শরদিন্দু সাহা

বাংলা কথা সাহিত্যের সুপরিচিত লেখক শরদিন্দু সাহা। লেখক সত্তা ও জীবনকে বিচ্ছিন্ন করে দেখতে তিনি অভ্যস্ত নন। নিছক লেখক হওয়ার জন্য তিনি কলম ধরেননি, সামাজিক দায়বদ্ধতাই তাঁকে সৃষ্টিকর্মে উদ্বুদ্ধ করে। শৈশব থেকে সৃষ্টিশীল মন লালন করে প্রস্তুতি পর্ব সারলেও নয়ের দশকের গোড়া থেকে তাঁর লেখালেখি শুরু। এ-পর্যন্ত শতাধিক গল্প, গোটা কয়েক উপন্যাস এবং অন্যান্য গদ্য মুদ্রিত হয়েছে। দশটি উপন্যাস আর সাতটি গল্পগ্রন্থ সহ মোট গ্রন্থের সংখ্যা ষোলো। ১৯৯৮ সালে ‘কাটোয়া মহকুমা গ্রন্থাগার পুরস্কার’ পান। ২০০৪ সালে ‘পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি প্রদত্ত সোমেন চন্দ পুরস্কার’ পান। ওই  বছরেই কাটোয়া লিটল ম্যাগাজিন মেলা কর্তৃক সংবর্ধিত হন। ইন্ডিয়ান অয়েল কর্তৃপক্ষ তাঁকে ‘হল্ অব্ ফেম’-এ সম্মানিত করেন। ২০০৫ সালে ‘ভাষা শহিদ বরকত স্মরণ পুরস্কার’ পান। ২০০৭ সালে সাহিত্য আকাদেমি’র আমন্ত্রণে গৌহাটিতে বাংলা-অসমীয়া গল্পকার সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। ২০১৩ সালে ‘আমি’ পত্রিকা তাঁর সাহিত্যকর্মের জন্য বিশেষ সম্মান দেন। প্রসার ভারতী’র আমন্ত্রণে নানা সময়ে সাহিত্য-সংস্কৃতি অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহণ করেছেন। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, মিলিয়ে অনেক উল্লেখযোগ্য সাহিত্য পত্রে ও ওয়েব ম্যাগাজিনে লিখে চলেছেন। ইতিমধ্যেই নিজস্ব এক ঘরানা সৃষ্টি করে তিনি পাঠকের মন জয় করেছেন।

(নিত্য সমাজ সংসারের যে স্রোত আমরা চাক্ষুষ করছি তার অন্দরমহল জুড়ে ঘুমিয়ে রয়েছে কত তো কথাকাহিনী, যার পরতে পরতে  তন্দ্রাচ্ছন্ন থাকে গোপনে কত তো নারীর জীবনযন্ত্রনা, ধারক বাহক হয়ে গোটা সমাজকে যাঁরা ছাতার মতো আগলে রেখেছে, নিজের পরিচয় খুঁজে নিয়েছে, সকল ঝড়ঝঞ্ঝা থেকে দিচ্ছে মুক্তি যুগ যুগ ধরে। কয়জনের কথাই বা আমরা মনে রাখি। তাঁদের গোপন ব্যথা, অনুচ্চারিত কথা গুমড়ে মরে যায়, চোখের জল কেউ মুছিয়ে দেয় না, গণ্ডীবদ্ধ শৃঙ্খলিত জীবনই তাঁদের বেঁচে থাকার একমাত্র ভরসা। এমনই এক সাধারণ গ্রাম্য নারীর কথকতা ও চেতনায় চেনা জীবন ও সমাজপিষ্ট অব্যক্ত যন্ত্রনার পাঁচালি ‘পঞ্চমীর বারমাস্যা’  উপন্যাস।)

চাঁদ যেমন করি সূর্যের লগে ঘর করে

মাইয়া হেথির ভাইদের লগে সুর ধরে

আঁর মাইয়াটার কতটুক আলো নিজের আছে আর কতটা ধার করা, কে জানে। তো মাইয়ার বুইঝছেন নি বড় সখ হাত পা ছড়াই থাইকব, নিজের ঘরে খেয়াল খুশিমতো বাসা বাঁইধব। হিয়ের লাই আঁই নজরে নজরে রাই। আঁই খেয়াল কইরছি মাইয়া আঁর উইড়ত চায়। বাড়ির হোলারা যন বই খুলি চেঁচাই চেঁচাই হড়ে, শব্দগুলা রসুইঘরে ওর কানের মধ্যে যাই ধাক্কা মারে, ভাতের ডেগের  ঢাকনা উলটাই ভাত উতরাই ভট ভট করে। মাইয়া তন লাকড়ি নিবাই আঁচ কমায়। কাউগে তো কইত হারেন না আঁইও হড়ুম। মাইয়াটার ইচ্ছাটা চাগাই উঠইলে আঁই একদিন ওর বাপেরে কইলাম মাইয়াঢা হইড়ত চায়, কোনো একটা বন্দোবস্ত করা যায় কিনা। ওর বাপ অমন কথা হুনি আকাশ তুন হইড়ল। তড়াক করি লাফাই উডি কইল, ‘তোঁর কি মাথা খারাপ হইছে ? আঁই মাইয়াদের হড়ালেখার বিরোধী নই। তুঁই চারহাশের অবস্থাখান দেইখতে হাও না। তবু কোন আক্কেলে কও। হুরুষ মাইনষে নাকাল হই যার, মাইয়াদের কথা দূর অস্ত। দেশের অবস্থা আগের মতো আছে নি, দিন দিন খারাপ হই তার, হিন্দু মাইয়াদের মুখ দেইখলে হক্কলে ছোলাই খাইব। আঁর অন চিন্তা হইল মাইয়াডারে কেমনে ওই রাক্ষসদের হাত তুন বাঁচাইয়ুম। হিন্দুর মাইয়ারে দেইখলে হেথাগো জিব লকলকাই উডের, তুঁই কইছ হড়ার কথা, একবার কইছ কইছ, দ্বিতীয়বার মুখ দিই উচ্চারণ করিও না।’ বুইঝতাম হাইরলাম দরজাটা সেই যে মাইয়ামানুষের লাই কোনকালে বন্ধ হইছে, কোনকালে যে খুইলব, কেউ জানে না। আঁই অনেক চেষ্টা চরিত্র কইরছি, হক্কল কিছু জলেই গেল বুইঝলাম। নিজের ঘরের লোক এত শিক্ষিত হই রাস্তা খুঁজি হান না, আঁই তো কোন ছার। আঁর মাইয়াঢার মাথা ভালা, কত স্বপ্ন দেইখছি ওর স্বপ্নটা হূরন করুম। বই দেইখলে হেতি ঝাপাই হড়ে, হাইরলে বইয়ের হাতাগুন চিবাই খায়, যেমন করি ঘুণ হোকা কুট কুট করি বইয়ের অক্ষরগুনেরে খায়, আমরা দেইখতও হাই না। আঁর মাইয়ারে আমনেরা কইতে হারেন চোর হুলিশ খেলে, বইয়েরে এমন জড়াই ধরে, হাত ছাড়া কইরত চায় না। বাপ তো কইয়ে খালাস, হেদিকে নজর আছে নি। হেথেনের সন্তুষ্টি অন্যখানে। খালি রামায়ন মহাভারত সুর করি হইড়ত হারলেই হয়, আর কাব্যের চরিত্রদের মুখস্ত কইতে হাইরলে মনের ভিতরটা আনন্দে নাচি উডে, তন বাকিদের ডাকি ডাকি কয়, ‘তোরা দেই যা আঁর মাইয়ার কেরামতি, এই মাইয়া যদি হোলা হইত, বাপের বেডা হইত, বংশের নাম উজ্জ্বল কইরত। হেই দিন তো আর নাই, গার্গী, মৈত্রেয়ী লোপামুদ্রা মরি স্বগ্গে গেছে। মাইয়ার নাম রাইখছি লোপা, তাই হইলে কি হইছে, ঋগ্বেদ শ্লোক রচনা কইরবার মতো পান্ডিত্য কেমনে হইব। সকল গ্ৰহ নক্ষত্র রাশির যোগ ঠিকঠাক না হইলে অমন মাইয়া কি জন্মাইব আঁর ঘরে।’ হেথেনের মনের মধ্যে একখানা সুপ্ত আশা ছিল কিন্তু এইটা বুইঝত হারেনের সময়টা সাথ দেওনের মতো না। মাইয়ার গুণের কদর করেন না  হেই কথাখান কেমনে কই। বিশ্বাসও রাখেন এমন একদিন আইব, মাইয়াদের দমাই রাইখতে হাইরত ন। দুঃখ করি আঁর কাছে কয়, ‘বুইজঝনি আঁর মাইয়াটা যদি আরও কুড়ি বছর পরে জন্মাইত, এমন দুর্দশা হইত না, অন তো শিক্ষাদীক্ষা না হাই ঘরে বসেই পচি মইরব। বাপ হই চোয়ের সামনে দেইখতে হইব আর এই মনের কষ্ট লই মইরত হইব যে মাইয়ার স্বপ্নখান ভাঙ্গি টুকরাটাকরা করি দিছি।’ আঁর মাইয়াও বুইঝত হারে বাপের কষ্টখান, হিয়ের লাই বাপের কাছে হড়ার আর আবদার করে না, মুখ বুঝি থায়। ভাইয়ের বই খাতা লই লাড়াচাড়ি করে। কদ্দিন হইছে এক মাষ্টার আইছে বাড়ির হোলাদের হড়ায়। লম্বা বারান্দায় বেত লই হড়া ধরে, শাসনও কি কম করে, হড়া না হাইরলে দু’একখান চড় থাপ্পর ও হড়ে। আঁর খুড়তুতো দেওরের মাইয়ারা উঁকিঝুঁকি মারি ফ্লাইং রায় আর মাইয়া কিন্তু সটান দাঁড়ায় থায়। কিরে লোপা তুই হড়বই নি। মাইয়া এমন করি ঘাড় নাড়ায় কিছুই বোঝা যায় না। ওর ওই টানটান চোখ দুইটা কত কথা যে কইত চায়, কত কিছু যে জাইনত চায় ঈশ্বর জানে। কিছু নমুনা টের হাওন যায় ও যখন ইসকুলের পাঠ্য বইয়ের তুন তুলি তুলি এমন সকল প্রশ্ন করে, জবাব দেওনের মতো কেউ থায় না, হক্কলে হলাই বাঁচে। আঁই কইতাম হাইরতাম ন, এটা কেমনে সম্ভব হইল, ওর ভাবনা চিন্তাগুলা কেমনে জন্মাইল। বাড়ির অন্য মাইয়ারা যেমন খেলনা বাটি খেলি, মজার মজার গালগপ্প করি, বাড়ির কামকাজ করি সময় কাটায়, হেথি তো হেইর তুন বেশি কিছু নয়। আঁই ভাবি ওর এই এমন একটা মন কেন্নে তৈরি হলো, আঁর মাথায় কোনোমতেই ঢোকে না। তবে এককান কথা ঠিক হেথি বারে বারে জিগায় বেগম রোকেয়া, কামিনী রায়, আশাপূর্ণা দেবীর কথা। খাতা পেন্সিল লই খচ খচ করি আবোলতাবোল লেখে, যার মাথামুণ্ডু আঁইও কিছু বুঝি না। আঁর ভাবসাব আর মনের ছায়া হেথির মনের মধ্যে যে একটু আধটু জায়গা করি নিছে, আঁর বাপের বাড়ির সংষ্কার আর এই বাড়ির আদব কায়দা, চালচলন দুইঢা মিলি যে ওর গড়ন হইছে, এইঢা হলফ করি কওন যায়। আঁর স্বামীও কয়, ‘মাইয়াঢারে লই আঁর দুশ্চিন্তার শেষ নাই। কেন্নে যে লোপাটা দেইখতে দেইখতে ওর দাদা ভাইদের মতো হই উইঠল, অবাক হই যায়। হেথির গুণটা স্বীকারও কইরতাম হারিয়েন না, অস্বীকারও কইরতাম হারিয়েন না।’ বইটই লই ওর বাছবিচার নাই, যা পায় গোগ্ৰাসে গিলে খায়। বড়দের হক্কলের হাতে-পায়ে ধরি যোগাড়যন্ত্র করে। হক্কলে হেলাফেলা কইরলেও মাইয়াটার এলেম আছে, দমও আছে। আঁর নিজের মাইয়া বলে নিজের মুয়ে ঢাক পিটাইয়ের না, কেন জানি মনে হয় আইজ না হয় কাইল হেথি কিছু একটা করি দেয়াইব।

লোপা ঘরের এক কোণায় বই কি যেন বিড়বিড় করে। আঁর ছোট জা টকস টকস কথা কয়, ‘লোপা তোর লক্ষণখানা তো ভাল দেইয়ের না। এই বইয়ের ভুত তোর মাথা তুন তাড়াইত না হাইরলে সব্বনাশ হই যাইব। এর একটা হেস্তনেস্ত কইরতেই হইব। মোসলমানের কচি কচি মাইয়াদের লগে গপ্প মারা বার কইরছি। হেথিগো ঘরের খবর জানি তোর কি কামে আইব। কোন চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার হইব, ক চাই। গাঁ গেরামের মাইয়া বাড়ির ভিতরে ঘুরি ঘুরি থাইকবি তা না, তোর পাখনা গজাইছে, উড়ি উড়ি বেড়াইতে চাস, কই বাকি মাইয়ারা তো এমন স্বভাব চরিত্রের নয়, তোর কেন এমন লা ?’ এর উত্তর লোপা কেমনে দিব ? ঈশ্বর ওরে যেমন করি গইড়ছে, তেমনটাই তো হইব। উত্তরটা না দিই চুপ করি কেমনে থাকে। আঁই তো জানি ভেতরটা হেথির গুড়গুড় করের। ‘কাকি, সমাজের খবর না লইলে  চলে। হাশাহাশি গ্ৰামের মাইয়া ওরা, কেমনে থায়, কেমনে চলে, না নিলে মনটা কেমন কেমন করে।’ ‘তোর মুখে বেশি চোপা হইছে। বাড়ির হোলাগো লগে হাল্লা দেওনের লাই তোর এমন দশা হইছে, ঝুনা নারকেলের মতো। এই মাইয়া বংশের বদনাম না করি ছাইড়ত ন। যেদিন হুশলাই লই যাই কলেমা হড়াই মোসলমান করি দিব, সেদিন বুইঝতে হারবি কত ধানে কত চাল।’ ‘কাকি আমনে তো বই হড়েন ন, হইড়লে বুইঝতে হাইরতেন এর কী স্বাদ।’ ‘ না হয় তুই রামায়ণ মহাভারতের গল্প মুখস্ত বলতি হারস, লাইন আওড়াতি হারস, হিয়ের লাই খোটা দিতি ছাড়বি না ?’ ‘ আরে, আঁই কি হেই কথা কইলাম, কাকি,আঁই দুই কলম হড়ার লাই ছটফট করি। বাড়ির হোলারা হক্কলএ কেমন সুন্দর হড়ের, আমরা মাইয়ারা কী দোষ কইরছি কয়েন চাই।’ আঁই খালি রঙ্গ দেখি। আঁর জায়ের মুখ দিই আর কোনো কথা সরে না, এককারে বোবা।

ভাই আই হেথের দিদিরে সান্ত্বনা দেয় ‘দিদি তুই হড়ালেখা লই এট্টুও দুশ্চিন্তা ক্যান করিস? ইসকুলে ভরতি না হইচছ তো কী হইছে, আঁই আছি না। ক্লাসে যা যা হড়াইব মাষ্টাররা, বেগ্গাইন তোরে আঁই বুঝাই দিমু। হুরান বই আঁই তোরে জোগাড় করি দিমু। তুই জিগাইন বুইঝতি হারবি না, আঁরে কইচ, তোরে জলের মতো বুঝাই দিমু।’ লোপা এই কথা হুনি কী যে খুশি হইছে, পিতলের কলসিটা লই লাফাইতে লাফাইতে কলের গোড়ার দিকে ছুট মারে। মাইয়ার আনন্দ দেই আঁই কী যে কমু, আঁর হোলাহাইন বেলার দিনগুনের কথা মনে হড়ি যায়। হেই মাইয়া কল চাইপতে চাইপতে ভুলিও যায় কন কলসিটা হুরি গেছে। আঁই ঘর তুন হক্কল কিছু চোয়ে চোয়ে রাখি। রাতারাতি মাইয়ার মধ্যে কেমন যেন হরিবর্তন আইছে। এমনে তো আঁই আগলাই আগলাই রাই, অবস্থাটা হইছে বাঁধন ছাড়া গরুর মতো। কিছু গাইল দিতাম গেলে চোখ দিই জল হড়ে, ভাবি মাইয়া মানুষ কদিন বাদে হরের বাড়ি চলি যাইব। কামকাজ শিখাইবার লাই দুই একটা চড় থাপ্পর দিলে বাড়ির হক্কলে মিলি আঁরে খামচাইতে আয়ে। হুইরে আঙ্গ নাইরকেল গাছের গুঁড়ির ঘাট। ঘর তুন হুইর দূর কম ন। দুই তিন বোন মিলি এতগুন মাইনষের কাঁসের আঁইডআ থালাবাসন মাজিঘসি গেছে হুইরে ধুইত। শেথলাতে হিজল খাই মাইয়ার গেছে কোমর ভাঙ্গি, থালাবাসন গড়াই হইড়ছে হুইরের জলে। মাইয়ার এই অবস্থা দেই মাথা ঠিক রাখতে হারি ন। কী করুম রে! কোনরকমে ঠাণ্ডা হই দুই এক পুরিয়া হোমিপ্যাথি ঔষধ আর্ণিকা খাওয়াই দিই, ধনেশ হাখির হাঁড় দিই ঝাড়িও দিই। ইগাইন আঁই কন যে দেই দেই শিখছি, অন সময়ে অসময়ে কামে লাগি যার। সংসারে এমন বিপদ আই চাপি বয়, হক্কল কিছু তালগোল হাকি যায়। মাইয়াটার তবু হেলদোল নাই, ঘোরে থাকে। স্বপন আই হেথাগরে ঘিরে ধরে। অদ্ভুত কইতেন হারেন। খালি রামায়ন মহাভারতে চরিত্রগুলা লই দিনরাত ভাবে আর ব্যাখ্যা করি করি আঁর নিজের হৌরী, খুড় হৌরীদের হোনায় আর ওরাও কান হাতি হোনে। ঈশ্বরের এত কাছাকাছি আওনের সুযোগ ওরাই বা হাতছাড়া কইরব ক্যান। নাতনিরে লই তেনাদের গর্বেরও শেষ নাই। কদ্দিন হইল হেথি কোমরে চোট হাই বিছানা নিছে। মনের মধ্যে ভারি চিন্তা ভাই কইছে ইস্কুলের প্রশ্নগাইন আনি ঘরের তুন পরীক্ষা নিব। চিন্তায় বেটির ঘুম নাই। কোমরের যন্তনায় কাতরায়, পরীক্ষা দিব ক্যামনে। ঠিক হইছে ওর বাপ হইব হেথির হরিক্ষক। হাশ কইরত হাইরলে দশ টিয়া পুরষ্কার আর সাট্টিফিকেট। মাইয়া তো খুশিতে ডগমগ। এদিকে চোয়ের জলও ধরি রাইখতে হারে না, গাছের পাতার তুন জল হড়ার মতো করি হোটাঁ হোঁটা হড়ে। যে কটা পাতা হোলা বুঝাই দিই যায়, মন দিই হড়ে, সামনের হপ্তায় হড়া ধইরব যে। ঘরদোরের কাম সামলাই তবে না বই লই হইড়ত বইব। অন সুযোগ পাইলেই হক্কলের লগে তর্ক জুড়ি দেয়। এই লই বাড়ির কাকিমা জেঠিমা দিদিরা তো কথা বইলতে ছাড়ে না – লোপা আইজকাল টক্কর টক্কর কথা কয়। কিছু কথা কইবার জো নাই জবাব তুবড়ির ফুলকির মতোই ছোটে। যে যত কিছু কক, মাইয়া কী সহজে হার মানার পাত্তর। লোপার চলাবলাও হালটি গেছে। সংসারে যে রীতিগুন আমরা মানি চলি, সহজে আর মিনতি চায় না, খালি জাইনত চায় এইসব কে শিখাইছে, কিয়ের লাই মানি! জন্ম- মৃত্যু, স্বর্গ-নরক, পূজা-আচ্চা লই হচনের পর হচন করে। হক্কলে হাসে যন জিগায় – আমনেরা হাসলেন ক্যান। তাকের তুন বই হাড়ি হাতা উলটাই দেয়ায় – এই চান কী লিখছে, আমনেরা তো কোনোকালে একটুও হড়িও দেইখলেন না।  আঁই আবার কইতে ছাড়ি না অল্পবিদ্যা ভয়ংকরী। হেথির ঠাকুরমা কয়, ‘হবে তো মূলার এক হাতা, আর তো দিন হড়ি আছে।’

মাইয়ার হড়ালেখা লই বাড়ির মাইনষের চোখাচোখি কানাকানি। জেঠা কাকাদের চোখ টেরা হই যার। কারে কী কমু আঁর এক দেওর আই খবর দেয় ‘হুইনছেননি বৌদি সকলে বলাবলি করের আমনেরা নাকি ঘরের মধ্যে ইস্কুলের বন্দোবস্ত করনের। লোপা নাকি শহরের ইসকুলের মাষ্টারের তৈরি প্রশ্ন লই ঘরে বই হরীক্ষা দিব। তাইলে আমরা কী মুখ দেখাইতে হারুম।’ আরে মাইয়ার আঁর বড় হই মাষ্টারনি হওয়ার সখ। কইলকাতা তুন আঁর বড় হোলা, ঠাকুরপো চিঠি লিখছে। চিঠিতে কত সুখ দুঃখের কতা। হিয়ানে মাইয়াদের আলাদা ইসকুল আছে, দিদিমণিরা হড়ায় প্রাইমারি ইসকুলে, হাই ইসকুলে। ওই চিঠি হড়ি হড়ি মনের ভেতরের গোপন ইচ্ছাটা জাগি উইঠছে। আঁরও তো অল্প বয়সে বিয়া হওয়াতে আর হড়তাইম হারি ন। আঁর স্বপ্ন আর মাইয়ার স্বপ্নখান মিলিমিশি এক হই যাওয়াতে আঁই সায় দিছি। বুইঝনি ঠাকুরপো নিজের মাইয়া বলি কইছি না মাইয়ার মাথা ভালা, একবারের বেশি দুইবার বইলত হয় না, সব ঝরঝর করি মুখস্ত বলি দিতে হারে। তোঁর বিশ্বাস না হয়, হরীক্ষা লই চাও না। তুঁই কী চাও না তোঙ্গ বংশের মাইয়া বিদ্বান হোক। হেথাগরে দেই তোঙ্গ লেদা মাইয়াগুন দেই শিখব। ‘কী যে কন, হেঢাই তো মুশকিল। হক্কলে ওই নিই তো পেচাল পাড়ের, আঙ্গ গ্ৰামে এমন বেআক্কেলে কআণ্ড জম্মে দেখেনি। হড়ালেখা কইরত যাই মাইয়ার বয়স হই গেলে বিয়েসাদি ক্যামনে দিমু।’ এই কথাটা ভাবি চাও তো, তোঁর মাইয়া মূর্খ থাইকলে হেথির হোলামাইয়ারে কী শিখাইব। পুরা জগতটা অন্ধকার লাইগব, এক বিন্দুও আলো হাইতন। দুনিয়াদারি হালটি যার ঠাকুরপো, এট্টুও কী টের হাইচ্ছ না। আঁর কথা ঠাকুরপোর হচন্দ হইল না, মাথা চুলকাই চৌকাঠ ডিঙ্গাই চলি যায়। কোনও জবাব যে নাই হেথের কাছে।

মাইয়া আঁর দরজা বন্ধ করি কী করের কেউ জানে না। হেথির খুড়তুতো জ্যাঠতুতো বইনেরা বাড়ির চৌহদ্দিতে ঘুরি ঘুরি বেড়ায়, ভাইরা হান্ডাগুলি মারে। লোপারে অন দলে না হাই চিন্তার একশেষ। শেফালীর ভাগে হইরছে মাসের পনের দিন হুজার ভাগ। হুজাআচ্চার নিয়ম কানুন ষোল আনা রপ্ত কইরছে। ধোয়া একখান শাড়ি হরি, হুইরে যাই বালতি করি জল আনে, হুজার বাসন ধোয়াপালা করি মন্দিরের দরজা ঠেলি দিই হুজায় বসে। হাঁচালিখান লোপাই সুর করি জোর গলায় হড়ি দেয়। অন আর কোথায় খুঁইজা হেথাগরে। উপায় নাই, তাই জিগাইন মুখস্ত আছে, হিগাইন বার বার হড়ে। দরজার বাইরে মন্দিরের উঠান। বাস্তুগাছ ডান কোনায়, বাঁ কোনায় গয়াম গাছ আর পশ্চিমে করবি ফুলের হাতায় ছড়াই থায়। লেদা মাইয়াগুন ঝাড় দিই হরিষ্কার করি রায়। নিচে নামলেই লাউ মাচা, কুমড়া মাচা। হলদি রঙের কুমড়া হুল আর সাদা রঙের লাউয়ের হুল, ডগার তুন হাতার গন্ধ বার হই বাতাসে ভাসে। লাউডগা সাপ লকলকাই উঠে। শেফালি ঘন্টা বাজায়। মন্দিরের ধার ঘেঁষি আঙ্গ বাড়ির কুত্তাগুন হুই থায়। শব্দের আওয়াজ হুনি হেগুনে গলা উঢাই ঘেউ ঘেউ করি ডাকে। বাড়ির বউ মাইয়া হোলারা বুইঝত হারে হূজার আরতি হুরু হই গেছে। অন বেলা বারোটা, বাজার তুন ব্যবসাপাতি বন্ধ করি ব্যবসাদাররা ঘরমুখো হইব। মাঝিরাও ঘাটে নৌকা ভিড়াইব। লোপারে মাইয়ারা হুজাআচ্চা তুন হক্কল কামে লগে হাইত, হেথি এখন বইয়ের হাতা খুঁজি মরে। যাগো মুয়ে অনও ঠিকমতো খই হোডে না, হেগুনেও সিলেট পেন্সিল বই লই নাড়াচাড়া করে। বইয়ের রোগ তো যেন তেন রোগ নয়, ছোঁয়াছো রোগ, একবার ধইরলে আর ছাড়ে না। লোপা হেগুনেরে গল্পের মতো করি বুঝাই দেয়, ওরা এমন ভাব করি হোনে যেন অন্য দেশে চলি গেছে। ওরা ভালা করি জানে ভাইদের মতো ওরা কোনোদিন ইসকুলে যাইত হাইরত ন। তবু কিয়ের লাই জানি মনের মধ্যে যেন আনন্দই আনন্দ, লাফায় ঝাঁপায়। লোপার হিছন হিছন ঘোরে। হেথিগো  বাবারা কয়, ‘তোগো কোনো কাম নাই, মা’র হাতে হাত লাগাইতে হারচ না, কামকাজ না শিখলে চইলব কেমনে। হৌর বাড়িতে যাই তো মুখ ঝামটা খাইবি দিনরাত। আঙ্গ হোড়া কপাল মাইয়ার হড়ার ঠেলায় সব সম্বন্ধগুন ভাঙ্গি যার। মত নষ্টের গোড়া ওই বড় বৌদি মাইয়াগুনের মাথা খার। লক্ষ্মীর পাঁচালি শনির পাঁচালি হইড়তে হাইরলেই তো হইল, না মাইয়াগুন পণ্ডিত বানাইবার সখ। কিছু কইবার কী জো আছে, কইত গেলেই তো পাঁচ কথা হুনাই দিব, হেথেনেই জানে হড়ার মধ্যে কী মধু আছে!’ আঁই কথাগাইন হুনি মনে মনে হাসি। গান আছে না – দোষ কারো নয় গো মা, আমি স্বখাত সলিলে ডুবে মরি শ্যামা…। বাপের ঘরে এক কাকা একতারা বাজাই গান কইরত, ভেতরটা তন কেমন করি উইঠত। অত কথার অর্থ কী তন বুইঝঝি ! অন বয়স বাড়ছে, বুইঝতাম হারি, খুব না দিত হাইরলে কিছু বোঝা যায় না, গাঙের জলের মতো ভাসি ভাসি চলি যায়, কুলকিনারা খুঁজি হাওন যআয় না যে হাড়ে উইঠব, অক্ষরের জাদুতে কত যে মায়া, ডুব না দিত হাইরলে বোঝা যে সহজ কথা নয়, খালি জল আর জল। মাইয়া আঁর শিখত চায় কিন্তু কে আর মুয়ের কাছে খাওন আনি দিব। চারিদিকে দুর্মূল্যের বাজার, কার অত আর পয়সাকড়ি আছে, দামদর করি খুঁজি আইনব। খুদকুঁড়া যিয়ানে যদ্দুর হায়, খুঁজিপাতি আনে। টঙে আঙ্গ থরে থরে হাজানো রইছে কত হুরান কাঁসা পিতলের থালাবাসন কলসি ডেগচি। দরকার না হইলে কে আর নাড়াচাড়া করে। এই মাইয়ার বড় সখ। দিনদুপুরে ঝনঝন আবাজ করি সব তছনছ করি হালায়। কার কথা কে হোনে – ও লোপা কী করচ, চাপা হড়ি তুই মরবি তো একদিন, তন তোর আক্কেল হইব, তুই তো মরণপণ কইরছস কারও কথা হুইনতি ন, তাইলে আর কি, হাত-পা ভাঙি হড়ি থাক। ওমা, মাইয়ারে দেই সিঁড়ি বাই বাই টঙ তুন নামের। লাল শালুতে পেঁচানো কী একটা বুকের মধ্যে চাপি ধরি আছে। সোনাদানা হাইলে চোয়েমুয়ে খুশির ঝিলিক মারে, হাবভাব দেখি ওইরকমই লাগে। কোনো কথা না বলি মাঝ ঘরের হেছনে ঘরটায় চলি যায়। ওই ঘরটাতে হেথির যতো নিজের লগে নিজের কথা কওয়া, শয়তানি, মদ্দানি। কাউরে ঢুইকত দিত ন। হুরা বাড়ির মধ্যে ওই একচিলতা ঘরই হেথির সম্পত্তি। মাঝে মাঝে রাগি গেলে কই – তোর হৌরবাড়ি যাইবার কালে এই ঘরটাও তুই লগে লই যাস। মাইয়া এই কথা হুনি মুখ ভার করি হালায়। কিন্তু মাইয়া টঙ তুন কী নামাই আইনল দেইখত তো হইব। খুলি দেই এক আশ্চর্য জিনিস। চৌকোনা ভারি ভারি। খুলি দেই আরে, এই তো বই। লেখক: বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কলকাতার তুন কেউ আনাইছে। হুইনছিলাম আঁর এক দাদাহৌর গান গাইত, কবিতা লিখত, নোবেল হইড়ত, হাগলামি করি ঘুরি ঘুরি বেড়াইত। কোন কামকাজে মন দিত না। রাগিমাগি হেথেনের বাপ মন ঠিক করনের লাই পণ্ডিতের বাড়ি হাডাই দিছিল। সে এক আজব কাণ্ড। হেথেনের হিয়ানেও মন টেঁকে নি। কন্নাই যে হলাই গেছিল, ঈশ্বর জানে। এদ্দিন বাদে এই মাইয়া খুঁজি খুঁজি বার কইরছে। বিধির কী খেলা! কার ধন কার কাছে হয় অমূল্যরতন! মাইয়ারে আঁই কী কইয়ুম, নোবেল হইড়তে বারণ করুম, না হেথির যেমন ইচ্ছা মন চায় করুক বলি ছাড়ি দিমু, ঠিক কইরতাম হারিয়েন না। হেথির বাপ হুইনলে তো মাথা গরম করি হালাই লঙ্কাকাণ্ড বাঁধাইব, যা চেতা মানুষ। মাইয়া তো ঘরের মধ্যে মাথা গুঁজি খালি নোবেল হয়ে। স্নানের কথা ভুলি যায়, ফাঁক হাইলে আবার বইয়ের হাতা উলটায়, নেশার মতো হাই বইছে। মাইয়া তো আঁর কতা হুইনত ন, অন কারে কই। শেষমেশ শহর তুন হোলা বাড়ি আইলে হেরে কইলাম। হেথে কইল, ‘মা, আমনে কিচ্ছু চিন্তা করিয়েন না, দিদিরে আঁই বুঝাই কমু।’ মাইয়ারে আঁই জিগাইলাম, তুই কী হড়স? উত্তর দিল একখান কথায় – ‘রাধারাণী’।

কইলকাতা তুন এক নাতজামাই আইছে। বাড়ির হোলাপাইনরে লই জামাইয়ের আমোদ আহ্লাদের শেষ নাই। এত্ত বড় শহর, হক্কলের লাই হিয়ান তুন একটা না একটা কিছু লই আইছে। মজার এমন এক জিনিষ আইনছে, যা আগে কেউ দেয় নাই। নতুন এক জিনিস দেই হক্কলে হতবাক। আগে এর নাম হুইনছে, স্বচক্ষে দেয় নাই।  উঠানে চাটাই হাতি গোল হই বই হোনে এক বাক্সের ভেতর তুন বার হই আয়ে মাইনষের কন্ঠ। যাত্রাপালা: নটি বিনোদিনী হোলামাইয়ার মনের মধ্যে আনন্দের ঢেউ উঠায়। এক দল আবার গোল হই নাচে। দলিল মিঞা দূরে চোখ পিট পিট করি চায়, তাইলে এর নামই রেডিও। লোপা কয় মা এই রেডিও কে বানাইছে জানেন নি ? উত্তরও দেয় নিজে, মার্কনি। এমন একটা আশ্চর্য জিনিস আঙ্গ বাড়ির উঠানে যে কোনদিন বাইজব, কল্পনাও তো কইরত হারে ন। নাতজামাই কইল,  ‘কাল মহালয়া, কাল সকাল সকাল সকলে ঘুম থেকে উঠবে।’ ‘কিয়ের লাই, কন।’ সকাল হইল, বাড়িশুদ্ধ লোক উডি আই আমবাগানের নিচে আই জড় হইল। রেডিও চালু কইরতেই শুরু হই গেল মহালয়া ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের এমন গলা জম্মে হুনি নাই। এমন যে হইব, আগে কেউ জানে ন। আমবাগানের নিচে যেন মেলা বই গেছে। কোথা তুন যে এত লোক আইছে চোয়ের নিমেষে। চার বাড়ির বউঝি, হোলারা, কর্তারা হাজির হই গেছে। এমন কীর্তি এই জনমে দেই ন। হক্কলের আনন্দ আর ধরে না। সূর্যের আলো আমগাছের ফাঁকফোকর দিই ঠিকরাই হড়ের। মা যেন জাগি উডের। কারো মুয়ে কোনো কথা নাই। মহালয়া শেষ হই গেছে, কারও এট্টুও নড়ন চড়ন নাই। এই আশায় বসি আছে যদি ফের শুরু হয়। একজন গ্যাতি হৌরি জামাইর মাথায় হাত দিই আশীর্বাদ কইরল, ‘জামাই কী হুনাইল, কোনোদিন ভুইলতাম ন, বাঁচি থাক।  কইলকাতার লোকেরা কী ভাগ্যবান, বছর বছর হুইনত হায়, আমরা পোড়াকপাইললা এত ভালা ভালা মায়ের গল্প গান হুইনতাম হারি না।’ আঁর মাইয়া মনের খেয়ালে কই হালায়, ‘মেসো, একখানা রেডিও কিনে দিয়েন চাই।’ সরল মনে কি মনে আইল, কই দিল। হেথি যা দেয়, মনের মধ্যে গাঁথি হালায়। আঙ্গ গ্ৰামের লোক আগে কনও রেডিও দেয়নি। হিয়ের লাই হামলাই হইড়ছে। বাক্সের মধ্যে নিশ্চয়ই করি মানুষ আছে, না হইলে এত কতা কয় কেমনে! এই সকল কথা হুনি জামাই হাসে। হেথি অবাক হই ভাবে কত কিছুই অনও শিখনের বাকি আছে। জামাইয়ের মুয়ে গপ্প হুনি হুনি চোখ বড় বড় করি চায়। ফোনে এক জায়গা তুন কথা কইলে অন্য জায়গা তুন হোনা যায়, অমন আজব যন্ত্রও হয়! শহরের মাইনষের মাথায় কত না বুদ্ধি, আঙ্গ মাথায় গোবর পোড়া। 

খাওয়া নাই, নাওয়া নাই, মাইয়া খালি হড়ে। ভুতে হাইছেনি! ভাই বাড়ি আইছে। প্রশ্ন করি করি হাগল করি হালায়। এত প্রশ্ন কইরলে উত্তর দিবে ক্যামনে। যারা ইসকুলে যায় হেথাগো চাই দিদির বুদ্ধির বহর দেই আঁর হোলা আকাশ তুন হড়ে। কেন্নে দিদি হাতার পর হাতা মুখস্ত বলি দেয়, ইসকুলে হইড়লে ফাষ্ট সেকেন্ড তো হইতই। দুঃখ করি কয়, ‘এইদেশে যদি মাইয়াদের হড়ার বন্দোবস্ত থাইকত, কন্নাই চলি যাইত আঁর দিদি, হোলাদের সাধ্য কী ধরে।’ মাষ্টারের জিগায়, ‘স্যার, মাইয়ারা কেন ইসকুলে হইড়ত আইত হারে না। মাষ্টারের মুখ দিই নাকি কোন কথা সরে না। সহপাঠীরা এদিক ওদিক চায়। মাইয়ারা কিয়ের লাই ইসকুলে আইব? হেথিরা হড়ালেখা করি কীই বা কইরব? এমন বেঢপ প্রশ্ন কেউ কাউরে করে? মাইয়ালোকের বুদ্ধি কোন কামে আইব?  ডেগ মাষ্টারি, ঘর গোছানো আর বাচ্চার জম্ম দিবার লাই নাকি মাইয়াদের ভবে হাডাইছে। এইসব কথা হুনি আঁর জেদ চাপি গেল। যেমনে হোক তেমনে হোক মাইয়ারে আঁই হড়াইয়ুম। ঘর সংসারের কামকাজ তো কইরতেই হয়। এত্ত বড্ডা পরিবারে হক্কলের বাঁধাধরা কাম তো আছেই। বাগানের তুন লাকরি কুড়ানো, উঠানের ঝাঁট দেয়া, বাসন মাজা, কাপড় কাচা পালা করি, পূজা আচ্চা, পাঁচালি হড়া কোনটা আর বাদ আছে। সময় বাঁইচলে বাড়ির অন্য মাইয়ারা যন গালগপ্পো করে, আঁর মাইয়া তন বই লয় বয়। একখান ঘর আছে, হিয়ানে কেউ ঢোকে না, চাটাই বিছাই হারিকেন জ্বালাই হইড়ত বয়। বেশিক্ষণ তো হড়ন যাইত ন, কেরোসিন তেল মাঙ্গা। হইড়তে হইড়তে ঝুরি হড়ি যায়।  নরম স্বরে কই, যা মা চোয়ে মুয়ে জল দিই আয়, ঘুম চলি যাইব। কদিন বাদে ঘরে বই হরীক্ষা দিব ওর বাপ। ছ মাস হরে হরে হরীক্ষা দিতে হইব, যদি একবার ফেইল করি রায়, বাপ ওর বকুনির চোটে ভুত ভাঙ্গাইব। বাংলা, ইংরাজি, অঙ্ক, ইতিহাস, ভূগোল আর বিজ্ঞান কোনটাই কি আর বাদ যায়। স্লেট পেন্সিলে এক অঙ্ক বার বার করি মোছে আর কষে। হরে হরে হপ্তায়ের দেওয়া অঙ্ক কুড়িটা করি কাঠ পেন্সিল দিই খাতায় করে। ভূগোলের ম্যাপ আঁখিতে হেথি ভয় হায়। বাপের ধমকের চোটে কাঁচুমাচু খাই যায়। তবে একখান জিনিস খুব লাভ হইছে। লেদা হোলাপাইনগুনে জাইনত চায় ‘দিদি, তুই কী হড়স রে?’ ‘রামায়ণ মহাভারতের গল্প হড়ি, তোরা হুইনবি?’

এই তো গেল নিজেদের বাড়ির কতা। হক্কল কতা বাতাসে ভাসে। এই বাড়ি ওবাড়ি করি কন যে কথা গাইন ভাসি চলি গেল। মাইনষে যে কেন সহজে অস্থির হই যায়, কে কইব। নতুন কিছু হুইনলেই চোখ টাটায়, রে রে করি তাড়াই আসে। কত কতার আগুন ছড়ায় – মাইয়া মাইনষের আবার হড়া কী ? কারা আই কতা হুনাই যার, আঙ্গ চার হুরুষ আগের গ্যাতি, কত বছর আগে ভাগ বাটোয়ারা হই নতুন বাড়ি হই গেছে, তবুও কতার পিঠে কতা রাইখতে ছাড়ে না। নতুন কিছু কইরত গেলেই খবরদারি করে। লতায় পাতায় জেঠা আই কয়, ‘এটা কিন্তু তোরা ঠিক করছেন না। আঙ্গ বাড়ির মাইয়াদের উসকানি দেয়ছের। হেথিরা কত বায়না ধরের, কওন হুরু কইরছে বই হইড়ব। এটা আবার একখান কথা হইল। উত্তুরের বায়ু দক্ষিণে আইলে যেমন আজব লাগে কতকটা তেমন। এত কিছু মাইয়াদের মাথায় ঢুইকলে যদি বেচাল হই যায় তন সামলাইতে হাইরবি নি, মাথায় চড়ি বইব।’ ওই জেঠার কতা হুনি আঁই তো আকাশ তুন হইরলাম। রাগ করিয়েন না জেঠা, একখান কথা কই। যদি মাইয়ামানুষের লই আমনেগো এত মাথা ব্যথা, তো খালের জলে ভাসাই দেন, আমনেরা একাই ঘরে থান। ‘এই তুমি কী কতা কইলা, ঘরে বউঝি না থাইকলে চলে, রাজ্যের কাম কইরব কে?’ ও এতক্ষনে আমনে হাঁচা কথাখান কইলেন। আঙ্গ ক্ষমতাখান দেইখলে আমনেরা এত ভয় পাই যান ক্যআন? মাইয়ারা বাঘ না ভালুক যে সুযোগ পাইলেই হুরুষ মাইনষের মাথা মুড়াই খাইব। মাইয়াদের এট্টু সুযোগ দিই দেয়েন না শেষকালে আমনেগো লাভ ছাড়া লোকসান হইত ন। বৈতরণীও হার করি যাইবেন এক লাফে। ‘তুঁই এইটা কী কও কমলের মা, তোঁর কি এট্টুও বোধজ্ঞান নাই, মাইয়ারে হড়াইতে চাইছ হড়াও, এর ফল কিন্তু ভোগ কইরত হইব। নিজের মাইয়ার সব্বনাশ কইরছ কর, হুরা গ্ৰামের হিন্দু মাইয়াদের হরকাল ঝরঝরে করি দিও না। এমনিতে  হুইনতে আছি হিন্দু মাইয়াদের ধরি ধরি বিয়া করার হিড়িক হইড়ছে মোসলমানদের মধ্যে, সেই জ্বালায় জ্বলিহুড়ি মরিয়ের,  তাড়াতাড়ি হরের বাড়ি হার কইরতাম হারইলে বাঁচি যাই। দেশকালের অবস্থার কথা তো একবার ভাইববা।’ কথাটা যে এক্কইবারে হালাই দিবার মতো নয়, কিন্তু মাইয়ার স্বপ্নটারে জলাঞ্জলি দিই কেমনে? ক্যামনে মাইয়াটারে কই, তোর হড়া বন্ধ করি দে। মাইয়া তো মুখটারে বেজার করি হালাইব তন। তবে মাইয়ার আঁর মনের গতি অনেক হালটি গেছে। মতো রাজ্যের খুঁতখুঁতানি ছুঁতমারগ আর আগের মতো মাইনত চায় না। হছন্দ না হইলে কতায় কতায় তর্ক লাগাই দেয়। কতায় কতায় কইছিলাম, স্নান করে লোহা হাতে বাড়ি আসতে নাই। মাইয়া মুয়ের উপর জবাব দিল, ‘এমন কতা কইও না মা, তা হইলে হড়ালেখা শিখানোর লাই এত উডিহড়ি লাইগছ ক্যান?’ মাইয়ার কতা হুন, এতকাল যা মানি আইছি, আঙ্গ বাপ ঠাদ্দারা, হৌড় হৌড়িরা যা মানি আইছে বেগ্গাইন ভুল ! এতদিনের শিক্ষাদীক্ষা সহজে ভুলন যায় রে মা, মন তুন তাড়াইতে সময় লাইগব। তোরা আজকাইলার যুগের মাইয়া, তোগো মতের লগে আঙ্গ মতের ফারাক তো থাইকবই। এই ধরছ না, কাল তো মনসা হুজা, উপাস করবি, মা মনসার গান করবি, আচার বিচারও মাইনবি, কাঁসর ঘন্টা বাজাই নমোও করবি, কলা, নাইরকল, তিলের সন্দেশ দিই ভোগ নৈবেদ্য দিবি তো, কলার খোলার ভেউঁরায় চিয়ঁই পিঠা রাই বাতি জ্বালাই হুইরে ভাসাইতি ন, কলাপিঠা বানাইবি। তোর বইয়ে কি ইগাইন লেখা আছে? নাই, মনের ভেতরে ঢুকি আছে, যুক্তি তক্ক করি এমন অনেক কিছুরই কুল কিনারা হাইতি ন। আমরা যে বত-এর ভাত খাই – আশ্বিনে রাঁধে কার্তিকে খায়। যেই বর মাগে হেই বর পায়।। সংক্রান্তির দিন আতপ চালের ভাত রাঁধি হরের দিন সেই ভাত গুড় নাইরকেল কোরা গন্ধ লেবু দিই চটকাই খাই, হরে ট্যাহা বৈচা, চাঁদা মাছ কড়া ভাজি দিই হান্তা ভাত খাই আনন্দ করি, এই নিয়ম কনডাই লেয়া আছে, মাইনষে নিজেই খুঁজি নিছে দরকারে। এইসবেরে অস্বীকার করুম ক্যামনে, তুই ক।  সময়ের পায়ে মাথা নোয়াইতে হয়। মাইয়া আঁর কথা হুনি ধন্দে হড়ি যায়। হেইলে কী দুই রকমের শিক্ষা হয়! মাথা চুইলকাতে চুইলকাতে ভাড়ার ঘরের দিকে চলি যায়।

মাইয়া আঁর শ্রীপঞ্চমী দিন হুজা করে ঘটা করি। হিঢা হায়েস বানায় নিজের হাতে। বেড়ার ফাঁক দিই চিতল হিঢা নিজেও খায়, ভাই বোনেদের খাওয়ায়। হেই বেলা খুব বিশ্বাস করে হেইলে মনে রাখবার ক্ষমতা নাকি বাড়ি যাইব। হেই বেলা আর মুক্তির ধার ধারে না। হড়ালেখার ভুত যে হেথিরে চাপি ধইরছে চার ধার তুন। 

হেথি ভূগোল ছাড়া হক্কল বিষয়ে হুরা মার্কস হাইছে। রসা মাষ্টার দিই হেথির বাপ খাতা দেখাইছে। নিজে দেইখলে ঠিক বিচার যদি না হয়। মাইয়াও তাতে  খুশিতে ডগমগ। আরও বেশি খুশি হইছে এইবার বাপ যন কইছে নতুন বই খাতা কলম কিনি দিব। এতকাল তো গোপনে হুরান বই দিই হইড়ছে। নতুন বইয়ের গন্ধই আলাদা। চারহাশে ছড়াই যায়। বিকাল তুন এঘর ওঘর করে বাপ কন নতুন বই আনি দিব শহর তুন। সদর দরজার দিকে তাকাই থার কন নৌকা আই ঘাটে আই ভিড়ব। আঁরে হুদ্দা হাগল করি হালার বাপ কন আইব। ঘরের চৌকাঠ ডিঙ্গাইলেই  ঝোলাটা বাপের কাঁধের তুন টান মারি হালাই দেয়। বইয়ের ছবি দেই চুপ মারি যায়, কি কইব আর কি কইতন বুঝি উইঠত হারে না।  খালি নাকের কাছে নি গন্ধ শোঁকে। হক্কলরে তুলি তুলি দেখায়। নাইচব না গাইব বুঝি উডোনের আগেই ছড়ছড়্ করি বইগুন হাত তুন মাঢিতে হড়ি যায় । কত না অপরাধ কইরছে ভাবি ঝারিঝুরি বইগুন লই কপালে ছোঁয়ায়। হক্কলে জড় হই দেখে এমন অবাক কাণ্ডকারখানা! মাইয়ার হাগলামি দেই আঁইও ভালামন্দ দু’এক কতা হুনাই দিই।  টেবিল চেয়ার তো নাই চইয়ের এক কোনায় সাজাই গোছাই রাখি দেয়। রসময় মাষ্টার দরজার সামনে দিই যাইবার সময় কী মনে ঘরে আই ঢোকে। ‘নতুন বই বুঝি, লোপা? উঁচা ক্লাসে উইঠছ, এইবার কিন্তু আরও ভালা করি হইড়ত হইব, কেমন।’ রসময় মাষ্টারের কথাগাইন একটু শুদ্ধ শুদ্ধ লাগে। মাইয়ারে সাহস জোগাইলাম এই জীবনটা হুরাটাই তোর, যেমন ঢঙে বাঁইচতি চাস বাঁচ, আঁই কিচ্ছু কইতাম ন। ঝওলআভর্তই বইখাতা লই দুইধারে দুই বেণী ঝুলাই দুইতে দুইতে চলে। আঁই চাই থাই। যেদিক যাইত চায় যাক। হাঁডি হাঁডি আজ না হয় কাইল হেথির লক্ষ্যে পৌঁছি যাইবই, এই বিশ্বাস আঁর আছে। ভয় তো লাগে, রাস্তাঘাটে কাঁচা মাঢির ভেতরে কত সরু সরু কাঁটা, কন যে হায়ে হুঁডি যাইব, কে জানে। এই বাড়ি তুন সেই বাড়ি যাইতে বাঁশের হামা, ধুপুস করি যদি খালে হড়ি তাই জলের তোড়ে ভাসি যাইব। হেথি ভরসা দেয় – মা, আমনে কোন চিন্তা করিয়েন না, হড়ালেখা শিখনের লাই কষ্ট কইরত হইত ন, কন। আমনেও তো কত কষ্ট কইরছেন, হক্কলের বিরুদ্ধে যাই মাইয়ারে হড়াইতে চান। রসময় মাষ্টারও চায় মাইয়ারা যাতে হড়ালেখা করে। মাইয়া আর জান হরান দিই জোরকদমে মনযোগ দিই হড়ে। কামের ফাঁকে হড়া মুখস্ত করে। মাষ্টার কয় হেথিরে এক ক্লাস উপরের বই আনি দিতে, ছয় মাসে সব বই হড়ি হালাইছে কিনা। মাষ্টারেরে এমন প্রশ্ন নাকি করে, কোন উত্তর দিতে হারে না, আজব মাইয়া বটে। মাষ্টার কয়, ‘এত ছাত্র হড়াইলাম, এমন ছাত্রী জম্মে দেখি নাই, হোনার টুকরা মাইয়া। ভাগ্য ভালা, এমন মাইয়া পেটে ধইরছেন।’

(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *