অরিত্রী দে
সপ্তম পর্ব
জল-চক্র
জলই যে জীবন, তোতা-ইতিহাসের মত এ শিক্ষা কোন ছোটবেলা থেকে আমাদের মগজে ঢুকিয়ে দিয়েছে ইস্কুল। কিন্তু পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা ত নয় সে শিক্ষা, ফলে মাথা ধরে নাড়িয়ে দিলেও চৈতন্য হয়না। বাষ্পীভবন, ঘনীভবন ও অধঃক্ষেপণের মাধ্যমে ভূপৃষ্ঠ আর ঊর্ধ্বাকাশের মধ্যে আবর্তিত জলচক্রের ভৌগোলিক আর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা না হয় ছবি দিয়ে আঁকা থাকল বইয়ের পাতায়। তার গুরুত্ব জানার সঙ্গে সুস্থ নাগরিকের দায়দায়িত্বের সম্পর্কটা যে কোথায় তা বুঝতে মাথা চুলকোতে হয় বৈকি! ভারতীয় সংবিধানের একাদশতম তালিকায় ‘ফান্ডামেন্টাল ডিউটিজ’ এর এগারোটির মধ্যে অন্যতম হল বন, হ্রদ, নদী সহ প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা করা, তার স্বাস্থ্য বজায় রাখা এবং জীবিত প্রাণীর প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করা। অধিক কথনে বাচালের মাত্রাছাড়া হওয়ার আশঙ্কায় কেবল ‘জলজীবন’কেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু করা হল। তাই হাঁটি পা পা করে প্রথমে বুঝতে হবে জলকে ঘিরে যে জীবনচক্র চরকি পাক খাচ্ছে, তার কথা। একবিংশ শতাব্দীতে এসে আজ আমরা স্মৃতিচারণ করছি আমাদের ফেলে আসা জলজীবনের, তার মূল্যবোধের, বুঝতে পারছি গত কয়েক বছরে আমাদের জলচর্যার বদল ঘটেছে বিপুল। বুঝতে হবে গ্রাম ও শহরের জলজীবনকে, আসুন কান্ডজ্ঞানে ফিরি। প্রথমেই বলার যে শক্তি ও ধৈর্য্য স্বরূপিণী ধরিত্রীদেবীর চারটি প্রধান মন্ডলের (Sphere) বিন্যাস লক্ষ্য করার মত। ‘লিথোস্ফিয়ার’, ‘হাইড্রোস্ফিয়ার’, ‘বায়োস্ফিয়ার’ ও ‘এটমোস্ফিয়ার’ পর্যায়ক্রমে অবস্থান করে মাটির ওপর জল, জলের ওপর জীবমন্ডল এবং তার ঊর্ধ্বে বায়ুমন্ডলের সুষম বন্টন ঘটায়। জল ছাড়া গোটা প্রাণমন্ডলেরই (বায়োস্ফিয়ার) অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। ‘ভূ-পৃষ্ঠের তিনভাগ জল’ অর্থাৎ পঁচাত্তর শতাংশ জলভাগ। শিল্পের ও কৃষিকাজের প্রয়োজনীয় জল, পরিশ্রুত পানীয় জলের উৎস সমুদ্র, ছোট- বড় জলাশয়, হ্রদ, খাল-বিল, নদী-নালা। কিন্তু এই যে জল খরচ হচ্ছে, তবু তার সাম্রাজ্য শেষ হচ্ছেনা তার কারণ বারিচক্র (water cycle)। সূর্যের তাপে ভূ-পৃষ্ঠের জল (এমনকি প্রাণী শরীর থেকে নির্গত বর্জ্য জল) বাষ্পীভূত হয় এবং মেঘ থেকে বৃষ্টিপাতের মাধ্যমে পৃথিবীতে ফেরত আসে। কোথাও কোথাও তুষারপাত বা শিলাবৃষ্টির মধ্যে দিয়ে জল ফিরে আসে পৃথিবীর বুকে, ভরিয়ে তোলে আমাদের ব্যবহার উপযোগী জলের উৎস গুলিকে। প্রাকৃতিক নিয়মে ঐ জলের অণু ভেঙে (H₂O) অক্সিজেন আর হাইড্রোজেন পরমাণু অক্সিজেন চক্র ও হাইড্রোজেন চক্রে প্রবেশ করে অর্থাৎ অন্য কাজে যোগ দেয়। গাছ তার সালোকসংশ্লেষে জল বা জলীয় বাষ্পকে কাজে লাগিয়ে তার হাইড্রোজন থেকে গ্লুকোজ (C₆H₁₂O₆) তৈরি করে। অন্যদিকে জলের দুটি অণুর দুই পরমাণু অক্সিজেন মিলে একটি অক্সিজেন অণু (O2) গঠন করে, যা আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসে সাহায্য করে। পরবর্তীতে ঐ পরমাণুগুলিই আবার সমযোজী বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে জল তৈরি করে।
২
আধুনিকতা’র গোলকধাঁধায় আসার বহু আগে থেকেই খাল, বিল, নদীসহ অন্যান্য জলাশয় নির্মাণের মধ্যে দিয়ে সমাজ আর তার সদস্যদের যুগলবন্দী পথ চলা ছিল। বসত গড়ার জন্য প্রাথমিক শর্তই ছিল বসতিস্থলের সুরক্ষা, গাছের ছায়া আর জলের সুলভতা, তা সে দীঘি-পুকুরের হোক বা কুয়োর হোক। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যখনই মানুষ একের অধিক হয়ে সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে বাস করতে গেছে, প্রয়োজন অনুযায়ী গড়ে নিয়েছে তালাব (পুকুর), বেরি (ছোট কুয়ো), চৌকরি প্রভৃতি। পানীয় জলের জন্য, সেচের জলের জন্য, নিত্য ব্যবহারের জন্য তখন এলাকার জনসংখ্যা অনুযায়ী পুকুর কাটার রেওয়াজ ছিল। পুকুর কখনও প্রাকৃতিক কারণে তৈরি হত কখনও বা মানুষ তৈরি করত। এতে সাধারণ মানুষের লোকালয়ের দৈনন্দ্যিন কাজ মিটত। তবে পুকুরের বদ্ধ জল খানিকটা মজে যাওয়া ধরনের হয়ে যেত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে। অভিধানে পাচ্ছি ‘পনড’ (pond) বা ডোবা বলতে ‘a pool of stagnant water’। আবার দিঘি সাধারণত শাসকবর্গ দ্বারা খনিত হত সমাজের জন্য। তখন দীঘি-পুকুর কাটা ‘পুণ্য’ কাজের সঙ্গে জড়িত ছিল, রাজা-রানী-গৃহস্থ ‘মহাত্মা’র শিরোপা পেতেন লোকালয়ে এসব নির্মাণের জন্য। প্রতি গ্রামে নানা উপলক্ষ্যে ছোটো বড়ো প্রচুর দিঘি পুকুর কাটা হত। সরোবর অনেক বড় জলাশয়, একে সুদৃশ্য ভাবে বাঁধানো হত। আর বাংলায় হ্রদ বলতে আমরা সমুদ্র লগ্ন জলাশয় বুঝি। পাহাড় থেকে নিঃসৃত বৃহৎ প্রাকৃতিক জলাধার কেও ‘লেক’ বা হ্রদ বলি। অভিধান অনুযায়ী- a large body of water entirely surronded by land। তা সে জলের বহুধারার মত পুকুর, নাছপুকুর, সরোবর, দিঘি, তাল, বাঁধ, ডোবা, ঝিল, বিল, হ্রদ, গইড়া- প্রভৃতি বিভিন্ন রকম বা ফর্ম হলেও জলাশয় তো জলাশয়ই। ব্যবহারের ধরন অনুযায়ী পৃথক করা থাকত সেসব জলাশয়, যেমন গ্রামের মন্দিরটার জন্য আলাদা পুকুর (সংরক্ষিত পুকুর), বর্ধিষ্ণু পরিবারগুলোর খিড়কি দরজার কাছে রাখা হত নাছপুকুর আর তুলনায় সামান্য অবস্থার গৃহস্থের মেয়েদের আব্রু ছিল বাঁশঝাড় লাগোয়া ‘গড়্যা’ বা ডোবা। এখন ভূ-প্রকৃতি ও আবহাওয়ার বৈচিত্র্যে বিভিন্ন স্থানে জলপ্রবাহ ও জল ধরার কৌশল ভিন্ন ভিন্ন, ফলে জলজীবনের ধারাও পৃথক হয়ে যায়। যেমন ভারতবর্ষের পশ্চিমাঞ্চলে জলের অভাব সবচেয়ে বেশি। রাজস্থানের আরাবল্লি পার্বত্য অঞ্চলের গাছগাছালির জন্য বাতাসে যতটুকু ভাসমান জলীয় কণার পরিমাণ বাড়ে তার ফলস্বরূপ অল্প বৃষ্টিপাতেই আলোয়ার দিয়ে রূপারেল নদী প্রবাহিত হত। কিন্তু ক্রমে গাছশূন্য হওয়ায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য ভাবে কমে যায়, মাটির লেয়ার পাতলা হতে থাকে এবং কৃষিকাজ প্রায় বিলুপ্ত হয়। এলাকাবাসী জোহড় নির্মাণ করে এই সমস্যার সমাধান করল। যে অঞ্চল দিয়ে ঐ যৎসামান্য বৃষ্টির জল প্রবাহিত হয়ে যায় (আগোর), সেখানে পাথরের খন্ড সাজিয়ে সীমানা গেঁথে দেওয়া হল। তাতে যেমন পানীয় জল মিলল, তেমনি সেচের কাজে প্রয়োজন মত ব্যবহারও করা গেল। আর এক জায়গায় জল জমা থাকার ফলে সছিদ্র মাটি দিয়ে ভূমিগর্ভে জল সহজেই প্রবেশ করতে পারে, বাড়ে ভৌমজলস্তর। লোকালয়ের বহু পাতকুয়ো যেমন তাতে ভরে উঠল তেমন বহু শুকনো নদীও টলটলে জলে ভরে গেল। এছাড়াও আশেপাশের নরম ভিজে উর্বর মাটিতে সবুজ ঘাস আর গাছ জন্মাল। কোথাও কোথাও সামাজিকভাবে কুন্ড তৈরি করে নয়তো বাড়ির ছাদে টাঁকা তৈরি করে বৃষ্টির জল বা ‘পালরপানি’ ভরে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। ইঁট- ফৌগ কাঠ-বালি-খড়িয়া পাথর প্রভৃতি যখন যেখানে যা মেলে তাই দিয়ে সর্বজনীন কুন্ডি, তার ঢাকনা তৈরি হয়। সঙ্গে থাকে জল ওঠানোর জন্য প্রয়োজনীয় কপিকল। বাড়ির মেয়েরা ঘরে চৌকাবর্তন তৈরি করে জল সংরক্ষণ করে। ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চলের পূর্ব ঢালে অবস্থিত পুরুলিয়াতেও জল সংরক্ষণের চেষ্টা চালাতে হয়। ল্যাটেরাইটযুক্ত অনুর্বর মৃত্তিকা, ভূমি সিঁড়ির ধাপের মতো উঁচু নীচু অসমতল হওয়ায় বৃষ্টির জল জমবার এখানে সুযোগই পায় না। আবার ভূস্তর কঠিন শিলাযুক্ত হওয়ায় জল মাটির নীচে বেশি দূর চুঁইয়ে চুঁইয়ে ঢুকতেও পারে না। ফলে বৃষ্টিতে গড়িয়ে যাওয়া জলের পথে শুধুমাত্র একদিকে একটি পাড় বেঁধে দিয়ে পুকুর নির্মাণ করেই জল সংরক্ষণ করা যায়। বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বীরভূমের কাঁকুড়ে মাটি বেয়ে পরিষ্কার জল নীচে গড়িয়ে যেতে পারার পথ বন্ধ করে মাটি বেঁধে ‘বাঁধ’ (এই জলাশয়ের তিনদিক খোলা), জলাশয় বানিয়ে নেওয়া হয়। এই যে বাঁধ, কুন্ড, পুকুর, দিঘি, কুয়ো খোঁড়ার সবচেয়ে জরুরি তত্ত্ব-গ্রামের সাধারণ মানুষদের সেসব জানা ছিল।