সুপন
অন্ধকার জমাট হচ্ছে। রাস্তার বোকা বোকা আলো একরোখার মতো ঠেলছে একত্রিত আঁধার আর নিজেদেরই অস্তিত্বে ঘেরাও হয়ে নিরাশ, ম্রিয়মান। পারষ্পরিক অযথা ঠেলাঠেলির মধ্যে প্রত্যেক আনাচ-কানাচের আড়ালে ওত পেতে আছে আরো গাঢ় অন্ধকার, যেকোন মুহুর্তে ঝাঁপিয়ে এসে স্তম্ভ সমেত ছিন্নভিন্ন করে দেবে আলোর দেখনাই। লাস্ট ট্রেনের কয়েকজন মাত্র যাত্রী নিজেদের দিকে উবে গেছে সহজে, ফলত সুনসান, গুড়িসুড়ি পড়ে থাকা রাস্তায় সে একা, একাই। একটাও টোটো বা ভ্যান নেই, থাকলেও আড়াই কিলোমিটার যাওয়ার ভাড়া সে দিতে পারতো না, নেই, তবু চোখের সামনে সুবিধা বা উপায় থকলে উৎসাহ আসে, সুবিধা প্রত্যাখ্যানে থাকে মহত্বের অনুভূতি। এখন হেঁটে হেঁটে তাকে যেতে হবে, যেখানে আজ তার ফেরার কথা না, প্রকৃত কারণ কিছু নেই, কেউ তার অপেক্ষায় রাত জাগছে না। দুজন অসুস্থ ও বয়স্ক মানুষ সেখানে সুস্থিরতার আশায় আছে বহুদিন, যে স্থিরতা তার হাত ধরেই আসার কথা, সেই দিনটার জন্যে মানুষদুটো নিজেদের শরীর মন নিঙরে নিঙরে বহুদিন ধরে জুটিয়ে এসেছে সব জরুরি, বেচে ও চেয়ে বেঁচে থেকেছে তাকে নিয়ে তার সাথে তার জন্য। তাকে অবলম্বন করে বদলে নিতে চেয়েছে নিজেদের অসুখ, অভাব, অনিশ্চয়তা। চাওয়ায় ভুল ছিল না, ত্রুটি ছিল না প্রতিদানের চেষ্টায়।
একটু আগে বৃষ্টি হয়ে গেছে। আবার হবে। ঝাপটা মারা হাওয়ার শরীর জুড়ে জলের ছটফটানি স্পষ্ট। খোদল, জমা জল আর এ্যাকাব্যাঁকা দেহ নিয়ে রাস্তা পিচ্ছিল। তাকে পৌছতে হবে, যেখান থেকে তার সব যাত্রা শুরু হয়েছে আনন্দে, শোকে, পরিশ্রমে, স্বপ্নে। এই মুহুর্তে কোলাহলহীন ও স্তব্ধ সড়কে নিজের পায়ের শব্দে তাকে চলতে হবে, হাঁটতে হবে ধীর, ক্লান্ত ও হেরে যাওয়া ধ্বস্ত মানুষের মতো একাকী, একাকীত্বের মগ্নতায়। তবু কিছু মানুষ জেগে থাকে। রাতে, বৃষ্টিতে, আলো বা অন্ধকারে, আবছায়ায় নিজেদের অস্তিত্বে বিপন্ন।
দৃশ্যটা হাস্যকর। তেমোহনায় মূর্তিটার সাথে যেন কুস্তি করছে – কে ওটা? একবার হাত, কখনো পা বা মাজা ধরে ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে মূর্তিটাকে ডাকছে পাগলা নবা। গভীর গলায় ডাকছে – এ্যই চলো চলো, অনেক বৃষ্টিতে ভিজেছ, রোদে পুড়েছ, একেবারে ফ্যাকাসে মেরে গেছ শালা…লোকে ভাবছে ফরসা…কি আজব দুনিয়া মাইরি…চলো শালা…চলো চলো, আমার ঘরে গে চাড্ডি খেয়ে একটু ঘুমিয়ে নেবা…কাল আবার রোয়াবি মারিও…চল বলছি শালা…এ্যই…কথা না শুনলে কলার ধরে নিয়ে যাব…আমি শালা নবা…চালাকি চলবে না…যাবি কিনা বল…
আরো, আরো কথা হয়তো নবার আছে, আরো মিথ্যে চেষ্টা সে করবে, সারারাত ধরে এসব উৎপাত সে করতে পারে। সবাই জানে, এটাই পাগলার চরিত্র। মূর্তিটাকে ঠেলতে ঠেলতে একটুও না নড়াতে পেরে হয়ত ওটার পায়ের কাছে পড়ে থাকবে সারারাত। একটু বুঝিয়ে ব্যাটাকে বাড়ি পাঠানো যেত, তেমন সময় হলে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে ব্যাটার কীর্তি দেখাও যেত, কিন্তু নন্দনের এখন কিছুই ইচ্ছা করছে না, থামতে না, চলতে না। আকাশটা ঝুল খেয়ে আনেকখানি নীচে, স্পষ্ট দেখা না গেলেও কিসের একটা প্রচণ্ড চাপ গোটা পরিস্থিতিকে স্তম্ভিত ও গুমোট করে রেখেছে। উত্তর দিকে শিউরে উঠলো বিদ্যুৎ, বাজ পড়লো দূরে কোথাও, এখনও তাকে হাঁটতে হবে, অনেকখানি পথ, অনেক।
ফাটা সোল থেকে জল চ্যুঁইয়ে উঠে স্যাতসেতে করে দিচ্ছে চপ্পল, প্রতি পদক্ষেপে হড়কে যাচ্ছে পা, তবু নিঃস্ব রাস্তার মাঝ-বরাবর হাটছে, ঘরের দিকে। যেখানে কেউ অপেক্ষায় নেই, হয়তো শুধু মা জেগে আছে। তার জন্যে নয়। ঘুমের ওষুধের অভাবে একটানা জাগতে জাগতে রুক্ষ আর অস্বাভাবিক রোগা মানুষ তার উপস্থিতি টের পেলে দরজা খুলবে, নিঃশব্দে, অভ্যর্থনাহীন একপাশে সরে তাকে ভেতরে যেতে দেবে। সে জানে, খুব আলতো সাড়া পেলেও উঠে আসবে মানুষটা। বাবা ঘুমচ্ছে, অথবা এমনও হতে পারে, বৃষ্টির রাতে তার কাশিটা বেড়েছে খুব, দমকে দমকে বেসামাল দম নেওয়ার তাগিদে সেও ঘুমতে পারেনি। গভীর রাতের হাফানি তাকে কাহিল করে জাগিয়ে রেখেছে।
এই তো, তপাদার মুদিখানা। গেল সপ্তা থেকে তাদের বাকি খাতা বন্ধ হয়েছ এই দোকানে। ধার না শুধলে কেই বা বাকি খাওয়াবে আজীবন! শেডের নীচ থেকে একদলা অস্পষ্টতা ক্যুঁইক্যুঁই করছে, ওগুলো কুকুর। ভিজে চুপচুপে প্রানীগুলো জড়িয়ে মড়িয়ে একাকার হয়ে আবছায়াটাকে অপছায়া করে তুলেছে, কোনো উত্তেজনা নেই, রাগ দ্বেষ দখলদারির অভিমত এই মুহুর্তে ওদের নেই। এত রাতের নিশ্চিত স্তব্ধধা ফুড়ে নিঃসঙ্গ মানুষের নিরিবিলি এই যাওয়ায় তাদের আক্রমণাত্মক প্রতিক্রিয়া দেওয়ার কথা, অন্তত উৎসুক হয়ে এগিয়ে আসার কথা দু-কদম – সেসব ভুলে অতি সামান্য আর নগন্য জায়গায় নিজেদের সংকুচিত করে নিয়েছে অবলীলায়। আর কি বা তারা করতো? নন্দনরাও বা জোটবদ্ধ হয়ে কি করতে পেরেছে নিজেদের যোগ্যতাকে প্রামাণ্য হিসেবে উপস্থাপিত করা ছাড়া! ছোট বেকারীর দুর্বল কর্মী ভোলা দাসের পুত্র, বাবার সামান্য আয়ের পারানিতে প্রচলিত বহমানতায় নিজেকে উপযুক্ত করে যোগ্যতার প্রমাণ সহ আজ শ্রান্ত, লড়াই লড়াই লড়াইয়ের শেষে বিপর্যস্ত। নিজেকে উপযুক্ত করে তোলার চেষ্টায় শেষ হয়ে গেছে বাবার উপার্জন, মায়ের সামান্য সোনাটুকু গেছে বি.এড ডিগ্রি অর্জনে। তারপরেও পড়া, লাইব্রেরী, সাজেশান, একাধিকবার পরীক্ষা, রেজাল্ট, ইন্টারভিউ – কি দীর্ঘ পথ! এতদূর পার হয়ে স্বার্থকতার স্বাদ যখন নাগালে – তখনই ঘটেছে অপঘাত। মেধায় যারা অযোগ্যতর, গচ্ছিত অর্থে বলিয়ান যারা সম্পদ ভাঙিয়ে যেকোন সাফল্যকে বানাতে পারে মাথার মুকুট, খরিদ করতে পারে আইন ও সরকার – তারা খুব দ্রুত তাদের মেধা পরিশ্রমকে ব্যর্থ করে ঘোষিত হয়েছে যোগ্যতম। নন্দনরা অনেকজন, সমস্ত ব্যবস্থার মধ্যে নিজেদের যোগ্যতা কোর্টে ও খবরে প্রামাণ্য হিসেবে উপস্থিত করতে যারা আপাত সফল, সেই স্বীকৃত যোগ্যতায় পথে এসে দাঁড়াতে পেরেছে শুধু, যে পথ তাদের অভিষ্ট স্কুল থেকে বহুদূরে পারষ্পরিক সম্পর্কহীন। যোগ্যতমদের অধিকার সম্মত দাবি আদায়ে নন্দনের পারিবারিক চলমানতা ঘুচে গেছে একেবারে। বিচারের অচেনা ও দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় জোগাতে হয়েছে অর্থ। অনেকে মিলে সে ব্যয় বহন করে চলায় সে এতদূর পেরেছে, নচেৎ একা সে একদিনও পারত না, দরিদ্রের জন্যে বিচারের প্রত্যাশা বাস্তবিক দুরাশা। এখন তারা রাস্তায়, রোদে জলে, বৃষ্টি হাওয়া শীতে তিন-তিনটে বছর, একটানা। তারও আগে কখনো কখনো দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা আর প্রতিশ্রুতিতে গেছে আরো পাঁচ। একটানা রাস্তায় থাকতেও কিছু খরচ লাগে মানুষের, খিদে থাকে, তেষ্টা পায় – সেসব চাহিদা গরিবতম উপায়ে মেটাতেও লাগে অর্থের জোগান। কোনো সহমর্মী সংগঠন হয়ত এক-আধদিন এগিয়ে এসে ব্যবস্থা করে, সাহায্যের নামে সেসব আসলে উদারতা, লড়াই সঙ্গী তারা নয়। দয়া দিয়ে সংশোধন হয় না, সংশোধনের দায়িত্ব অত্যাচারিতের কাঁধেই আঁট হয়ে থাকে। সবাই খুব স্পষ্ট জানে কি হয়েছে, কিভাবে হয়েছে, সবাই জানে কারা কারা করতে পারে – কিন্তু সংশোধনের গণতান্ত্রিক ক্ষমতা যাদের আছে তারা অন্যায়কারীর পুনঃর্বাসন নিয়ে যতটা সক্রিয়, বঞ্চিতদের প্রতি যথাযোগ্য দায়িত্ব পালনে ততটা না। তদন্তের নামে, বিচারের নামে, দোষি প্রমাণের নামে – সমস্ত খেসারৎ দিতে হচ্ছে যোগ্য কিন্তু বঞ্চিতদের। হয়ত কখনো কখনো তাদের প্রতি মানবিক মন্তব্য করে নানা প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন ক্ষমতাবানেরা, কিন্তু সমস্বরের বদলে সমব্যথা প্রদর্শনের উচ্চকিত উদ্যাপন যেকোন আন্দোলনকে খানিক প্রতিহত করে শেষ পর্যন্ত।
স্কুল মোড়, আর কয়েক পা মাত্র, স্কুলের ঠিক পিছনেই ঋতিদের বাড়ি। সে পৌঁছলে কি শিশু গাছটার ঝাঁকড়া ছায়া থেকে সামনে এসে ঋতি কি বলে উঠবে – আমি জানতাম তুমি আজ আসবে, আমি জানতাম জন্মদিনের শুভেচ্ছা ফোনে না জানিয়ে তুমি আসবে দেখা করতে, আমি জানি তুমি আন্দোলন ছেড়ে এসেছ, আর যাবে না। আমরা মিলে একটা বিকল্প ব্যবস্থা করে নেব ঠিক, নেবই…
ঋতি কি আসতে পারে সত্যি? চমকে দিয়ে সামনে দাঁড়াতে পারে হঠাৎ? যদি না আসে এত রাতে, সে কি যাবে তাদের বাড়ির গেটে, জন্মদিনেও ফোন না পেয়ে অভিমানিকে ডাকবে আস্তে করে একবার, নাকি এখান থেকে কল করবে একটা! সে উপায় তো নেই, ঋতিও জানেনা, তিনদিন আগে তার অউটগোয়িং ফুরিয়েছে, বড়জোর কল আসবে আর চারটে দিন। তার আগেই তো প্রয়োজনহীন হয়ে যাবে এই যন্ত্রটা। এখন যদি সত্যি সত্যি ঋতি আসে, গাছটার গোড়ায় কি তারা বসে নেবে দু-দণ্ড? বৃষ্টির মিহিন ফোঁটা হাওয়ার মতো জড়িয়ে ধরে ভিজিয়ে দিচ্ছে আলতো, দুজনেই কি ভিজবে অনেকক্ষণ, খবর দেওয়া নেওয়ার বদলে মানুষের নিজস্ব কথা বলতে পারবে পরষ্পরে! ঋতির সাথেও আনেকদিন কথা মানে শুধু খবর দেওয়া – কি হলো? কোথায় আছ? খেয়েছ? কোর্ট কি বলছে? – ইত্যাদির বাইরে সব কথা যেন ফুরিয়েছে। এইতো গাছটা, সে পেরিয়ে যাচ্ছে, খুব ধীরে মাথাটাকে বাঁদিকে ফিরিয়ে ঋতিদের নিঃশব্দ অন্ধকার বাড়িটাকে দেখতে দেখতে।
পথ ফুরিয়ে আসে, জল ঝড় বিদ্যুৎ বা প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও চলতে পারলে পথ এক সময় হার মানে সমাধান অথবা সমাপ্তিতে। কিন্তু যারা চলতে পারে না, তারা কি পথে ফুরোয়? নন্দন সন্তপ্ত নয়, সে লড়াই করেছে, সর্বস্ব, যা তার ছিল, অর্থ মেধা যুক্তিবোধ সক্ষমতা – সব, সবটুকু সে নিঙরে দিয়েছে আরো অনেকের মতো স্বার্থকতার চৌকাঠে। অনেকে লড়াই থামায়নি এখনও, হয়ত তাদের শক্তি নন্দনের চেয়ে বেশি, সহ্য ক্ষমতা বেশি, যারা হয়ত তিথির মতো, কান্নাকাটি করেও সামলে ওঠে দ্রুত, নিরাশাকে উস্কে উস্কে ফুলকি তুলে আনে। তিনবছরের বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে প্রথম এসেছিল তিথি, বাঁকুড়ার প্রান্ত থেকে। খোলা রাস্তায় বাচ্চা কোলে কি প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস। উদোম রাস্তার ধুলো হাওয়া জল মরমী হতে হতেও প্রতিদান রাখতে ভোলেনি ছোট্ট নরম শরীরে। অসুস্থ ছেলেকে বাড়িতে রেখে আবার ছুটে এসেছে, ভিডিও কলে বাচ্চার ডাক শুনে কান্নাকাটি করে ফিরে যায়, আবার আসে, পাথরের মতো চোখমুখ নিয়ে প্রতিবাদ ধর্ণার সামনে থাকে, যা তার হক, যা ডাকাতি হয়ে গেছে প্রকাশ্যে, সেটাকেই পুনরুদ্ধারে অদম্য। সেরকম সুদেব, বাড়িতে অভাব নেই, চাকরিটা নিতান্তই প্রয়োজনীয় নয়, কিন্তু নিজের যোগ্যতাকে অন্যায়ের হাতে বলি হতে দেবেনা বলে মাস বছর পেরিয়ে রাস্তার অরাজকতায় জাপ্টে আছে আনেকের সাথে হাসি ঠাট্টা লড়াইয়ে। সেই অনেক করুণা চায়নি, সহমর্মিতার প্রতি তীব্র লোভ নেই, নেই বিপ্লব সৃষ্টির বাসনা। শুধুমাত্র প্রতিষ্ঠিত যোগ্যতার ন্যায্য স্বীকৃতি – এইমাত্র দাবি। যোগ্যতা প্রামাণ্য হলে স্বীকৃতি জরুরি, সেই তাগিদে এত এত তরু্ণ তরুণী রাস্তায় নিজেদের ক্ষয় করে চলেছে উপযুক্ত বিচারের পরিক্রমায়। বিচারের অশুভ দীর্ঘতা, প্রশাসনের অকর্মণ্যতা, ক্ষমতাবানের ন্যুন্যতম সততাকে প্রশ্ন করে চলেছে প্রতিদিন, উত্তর অধরা। প্রামাণ্য সহ প্রচুর অনৈতিকতার খবর তারা তুলে ধরার পরে শুধু এক পরিসর তৈরি হয়েছে আলোচনা ও অস্বীকারের। যেখানে শাসকের আস্ফালন আর বিরোধীদের প্রতিক্রিয়া পারষ্পরিক উপাদেয় হয়ে উঠলেও তাদের সুরাহা আসেনি। কয়েকজন দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং স্খলিত ক্ষমতাবানের জেল হেফাজত তাদের সাফল্য, স্বপ্নপূরণ নয়।
নন্দন আজ সেই আন্দোলন থেকে চলে এসেছে, চুপিচুপি, কাউকে না জানিয়ে। লড়াইয়ে টিকে থাকার সামান্য রসদ জোগাড়ে সে আর সঙ্গীদের সাহায্যপ্রার্থী হতে চায়নি। আন্দোলন সমষ্টিকে সমৃদ্ধ ও পুষ্ট করলেও ভেতর ভেতর দুর্বলকে রিক্ত, নিঃস্ব করে দেয়। কদিন আগে বাড়ি ঘুরে যাওয়ার সময় হাতে কয়েকটা মোটে টাকা তুলে দিয়ে মা বলেছিল – এই শেষ, এরপর আর কিছু নেই। তার লড়াইয়ে সামান্য পাথেয় জোগাতে দুজন অসুস্থ মানুষ হয়ত একবেলা আধপেটা খেয়ে কাটিয়ে চলেছে দিনের পর দিন। সেটাতেও টান লাগলে লড়াই মূল্যহীন, জেদ অপরাধ, সৎ শপথও পরিস্থিতি বিচারে স্বার্থপরের গোয়ার্তুমি হয়ে ওঠে। পকেটে থাকা সব সব টাকা এবারে খরচ করেছে নন্দন, ছোট ছোট ওষুধের দোকান ঘুরে ঘুরে মায়ের ওষুধ কিনেছে আনেক দিনের, বাবার ইনহেলার একটা। প্রেস্কিপশান দেখিয়ে প্রেসার সুগারের নানা ওষুধের অল্প কয়েকপাতার সাথে অনেকগুলো অ্যালপ্রাজ টেন। আট পাতা ঘুমের ওষুধ তাকে বা তিনজনকেই ভাসিয়ে নিতে পারবে নিশ্ছিদ্র নিরাময়ে।
এমন একটা ব্যবস্থার কথা মা তাকে বলেছিল, যখন কোভিড, যখন ধুকতে থাকা বেকারি বন্ধ হয়ে গেল রাতারাতি আর বেকারির দুর্বল কারিগর হঠাৎ নিঃস্ব রিক্ত হয়ে দীর্ঘকালীন অনিয়মের স্পষ্ট প্রতিদানে ফুসফুস ক্ষয় করে আশ্রয় নিল বিছানায় – তখন মা বলেছিল, আর সে রুখে দিয়েছিল চমৎকার একটা বেঁচে থাকার স্বপ্ন দিয়ে। যে স্বপ্নের ভেতর শুধু খাদ্য নয়, চিকিৎসা সুখ আরাম নিশ্চয়তা আর স্বার্থকতার পর্যাপ্ত আনন্দ, সেই স্বপ্নটাকে সে প্রায় ছুঁয়ে দেওয়ার দোরগোড়ায় নিজেকে নিয়ে যেতে পেরেছিল ততদিনে। আপসকামী ব্যবস্থার মধ্যে তারও আগে সে নিজেকে স্বার্থক করে তুলতে অবসরহীন পরিশ্রমের পথ পেরিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছিল যোগ্যতা। আজ, ঠিক এই মুহুর্তে তার সেই যোগ্যতার বড়াই গোটা পরিবারকে ধ্বস্ত করে পুরনো সিদ্ধান্তের দিকে নির্মম টেনে এনেছে ধীরে ধীরে।
না, কারো করুণা আর নেওয়া চলে না। অমলকাকু অনেক সাহায্য করেছেন। ঘুপচি ঘরে ছোট্ট বেকারির মালিক অধিকাংশ দিন কাজে যেতে না পারা অসুস্থ কর্মচারীকে সাহায্য করে চলেছেন অনেকদিন, একটু একটু করে তাঁর সঙ্গতির মতো সাহায্যের পরিমান ফুরিয়ে এসেছে। গতমাসে বাবাকে হসপিটালে ভর্তি রাখার সময়ে পঞ্চায়েত মেম্বারও সাহায্য করতে পৌঁছেছিলেন। আড়ালে ডেকে আপনজনের গলায় বলেছিলেন ওইসব অকারন আন্দোলন থেকে সরে আসতে। সরকার চাইলে আন্দোলন লাগে না, না চাইলে আন্দোলনেও সুবিধা হয় না, বরং আসুবিধার আশঙ্কা ষোলআনা। প্রয়োজনে তিনি অন্য কাজ জোগাড় করে দেবেন, সিভিক ভলিন্টিয়ারের চাকরি চাইলে তিনি তখনই ব্যবস্থা করতে পারবেন বলে চাপড়ে দিয়েছেন পিঠ। নন্দন রাজি হয়নি তখন, যোগ্য শিক্ষকের সিভিক হয়ে যাওয়া তো আত্মহত্যাই, অথবা খুন। সাফল্যের দাবি একমাত্র স্বীকৃতিতে প্রতিষ্ঠিত হয়। আজ সে হেরে গেছে, নিয়োগের জন্যে লড়াইয়ের ময়দান ছেড়ে চলে এসেছে একেবারে, ঝড় জল প্রতিশ্রুতি হুমকি থেকে পুলিশের লাঠি যা পারেনি, আজ সেটাই তার বাস্তবতা, তবে পালিয়ে না, পরাস্ত হয়ে। কিছু হেরে যাওয়া এমনই ধ্বস্ত করে যে, ফেরার পথ থাকে না, থাকে না দিক বদল। পরাজয়কে তখন বরণ করতে হয় আত্ম সংহারে। বলিদানের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠা করতে হয় সত্যকে, আর শুধু প্রতিশ্রুতিতেই মিথ্যে প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায়।
খুব কাছেই বাজ পড়ল। আকাশ ভেঙে সেই আলো স্কুলের পুকুরে ছলবলিয়ে উঠতেই নন্দন বুঝলো সে দাঁড়িয়ে, স্কুল পেরিয়েও সে অপেক্ষা করছে, কার জন্যে? ঋতি? যখন সমস্ত নিশ্চয়তার প্রস্তুতি সে নিয়েছে নীরবে, প্রায় প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সফল হওয়ার মতো নিরলস একাগ্রতায় সব ব্যবস্থা ইতিমধ্যেই সম্পন্ন, তখন ঋতির জন্যে কেন এই অপেক্ষা? সে কি নিজেই বানচাল করতে চায় নিশ্চিত আয়োজন! ঋতি ব্যথা পাবে, কষ্ট হবে তার, কিন্তু মানিয়ে নেবে একসময়। মানুষকে মানিয়ে নিয়েই অন্যের মান্যতা পেতে হয়, যাকে বলে সমাজ বাস্তবতা। তদের আন্দোলনও সমব্যথী পেয়েছে, কিন্তু জনমানসের মান্যতা পায়নি, পেলে ফলাফল বদলে যেত। অভিভাবকরা দুর্নীতিগ্রস্ত শিক্ষকদের কাছে সন্তানকে পাঠানোর আগে প্রতিবাদ করতেন, অর্থলোলুপ প্রশাসনের বিরুদ্ধে তাদের সমস্বরে হতেন সোচ্চার। সেক্ষেত্রে এত সময়, নষ্ট ও ভ্রষ্টদের পরিচালনে এত অনৈতিকতার ভেতর দিয়ে আতিবাহিত হত না জীবন। অন্যায়ের সাথে আপোষ আসলে সফল অভিযোজন, অধিকাংশ মানুষ নব্য ব্যবস্থায় অভিযোজিত, আর কিছুদিনেই হয়ত এইসব অন্যায় নৈতিক হিসেবে বিবেচিত হবে। যারা অভিযোজিত হতে পারে না, তাদের কাছে তো বিলুপ্তিই সন্তোষ। গোটা জনব্যবস্থা তাদের বিচ্ছিন্ন করে দৈনন্দিনতার অভ্যাসে অভিযোজিত হয়ে চলেছে। জনকল্যানের আড়ালে যখন সংগঠিত অব্যবস্থা কাউকে ঠেলতে ঠেলতে নিরাশা আর মৃত্যুর দিকে অনিবার্য নিয়ে যায় আর তখনও যদি সেখানে আত্ম সংহার হয়ে থাকে আইনত অপরাধ – তাহলে তো আত্মহত্যাই প্রতিবাদ, চূড়ান্ত প্রতিবাদ।
নন্দনের পেচ্ছাপ পায়, জোর। দুপুরে খাওয়া একপেট জল প্রচণ্ড তেজে নিম্নমুখি, আটকে রাখা যায় না। রাস্তার পাশে কালকাসুন্দির আবছা ঝোপের মধ্যে হিসহিসিয়ে ছুটতে থাকে সেই জলের ধারা, ধারার শব্দে চাপা পড়ে যায় হাওয়া বৃষ্টির স্বর, খানিক উপস্থিতি ও প্রচণ্ড বেগের আন্দোলন স্তিমিত থেক সমাপ্ত হলে নন্দন আবার হাঁটে, রাস্তার আলগা খোয়া ফাটা সোল পেরিয়ে পায়ে বিধতে থাকলে তার ধীর গতি আরো ধীর আরো অস্বস্তির হয়ে ওঠে। সিদ্ধান্তের আগামীকে সকালেও যতটা সহজ মনে হয়েছিল, সেই সহজতাও কেমন স্তিমিত হয়ে আসে এই সময়। আর বেশি দূর যখন নয়, আর হয়তো পাঁচ মিনিটে সে পৌছে যাবে দোরগোড়ায়। সামনের বাঁদিকে থোক থোক অন্ধকারের হা মুখের ভেতর যে গলিটা ঢালু হয়ে নেমেছে সেখানে নিজ্ঝুমতায় আচ্ছন্ন পথটা ধরে হাঁটলে সে পাঁচ মিনিটেই পৌঁছে যাবে সমাপ্তির দোরগোড়ায়, নির্ভার হয়ে নির্মম বিস্মৃতিতে হারিয়ে যাবে সহজে। নির্লিপ্ত রাত্রির মধ্যে তার এতদূর হেঁটে আসা কোথাও ঢেউ তোলেনি, কোথাও চিহ্নিত হয়ে নেই তাদের থাকা না থাকা, হিংস্র উদাসীনতায় গোটা পাড়া, গোটা রাজ্য, গোটা দেশের সর্ববৃহৎ মানুষ ঘুমিয়ে আছে আস্তিত্বের আপব্যয়ে সম্পন্ন ও ভাবনাহীন। অদূর বা সুদূরে এমন কেউ নেই যে তাকে এখন আটকাবে, কেউ তাকে বোঝাবে না যে, বিনা আর্তনাদে হারিয়ে যাওয়ার মধ্যে কোনো অর্জন নেই, নেই বাহাদুরি। বাহাদুর সে কোনকালেই হতে চায়নি, এখনও না। আরেকটু ধীরে পা ঘষে ঘষে অগত্যা নন্দনকে এগিয়ে যেতেই হয় তারই নির্মিত সমাপ্তির দিকে, যে দিকের অন্তিম শূন্যতায় সে নিজেকে সঞ্চারিত করেছে কিছুটা আবেগ, বেশিটা বাধ্যবাধকতায়। শুধুমাত্র তার বাস্তবিক পরিবার – অসহায় ও প্রায় অথর্ব বৃদ্ধ বৃদ্ধাদের নাগালে যদি এখনও কিছু প্রাণোদনা থেকে থাকে তবে সেই অবশিষ্টাংশে হয়তো তার কিছুটা সময় অতিবাহিত হবে আরো, আর যদি থাকে তাদেরও সম্মতি, তাহলে আজ অথবা কাল – আরেকটা অতি সাধারন ঘটনা স্থানীয় সংবাদের অকুলিন অবস্থান ছুঁয়ে বিস্মৃতির দিকে তাড়িত হবে অনটনেও সময়ের যোগ্য হয়ে ওঠা এক নিঃশব্দ লড়াই।
হাঁটতে হাঁটতে নন্দন আরেকটু বেশি কুঁকড়ে যায়, খিদের একটা তেজালো অনুভূতি পেটের ভেতর থেকে ডুকরে ডুকরে গলার কাছে ঘাই দিতে থাকলে সামান্য গরম ভাতের কথা ভাবতে মন চায় আর তখনই হোঁচট লাগে, অথবা কল্পিত ভাতের ভীষণ গরমে ছ্যাঁৎ করে পুড়ে যায় পা। নিজের পা হাতে তুলে নিতে গিয়ে অন্ধকারের পর্দায় যেন ভেসে ওঠে নবা পাগলার রাগী মুখ, কি প্রচণ্ড এক চেষ্টা এই ঝড়জলে করে চলেছে নবা। আহারে, সে যেন পারে, অন্তত একটি বার। কিন্তু তাকে তো বোঝাতে হবে, কাউকে গিয়ে বুঝিয়ে বলতে হবে যে এভাবে না, অনড়কে আবেদনে রাজি করে নড়ানো যায় না, ভেঙে সরাতে হয়। শুধু এই কথাটুকু নবাকে বোঝাতে হবে। কে বোঝাবে? সে ছাড়া আর কেউ তো আজ তাকে দ্যাখেনি।