অরিত্রী দে
পঞ্চম পর্ব
পরিবেশ- পুরানো সেই দিনের কথায়
Nature is pure, supporting all forms of life and abundant resources while environment is shaped by human activities and more man-made, triggering scarcity and corruption of resources.
অর্থাৎ পরিবেশ বলতে বাহ্য উপাদানগুলির সমন্বয়গত সেই পরিস্থতিকে বোঝায়, যা কোনো জীব বা প্রজাতির প্রাণধারণ ও বিকাশকে প্রভাবিত করে। যখন থেকে ধনতন্ত্র নিজের উন্নয়নের স্বার্থে প্রকৃতিকে পণ্য করলো, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সমন্বয় তাকে গতি দান করলো, তখন থেকেই প্রকৃতির স্বাভাবিক আশ্রয় থেকে বিচ্যুত হয়েছি আমরা। মনে রাখার যে অষ্টাদশ শতকে শিল্পবিপ্লবের (১৭৫০ সাল) পর ক্রমপ্রসারিত শিল্পাঞ্চলগুলিতে স্থানীয় ও পারিপার্শ্বিক বায়ুমণ্ডল, জলবায়ুর উপর কারখানা থেকে নির্গত অ্যাসিড, ধোঁয়া, তাপপ্রবাহের প্রভাব সম্পর্কে তাত্ত্বিক আলোচনা করতে গিয়েই গোয়েথ কার্লাইল (Goethe Carlyle) প্রথম ‘এনভায়রনমেন্ট’ শব্দটি প্রয়োগ করেন ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে।
ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে ঔপনিবেশিক শাসন ও পরপর দুই বিশ্বযুদ্ধের পর দেশীয় প্রকৃতিলগ্ন উৎপাদন নীতিটি হ্যারি ট্রুম্যান কথিত নতুন উৎপাদন নীতির দ্বারা (‘To develop produce more’) প্রতিস্থাপিত হলে এমন এক যুগের সূচনা হয়, যখন চেয়ে বা না চেয়ে পরিবেশ (environment) ও প্রতিবেশের (ecology) চিন্তা আমাদের দৈনন্দিন জীবন-ভাবনায় ঢুকে পড়েছে; দীপেশ চক্রবর্তীর মতে এ এক বিশেষ ‘গ্রহের যুগ’ (planetary age), পরিবেশ বিপন্নতা এই যুগের নিজস্ব সমস্যা। বাধ্যত এই সময়ে আমাদের অর্জন করতে হয়েছে পরিবেশ-চর্চার শিক্ষা, গত তিন দশকের বেশি সময় ধরে ‘এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স’ আমাদের পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত। চরাচরের আলো, জল, বায়ু, গ্যাস, তেল, মৃত্তিকা, পাথর, উদ্ভিদসহ সমস্ত জৈব ও অজৈব উপাদানের গুরুত্ব বুঝে তার ব্যবহারিক (use value) ও অস্তিত্বের মূল্য (existence value) নির্ধারণের দায় হঠাৎ একদিনে বিশ শতকের শেষভাগে এসে উপস্থিত হয়নি। ধনতন্ত্রের বিকাশ ও নগরায়ণের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতির রূপান্তরের প্রক্রিয়াটি বিশ্বজনীন চরিত্র অর্জন করলেও তার ক্রমিক রূপান্তরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সংরক্ষণের যথাযথ বন্দোবস্ত গৃহীত হয়নি। পরিবেশবিজ্ঞান অনুযায়ী পরিবেশ-চেতনার বিজ্ঞানসম্মত ভিত্তি হলো ভৌত পরিবেশ (physical environment)।
ঔপনিবেশিক আমলে পরিবেশের সঙ্গে কেবল বসতিভিত্তিক পন্থায় স্থাপিত সম্পর্ককে অর্থাৎ স্থায়ী বসতির কৃষিভিত্তিক জীবনকে স্বীকার করা হত। কেননা তাতে ভূমি রাজস্বের জোগান তো হতই, সঙ্গে কৃষিপণ্যের রপ্তানি বাড়ত, যার গুরুত্ব উনিশ শতকীয় ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের মৌলিক কাঠামোয় অপরিসীম ছিল। রপ্তানি উদ্বৃত্ত বজায় থাকলে মুনাফার মাধ্যমে পুঁজিবাদী স্বার্থও বজায় থাকত। এই সময়ে কয়েকজন ব্রিটিশ প্রকৃতিচর্চাকারী, মূলত কোম্পানির কাজে নিযুক্ত শল্যচিকিৎসকেরা অরণ্য সংরক্ষণের দাবি তোলেন। আমাদের মনে পড়বে রানাল্ড মার্টিনকে, যিনি চাকরিসূত্রে কলকাতায় এসে ১৮২০ সালের বার্মা যুদ্ধ-পর্বে ইউরোপীয় সেনাদের নানা অসুখে ভুগতে দেখে কলকাতার প্রাকৃতিক পরিবেশ, সেখানকার মাটির বিবর্তন, জলবায়ুর ধরন নিয়ে পরীক্ষা চালান। তিনিই প্রথম বাংলার জলবায়ু, স্বাস্থ্য ও উন্নয়নের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ককে জনসমক্ষে আনেন এবং বনবিভাগ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ব্রিটিশ ভারতে বন সংরক্ষণ কার্যক্রমকে প্রাতিষ্ঠানিক করে তোলেন। তিনি কলকাতায় যে ‘ফিবার হাসপাতাল’ (fever hospital) তৈরি করেছিলেন, সেখানে বাংলায় চিকিৎসা-ব্যবস্থার উন্নতি বিধানের পদ্ধতি-প্রকরণ নিয়ে একটি কমিটি তৈরি হয় ১৮৩৫ সালে। উক্ত কমিটিতে ডাক্তার মধুসূদন গুপ্ত (১৮০০-১৮৫৬) কলকাতার সংকীর্ণ রাস্তা, নোংরা জল ও জঞ্জাল ভর্তি পয়ঃপ্রণালীকে রোগের আঁতুড়ঘর হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। এমনকি তিনি কলকাতার অধিকাংশ উচ্চবিত্ত কর্তৃক ব্যবহৃত গঙ্গার জলকেও পানযোগ্য বলে মনে করেননি। তখন নেটিভ কলকাতার পুকুরের জলও পানের উপযুক্ত ছিলো না, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ তৈরি করত। ড. মধুসূদনের মতে- যথাযথ বায়ু চলাচল, জল নিষ্কাশন ও সেই সঙ্গে পানীয় জলের উপযুক্ত ব্যবস্থা করলে কলকাতাকে একটি স্বাস্থ্যকর স্থান হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। তিনি তাঁর আলোচনায় ধুলোর ক্ষতিকর দিকের কথাও বলেন, অর্থাৎ ধুলো সংক্রান্ত দূষণের কথা (dust pollution) তুলে ধরেন। মধুসূদন গুপ্তর এই বিবৃতি থেকে কলকাতা ও তৎসন্নিহিত অঞ্চলের জনস্বাস্থ্যের এবং পরিবেশের বিস্তারিত, পুঙ্খানুপুঙ্খ চিত্ররূপ মেলে। শতাব্দীর গোড়া থেকে শহর কলকাতায় পানীয় জল সংক্রান্ত সমস্যা ছিলো। উত্তর কলকাতায় বাড়ির ভিতর পুষ্করিণীর জল ততোটা ভালো ছিল না। সাহেবরা বর্ষার জল ধরে রেখে ব্যবহার করতেন আর ১৮০৫ থেকে ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত হেদো, পটলডাঙার গোলদিঘি, বহুবাজারের গোলদিঘি, মাদ্রাসার দিঘি, চাঁপাতলার তালাও, সুরতিবাগান পুকুর প্রভৃতি খনন করা হয় বিশুদ্ধ পানীয় জলের জন্য। ১৮২০ সালে পাকা জলপ্রণালী (aquaduct) প্রস্তুত হলে চাঁদপাল ঘাটে দমকলের সাহায্যে গঙ্গাজল তুলে ধর্মতলা, চৌরঙ্গি, লালবাজার, বহুবাজার, কলেজ স্ট্রিটে ব্যবহার করা হত।
উনিশ শতকের ষাটের কোঠায় ড. গুডিব চক্রবর্তী কলকাতার পানীয় জল সম্বন্ধে বক্তৃতা করেন। ১৮৬৫ সালে জল-কল প্রতিষ্ঠার সূচনা হল এবং অব্যবহিত পরেই শহরে ওলাইচণ্ডী রোগের হ্রাস বোঝা গেল। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর জন্ম ১৮৪৯ সালের ৪ মে। তাঁর শৈশবকে ষাটের দশক পর্যন্ত টেনে নিয়ে গেলে তা থেকে জানা যায় (শ্রী বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রণীত জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতি থেকে) যে তখন কলকাতায় খোলা নর্দমা ছিলো, চারিদিকেই দুর্গন্ধ আর তখন শহরের যতো ময়লা সব গঙ্গায় ফেলা হত। গঙ্গার জলে সবসময় ময়লা ভাসতো কিন্তু অভ্যাস ও সংস্কারের মাহাত্ম্যে গঙ্গাস্নানের সময় ময়লা বা তজ্জনিত দুর্গন্ধ সত্ত্বেও মানুষজনের তেমন অসুবিধাই মনে হত না। তাদের বাড়িতে লালদিঘি থেকে পানীয় জল আসতো, বাড়ির পুকুরের সঙ্গে গঙ্গার যোগ ছিলো, পুকুর শুকোলে লহর দিয়ে গঙ্গার জল আনা হত।
বোঝা যায় মধুসূদন গুপ্তর বিবৃতিদানের দুই দশক পরেও অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি, বরং উত্তরোত্তর জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে পরিবেশে আরো প্রতিকূলতার সৃষ্টি হয়। বীরেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়-এর বাংলাদেশের সপ্ত প্রসঙ্গে গ্রন্থে এই সময়ের কলকাতা প্রসঙ্গে বলা আছে যে শহরের বেশিরভাগ রাস্তা তৈরি হত খাল ভরাট করে। এমনকি খালগুলি ভরে বসতি নির্মাণও হত। যেমন প্রাচীন কলকাতার একটি খাল ওয়েলিংটন স্কোয়ার, বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট ও হেস্টিংস স্ট্রিট দিয়ে এসে গঙ্গায় পড়ত; ওই খালটি ভরাট করেই ‘ক্রিক রো’ সড়কটি নির্মিত হয়।’ আবার উনিশ শতকের কলকাতায় উপযুক্ত পয়ঃপ্রণালীহীন কসাইখানায় ছাগল বলি দিয়ে মাংস বিক্রির মাধ্যমে নিত্য যে দূষণ ছড়াতো ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ তৈরি হত, তার জন্য পৌর কর্তৃপক্ষের আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের কথাও জানা যায়। কলকাতায় মিউনিসিপ্যালিটির কমিশনাররা ১৮৮০ থেকে ১৮৮৪ সালের মধ্যে দূষণ নিয়ন্ত্রণ আইনের একাধিক উপধারায় স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের নিযুক্ত করে নিয়মিত পরিদর্শনের ব্যবস্থা করেছিলেন।
ফেলে আসা কালের যবনিকা উত্তোলন করলে দেখব- সপ্তদশ শতকে জোব চার্নক কলকাতায় কুঠি প্রতিষ্ঠা করলে তাঁর পূর্বপরিচিত বাঙালি, হিন্দুস্থানি, আর্মেনীয় হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টান নির্বিশেষে সহযোগী ব্যবসায়ী, দালাল, গোমস্তা, পেয়াদা, দাদন দেওয়ার লোক— সবাই এসে উপস্থিত হয়। কোম্পানির ব্যবসা ফুলে-ফেঁপে উঠল, ফলে মানুষজনের সংখ্যা উত্তরোত্তর বাড়ল। অনেকে পাকাপাকিভাবে পরিবার নিয়ে এসে ভিড় করল কাঁচা টাকার লোভে। ফলে দরকার পড়ল জমির। এই সময়ে অনেক পতিত জমিকে স্থায়ী বসতির আওতায় আনার সিদ্ধান্ত গৃহীত হল এবং প্রয়োজনে নিচু জমিকে উঁচু করে ঘর-বাড়ি বানানো শুরু হয়। শহর তো গড়ে উঠল কিন্তু নিকাশি ব্যবস্থা ঠিকঠাক হল না। জমা জল বেরিয়ে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছিল, জলে বিবিধ প্রকারের জঞ্জাল পচত। অসুখের কবলে পড়ে নবগঠিত শহর। ১৭০৪ সালে আদেশ এল, আবর্জনাতে ভরা সব দিঘি আর পুকুর বুজিয়ে দেওয়ার। এরপর নিকাশিব্যবস্থাকে যেভাবে শহর আর বসবাসকারী মানুষের উপযোগী প্রযুক্তিতে বানিয়ে তোলা হল, তা আরেক সচেতনতার ইতিহাস।
–ক্রমশ