শরদিন্দু সাহা
বাংলা কথা সাহিত্যের সুপরিচিত লেখক শরদিন্দু সাহা। লেখক সত্তা ও জীবনকে বিচ্ছিন্ন করে দেখতে তিনি অভ্যস্ত নন। নিছক লেখক হওয়ার জন্য তিনি কলম ধরেননি, সামাজিক দায়বদ্ধতাই তাঁকে সৃষ্টিকর্মে উদ্বুদ্ধ করে। শৈশব থেকে সৃষ্টিশীল মন লালন করে প্রস্তুতি পর্ব সারলেও নয়ের দশকের গোড়া থেকে তাঁর লেখালেখি শুরু। এ-পর্যন্ত শতাধিক গল্প, গোটা কয়েক উপন্যাস এবং অন্যান্য গদ্য মুদ্রিত হয়েছে। দশটি উপন্যাস আর সাতটি গল্পগ্রন্থ সহ মোট গ্রন্থের সংখ্যা ষোলো। ১৯৯৮ সালে ‘কাটোয়া মহকুমা গ্রন্থাগার পুরস্কার’ পান। ২০০৪ সালে ‘পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি প্রদত্ত সোমেন চন্দ পুরস্কার’ পান। ওই বছরেই কাটোয়া লিটল ম্যাগাজিন মেলা কর্তৃক সংবর্ধিত হন। ইন্ডিয়ান অয়েল কর্তৃপক্ষ তাঁকে ‘হল্ অব্ ফেম’-এ সম্মানিত করেন। ২০০৫ সালে ‘ভাষা শহিদ বরকত স্মরণ পুরস্কার’ পান। ২০০৭ সালে সাহিত্য আকাদেমি’র আমন্ত্রণে গৌহাটিতে বাংলা-অসমীয়া গল্পকার সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। ২০১৩ সালে ‘আমি’ পত্রিকা তাঁর সাহিত্যকর্মের জন্য বিশেষ সম্মান দেন। প্রসার ভারতী’র আমন্ত্রণে নানা সময়ে সাহিত্য-সংস্কৃতি অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহণ করেছেন। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, মিলিয়ে অনেক উল্লেখযোগ্য সাহিত্য পত্রে ও ওয়েব ম্যাগাজিনে লিখে চলেছেন। ইতিমধ্যেই নিজস্ব এক ঘরানা সৃষ্টি করে তিনি পাঠকের মন জয় করেছেন।
(নিত্য সমাজ সংসারের যে স্রোত আমরা চাক্ষুষ করছি তার অন্দরমহল জুড়ে ঘুমিয়ে রয়েছে কত তো কথাকাহিনী, যার পরতে পরতে তন্দ্রাচ্ছন্ন থাকে গোপনে কত তো নারীর জীবনযন্ত্রনা, ধারক বাহক হয়ে গোটা সমাজকে যাঁরা ছাতার মতো আগলে রেখেছে, নিজের পরিচয় খুঁজে নিয়েছে, সকল ঝড়ঝঞ্ঝা থেকে দিচ্ছে মুক্তি যুগ যুগ ধরে। কয়জনের কথাই বা আমরা মনে রাখি। তাঁদের গোপন ব্যথা, অনুচ্চারিত কথা গুমড়ে মরে যায়, চোখের জল কেউ মুছিয়ে দেয় না, গণ্ডীবদ্ধ শৃঙ্খলিত জীবনই তাঁদের বেঁচে থাকার একমাত্র ভরসা। এমনই এক সাধারণ গ্রাম্য নারীর কথকতা ও চেতনায় চেনা জীবন ও সমাজপিষ্ট অব্যক্ত যন্ত্রনার পাঁচালি ‘দেশের গর্ভে স্বদেশ’ উপন্যাস।)
দেশের কথার হিসাব রাখে কোন জনা
মনের দুঃখে হরান যায়, শুনতে রে মানা
দেশ তো ভাগ হইল, কতশত লোকের কপাল হুইরলো। কে যে কোনদিকে ছিটকাই গেল, কেউ কি তার হিসাব রাইখছে। বুক হাঁঢি গেছে, গুমরাই গুমরাই কাঁদি মইরছে। কেউ তো কারো মুখ দেয়ের না কমদিন তো হইল না। মাইনষের কথা না হয় বাদই দিলাম, গরু-গোতান, কুত্তা বেড়ালের চোখ দিই বাই বাই জল হড়ের অনও। টুকরা-টাকরা হই যাবার হড়েও যে আগুন জ্বইলছে দাও দাও করি, হেইঢা যেন টিম টিম করি জ্বলের, চোয়ে দেয়ের না কেউ সত্য কিন্তু আগুনের আঁচ তুন কারও কি রেহাই হাইব কোনোদিন। কেউ কেউ আনন্দে মজি আছে, মনের মতো দেশ হাইছে, কেউ কেউ যেন মনের দুঃখে চেঁচাই উঢের, এইঢা আবার একখান দেশ হইল। কথাখান তো ফেলাইনার নয়, অন্য জায়গা থুন কি আমাগো দেশ শাসন করা যায়, পাকিস্তানীরা হুকুম কইরব আর পূর্ববঙ্গীয়রা মাথা নত করি অক্ষরে অক্ষরে হুকুম তামিল কইরব, এইঢা কেমন করি হয়। এইসব হক্কল কথা আঁর কানে আইয়ের। হাওয়ায় ভাইসতে ভাইসতে চলি আয় নি। রসময় মাষ্টার ঘুইরতে ঘুইরতে যন আঙ্গ বাড়ি আয়ে, দেশগাঁয়ের