তাপস সরকার

লেখক পরিচিতি 

( সৃজনশীল সাহিত্য কর্মে নিয়োজিত কিশোর  বয়স থেকেই। প্রথম পঠিত গ্রন্থ রামায়ণ, মহাভারত ও গীতা। গদ্যসাহিত্য ও উপন্যাসেই সাবলীল। যদিও শতাধিক গল্প ও দশ-বারোটি উপন্যাসের রচয়িতা কিন্তু সেসব হারিয়ে গেছে অপ্রীতিকর কারণে। প্রিয় বিষয় মহাকাশবিদ্যা। কল্পবিজ্ঞান ও কিশোর সাহিত্য প্রিয় লেখা।কিছু গল্প নব্বইয়ের দশকে বাণিজ্যিক ও অবাণিজ্যিক পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত। উন্মীলন নামে প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকায় নিজের গল্প ও দুটি উপন্যাস ছাপা হলেও সেই উদ্যোগ থেমে যায়।প্রতিভাস সাহিত্য ম্যাগাজিন চলছে পনের বছর যা মায়ের নামে। সেখানে মায়ের উদ্দেশ্যে নিবেদিত লেখা স্মৃতিচিত্রণ ও বেশ কিছু ছোটগল্প। নব্বইয়ের দশকে কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে কিছুদিন লিটল ম্যাগাজিন গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত থেকে জেলায় জেলায় সাহিত্য আসরে ঘোরাঘুরি। বিশ্বকে নিজের ঘর বলে ভাবতে অভ্যস্ত। মায়ের মৃত্যুর পর অবসাদে দীর্ঘদিন লেখায় বিরত। তারপর আবার লেখা শুরু কিশোর সাহিত্য ‘গাছবাড়ির বাসিন্দা ‘ দিয়ে। পাঁচ বছরের প্রচেষ্টায় কোভিড পরিস্থিতিতে লেখা ইংরেজি ভাষায় ‘ইটস মাই আইল্যান্ড ‘ প্রকাশের অপেক্ষায়। স্বউদ্যোগে প্রকাশিত একমাত্র উপন্যাস ‘অন্তরালোকে ‘ নিজের জীবনের এক বিশেষ অধ্যায় ও মাকে নিয়ে লেখা। ভারতীয় প্রাচীন দর্শনের ওপর একনিষ্ঠ বিশ্বাস ও আধুনিক প্রযুক্তির ওপর বিরক্তি  ‘অনন্ত জীবন ‘ উপন্যাসের পাতায় পাতায় প্রতিফলিত। পেশায় অর্থনীতি বিষয়ের অধ্যাপক। ) 

মূলাংশ       

(মরজগতে মানুষ চলেছে অমরত্বের সন্ধানে। অনাদি অতীত থেকে তার এই যাত্রারম্ভ। অনন্ত জীবন তারই এক প্রকাশ। তাই অমৃতের অধিকার নিয়ে সুরাসুরে এত অশান্তি, কারণ অমৃত নাকি অমর করে। অমরত্বের ব্যাখ্যা আবার দ্বিধাবিভক্ত, দৈহিক অমরত্ব এবং আধ্যাত্মিক অমরত্ব। দানব ও সর্বসাধারণ বোঝে প্রথম মতবাদটিকেই। কোনটি সঠিক? সবাই ছোটবেলায় হারিয়ে যায় মানুষের মেলাতে, সেখানে সে বন্ধু খুঁজে পায় যাকে সে তাকে হাত বাড়িয়ে দেয়, বোঝাতে চায় মানুষ ও বিশ্বজগতের উদ্দেশ্যবিধেয়। যে তাকে চেনে সে বোঝে সব। শৈবাঙ্কন আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর সভ্যতাকে অস্বীকার করে চলে যায় স্পিতি ভ্যালিতে। সেখানে সে আবিষ্কার করে সর্বজনীন ভাষা যাতে বাক্যালাপ চালাতো সনাতন মুনি-ঋষিরা কীটপতঙ্গ, পাহাড়-পর্বত, নদী-জঙ্গল, পাথর-প্রান্তর এবং অদৃশ্য দেবতাদের সঙ্গে। স্পিতি ভ্যালির পটভূমিকায় স্পিতি নদী ও প্রাকৃতিক উপাদানসমূহ এবং মানুষের সঙ্গে কথোপকথনে সে খুঁজতে থাকে অনন্ত জীবন বা অমরত্ত্বের ব্যাখ্যা। কী পেল সে শেষ পর্যন্ত ? )

অন্তর্বর্তীয় : দুই

অন্যান্য পৃথিবী 

তারা সবাই দল বেঁধে বেড়াতে গিয়েছিল কয়েকদিনের ছুটি পেয়ে। সেই জায়গাটা অবশ্যই প্রকৃতির এক সংগোপনে আড়াল যেখানে সমুদ্রসৈকত পাথুরে পাহাড়ে খুঁজে পেয়েছে সমাপ্তিরেখা। এখানে গাছপালারা ভিড় জমাতে পারেনি তেমন, কারণ মাটির চরিত্রে সেইরকম প্রশ্রয়ের সন্ধান পায়নি তারা। তবুও যারা আছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে উদ্ভিদজগতের প্রতিভূ হিসেবে তারা পৃথিবীর যেকোন পরিবেশকেই অত্যন্ত আদরে নিজের করে নেওয়ার মন্ত্র জানে। সমুদ্রের গায়ের রঙ চোখ এমন বিভ্রান্ত করে দেয় যে নীল না সবুজ বোঝা যায় না, ঢেউগুলি হাত ধরাধরি করে কাঁকুড়ে বালিভর্তি বেলাভূমিতে আলস্যে গা এলিয়ে দেয় অবিশ্রাম আর অদূরে পাহাড়ি ঢালে তেমন বিছানা না পেয়ে হতাশায় ফেনিল ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে। সেদিন বুদ্ধপূর্ণিমার রাত, আকাশে চাঁদের তাই স্বমহিমায় অবস্থান ছিল। এখন আর সমুদ্রের রঙ নিয়ে মাথাব্যথার কারণ নেই যেহেতু জ্যোৎস্না সব বিতর্ক মুছে দিয়েছে। হোটেল তাদের সৈকতভূমির কাছাকাছি হলেও সেখান থেকে সমুদ্র দেখা যায় না বলে সন্ধের একটু পর তারা বেরিয়েছিল। সৈকতে অনেক না হলেও মন্দ লোক ছিল না। অপেক্ষাকৃত নিরিবিলি একটা প্রান্তে এসে তারা মুখ গুঁজে থাকা পাথুরে বোল্ডার খুঁজে পেল যেখানে অনায়াসে বসে বসে গল্প করার মজা ও আরাম উপভোগ করা যায়। তারা সবাই বসল সেসবে, সমুদ্রের মুখোমুখি। উপলক্ষ হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, 

‘আচ্ছা, বুদ্ধদেব কি কখনো সমুদ্রের ধারে গিয়েছিলেন ?’

শুনে সবাই একটু হকচকিয়ে গেল। প্রশ্নটা কেমন যেন খাপছাড়া। যাকে বলে অফ দ্য ট্র্যাক বা অফ দ্য রুট। বুদ্ধপূর্ণিমার রাত হলেওবা। এমন পাহাড়ি পাদদেশে সমুদ্রশোভিত বেলাভূমিতে পাথরের আসনে আসীন হয়ে আকাশি মায়ায় আশ্রিত সুবর্ণগোলকাকৃতি চাঁদের অফুরন্ত ভালোবাসার তলায় থেকে কারো মাথায় এমন প্রশ্ন আসে? উপলক্ষের চরিত্রটা এমনই। তার হঠাৎ হঠাৎ এমনি সব আলটপকা প্রশ্নে সবাই বেসামাল হয়ে যায়। বন্ধুমহলে এই নিয়ে তার বদনাম আছে। বন্ধুদের মধ্যে কেন, সর্বত্র। স্কুলেও শিক্ষকরা ক্লাসে এসে ভয়ে ভয়ে থাকতেন। পারতে তার দিকে তাকাতেন না, পড়াও ধরতেন না। কখন ছেলেটা কী উদ্ভট প্রশ্ন করে বসে ! উত্তর না দিতে পারলে কি ছেলেদের কাছে মান-সম্মান থাকবে ? ছাত্রদের প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে শিক্ষকের নাকাল হওয়া শোভা পায় না। পরবর্তী সময়ে উচ্চশিক্ষার প্রাঙ্গণেও এরকমই হত, আর পরিচিত মহলেও সবসময়। এখনও তার প্রশ্ন শুনে চট করে কেউ কিছু বলে উঠতে পারল না। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর একসময় প্রযত্না আমতা আমতা করে বলল,  

‘বুদ্ধ তো বেশি ঘোরাঘুরি করেন নি। পাহাড়, জঙ্গল, সমতলভূমির বাইরে কোথাও যাওয়ার দরকারই হয়নি তাঁর।’

উপলক্ষ দমার পাত্র নয়। উত্তর শুনে বলতে গিয়ে সে টগবগিয়ে উঠল,

‘ওইখানেই তো ভুল করলি। বুদ্ধদেব সমুদ্র পেরিয়ে কাঁহা কাঁহা মুল্লুকে চলে গিয়েছিলেন। তোরা তা জেনেও দেখিস না।’

সমস্বরে প্রতিবাদের ঝড় উঠতে যাচ্ছিল। সবাইকে ছাপিয়ে মুখর হয়ে উঠল নিভৃতির গলা,

‘তোর কাছে প্রমাণ আছে বুদ্ধদেব সমুদ্র পেরিয়েছিলেন ? জন্মেও শুনিনি এমন কথা।’

সে থামতে না থামতেই বিবর্তন চেঁচিয়ে উঠল,

‘তুই কোথাকার কোন্ ঐতিহাসিক এলিরে যে বুদ্ধ সম্পর্কে আজগুবি এমন তথ্য জানাচ্ছিস যা আজ অব্দি কেউ জানে না !’

তাদের সম্মিলিত চেঁচামেচিতে নির্জনতার বুক ফালাফালা হয়ে যাচ্ছিল। আসলে তার স্বভাবের জন্য উপলক্ষকে বন্ধুরা আক্রমণ করে আনন্দ পায়। সবাইকে সে যখন-তখন এমন অপ্রস্তুত করে দেয় বলে রাগে বা আক্রোশে। প্রতিবাদের ঝরে খড়কুটোর মত ভাসতে ভাসতে উপলক্ষ কোনকিছু বলার আর সুযোগ পেল না আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য। বাধ্য হয়ে সে চুপ করেই থাকল। এটাই তার স্বভাব। তাঁর খোঁচা খেয়ে সবাই যখন উত্তেজিত হয়ে পড়ে তখন সে নির্বাকই থাকে। বিরুদ্ধপক্ষের বাক্যজালের তোড় শান্ত হলে সে নিজের যুক্তি সাজাবার চেষ্টা করে এবং শেষপর্যন্ত বুঝিয়েই ছাড়ে যে তার প্রশ্নটা সত্যিই কতটা সঠিক। এখনও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে সে সবাইকে গায়ের ঝাল ঝেড়ে ঠাণ্ডা হওয়ার সুযোগ দিল। আক্রমণ মোটামুটি নিশ্চুপ হওয়ার পর সে বলল,

‘অরে প্রমাণিত খুনীরাও তো আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পায়। তোরা তো এমন শুরু করলি যে আমাকে কিছু বলতেই দিচ্ছিস না।’

অন্যথা ঝাঁজিয়ে উঠল কথা শুনে,

‘সবসময় দেখি তুই ভুলভাল কথা বলে ভুলভাল যুক্তি দিয়ে তাকে প্রতিষ্ঠা করিস। তোকে কথা বলতে দেব কেন ? কুযুক্তি দিয়ে ভুলভাল শেখাবি বলে ?’

তাকে সমর্থন জানিয়েও কর্পুরাক্ত বলল,

‘আচ্ছা, থেমে যা না, দেখি ও কী বলে। কোন্ ঐতিহাসিক তথ্য সাজিয়ে বুদ্ধকে সমুদ্রযাত্রা করায় ! বলতে দে না।’

প্রস্তাবটা শুনে সবাই চুপ করলে পর উপলক্ষ বলার সুযোগ পেল। নিরুত্তাপ গলায় ধীরস্থির ভঙ্গিতে জানাল,

‘এতো উত্তেজনার কোন কারণই ছিল না। আমার বক্তব্যের মূল বিষয়টা তোদের আমি বোঝাতেই পারিনি। বুদ্ধ বা তাঁর ধর্মমত কি বিচ্ছিন্ন ? এককে বাদ দিয়ে অন্যটাকে ভাবা যায় ? আমি বুদ্ধদেব মানুষটাকে বোঝাতে চাইনি। তাহলেই দ্যাখ্ কোন সমস্যা নেই। বুদ্ধদেব না হলেও তাঁর প্রচারিত ধর্মমত সমুদ্র পাড়ি দিয়ে শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, চীন, জাপান, কোরিয়া সব জায়গায় পৌঁছে গেছে। নিয়ে গেছে কারা ? বৌদ্ধ ধর্মপ্রচারক অথবা তাঁর শিষ্যরা। একথা তো সর্বজনবিদিত যে গুরুশিষ্য ভিন্ন নয়। বহুল প্রচারিত একথা। তাহলে দ্যাখ্, তাঁর ধর্মমত ও শিষ্যদের সমুদ্র পাড়ি দেওয়াই কিন্তু বুদ্ধদেবেরও সমুদ্রদর্শন করা বা সমুদ্র পাড়ি দেওয়া বোঝায়। আসলে কী জানিস, অনেক বাস্তব সত্যকে আমরা জেনেও দেখতে ভুলে থাকি। আমরা অন্ধ থাকি বলেই অনেক জানা বিষয়কেও অস্বীকার করি।’ 

সবাই মিলে হৈ-হৈ করে উঠে জানাতে যাচ্ছিল যে এই যুক্তিটা হজম করতে কেউ প্রস্তুত নয়। একমাত্র সম্বোধন এতক্ষণ কিছু না বলে শুনছিল সব। সে আসলে ঝগড়াঝাটি করতে পারে না, চুপচাপই থাকতে চায়। তবে সে যখন কথা বলে তখন সবাই শুনতে বাধ্য হয়, এমনই তার ব্যক্তিত্ব বা কৃতিত্ব। এখনও সে সবাইকে ঝগড়া করতে না দিয়ে থামিয়ে দিল আর বলল,

‘এই সুন্দর পরিবেশটাকে কেন সবাই কোলাহলে ভরে দিচ্ছিস ? নিজের যুক্তি বা কথা শোনাতে কি তোদের মত এমন  চেঁচাতে হয় ? এতো উত্তপ্ত হওয়ার তো তেমন কোন কারণ দেখছি না। অন্তত এই সুন্দর জায়গাটার তো মর্যাদা দিবি ?’

তার কথা সবাইকে সত্যিই চুপ করাল আর সবাই বুঝল যে সত্যিই অতটা উত্তেজিত হয়ে পড়ার কোন কারণ নেই। আর যাই হোক, উপলক্ষ তাদের খুব প্রিয় বন্ধু। তার ওপর রাগ হলেও তাকে ছাড়া জমেও না আসর। তাছাড়া সত্যিই পরিবেশটা এখন অপরূপ। সৈকতে ছন্নছাড়া বিছিয়ে থাকা খণ্ডবিখণ্ড নানা আকার ও আকৃতির পাথরগুলিতে বিনম্র চাঁদের আলো খাপখোলা অবস্থায় লুটিয়ে পড়েছে, তাতেই উৎসব লেগেছে বালুকাময় প্রান্তরে আর সমুদ্রে। স্নেহাতুরতায় আচ্ছন্ন চতুর্দিক। সবাই তাই শান্তিপ্রস্তাবে সায় দিয়ে আপাতত উগ্রতা দমন করল। উষ্ণতা কমিয়ে ঝগড়া থামাল তারা। সম্বোধন তখন নিরীহ ভঙ্গিতে শোনাতে চাইল তার কথা,

‘এক অর্থে ভেবে দ্যাখ্, উপলক্ষ কিন্তু ভুল কিছু বলে নি। ওই যে বলে না ভণিতা, সাহিত্য কিন্তু ভণিতা বাদ দিয়ে হতে পারে না। যদিও ভণিতা প্রায় পুরোটাই অনর্থক। তবুও তাকে বর্জন করলে সাহিত্য বলে কিছুই থাকবে না। আর জীবন থেকে কি সাহিত্য বাদ দেওয়ার উপায় আছে ? তাহলে আর জীবনের কী পড়ে থাকল ? উপলক্ষের প্রশ্নটা আসলে সাহিত্যের ওই ভণিতার মত। এই ভণিতা বাদ দিয়ে যেমন সাহিত্য চলে না তেমনি জীবনও কিন্তু অচল। জীবন বলতে আমি মানুষের জীবনের কথাই বলতে চাইছি, সেটা নিশ্চয় বুঝতে পারছিস ? তবে কী জানিস, ভণিতা কিন্তু অন্য প্রাণিদের ক্ষেত্রেও জীবনযাপনের একটা বড় অঙ্গ। যে পাখিটা ওড়াউড়ি করছে সে কতটা সময় খাদ্যের সন্ধানে কাটায় ? তার ওইসব ওড়াউড়ি বা গান গাওয়া-গাওয়ির অনেকটাই ভণিতা মাত্র। রূঢ় বাস্তব বা সত্যিটা যার আড়ালে ঢাকা থাকে। পশুদের সঙ্গী বা সঙ্গিনী নির্বাচনের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটার বাস্তবতা বুঝতে পারবি। পাখিদের কথাই আবার ভাবা যাক। ময়ূর কেন পেখম তুলে নাচে ? কোকিল কেন সারা বসন্তকাল গান গেয়ে কাটায় ? সবইতো জীবনের ভণিতামাত্র। একে আমরা অস্বীকার করতে পারি না। হয়তো জড় পদার্থের বেলায়ও ব্যাপারটা কাজ করে। এই যে পাথরগুলি এভাবে এখানে পড়ে আছে কে বলবে এগুলি ভণিতা নয় ? তারা তো এখানে না থেকে স্বস্থানে পাহাড়ের গায়েও লেগে থাকতে পারত ? এ কি তাহলে প্রকৃতির ভণিতার প্রকাশ ? কে বলবে সেই কথা ? আসলে উপলক্ষের ওই কথাটা ভণিতামাত্র, কথার ফাঁক বা ভাঁজ। তাকে আবার পাত্তা না দিয়েও উপায় নেই যদিও তা তেমন ক্ষতিকর নয় মোটেই। তোদের অত রেগে যাওয়ারও কোন মানে হয় না। আর দ্যাখ্, জীবনে বা জগতে এমন বিষয় আছে যাকে আমরা যেভাবে দেখতে অভ্যস্ত তাকে অন্যভাবেও দেখা যায়। তখন সেই একই বস্তু হয়ে যাবে অন্যকিছু। যেভাবে আমরা সব জানি সেই জানাটাকেই চূড়ান্ত ভাবছিস কেন ? অন্য কেউ তার এমন সংজ্ঞা দিতে পারে যে তখন মনে হবে এই বিষয়টাকে কোনদিন জানতামই না। যেমন, নিউটন মহাবিশ্বকে যেভাবে জানার কথা বলেছিলেন সেই একই মহাবিশ্বকে আইনস্টাইন নতুন করে অন্যভাবে জানালেন। তখন আমরা ভাবলাম, এটা এতদিন জানতাম না। আবার এটাই যে চূড়ান্ত তাই বা ভাবছিস কেন ? আবার হয়তো দশ-বিশ-একশ বছর পর কেউ এসে এমন আবিষ্কার করে এমন সংজ্ঞা দেবে যে তখন সবাই ভাববে এই বিশ্বটাকে কোনকালেও জানতাম না। মজা দ্যাখ্, মহাবিশ্বটা কিন্তু নিউটন যা দেখেছিলেন আইনস্টাইনও তাই দেখেছেন, একই মোটামুটি অবিকল তার চেহারা-চরিত্র। কেবল পাল্টে গিয়েছিল দেখার চোখটা। নিউটন যে চোখে দেখেছিলেন সেটাকেই আইনস্টাইন দেখেছিলেন অন্য চোখে। দেখার বিষয়টা কিন্তু যেমন ছিল তেমনই আছে। কে কিভাবে দেখবে সেটাই বড় কথা। তেমনি যে ব্যাপারটাকে তোরা তোদের চোখে দেখছিস সেটা উপলক্ষ অন্য চোখে দেখার চেষ্টা করছে। তাতেই যত গণ্ডগোল। এতদিনের জানা বিষয়টা পাল্টে যেতে চাইছে আর তোরা সেটা মেনে নিতে পারছিস না। নতুন কোন পদ্ধতি বা আবিষ্কারের এটাই হচ্ছে বড় বিপদ। প্রথাগত দৃষ্টিভঙ্গিটা হঠাৎ পাল্টে যায় বলে লোকরা চট করে সেই জানাটাকে মেনে নিতে পারে না। সেই জানাটাকে মেনে নিতে সময় লাগে মানুষের।’ 

এতক্ষণ ধরে সবাই চুপচাপ শুনে গেল সম্বোধনের কথা। মানুক বা না মানুক, কেউ কোন প্রতিবাদ করল না। সে থামার পরও কোন সাড়াশব্দ এলো না কারো কাছ থেকে, বোধহয় সবাই কী বলবে বুঝে উঠতে পারছিল না। সেই অবকাশটাকে কাজে লাগিয়ে সম্বোধন আবার বলতে লাগল,

‘একটা কথা তোদের আমি শোনাতে চাই। কিন্তু বলতে ভয় পাচ্ছি, বলা ঠিক হবে কিনা ভেবে। বলি না কখনও পারতে, কারণ শুনলে কেউ নিশ্চয় বিশ্বাস করবে না। তবে পরিস্থিতি-পরিবেশ অনেক না-বলা কথা মানুষকে দিয়ে বলিয়ে নেয়। সেই রকমই অবস্থা এখন। তাছাড়া এটাও ভাবি, মনের কথা চিরদিন চেপে রাখা যায় না। কাউকে না কাউকে বলতেই হয়। আর তোদের ছাড়া কাকেই বা বলব ? তোরা আমার সবচেয়ে কাছের। যে সত্যিটা আমার মনে আছে তা একমাত্র তাদেরকেই বলা যায়। যাই হোক, বলছি। তোরা বিশ্বাস করবি কি করবি না সেটা তোদের ব্যাপার।’

বলতে বলতে একটু দম নেওয়ার জন্য থামল সম্বোধন। সবাই তাকিয়ে তার দিকে। চাঁদের আলোয় যতই আবছা হোক সবার উদগ্রীব মুখ দেখতে পাচ্ছিল সে। কেউ কিছু বলছিল না, শুনতে উন্মুখ তার কথা। তাই দেখে বুঝি সে সাহস সঞ্চয় করছিল। তারপর শান্তভাবে উচ্চারণ করতে লাগল,

‘পৃথিবীতে এমন কিছু বিষয় আছে যা আমরা জানি না। পৃথিবী বলতে আমি কিন্তু আমাদের বাসস্থান এই পৃথিবীটার কথাই বলছি। বিষয়গুলি জানি না তার মানে এই নয় যে সেগুলি নেই। আছে এই পৃথিবীতেই, কিন্তু এখন পর্যন্ত সেসব দৃষ্টিসীমা বা বোধগম্যতার বাইরে থেকে গেছে। আবার এই পৃথিবীতেই কিছু কিছু লোক আছে যাদের আমরা চিনি না।’

সম্বোধন থামল। নিভৃতি মুখ খুলতে গিয়ে ঠোঁট বেঁকাল, 

‘এ আর নতুন কথা কী ? রোজ পথেঘাটে হাজার হাজার লোক দেখি। তাদের ক’জনকে আমি চিনি ? বিশাল পৃথিবীর নানা প্রান্তে কত কত বিষয় আছে। সেগুলির সব জানা কার পক্ষে সম্ভব ? তুই যা বললি তা এমন কী আশ্চর্য ব্যাপার?’

সম্বোধন উসখুস করছিল। নিভৃতি চুপ করতেই সে তার কথা শুরু করল,

‘আসলে আমি অন্য কথা বোঝাতে চেয়েছি। যেসব লোককে চোখের সামনে দেখছি বা না দেখলেও জানি তারা কোন না কোন দেশে আছে, তাদের কথা বলছি না। আবার বিষয় বলতে ঘটনাকে বোঝাতে চাইছি। যেসব বিষয় বা ঘটনা সত্যিই পৃথিবীতে ঘটছে বা সত্যিসত্যি যার অস্তিত্ব রয়েছে সেসবও বোঝাতে চাইনি।’

তাকে প্রায় থামিয়ে দিয়ে প্রশ্ন তুলল অন্যথা,

‘তাহলে কী বোঝাতে চেয়েছিস ?’

নিজের ভিতরে থাকা কথাগুলি ব্যাখ্যা করতে চাইছিল সম্বোধন। গলায় তার নিশ্চয় অন্তরের সেই আকুল চেষ্টা প্রকাশ পাচ্ছিল বলেই কেউ বাধা দিল না তার কথা বলায়। 

‘আসলে আমি এমন বিষয়ের কথা বলছি যা আমার চোখের সামনে থাকলেও আমি দেখতে পারছি না। আবার আমার গায়ে গায়ে ছুঁয়ে রয়েছে এমন লোক অনেক আছে যাদের সম্পর্কেও আমার কোন বোধ বা ধারণা নেই। এইসব বিষয় বা ঘটনা এবং লোকগুলো নেই এমন হতে পারে না। ঘটনাগুলো ঘটছে কিন্তু আমি জানতে পারছি না। লোকগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছে, আমি দেখতে পাচ্ছি না। ঘটনা ঘটছে আমার নাগালে, লোকগুলোও থাকছে আমার যথেষ্ট কাছাকাছি, প্রায় আমার চোখের সামনেই।’

সম্বোধন থামল। কর্পুরাক্ত জানতে চাইল,

‘বুঝলাম। কিন্তু সেইসব বিষয় বা লোকগুলো থাকছে কোথায় ? কিভাবেই বা থাকছে ? তুই বললি, নাগালের মধ্যে বা চোখের সামনে। তবুও তাদের দেখতে পাচ্ছি না, তাদের সম্পর্কে জানতে পারছি না। এতই যখন তুই জানিস তো এটাও নিশ্চয় তোর জানা ? সেই বিষয় বা লোকগুলো অদৃশ্য হয়ে থাকছে ক্ষতি নেই, থাকুক। কিন্তু কোথায়, কিভাবে?’

প্রশ্নটা লম্বা। ধৈর্য না হারিয়ে শুনল সম্বোধন। শুনে জবাব দিল শান্তভাবে,

‘ আসলে এই পৃথিবীর মধ্যে রয়েছে একাধিক স্তর। তার একটি স্তরে আছি আমরা। যে স্তরে যে থাকে সে সেই স্তরটাকেই চেনে, তাকেই ভাবে পৃথিবী বলে। সে জানে না অন্য স্তরগুলোর কথা। সেইসব অন্য স্তরে কী আছে বা কারা আছে তার কথা ধারণাও করতে পারে না কোন একটি বিশেষ স্তরের বাসিন্দারা। সমস্ত স্তরেই কিন্তু মানুষ থাকে, কিন্তু এক স্তর থেকে অন্য স্তরে যেতে পারে না, জানতে পারে না অন্যান্য স্তরের কথা।’

সবাই কি স্তম্ভিত হল ? যাই হোক, অসহিষ্ণুতা দেখাচ্ছিল না। একসময় প্রযত্না কিছুটা মজার গলায় বন্ধুসুলভ মেজাজ প্রকাশ করে বলল,

‘নাঃ, তোর কল্পনাশক্তিকে বাহবা দিতেই হয়।’

‘এটা নিয়ে অনায়াসে একটা সায়েন্স ফিকশন লিখে ফেলতে পারিস। কল্পনাটা সত্যি অসাধারণ।’

বিবর্তন বলল হালকা সুরে। সম্বোধনের গলায় উত্তরে শোনা গেল আত্মবিশ্বাস,

‘কল্পনা নয়, বাস্তব। আমরা আমাদের স্তরে মানুষ হিসেবে যারা বসবাস করছি তাদের দেখার চোখ, শোনার ক্ষমতা, এমনকি বোধশক্তি বা কল্পনা করার দৌড়ও একটা নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত কর্মক্ষম। এই ক্ষমতা অন্য স্তরগুলোকে নিজেদের কথা জানাবার জন্য যথেষ্ট নয়। আমরা কেউ তাই জানি না ওই স্তরসমূহের ঘটনাবলী ও বাসিন্দাদের কথা। অথচ ওইসব স্তর আমাদের স্তরটার গায়ে গায়ে লেগে আছে, বাসিন্দাদের হাত দিয়ে ছোঁয়াও যেতে পারে। তবুও সেসব বোঝার বা জানার কোন উপায় নেই আমাদের কাছে।’

সম্বোধন চুপ করল। সে দেখে অবাক হয়ে গেল, বন্ধুরা তার কোন কথা ফেলে দিল না, প্রতিবাদও জানাল না। সবাই নিরুত্তর, কোন এক অন্যদিকে চোখ রেখে নিশ্চল। তারা কি তবে তার কথাগুলি বিশ্বাস করেছে ? নাকি ভাবছে ?

রাত্রির আকাশের প্রাঙ্গণে বুদ্ধপূর্ণিমার চাঁদটা এতক্ষণে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত, আরও বেশি উজ্জ্বল। সমুদ্রও কেমন যেন নির্বাক। সৈকতভূমিও নিথর। প্রকৃতিও বুঝি নিঃস্পন্দ। তার গোপন রহস্য সম্বোধন জেনে ফেলেছে বলে সে কি অবাক ? নাকি এরাও সবাই ভাবছে ? মনে হচ্ছে, ভাবছেই। হ্যাঁ, ভাবছে।  

(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *