মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস
সপ্তম পর্ব
সেই তিনতলা বাড়ির কাছে আবার একবার ফিরে আসি। একটা ছোট্ট উঠোনকে তিনদিক থেকে ঘিরে থাকা ছোট্ট ছোট্ট ঘর বারান্দায় ছয়টি পরিবারের দিবারাত্রির কাব্য রচনা হতো এখানে। একতলায় উঠোনটির একপাশেই কুয়ো ও যৌথ চানঘরের ঘেরাটোপ। সবার ব্যবহারের জল এই কুয়ো থেকে বালতিতে বয়ে বয়ে তুলতে হতো দোতলা বা তিনতলায়। খাবার জন্য সম্ভবত রাস্তার টিউবকল বা বাঁকি ভরসা ছিল।
এখনকার শহুরে প্রজন্ম ভাবতেও পারবে না যে খুব সাধারণ পরিবারে রান্না খাওয়ার জল জোগাড় করা কতটা মাথা ব্যথার কাজ ছিল রোজ। তারা সরকারি জলের লাইনে আসা জল, অথবা বাড়ির কুয়ো বা সাব মার্সিবলে লাগানো পাম্পের মাধ্যমে জল তুলে রিজার্ভ করা জল কল খুললেই পায়। তখন কিন্তু পথের কল থেকে সম্পন্ন পরিবারগুলোতে মাসিক বন্দোবস্তে বাঁকের দুদিকে টিন ঝুলিয়ে জল দিয়ে যেত বাঁকি। না হলে পরিবারের যে কোনো কাউকে সে দায়িত্ব পালন করতে হতো।
বাড়ির দক্ষিণ অংশটা দোতলা, আর সামনে বড় রাস্তার দিকে তিনতলা। একপাশে সরু গলিপথে ভেতরে আসার রাস্তা, যে রাস্তায় একটা সাইকেল ঢোকানোও আমার অসম্ভব বলে মনে হতো। বাড়ির মালিকানা বদলে গেছে কিন্তু সেই তিনতলার দিকে একেবারে নিচের তলায় তখনকার মতো এখনও আছে মাধবী মামীরা। এই পরিবারটার কথা মনে হলেই মনে পড়ে মামীর মেয়ে সিদুর কথা। আমারই সমবয়সী মেয়েটার অল্প বয়সে বিয়ের পর পণের দাবির নির্মম বলি হয়েছিল।
উল্টোদিকের দোতলায় বাস ছিল কেয়াপিসির। কেয়াপিসি বাবাকে ভাই ডাকতো। আমি আর আমার ভাই পিসির বড় আদরের ছিলাম। পিসি ছিল অত্যন্ত পরিস্কার পরিচ্ছন্ন, গৃহকর্মে সুনিপুণ, রন্ধন পটিয়সী এক নারী। পিসির হাতে বোনা বৌ টুপিটা বোধ হয় চল্লিশ বছর পরেও আমি ছাড়তে পারি নি।
শীত পড়লেই প্রতি বছর আমার আলাদা করে কেয়া পিসির কথা মনে পড়ে। সে এক অদ্ভুত কারণে। সেদিন বোধ হয় পঁচিশে ডিসেম্বর ছিল। কেয়াপিসির ছোট মেয়ে রিঙ্কুদি আমায় ডেকে বলল, মা ডাকছে।
তখন জলখাবার খাবার বেলা। আমি লাফ মেরে চললাম পিসি কেন ডেকেছে জানতে। পিসির ছোট্ট ঘরটা কি ঝকঝকে সব সময়। রান্না বারান্দায় দিকে একটা মিটসেফ। চার পা বসানো চারটে জল দেওয়া পোর্সেলিনের বাটিতে। পিঁপড়ের ভয়ে। ফ্রিজের রমরমা বাজারের আগে এ দৃশ্য অনেকের বাড়িতেই দেখা যেত। সেই মিটসেফটা ঘেঁসে বসতেই এক অপূর্ব অনাস্বাদিত গন্ধ নাকে এলো। পিসি এবার আমার সামনে একটা বাটি বসিয়ে দিল চামচ দিয়ে। মটরশুঁটি ফুলকপির টুকরোগুলো বাদ দিলে হলুদ হলুদ কেঁচো বাটিতে ভরা।
কি গো এটা?
খেয়ে দেখ।
আহা! দারুণ।
এর নাম ম্যাগি।
এর পর কতবার কত ভাবে ম্যাগি খেয়েছি। কিন্তু সেই প্রথমবারের স্বাদ ও গন্ধ প্রতিবার নতুন ফুলকপি ও মটরশুঁটির সাথে সাথে আমার কাছে ফিরে আসে পিসির বানানো বউ টুপিটার মতো আদুরে উষ্ণতা নিয়ে। অথচ কত কত বছর পিসি নেই।
ওই তিনতলার দিকের দোতলা ছিল ‘ভোলার মা’য়ের আন্ডারে। দুই ছেলের মা ছিলেন উনি। প্রতি বছর জোড়া কার্তিক পুজোতে আমরা প্রসাদ পেতাম। কিন্তু অসম্ভব ছুঁচিবাইগ্রস্হ ছিলেন। দোতলা থেকে একতলায় যাতায়াতের রাস্তা কখনও শুকনো রাখতেন না। আমরা ছোটরা সেই ভেজা সিঁড়ির তোয়াক্কা না করে সিঁড়ি টপকে টপকে কি ভাবে বার বার ওঠা নামা করতাম তা এখন ভাবলেই কোমর ভাঙার ভয় চেপে ধরে।
অনেক পরে ওনারা বাড়ি করে এই ভাড়া বাড়ি ছেড়ে যেতে সোনা মোম দুই ছোট্ট মিষ্টি মেয়ে বাবা মায়ের সাথে থাকতে আসে দোতলায়। ততদিনে আমি পাড়ার ছানাপোনা সকলের দিদিভাই হয়ে গেছি। ওদের বেশিরভাগ জনকেই পড়া দেখানোর দায়িত্ব নিতে হয়েছে।
তিনতলায় কল্যাণী দিদিমণির ঘরখানার পাশের ঘরটা ছিল আমার আসল আড্ডা। ওই ঘরের কর্ত্রী ছিলেন আনন্দময়ী। স্বামী, দুই ছেলে, দুই মেয়ে নিয়ে তার সংসার। এই দাদা দিদিদের সাথে এমন ভাবে বড় হয়েছি যে মনে হত না ওরা আপন দাদা দিদি নয়।
ছোটবেলায় দেখেছি, কিন্তু বুঝি নি, একটু বড় হবার পর অনুধাবন করেছি, কি টানাটানির সংসারে এরা বড় হচ্ছিল। খাওয়া পরার পর চারটি ছেলে মেয়ের পড়াশোনা চালানো সেই সময়ে একজন বাস কন্ডাক্টরের পক্ষে সত্যিই কঠিন ছিল। তবুও সেই অসম সমাজিক লড়াইয়ে বাড়ির সবাই সামিল ছিল।
ওই বাড়িতে আমি দেখেছি কি ভাবে কাগজের ঠোঙা বানানো হয়, বোনা হয় তাল পাতার চাটাই। মাটির ডাবায় গাপ্পি আর হরলিক্সের জারে ফাইটার ছিল বাড়ির ছোটছেলের শখ। শীতকালে তিনতলায় বারান্দায় যা একটু রোদ আসতো। তাই এক তলা টু তিনতলা, সব গৃহিণীরা ঘরের কাজ শেষে এসে বসতো এই বারান্দায়। হাতে হাতে উল, কাঁটা। কত ডিজাইনের আদান প্রদান। আপন খেয়ালে চলতো রেডিও। আমার মনে পড়ছে সমর কোম্পানির স্কুল বাক্সর বিজ্ঞাপন এখানেই বসে শুনেছি বলে। জানি না আজ এত বছর পরে সে কথা কেমন করে মনে পড়ল। আবার কোনো এক সন্ধ্যায় এই বাড়ির রেডিওতে শুনেছিলাম সাংঘাতিক ভয়ের এক গল্প। অল্প ওয়াটের ডুম জ্বলা সিঁড়ি বেয়ে নেমে বাড়ি ফিরতে বেজায় বেগ পেতে হয়েছিল সেদিন।
দিদিদের বিয়ে হয়ে গেল এক সময়। দাদারা কাজের জোগাড় করল। তারপর এই ভাড়াবাড়ি ছেড়ে একদিন নিজস্ব বাড়িতে চলে গেল এই পাড়ার পুরোনো একটা পরিবার।
তিনতলায় এখন পুরোনো কোন মানুষ নেই। দোতলাতেও নয়। বাড়ির মালিকানাও পাল্টে গেছে। তারাই বসবাস করে দোতলা তিনতলা মিলে। এক তলায় এখনও আছে মাধবী মামীরা। উল্টো দিকের দোতলা অংশে কেয়া পিসির ছোট মেয়ে বসবাস করে। বাড়ির নক্সায় যতই অদল বদল হোক না কেন, আমার চোখে স্পষ্ট ভাসে সেই সব দিনের ছবি। সবাই মিলে রথ আর মহিষমর্দিনী মেলায় যাওয়া, কম বাজেটের গুড় আর সেদ্ধ পিঠে খাওয়া, খিচুড়ি ডিম ফিস্টি। শেওলা পড়া সিঁড়ির ধাপে পুরোনো বেলিগাছ, নাইটকুইনের ডাবা। পাড়ার ছোটদের অল্প পড়া, বেশি আনন্দের এক হারিয়ে যাওয়া শৈশব যাপন।
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)