খবর আনি আঁরে হুনাই যায়। হইলা হইলা আঁই গ্ৰাহ্য কইরতাম না, হরে হরে ভিতরে ভিতরে যন্তনা শুরু হইল। সত্যই তো এইঢা কেমন কথা? একে তো অত্ত বড় দেশ ভারত ভাগ হই গেল, আমরা এক কোনায় গালমন্দ হুনি হড়ি রইলাম, অন আর একটা দেশ আঙ্গরে শাসন কইরব, আঙ্গ উপর খবরদারি কইরব, এইঢা তো মানা যায় না। কিন্তু আঁই ঘরের বউ হই কিইবা কইরতাম হারি। তবে আন্দাজ কইরতাম হারিয়ের দেশের লোক মোঢেও চুপ করি থাইকত ন। এই প্রশ্নখান জাগে তো মনে, এত ঘটা করি দ্যাশভাগ হইল, দেশের গরীব মানুষগুনের একটুও তো উন্নতি হইল না, যেই তিমিরেই ছিল, হেই তিমিরেই হড়ি রইল।
গাঁ-গঞ্জের মানুষ কোনো কথা যে কয় না, যেমনে মুরুব্বীরা চালায়, তেমনি ওরা চলে, কথা কইবার কোনো জো আছে নি। কোন হতে যে হেথারা গেলে শোক দুঃখের জ্বালা জুড়াইত হাইরব কিছুই বুইঝত হারেন না। মন তো চায় একটা না একটা উপায় খুঁজি বাইর কইরতে। মাসির ছেলে মনোরঞ্জন আইছে বেড়াইতে। ও খালি দুঃখের নদীতে ভাসে। চালের মহাজনের গদিতে হিসাবের খাতা লেখে। ছুটিছাটা হায় না কিন্তু মন তো চায় পূজা-পাব্বনের দিনে আত্মীয় স্বজনের মুখ দেইখতে। আইতে যাইতে বড় দূর্গতি, রাস্তাঘাটের অবস্থাটা ভালা ন। খানাখন্দে ভরতি, গোড়ালি হমান কাদা, মাটি কামড়াই হড়ি থায় ইটের টুকরো টাকরা, হাড়ের তালুতে থাকি থাকি খোঁচা খায়। কয় ‘মাসি গো আমনেগো গ্ৰামের রাস্তাঘাট আঙ্গ গ্ৰামের মতোই, ইউনিয়ন বোর্ডের বাবুরা খালি হড়ি হড়ি ঘুমায়, মানুষ মরুক বাঁচুক হেথাগো কোনো মাথাব্যথা নাই। হক্কলে খালি বড় সাহেব-সুবোদের তাবেদারি করের, হায়ের উপর হুমড়ি খায় হড়ি থায়, বাঁ হাতের কাম কাজবার ছাড়া এক টেবিল তুন অন্য টেবিলে একখান হাইলও নড়ে না, বেশি কতা কইলে মুখ ঝামটা, সহ্য হয় না ইগাইন। এখন নাকি হেথাগো সময়, দিনেরে রাইত বানাই দের। কী আর কইয়ুম। আঙ্গ জমির তুন ফসল কাটি লই গেছে, কিছু কইতে গেলে ধমকাই ধমকাই তাড়াই মারে। দা কাস্তে লাঠি লই মাইরত আসে। দেশের অবস্থা খুবই খারাপ হই গেছে গো মাসি। কী কইরলে যে ভালা হইব কেউ জানে না। অন নাকি হেথাগো রাজত্বই চইলব। কানাকানি হানাহানি বাতাসে ভাসে। এটা গোঙানির হইত হারে, গুনগুনানিও হইত হারে। মধুর চাকের মতো মাইনষের মনের মধ্যে জমা হর। সুরটা উল্টাহাল্টা লাগের। রাগ হাঢি হড়ি কথাগাইন খইয়ের মতো হোঢের। মাইনষের দম বন্ধ হই আইলেও আছড়াই হইড়ব তুফানের মতো এইঢা আন্দাজ কইরতে বেশি সময় লাগের না। হথেঘাটে হাটেবাজারে রাস্তার মোড়ে মোড়ের ফিসফিসানি ছড়াই হড়ের আস্তে আস্তে ঘরে ঘরে। হেস্তনেস্ত তো কইরতেই হইব। এখন গোপন কথা হইল কিয়ের লাই? কাদের বিরুদ্ধে গোপন কথা? এর উত্তর খুঁজি হাওন কি দূর অস্ত! তাইলে কী হইছে! মাইনষের কথা কি আর থামে, দিনে দিনে বাড়ে। লোকে কয় ইসকুল কলেজেও ঢুকি গেছে।’ বড় দুঃখের দিন আইল রে মনোরঞ্জন। দেইখবি না কিছুদিন যাইতে না চাইতেই সব খাঁ খাঁ করি উইঠব। দেশ ভাগ হইবার সময়ই আঁই টের হাইছিলাম। বুইঝতে হাইরলাম হক্কল কিছুরই একটা জের আছে। এন্নে এন্নে ঘটনার জের হুরাই যায় না রে। এর হরেও মাইনষের মনের বোমা ফাইটবই ফাইটব। যন আঁই কইছিলাম কেউ বিশ্বাস করে ন, এবার বুঝি দেখ, মাইয়া মাইনষের কথা কেউ বিশ্বাস করে ন। এতগাইন ভাঙনের হর হক্কল কিছু এমন সরল হইত হারে, তোরাই কস না।
ঠিক কথা কইছস রে, ওদের ঘরের কান্দন, বাইরের কান্দন কন যে এক হই গেছে, কে কইব। এত তো কানাঘুষা, জীবন তো এক্কারেও হাল্টায়নি, তবে হক্কলে যে স্বাধীন দেশ, দেশ আঙ্গ স্বাধীন হইছে কই ঢাকঢোল হিঢায়, হের অর্থঢা কী হইল! নিজেদের লগে মারামারি ঝারাঝারি করি মরের। খাওনের লাই ঘরে ভাত নাই, কামকাজও তো তেমন আর নাই। কোন মুই গেলে শান্তি হাইব, হের উত্তর খুঁইজব কেমনে। দিন দিন অশান্তির কালা মেঘ চারদিক যে ঘিরি হালার, কেউ কি টের হান না, নাকি জানি হুনি বেবাক চুপ মারি আছে। কত কথাই তো হোনা যার, পাকিস্তানীরা বাঙ্গালীদের কব্জা করার লাই ফন্দি আঁঢের গোপনে গোপনে। তুই কি বেগ্গাইন হাঁচা কথা কসের? আচ্ছা আঁই রসময় মাষ্টারেরে জিগাইয়ুম। মাষ্টার ঠিক কথা কইব। দিন দুনিয়ার খবর হেথেনের নখদর্পণে। প্রশ্ন একখান মনে আর জাগে থাকি থাকি মানুষ আর আগের মতো নাই কেন? কনানে তো একটা ধাক্কা খার। স্বভাব চরিত্র আর মাইনষে মাইনষে বিশ্বাস তেমন আর নাই। আঁর কর্তা কয়, ‘বুইঝঝনি কোনো কিছু জোর জবরদস্তি চাপাইতে গেলে তার ফল ভালা হয় না, ভেতরে ভেতরে ভাঙন ধরে, ঝাঁঝরা করি দেয় একটু একটু করি। মানুষ বেবাক চোখ বন্ধ করি আছে। কোনো শোধবোধ নাই, কারে কখন কি দিব, দিলে কি দিব, অপাত্রে দান ছাড়া কি কইয়ুম।’ হেথেনের কথা আঁই যে বুঝি নাই, এমনটা না, তবে কিনা হক্কলটা বুইঝঝি এটা কইতাম হারি না। এই কথাখান কেন কইলাম জানেন নি, মাইনষের মুখ দেই আঁই চিনি হালাইতাম হারি কোনখান তুন আইছে, আর কনডাই যাইব। কদ্দিন হইল, আঙ্গ দেশগাঁয়ে এক গায়ক আইছে। আগে কনও দেই নি। হারমোনিয়াম কাঁধে ঝুলাই কত যে গান ধরে, মনের খুশিমতো গান বানায়, চট করি সুরও দেয়।
সময় গেলে রে ও মন সাধন হবে না।
দিন ধরিয়ে তিনের সাধন কেনে করলে না।।
জানো না মন খালে বিলে
মীন থাকে না জল শুকালে
কি হয় তারে বাঙ্গাল দিলে
শুকনো মোহনা।।
ওর পেছন পেছন ঘোরে কচি কচি হোলামাইয়ার দল। ওর গলায় গলা মিলাই এমন করি যেন কতকালের চেনা। অবাক তো লাগে, মনের ভেতর যাই ধাক্কা না লাইগলে এমন গানের জন্ম হইব ক্যামনে। কতজনের জিগাইলাম লোকটারে আগে দেইখছে নি। ঘাড়টা ডাইনে বাঁয়ে এমন করি নাড়ায়, কিছুই বোঝার উপায় নাই হাঁ কইছে কি না কইছে। লোকটারে আপন না কই হারিয়েন না, সুরের জাদু এমনি হয়, না হইলে এত জমাইত হারে নি। কথার পিঠে কথা রাখি মনের কথাখান কইত হারলে মানুষটা যেন হরান লই বাঁচে। মাইনষেরে হুনাইবার লাই ও কেন জানি এমন ভাব করে যেন রাজা বাদশাহর দরবারে বই দরদ দিই হুঢাই তুইলত চায়। হইলা হইলা বুইঝতাম হাইরতাম না। জনে জনে জিগাইতাম লোকটা কয় কিরে! হোলাপাইনরা সুরের তালে তাল মিলাই নাচে বটে কিন্তু কথার সার উদ্ধার কইরত হারে কিনা সন্দেহ। তবে কিনা শব্দগুলানের মাহাত্ম্য অস্বীকার কইরব কার এত বুকের পাটা। কোমর দুলাইতে দুলাইতে ও যখন সদর দরজা ছাড়ি উঠান হমান চলি আয়ে, শব্দগাইন স্পষ্ট হয় ক্রমশ ক্রমশ। কান পাতি তন হুনি থাকি।
‘দেশে অন আগুন লাইগছে,মানুষ গেছি ক্ষেপি রে।
ও পোলার দল, মা বোন ঝি, হুইনতে আছস রে।
দুঃখের কথা হোনামো কি, ভাবের ঘরে নেত্য করে আমরা সকল কলের পুতুল এ অধম সংসারে।’ বুঝি না তো, অনেক চেষ্টা তো কইরলাম। ও বাবাজি, একবার বুঝাই কন না, আমনে বড় পেঁচাই পেঁচাই কথা কন, সরল সাদাসিধা করি কন না। ‘এ-ও বোঝ না, ছারখার হই যাইব সব, তোমার কথা আর তোমার রইত ন, হুরাটা অন্যের হই যাইব।’ এই আবার কেমন করি সম্ভব! মাইনষের কথার মাঝে অমন পাল্টাপাল্টি হয় নাকি ! ‘ হয় গো হয়, মানুষ চাইলে কি না হয়। হক্কলটাই উপরওয়ালার ইচ্ছা। তিনি যে সকল চাওয়া পাওয়ার উপরে গো। তেনাকে ধরা কি তেমন সোজা কাজ! হুইনছ নি কথাখান –
উত্তুরের হাওয়া দক্ষিণে যায়, দক্ষিণের হাওয়া উত্তুরে, গাঙের পানিতে ছলাৎ ছলাৎ ধরা অধরার পানি রে।
এই পানি যে গভীর পানি হরান কাঁদে তল অতলে
মধুকর বাসা বাঁধে কোন ঠিকানায় কে আর জানে।
আবারও বাবাজি আড়াল করি কথা কইলেন। কথার মধ্যিখানে এমন ঘোমটা হরাইলে আমরা মুখ্যুসুখ্যু মাইনষেরা যাই কন্নাই কন দেখি। ‘এত শহর গ্যারাম ঘুরি মইরলাম, সোন্দর সোন্দর কথা হুইনলাম, সেই কথাগাইন তোমাদের হোনাই হরান ভরি, ভাবের ঘরে কেমনে করি চুরি।’ আরে আঁর হইছে তের জ্বালা মানুষটার রকমসকম কিছুই ধইরতাম হারি না! যে করি হোক বুইঝত আঁরে হইবই। ‘অত বুঝে কাম নাই, ঘরে চল জেঠি, বেলা হই গেল যে।’ রত্না ডাকে বুঝি। কিন্তু মানুষটারে তো অমনি অমনি ছাড়ি দেওন যায় না। থালায় করি মুড়ি-খই-খেজুরে গুড় দি দেখি। কত দূর তুন আইছেন বাবাজি, আগে হেট ভরি খান, হরে কথা হইব। একখান হিড়িও দিছ, এক গ্লাস জলও দিছ, আরাম করি বই খাইব।
কোনটা সত্যি, কোনটা মিথ্যা কে কইব। যিয়ান ঘটছে, ঘইটতে দাও, এইঢাই নাকি নিয়ম। আঁর কাছে কত আশা ভরসা লই মাইনষে আসে, হেথাগো মনে ভারি দুঃখ, হক্কল আশা ভরসার হইছে জলাঞ্জলি। একদিন কই হালাই তোঙ্গ মনে সুখ নাই বুঝি। ‘সুখ আর কনডাই দেইখলেন কাকিমা ? আঙ্গ কপাল হোড়া, গতর খাটাই খাই কিন্তু কেউ গতরের দাম দিল না। আশা ছিল মনে মনে দিন দুনিয়া হালটি যাইব একদিন, খড়ের চালে টিনের চাল হইব, হেঢে ভাত জুইটব, কনডাই কি, কেউ খবরও লয় না।’ হুইনলাম তোমাগো হোলাদের শহরে হাডাইবা। ‘ হুইনছেন তো ভালা, তেমন সুযোগ মিলে কই। যাক শেষমেশ ঠিক কইরলাম চাষীর বেটা চাষই করুক। লাঙ্গল উডাই দিলাম কাঁধে। হালের গরু লই মাঠে যায়। মাথার ঘাম পায়ে ফেলি যতটা কামাইত হারে।’ জানি গো জানি, তোঙ্গ আর তেমন রোজগারপাতি নাই। খালবিলে আর তেমন জাল ফেলি মাছও উডে না। হইব কনতুন, এক জলে হক্কলে মিলে কাড়াকাড়ি কইরলে হইব কেমনে! মাছ তো আর ঝাঁকে ঝাঁকে আই জালে ধরা দের না। একটা জিনিষ খেয়াল কইরছনি আসমত মিঞা আঙ্গ গ্ৰামের লোকসংখ্যা কত বাড়ি গেছে দিনে দিনে। খেয়াল করি দেইখছনি হেইঢা। ‘ভাবি তো কুল হাই না, কেমনে কেমনে হই গেল, কন চাই।’ ওরা চোখের জল এক কইরত হারে না। কারে যে দোষারোপ করুম। রোগের চিকিৎসা নাই, হরনে কাপর নাই। পুরুষ মাইনষে না হয় ছেঁড়াছুঁড়া হইরলে চলি যায়, মাইয়া মাইনষের কি আর চলে? ইজ্জত বলি তো একটা কথা আছে। ছেঁড়া জামা গায়ে দেই ধোপাবাড়ির মেঝ বউরে ডাকি কইলাম, এরম উদোম গায়ে কেউ বাড়ি বাড়ি ঘুরি কাপড় নিত আসে? কি আর করি, একটা হুরান জামা হাতে দিলে খুশি হই নমষ্কার করে। ওঁর নমষ্কারের ধরন দেই কত ভাবনা আই জাপটাই ধরে।
আঙ্গ উঠানে চড়াই শালিক, কাক আসি ভিড় জমায়। লাফাই লাফাই খুঁঢি খুঁঢি ধান খায়। তাড়াই দিলে হুশ করি চলি তাই বেহায়ার মতো আবার উড়ি আঁই চড়িবড়ি খাইতে থাকে। মাইনষেও ক্ষুধার জ্বালায় কেমন যেন হই গেছে, হাত জোড় করি দাঁড়াই থায়। এইটা কী আঙ্গ দেশ! কে বানাইল এমন দেশ? কে কইছে এমন দেশ বানাইতে? হুদা হুদা এত লোক হরান দিল, ভাইবলে হরানঢা আঁর হাঁঢি যায়। খালি মনে হয় কারা যেন জোর করি আঙ্গ উপর কত কিছু জোর করি চাপাই দের। এমন কেউ কি নাই জিগাই তোমরা কারা গো? আঙ্গরে চেন না আঙ্গরে জান যে খবরদারি কর। দেশের ভেতরের পয়সাওয়ালারা গরীবগুরবোদের ঠিকঠাক চেনে না। বুঝেও না কেমনে ওদের দিন কাটে, কি ওরা ভাবে, কেমন করে কথা কয়, খালি উপর উপর ভাব ভালোবাসা, দরদ তো নয়, মরা কাঁদুনি। কিয়ের লাই যেন মনে হয় দেশটা আর একবার স্বাধীন হইতে পাইরলে ভালো হইত। আঁর স্বামীরে যন জিগাই, এত তো আমনেগো শহুরে বাবুরা গরীব মানুষদের দুঃখ শোকের কথা লই গলা ফাঢাই হালায় এমন করি যেন জীবন দিই দিব, হাঁচা কথা কন তো, মন তুন কি চায়, নাকি সব লোকেরে দেখায় কত চোখের জল ঝরার, আসলে মনে মনে চায় হেথারা আজীবন ওনাগো পায়ের নিচে হড়ি থাক। কথাটা হুনি আঁর স্বামী চুপ মারি থায়, মুখ দিই কোনো কথা সরে না। ক্ষাণিকক্ষণ বাদে টনক নইড়লে কয়, ‘এমন করি ভাবি তো দেই ন। হক্কল কিছু তাইলে উপর উপর দেখছে এতটাকাল। কথাটা তুঁই মন্দ কও নি। ঘরের ভেতরে ঢুকি দেইখতে হইব, খালি মাঠেঘাটে দেইখলে হইত ন। দেইখতে হইব ওরা কেন্নে হোয়, কেন্নে উঢি বয়, কেন্নে হাসে, কেন্নে কাঁদে, কেন্নে হোলামাইয়ারে ধমকায়, আদর করে, কেন্নে জ্যান্ত থাকে, কেন্নে মরে, কেন্নে খায় দায়, কেন্নে দিনমানে ঘুরি ঘুরি দুয়ারে দুয়ারে ভিক্ষা করি হেরে, কতটা চোয়ের জল হালায়, কতটা রক্ত ঝরায়, গায়ে কতডা মাডি মায়ের, কত পথ হাডি হাডি মরে, কতটা সুখ দুঃখরে লই ঘর করে।’ আঁর কি মনে হয় জানেন, আমরা ওগো অন্তরের ভেতরের কথাগাইন আগে জাইনত হইব, বুকে হাত রাই কইত হইব তোমরা আঙ্গ মানুষ তাইলে না অন্যরে চোখে আঙুল দেখাই কইতে হারুম, পশ্চিমারা আঙ্গ লোকদের কতটা দেইখছে, আর কতটা দেইখছে না, তার আগে যত কথা কইনা কেন, বেগ্গাইন হুদা। ওরা খালি ভেটকাই থাইকব।
আইজ হক্কাল তুন দেইখছি, কত পাখি বাতাসে ঘুরি ঘুরি মরে। এমন আজব কান্ডকারখানা কোনো দেই ন। পাখিরা এডাল তুন ওডালে যায়, কিচিরমিচির তো করে কিন্তু দুই একটা পাখি আমনে আমনে চক্কর খাই মাটিতে হড়ি যায়, আবার টুকুস করি মরিও যায়। এই দেই, এই নাই, আরে মরার আগেও তো জানান দন লাগে, এই কথাটা ভুলি গেলি চইলব কেমন করে! দুনিয়াশুদ্ধ হক্কল কিছু ঘটনা ঘইটবার আগে চারদিকটা কেমন হালটি খায় না, খায় তো ঠিকই, হেইঢা কেন হয় কারণটা খুঁজি বার কইরত হইব তো। আঙ্গ বাড়ির কুচোকাচারা মরার আগে হাখির ঠোঁটে আঁজলা ভরি জল দেয়, ওরা গিলতে গিলতেই ঢলি হড়ি যায়। কেমন আশ্চার্য লাগে। কার পাপে এমনটা ঘইটতে লেগেছে। কার আবার, মানুষ ছাড়া আবার কার। এই পাপের বোঝা কদ্দিন বয়ে বেড়াবে, আজ না হয় কাল, গায়ে তো লাগবেই। চুপিসারে লাগে না হয় ঝামটা মারি আয়ে। যার দেখা সেই দেখে, বাকিরা চোখ বন্ধ করি রায়। হৈ হট্টোগোলে হুরা গ্ৰাম যেন কলকলাই উঢে। কীসের টানে বুঝি উঠতি গেলে সময় লাগি যায়। রাজ্য কাবার হয়। কে কার কথা হোনে। হোনার ইচ্ছা থাইকলে তো হুইনব, বোঝার ইচ্ছা থাইকলে তো বুইঝব। হক্কলে ঘুরি ঘুরি মরে। কী হইছে, কী হইছে কই চিল্লায় মরে। এই হাঁকে ইসকুলের হোলারা যার যার মতো করি মনের কথা কয়। যিগাইন হুনি আইছে উগরাই দেয়। ওরা জানেও না কারে কী কইব, হুধু জানে কিছু একটা কইত হইব। ঘরবার ছানাছানি করে। বুজুর্গরা কথা চালাচালি করে। আকাশের মাঝামাঝি বৈশাখের দুপরে সূর্যের আলো মাঝ আকাশে লাফালাফি করি সটান আই হড়ে মাথার উপর। ঘামি নাই ওদের যে কী দশা ওরাই জানে। জোরে জোরে গা চুলকায়। মুয়ে ওদের একটাই বুলি ‘উর্দু’ । কচি ঠোঁটের নাড়ানাড়িতে কত কিসিমের যে শব্দ বার হই আইয়ে, অর্ধেক বোঝা যায়, আর বাকিটা বাতাসের ধাক্কায় নানারকমের উচ্চারণে কানের কাছে আই থামি থায়। হোনা যায় ‘উট’ ‘উবু’ ‘উদু’ ‘উদ’ ‘উদক’ আরও কত কী।
হুরা ব্যাপারটা যে এমন করি উথলাই উইঠব কে জাইনত। কারও বুঝি ওঠার আগেই শুরু হই গেল কানাকানি বলাবলি। কী কইত আছে বেগ্গুনে মিলি তাইলে এমন একখান দেশ হাই কি লোমের লাভ হইল, আঙ্গ মুয়ের ভাষা কাড়ি লইত চায়, এঢা কেমন মতলব, এইঢা তো ভালা কথা নয়। আঙ্গ হাশের বাড়ির রমেন, মোল্লা হাড়ার রহমত, বেল্লাল, যুগি হাড়ার রতন, সতীশরা, শীল হাড়ার অনন্তদের মুখ ভার। হেগুনে হক্কলে হাই ইসকুলে হড়ে। হোলাগুনের তেজ আছে – ‘ কচাইন এদ্দিন ধরি আমরা যে ভাষায় জন্মের তুন কথা কই আইছি, অন পশ্চিমারা আঙ্গ উপর চাপাইতে চায়, বেগ্গাইন হেথাগো সুবিধার লাই, ইয়ান কি আমরা বুঝি না। আমরা যাতে নিজের মারে ভুলি হেথাগো মারে মা ডাকি, আচ্ছা তোরা কস না, রমেন রাগে হোঁসে, এইটা কনও সম্ভব, একটা প্রতিবাদ কইরত হইব। আঙ্গ দেশের একদল লোক নাকি খুশি, হেথাগো মান ইজ্জত বলি কিছু আছে? ওগো কথাবার্তা হুনি আঁর চক্ষু তো চড়কগাছ। গ্ৰামের মধ্যে থাই এতগাইন শিখল ক্যামনে। ওরা তালগাছের নীচে বই গপ্প মারে, দেশের খবরও রায়, ভাবি তো অবাক হই যাই। আঁরে দেই ছুঁঢি আইয়ে কয় ‘হুইনছেন নি জেঠি দ্যাশের অবস্থা দিন কে দিন খারাপের দিকে যার।’ তোরা কিয়রছের ওই কাগজের টুকরাখান লই। পাকিস্তানী সরকারেরে হুঁশিয়ারি দিতে আছি জোর করে উর্দু চাপাইত চাইলে আমরা ছাড়ি কথা কইতানন। দ্যাশের নেতারাও ক্ষেপি গেছে এর একটি বিহিত করি ছাইড়ব। দেইখছনা আমরা হক্কলে কালা ব্যাজ হইরছি। ভাষা আন্দোলনের নেতারা কইছে হুরা দ্যাশে মিটিং মিছিল সভা হইব। কাল ইস্কুলে তুন শুরু হই এক মাইল ধরি প্রভাতফেরী হইব।’ তোগো কি মাথা খারাপ হই গেছে? হেগুনেরে চোয়েমুয়ে আঁই আগুন দেখছি। না জানি কী দশা হয়! টগবগ করি হুঢের কড়াইতে গরম জল তেমন হুঢে। ওরা চলি গেলে এক দল লোক আসি হুমকি দিই যায়। ‘গ্ৰামের হোলাদের সামলাই রাখবেন যেন বাংলা বাংলা করি না চিল্লাই।’ এমা এরা কী কর, হুমকি দিই গেল নি।’ আঁর দেয়রের হোলা কয়, ‘অত ঘাবরাইতে আছেন ক্যান জেঠি, এরা কিচ্ছু কইরতে হাইরত ন, হাওয়া অন উল্টি গেছে, বাজার গরম। জাহিদ আলীদের ধানের গদিতে খবরের কাগজে দেইখলাম লিখছে ‘ আরবি অক্ষরে বাংলা হড়াইতে চাইলে আগুন জ্বইলব হুরা দ্যাশে।’ এই দ্যাশে আর কোনদিন শান্তি আইত না রে। আমরা কনডাই যাই যে মাথা গুজুম কইতি হারস নি।
কারে যে কী কইয়ুম বুঝি উইঠতাম হারি না। আর একটা গণ্ডগোল লাইগল বলি। হুইনতে আছি ধরি ধরি তাজা তাজা হোলাদের জেলে ঢুকাইদের। এমন করি যদি উর্দু চাপায় শিক্ষিত হোলারা করি কম্মই খাইব। শেষে মূর্খ হই মাঠে নামি হালচাষ কইরব, ব্যবসাপাতি করি খাইবই বা ক্যামনে। হইড়বই বা ক্যামনে, ইস্কুলে মাষ্টারিই বা কইরব ক্যামনে। হেগুনে তো কোনদিন উর্দু হড়ে নি। পূর্ব বাংলায় বাংলা হইড়ত হাইরত ন, এই আবার ক্যামন কথা। পাকিস্তানী সরকারেরে কী এককারেই মাথা খারাপ হই গেছে। শেষমেশ দ্যাশটা ভাগ হই এই হাল হইছে। আঁর যদি ক্ষমতা থাইকত হেথাগোরে কানে ধরি কইতাম আমনেগো একটুও আক্কেল নাই আঙ্গ দ্যাশের এমন সব্বনাশ কইরতে আছেন। এত লোভ কীয়ের লাই, আমনেগো দ্যাশে কী চাইল ডাইলের টান হইড়ছে। আঙ্গ ভাষা ভিন্ন, রং-ঢং ভিন্ন, রহন-সহন ভিন্ন, মানুষগুন ভিন্ন, দুই হাজার মাইল দূরে থাই আমরা, আঙ্গরে আঙ্গ মতো থাইকতে দিন না। ‘হেথাগরে তো চিনেন না জেঠি, এক একটা রাইক্ষস, ধইরত হাইরলে খামচাই দিব।’ মাইনষে আবার ক্যামনে এমন হয়, হাঁচা কথা কচের তো? ‘ আঁই কই আমনের লগে রসিকতা কইরতে আছি। আঁই তো আমনেরে কম কইছি, ওরা হারে না এমন কিছু নাই, ঘরের বউঝিদের ইজ্জত লই টানাটানি করে সুযোগ হাইলে। হেথাগো চর ঘুরি বেড়ায় আঙ্গ দ্যাশে, হেইঢা জানেন। হেথারা বেক খবর লই ওই দ্যাশের সাহেবদের কানে তোলে। হেথাগো লাজশরম নেই গো জেঠি, না হলে আঙ্গ দ্যাশের এই হাল করে।’
চিন্তায় চিন্তায় মরি যাই। আঁধার নাইমছে চারধারে। এক একদিন একটা খবর আই পৌঁছাইতে আছে গ্ৰামে । হোলাগুনের মুয়ের দিকে চাওন যায় না। চোখমুখ হুকনা হই গেছে, খালি গজগজ করে। কে যে জবাব দিব? দ্যাশটা যে কোনদিকে যাইতে আছে বুইঝতাম হারি না। উঠানে হাইঙ্গল গাছের হাতা ছড়াই ছিঢাই আছে, হরিষ্কার না কইরলে নয়। একশরও বেশি গলার আবাজ কত দূর তুন মাঠ টপকাই গাছ-গাছালিতে ধাক্কা খাই ঘরে ঢুকার লাই হাঁকপাক করের। এমন গলার ঝাঁজ আঙ্গ গ্ৰামের হথে কোনো হুনি ন। ঝগড়াঝাঁটি কোন্দল নাই এই কথা ক্যামনে কই। অভাবের সংসার ঘরে ঘরে। দিনে আনে দিন খায়। জমি বিবাদ লই কোপাকুপি হয় দিন-দুপরে। কারোগে কিছু কওয়ার নাই। হিগাইন লই মামলা মোকদ্দমা চইলছে তো চইলছে। মুসাবিদা করার লাই
আঁর কর্তারে আই হাতেপায়ে ধরে। রক্তারক্তি মাথা ফাঢাফাঢি হইলে হোমিওপ্যাথি ঔষধের লাই আঁর ঘরের দুয়ারে আই মাথা খোঁড়ে। গালমন্দও করি – খুনোখুনি করার সময় মনে থায় না। এইসব তো নিত্যি কাণ্ড। যবে তুন বউ হই আইছি এমন কান্ডকারখানা সহ্য করি আইছি। এইসব দেই দেই দিন গুজরান হয়। ভালা কিছু নাই হেইঢা ক্যামনে কই। হরের বিপদে আবার হাত লাগাইবার লাই ছুঢিও আইয়ে। জান হরান দিই দেয়, চোয়ের জল হালাইতে হালাইতে ভিডা ছাড়ে। কিন্তু আইজ্জার কথাগাইন যেন অন্যরকম লাগে। মাথা চাটি হালার। কথার ভাইল নিজের জন্য নয়, দলাদলি হইলে যেমনটা লাগে তেমনটা নয়, এমন কথার ভাঁজ জম্মে হুনিনি। কিন্তু সেই কথাগাইন হুনিয়ের আরও বেশি করি হুইনবার লাই কান হাতার ইচ্ছা হয়।
‘আঙ্গ নেতারা দের ডাক। ঝাঁপাই হড়ুম হরান যাক। আঙ্গ ভাষা বাংলা ভাষা। হরানের ভাষা, মার ভাষা। হরের ভাষারে কবর দাও, নিজের ভাষা হিরি হাও।’ এই আকবর এই মন্টু ইস্কুলের হোলারা দলবাঁধি কন্নাই যাওনের লাই এত হায় হুতাশ করের। ‘দেইখছনি জেঠি এত খবর রায়, ইয়ান ক্যামনে ভুলি গেছে। ওরা দ্যাশ বাঁচাবার লাই, ভাষা রক্ষার লাই গ্ৰামে গ্ৰামে মিছিল করের, শহরে যাইব চার গ্ৰামের লোক জড় হই। প্রতিবাদ সভা হইব।’ বুইঝলাইম তোদের কথা। একখান কথা কই, ঢাল তলোয়ার ছাড়া হক্কলে মারা হইড়ব যে, এইঢা কী খেয়াল কইরছস। হমানে হমানে লড়ালড়ি হইলে না টক্কর দেওন যায়, না হইলে মাঝপথে উল্টাই হড়ি যাইব যে। ‘ওরা কত মাইরব মারুক, রুখি ওরা দাঁড়াবই। দেইখছেন না, রাগে ওরা ফুঁইসছে। বেশি কথা কইত আইলে নাকি হেথাগরে দেশ ছাড়া করি ছাইড়ব।’ এই কি দশা রে, এই যে দেইখছি কাতারে কাতারে লোক আইয়ের। হেগুনের কামকাজ নাই, খাওন যোগাইব কারা। চাষাভুষা হক্কলে তো যোগ দের। বুইঝাইতে চায় এই একখান ব্যাপারে ওরা এক, পাকিস্তান যত চেষ্টা করুক আঙ্গ দ্যাশের মাইনষেরে দাস বানাইত হাইরত ন। হুইনতে তো আছি ওরা আঙ্গরে হিরি হরাধীন করার চাল চালের।
দেইখতে দেইখতে মিছিলটা আঁর চোয়ের সামনে লম্বা হই গেছে। এত লম্বা হই গেছে আঁর নজর যায় হৌঁছেন। যত দূর চোখ যায় মানুষ আর মানুষ, হামনেও কিছু দেয়া যায় না, হেছনেও কিছু দেয়া যায় না যেন একখান নদী ঢেউয়ের তালে তালে নিজের মনে চলি যার, নিজেও জানে না কনডাই যাই ঠেইকব। ওরা এক শহর তুন আর এক শহরে যাইব, হেই শহরের মাইনষের লগে মিশি যাইব, তারপরে যা হইব, মাইনষের সমুদ্র, পাকিস্তানের রাজা উজিরদের বাপের সাধ্য আছে নি এমন মাইনষেদের মুয়ে তালা লাগাইত হারে। খালি খালি মনে হর কদ্দিন ধরি আঙ্গ দ্যাশে কী অলক্ষ্মী ঢুইকছে, না হইলে এমন আগুন জ্বইলব কিয়ের লাই। ওই ব্যাটাদের আর কি কোনো কাম নাই আঙ্গ দ্যাশের দিকে কুনজর দিত লাইগছে। জানি না আঙ্গ কোয়ালে আর কি কি লেয়া আছে। বেগ্গাইন তো ভাঙ্গিচুরি একসার হই যার। একে তো গরীব মাইনষের হেঢে ভাত নাই অন যদি মুয়ের ভাষাখানও কাড়ি লই যায়, তন কওন চাই কী দশা হইব। হুইনছি দুঃখের খালি জ্বালাই হয়, হেইঢার কোন চেহারা সুরত হয় না, খালি মুয়ের কথায় হাউমাউ করি ঘরবার করে। তারা সান্ত্বনা দিত বলি হাজির হয়, গায় মাথায় হাত বুলাই দেয়, কথার হিঢে কথা বয়ায়। অন্তরের ভাষায় হাসন কাঁদন যায় নি। রাগে হরীল হাডে। মাইয়ালোকের যদি রাস্তায় নাইমবার সুযোগ হইত, গ্ৰামের মাইয়াগুনরে লই আঁই রাস্তায় নামি দ্যাশের নেতাদেরে কইতাম আঙ্গরে আমনেগো হঙ্গে লন। আঁর মাইয়া তো কই ফালাইছে – মা তাইলে আঁইও আমনেদের লগে যামু। কী হইব মা উর্দু চাপাইলে আঁই হড়ালেখা করুম ক্যামনে। আঁর স্বামী কয়, ‘তুঁই তো খালি ভাষা দেইখছ, যত দিন যাইব, বেটারা আরও কত জিনিস যে কব্জা কইরব তার কোনও ঠিকানা আছে নি। কত কথাই তো কানে আইয়ের ওরা দিনে দিনে হেথাগো দ্যাশের আইন কানুন আঙ্গ দ্যাশে লাগু কইরব। হিয়ের লাই যেমন করি হোক, ভাষা লাগু করার আগে আটকাইতেই হইব, আদালতেও ভাষা লই তর্ক বিতর্ক চলের।’ মাইয়াঢার আঁর এত হড়ালেখার শখ, কেন্নে রে হেথিরে বুঝাইয়ুম। ‘আরে এত চিন্তা কর ক্যান, চাইলেই হই গেলনি, দ্যাশের এত মাইনষে বাংলা ভাষায় কথা কয়, পূর্ব বাংলার মানুষ আমরা, রাতারাতি বেবাক হাল্টি যাইব, ব্যাপারখানা এত সহজ হইত না, তুঁই দেই রাইও। আঁর কথাখান মিলাই লইও।’
হুইনছেননি, ওই যে চুনির বাপদের ঘরের হাশে নাইরকল গাছের কোটরে বই লক্ষ্মী প্যাঁচাটা ডাইকত না, এখন আর ডাইকতে হুনি না। পাখিটা বাড়ি ছাড়ি চলি গেল নাকি। ‘আরে কনডাই আর যাইব, অন্য কোনো বাড়ির গাছে চলি গেছে।’ আমনে আঁর কথাটার আমল দেনের না কিন্তু এত বছরের পাখি, লক্ষ্মী প্যাঁচা বলে কথা। আঁর হৌরি কয় এই পাখিটা বড় পয়া, লক্ষ্মীর বাহন, আঙ্গরে ছাড়ি চলি গেল। আই আগেও দেইখছি কোনো খারাপ সময় আইলে ও হলাই যায়। আঁর মনের ভিতরে দুশ্চিন্তা হর। কিছু একটা অমঙ্গল তো ঘইটব, আমনে চাই রাইয়েন। হক্কল কিছু কথায় কথায় কুসংস্কার বলি উড়াই দিলে চলে না। হেইবার মনে নাই আঙ্গ গরুর বাচ্চাটা মরি যাইবার আগে পাখিটা ডাকা বন্ধ করি দিল। আর একবার ফুলির বিয়াটা ভাঙ্গি গেল যন তার আগেই ও উড়ি চলি গেল আঁই নিজের চোয়ে দেইখছি। ইগাইন তুচ্ছ ঘটনা নয়। অস্বীকার কইরলে তো ঈশ্বরেও বিশ্বাস করি আর লাভ নাই, কাইল তুন হূজা আচ্চা বেবাক বন্ধ করি দিই কি কন। হেথেনে আঁর কথা হুনি চুপ করি থায়। মনের মধ্যে আঁর খচখচানি রই যায় – কিছু একখান বিপদ বুঝি আইয়ের। হৌরি বিছানার তুন ডাক দেয় ও খোকার মা, চা চাই কুকুরটা আবার অসময়ে কিয়ের লাই মরা কান্না কাঁদের। কুকুরের কাঁদনে আঁর ডর লাগে, ওরে চুপ কইরত ক।
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)