বিদ্যুৎ মণ্ডল

ষষ্ঠ পর্ব

পথ হারিয়ে ব্রানফার্ট

মনে মনে ভাবছি যে বিপদ হল নাকি কোনো। না, সেরকম কিছু নয়। আরো কিছুটা সময় অতিবাহিত হওয়ার পর দেখলাম দূরে সামনের টিলাটার আড়াল থেকে কিছু গোলাকার বস্তু নড়াচড়া করছে। কিছুটা সামনে আসতেই মনে হল যেন মনোজদায়েরা ফিরে আসছে। কিন্তু ভালো করে ঠাওর করবার আগে উড়ো মেঘ কোথা থেকে ক্ষিপ্রবেগে এসে সর্বত্র ঢেকে ফেলল। বাইরে বসে চা আর পকোড়া সহযোগে চারপাশের বরফে ঢাকা ভূস্বর্গের সৌন্দর্য উপভোগ করছিলাম। হঠাৎ করে তাতে ব্যাঘাত ঘটিয়ে দিল উটকো মেঘ। বিন্দু বিন্দু জলকণা ঝির ঝির করে ঝরে পড়ছে। দুতিন চাপান শীতের পোষাক পরেও খুব শীত করছে। অগত্যা খাবারের প্লেট নিয়ে তাঁবুর মধ্যে ঢুকে গেলাম। মিনিট দশ পনের বাদে মেঘ দূরীভূত হলে আবার সূর্য্যী মামা মৃদু হাসি মুখে আবির্ভূত। পুনরায় বাইরে গিয়ে বসি। এতক্ষণ পর টীলার পেছনের ছায়া স্পষ্ট হয়। কিংশুকদাদারা নিজেদের মধ্যে কিছু গভীর বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে করতে তাঁবুর দিকেই ফিরছে। জানতে পারলাম যে মানালি পাসের কাছে বরফের স্তর এত পুরু হয়ে জমে আছে যে সেপথে আরোহণ করে হিড়িম্বা টেম্পলের দিকে গমন করা বিপজ্জনক। ফেরার অন্য কোনো পথ আবিষ্কার করতে হবে।

র‍্যাম্বোর ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলাম সময় সাড়ে সাতটা। মজার বিষয় তখনও সম্পূর্ণরূপে দিনের আলো বিরাজমান। মনের অজান্তেই দূরে পরিষ্কার নীল আকাশের পানে তাকিয়ে তৃপ্তি বোধ করছি আর ভাবছি কাশ মা-বাবাকে ভিডিও কল করে যদি এই অপরূপ দৃশ্য দেখাতে পারতাম ! কে জানে বাড়িতে ততক্ষণে সন্ধ্যে পেরিয়ে রাত হব হব। কারণ, জুন মাসে সন্ধ্যে নামে ছয়টা-সাড়ে ছয়টার মধ্যেই। পাহাড়বাসিদের কাছে খুব ভোরেই যেমন সকাল হয়ে যায় তেমনি খুব তাড়াতাড়ি রাত আসে না। এখানে আটটার আগে সন্ধ্যে নামে না। যাইহোক, দুদিন আগেই ফোন বাবাজী দেহত্যাগ করেছে। তাকে পুণরায় জীবিত করবার চেষ্টা যে করিনি তা কিন্তু নয়। কিন্তু কয়েকজনের কাছে পাওয়ার ব্যাঙ্ক থাকলেও তারা কাউকে দিতে নারাজ। আমি তো সরল মনে একজনকে বলে তৎক্ষণাৎ প্রত্যক্ষিত হয়ে যথেষ্ট লজ্জা বোধ করেছি। আর সত্যিই তো কেন দেবে তারা? বাড়িতে টেবিলে পাওয়ার ব্যাঙ্কটাকে অগ্রাহ্য করে ফেলে এসেছি। কাজেই ভুগতে তো হবেই আমাকে। র‍্যাম্বোর পাওয়ার ব্যাঙ্কে প্রথম দিনই চার্জ করেছিলাম। সে তাকে এত অপব্যবহার করেছে, সেটাও গতরাত্রে দেহত্যাগ করেছে মাইলিথালের তাঁবুতে।

একদিকে কিচেন টেন্টে খাবারের আয়োজন চলছে, প্রায় সকলেই উত্তাপের লোভে সেখানে আসন গেঁড়ে বসেছে, অন্যদিকে ঐ দুর্গম স্থানে যেখানে ধারেকাছে কোনো গাছেদের দেখা নেই সেখনে সুরেশ জী এক পাঁজা জুনিফার গাছ উপড়ে এনে বনফায়ারের আয়োজন করছেন। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, “সুরেশ জী আপ ইতনা ফায়ারউড কাহা সে লায়ে, আসপাস তো অ্যাইসা কুছ দিখাই নহি দে রহা হ্যায়?” সুরেশ জী হাসতে হাসতে উত্তর করল, “বগলকে পাহাড়সে লায়া স্যার। সুখা নহি। আগে কাচ্চা-সুখা জো মিলা উখড়কে লে আয়া।” এই প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় এতটা পাহাড়ি পথ অতিক্রম করে তিনি পাশের পাহাড় থেকে মাথায় করে এক বোজা জুনিফার গাছ উপড়ে এনেছেন। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান বেড়ে গেল। তিনি একটা কুলাহড়ি দিয়ে বনগাছগুলোকে ছোটো ছোটো করে কাটতে লাগলেন। দেখে মনে মনে কষ্ট হল, আমি বললাম, “মেরেকো দিজিয়ে ম্যায় ভি থোড়া প্রয়াস করে।” তিনি সেই আগের মতো হাসি দিয়ে বললেন, “স্যার, আপসে নহি হো পায়েগা। বহত হার্ড চিজ হ্যায় এ। দেখনে মে লাগ সকতা হ্যায় বহত আসানিসে আপ কর লোগে, লেকিন কাচ্চা জুনিফারকা ঝাড়ি একদম আমরুদ পেড় সে ভি য়াদা শক্ত হ্যায়।” আমি কিছু না বলে তাঁর হাত থেকে কুঠারটা কেড়ে নিয়ে জুনিফারের জঙ্গলগুলোকে কাটতে লাগলাম। মিনিট দশ পনের করার পর বুঝলাম হাতে ফোসকা পড়েছে, সত্যিই গাছগুলো খুবই শক্ত। তাদেরকে টুকরো টুকরো করতে যথেষ্ট কায়িক পরিশ্রম করতে হল।

পরদিন খুব ভোরে দিনের আলো উঁকি মারতেই ঘুম ভেঙে গেল, সতেজ শীতল পাহাড়ি বাতাসের গন্ধে আমাদের তাঁবুটা ভরে উঠলে আর শুয়ে থাকতে পারলাম না। ঠাণ্ডার ভয়ে স্লিপিং ব্যাগের মধ্যেই শুয়ে শুয়ে আধো আলো আধো ছায়াময় তাঁবুর পৃথিবীর সৌন্দর্য উপভোগ করছিলাম। উঠে পড়লাম, ঝটপট চোখেমুখে বরফগলা জলের ঝাপটা দিয়ে গরমের পোশাক জড়িয়ে কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে পড়লাম। কনকনে বাতাস ছুটে এসে নাকে ধাক্কা মারতেই লাগাতার হাঁচি দিতে শুরু করলো। নাকাল হয়ে একটা গ্লাস নিয়ে ছুটে গেলাম রান্নার তাঁবুটার কাছে। বুদ্ধিজি চা খেতে খেতে বলল, “আপ তুরন্ত চা পি লিজিয়ে, দাবাই কা কাম করেনা।” গ্লাসটা বাড়িয়ে চা নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরলাম। সন্দীপণ ডাক দিল যাত্রা শুরু করা হবে। তড়িঘড়ি ফিরে এসে গোগ্রাসে দুটো রুটি আর সব্জী সাঁটিয়ে নিলাম।

তারপর মনোজদা আর আমি তাঁবুগুলো খুলে ফেললাম। সকাল ৮ টার মধ্যেই মানালি পাস পাসের কাছে খানপাড়ি ডিব্বা পৌঁছে আবার ফিরে আসতে হবে। যাত্রা শুরু হয়ে গেল ঘড়িতে তখন কাঁটায় কাঁটায় ছয়টা বাজে। রাস্তা তেমন দুর্গম নয়। তবে মাঝে মাঝে বরফের রাস্তা যেগুলো পেরোতে বেশ কিছু জনকে নাজেহাল হতে হচ্ছে। কয়েকজন তো পিছলে গিয়ে বরফ কাপড়ে চোপড়ে করে ফেলছে। এদিকে দ্রুত পথ অতিক্রম করার জো নেই, নইলে আবার পেছন থেকে শব্দবাণ ছুটে আসবে “হিরোগিরি করতে এসো না, এটা পাহাড়”। যাহ সালা ! মুক্তি আজাদি স্বাধীনতার খোঁজে পাহাড়ে এসেছি সেখানে কাটি করার মত লোক থাকবে, তা কখনো স্বপ্নেও ভাবেনি। যাই হোক, অগত্যা কি আর করার, ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছি পাহাড়ের চূড়ার দিকে। যত উপরের দিকে এগোচ্ছি তত দৃষ্টি পথের বাধা দূরীভূত হতে থাকছে।

একটু একটু করে পাহাড়ের চূড়া অর্থাৎ খানপাড়ী ডিব্বার দিকে অগ্রসর হচ্ছি পৃথিবীকে যেন নিচের দিকে যেতে দেখছি। প্রকট হচ্ছে চারপাশের পীরপাঞ্জল পর্বতমালার পর্বতসকল সব একটু একটু করে উন্মোচিত হচ্ছে। আবেগে আপ্লুত হয়ে পাগলের মতো ছুটছি একবার এদিকে তো একবার ওদিকে। কি অপরূপ দৃশ্য। ছবির বইয়ের দেখা দৃশ্যগুলো চোখের সামনে এত জীবন্ত এত প্রাণবন্ত যে মনে হচ্ছে এখনো স্বপ্নের জগতে। পাহাড়ের গায়ে বরফ আলগা হয়ে শুকনো মরা ঘাসগুলো একটু একটু করে জিইয়ে উঠছে। যত্র তত্র হীরের মতো স্বচ্ছ শুভ্র পাথরের টুকরো গুলো ছড়িয়ে। তাদের কিছু কিছু দুহাতে কুড়িয়ে ব্যাগের সাইড পকেট ভর্তি করছি।

সকালে রোদ্রের তেজ জোরালো না থাকায় হাঁটতে বেশি পরিশ্রম বোধ হচ্ছে না। মানালি পাসের কাছে পৌঁছাতেই সামনে পিছনের সব আবরণ আলগা হয়ে পৃথিবীর সৌন্দর্য বেরিয়ে এলে। মনে হল যেন বিরাট এক গুপ্তধনের হদিস পেয়ে গেলাম। একদম নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে কিন্তু মনটা যেন এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে।‌ আটকে রাখতে পারছি না তাকে। আর মিনিট পাঁচেক এগোলেই চূড়ায় পৌঁছে যাব। অবশেষে পাহাড়ের একদম টপে উঠে পতাকা উত্তোলন হল, ছবি তোলা হল।

প্রত্যেকটা পাথরের ঢিবির কাছে গিয়ে ভারী ভারী একটা করে পাথর চাপিয়ে দিচ্ছি আর পাগলের মতো ছুটছি। সন্দীপণ মুঠোফোনে বন্দী করে চলছে সেই দৃশ্য। খানপাড়ি ডিব্বা থেকে থ্রী সিক্সটি ভিউ পাওয়া যায়। ডাইনে বামে যেদিকে তাকাই সেদিকেই যেন কেউ রঙ তুলি দিয়ে ধূসর শুভ্র বরফের পাহাড় এঁকে দিয়ে চলে গেছে। কোনোদিনই ভাবিনি এই অবিস্মরণীয় মুহূর্তের সাক্ষী হতে পারব। গতবছর হেমকুণ্ড অভিযানে গিয়ে ঠিক এমন অনুভূতি হয়েছিল। তবে সেখানে সামিটের কোনো ব্যাপার ছিল না, পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছানোর কোনো পরিকল্পনা ছিল না, হেমকুণ্ডের গুরুদ্বারাতে পৌঁছে বরফগলা জলে স্নান করে প্রার্থনা করেই ফিরে এসেছিলাম। তবে, পাহাড়ের সৌন্দর্যের সর্বশেষ পর্যায় বোধহয় একবারে চূড়ায় পৌঁছে থ্রী সিক্সটি ভিউ পাওয়া। যেদিকে তাকায় তীরের ফলার মতো পর্বতের মাথাগুলো নীলাকাশ ভেদ করে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে তাদের শ্বেতশুভ্র চাদর জড়ানো। এত অপূর্ব এত মনমুগ্ধকর সে অভিজ্ঞতা কখনো ভাষায় ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। প্রত্যেকেই এত খুশি এত আনন্দিত যেন পাহাড়ও সেই আনন্দের সাক্ষী হতে তার শোভা বর্ধন করে যাচ্ছে। একটু একটু করে সেও যেন সতেজ প্রাণবন্ত হয়ে উঠছে।

বাকিরা সকলে আনন্দে আত্মহারা হয়ে কেউ রিলস্ বানাচ্ছে বরফের ওপর তো কেউ ভিডিও করছে। কেউ কেউ আবার ভিডিও কল করে আত্মীয় পরিজনের সাথে খুশির মুহুর্ত ভাগ করে নিচ্ছে। কিংশুক দাদা ডাক দিল সবাইকে নামতে হবে। মানালি পাস পাসের কাছে বরফের এত পুরু আস্তরণ জমে গেছে যে ঐ পথে নামতে গেলে একটা কিছু অঘটন ঘটে গেলে আমাদের নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। তাই রে পথে অবরোহন করেছিলাম সেই পথেই আরোহন করতে হবে। সকলে নীচের দিকে নামতে শুরু করেছে।

ভাবতেই মনে মনে খুব কষ্ট হল। কাশ আমার ফোনটা জীবিত থাকলে বাবা মাকে ভিডিও কল করে দেখাতে পারতাম। হঠাৎ কি মনে হল এক ছুটে একটু উপরে উঠে ফোনটা বের করে অন করলাম অন হয়ে আবার অফ হয়ে গেল। দ্বিতীয়বার চেষ্টা করলাম ফোন রেড সিগন্যাল দিয়ে ১ পার্সেন্ট চার্জ দেখালো। এদিকে নীচে থেকে ডাক আসছে “এই চলো চলো সবাই জোরে পা চালিয়ে চলো।” আমি ১ পার্সেন্ট চার্জ নিয়ে ভিডিও কল করে বাবা মাকে সেই অপরূপ সৌন্দর্য শেয়ার করলাম। বাব-মা একসাথেই আগ্রহ সহকারে দেখল। তারাও ভীষণ খুশি হল।২০-৩০ সেকেণ্ডের মধ্যেই ভিডিও কল হতে হতে অফ হয়ে গেল। তবুও এক অপার ত তৃপ্তিবোধ করলাম। মনে হল যেন মানালি পাস সামিট এইবার সম্পূর্ণ হল। কয়েক মুহূর্তে জন্য জীবনের সার্থকতা অনুভব করলাম।

যে পথে এসেছিলাম ঠিক সেই পথেই নীচের দিকে অগ্রসর হচ্ছি। বুদ্ধিজিকে শুধিয়ে জানতে পারলাম মাইলি থাল পৌঁছে রাস্তা পরিবর্তন করে একেবারে সরাসরি খাড়াইভাবে মানালি শহরে নামা হবে। তবে একদিনে হবে বলে তো মনে হয় না, প্রয়োজনে একটা রাত জঙ্গলে কাটাতে হতে পারে। একদিনে ১৪০০০ ফুট নীচে আরোহণ করা যে একেবারে অসম্ভব তা ঠিক নয়, তবে আমাদের লোকাল রাস্তা জানাও নেই, তাছাড়া একই গতিতে সকলের পক্ষে নামা সম্ভব ও নয়। তবে, ওঠার সময় সময় ও কায়িক শক্তি অত্যাধিক ব্যায় করতে হয়েছিল। নামার ক্ষেত্রে সেটা আর নেই। কম সময় দ্রুত আরোহণ সম্ভব। তবে, খেয়াল রাখতে হয় রে হাঁটতে বা পায়ের গোড়ালিতে যেন কোনো আঘাত না হয়। সকলে সারি সারি লাইন ধরে চলছি সেই একই পথে। রানিসুই লেককে পিছনে ফেলে ঘণ্টা তিনেক বা তারও একটু বেশির মধ্যেই পৌঁছে গেলাম মাইলি থাল। আবহাওয়া একদম পারফেক্ট। মেঘে ঢাকা। রোদ্দুরের তেজ মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে। রোদ্দুর থাকলে কম সময়ে বেশি পথ অতিক্রম করা সম্ভব হবে না, ডি-হাইড্রেশনও হতে পারে।

মাইলি থালে পৌঁছে একটু বিশ্রাম নিয়ে উত্তর পশ্চিমে রাস্তা ধরা হল এবং সেই দিকেই অগ্রসর হয়ে চলেছে সকলে। কম করে আরো ১০০০-২০০০ ফিট চলার পর খাড়াই একটি পাহাড়ের কাছে এসে তাওজি বুদ্ধিজি সকলে থেমে গেল। আমরাও সেখানে গিয়ে বসে পড়লাম। বুঝলাম রাস্তা গুলিয়ে ফেলেছে শেরপা। বুদ্ধিজি কিংশুক দাদাকে বলল “কিংশুক সায়াদ হামলোক গলদ রাস্তা পকড় লিয়া। ফিরসে ওপাস জানা পড়েগা সায়দ। চল দুসরে জঙ্গলকে রাস্তা ধুন্ডকে যাতে হ্যায়।” ওখানে সকলে মিনিট দশেকের জন্য বসে পড়ল। এদিকে সন্দীপণ আর চলতে পারছে না। ছেলেকে বললাম তোমার ব্যাগটা আমাকে দাও। সে লজ্জায় বোধহয় আমাকে অবজ্ঞা করে বলল। না না ঠিক আছে তবে দ্রুত হাঁটতে পারছে না। পিঠে ব্যাগ নিয়ে একেবারে ঘেমে নেয়ে স্নান হয়ে গেছে। সকলেই পিঠে ব্যাগ নিয়ে অবরোহণ আরোহণ করছি। তাই ঘর্মাক্ত হওয়া খুবই স্বাভাবিক। সন্দীপণের শারীরিক অবস্থা নিয়ে বেশি মাথা ঘামালাম না সেকারণে। তাওজি নতুন রাস্তা খুঁজে সকলকে সে পথ অনুসরণ করতে বললেন। আমি মধ্যমণি হয়ে চলছি। জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করতেই ঘন গাঢ় অন্ধকার ছেয়ে এল। সেখানে দিনের আলো প্রবেশ করতে পারে না। এক হাঁটু শুকনো পাতার সমুদ্র সেখানে। তবে সেখানে প্রচুর বন্য স্ট্রবেরী ফলের গাছ ছিল। পথের দুধারে হাজার হাজার লাল হলুদ পাকা পাকা বন্য স্ট্রবেরী, মালবেরী ফলে আছে। বুদ্ধিজিকে জিজ্ঞেস করলাম, “বুদ্ধিজি এ ফল হাম খা সকতে হ্যায়? দেখনে মে তো আচ্ছা স্বদেষ্ট লাগতা হ্যায়। “বুদ্ধিজি একটা পাকা ফল তুলে নিয়ে মুখে দিয়ে বলল, “জি জি এ ফল বহুত স্বদেষ্ট হ্যায়। আপ বিলকুল খা সকতে হো। লেকিন জ্যাদা খা লোগে তো পেট কা প্রবলেম আ সকতা হ্যায়।” বুদ্ধিজির কথা শেষ হওয়ার আগেই দুহাতে যেদিকে যত পাকা টকটকে লাল, হলুদ বন্য স্ট্রবেরী, মালবেরী তোলা যায় তুলেই সরাসরি মখে পুরে দিচ্ছি। ধোয়ার কোনো গল্প নেই। ছেলেবেলার স্মৃতি ভেসে আসছে, জঙলি ফলগুলো খেয়ে এক অপার তৃপ্তি বোধ করছি। আমার দেখা দেখি কয়েকজন পাকা রসালো ফল ছিঁড়তে শুরু করে দিল।

জঙ্গলের পথ পেরিয়ে এক বিশাল ঢিবির সামনে এসে একটু থেমে গেলাম। বৃষ্টি বাবাজীবন আর থাকতে পারল না, হুড়মুড়িয়ে নেমে এল। পঞ্চুটাকে খুলে ঝেড়ে নিয়ে গায়ে চপিয়ে দিলাম, দু এক পা যেতে না যেতে বৃষ্টি থেমে গেল। আবার তাকে ব্যাগে পুরে নিলাম। পথচলা শুরু হল আবার। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে অনেক নীচে একটা ঘন জঙ্গল একেবারে সোজা নীচে নেমে গেছে। পাইন, ফার, সিডার, স্প্রুস গাছের বিশাল সারি, মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে যুগ যুগ ধরে। সম্ভবত সেই জঙ্গলেই প্রবেশ করতে হবে। তাতেই ঘোর অনর্থ হল। জঙ্গলের মধ্যে কিছুটা পথ আরোহণ করার পর, পথভ্রান্ত হলাম। কিছুপর একে একে সকলে একত্রিত হলে বুদ্ধিজি কিংশুক দাদার সাথে কিছু একটা পরামর্শ করল এবং সকলকে বলল যে রাস্তা গুলিয়ে গেছে নীচে কোথাও ভালো একটা জায়গা পেলে সেখানেই তাঁবু খাটানো হবে। আজ কোনোভাবেই একেবারে নীচে নামা সম্ভব হবে না। অগত্যা কি আর করা যাবে। এদিকে জঙ্গলের খাড়া পথে আরোহণ করে সন্দীপণের অবস্থা কাহিল। সে না পারছে অবরোহণ করতে না পারছে আরোহণ করতে। নীচে নামার সময় কোনোভাবে তাঁর পায়ের মাংসপেশিতে খিঁচ ধরেছে, হাঁটুতে খুব আঘাত পেয়েছে বেচারা। বাবাইদা নীজের বোঝাটা খচ্চরের পীঠে চাপিয়ে সন্দীপণের লাগেজটা নিয়েছে। সন্দীপণ কখোনো বাবাইদায়ের হাত ধরে নামছে তো কখোনো কিংশুকদায়ের। সকলে ভীষণ চিন্তিত। বেচারা নীচে পৌঁছাতে পারবে তো।

ঘণ্টা দুয়েক অতিবাহিত হল। বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে। শুকনো খাবার শেষ হয়ে গেছে। সকলেই খুব ক্ষুধার্ত। কাছাকাছি জলের সন্ধান চলছে। জল পেয়ে গেলেই সেখানে তাঁবু গাঢ়া হবে। কিছু পর একটি জায়গা পাওয়া গেল, বড়ো বড়ো পাহাড়ি বনগাছে ভর্তি, কাছেই ঝরনার জল চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে। এর থেকে ভালো জায়গা হয়তো আর পাওয়া যাবে না ভেবে সেখানেই তাঁবু লাগানো হল। তাওজিকে জিজ্ঞেস করে জানলাম জায়গাটা ব্রানফার্ট নামে পরিচিত। সেখানে কিছুটা জায়গা বিরাট বিরাট সাদা সাদা পাথরের ঢাকা। সেকারণে কেউ কেউ এই জায়গাটাকে দুদুপাত্থর বলেও অভিহিত করে থাকে।

জঙ্গল পরিষ্কার করে ব্রানফার্টেই রাত্রিযাপনের আয়োজন করা হল। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে বুদ্ধিজি পিঁয়াজি আর আলুর পকোড়া সহযোগে চামুড়ি পরিবেশন করল। খেতে খেতেই আশেপাশে ঘোরা হল। পাশেই একটু নীচে দুটো তাঁবু ফেলা, বুদ্ধিজির চেনা লোক। গোরু মহিষ চড়াতে এসেছিলেন। ঐদিন বকরিঈদ, কিছু গবাদিপশু সরবরাহ দিতে হবে বলে কয়েকদিন ধরে সপরিবারে সেখানে থাকছেন ভদ্রলোক। আমাদের দেখতে পেয়ে নিজেই আলাপ করতে চলে আসলেন। খুব রসিক মানুষ। গায়ে প্রচণ্ড জোর, প্রচুর পরিশ্রম করেন। রোজ প্রায় পাহাড়ের ওপরে ওঠেন এবং নামেনও। গল্প করে খুশী হয়ে যাবার সময় সকলকে নেমন্তন্ন করে গেলেন। খাঁটি দুধের চা খাওয়াবেন সকলকে। কয়েকজন তো চায়ের সাথে ভেড়ার মাংস খাবার লোভে ঘণ্টাখানেক পরেই ভদ্রলোকের তাঁবুতে হাজির হল, কিন্তু মুখটা বেজায় করে, চা খেয়েই তাদেরকে ফিরে আসতে হল। শুনলাম ভদ্রলোক কতকগুলো ভেড়া-ছাগল ভাগিয়েছেন ঠিকই কিন্তু কিছু মাংস রেখে বাকি নীচে পাঠিয়ে দিয়েছেন।

ক্যাম্পফায়ারের ব্যবস্থা চলছে। হাতাহাতি করে কিছু শুকনো কাঠ কাটলাম। খুব ক্লান্ত লাগছে। মনে মনে ভাবছি কখন যে রাতের খাবার খেয়ে স্লিপিং ব্যাগে গ্যারেজ হয়ে যাব। অনিরুদ্ধদাদার সাথে বেশ জমিয়ে গল্প করার অবসর পেয়ে গেলাম। অনেক কথোপকথন হল। হাড় হিম করা ঠাণ্ডা না পড়লেও আন্দাজ মতো ৮ থেকে ৯ ডিগ্রী তো হবেই। হু হু করে শীতল বাতাস বইছে। বনফায়ারের কাছে বসে আগুন পোহাচ্ছি। তাওজি, রমেশজি হিন্দি হিমাচলি মিশিয়ে নানা কাহিনি শোনাচ্ছেন। সে এক স্বর্গীয় অনুভূতি, এক মায়াবী সুন্দর রাত। সারাদিন যাত্রা করে অবসাদের কোনো লেশমাত্র নেই। কে জানে যখন ব্যস্ত শহরের ভীড়ে হারিয়ে যাব, এই স্মৃতিচারণ করে পুণঃ পুণঃ ফিরে আসবো মানলি পাসে, ফিরে আসবো রানিসুই লেকে অথবা ফিরে আসবো ব্রানফার্টে। সাড়ে আটটা নটা নাগাদ রাতের খাবার খেয়ে নিদ্রা মগ্ন হলাম। পরদিন নীচে ফিরতে হবে। বুদ্ধিজির স্ত্রী আমাদের জন্য দেশি পাঁঠার মাংসের ঝোল রান্না করে বসে থাকবেন। কব্জী ডুবিয়ে তৃপ্তি করে খাবো।

(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)

লেখকের অসহযোগিতায় এই লেখাটি সম্পূর্ণ করা সম্ভব হল না, তার জন্য বিশেষভাবে দুঃখিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *