তুষার বরণ হালদার

লেখক পরিচিতি 

(তুষার বরণ হালদার নদীয়ার আড়ংঘাটা গ্রাম থেকে স্কুল শিক্ষা শেষ করে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা  সম্পন্ন করেন। পি.এইচ.ডি. ডিগ্রি পান নদীয়া জেলার অসংগঠিত শিল্প ও শ্রমিকদের ওপর গবেষণা করে । গবেষণা কর্মের ওপর ভিত্তি করে দুটি বই এবং  বিভিন্ন গ্রন্থ ও জার্নালে বহু প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদ কর্তৃক প্রদত্ত শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধের জন্য তিন বার পুরস্কৃত হন। এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য। বর্তমানে তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত দক্ষিণবঙ্গের একটি কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপক।)

প্রাচ্যবিদ্যা বিশারদ মনমোহন চক্রবর্তী

প্রাচ্যবিদ্যা চর্চার এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তিত্ব ছিলেন মনমোহন চক্রবর্তী, জন্মেছিলেন তৎকালীন চব্বিশ পরগনা জেলার বারাসাতে ১৮৬৩ সালে। পিতা দ্বারিক চন্দ্র ছিলেন শিক্ষা বিভাগের একজন আধিকারিক। পিতার চাকরীর সূত্রে তিনি উড়িষ্যার কটকের বিখ্যাত রভেনসন কলেজিয়েট স্কুল থেকে এন্ট্রান্স উত্তীর্ণ হন এবং পরে ওই কলেজ থেকেই স্নাতক হন। এরপর তিনি কলকাতায় ফিরে  আসেন। তিনি প্রাদেশিক সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে  কটকেই ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে কর্মরত থাকেন বেশ কিছুদিন। জীবনের প্রাথমিক পর্যায় উড়িষ্যায় থাকার জন্য তাঁর মনে ওখানকার প্রাচীন ঐতিহ্য, ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রতি একটা অনুরাগ জন্মেছিল। আর সেটাই তাঁর ভবিষ্যত প্রাচ্যবিদ্যা তথা ভারত বিদ্যার ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিলো। তিনি উড়িষ্যার প্রাচীন ইতিহাস ও সংস্কৃতি নিয়ে চর্চা করেছিলেন।
    এই বিষয়ে তাঁর পূর্বসুরী ছিলেন, এন্ড্রু স্টার্লিং, উইলিয়াম  হান্টার, রাজেন্দ্র লাল মিত্র ও রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর পূর্বসূরীরা অনেকেই ‘মাদলাপঞ্জির ‘ উপর নির্ভর করে ওড়িষা চর্চা করেছেন, তাঁর ওড়িষা বিষয়ক চর্চা ছিল একটু ভিন্ন পথে । মাদলাপঞ্জি হলো,পুরির জগন্নাথ দেব মন্দিরের পূজারীদের দ্বারা পুরুষানুক্রমে লিখিত ও রক্ষিত বিবরণ। এটি উড়িষ্যার প্রাচীন ইতিহাসের অন্যতম উপকরণ। তিনি মাদলাপঞ্জি থেকে প্রাপ্ত তথ্যের উপর নির্ভর না করে তামর শাসন, শিলালেখ, প্রাচীন পুঁথি এই সব প্রামাণ্য ঐতিহাসিক উপকরণের উপর নির্ভর করেছিলেন। যার ফলে তাঁর ইতিহাস অন্বেষণ ছিল যুক্তিসঙ্গত। ফলত, উড়িষ্যার সংস্কৃতি ও ভাষা চর্চার ইতিহাস রচনায় তিনি ছিলেন অগ্রদূত। এখানেই তিনি নিজের প্রতিভার পরিচয় বহন করেছেন। 
    ১৮৯২ থেকে ১৯১৬ সাল পর্যন্ত কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে তিনি উড়িষ্যা বিষয়ে সাহিত্য, ইতিহাস, ভূগোল ও প্রাচীন সাহিত্য সম্পর্কে অজস্র নিবন্ধ রচনা করেছেন। কলকাতা বিশ্ব বিদ্যালয়ে উড়িয়া ভাষাতে এম, এ. পাঠক্রম শুরু হলে এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে তাঁর যত প্রবন্ধ বেরিয়েছিল সেগুলিকে সংকলন করে বিশ্ববিদ্যালয় ‘Notes on the Language and Literature of Orissa” নামে অবশ্য পাঠ্য বইয়ের তালিকায় রাখা হয়েছিল।  এছাড়াও তিনি ‘History of Mithila during Pre Moghul Period’ নামে উৎকৃষ্ঠ মনের একটি প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন। ‘Sanskrit Literature in Bengal during Sen Rule’ আর একটি ভারত চর্চা  বিষয়ক মূল্যবান প্রবন্ধ। তিনি নব্য ন্যায়ের ইতিহাস চর্চার সঙ্গে মনমোহন বাংলা ও স্মৃতি শাস্ত্রের চর্চা সম্বন্ধে গবেষণা করে ১৯১৫ সালে লিখেছিলেন ‘History of Navya Naya in Bengal and Mithila’. শুধু এদেশে নয়, বিলেতের রয়াল এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে তিনি প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সাংস্কৃতির উপর একাধিক নিবন্ধ লিখেছেন।
   ১৯১৪ সালে বিদ্যাচর্চার বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর অসামান্য অবদানের জন্য তিনি সরকার কতৃক ‘ রায়বাহাদুর ‘ উপাধি প্রাপ্ত হয়েছিলেন।  এই বিখ্যাত ভারততত্ত্ববিদ ১৯১৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ইহলোক ত্যাগ করেন। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *