাবনাটা অহেতুক ছিল ক্যামনে কই। আঁর এক জায়ে ভাশুরঝিরে কয় ‘তোর বড় হাখনা গজাইছে, লম্বা চওড়া কথা গজাইছে, বাপের তো দুপয়সা রোজগার নাই, এত বড় সংসার আছে বলি দুবেলা হাত পাড়ি খাইতে হারস, না হইলে এমন চোপা বার হই যাইত।’ মাইয়াঢা চোখের জল হালাইতে হালাইতে আঁর পা দুখান জড়াই কাঁইদল। ‘ কন চাই জেঠি, খুড়ি আঁরে ঠেস দিই কথা কর, খাওয়ার খোটা দের।’ মাইয়ার মাথাই হাত বুলাই দি সান্ত্বনা দিই কইলাম তোর এমন মুয়ে মুয়ে কথা কওয়া ঠিক হইছে ক। খুড়ি তো মায়ের সমান, না হয় দুকথা হুনাইছে, উঠানে গোবরের জল ছিঢাই দিই মুছি দিলে কী হইত। নিজের লগে নিজে কথা কইলাম – যতিনের মা’র বাপের রোজগার লই ঐটুকানি ছুটকিরে এত বড় কথাখান না কইলেই তো হাইরত। গোলমালটা আসলে যে অন্য জায়গায় হেইডা বুইঝতে সময় লাইগল না। কারোগে কইবার আগে আর একটু পরখ কইরতে চাইলাম। আঁর মা কইত, ‘বুইঝলি মা এমন কিছু কিছু জিনিস আছে, সময়ের হাতে ছাড়ি দেওন লাগে, হড়বড় করতই হয় না।’ ষোল আনা খাঁটি কথাই কইছিল মা। 

সেজ দেওরের হৌর বাড়ির তুন পাঁচ ছয় জন আত্মীয় আইছে। হুইনতাম মাস খানেক থাইকব। ওমা মাস তো হুরাইল, যাওনের নাম নাই। এই কথা লই হেছনেও হেছনেও ফুসুর-ফাসুর শুরু হই গেছে, মুখ তুলি আর কথা কয় না। দেওরের কানে কথাগাইন গেলে কী দশা হইব। মাসান্তে বাড়ি আইছে। কোম্পানির ঘরে হিসাব লেখার কাজ করে। সেজ জা হোনে ন এমনটা নয়। কোনো কথা না কি চুপ মারি ছিল। এবার দেওর যদি হোনে, তাইলে তো লঙ্কা কাণ্ড বাঁধাইব, ভাইবলে আঁর গা দি জ্বর চলি আইয়ের। এই কথা সেই কথায় আঁর কাছে আই কয়, ‘ বৌদি আমনের লগে আঁর একখান কথা আছে। কিন্তু একটু নিরিবিলি জায়গা হাইলে ভালো হয়। ‘আইও না, রসুইঘরে চলো, রান্না কইরতে কইরতে তোঁর কথা হুনুম। ‘কিছু ভাইববেন না যেন। বাড়ি আসা ইস্তক দেইখছি আমনের জা গোমড়ামুখো হই আছে, কোনো কথা কয় না, হাসি ঠাট্টাও করে না আঁর লগে, এতবার করি জিগাইলাম কোনো উত্তর দেয় না। হেথি তো তেমন মানুষ নয়, কারণটা কিছু কইত হারেন।’ লাকড়িখান উনুনে গুঁজি দি  আরও জুত হই বইলাম। কি উত্তর দিমু, কি উত্তর দিমু কই চাইর কদম হিছাইলাম। আঁর দেওরের মুখখানা বেজার হই গেল। ‘আরে মাইয়া মাইনষের কত কারণে মন খারাপ হয়। এই কাঁদে এই হাসে, অত চিন্তা করিও না। আঁই বুঝাই কই দিমু। দেইখবা দুই দিন বাদে বেগ্গাইন ঠিক হই যাইব। ‘চাপা গোছের মাইয়া তো, ডর লাগে কখন কী করে বসে। আমনে যন কইছেন আর একটু দেখি।’

মনের মধ্যে কত চিন্তা আই উঠবস করের। এমন করি ছাঁকি ধরে, হের তুন ছাড় হাওনের কোনো রাস্তা খুঁজি হাইয়ের না। বকুল ফুলের গাছটা দুলি দুলি উইঠলে বুকের মধ্যে হাপরের মতো শব্দ হয়। এক অজানা ভয় বুঝি আই বসে। বকুল গাছটা যত্ত নষ্টের গোড়া। নিজের ডালে কত রকমের পাখিরে জায়গা করি দেয়। ছাতার ময়না চড়ুই আই লাফায় ঝাঁপায়, মনের সুখে কিচিরমিচির করে। আবার ডানা মেলি উড়ি চলি যাই শূন্যে।  ঘুড়ির মতো গোত্তা খাই মাটিতে নামি ছটফটায়। আহা মাটির জন্য ওদের কত মায়া। মানুষগুন যদি এমন হইত। গায়ে গায়ে লাগি লাগি থাইকত। আঙ্গ তো জলের তৃষ্ণা লাগে, পাখিরা জল খাইবার লাই মাটির কলসির ভাঙা টুকরার বৃষ্টির জলে ঠোঁট চুবাই তৃষ্ণা মিটায়। ভগবান পাখিও বানাইছে, আবার হিয়াল কুকুরও বানাইছে। ওরা বনে জঙ্গলে থায়, রাস্তাঘাটে ঘুরি বেড়ায়, সাপেরা গর্তে থাই ফোঁসফোঁস করে, মশামাছি ভন ভন করে, ঘরবার করে আর মানুষ খালি ঘর বানায়, জোট বাঁধে আবার সেই ঘর ভাঙ্গিও হালায়। মানুষ জাতটারে আঁই অনও ঠিকঠাক চিনতাম হাইরলাম না। কখন যে মাইনষের মতিগতি হাল্টি যায়, কে জানে। মাইনষের জীবনে ঝড় আয়ে না কে কইছে। আঙ্গ বাড়ির চারপাশে যন ঝড় বাতাস আই উথালপাথাল করে মটমট করি বড্ডা বড্ডা গাছও গোড়া উল্টাই হড়ি যায়। মানুষ এক জাতের, প্রকৃতি আর এক জাতের, হক্কলের স্বভাব চরিত্রির আলাদা, কেউ কাউরে লগে শত্রুতামি করে না, আঘাত করতি গেলে কেউ কাউরে ছাড়িও কথা কয় না, এ যেন বউ শাউরির কোন্দল। শান্ত হই গেলে ভালা, না হইলে কোয়ালে দুঃখ আছে। কালবৈশাখী ঝড়ের আঁচ এমন করি ঘরের দুয়ারে আই আঁছড়াই হইড়ব কেউ ঘুণাক্ষরেও জাইনত হারে ন।

আশঙ্কার মেঘ এত তাড়াতাড়ি যে কাছে চলি আইব কেইবা আন্দাজ কইরতে হাইরছে। হারার কথাও নয়। রসুইঘরের লগের ঘরের দশখানা পাতে তিন বারে ত্রিশ জনের ভাত বাড়ি দিছে বউরা। খাইত বই আঁর দেওরদের কত রঙ্গ রসিকতা। হক্কলে হাসিতে হাসিতে গড়াই হড়ি যায়। তারপরেও তো  কথার শেষ আছে নি – হারাদিন কে কন্নাই গেছে, ব্যবসাপাতি মন্দা,  লক্ষ্মী মুখ তুলে চাইছে না, গুদামে কত গাড়ি মাল ঢুইকছে,  আউস ধানের চাষের অবস্থা যে ভালা নয়, সেই কথা লই দুঃখ করে নদেওর। খুড়তোতো জার মুয়ে খই ফোটে, বড় ছোট মানে না, যা মনে হায় কই হালায়। ধমক মারে – ‘তোঙ্গ খাইত বই যত কথা, গলায় কাঁটা আঁটকাই গেলে, বিষম খাইলে ঠেলা বুইঝবা।’ আর এক খুড়তোতো দেওরের বড় হোলার বিয়া হইছে, নতুন বউ হাইরতে কথা কয় না। ছোট ছোট হোলাপাইনরা ওর নেওটা। ওই বউয়ের হেছনে ওরা ঘুরঘুর করে ভালো মন্দ খাওয়ার লোভে। হেগুনেরে দেখভাল করার ভার ওর উপর হইড়ছে কিনা।রাতের খাওন সাইরলে ভাইবোন বেগ্গুনে তো হাথালি বিছানায় জড়াজড়ি করি হুইত যায়। মাইয়ারা তো পাটির উপর তোষক পাতি ভাগে ভাগে বিছানা করি দিছে। হেগুনেরে গল্প হোনায় আঁর খুড়হৌড়ি। জমজমাট সংসারে অভাব থাইকত হারে, সুখ দুঃখ হইলে হক্কলে ভাগাভাগি করি লয়। খুড়তোতো মেজজা মন্দিরা বিয়ের হর তুন দেইখছি একটু আত্মভোলা গোছের। সংসারের কামকাজে এককারেই মন নাই। তাই লই দুইচার কথা উইঠলেও বেশি কেউ চটকায় না। মন্দিরাও নিন্দামন্দের কথা কানে লয় না। ঘরের এধার ওধার হাঁটাহাঁটি করি ওর দিন কাটে। ওর যে তিন খানা হোলা দুইখানা মাইয়া আছে, ওরা ক্যামনে ক্যামনে বড় হই গেল ও নিজেও জানে না। ভাবখানা এমন, হইলে হইল না হইলে নয়। গায়ে হাওয়া লাগাই চলাটা ও বাপের বাড়ি তুন অভ্যাস করি আইছে। এত বড় সংসারে কথা কাটাকাটি হইত না সেইটাই বা ক্যামনে সম্ভব। কথা হইতেছে দিন কে দিন। দিনকাল তো সমান যায় না। মনের অবস্থা হক্কলের ক্যামন হাল্টি যার। আঁর কানের আর চোয়েরে বিশ্বাস কইরতাম হারিয়েন না।

সেঝ জায়ের আত্মীয়রা হেই যে আইছে আর যাইবার নাম করে না। কেউ কোনো কথা তো কয়ই না, দেয়া হইলে মুখ ঘুরাই চলি যায়। সংসারের হাঁড়িতে ভাগ বসাইলে গায়ে ছ্যাঁকা তো লাইগবই। কুন্তলারে ঠারেঠুরে বোঝাইবার কত চেষ্টাই তো কইরলাম – বোন এরকম করি কেন থাউস, ঘরে নতুন বউরা আইছে, ওরা ভালোমন্দ কইলে মুখ চাপা দি রাইখতি হারবি নি। আঁর কথার কোনো উত্তরই দেয় না। কলসি তুন এক গ্লাস জল লই ঢোক ঢোক করি গেলে। ওর ভাবগতিক আঁর সুবিধার লাগে না। ছুঢি চলি যায় হরমুলের বেড়ার কাছে। গোয়াল ঘর তুন গোবর লই হাতের পাঁচ আঙুল দিই গুটে দেয় আর হুকনা গুটেগাইন লই ঝোরায় ভরে। ওর ছোট হোলাটা ঘেঁটি ঝাঁকাই কয় মা ক্ষুদা লাইগছে। যা তোগো নতুন বৌদির কাছে চাগই, খাওন দিব। কুন্তলার হক্কল কিছুতেই গা আলগা ভাব। বাড়িঘরে কতকিছু যে ঘটি যার ওর কোনোটাতেই নজর নাই। ওর এমন উদাসীন ভাব আঁরে চিন্তায় হালাই দেয়। সময় তো কারও জন্য বই থায় না, নিজের মতো করি চইলতে চইলতে এক সময় ধাক্কা মারে, কত কিছু হাল্টাহাল্টি করি দেয়, আগে তুন অনুমান করা কঠিন হই যায়। কুন্তলা বাপের বাড়ির লোকজনেরে কিছু কইত হারে না, ওর আত্মীয়রা দেনা শোধ কইরত হারে নাই বিধায় বাড়ি তুন বার করি দিছে মহাজন। হিয়ের লাই ঘরের বউ মাইয়াদের কথা মুখ বুঝি সহ্য করে। এদিকে ঘরের মধ্যে দুই বুড়াবুড়িরে লই শুরু হইছে নানা ঝঞ্ঝাট। নব্বইয়ের কোঠায় বয়স কে আর যত্ন হাত্তি কইরব। হাগিমুতি লই বিছানায় হড়ি থাই। এক দূর সম্পর্কের বিধবা মাইয়ারে আইনছে, হেথি যতটা হারে সামাল দেয়। অন আর কেউ কারও কথা হুইনতে চায় না। খালি অভিযোগ আর অভিযোগ কার ভাগে কম হইরছে। রোজের কামকাজেও আগের মতো নিয়ম মানি কেউ চইলত চায় না। আদর ভালোবাসা লই কেমন দড়ি টানাটানি। আঁই আর কদ্দিকে তাকাইয়ুম। স্বামী বাড়ি আইলে বুঝাই যে কমু হেই সুযোগ নাই। গ্ৰামের পাড়া-প্রতিবেশীরা সকাল না হইতে ঘিরে ধরে।  গ্ৰামের মধ্যে গুরুজন বলি ওনারে সকলে মান্যগন্য করে। আর উনিও এমন ধারার মানুষ কোনো কথাই হালাইতে হারে না। জান হরান দিই হালায় ওরাও খুশি খুশি হাসিমুয়ে নাইচতে নাইচতে ঘরে চলি যায়। হইব নাই বা কেন হাপিত্যেশ করি বই থায় যে গোটা হপ্তাহ।

সকাল না হইতে কাঁদাকাটি হড়ি যাই বাড়িতে। ওমা কী হইছে কী হইছে করি ছুটি গেলি তো ভিড়মি খাই যাই। এমনটা যে হইত পারে কল্পনায়ও আনিন কনও। কী করি কী করি ভাইবতে ভাইবতে হরান যায়। বাড়ির যে যেখানে আছে ওদের খবর দিতে হইব যে। কারে হাডাই, কারে হাডাই শেষমেশ বিসমিল্লাহর বাপেরে কইলাম, দোকানে, গদিতে, মাঠে হক্কলরে লোকজন দিই খবর পাঠান, এট্টুও দেরি না করি য্যান বাড়ি চলি আইয়ে, সব্বনাশ হই গেছে। কুন্তলা গলায় ফাঁস লাগাই আত্মঘাতী হইছে, নিজে তো গেছে গেছে, হক্কলেরে মারি গেছে। এবার থানার দারোগা আই বেগ্গুনেরে গারদে হুইরব। মেয়েটারে কত কইছি এমন উচাটন হইতে নাই, হুইনল না। বেবাকের কথাগাইন মনের ভিতরে গাঁথি লইছে, হুরা ভাবের মাইয়া। কারে আর কী কমু, নিজের মাথা নিজে হিঢাইতাম চাই। চাপা আর কন্নাই থায়। যে বাড়ির এত সুনাম ছিল এক নিমিষে ধুলায় মিশি গেল। লোকজন তো যা কইবার কইল, আঙ্গ বাড়ির মাইনষের ঘাড়ে দোষ হইড়ল, কুন্তলার চলি যাওন যেন বড় শিক্ষা দিই গেল, বুঝাই দিল অনেক কিছুই নতুন করি ভাইবতে হইব। কেউ কেউ যেন মনে মনে খুশিই হইল, ভাবসাব এমন, এমনটা হইবারই ছিল। অন্য বাড়ির গ্যাতিগুষ্টি মিলি আবার শাপ-শাপান্তও কইরল। কইরছে করুক, কইবার কিছু নাই, যত সব্বনাশ আঙ্গই তো হইল।

প্রস্তাবটা শেষমেশ আঁর হৌরিই দিল। বুড়া হইলে কী হইছে মাথায় বুদ্ধি গিজগিজ করে। ‘বুঝলি বড়বউ হালচাল যা বুঝিয়ের আর বোধহয় এই সংসারটা চইলত ন। ঘরদোর আর তেমন সুবিধার ঠেইকছে না। যেদিক তাকাই যেন হুড়মুড় করি ভাঙি যার। কেউ আর কারও কথা হুইনত হারেন না।’ আঁর হৌরির এই বুড়া বয়সেও যা নজর আঙ্গ ভাবনাচিন্তা হার করি চলি যায়। হেথেনের কথাগাইন ফেলনার নয়।‌ এখন প্রশ্ন হইল, কথাটা হাড়ুম ক্যামনে, আর কারেই বা কইলে জুতের হয়। কইবার আগে চৌদ্দবার ভাবন লাগের, কে ক্যামনে নিব। যদি কই বসে আঁর কোনো স্বার্থ আছে। বড় ছোট জ্ঞানগম্মি তেমন কি আর আছে! আঙ্গ যাদের বয়স হইছে ওরা তবু কিছু কইবার আগে চৌদ্দ বার ঢোক গেলে, নতুন বউদের তেমন টান আর কই। কুন্তলার মরন আই হক্কলের চোখ খুলি দিই গেছে। কথা কইবার আগে অন হিসাব করি কইত হইব, কারও তো মুয়ের কোনো টেকসো নাই। আমরা যেন বাতিলের দলে নাম লেখাইছি। মনের মধ্যে কেন জানি না কেমন আনচান করে। বুকের মধ্যে একটা ব্যথা চাগাড় দিই উঢে। কত বড় লম্বালম্বি ঘর, ঘরের দিকে তাকাইলে এমাথা ওমাথা দেয়া যায় না। কত তো থালাবাসন জামাকাপড় বিছানাপত্র আনাচকানাচে। ছোটবড় মিলাই জনা সত্তর লোক গিজগিজ করে। হারাক্ষণ কলকল করে বাচ্চাগুনের চিৎকার চেঁচামেচিতে আর বউঝিদের গালগপ্পে। ঘরের মেঝে তো নয়, একখান ছোট উঠান কওন যায়। বাসন কোসন ঝনঝন করে একোনা থেকে ওকোনা যায়। ঘরের মধ্যে কত রাজ্যের কোনা, কে আর তার হিসাব রায়, হক্কলটাই চোয়ের দেয়া। সুযোগ হাইলেই দাপাই বেড়ায়, কার ধমকানি কার বারন কে শোনে। এতগুন মাইনষের চলন বলনে আনন্দের বহর ছিল মনের মতো। দূর সম্পর্কের আত্মীয় স্বজনের এমন সুখের ঘরকন্না দেই হিংসা কি কম করে, কারো রে চক্ষুশূল হয় না তাই বা কেমন করে কই। এমন একটা সংসারেও জোয়ার ভাটা খেলে।

এমন  দিন যে দেইখতে হইব কোনোদিন ভাইবতাম হারি ন। অনেকগুন ঘটনাই চোখ খুলি দিছে, যদি অন ভাগ না হয়, হরে অনেক দেরি হই যাইব। হক্কলের মনের মধ্যে হায় হুতাশ ভাব। কি হইব আর কি না হইব, এই লই কেউ দুই চোয়ের পাতা এক কইরত হারেন না। বাড়ির যেই চেহারাখান লই বেগ্গুনে আনন্দে মাতি তাইখত, বেগ্গাইন যে এমন করি দুই টুকরা হই যাইব, স্বপ্নেও তো ভাবে নি! বড় ঘরের সামনের বারান্দায় লম্বা করি তিন চারখানা হাঢি বিছাইছে। এ ওর মুয়ের দিকে চায়, কিছু তো আর কওনের নাই। বড়দের মুয়ের উপর কথা কইব এমন সাহস তো নাই। যা অবস্থা দাঁড়াইছে, হক্কলের সম্মতিতে ঠিক হইল, বাড়িটা সাত ভাগ হইব। হক্কলের ভাগে দুইডা করি বড় ঘর মিলব, ঘরের তুন আলগা করি যার যার হিছনের ভিটায় রসুইঘর বানাই লইত হাইরব। ঘরের মাঝখানে মাঝখানে টিনের বেড়া দিই পার্টিশান করি নিত হইব, যাতে করি ভবিষ্যতে কোনোদিন ঝগড়াঝাঁটি না হয়। এই না হয় গেল ঘরের কথা। আর হরে হরে যার যার ঘর একটা তুন দুইটা কইরতে চাইলে ওরা নিজের খরচায় করি নিব, হেইঢা লই কারো কিছু বলার থাইকত ন। বিধির কী মহিমা হোলাপাইনগুনের সেইদিকে নজর নাই, মনের সুখে উঠানে গোল্লাছুট খেলে, একবার এই দল জেতে তো আর একবার অন্য দল। হেথাগো বাবা কাকাদের খেলা ওরা কিছুই বুইঝত হারেন না। ওরা জানেও না কাইল তুন বেগ্গুন ভিন্ন হই যাইব। কাঁসা পিতলের থালা বাসন ভাগে হইড়ছে কার ঘরে কতজন লোক সেই হিসাব করি। মাথা গুইনত যাই হৌরি কয়, ‘ল্যাদা হোলাদের গণায় ধইরচছ তো।’ হরের দিন ঘরের চেহারাখান হাল্টাই গেল। বাজারে গণেশের দোকান তুন মাপে মাপে টিন কিনি আইনল। হেই হর্যন্ত খরচাপাতি হুরান সংসারের তহবিল তুন দিবার কথা হইছে, তাই তো কারও গায়ে আঁচ লাগেন। বিপত্তিটা হইছে যবে তুন আলাদা রসুইঘর বানানো শুরু হইছে। মাটির উনুন তৈরি হইছে তড়িঘড়ি। লাকড়ি ঘরও ভাগাভাগি হই গেছে। রসুইঘরে ছ্যাঁতছুঁত আবাজ হইলে কারও কারও চোখ দিই জল গড়ায়। কাঁচারি ঘরের সামনের জায়গা তো ভাগাভাগি হবার জো নাই। কোনো মতে ঠাসাঠাসি করি যে যার জায়গায় খড়ের গাদা বানাইছে। আরো যে কত ভাগাভাগি কইরত হইব কে জানে। এতদিনের জড়াই জড়াই থাকি যা যা জোটাইছে তা কি এত সহজে ভাগ করা যায়! মনের ভাগ কার কতটা হইছে সেইবা কজনে জানে। গরুগোতানগুন মুখ তুলি চাই থায়। ওরা বুইঝত হারেন না হেগো মা-মাসিরা এদ্দিন একটা গোয়ালঘরে থাইকত, মজায় তো থাইকত গা ঘেঁষাঘেঁষি করি, আইজ কেন এক একজন ভিন্ন দিকে চলি যার, চোখের কোনা ভেজা, মুয়ের হাম্বা হাম্বা বাক নাই। এই প্রশ্নের জবাব কার কাছে চাইব। দলিল মিঞার কাছে কি আঙ্গ বাড়ির কর্তাদের কামকাজের হিসাব থাকে? ও তো সারাদিন ধরি হালচাষ কইরবার লাই মাঠে বলদ লই যায়, ঘাস খাওয়ায়, খড় খইল দেয়, ওরা জাবর কাটে। মাঝে মাঝে গায়ে গোবর লাগি থাইকলে মোছাই দেয়। এমন সম্পর্কের কি নাম হয়? মাইনষের সম্পর্কের আবার কত নাম, কত ভাগ, কত রূপ, এই পারদের মতো উঢে আর নামে, ধরি রাখন তো যায় না, এই আছে, এই নাই। কোনও কিছু বুঝি উইঠবার আগেই জায়গা হাল্টি হালায়।

জমিজমার ভাগাভাগি লই ভাইয়ে ভাইয়ে কথা কাটাকাটি শুরু হইছে। কারোরে কি থামানো যায়। একজন ডাইনমুই যায় তো, আরেকজন বাঁমুই। দড়ি টানাটানির খেলা শুরু হই যায়। এমন গোলমালে অবস্থা দেইখলে নানা কথা আই মনের ভেতরে খচখচ করে। এতদিনের একজোট হই থাকা সব অংশীদারি লই, সীমানা লই বৃথা হই গেল! আঁই দূর থুন দাঁড়াই দাঁড়াই রঙ্গ দেই। কথার মাঝখানে কথা কওনের লাই মাইয়া মাইনষের জায়গা আছে নি। কে আঁর আঙ্গরে মূল্য দেয়। সংসারটারে আমরা কত কষ্ট করি বাঁধি রাই, এই কথা কেউ মনেও রায় না। এর মর্ম আর কয়জনে বোঝে। কোনও কিছু সিন্ধান্ত লইবার বেলায় পুরুষ মাইনষের কথাই শেষ কথা। হেথেনেরা সব বোঝাপড়া করেন কিনা। এমন নিয়মই তো চলি আইছে। যাই হোক না কেন জমিজমা ভাগাভাগি হইতেই হইব। ঘর ভাগাভাগির হর তুন কেউ কারও লগে তেমন কথা কয় না। হক্কলে কেমন চুপ মারি গেছে। ভিটা এক জিনিষ চাষের জমি আর এক জিনিষ। একটা হইল মাথার উপর ছাদ দেয়, থাওনের লাই জরুরি, আর জমি হইল লক্ষ্মী, এই হলো ফসলের ধন, হেটও ভরে, মনও ভরে। হক্কলে অন উডিহড়ি লাইগছে ক্যামনে কী করন যায়। দূরের জমির তুন কাছের জমি লই যত মাথাব্যথা। মাথার উপর বোঝা চাপাইলে তো আর রক্ষা নাই। জমির মাপজোক লই কাজিয়া তো কম শুরু হয়নি। আল বাঁধা লই গরম গরম কথা। মাঠেঘাটের ঝগড়া আই যন হড়ে ঘর-দূয়ারে তার জ্বালা তো কম নয়। ভাগাভাগির আগের দিন হইলে হক্কলে হক্কলের মুখ দেইখত, মিষ্টি মিষ্টি কথা কইত, বাইরের কথা ঘরে কইত, ঘরের কথা চটকাই মটকাই এমন দশা কইরত, ঘরের বাইরে যাইবার কোনো রাস্তাই খোলা থাইকত না। অন কি আর হেইদিন আছে, আগে ছিল একটা দরজা আর অন দরজা হইছে সাতখানা। খুড়তুতো জেঠতুতো মিলি সাত ভাই হেথাগো বউঝি হোলামাইয়ারা বেজার মুখ করি যে যার ঘরে ঢুকি যায়। জায়ে জায়ে বউয়ে বউয়ে গালগপ্পো হাসি ঠাট্টা কইরবার দিন ফুরাইছে। জানালার শিকের ফাঁক দিই দুইচার কথা কয়। কথার মধ্যে নাই কোনো রসকস, নাই কোনো ছিরি। আমাগোর জায়গায় তোঙ্গ হেথাগো আমনেগো আই হইড়ছে। যে যার ঘরে বই ইষ্ট নাম জপে। টঙের উপরেও পিচবোর্ডের হাটাতন দিই ভাগ ভাগ হই গেছে।  ট্রাঙ্ক লেপ তোষক কাঁথা কম্বল হোটলা বাঁধি সরাই লই গেছে যার যার সীমানায়। হায় হায় রে, এমন দুঃখের হিসাব কষা কি সহজ কথা।

আঁর স্বামী মনমরা হই আছে। ঘরের চৌকাঠে পা রাখতেই টের হায় ঘরটা বড় ছোট হই গেছে। এমাথা ওমাথা কিছুই আর দেওন যায় না। কোনও ঘরে টিমটিমে আলো, কোনও ঘরে আঁধার। ভাইয়েরা কাম তুন ঘরে ফিরলনি বুইঝত হারেন না। নিজের মনেই কয়, ‘সংসারটা ভাগাভাগি না হইলে চলছিল না।’ হক্কলটা কি আঙ্গ ইচ্ছার উপর চলে। জোয়ার  আই আমনাআমনি বানের জলে ভাসাই লই যায়। কনও আর ফেরত দেয় না। আঁর মুয়ে এমন কথা হুনি মাথায় হাত দিই বসি হড়ে। ভাইয়ে ভাইয়ে মুখ দেয়াদেয়ি নাই, দিনরাত হাওনাগণ্ডার হিসাব লই কূটকচালি। আঁর নিজের মাথা নিজে হাঢাইতে মন চায়। হোলামাইয়াগুনেরে হয্যন্ত আঁর কাছে হইড়ত হাঢায় না। আঁর হৌরি কয়, ‘ চোয়ের জল হালাইস না মা, বেগ্গাইন ভবিতব্য।’ মাইনতে হাইরলাম না কথাটা, মাইনষের অন্তরটাই হচি গেছে। হুইনলাম, আঁর মেজ দেওর চার কানি জমি কিনছে রমেশ অধিকারীর তুন। হেথেনরা ইন্ডিয়া চলি যাইব, হিয়ের লাই সস্তায় বিক্রি করি দিছে। মাইয়ার বিয়াও কেমনে কেমনে ঠিক কইরছে ইন্ডিয়ার হোলার লগে। বুকের ভিতরে মোচড় দিই উইঠল। আঁর স্বামী নিজে হেই হথ মাড়ায়নি যদি গ্ৰামের হিন্দুরা একা হই যায়, মাইন্যগন্য করে কিনা, আপদে বিপদে ভরসা কিনা। মুসলমানরাও কম ভালোবাসে না। ওরাও তো বিপদে হইড়লে শলা পরামর্শ করার লাই ছুটি চলি আইয়ে। মাটি আঁকড়াই হড়ি আছে দ্যাশটারে ভালোবাসে বলেই না। অমন মাইনষের নিজের ঘরেই ভাঙন ধইরছে এও কী সহ্য হয়। বাড়ির চারধারে তালগাছ, সুপারি নাইরকেলের বাগান, আমের বাগান। হেগুলিও তো ভাগ করন লাইগব। আঁর দেওররা হাত চাবি ধরি কয়, ‘ বড় বৌদি আমনে একটা উপায় বাতলাই দেন।’ আনন্দ পাইলাম এই ভাবি যে এত ঝঞ্ঝাটের হরেও হেগুনে আঁর উপর বিশ্বাস রাইখছে।

ঘরের পাশে ঘর হইল, ভাগ বাটোয়ারা হইবার হর যার যার মতো সংসার হইল। আগে যেমন মুখ দেখি কই হালাইতাম কে কেমন আছে, অন দেইও না হারাক্ষণ, ভালা আছে না মন্দ আইছে কে কইব, নিজেগো ঢাকিঢুকি রাইখতেই ওগো আনন্দ। ছোটোমোটো দোকানপাট করি যেতেগো দিন চলে হেথাগো অভাবের ঠিকানা নাই, চোয়ের জলে নাকের জলে হয়। এ যদি ওর গাছ তুন হল ছিড়ি খায়, লঙ্কাকান্ড বাঁধি যায়, কোমর বাঁধি ঝগড়া করে, আকথা কুকথার ঝড় বই যায়। মাঝখানে যাই কিছু তো কইতাম হারি না, হিতে বিপরীত হইলে আর রক্ষা নাই, চোয়ের জল হালাই ছোট বড় কথা হোনাইতে ছাড়ে না। এইভাবেই তো দিন চলি যায়। যাগো কাপড়ের ব্যবসা চালের গুদাম আছে হেথাগো মুয়ে চওড়া হাসি, অন্যদের দেয়াই দেয়াই মনের খুশিতে আরামসে চলে, কাউকে তোয়াক্কা করে না, ভুলি যায় একসময় ভাগাভাগি করি খাইছিল, সুখ দুঃখে একলগে মন জুড়াইত। সময় হালটি গেছে, জমিজমা দেয়াহোনার কাম ছাড়ি অন কেউ অন্য হথ ধইরছে, শহরে যাই মুহুরীগিরি করে। ছাড়াছাড়া ভাব, বাড়ি তুন সদর দরজা দিই বার হই যে যার রাস্তা ধরে। হড়ালেখায় মাথা ভালা হোলারা উঁচা ক্লাসে হড়ালেখার লাই দূরের শহরে চলি যায়। ঘরে বই থাই কিছু হোলারা বাপের দোকানে বই রোজগারপাতি করে। আঁর ন দেওরের হোলার বুকের দোষ হইছে। নরোত্তম কবিরাজ কম চেষ্টা তো করেনি, হোলার রোগের হল কোথায় হইল, কমা দূরে থাক, যত দিন যায়, আরও কাবু করি হালায়। শেষমেশ ঠিক কইরল, হক্কলের তুন চাইচিন্তি হোলারে বড় ডাক্তার দেয়াইব। দেয়ানো হইল কিন্তু ব্যারাম সারে কই। হোলা তো যায় যায়। আঁই কী চোখ হিরাই থাইকতাম হারি। হেথের শিয়রে বসি মাথায় হাত বুলাই দি। হাড়ার লোকে কইল, ‘ইন্ডিয়া লই যাইত হাইরলে এই হোলারে বাঁচানো যাইত হারে।’ ভালা ভালা কথা কইতে সোজা, কিন্তু নেয় কে? গাঁটের কড়িও নাই, কইলজের জোর যিগাইন ছিল, হুরাই গেছে। সংসার অসার, ভাঙি গেলে তো আর জোড়া লাগে না। একলগে থাইকলে না হয় একটা কথা ছিল, জমি এক চিলতে বিক্রি করি একবার চেষ্টা করি দেইখতে হাইরত। ভাগে যেইটুকুনি হইড়ছে, বিক্রি কইরলে খাইব কি, দেবতার কাছে হত্যে দিই হড়ি থাওন ছাড়া আর কি কোনো উপায় আছে। 

সেজ দেওর কেমনে কেমনে অঢেল পয়সার মালিক হইছে। রাস্তার ধারে ধারে কানি কানি জমি কিনছে। বড় গোয়াল ঘর হইছে, হালের গরুর সংখ্যা দ্বিগুণ হইছে। কাঁচারি ঘরের লগে নতুন একটা ঘর বানাইছে। অতিথিরা বেড়াইত আইলে হেই ঘরে রাত কাটায়। ধনী লোক বলি হেথের নাম হিন্দু মুসলমান বেগ্গুনের মুয়ে মুয়ে হিরে। ছোট দেওরের ভাগ্য হেরেনি। হোলামাইয়া লই খুব কষ্টে আছে। ওর ভাগে শেষ মাথার ঘরটা হইড়ছে, রোদ হড়ে না। নাইরকেল সুপারি হপ্তার হাঁটে বিস্যুৎবার আর রইববারে যা বেইচত হারে, তা দিই কোনোমতে সংসার চালায়। আঁরে আঁর স্বামী যা হপ্তায়ের খরচা দিই যায়, হিয়ান তুন বাঁচাই ছোট জার হাতে দু-এক টিয়া দিই। হোলাঢারে আঁর কাছে হইড়ত হাঢায়। দুপুরের খানা আঁর কাছে খায়। আঁর আঁচলের খুট ধরি হারা ঘর ঘোরে। রসুইঘরেও একটা হিড়ি লই চুলার কাছে বই থায়। ওর মার কাছে যাইবার নাম করে না। আঁর বইন আইছে বেড়াইতে হোলা মাইয়া লই। বাড়ির চেহারা দেই হেতির তো চোখ ছানাবড়া। ‘এমন দশা ক্যামনে হইল কবে তুন হইল দিদি!’ হেতি ঘরে ঘরে যাই হক্কলের হাড়ির খবর লয়। এই ঘরের কথা অন্য ঘরে কয়। আগে যন আইছিল, কত সুখের সংসার ছিল, এক উনুনে হাড়ি চড়ত, গলায় গলায় ছিল কত ভাব ভালোবাসা, উবে গেছে বেগ্গাইন চোয়ের নিমিষে। ভাঙা ঘরে তেমন আনন্দ আর কই, হিয়ের লাই হেথির দুঃখের শেষ নাই। দুঃখ করি কয়, ‘দিদির বাড়ি আর আইতানন।’ এত কষ্ট আর হাইস না বইন, বেগ্গাইন বিধির নিয়ম, আঙ্গ আর কী করার আছে। হেথি আঁর কথা হুনি খুব একটা খুশি হইল না। বাইচ্চাকাইল তুন আইয়ের তো, একটা মায়া জন্মি গেছে, দিদির বাড়ি নিজেগো বাড়ির মতো হই গেছে। বেবাক ঘরের হোলামাইয়াদের নিজের ভাগনা ভাগ্নির মতোই দেয়ে। হেথির কষ্টটা আঁই বুঝি। মনে মনে চায় যদি আগের মতো এক হই যাইত। আইবার সময় বেগ্গুনের লাই টিন ভরতি করি লাড়ু লই আইছে। দিদির বাড়ি বইলতে এতকাল হেইরকমই ভাবি আইছে, অন আর মাইনত হারেন না। কার কাছে কয় দুঃখের কথা। আঁর জাদের গলা জড়ি ধরি কয়, ‘মেজদি, সেজদি তোমরা এমনটা কেন কইরলা, তোঙ্গ সুখের ভাগে টান হইড়ছলি নি।’ হেথিরা কি আর জবাব দিব, যে ব্যারাম তিল তিল করি শরীরে বাসা বাঁইধছে, তারে সারিতে গেলে তো ঔষধ খাওয়ানো লাইগব। এই ভাঙনই যে ঔষুধ তাইলে যদি মনের অসুখ সারে। বইন আঁর অখুশি হই বাড়ি যাইত চাইলে হক্কলে মিলি টানি ধরি রাই। রোজ এক ঘর করি নেমন্তন্ন খায়, আদর যত্ন হাই মনটা শান্তি হয়। মাইনষের মন বড় বিচিত্র কন যে কোন দিকে ঘুরি যায় কেউ কইত হারে না। সুখের খোঁজ কইরত যাই নিজেরাই গাড্ডায় হড়ে। 

গাছগাছালি গরুগোতান ধানের গোলা খড়ের গাদা হক্কল কিছুই ভাগ হইছে, কেবল ভাগ হয় ন দুইটা বড় বড় হুইর। দুইটা হুইরই মেঘনা নদীর খালের লগে নালা দিই জোড়া। কত রকমের মাছই তো কিলবিল করে, লাফায় ঝাঁপায়, হিগুনেরে ভাগ করন তো যায় না। হিংসাহিংসি নাই, ঝগড়াঝাঁটি নাই, গলাগলি করি হুইরের মধ্যে ঘুরি বেড়ায়। হুইরে মাঝে মাঝেই বেড় দেয়। যেই মাছ এক ভাগ হইত, অন সাত গিরি মিলি ভাগ করি খায়। বাড়ির মধ্যে দড়ি টাঙাই সামনে হিছনে তেলচাপাটি, হুঁঢি, টেমবইচা, মেনা, ভেদা মাছ হুয়াই শুটকি করে। শ্রাদ্ধশান্তি বিয়া হইলে রুই কাতলা বোয়াল, কোরাল, আইড় মাছ ধরি চার বাড়ি নেমন্তন্ন করি খাওয়ায়। এদের ভাগাভাগি যে কবে হইল, কেমনে হইল কে জানে। বিয়ার পর আই যতটা হুইনছি তিন পুরুষ চার পুরুষ আগের তুন ভাগ ভাগ হই একখান করি বাড়ি হইছে। হেই বাড়ির ভিতরে ভাগ হই কত ঘর হইছে। লম্বা হাত পারি খাইত বইলে মুখগুনরে চেনা যায়, দেখা-সাক্ষাৎ হয়, না হইলে আর কে কার দিকে চায়, কালেভদ্রে না দেখা । খাইত বই কত হাসাহাসি, ঠাট্টা-মস্কারা – নিজে খাইবার লোভে কয় হেতের হাতে মাছের মাথা দাও দেখি ঠাউর। আরও চারটা রসগোল্লাও দাও। আহারে বেচারার মুখটা শুকনা হই আছে। অমিলের মধ্যে মিল দেইখলে মনটা আঁর জুড়াই যায়। এই হুইর আঁর মনের মধ্যে ঘুরি ফিরি বেড়ায়। মাইয়া হোলা বউঝি, হুরুষ মানুষ হক্কলে হেই হুইরে যায় ঝাঁপায়। বৃষ্টির জল হইড়লে হুকুরটা কেমন সুন্দর নাচে। মানুষ যায়, মানুষ আসে, সময় মরি গেলেও শরীরের ছোঁয়া মিশি থায়। মাটির উপরে থাইলে মনে হয় কত দূরে দাঁড়াই আছি, হুইরের জলে কত কাছের লাগে। ঘাটে যাই বাসন ধুইতে গেলে দেই হুকুরটা আঁর দিকে চাই আছে, আঁরে ইশারা করি ডাকে, কত শত কথা কয়। জীবনটা আঁর কাছে হুইরের মতো লাগে। আঁর হৌরি দেরি হই গেলে চিন্তায় হড়ি যায়। হুইরের পারে সন্ধ্যা হইলে নাকি আত্মারা স্নান কইরত আয়ে, হেথেনেরা মনের সুখে ঘোরে। বাড়ির লোকজনদের হাইলে আর ছাড়ে না। আঁই ভাবি মরা মাইনষের আঙ্গ লাই এত টান, জ্যান্ত মানুষরা কেন আলগা আলগা থাইকত চায়। 

আম বাগানের পাশে এক চিলতে জমি। কারও নজরেও হরেন এদ্দিন। ইঁদুর মাটি তুলি খুঁড়ি খুঁড়ি রাইখছে। হেই জমিতে যে শাকসবজির চাষ হইত হারে কেউ ভাবেনি। জমির চারধারে খাদ, খাদে আমপাতা জামপাতা হরি হচা গন্ধ বার হর। গর্ত আবার সেজ দেওরের সীমানার লাগোয়া। বাড়ির তুন বার হইত গেলে গন্ধ শুঁইকতে হর বলে অনেকের গা জ্বালা। কারা আবার সাপের হামির গন্ধ হাইছে, কারা আবার গোখরো সাপের নাচনও দেইখছে। এইটা লই সেজ জায়ের লগে একদিন সারা দুপুর ধরি তুমুল ঝগড়া, এমন যে ঝগড়া, সেই আর থামতেই চায় না। হুইর বাগান টপকাই হাশের বাড়ির গ্যাতিগুষ্টির টনক নাড়াই দিছে। শেষমেশ তিন বাড়ির লোক জড় হই বুঝাই সুঝাই ঠাণ্ডা করে। হেই চিলতে জমিটা কার ভাগে হইড়ব এই লই আঁর স্বামী আর দেওরেরা মিলে বৈঠক কইরছে। ঠিক হইছে খুড়তুতো ছোট দেওর আর আঁর না দেওরের মধ্যে হক্কলে দাঁড়াই থাই আধাআধি ভাগ করি দিব। হরের দিন বাঁশের কঞ্চির বেড়ায় দুই ভাগ হইল। জমি নিড়ানি দিই দুই জনেই বীজ ছড়াইল। ঢুল্লার শাক, কাঁচা লঙ্কার চারা গজাইছে ন দেওরের জমিতে আর খুড়তুতো ছোট দেওরের জমিতে মাইরা গাছ আর টকবাইগুন। যে জমিখানের দিকে কেউ ফিরেও চাইত না, অন আইতে যাইতে চোখ টাটাই চায়। ন দেওর শখ করি ছাগল হুইশছে। সেই ছাগল গয়াম গাছের গোড়ায় বাঁধি রায়। ওমা কী কাণ্ড কী কাণ্ড ছাগল দড়ি ছিঁড়ি কেমনে কেমনে জমিতে ঢুকি মাইরা গাছের হাতা চাবাই চাবাই খাই হালায়। সব্বনাশের মাথায় আগুন। রাগিমাগি ফোঁস করি উঠে খুড়তোতো দেওর। ভরা উঠানে লাঠি লই তাড়াই আয়ে। অবস্থা বেগতিক দেই আঁই দুইজনের মাঝখানে আই গোলমাল থামাই। অগত্যা ঠিক হয় ছাগল আর কোনমতে বাড়িতে রাখন যাইত ন। আজ এই জমিতে আইছে কাইল অন্য জমিতে যাইব। ভাগাভাগির জেরে ভাইয়ে ভাইয়ে শত্রুতামির বীজও যে পোঁতা হই যাইব, কে আর জানত। মোদ্দা কথা হইল দেইখতে দেইখতে আঁর এত বছরের দেয়া হৌরবাড়িটা খান খান হই গেল। আঁর স্বামী কইল, আর যাই হই যাক, নিজের মনের ভেতরে কনও বেড়া দিও না। 

(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *