অরিত্রী দে
ষষ্ঠ পর্ব
ঔপনিবেশিক কলকাতার নিকাশি পরিবেশ
১
The drains were unpaved and coolies had to be continually employed in digging out the black mud and filth.
-নিকাশি নালার এই চেহারার বর্ণনায় ঔপনিবেশিক সমাজেতিহাসের কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারবার আছে। ১৬৯০ সালে কলকাতার ভূখণ্ডে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আগমনের পর কুঠিয়াল জব চার্নক হুগলি নদীর তীরে জলাভূমি বেষ্টিত সুতানুটি নির্বাচন করেছিলেন কোম্পানির কুঠি স্থাপনের জন্য। তখন জায়গিরদার সাবর্ণ রায়চৌধুরী সসম্মানে বর্তমান। ১৬৯৮ সালের ১০ নভেম্বর নাগাদ কোম্পানি তাঁর কাছ থেকে সুতানুটি, কলিকাতা আর গোবিন্দপুর গ্রামের প্রজাস্বত্ব ইজারা নেয়। পরে ১৭১৭ সালে ফারুকশিয়রের ফরমানে গ্রামের জমিদারিসত্ত্ব কেনার অধিকার অর্জন করেছিল। পরবর্তী চল্লিশ বছরের মধ্যে পলাশির যুদ্ধ আর ‘নবাব’ শব্দ জাত ভাবভঙ্গির জনপ্রিয়তা ইংরেজদের পেয়ে বসে। ক্রমে মীরজাফরের দৌলতে চব্বিশ পরগনার জায়গির লাভ, বক্সারের যুদ্ধে জয়লাভ, শাহ আলমের থেকে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার রাজস্ব আদায়ের অধিকার অর্জন নতুন নবাব-শাসক তৈরি করল। এই নতুন নবাব-শাসকদের জন্যই কলকাতা হয়ে উঠছিল অন্তত উনিশ শতক পর্যন্ত। বলা যায় সিপাহী বিদ্রোহের কাল অবধি কলকাতার শৈশব দশা কাটছিল, অনেক কিছুর সঙ্গে তৈরি হচ্ছিল শ্রেণি বৈচিত্র্যও। কার্যত ভারতের পূর্ব সীমান্তে ইস্ট ইন্ডিয়ান কোম্পানির শাখা স্থাপন করে তাকে নিজের শর্তে নিয়ন্ত্রণ করতে পারার প্রতি চার্নকের উচ্চাকাঙখা বর্তমান কলকাতা শহর তৈরিতে ভূমিকা পালন করেছিল। ১৭৫৭ সালে শহরকে নতুন করে সাজানোর কথা ভাবেন হলওয়েল সাহেব। হুগলি নদী বরাবর তিনটি গ্রাম- সুতানুটি, কলিকাতা আর গোবিন্দপুরের একদিকে নদী আর তিনদিকে জলা ও জঙ্গল। কেবল উঁচু ফাঁকা ডাঙা এলাকায় ঘর বসতি ছড়িয়ে ছিল। ইতিমধ্যে কর্ণওয়ালিশের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের (১৭৯৩) মাধ্যমে জঙ্গল কেটে প্রচুর অনাবাদি জমিকে আবাদযোগ্য করে তোলা হয় আর তাকে কেন্দ্র করে স্থায়ী বসতি গড়ে ওঠে। ১৮০৯-১৮৩৬ সালের মধ্যে লর্ড ওয়েলেসলির উদ্যোগে লটারি কমিটির মাধ্যমে রাস্তাঘাট তৈরি হতে থাকে। যদিও সাতের দশকের পর রাস্তা পরিসর ও পরিমাপগত দিক থেকে বাড়ে। এসব অবশ্যই নগর উন্নয়ন প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত, যার স্বার্থে কাজ করেছিল উক্ত কমিটি।
২
কোম্পানির বাণিজ্যের শুরুতে গঙ্গা নদী থেকে গোয়ালন্দের কাছে ব্রহ্মপুত্র ও চাঁদপুরের কাছে মেঘনা নদী দিয়ে পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষিত হত। আবার উত্তর-পশ্চিম থেকে যাত্রী ও পণ্য নদীয়া হয়ে গঙ্গার শাখা ভাগিরথী, জলঙ্গি ও মাথাভাঙ্গা দিয়ে পরিবাহিত হত। শাখা নদী তিনটির মিলন স্থল হুগলি নদী। এটা ঘটনা যে কোম্পানি পলি সরানোর ব্যবস্থা করে বাষ্পীয় ইঞ্জিন চালিয়ে জলপরিবহণ ব্যবস্থাকে সুগম করে তুলেছিল। গোটা শহরে খনন করেছিল প্রচুর খাল, পানীয় ও নিকাশি ব্যবস্থা দুয়ের জন্যই। হুগলি নদীর পূর্ব তীরে অবস্থিত কলকাতার প্রাকৃতিক ঢাল ছিল লবণহ্রদ অভিমুখী। অথচ তার নালাগুলোর গতিপথ ছিল গঙ্গার দিকে। আবার কলকাতার চেয়ে উঁচু ভূ-পৃষ্ঠে রয়েছে গঙ্গা। ফলে বৃষ্টি বা জোয়ারের সময়ে ওই নালাপথে জল ঢুকে পড়লে নগর কলকাতা বাটির মতো জলে ডুবে যেত। মশা, মাছি, মহামারীর প্রকোপ এই কারণে শুরু থেকেই ছিল। ১৮০৩ সালে পঞ্চম গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়েলেসলির চোখে বিষয়টি ধরা পড়লে তাঁর প্রস্তাব অনুযায়ী একটি উন্নয়ন কমিটি গঠিত হয় (১৮০৪)। সেখানে প্রস্তাবিত হয়- বর্ষার সময় গঙ্গার জলস্তর ও নর্দমাগুলির জলস্তর পার্থক্য নির্ণয় করা অবশ্য কর্তব্য। সেই সঙ্গে ঠিক হয় কলিকাতার বিভিন্ন অঞ্চলের ভূপৃষ্ঠের উচ্চতার পরিমাপ করে সেই অনুযায়ী নিকাশি নালা নির্মাণ করতে হবে এবং কলিকাতা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের আবর্জনা নিকাশে উপযুক্ত নিকাশি ব্যবস্থার পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। এই সময়ে লটারি কমিটি ব্যয়ভার বহন করে প্রকল্পটিকে বাস্তব অভিমুখী করে তোলে। এমনকি বেলেঘাটা খাল খনন, এলিয়ট পুষ্করিণী খননও সম্পন্ন হয় কমিটির অভিভাবকত্বে।
১৮২০ সালে চাঁদপাল ঘাটে বিশুদ্ধ জল সরবরাহের জন্য একটি পাম্পিং স্টেশন গড়ে তোলা হয়। কিন্তু সেখান থেকে জলসরবরাহ চলত বাছা কিছু এলাকায় (ধর্মতলা, পার্কস্ট্রীট, চৌরঙ্গী, লালবাজার, বউবাজার)। আগের কিস্তিতে রানাল্ড মার্টিনের নাম করা গেছিল, প্রথম তিনিই কলকাতার টোপোগ্রাফি তৈরি করেন। এর গুরুত্ব এইখানে যে নেটিভরা নগর কলকাতার যে অংশে বাস করত, সেখানকার ভূ-প্রকৃতি, আবহাওয়া, স্বাস্থ্য, স্যানিটেশন নিয়ে পরিবেশ আর সমাজের আন্ত:সম্পর্কীয় পাঠ নির্ণয় করা গেল। পরে তা ‘ফিভার হাসপাতাল’-এর কার্যক্রমে বিশেষ সহায়ক যেমন হয়েছিল, তেমনি তাঁর ‘Notes on Medical Topography of Calcutta’ গ্রন্থে শহর কলকাতার নিকাশী ব্যবস্থা সম্পর্কেও সচেতন সমীক্ষার পরিচয় মেলে। ফিবার কমিটিতে পুরসভার তরফে নিকাশী নালা সম্পর্কে বেহাল পুতিগন্ধময় অবস্থার কথা জানানো হয়েছিল। নালাগুলির ‘আউটলেটে’র ব্যবস্থাও ছিলনা। নালা ভরে গেলে উপচে পড়ে রাস্তাঘাটের দুর্দশার অন্ত থাকত না। সমস্যা মেটাতে শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত উত্তর ও দক্ষিণে প্রবাহিত একটি খাল এবং তার পাশে প্রধান নর্দমার এমন নকশার আশু প্রয়োজন ছিল, যাতে পরিস্থিতি অনুযায়ী হুগলি বা সল্টলেক- উভয় দিকেই প্রবাহিত হতে পারে। এই প্রেক্ষিতে স্যানিটারি ইঞ্জিনিয়ার উইলিয়াম ক্লার্ক ১৮৫৫ সালে যুগান্তর আনলেন। আগে লেনিন সরণি (অ্যাভিনিউ) নর্দমার মতো ইট নির্মিত নর্দমা ছিল। তিনি পাঁচটি ভূগর্ভস্থ পয়:প্রণালীর মাধ্যমে শহরের বর্জ্য লবণ হ্রদে নিয়ে যাওয়ার প্ল্যান কষলেন এবং কার্যত এক নতুন নিকাশী ব্যবস্থার দিক উন্মোচন করেন। সেই মতো ড্রেনেজ কমিটি গঠন করা হয় (১৮৫৬) ও পরিকল্পনাটি অনুমোদিত হয়ে ১৮৫৯ সালের ২০ শে এপ্রিল থেকে কাজ শুরু হয়। শোভাবাজার স্ট্রিট থেকে ধর্মতলা (মৌলালি) মোড় পর্যন্ত আপার সার্কুলার রোড (বর্তমানে এপিসি রায় রোড) বরাবর দুটি প্রধান নর্দমা নির্মাণ করা হয়, যেখানে এটি লোয়ার সার্কুলার রোড (বর্তমানে AJC) বরাবর আরেকটির সাথে যুক্ত হয়। টালির নালা মৌলালি মোড় পর্যন্ত আসছিল। সঙ্গে একটি প্রধান আউটফল নর্দমা ছিল এই সম্মিলিত প্রবাহকে পামার’স ব্রিজ পাম্পিং স্টেশনে (PBPS) পৌঁছে দেওয়ার জন্য। দীর্ঘকাল উপযুক্ত বিজ্ঞানসম্মত পয়:প্রণালীর অভাবে নেটিভরা কলেরা, আন্ত্রিকের মতো রোগে ভুগত। ঊনবিংশ শতাব্দীর ছয় থেকে আটের দশকের মধ্যে কলকাতার হাতে গোনা বাড়িতে বিশুদ্ধ পানীয় জল আনার ব্যবস্থা এবং এলাকার কঠিন বর্জ্য চক্ররেলের মাধ্যমে শহরের বাইরে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কোম্পানির বণিকদের অধিকাংশই স্বার্থের বাইরে বেরিয়ে কলকাতার ভূপ্রকৃতি, জলবায়ুর ভঙ্গি বুঝতে চায়নি প্রথমদিকে।
৩
অষ্টাদশ শতকের শুরুতে (১৭০৭, ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পরে) কলকাতার জমি জরিপের যে হিসেব মেলে, তাতে দেখা যায়-
বাজার কলকাতায় জলাজমি ৩ বিঘা ১২ কাঠা আর ঘরবাড়ি ৪০২ বিঘা মত।
গোবিন্দপুরে পুকুর, জলাজমি ৯ কাঠা আর ১৮ বিঘার মত। সেখানে ঘরবাড়ি ৫৭ বিঘায়। সুতানুটিতে পুকুর আর পথ ৭২ বিঘা, ঘরবাড়ি ১৩৪ বিঘায়। লটারি কমিটির উন্নয়ন প্রকল্পে স্বল্প স্থানে বাড়ি তৈরি করা হয়ে থাকে, জনসংখ্যা বাড়তে থাকলে আরো ছোট হয়ে আসে বসত বাড়ি এবং শহরের, ‘স্পেসে’র ব্যবহার বেড়ে যেতে থাকে। পরিস্ফুট হয় যান্ত্রিক মনোভাব, ল্যুইস মামফোর্ড যাকে ‘বারোক শহর ও মন’ বলে চিহ্নিত করেন। A griffin: sketches of calcutta (১৮৪৩) বইটি চৌরঙ্গির প্রাসাদ ব্যতিরেকে চুনকাম করা ঘিঞ্জি ঘনসন্নিবিষ্ট বসতির সন্ধান দেয়- “In other parts of native town the houses are covered with tiles, these houses if possible closer to one another than the flat roofed ones and have not a pleasing appearance.” উনিশ শতকের মধ্যে কলকাতায় অস্বাস্থ্যকর বস্তিও এসে যায়।
শ্রীপান্থের বর্ণনা অনুযায়ী এখন যার নাম ফ্যান্সি লেন, তা আগে বনাঞ্চল ছিল। আর তার পাশ দিয়ে যে ছোট নদী প্রবাহিত হতো, তা বুজে কিরণশঙ্কর রায় রোডে পরিণতি লাভ করেছে। কলকাতার সঙ্গে বড় রাস্তার সংযোগ ঘটে যে সার্কুলার রোডের মাধ্যমে, তা ১৭৪২ সালে খোঁড়া মারহাট্টা বা বাগবাজার খাল বুজিয়ে নির্মিত। বিনয় ঘোষ তাঁর কলকাতাকেন্দ্রিক সামাজিক গবেষণার ভিত্তিতে আমাদের জানান আঠারো শতকের চারের দশকে কলকাতায় ঘোড়ার প্রচলন হচ্ছে, তার আগে অবধি পরিবহন ও চলাচলের উপায় ছিল পাল্কিই। ১৭৯৯ সালে ওই সার্কুলার রোডের ব্যবহার শুরু হয় অর্থে ঘোড়া চলতে পারার মতো রাস্তা তৈরি হয়ে যায় তখন৷ এরপর একে একে ঘোড়ায় টানা ট্রাম আর ইলেকট্রিক ট্রাম আসে যথাক্রমে ১৮৭৩ এবং ১৯০২ সালে। তারই মাঝে ১৮৫৮ সাল নাগাদ কলকাতার রাস্তার সঙ্গে প্রথম সংযুক্তি ঘটে ফুটপাথের। স্পষ্টতই কাঁচা, কর্দমাক্ত পথ আর থাকল না; মাটির জমিই আর থাকল না তেমন করে কৃষিজমিটুকু ছাড়া। এর মাশুল গুনতে হল নগরবাসীকে। প্রাকৃতিক জলচক্রে যে জল মাটি চুঁইয়ে নেমে ভূগর্ভস্থ জলস্তরের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করে তুলত, সেই স্বাভাবিক প্রক্রিয়াই বন্ধ হয়ে গেল। আজ বিশ্ব উষ্ণায়নের যুগে আমাদের মেট্রোপলিটন শহরে গরমে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা হয়, সে এই কান্ডজ্ঞানের অভাবে। ক্লান্ত শ্রান্ত পথিক ভিজে মাটিতে খানিক জিরোতে অবধি পায়না, যদিবা খানিক বৃষ্টি হয়, পিচের রাস্তায় কয়েক ফোঁটা পড়তে না পড়তেই তা মিলিয়ে যায়। আর মাটি, গাছ, জলের সুস্থ সম্পর্কজালটিই না থাকায় বৃষ্টি আমন্ত্রণ পায় কই!
–ক্রমশ