তুষার বরণ হালদার
লেখক পরিচিতি
(তুষার বরণ হালদার নদীয়ার আড়ংঘাটা গ্রাম থেকে স্কুল শিক্ষা শেষ করে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করেন। পি.এইচ.ডি. ডিগ্রি পান নদীয়া জেলার অসংগঠিত শিল্প ও শ্রমিকদের ওপর গবেষণা করে । গবেষণা কর্মের ওপর ভিত্তি করে দুটি বই এবং বিভিন্ন গ্রন্থ ও জার্নালে বহু প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদ কর্তৃক প্রদত্ত শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধের জন্য তিন বার পুরস্কৃত হন। এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য। বর্তমানে তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত দক্ষিণবঙ্গের একটি কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপক।)
প্রথম বাঙ্গালী মহিলা ডাক্তার কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়
যে বছর রবীন্দ্রনাথ জন্মেছিলেন সেই বছরেই ১৮৬১ তে ৮ ই মে জন্মেছিলেন আরেকজন বিখ্যাত বাঙ্গালী মহিলা ডাক্তার কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়। তবে বাঙ্গালী মননে তিনি এখন বিস্মৃত প্রায়। কাদম্বিনী জন্মেছিলেন বিহারের ভাগলপুরে এক শিক্ষিত, সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্ম পরিবারে। পাঁচ বছর বয়সে তাঁর পরিবার বহরমপুরে চলে আসে। ১৮৭৪ সালে তিনি কলকাতায় পড়তে গিয়ে তিনি ভর্তি হন বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়ে যা বেথুন স্কুল নামে পরিচিত হয়। এই বেথুন স্কুলেই তাঁর সাথে পড়তেন স্বর্ণ কুমারী দেবী, অবলা দাস প্রমুখ।
বেথুন স্কুলে তিনি সাহিত্যর বিষয় গুলি ছাড়া বিজ্ঞানেও ভালো নম্বর পেয়েছিলেন। সরকার তাঁকে বৃত্তির ব্যবস্থা করেছিল এই শর্তে যে সে এফ. এ. পড়বে। কাদম্বিনীতো এক কথায় রাজি। তাঁর জন্যই সেদিন বেথুন স্কুলে এফ. এ. ক্লাস খোলা হয়েছিল। এই কৃতিত্ব তাঁকে ভাওয়াল রাজের কাছ থেকে স্বর্ণ পদক এনে দিয়েছিল। এরপর ১৮৮৩ সালে তিনি বেথুন কলেজ থেকে বি. এ. পাশ করলেন। তিনিই প্রথম মহিলাদের মধ্যে স্নাতক উত্তীর্ণ। আর তাঁর সঙ্গে ছিলেন চন্দ্রমুখী বসুও।
কাদম্বিনী যখন বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়ের ছাত্রী তখন তাঁর সাথে আলাপ হয় সমাজ সংস্কারক ও নারী মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম ব্যক্তিত্ব দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় এর। পরবর্তীতে তাঁরা পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হয়েছিলেন দ্বারকানাথ ঢাকা থেকে অবলাবান্ধব পত্রিকা প্রকাশ করলে কাদম্বিনী সেখানে নিয়মিত লিখতেন। নারী সমাজের মুক্তির জন্য তাঁর তীব্র নিবন্ধ গুলির জন্য তিনি বিখ্যাত মানুষদের কাছেও আদর্শ হয়ে ওঠেন। দ্বারকানাথ তাঁর স্ত্রীর কে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির জন্য উৎসাহিত করেন। কিন্তু প্রথম মহিলা ডাক্তার কাদম্বিনীর মেডিক্যাল পড়ার রাস্তা সহজ ছিল না। বহু বাঁধা- বিপত্তি পার হতে হয়েছিল। কলেজের ডাক্তাররাই নানা অজুহাতে তাঁকে মেডিক্যাল পড়তে না পারে সেই যুক্তিই সাজান। কিন্তু সেই সময় বাংলার ছোটোলাট রিচার্ড টমসন মেডিক্যাল কলেজের ডাক্তারদের আপত্তি উপেক্ষা করে মেডিক্যাল কলেজের মেয়েদের ডাক্তারী পড়ার বন্দোবস্ত করে দিয়েছিলেন। যাইহোক, ছেলেদের সঙ্গে পূর্ন আত্ম মর্যাদা নিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে ১৮৮৮ সালে তিনি কলেজের শেষ পরীক্ষায় বসলেন। কিন্ত সব বিষয়ে ভালো নম্বর পেলেও মেডিসিনের প্রাকটিক্যালে তিনি প্রয়োজনের থেকে এক নম্বর কম পেলেন। শোনা যায় একাজ করে ছিলেন মেডিক্যাল কলেজের এক বাঙালি ডাক্তার রাজেন্দ্রচন্দ্র চন্দ্র যিনি কাদম্বিনীর ডাক্তারী পড়াতে ঘোর আপত্তি জানিয়েছেলেন। শেষপর্যন্ত তাঁকে M.B. উপাধী না দিয়ে G.B.M.C.উপাধী প্রদান করা হয়। যাই হোক সেই যুগে তীব্র বাঁধার পাহাড় ঠেলে কাদম্বিনী প্রথম বাঙ্গালী মহিলা ডাক্তার হতে পেরেছিলেন।
ডাক্তার হয়ে তিনি প্রথমে লেডি ডাফরিন হাসপাতালে যোগদান করেন। কিন্তু M.B. ডিগ্রী না অর্জন করার বেদনা তাঁকে দমাতে পারেনি। তিনি সদ্যজাত শিশু সন্তানের দায়িত্ব তাঁর স্বামীর কাছে দিয়ে ১৮৯২ সালে তিনি লন্ডনে গেলেন। এডিনবরা গ্লাসগো এবং ডাবলিন থেকে চিকিৎসা বিদ্যায় বেশ কিছু উপাধি পাবার পর ১৮৯৩ সালে দেশে ফিরে এসে তিনি আবার লেডি ডাফরিনেই যোগ দিলেন। ডাক্তারী করার ফাঁকে ফাঁকে তিনি সমাজ, মেয়েদের সমস্যা , অন্যান্য সমসাময়িক বিষয় নিয়ে লেখালিখি করে গেছেন। সেগুলি বিভিন্ন পত্র পত্রিকা তে প্রকাশিত হতো।
তিনি প্রাইভেট প্র্যাকটিস করলেও বিত্তহীন মানুষদের জন্য প্রতিদিন একঘন্টা তাঁর বাড়িতে বিনা পারিশ্রমিকে তাঁদের পরীক্ষা করে প্রয়োজনে বিনামূল্যে ওষুধপত্রও দিয়ে যেতেন। কর্ম এবং সামাজিক উভয় জীবনেই তিনি হয়েছিলেন নানা বৈষম্যের শিকার। কিন্তু অসম্ভব ব্যাক্তিত্ব মর্যাদা জ্ঞানের অধিকারি কাদম্বিনী সব সময়েই মাথা উঁচু করে নিজের আদর্শ অনুযায়ী অভীষ্ট লক্ষের দিকে এগিয়ে গেছেন।
তাঁর সম্পর্কে কামাখ্যপ্রসাদ গুহ লিখেছিলেন,” অসম্মানজনক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিলেন তিনি সারাটা জীবন। কিন্তু মেধা, প্রত্যয় এবং স্তৈর্য নিয়ে এই বিরুদ্ধ স্রোতকে বারে বারে পরাজিত করেছেন। তাঁর জীবনের শেষের দিনটিও উজ্জ্বল (৩ অক্টোবর ১৯২৩)। একটি কঠিন অপারেশন শেষ করেছেন সফল। তার পরেই চিরশান্তি”।