পাঠক মিত্র
যেদিন আকাশ থেকে হারিয়ে গেল পাখিরা
‘যেদিন আকাশ থেকে হারিয়ে গেল পাখিরা ।’ প্রকৃতির নিবিড় পাঠ বা পর্যবেক্ষণ থাকলে তবেই এমন কথা কেউ বলতে পারেন । বলতে পারেন, ‘পাখি আছে বলেই আকাশটা রয়েছে / আকাশ আছে বলেই বেলুন আছে/ বেলুন আছে তাই /শিশুরা দৌড়ঝাঁপ করে বেড়াচ্ছে ।..মাটি আছে বলেই জল প্রবাহিত হচ্ছে ।’ জলের প্রবাহের সাথে সময়ের সম্পর্ক বলতে পারেন, ‘আর আছে আজ আর কাল/ রয়েছে একটি হলুদ পাখি/ আর সমস্ত রং, রূপ এবং গতি নিয়ে রয়েছে জগৎটা ।’ জগতের এমন পর্যবেক্ষণে প্রকৃতির কাছে হয়ে ওঠে যেন অতিথি অন্য সবার মতই । জগতের অতিথি । যেখানে বখে যাওয়া শিশুরা কোনোকিছুই অভিবাদন ছাড়াই নীল আকাশের দরজা যেমন খুলে ফেলে, সেরকমই কোনোরকম অভিবাদন ছাড়াই যেন জগতের পারলারে অতিথি সবাই। ঘাস, বৃক্ষ, জল আর পাখিদের অতিথি । প্রকৃতির প্রকৃত অতিথি হলেই দেখতে পাওয়া যায় তার অতি সরলতা । আর অনুভব করা যায় তার অবিরাম নানা প্রশ্ন । সেই প্রশ্নে আকাশ থেকে পাখিদের হারিয়ে যাওয়া দেখতে পান যে কবি তিনি শুনতারো তানিকাওয়া । জাপানি কবি । তাঁকে সমালোচকরা জাপানি কবিতার টি এস এলিয়ট বলেন । তাঁর নির্বাচিত কবিতার অনুবাদ গ্রন্থ ‘যেদিন আকাশ থেকে হারিয়ে গেল পাখিরা ।’ তাঁর একুশটি কাব্যগ্রন্থ থেকে নির্বাচিত চুয়াল্লিশটি কবিতা নিয়ে এই সংকলন । প্রকৃতি, প্রেম ও মৃত্যুচেতনার ভাবনার যেন এক কোলাজ এই সংকলন । যেখানে একটি কবিতায় ছোট্ট স্ফিংস পাখিকে প্রশ্নে বলেছেন, ‘তুমি তো একটি ছোট্ট স্ফিংস ।/নীরবে,/খেলছ/বা ঘুমাচ্ছ,/ গোল গোল চোখে আর তুলতুলে চিবুকে,/ অনবরত জিজ্ঞেস করে চলছ প্রশ্ন।’ ছোট্ট স্ফিংস পাখির আচরণ ও ভাষা শুধু শুনতে পাননি কবি । তিনি শুনতে পেয়েছেন সমুদ্রের ভাষা, সমুদ্রের গভীরে থাকা প্রাণের ভাষা । শুনতে শুনতে নিজের অবস্থান নিয়ে সংশয়াচ্ছন্ন হয়ে পড়েন । সেই সংশয়ে তিনি শুনতে পান সমুদ্রের কথাবার্তা । তাঁর কবিতায়-‘শুনছি সমুদ্রের কথাবার্তা ।/ বিশাল এই গ্রহের হৃৎপিন্ডটি যেন কাঁপছে ।/ অবিরাম বহমান রক্তপ্রবাহ তার ।/ শুনছি অজানা কারও কন্ঠস্বর।/ শুনতে পাই এমন একজনের গান যে-কখনও হারিয়ে যাবে না ।’ সমুদ্রের ভাষা শুধু মানুষই শুনতে পায় না । মানুষের ভাষাও সমুদ্র শুনতে পায় । সমুদ্রও মানুষকে দেখতে পায় । সে কথাই কবি তাঁর ‘সমুদ্ররূপক’ কবিতায় বলছেন, ‘এটাই নয় যে মানুষই দ্যাখে সমুদ্রকে–/সমুদ্রও তার উজ্জ্বল চোখ দিয়ে চেয়ে থাকে মানুষের পানে,/সময়ের আরম্ভবিন্দু থেকেই চোখ তার স্থির ।/ এমন নয় যে মানুষ সমুদ্রকে শোনে,/ পাতালের অসংখ্য শঙ্খের কান দিয়ে/ সমুদ্রও আজ শোনে মানুষকে ।’ এই সমুদ্রের বর্ণনায় আবার বলছেন, ‘..সমুদ্র হল সেই সমগ্রতা,/ ক্লান্তিহীনভাবে পুনরাবৃত্তিময় চিরসুন্দর এই সমুদ্র ।’ চিরসুন্দর সমুদ্রের ভাষা কবি শুনতারো তাই শুনতে পেয়েছেন, ‘সমুদ্রও মানুষের গান গায় ।/ সমুদ্র মানুষকে উদযাপনও করে ।’
সমুদ্রের গান যেমন তিনি শুনতে পেয়েছেন, তেমনই তিনি বৃক্ষের সংগীতের সুরও শুনতে পেয়েছেন । ‘গান’ কবিতায় বলছেন, ‘জলদগম্ভীর স্বরে/ আর বৃক্ষের/ সুরসংগতিতে ।/ কেউ একজন /গান শোনাচ্ছে আমাকে ।’ বৃক্ষের সংগীত সেই তো শুনতে পাবে যিনি গাছের সাথে লীন হতে পারেন । গাছের সাথে লীন হতে পারার বাসনা নিয়ে বলতে পারেন, ‘শীঘ্রই আমি একটি গাছ হয়ে যাব ।/ আমার মধ্যমা আঙুলের ডগা শিরশির করছে,/ তাতে গজিয়ে উঠছে সবুজ পাতা ।’ সারা শরীর কান্ড যখন পায়ের ওপর কাদামাটিতে দাঁড়িয়ে থাকে, তখন ব্যস্ততায় তা চোখে পড়ে না কারো । শুধু মিশে যাওয়ার আগে হাওয়ার দুলতে দুলতে মর্মরধ্বনি তুলে যায় । শুধু তাই নয় । ‘তাদের সবুজ আমাদের দৃষ্টিকে জগতের ওপারে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানায়, আর ছড়িয়ে থাকা তাদের বিশাল ডালপালাগুলো আমাদের কোলাহলময় ভবিষ্যতকে আলিঙ্গন করে । তাদের পাতার সঞ্চরণ আমাদের কর্ণকুহরে শাশ্বত প্রেমের শব্দাবলী চুপি চুপি বলে যায় ।’ গাছের চুপিচুপি এই শব্দাবলী শুনতে পেয়েছেন কবি শুনতারো । কারণ তিনি মনে করেন গাছ এক অবিশ্বাস্য সঙ্গী ।
পাখির ভাষা, সমুদ্রের ভাষা, বৃক্ষের ভাষা শুধু যে কবি শুনতে পান, সে কবি কোনো ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে আসা শব্দের ভাষা শুনতে পাবেন না, এমন হতে পারে না । তাই ধ্বংসস্তূপের ওপর রাত্রির নিস্তবদ্ধতার প্রতিধ্বনি শুনতে পান । সেই প্রতিধ্বনির মাঝে পতঙ্গের গান ভেসে আসে তাঁর কানে । পতঙ্গের সেই গানে তিনি শুনতে পান তাঁর স্মৃতির গভীরের শব্দ । যেখানে তিনি বলতে পারেন, ‘আমার স্মৃতির গভীরে/ জমাটবাঁধা/ আতসবাজি ।’ স্মৃতির জমাটবাঁধা আতসবাজির আলো-ধোঁয়ায় দূরের দেশগুলো অদৃশ্যমান হলেও মহাজগৎ তাঁর কাছে স্পষ্ট । যে জগতে মানুষ মরণশীল বলে তিনি বলেন, কোনো একদিন থেমে যাবে, হৃৎস্পন্দন । আবার ‘মুখ’ কবিতায় বলছেন, ‘হৃদয়ের রজনিতে/ শেষ সূর্যোদয়ের জন্য/ আমি অপেক্ষমাণ ।’ এভাবেই ‘মৃত্যু অব্দি এইখানে শুধু থেকে যাওয়া ।’
মৃত্যু অব্দি থেকে যাওয়া সময় কখনো রহস্যে আবৃত হয়েছে । সে রহস্যে তাঁর মনে হয়েছে বৃষ্টিও যেন কিছু একটা লুকোচ্ছে । তার উল্লেখ করেছেন কবি এভাবে, ‘মাটিতে বৃষ্টি পড়ছে টুপটাপ । এটাও কিছু একটা যেন লুকাচ্ছে । বৃষ্টি মাটিতে পড়ছে যেন তার গোপনতাকে জানাতে ।’ পরক্ষণেই বলছেন বৃষ্টির সেই গোপন সংকেত তিনি বুঝতে যেমন পারছেন না, তেমনই হৃদয়ের ছিদ্রে চোখ রেখে মেঘাচ্ছন্ন রাতের আকাশ ছাড়া আর কিছু তাঁর চোখে পড়ে না । তবুও তারপর যা কিছুই থাকে তাও কুয়াশায় একদম মিলিয়ে যায় । তারপর সবকিছুই বেড়ে হয় অন্তহীনভাবে নীল । তারপর তিনি বলেন, ‘পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে/এর পরও অনেক অনেক কিছু থেকে যায় ।’ হৃদয়ে অনেক কিছু থেকে যায় বলেই তিনি বলতে পারেন, ‘হে মোর হৃদয়, নিয়ে চলো মোরে/ দূরে, কোথাও দূরে/ দিগন্তের থেকেও কোনো দূরতর স্থানে ..।’
কবি শুনতারো প্রকৃতির একটি শাখাপ্রশাখা থেকে আর একটি থেকে আশা-ভরসা কিংবা হতাশা ছাড়িয়ে দূরে চলে যান । দূরে গিয়েও হারানো অতীত নিয়ে ভবিষ্যতের পথে খুঁজে ফেরে ভালবাসার পাঠ আর আনন্দ । তাই মন-খারাপ কেবল তাঁর নিজস্বতা । আবার সুখের পরশও তাঁর কাছে আর এক নিজস্বতা । এই নিজস্বতার প্রকাশে কখনোই উৎসাহী হন না । কবির নিজস্বতা প্রকাশ তাঁর কবিতা । কিন্তু কবি বলেন, ‘মন-খারাপ হলে আমি মন-খারাপের কবিতা লিখতে পারি না । ..সুখে থাকলেই লিখি না সুখের কবিতা ।’ কবির কবিতা আসে যখন তাঁর মন দূরের নির্জন কোনো পর্বতের হ্রদের মত শান্ত হয়ে ওঠে । আর সেই শান্ত হ্রদের তলদেশ ডুবে তাঁর সমস্ত বিরাগ, বেদনা, আনন্দ আর সুখানুভূতিতে শব্দের যে ঢেউ তৈরি করে, তা পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করলেই তা কবিতা হয়ে ওঠে । আবার কবি কবিতা নিয়ে প্রশ্ন যেমন করছেন, তার উত্তরও দিচ্ছেন । ‘কবিতা কি শুধুই শব্দাবলী ? না, তা তো নয় ।/ এ এক অবর্ণনীয় অস্পষ্টতা এবং আত্মার বিধান/ যা কারও কারও কাছে সুন্দর, কারও কাছে দুর্জ্ঞেয় ।’ তবুও কবিতা পরস্পর সম্পর্কিত বলে মনে করেন কবি । কবিতা যেভাবেই আসুক না কেন যা অন্য একজনের সঙ্গে সম্পর্কিত হয় বলে তিনি উল্লেখ করেন । তাঁর এক কবিতায় বলছেন, ‘অনুজ্জ্বল শব্দে সজ্জিত হয়ে/ প্রত্যুষের আগেই এসে পড়েছিল কবিতা ।/ তাকে আমার কিছুই/ দেবার নেই, বরং/আমিই পেলাম যেন কিছু একটা ।’ কবিতা পরস্পর সম্পর্কিত আবার গদ্যের সাথেও । কবির কথায়, ‘গদ্যকে যদি গোলাপ ধরি তবে/ কবিতা তার সুগন্ধ ।/গদ্য যদি হয় আস্তাকুঁড়ের ময়লা/তবে কবিতা তার দুর্গন্ধ।’ কবিতার সম্পর্ক হল একজন থেকে অন্যজনের কাছে যাওয়ার হাওয়ায় বোনা এক পথ । যে পথে শব্দের ওপর শব্দ চাপিয়ে আত্মার মিলনের আকাঙ্খা তৈরি করে । অথচ শব্দরা নিছক শব্দ হয় না । কবির কাছে শব্দ কখনো ভিনদেশী । আবার কখনো ‘শব্দরা চিরকালের জন্য/ খোয়ানো অসহায় শিশু..।/তারা বস্তুর মধ্যে আশ্রয় নিতে চায়…/নক্ষত্র-উজ্জ্বল আকাশ তাদের ছিনতাই করে নেয় ।’ আবার তারাই কবিকে অভিশাপ দিয়ে মরে যায় । আর কবি তাদেরই মৃতদেহ বিক্রি করে চলে । শব্দের গোলকধাঁধা অতিক্রম করে যেতে পেরেছেন বলেই কবি শব্দের মৃতদেহ সওদা করতে পারেন । তাই কবি বলতে পারেন, ‘মুখরিত শব্দের নদীতে ভেসে চলেছে/ যন্ত্রণাতুর ছোট্ট-এক বাঁশপাতার নৌকা ।/ জীবননদীর তীরে এসে আমি দাঁড়াই,/ নীরবে বুকভোরে টেনে নিই নদীর জলের সৌগন্ধ ।’
কবি তানিকাওয়ার কবিতা প্রকৃতির সৌগন্ধে সুবাসিত । যেখানে মাটির স্পর্শ রয়েছে । তিনিও তাই মনে করতেন যে কবিতা মাটি থেকেই উত্তোলিত হয় । যা তাঁর কাছে ভোরবেলায় স্বপ্নে শব্দ বা পঙ্ক্তির ঈশারায় হাজির হয় । যদিও নবতিপর কবির কাছে তাঁর এই বয়সে তা হাস্যকর মনে হয় । এখন তাঁর কাছে কবিতা হাস্যকর হলেও তাঁর কবিতা মাটির ঘ্রাণে সুবাসিত । মাটির ঘ্রাণ, মেঠো ঘাসের ঘ্রাণ, নতুন ধানের ঘ্রাণ, শিশিরের ঘ্রাণ, নদীর জলের ঘ্রাণ, এমনকি শৈশবের ঘ্রাণেও সুবাসিত হয়েছে বাংলা কবিতা । কবি জীবনানন্দ দাশের সৃষ্টিতে তা সুবাসিত । জীবনানন্দ সেই ঘ্রাণ নিয়ে এই বাংলায় বারেবারে ফিরে আসতে চেয়েছেন । কখনও শঙ্খচিলের বেশে, কখনো কাক হয়ে বা কখনো বক ও হাঁস হয়ে । কবি তানিকাওয়া বলছেন, ‘শীঘ্রই আমি একটি গাছ হয়ে যাব ।/ আমার মধ্যমা আঙুলের ডগা শিরশির করছে,/ তাতে গজিয়ে উঠছে সবুজ পাতা ।’ শুধু গাছ হয়ে গেলেও মৃত্যুসংবাদে কবি সেই গাছের পাতার কানাকানি শুনতে পাওয়ার কথা বলেন । ‘আমাদের মৃত্যুদিনের সকালে–/পাখিদের প্রভাতসংগীত,/ভেঙে পড়া ঢেউ।/ দূর থেকে ভেসে আসে সুর,/ পাতারা করছে কানাকানি-/ এই ক্ষণে তুমি কি শুনতে পাও/তাদের ?’ এ যেন কবির মৃত্যু চেতনার পরিচয় । এ পরিচয়ে কবি জীবনানন্দ দাশও পরিচিত । তাঁর ‘ধূসর পান্ডুলিপি’ কাব্যগ্রন্থের কবিতা তাঁর এই পরিচয়কে মান্যতা দেয় ।
কবিতা কখনো একার থাকে না । কবিতা জন্মের পর কবির অধিকার থেকে মুক্ত । তাই কবিতা সবার । পৃথিবীর মতো । কবি তানিকাওয়ার এই কথা তাঁর ভাষা জাপানি ভাষায় ব্যক্ত করেছেন । অথচ প্রকৃতি প্রেমে কবিতা সেতু তৈরি করে এক দেশ এক ভাষা থেকে আর এক দেশে আর এক ভাষায় । তাই জীবনানন্দ দাশ কিংবা তানিকাওয়া পরস্পর পরস্পরের তুলনীয় নয় । বরং একটা সম্পর্ক। কবিতার । কবিতার ভাব ও ভাষায় । এই ভাবনায় তাঁরা দেখতে পান আকাশ থেকে পাখিরা কখন হারিয়ে যায় ।
‘যেদিন আকাশ থেকে হারিয়ে গেল পাখিরা’
শুনতারো তানিকাওয়ার নির্বাচিত কবিতার
অনুবাদ- কুমার চক্রবর্তী
উজান, কাঁটাবন, ঢাকা