তাপস সরকার

লেখক পরিচিতি 

( সৃজনশীল সাহিত্য কর্মে নিয়োজিত কিশোর  বয়স থেকেই। প্রথম পঠিত গ্রন্থ রামায়ণ, মহাভারত ও গীতা। গদ্যসাহিত্য ও উপন্যাসেই সাবলীল। যদিও শতাধিক গল্প ও দশ-বারোটি উপন্যাসের রচয়িতা কিন্তু সেসব হারিয়ে গেছে অপ্রীতিকর কারণে। প্রিয় বিষয় মহাকাশবিদ্যা। কল্পবিজ্ঞান ও কিশোর সাহিত্য প্রিয় লেখা।কিছু গল্প নব্বইয়ের দশকে বাণিজ্যিক ও অবাণিজ্যিক পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত। উন্মীলন নামে প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকায় নিজের গল্প ও দুটি উপন্যাস ছাপা হলেও সেই উদ্যোগ থেমে যায়।প্রতিভাস সাহিত্য ম্যাগাজিন চলছে পনের বছর যা মায়ের নামে। সেখানে মায়ের উদ্দেশ্যে নিবেদিত লেখা স্মৃতিচিত্রণ ও বেশ কিছু ছোটগল্প। নব্বইয়ের দশকে কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে কিছুদিন লিটল ম্যাগাজিন গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত থেকে জেলায় জেলায় সাহিত্য আসরে ঘোরাঘুরি। বিশ্বকে নিজের ঘর বলে ভাবতে অভ্যস্ত। মায়ের মৃত্যুর পর অবসাদে দীর্ঘদিন লেখায় বিরত। তারপর আবার লেখা শুরু কিশোর সাহিত্য ‘গাছবাড়ির বাসিন্দা ‘ দিয়ে। পাঁচ বছরের প্রচেষ্টায় কোভিড পরিস্থিতিতে লেখা ইংরেজি ভাষায় ‘ইটস মাই আইল্যান্ড ‘ প্রকাশের অপেক্ষায়। স্বউদ্যোগে প্রকাশিত একমাত্র উপন্যাস ‘অন্তরালোকে ‘ নিজের জীবনের এক বিশেষ অধ্যায় ও মাকে নিয়ে লেখা। ভারতীয় প্রাচীন দর্শনের ওপর একনিষ্ঠ বিশ্বাস ও আধুনিক প্রযুক্তির ওপর বিরক্তি  ‘অনন্ত জীবন ‘ উপন্যাসের পাতায় পাতায় প্রতিফলিত। পেশায় অর্থনীতি বিষয়ের অধ্যাপক। ) 

মূলাংশ       

(মরজগতে মানুষ চলেছে অমরত্বের সন্ধানে। অনাদি অতীত থেকে তার এই যাত্রারম্ভ। অনন্ত জীবন তারই এক প্রকাশ। তাই অমৃতের অধিকার নিয়ে সুরাসুরে এত অশান্তি, কারণ অমৃত নাকি অমর করে। অমরত্বের ব্যাখ্যা আবার দ্বিধাবিভক্ত, দৈহিক অমরত্ব এবং আধ্যাত্মিক অমরত্ব। দানব ও সর্বসাধারণ বোঝে প্রথম মতবাদটিকেই। কোনটি সঠিক? সবাই ছোটবেলায় হারিয়ে যায় মানুষের মেলাতে, সেখানে সে বন্ধু খুঁজে পায় যাকে সে তাকে হাত বাড়িয়ে দেয়, বোঝাতে চায় মানুষ ও বিশ্বজগতের উদ্দেশ্যবিধেয়। যে তাকে চেনে সে বোঝে সব। শৈবাঙ্কন আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর সভ্যতাকে অস্বীকার করে চলে যায় স্পিতি ভ্যালিতে। সেখানে সে আবিষ্কার করে সর্বজনীন ভাষা যাতে বাক্যালাপ চালাতো সনাতন মুনি-ঋষিরা কীটপতঙ্গ, পাহাড়-পর্বত, নদী-জঙ্গল, পাথর-প্রান্তর এবং অদৃশ্য দেবতাদের সঙ্গে। স্পিতি ভ্যালির পটভূমিকায় স্পিতি নদী ও প্রাকৃতিক উপাদানসমূহ এবং মানুষের সঙ্গে কথোপকথনে সে খুঁজতে থাকে অনন্ত জীবন বা অমরত্ত্বের ব্যাখ্যা। কী পেল সে শেষ পর্যন্ত ? )

অধ্যায় : সতেরো  

জাদুজগতের আয়তন কতটা সে জানত না। 

এখন তাই বিস্ময়ে অবাক হয়ে যেতে হল তাকে। 

সে দেখল, এতটাই বড় জাদুজগৎটা যে সেখানে গোটা মহাবিশ্ব হাজির হয়ে যাওয়ার স্থান পেল জাদুহস্তের সঞ্চালনে। তারপরও সে বুঝতে পারল, আরও এতটাই জায়গা পাওয়া যেতে পারে যেখানে আরও কয়েকটা বিশ্বের স্থান সংকুলান হওয়া বিচিত্র নয়।  

‘আয়, এবার তোকে সব চিনিয়ে দিচ্ছি। মনে রাখবি, আমি সমস্ত নাম-ধাম ইত্যাদি জানাব পৃথিবীতে যেভাবে তারা পরিচিত সেই নিয়ম মেনে। আমার কাছে যদিও তাদের পরিচয় অন্যরকম। সেসব তোকে জানাতে গেলে মুশকিলে পড়ে যাবি তুই। আমি এই মহাবিশ্বটার সমস্ত খবরাখবর জানলেও তোকে ঠিক ততটাই জানাব যতটা পৃথিবীর মানুষ আজ পর্যন্ত জানতে পেরেছে। তার বাইরে কিছুই জানাব না তোকে, কালক্রমে পরে যা জানবে মানুষ। তোর যাতে বুঝতে সুবিধে হয়, যাতে সব মিলিয়ে নিতে পারিস মানুষের আজ অব্দি জানা সমস্ত বিষয়ের সঙ্গে তার জন্যই এই ব্যবস্থা। এতে কোনোকিছু তালগোল পাকাবে না তোর কাছে।তুই দেখবি, আমি যা যা জানাচ্ছি তা তা রয়েছে মানুষের প্রাপ্ত তথ্যেও।’  

দিগদর্শক বলল তাকে। শুনে সে তাকিয়ে দেখল জাদুজগৎটাকে। অবাক হয়ে দেখল, জাদুজগতে রয়েছে মহাকাশ ও মহাবিশ্ব। সে দেখল, জাদুজগতে রয়েছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত উপাদান ও সদস্যসমূহ। সে সময় নিয়ে দেখতে লাগল মহাবিশ্বটায় কী কী রয়েছে। সে কী দেখল ?

সে দেখতে পেল একটি গোলকাকৃতি পরিমণ্ডল, অন্ধকারাচ্ছন্ন সর্বাঙ্গে, পরিব্যাপ্ত বহির্মুখী যা যে কোন পর্যবেক্ষণ বিন্দু থেকে সমস্ত দিকে অনন্ত প্রসারণশীল অন্তত চার হাজার ছ’শ পঁয়ষট্টি কোটি আলোকবর্ষ দূরত্ব, যেখানে এক আলোকবর্ষ মানে সেকেন্ডে প্রায় তিন লক্ষ কিলোমিটার গতিবেগে এক বৎসর বা তিনশ’ পঁয়ষট্টি দিনে আলোর ফোটন কণা মোট যতটা পথ যেতে পারে। এই সাংখ্যিক হিসেব স্পষ্ট সে প্রত্যক্ষ করছিল সেই বর্তুলাকৃতি জগতের গায়ে যার উপস্থিতি মহাজাগতিক সীমান্ত দিয়ে ঘেরা অনেকটা মহাসমুদ্রের মত, যত এগোনো যাক না কেন তার পরিধি বেড়েই যেতে থাকবে। অন্য কথায়, সর্বদিকে অনির্দিষ্ট ভাবে ও গতিবেগে ধাবিত এই রহস্যমণ্ডিত অন্ধকার শূন্যতল প্রকৃতভাবেই সীমান্তবিহীন অথবা অনন্ত ব্যাখ্যাহীন কোন মহাবিশ্বের একাংশ মাত্র যাকে দেখা যাচ্ছে বারো থেকে তেরোশ’ কোটি আলোকবর্ষ পর্যন্ত যেহেতু তারও পরবর্তী অঞ্চল থেকে আলো আর এসে পৌঁছতে পারছে না, আর এই দূরবর্তী অঞ্চলও ধাবিত এবং যেহেতু আলোকসদৃশ কণিকার চূড়ান্ত গতিবেগসম্পন্ন তাই নাগাল বহির্ভুত। এই রহস্যময় শূন্যতলে কী আছে ?  

সর্বব্যাপী কৃষ্ণতল বর্তুলের গায়ে রয়েছে নানা আকৃতি ও প্রকৃতি বিশিষ্ট দ্বীপ, এমন বহু দ্বীপের সমন্বয়ে একগুচ্ছ দ্বীপপুঞ্জ এবং এবং আবার বেশ কিছু দ্বীপপুঞ্জ সমষ্টি। দ্বীপগুলি অধিকাংশই দর্শনে কুণ্ডলী পাকানো ও উপবৃত্তাকার, কিছু আবার অদ্ভুতদর্শন ও অনির্দিষ্ট আকৃতির।উপবৃত্তাকার দ্বীপ গোলাকৃতি থেকে লম্বভাবে ডিম্বাকৃতি যার কোন উজ্জ্বল কেন্দ্র নেই। কুণ্ডলী পাকানো দ্বীপ চ্যাপ্টা ডিস্কের মত যার কেন্দ্রীয় নিউক্লিয়াস ভাস্বর, যাদের আবার চারটি প্রকৃতি—- অনেকে বিশুদ্ধ কুণ্ডলী, অনেকে বাধাসম্পন্ন কুণ্ডলী, বহু কুণ্ডলী উপবৃত্তাকার এবং কিছুবা অনির্দিষ্ট প্রকারের। বাধাপ্রাপ্ত কুণ্ডলীবাহুবিশিষ্ট দ্বীপ ছেয়ে রেখেছে দ্বীপমালার এক-তৃতীয়াংশ ক্ষেত্র যাদের কুন্ডলীবাহু নিউক্লিয়াসের পরিবর্তে পার্শ্বনির্গত। কিছু আবার লেন্স বা মটরশুঁটির মত উভ উত্তল আকৃতির, কিছু বামন উপবৃত্ত আর কিছুকে বলা হয় ম্যাগেলানিক কুণ্ডলাকার। মূলত উপবৃত্ত, কুণ্ডলী ও অনির্দিষ্ট প্রকৃতির দ্বীপই বেশির ভাগ। কোটিকল্প বলতে লাগল, 

‘প্রত্যেকটি দ্বীপ হল একটি গ্যালাক্সি যাতে রয়েছে হাজার কোটি বা তারও বেশি তারকা, আর অনেকগুলি গ্যালাক্সি মিলিয়ে তৈরি হয়েছে গ্যালাক্সি ক্লাস্টার এবং অনেকগুলি ক্লাস্টার মিলে গড়ে তুলেছে সুপারক্লাস্টার। তিনটে মূল শ্রেণি দ্যাখ্, উপবৃত্তাকার, কুণ্ডলীসদৃশ আর অনির্দিষ্ট—- এরাই বিস্তৃত দ্যাখ্ বহু আকারে, বামনাকার গ্যালাক্সিতে আছে অন্তত দশ কোটি তারকা আর দৈত্যাকার গ্যালাক্সিতে বসবাস করতে পারে অনায়াসে দশ হাজার কোটি তারকা, যে তারকাদের অধিকাংশই সূর্যের সমান বা তার চেয়ে দশ-বিশ-একশ গুণও বড় হতে পারে আকারে ও ভরে। অবস্থাটা ভাবতে পারিস ?

তার মাথায় চক্কর লেগে যাচ্ছিল। সে দেখতে পাচ্ছিল প্রতিটি দ্বীপাকার গ্যালাক্সিতে সেইসব অসংখ্য তারকা, প্রত্যেকটি তারকার মধ্যে কম করেও কয়েক আলোকবর্ষ ব্যবধান এবং একেকটি গ্যালাক্সির মধ্যে ব্যবধান আরও আরও বেশি, কয়েকশ’ থেকে হাজার আলোকবর্ষও হতে পারে, অর্থাৎ দু’টি গ্যালাক্সির মধ্যে যদি ব্যবধান থাকে একশ’ আলোকবর্ষের তো একটি থেকে অন্যটিতে যেতে আলোরই লেগে যাবে একশ’ বছর। এতটাই দূরে দূরে তাদের অবস্থান আর তাই ঘোরকৃষ্ণ বর্তুলের গোটা ব্যাপ্তিটাই বড়োই একা একা ফাঁকা ফাঁকা। কোটিকল্প তাকে বোঝাতে লাগল,

‘এই যে সীমান্ত না জানা বর্তুলাকার কৃষ্ণ ক্ষেত্রটিকে দেখছিস সেটি সময়ের বা কালের উপস্থিতিতে চার মাত্রাবিশিষ্ট, যদিও শূন্যতলের রয়েছে তিনটি মাত্রা—- দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও গভীরতা বা উচ্চতা, এবং জেনে রাখ্ এই বিশ্বক্ষেত্র তিন মাত্রাতেই সীমাবদ্ধ যেহেতু সময়কে কেউ চালাতে পারে না বা সময়ের মধ্যে দিয়ে ভ্রমণ করতে অপারগ। সময় চলে নিজের খেয়ালে নিজের নিয়মে এবং সবাইকে সে চালায় একই দিকে। তবুও বিজ্ঞানীরা পঞ্চম মাত্রার কথা ভেবেছেন যাকে দেখা বা উপলব্ধি করা না গেলেও কল্পনা করা যায় আর তা হল মাইক্রো ডাইমেনশন। আবার অনেকেই ভেবে ফেলেছেন যে এই মহাবিশ্ব দশটি মাত্রায় প্রতিফলিত, যদিও কোন প্রমাণ নেই।’

তার খাবি খাওয়ার মত অবস্থা দেখে কোটিকল্প সহৃদয় গলায় বলল,

‘আয়, তোকে আবার কিছু সংখ্যাতত্ত্ব বোঝাই। আমাদের সূর্য একটি মধ্যমানের ছোট তারকা। সে আছে ওই কুণ্ডলী পাকানো গ্যালাক্সিটার কেন্দ্র থেকে অনেকটা দূরে এক বাহুতে। এই গ্যালাক্সিটার নাম মিল্কি ওয়ে বা ছায়াপথ বা আকাশগঙ্গা। তাতে সর্বমোট তারকার সংখ্যা এক হাজার কোটি। উভতল লেন্সের মত গ্যালাক্সিগুলোকে দ্যাখ্, কেন্দ্র ঘিরে তাদের থালাসদৃশ গঠনে রয়েছে ধুলোর পথ এবং নেই কোন তারকাসৃষ্টির অঞ্চল। আবার বামনাকৃতি উপবৃত্তাকার গ্যালাক্সিগুলিকে দ্যাখ্, আছে সবাই গ্যালাক্সিক্লাস্টার বা গুচ্ছের কেন্দ্রস্থলে। অনির্দিষ্ট গ্যালাক্সিগুলির দ্যাখ্ কোন নির্দিষ্ট কুণ্ডলী বা উপবৃত্তাকার অংশ নেই, তারা অদ্ভুত গঠনের। আর ওই বিশাল গ্যালাক্সিটার নাম লার্জ ম্যাগেলানিক ক্লাউড, তার কুণ্ডলী আবার অন্য ধাঁচের এবং ওই দ্যাখ্ প্রায় তারই মত চেহারার স্মল ম্যাগেলানিক ক্লাউড গ্যালাক্সি। কুণ্ডলী গ্যালাক্সির বাইরের বাহুতে রয়েছে নবীন তারকারা আর ভিতরের দিকের বাহুতে পুরোনো তারার দল। মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সির কাছাকাছি গ্যালাক্সিগুলি কী কী দ্যাখ্। এটি হল অতি ঘন ক্যানিস মেজর, এটি স্যাজিটেরিয়াস বামন উপবৃত্তাকার, কাছেই আছে লার্জ ও স্মল ম্যাগেলানিক ক্লাউড আর অ্যান্ড্রোমিডা, অতি ত্রিকোণাকৃতি গ্যালাক্সি, এর নাম সিগার গ্যালাক্সি, এটি সমব্রেরো, এর নাম ম্যাগেলানিক ক্লাউড আর এটি হল ট্রায়াঙ্গুলাম, এর নাম হোয়ার্লপুল আর এটি পিনহুইল, এখানে আছে ব্ল্যাক আই আর বোডস্ গ্যালাক্সি, এটি কমেট আর এর নাম মেসিয়ার এইটি থ্রি। একটা ব্যাপার দ্যাখ্, অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সিতে আছে প্রচুর মহা উত্তপ্ত তারকা, অনেক সেফাইড ও সুপারজায়ান্ট তারা আর গ্যাস ও ধূলিকণার বিশাল বিশাল মেঘ। সে সেকেন্ডে একশ’ কুড়ি কিলোমিটার গতিবেগে দ্যাখ্ চলেছে মিল্কি ওয়ের দিকে। এই হিসেবে চারশ’ কোটি বছর পর দু’টি গ্যালাক্সির দেখা হবে এবং দু’টিতে মিলে জন্ম নেবে এক উপবৃত্তাকার গ্যালাক্সি। বিশেষ কোন সংঘর্ষ হবে না যেহেতু প্রচুর ফাঁকা জায়গা আছে। ওই দ্যাখ্ না দু’টি কুণ্ডলী গ্যালাক্সি মিশে তৈরি করেছে এইযে অ্যান্টেনি গ্যালাক্সিগুলি। এবার প্রশ্ন, এই দৃশ্যমান মহাবিশ্বে কত গ্যালাক্সি থাকতে পারে। উত্তর হল, এক হাজার কোটি থেকে দু’ হাজার কোটি। নির্দিষ্ট কোন সংখ্যা জানা নেই মানুষের। সেই হিসেবে মোট তারকার সংখ্যা কী হতে পারে ব্রহ্মাণ্ডে ? সংখ্যাটা লেখার জায়গা পাওয়া গেলেও বলে বোঝানো মুশকিল। দুইয়ের পর একুশটি শূন্য বসলে যা হতে পারে সেটাই হচ্ছে দৃশ্যমান এই মহাবিশ্বে মোট তারকার সংখ্যা, কথায় বলতে পারিস, কুড়ি কোটি কোটি কোটি। এবার বলি শোন্, গ্যালাক্সিগুলি তাদের ক্লাস্টারে বা ক্লাস্টারগুলি সুপারক্লাস্টারে জুড়ে আছে কিসের টানে। সেটা হল মহাকর্ষ বল। এখানে এসে কন্সটেলেশন বা তারকাপুঞ্জের কথাও তোকে জানিয়ে রাখছি। সে কিন্তু গ্যালাক্সি নয়, একগুচ্ছ তারকা যারা একত্র হয়ে একটি বিশেষ চেহারা ফুটিয়ে তুলেছে আকাশের গায়ে যা পৃথিবী থেকে দেখে মানুষ। এরা সবাই মিল্কি ওয়েতেই রয়েছে। যেমন, শিকারির চেহারায় কালপুরুষ বা ওরিয়ন, উত্তর মেরুতে ডব্লিউ চেহারার ক্যাসিওপিয়া। গল্প জানিস তার ? গ্রিক পূরণের গল্প। ক্যাসিওপিয়া ছিল সম্রাজ্ঞী, খুব দম্ভ তার রূপের আর বলে বেড়াত যে সমুদ্রকন্যাদের চেয়েও সে বেশি সুন্দরী। তাই শুনে সমুদ্রের দেবতা পসাইডনের খুব রাগ হয় আর সে সমুদ্রদানব সিটাসকে পাঠায় তার রাজ্য ধ্বংস করার জন্য। ভয় পেয়ে ক্যাসিওপিয়া তার কন্যা  অ্যান্ড্রোমিডাকে শিকল দিয়ে সমুদ্রোপকূলে পাথরে বেঁধে রাখে সিটাসের জন্য। গ্যালাক্সির নাম অ্যান্ড্রোমিডা ওই অসহায় মেয়েটির নামেই। আর উত্তরাকাশে রয়েছে ক্যাসিওপিয়া নক্ষত্রপুঞ্জ। এমন আটাশিটি কন্সটেলেশন বা তারকাপুঞ্জ বানিয়েছে মানুষ। তাদের মধ্যে সপ্তর্ষিমণ্ডলকে তো সবাই চেনে।’ 

একটু থামল কোটিকল্প। তাকে খানিকটা ভাববার সুযোগ দিয়ে আবার বলতে লাগল,

‘তাহলে এত কথা শুনে আর গোটা মহাবিশ্বটাকে চোখের সামনে বর্তমান দেখে কী বুঝতে পারলি ? গ্যালাক্সিগুলি হল মহাবিশ্বের গাঠনিক খণ্ড এবং ক্লাস্টার ও সুপারক্লাস্টার মিলে গোটা কাঠামো বানিয়ে দিয়েছে। একটি ক্লাস্টারে রয়েছে একশ’ থেকে এক হাজার গ্যালাক্সি যারা মহাকর্ষ বলে পরস্পর আকৃষ্ট ও অটুট এবং যাদের মোট ভর হল সূর্যের ভরের সঙ্গে চোদ্দ বা পনেরোটি শূন্য বসালে যত হবে তত। এমনিতে দ্যাখ্, মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সি কোন ক্লাস্টারে নেই, সমস্ত গ্যালাক্সিকে যে কোন ক্লাস্টারে থাকতে হবেই এমনটাও নয়, কেউ কেউ থাকতে পারে কোন দলে। অনেকে মনে করে যে মিল্কি ওয়ে রয়েছে তেমনই এক দলে, কেউ বলে যে সে হল বার্গ সুপারক্লাস্টারের একাংশ, ওই দ্যাখ্ তাকে, একটু বিভ্রান্তিকর তার অবস্থান। এখন মনে করা হচ্ছে, মিল্কি ওয়ে হল ল্যানিয়াকিয়া সুপারক্লাস্টারের অন্তর্গত যাতে আছে পাঁচ লক্ষ পঞ্চাশ হাজার গ্যালাক্সি, যার অন্য নাম কোমা ওয়াল। এটি বৃহত্তম এক সুপারক্লাস্টার। আরও দু’-একটি কথা মিল্কি ওয়ে সম্পর্কে বলি। এখানে আছে ততটাই ভর একের পর আঠেরোটি শূন্য বসালে যতটা সূর্যভর হয় তার সমান, আর রয়েছে একটি গ্লোবিউলার ক্লাস্টার এক লক্ষ সৌরভরের সমান, যার তুলনায় গ্যালাক্সির সমগ্র ভর এক কোটি গুণ বেশি।’  

কোটিকল্প বর্ণনা থামাল, আর সে স্বপ্নাচ্ছন্ন অথচ সজাগ চোখ মেলে ত্রিমাত্রাধীন কৃষ্ণকায় অনন্ত বর্তুল ও তার স্থানে স্থানে উপস্থিত নানাজাতীয় পদার্থ বা বস্তুকণা সম্মেলনসমৃদ্ধ দ্বীপ, দ্বীপপুঞ্জ ও মহাদ্বীপপুঞ্জগুচ্ছ সদৃশ্য গ্যালাক্সি, ক্লাস্টার ও সুপারক্লাস্টারগুলি ও তাদের গতিবিধি, চরিত্র, চেহারা দেখতে লাগল। প্রশ্ন ভুলে গেল এই মহাবিশ্বদর্শনে ব্যস্ত থেকে যেহেতু তাকে আগেই বলে রাখা হয়েছিল প্রাসঙ্গিক বিষয়ে, 

‘পার্থিব মানব সম্প্রদায়ের মেলা এবং মেলায় উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যবিধেয় তো জানালাম তোকে আদ্যোপান্ত এযাবৎকাল। বুঝেও গেছিস বললি তুই। বুঝিসনি কেবল যে পৃথিবীটাই সব নয়, যেমন আর আর মানুষরাও ভাবে। কেবল এই পৃথিবীকে এবং এখানকার মানবকুলকে দেখাই সব দেখা নয়।এর অন্তর্গত আপনাপন সংসার ও ক্ষুদ্র স্বার্থান্বেষণ নিয়ে ব্যস্ত থাকবে বলে সৃষ্টিকর্তা মানুষকে শ্রেষ্ঠ জীব বানিয়ে এবং একটা মস্তিষ্ক দান করে তাকে অগাধ জ্ঞানান্বেষণের ক্ষমতা দেননি, সেটা সে ঘুম পাড়িয়ে রেখে দেবে বলে, দিয়ে সে পরনিন্দা-পরচর্চা করে, অন্যকে পীড়ন করে, কেবলই ব্যক্তিগত আখের গোছাবার কাজে সেই অনন্য ক্ষমতাসম্পন্ন মস্তিষ্কটাকে দিনের পর দিন অপব্যবহার করেই যেতে থাকবে। এটা ছিল না সৃষ্টিপিতার উদ্দেশ্য, সে জানত না ভাবতেও পারেনি যে তার মানসপুত্র, যাকে সে অমৃতস্য পুত্রা হওয়ার ক্ষমতা ও অধিকার দিয়েছিল সে সেসব এমন দানবিক করে তুলবে তার অন্যায় আচরণ ও কর্মে। বিশ্বপিতাকে তার সৃষ্টির জন্য দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলতে বাধ্য করবে। তার যে সৃষ্টিকে সে শ্রেষ্ঠ ও আদর্শতম হবে বলে আনন্দ আর আবেগে আপ্লুত ছিল তা এমন অপদার্থ বলে প্রমাণিত হয়ে জগৎসংসারে তার জন্য কলংকের কারণ হবে। তারা অহরহ দানবিক কর্মকাণ্ড, হানাহানি, নিষ্পেষণ, মিথ্যাচার, স্বৈরাচার, বিশ্বাসভঙ্গ, পদলেহন ইত্যাদি যাবতীয় কুকীর্তির দৃষ্টান্ত স্থাপন করেই যাবে করেই যাবে এবং ক্রমাগত অধঃপতন ঘটাতে থাকবে যা দেখে বিশ্বসংসার হতভম্ব হয়ে যাবে এসব সৃষ্টিকর্তা তার পরিকল্পনার সময় স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। আমিও তারই সৃষ্টি, আমিও জানতাম না এমন হবে তার সামগ্রিক আচরণ। কেউ আমাকে আজ মানেই না, চেনেও না এতো দাম্ভিক ও অন্ধ সবাই। বিশ্বজগতের সূচনা থেকেই আমি আছি, পৃথিবী ও  মানবসভ্যতার জন্মটাও তাই আমার জানা। আমি বৈদিক ভারত দেখেছি, মধ্যযুগের ইউরোপ দেখেছি, মিশরীয় সভ্যতা দেখেছি, দেখেছি মায়াসভ্যতা ছাড়াও মানব প্রজন্মের আদিতম সমস্ত কাহিনী। আমি দেখেছি আদিমানবের সভ্যতা বিস্তারের প্রয়াস, দেখেছি আধুনিক মানুষের উত্তরণ পর্ব। আমি দানবিক ও লোভী মানুষ দেখেছি, তার তালিকা বিপুল— দেখেছি সাম্রাজ্যলোভী নায়কদের পরিক্রমা ও অত্যাচার, সমস্ত যুদ্ধবিগ্রহ, অকারণ ধ্বংস ও গণহত্যালীলার তাণ্ডব, বর্বর যুগ পেরিয়ে এসেও মানুষের বর্বরতা, দেখেছি ধর্মীয় অন্ধত্বের বশে কিভাবে কোটি কোটি মানুষ যুগের পর যুগ ধরে পীড়িত ও খুন হয়ে আসছে, দেখেছি মানুষ কিভাবে লোভ ও আধিপত্য বিস্তারের মোহে মানুষের সভ্যতা ও গৌরবকে হেলায় ধ্বংস করেছে, দেখেছি ঔপনিবেশিক জাতিদের অভিযান এবং তাদের অত্যাচার ও লুন্ঠন আর গণহত্যার ইতিহাস, নানাবেশী নরখাদক ও দস্যু মানুষ। কী দেখতে বাকি আছে আমার সভ্যতার গোড়া থেকে ? দেখেছি তাদের যারা যীশু খ্রিস্টকে ক্রুশবিদ্ধ ও শ্রীচৈতন্যকে গুপ্তহত্যা করেছিল। দেখেছি দেশবিভাগ, জাতিদাঙ্গা, স্বভূমিচ্যুত কোটি কোটি জনতার উদ্বাস্তু হওয়ার জ্বালা-যন্ত্রণা ও লড়াই। দেখছি গণতন্ত্রের চমকপ্রদ খোলসের আড়ালে স্বৈরতন্ত্র ও ব্যাভিচারের প্রকাশ। আমাকে তো সমস্তকিছুরই সাক্ষী থাকতে হচ্ছে যখন সৃষ্টিকর্তা আড়ালে বসে দীর্ঘনিঃশ্বাস মোচন করছে। কিন্তু তবুও কেন সভ্যতা টিকে আছে জানিস ? কারণ এইসব অপদার্থ ও অমানুষদের সংখ্যাধিক্যতার মধ্যেও কিছু সত্যিকারের মানুষ আছে চিরকাল। তারা ব্যক্তিস্বার্থের পরোয়া করে না, দানবের রক্তচক্ষু দেখে ভয় পায় না, কোন আপোষ করে না অন্যায়ের সঙ্গে, কোন মূল্যে কোন ভয়ে নৈতিকতা বিসর্জন দেয় না, বিকিয়ে দেয় না নিজেকে তুচ্ছাতিতুচ্ছ প্রাপ্তির লোভে, রং পাল্টায় না, শাসকের পদতলে সটান শুয়ে পড়ে না অনুগ্রহ লাভের মোহে, পদলেহন করে না, মেরুদণ্ডহীন কীট হয়ে মাথা নত করতে শিক্ষা পায়নি, উপেক্ষা করতে জানে অসৎকে, অন্যায়কে অন্যায়ই বলে, বিবেক তাদের সদাজাগ্রত, অথচ তারা দাম্ভিক নয়, বিনীত ও ভদ্র এবং যথাযথ শিক্ষাপ্রাপ্ত। তাদের যশখ্যাতির মোহ নেই, জননেতা বা জনবরেণ্য হতে চায় না, কিন্তু জনতা তাদের তবুও চিনে ফেলে একদিন, তাদের জীবদ্দশাতে না হলেও এবং তারা স্বেচ্ছায় না চাইলেও অনন্ত জীবন পেয়ে যায় আর যথার্থই অমর ব্যক্তি। চিরকাল মানুষ প্রজন্মান্তরে শ্রদ্ধাবনত থাকে তাদের জন্য। তারাই বিশ্বপিতার কাঙ্খিত সন্তান, সৃষ্টিকর্তার আদরের সেই অমৃতস্য পুত্রা, এবং তুচ্ছ আপাতদৃষ্টিতে মনে হলেও এতোই তাদের ভিতরে সুপ্ত থাকে ক্ষমতা ও প্রাণশক্তি যে শত দানব-দানবীর উৎপীড়ণ বা দমননীতিও তাদের থামাতে পারে না, তারা অনায়াসে তাদের অমরত্বের মাধুর্য দিয়ে সহস্র দানব-দানবী বা স্বৈরাচারী শাসককে ও তার নিস্পেষণকে নস্যাৎ করে দিয়ে লক্ষ জনতাকে প্রভাবিত করে ফেলতে পারে। এমন একজন সার্থক মানুষ ম্লান করে দেয় কোটি জনের অন্যায়কে এবং এর জন্যই সভ্যতা টিকে আছে। তারা আমাকেও চিনতে পারে, যেমন তুই চিনেছিস। তোর মত আরও কিছু মানুষকে আমি জানি যারা তোর মতোই আমার হাত ধরতে পেরেছে এখনও। আমি তাদের কাছেও নিজেকে জানিয়ে দিয়েছি যেমন করেছি তোর ক্ষেত্রে, আমাকে বশে রাখার অধিকারও দিয়ে দিয়েছি সানন্দে। যেমন দিতাম আগেও ওইসব যথার্থ মানুষদের কাছে। তারাও কিন্তু কম নয় কিছু, সবাই স্বনামধন্য যেহেতু অমরত্ব পেয়ে গেছে জনসমুদ্রে কোন না কোন মানুসিক কার্যকলাপের জন্য। কারা এইসব মহামানব তা কি আর বলে দিতে হবে ? তারা সবাই অমৃতস্য পুত্রা, সৃষ্টিপিতার গৌরব। আদিযুগ থেকে এখনও তারা বর্তমান। কিন্তু……’ 

এতক্ষণ একটানা কথা বলার পর কোটিকল্প থেমেছিল। তার শোনার ক্ষমতাকে একটু বিশ্রাম দিতে। সে শুনছিল সব তন্ময় হয়ে। কথা থামলে পরও কিছু না বলে তাকিয়েই ছিল আরও শোনার আগ্রহ চোখে রেখে। তার এই আগ্রহ দেখে কোটিকল্প শান্ত ভঙ্গিতে আবার বলতে শুরু করেছিল, 

‘মানুষ বা জীবকূলকে দেখাই তো সব দেখা নয়। সব দেখা নয় যদি কেবল পৃথিবীটাকেই দেখিস। তুই তো বললি, ব্রহ্ম সর্বত্র বিরাজমান। সে পার্থিব জীব ছাড়া জড় বস্তুতেও আছে তুই জেনেছিস। জাদুজগতে দেখেছিস এতকাল সেই মানুষের মেলাকে। কিন্তু ব্রহ্ম যেহেতু জীব ছাড়া জড় বস্তুতেও বিদ্যমান সেইসব জড় বস্তুর মেলাটাকেও তোর দেখা উচিত, তাদের জীবনযাপন ও কার্যকলাপ। কেবল পৃথিবীটাতে আছে তারা এমন নয়, আছে গোটা বিশ্বজগৎ জুড়ে। জাদুজগতে তাই সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডটাকে নিয়ে এলাম, দ্যাখ্ বিশ্বজগতের গ্রহ-তারকা-গ্যালাক্সি ও অন্যসব বৈচিত্র্যময় জড়বস্তুর আচার ও আচরণ, উদ্দেশ্যবিধেয়, জীবনযাপন।দ্যাখ্ ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত বস্তুকণার চলনে-বলনে ব্রহ্ম কিভাবে তার উপস্থিতি জানায়। দ্যাখ্ এবার জাদুজগতে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের জড়বস্তুসমুদয়ের মেলা। দেখলিও সব এতক্ষণে অনেককিছু, কিভাবে চলছে মহাজাগতিক মেলাতে জড়বস্তুরা, কিভাবে করছে জীবনযাপন দেখলি আর শুনলি। কোটি কোটি কোটি তারকা, কোটি কোটি গ্যালাক্সি ও তাদের গুচ্ছ এই সুবিশাল ব্রহ্মাণ্ড জুড়ে দ্যাখ্ কিভাবে বিন্যস্ত হয়ে রয়েছে। কী বিপুল তাদের পরিমাণ ও ভর হতে পারে তা কি কল্পনা করতে পারিস ? কিন্তু তা সত্ত্বেও দ্যাখ্ সবাই কেমন একা একা মনে হচ্ছে, কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে এই বিশ্বজগৎটাকে। এতো এতো হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি বিপুলায়তন তারকা, গ্রহ, গ্যালাক্সি, ধূমকেতু ইত্যাদি ভরসমৃদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও দ্যাখ্ কত এবং কী বিশাল কৃষ্ণ অন্ধকার বিরাজমান তারকায় তারকায়, গ্যালাক্সিতে গ্যালাক্সিতে, অন্য কথায়, দৃশ্য বস্তু ও পদার্থসমূহের মধ্যে। তোর কি মনে হচ্ছে না আলো নিঃসরণ বা প্রতিফলনকারী দৃশ্যমান বস্তুসমূহের তুলনায় কৃষ্ণকায় শূন্যতলের ব্যাপকতা অনেক বেশি ? ঠিক তাই। এই যে বিপুলায়তন গ্রহ-তারকা-গ্যালাক্সি-মহাগ্যালাক্সিময় দৃশ্যমান বস্তুসমূহের মহাসমারোহ তা মহাবিশ্বের কতটা স্থান অধিকার করে আছে জানিস ? শুনলে অবাক হয়ে যাবি, মাত্র চার থেকে পাঁচ শতাংশ স্থান। মহাবিশ্বের বাকি পঁচানব্বই স্থান কেবলই দৃশ্যত ফাঁকা শূন্যতা। কিন্তু একেবারেই শূন্য নয় অবশ্য এই দৃশ্যত ফাঁকা শূন্যতল। যে ফাঁকা অন্ধকার মহাকাশটাকে দেখতে পাচ্ছিস তার আটষট্টি ভাগ ডার্ক এনার্জি বা অদৃশ্য শক্তি, সাতাশ ভাগ ডার্ক ম্যাটার বা অদৃশ্য বস্তুকণা এবং দৃশ্যমান চার থেকে পাঁচ ভাগ গ্রহ-তারকা-গ্যালাক্সি ইত্যাদি। এ সমস্ত নিয়েই মহাবিশ্ব। যদিও ডার্ক এনার্জির অস্তিত্ব সম্পর্কে হালে সন্দেহ প্রকাশ করেছে অনেকেই।’  

এতক্ষণে সে প্রশ্ন করল এবার,

‘ডার্ক এনার্জি কী ?’

‘সেটা বুঝতে হলে তোকে মহাবিশ্বের সৃষ্টিটাকে জানতে হবে। আমার হাত ধরে তুই সময়কে আয়ত্তে আনতে পেরেছিস, তাই সময়ের মধ্যে দিয়ে তোর চলাচল সম্ভব। তোকে এবার পিছিয়ে যেতে হবে তেরোশ’ আশি কোটি বছর আগে। তখনই বিশ্বসৃষ্টি ঘটেছিল। কিভাবে ঘটেছিল সেই প্রাগৈতিহাসিক সর্বশ্রেষ্ঠ ঘটনাটি এই জাদুজগতে আবার ঘটবে, অবিকল যেভাবে ঘটেছিল ঠিক সেভাবেই। তুই কেবল সেই সর্বকালীন সেরা ঘটনাটি আবার ঘটছে দেখতে পাবি। আয়, দেখে না।’

এক বিচিত্র শূন্যতা দেখতে পেল সে জাদুজগৎ জুড়ে, ঠিক যে কেমন বোঝা বা বলা মুশকিল। এমন অদ্ভুত ও অপরূপ পরিবেশ যার কোন বর্ণনা চলে না, যা নিথর নিশ্চল থম ধরা, রূপহীন, বর্ণহীন, বৈচিত্র্যহীন এবং ঘটনাবিহীন আর গোটা শূন্যতা একটি ক্ষুদ্র ডিম্বাকার বস্তু পরিপূর্ণ করে রেখেছে। যদিও ডিম্ব তবুও তার ব্যাপ্তি সমগ্র শূন্যতাকে ছেয়ে ফেলেছে। সে বুঝতে পারছিল যে ওই ডিম্বতেই জগতের যাবতীয় উত্তাপ ঘনীভূত। সেই উত্তপ্ত ডিম্বটির উত্তাপ লেখা দেখছিল সে ফুটে উঠেছে গায়ে একশ’ কোটি কেলভিন বা প্রায় একশ’ কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াস। এবং তারপরই সে দেখল এক মহা বিস্ফোরণ, যার তুলনা একমাত্র সে নিজেই। ঘটনার সূত্রপাত ঘটতে লাগল তখন থেকেই। সে দেখল যে অবিশ্বাস্য ঘনীভূত সেই বিন্দু ফেটে বস্তুকণাসমূহ অকল্পনীয় গতিবেগে ধাবমান দিগ্বিদিকে, এই সমস্ত বস্তুকণা প্রোটন ও নিউট্রন। মহাবিশ্বের সূত্রপাত হল সময় ও ঘটনাবলীকে সঙ্গী করে। তখন তার ঘনত্ব জলের তুলনায় চার লক্ষ গুণ ভারী আর তাপমাত্রা দশ হাজার কোটি কেলভিন বা কমবেশি দশ হাজার কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াস।  

‘দেখলি তো কিভাবে মহাবিশ্ব সৃষ্টি হল ?’ সে বলতে লাগল, ‘কিন্তু মনে রাখিস, এভাবেই যে সৃষ্টি হয়েছে সেটা কিন্তু আমি বলছি না। এই ঘটনা একটি সর্বজনগ্রাহ্য তত্ত্ব যার প্রবক্তা লা মিত্রে নামের এক যাজক বিজ্ঞানী। অন্যভাবেও কিন্তু সৃষ্টি হয়ে থাকতে পারে বা হতেও পারে অন্য অনেক কিছু যেমন, মহাবিশ্ব বলে এই বস্তুত একটি কল্পনাধীন প্রকল্প বিশ্বনিয়ন্তার যা সে ভাবছে কোন অবসর বিনোদনের সময় এবং আমরা সবাই আঁকা বা ভাবা ছবি। তবে ওইভাবে মহা বিস্ফোরণে যে বিশ্বসৃষ্টি ঘটেছিল তার প্রমাণ কিন্তু পাওয়া গেছে, সেই প্রমাণকে বলা হয়ে থাকে ব্যাকগ্রাউন্ড টেম্পারেচার বা পটভূমি তাপমাত্রা যা প্রায় তিন কেলভিন বা মাইনাস দু’শ সত্তর ডিগ্রি সেলসিয়াস। তেরোশ’ আশি কোটি বছর আগে ওই মহা বিস্ফোরণে, যাকে বলা হয় বিগ ব্যাং তত্ত্ব, বিশ্বসৃষ্টির পর যতটা তাপমাত্রা ছিল তা এই তেরোশ’ আশি কোটি বছর পর যা হতে পারে মহাকাশে অনুসন্ধান করে দেখা গেছে তা গড়ে ওই প্রায় তিন কেলভিন এবং বর্তমানে সেটাই হওয়ার কথা। আর এটাই হল বিগ ব্যাং তত্ত্বের বড় প্রমাণ।’ 

কোটিকল্প থামল। থামতেই সে আবার তুলল আগের প্রশ্ন, 

‘এখানে ডার্ক এনার্জি কোথায় ?’

‘আসছি এবার সেই প্রসঙ্গেই। তুই হয়তো জানিস জগৎজোড়া দু’টি বলের কথা, একটি হল অভিকর্ষ বল এবং অন্যটি মহাকর্ষ বল। অভিকর্ষজ বল সাধারণত দেখা যায় গ্রহ-তারকা ইত্যাদির নিজস্ব পরিমণ্ডলে, যা দিয়ে সে নিজস্ব পরিমণ্ডলে থাকা সমস্ত কিছুকে নিজের দিকে টেনে নেয় বা নিতে থাকে। আর মহাকর্ষজ বল মহাকাশে থাকা বিভিন্ন বস্তুকে একত্র করে রাখে, যেমন গ্যালাক্সির অন্তর্গত গ্রহ-তারকাদি তার প্রভাবেই নিজস্ব এলাকা ছেড়ে বেরিয়ে যায় না এমনকি, গ্যালাক্সিগুলিও একে অন্যকে পরস্পর আকর্ষণ করে। এ দু’টি বলের প্রমাণ পাওয়া যায় সর্বত্র। কিন্তু ডার্ক এনার্জি হল এ দু’টি বলের সম্পূর্ণ বিপরীত যাকে প্রমাণ করা না গেলেও অনুমান করা যায়। এ হল প্রাথমিক বল যার উৎপত্তি ঘটেছিল মহা বিস্ফোরণে আদিম ডিম্বটি ফেটে যাওয়ার পর যার প্রভাবে ডিম্বটি ফেটে ডিম্বস্থিত বস্তুসমূহ দিগ্বিদিকে প্রবল ধাক্কায় অকল্পনীয় গতিবেগে ছড়িয়ে যেতে শুরু করেছিল। সেই প্রবল ধাক্কার জের এখনও চলছে এতকাল পর, উল্টে বেড়েই চলেছে। তার জোরে মহাকর্ষজ বল উপেক্ষা করে গ্যালাক্সিসমূহ এবং তার অন্তর্গত বস্তুসমূহ কেবলই একে অন্যের কাছ থেকে সরে যাচ্ছে ক্রমাগত সরে যাওয়ার হার বাড়িয়ে। যে যত দূরে তার সরে যাওয়ার গতিবেগ তত  এবং এই হিসেবে পৃথিবীর সাপেক্ষেই মনে কর্, তেরোশ’ আশি কোটি আলোকবর্ষ দূরের কোন গ্যালাক্সি বা বস্তু সরে যাচ্ছে আলোর বেগ প্রাপ্ত হয়ে। এই সীমার বাইরের অঞ্চল বলে যদি কিছু থাকেওবা কোনোদিনও আমরা তার নাগাল পাব না বা তার সম্পর্কে কিছু জানতেও পারব না, কারণ সেই সীমানা বা তার বাইরে থাকা বস্তু যেহেতু আলোর গতিবেগে চলে যাচ্ছে তাই তার থেকে আলো কোনোদিনও এসে পৌঁছবে না আমাদের কাছে আর আলো না এলে কোন বস্তু থেকে তার সম্পর্কে কিছু জানব কী করে ? এটাই হল ডার্ক এনার্জি যার প্রভাবে ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে মহাবিশ্বের পরিধি, স্ফীত থেকে স্ফীততর হয়ে চলেছে আয়তন ক্রমবর্ধমান ত্বরণে। যত সময় এগোচ্ছে, গ্যালাক্সির বস্তুসমূহকে সে মহাকর্ষজ বলের বিরুদ্ধে কাজ করে ছিঁড়ে বার করে দিতে চাইছে এবং সময় ও শূন্যতলকেও বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে। তবে এই ডার্ক এনার্জি যে সত্যিই আছে তার কোন প্রত্যক্ষ প্রমাণ কিন্তু নেই।’

‘আর ডার্ক ম্যাটার ?’ 

‘ডার্ক ম্যাটার হল অদৃশ্য পদার্থ, মহাকাশের রহস্য। এই বস্তু বা পদার্থ সমন্বয় আলো প্রতিফলিত বা উৎপাদিত করে না এবং তাদের সরাসরি তড়িচ্চৌম্বক বিকীরণের মাধ্যমে দেখা যায় না, তবে তারা আছে বুঝি দৃশ্য বস্তুগুলির স্বাভাবিক আচরণ বিঘ্নিত হওয়া থেকে। গ্যালাক্সিগুলির দৃশ্য বস্তুসমূহের যা ভর প্রকৃতপক্ষে দেখা যায় তার চেয়ে অনেক বেশি ভরের উপস্থিতি, যা অদৃশ্য বস্তুসমূহের ভরের কারণে ঘটে। অন্ধকারে মিশে থাকে এই ভর বা এই বস্তুসমূহ, তাই এদের বলা হয় হারানো ভর। দেখা না গেলেও তারা অবশ্যই আছে, আড়ালে থেকে দৃশ্য বস্তুগুলির গতিবিধিকে প্রভাবিত করে যাচ্ছে। এরা হতে পারে শ্বেত বামন, ব্ল্যাক হোল, নিউট্রন তারা বা এমনই কোন মৃত তারকা। অন্য একটি হিসেবে অনুযায়ী, মহাবিশ্বের ত্রিশ দশমিক এক ভাগ এইসব অদৃশ্য বস্তু, ঊনসত্তর দশমিক চার ভাগ ডার্ক এনার্জি আর মাত্র দশমিক পাঁচ ভাগ দৃশ্য বস্তুসমূহ।’

‘তুমি একটু আগেই অন্য হিসেব বলেছিলে।’

‘বলেছিলাম। কিন্তু জেনে রাখ্, কোন হিসেবই চূড়ান্ত নয়। মহাজাগতিক হিসেব নিয়ে নানা মুনির নানা মত। তাছাড়া তোকে আগেই বলেছি, সমস্ত তত্ত্ব আর হিসেব তোকে বলছি প্রথিবীর মানুষের জানা বা দেখা অনুযায়ী। মহাজগৎটা কত বড় দেখলি তো ? পৃথিবী তার তুলনায় কত নগণ্য তাও জেনেছিস। তাই পৃথিবীতে থেকে মানুষের অত বিপুল বিশ্বের আন্দাজ পাওয়া কতটা অবাস্তব বুঝে দ্যাখ্। মানুষের সমস্ত দেখা বা জানা গরমিল হয়ে যেতে বাধ্য যে কোন সময়ে।’ 

জাদুজগতে উপস্থাপিত মহাবিশ্বটাকে দেখতে লাগল সে মনোযোগ দিয়ে। অনন্ত অন্ধ শূন্যতাকেও সে শুনল শূন্যতা নয়, তাতেও রয়েছে বস্তু বা শক্তির উপস্থিতি যা অদৃশ্য হয়ে থাকছে। আলোকিত বস্তুসমূহ সত্যিই এই মহাশূন্যতার বুকে খুবই কম স্থান দখল করে রয়েছে দেখে মনে হচ্ছিল, সমগ্র মহাবিশ্বটার এক ভাগ স্থানও নয়, বিস্ময়কর মনে হলেও অবিশ্বাস করার কোন উপায় নেই। 

(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *