বিদ্যুৎ মণ্ডল

পঞ্চম পর্ব

বরফে ঢাকা মানালি পাস

ঐ হাড়হিম করা শীতের রাতে দশ-পনের মিনিট স্নো লেপার্ড এর সন্ধানে জঙ্গলে অনুসন্ধান চালানো হল। কিন্তু না শেষমেশ হতাশ হয়ে ফিরে আসতে হল। তাওজি বললেন, “বেচারা কাহা ছুপকে ব্যাঠা হ্যায় উসে ঢুন্ডনা বহত মুশকিল হ্যায়।” অগত্যা অখুশি হয়েই ফিরে আসলাম। মনে মনে ভাবলাম স্নো লেপার্ডের এত কাছে এসেও দেখা হল না। বনফায়ারের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে। রাতও অনেক গভীর হয়েছে। বিষণ্ণ মনে অবসন্ন রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবছিলাম। হঠাৎ বুদ্ধিজির আওয়াজে ঘোর কাটল, “সুরেশ গোট্টু থা। আগ কি দুয়ো লেনে আয়ি থি।” আমি উৎসাহভরে জিজ্ঞেস করলাম, “বুদ্ধিজি, গোট্টু কনসি জানবর হ্যায়? বো ক্যা ইনসান খাতে হ্যায়?” বুদ্ধিজি হেসে হেসে বললেন, “ইস জানবর স্রিফ পাহাড়োমে মিলতা হ্যায়। কভি কভি ভুখি গোট্টু কো ইনসান খা জাতা হ্যায়।” চোখদুটো বড়োবড়ো করে গোল্লা পাকিয়ে বললেন, “গোট্টু লেপার্ড নহি হ্যায় লেকিন উসসে ভি খতরনাক হ্যায়।” বুদ্ধিজির ভয়ানক ভঙ্গিতে বোধহয় রাতের আকাশের মায়াবী পরিবেশ ভয় পেয়ে আরও মায়াবী হয়ে উঠল। যাইহোক, আবার কাল খুব সকালে যাত্রা শুরু করতে হবে। ফ্রাইড রাইস চিকেন আর কিছু একটা সব্জির আয়োজন করা হয়েছে ডিনারে। বেশিরভাগ সকলে খেয়ে স্লিপিং ব্যাগের মধ্যে গ্যারেজ হয়ে গেছে। আমি খাওয়া সেরে বাইরে একটু পাইচারি করছি। মাথার ওপর নীল আকাশ, দু একটা তারা মিটমিট করে জ্বলছে, বাইরে অন্ধকার গাঢ়। হু হু করে শীতল বাতাস এসে গায়ে ধাক্কা মারছে। দু-তিন দফা গরমের পোষাক পরেও গা হাতপা ঠাণ্ডায় জমে বরফ হয়ে যাচ্ছে। বেশিক্ষণ থাকলে নিউমোনিয়া হয়ে যাবে ভেবে তাঁবুতে ফিরে শুয়ে পড়লাম।

পরদিন সকাল ছটায় ঘুম ভেঙে বাইরে তাকিয়ে দেখি মেঘের পাহাড় জমে আছে চারিদিকে। মেঘেদের এত ভিড় জমেছে যে পাশের তাঁবুই চোখে পড়ছে না, অতিরিক্ত ঠাণ্ডা। মেঘ গলে তাঁবুর মাথার ওপর জল থলথল করছে, ভেতরে দু এক ফোঁটা জল চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে। তৎক্ষণাৎ জমা জল ফেলে দিয়ে তাঁবুর মধ্যেই অপেক্ষা করছি কখন রোদ্দুরের আলো গায়ে মাখবো এই ভেবে। মিনিট পাঁচ-সাতেক পর মেঘেদের দল ঘরে ফিরে গেলে ঝলমলিয়ে রোদের আলো ঠোকা মারে তাঁবুর দরজায়। দরজা খুলে দেখি বনফায়ারের আগুন তখনও জ্বলছে একইভাবে। আমাদের সবকটি তাঁবু ভিজে সোপ সোপ করছে। কাজেই সেগুলি ভালো করে না শোকালে আজরাত্রিতে কষ্টের শেষ থাকবে না। তাঁবুগুলোকে খুলে রোদে শোকাতে দেওয়া হল। পরিকল্পনা মাফিক সাড়ে ছয়টার মধ্যেই নতুন পথে যাত্রা শুরু করার কথা। মজার বিষয় হল, গতরাতের ভয়াবহ চিৎকারে ভয় পেয়ে দিনের বেলায় নীচের জঙ্গলে যেতে একা কেউ সাহস পাচ্ছে না। গতরাতের স্নো লেপার্ডের চিৎকার বিভীষিকার মতো গেঁথে আছে সকলের মনে। যাইহোক, যতক্ষণ না তাঁবুগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে পুরোপুরি যাত্রা শুরু করা যাবে না। এদিকে অনেক ভোররাত থেকে টিফিনের আয়োজন চলছে। সম্ভবত খাবার প্রস্তুতও হয়ে গেছে।

সকালের খাবার সেরে সাতটার মধ্যে যাত্রা শুরু হয়ে গেল। আগের দিনই রানিসুইলেকে পৌঁছে সেখানেই তাঁবু পাতার কথা ছিল। বিভিন্ন কারণে তা হয়ে না ওঠাই সিদ্ধান্ত নেওয়া হল যে একেবারে মানালি পাসপাসের কাছে পৌঁছে যাত্রা থামবে। যেহেতু পাসপাসের ওখানে বরফে ঢাকা থাকবে সেজন্য আমাদের গন্তব্যের একটু নীচে তাঁবু পাতা হবে যাতে করে পরদিনই যেন আমরা সামিট করে নীচে নামতে পারি। তাছাড়া পাহাড়ের একেবারে চূড়ায় সর্বদা জল পাওয়া যায় না, সারা জায়গা বরফে ঢাকা থাকে। তাঁবু পাতার মতো পরিবেশও পাওয়া যায় না। তাছাড়া পরিস্থিতি বলে দেবে কোথায় কি করতে হবে।

মাইলি থাল থেকে আমরা যত উপরের দিকে উঠছি রাস্তা ততই খাড়া হয়ে চলেছে। ঘণ্টাখানেক পথ অতিক্রম করার পর সামনে এক কঠিন রাস্তা। বিশাল বিশাল পাথর ভেঙে সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। এ রাস্তা ভীষণ দূরহ। একটু অসাবধান হলেই নীচে পড়ে গিয়ে খাতে কিংবা পাথরের ভেতরে ঢুকে গিয়ে প্রাণ বিসর্জন করতে হবে। বুদ্ধিজিকে শুধালাম, “বুদ্ধিজি ইস জাগাকা নাম ক্য হ্যায়? ইধর ইতনা বড়া বড়া পাত্থর কাহা সে আয়া?” বুদ্ধিজি কি জানে কি মনে করে হাসলেন এবং তারপর উত্তর দিলেন, “ইস জাগাকো হম কালাপাত্থর কেহেতা হ্যায়। এক টাইম থা জব ইধর বহত বড়া চট্টান থা। ইস চট্টান কো টপকানে মে লোগোকো বহত তকলিফ হোতা থা। একদিন অচানক সবলোগোনে ভয়ানক আওয়াজ শুনা। লোগোনে দেখা চট্টান না রহি। পুরখোনে কেহেতে হ্যায়, পাহাড়ো কি দেবী কি দুয়া সে এ হুয়ি। উস ঘট্‌না কে বাদ সে সবলোগ পাহাড়ো কি দেবী কো পুজকে আরহা হ্যায়।” তবে, কালাপাত্থর জায়গাটা বেশ খাসা। যেমন ভয়ানক, তেমন সুন্দর। এখানে ৩৬০ ডিগ্রি ভিউ পাওয়া যায়। যেন এক স্বর্গের দেশ। যেদিকে তাকাই সেদিকেই তুষার শৃঙ্গ, প্রত্যেকেই যেন সাদা তুলোর মুকুট পরে আছে। রোদের আলো সেইসব পর্বত শৃঙ্গে পড়তেই তাদেরকে অতীব সুন্দর লাগছে। সেখানে মিনিট পাঁচেকের বিশ্রাম নেওয়া হল। ছবি সেশন হল। তারপর আবার পথ চলা। আশেপাশে কোনো শব্দ নেই, নীচে দু একটা বাজপাখি, চীলের আওয়াজ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। একেবারে সুনসান নিস্তব্ধ। নিস্তব্ধতা ভেদ করে কেবল পায়ের ছপছপ আওয়াজ হচ্ছে। হঠাৎ চোখে পড়ল যে কিছুটা দূরে তুলোর মতো একটা বিছানা পাতা। বুদ্ধিজিকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম যে সেটা তুলোর বিছানা নয়, বরফের আস্তরণ। মনে হচ্ছে যেন তুলো বা সোলার স্তর মেখে আছে পাহাড়ের সর্বত্র গাত্রপোষাকে। দূরে থেকে প্রথমবারের জন্য দেখে বুঝতেই পারছিলাম না। কাছে যেতেই মন খুশিতে ভরে গেল। র‍্যাম্ব ভাই এবং আমি আনন্দে নাচতে শুরু করে দিলাম। বরফের বল বানিয়ে খেললাম। সে কি আনন্দ তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। এর আগে যদিও হেমকুণ্ড অভিযানে গ্লেসিয়ার পেয়েছিলাম। কিন্তু সে আনন্দের মাত্রা এক অন্যরকম। আর এই মুহূর্তে যে আনন্দ, আবেগ, উৎফুল্লুতা সারা মনের প্রাসাদ জুড়ে গ্রাস করেছে তার প্রকাশ করা কোনোদিনই সম্ভব নয়।

আবার পথ চলা শুরু হয়ে গেল। জীবনটাই একটা যাত্রা, যেখানে শুধু এগিয়ে যেতে হয়, থেমেছ তো নিশ্চিহ্ন হয়েছো। যাইহোক, কিংশুক দা এবং বাবাই দা এসকট্‌ হিসাবে পিছনে, তাওজি সার্বাগ্রে এগিয়ে চলেছে, সঙ্গে আমি আর দেবব্রত দা। বুদ্ধিজি তারপর, বুদ্ধিজির সঙ্গে অনিরুদ্ধ দা, তারপর অনুশ্রীতা দি চলেছে। পাহাড়ের ঢাল বরাবর চলা হচ্ছে, স্থানীয় কোনো রাস্তার লেশমাত্র নেই। আমরা যেপথে এগিয়ে চলেছি সেই পথই রাস্তা। তাওজিই আসলে পথপ্রদর্শকের ভূমিকায়। আগের থেকে গতিশীলতা একটু বেড়েছে। সূর্যের তাপ সহ্য করা যাচ্ছে না। ঘামে ভেতরের পোষাক ভিজে গেছে। এক একটা করে পোষাক খুলে ব্যাগের গায়ে ঝুলিয়ে পথ চলেছি। একেকটা পাহড় টপকে চলেছি। ছেলেবেলাতে পড়া ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়ের রচিত ‘কেদারনাথের পথে’র স্মৃতিচারণ করছি আর মনে মনে তৃপ্ত হচ্ছি এই ভেবে যে আমরাও সকলে চলেছি চড়াই উৎরাই পথ অতিক্রম করে। লেখাটিকে কল্পনায় যেভাবে এঁকেছিলাম ঠিক সেইরকমই অভিজ্ঞতা হচ্ছে। যদিও আমাদের অভিযান কেদারনাথ নয়, একেবারেই অন্যরকম। যাইহোক, ভাবলাম সম্পূর্ণ রাস্তাটাই খসখসে শুকনো পাবো। কিন্তু প্রকৃতি আর সঙ্গ দিল কৈ ?

ঝিরিঝিরি বৃষ্টি নেমে এল। ঠাণ্ডাটা বেড়ে গেল নিমেষেই। ব্যাগের সাইড পকেটে পঞ্চু রাখা ছিল, সেটা গলিয়ে নিলাম। হু হু করে পাহাড়ি বাতাস বইছে, যেন বরফের ছ্যাঁকা লাগছে। ক্ষণে ক্ষণে পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ এসে ঢেকে ফেলছে পথঘাট, মেঘেদের চাদর কাটিয়ে চলেছি সকলে। দূরে যে সাদা তুলোর বিছানা দেখেছিলাম একে একে সেই বিছানা অতিক্রম করে রানিসুই হ্রদের কাছে পৌঁছাতে হবে। সাদা তুলোর কাছে আসতেই বুঝলাম যে পাহাড়ের গায়ে গায়ে ছোপ ছোপ বরফের স্তর জমে আছে, কোথাও দশ মিটার তো কোথাও বিশ ত্রিশ মিটার। এখানের সর্বত্রই বরফ ঢেকে ছিল। মে মাস থেকে বরফ গলা শুরু হয়ে যায়। যে স্থানে বরফের স্তরের গভীরতা বেশি ছিল সেই স্থান সম্পূর্ণ বরফ মুক্ত হতে পারেনি। সেকারণেই যত্রতত্র বরফের আস্তরণ। বৃষ্টি জিরিয়ে নিচ্ছে বোধহয়। কিছুপর দ্বিতীয় যে বরফের পথ পেলাম সেটা আনুমানিক দশ-বারো মিটার চওড়া হবে, লম্বায় ঠিক কতটা হবে তা আন্দাজ করা সম্ভব নয়  যেহেতু বরফের আস্তরণ পাহাড়ের গা ঘেঁষে সোজা নীচে নেমে গেছে। দেখলেই গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। বরফের পথ অতিক্রমকালে যদি কেউ পা পিছলে ব্যালেন্স হারিয়ে ফেলে তাহলে আর বলতে হবে না, পাহাড়ের ওপর কেন একেবারে ওপরে উঠে যাবে যে ! কাজেই বরফের পথ যেখানে ঢালু হয়ে নীচে নেমে গিয়েছে সেখানে প্রচণ্ড সাবধানতার সঙ্গে অতিক্রম করতে হবে। বুদ্ধিজি, মনোজ দা, আর আমি প্রথমে পৌঁছালাম। পেছন পেছন র‍্যাম্বো ভাই এবং তারপর আর. যে. ম্যাডাম। বুদ্ধিজি বলে দিলেন কিভাবে বরফের রাস্তা পেরোতে হয়। মাথায় একেবারে গেঁথে গেল বিষয়টা। এক অভিনব পদ্ধতিতে জুতো কাত করে আংটার মতো ব্যবহার করে খুবই সন্তর্পণে বরফের রাস্তা অতিক্রম করলাম, তারপর র‍্যাম্বো। যদিও সে পিছলে বরফেই আছড়ে পড়ে গেছিল। একইভাবে আর জে ম্যাডামও পিছলে ধপাস করে বসে পড়েছিল বরফের ওপর।  আমি হাত ধরে র‍্যাম্বোকে, র‍্যাম্বো তাকে পার করে দিল। মনোজদা অনেক আগেই এসে পড়েছিল। বুদ্ধিজি রাস্তা দেখিয়ে দিলে আমাদের পিছু পিছু সেও এল। বরফের ওপর যেই পা টা রেখেছে মনোজদা, সড়্‌সড়্‌ সড়্‌সড়্‌ করে পিছলে আট থেকে দশ ফুট নীচে গড়িয়ে গেল। ভাগ্যিস হাতে আইস অ্যাক্স ছিল, সেটা দিয়ে কোনোমতে রেহাই পেয়ে গেল। তা নাহলে একেবারে খাতে গড়িয়ে পড়ত। একে একে বাকিরা এসে পৌঁছালে তাওজি এবং মনোজদা এসকট হিসাবে বাকিদের বরফের পথ অতিক্রম করাল।

ঢালু বরফের পথ অতিক্রম করে এক পাহাড় টপকে আরেক পাহাড়ে পৌঁছানো হল। সেখানে হরেকরকমের সবুঝ হলুদ গোলাপী লাল ঘাসজাতীয় ফুলে ভরে আছে। কি অপূর্ব সুন্দর দৃশ্য। মুহূর্তেই ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্সের ছবি ভেসে আসল। মন চাইছে ছুট্টে গিয়ে তাদেরকে জড়িয়ে নিই। বুদ্ধিজির থেকে জানতে পারলাম এই ঘাসজাতীয় উদ্ভিদগুলি হিমালয়ের অহংকার, হিমালয়ের গৌরব। সারা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ আসে এই সব উদ্ভিদ, ফুল, শেকড় ইত্যাদি সংগ্রহ করতে। বিজ্ঞানী থেকে গবেষক প্রায়ই সকলেই এইসব সংগ্রহ করে থাকেন। পাহাড়ে বসবাসকারী মানুষদের জীবন দাঁড়িয়ে আছে এই গাছগাছড়ার ওপর। কবিরাজী চিকিৎসার প্রায় সম্পূর্ণ তারা এই পাহাড় থেকেই সংগ্রহ করে থাকেন। পথ চলা শুরু পুনরায়। অভিমুখ উপরের দিকে। আমি মনের হরষে হেলতে দুলতে উপরের দিকে উঠছি, হঠাৎ পাহাড়ের গায়ে শুকনো মরা ঘাস দেখে থ হয়ে গেলাম। সবুজ পাহাড়ে মরা ঘাস এল কিভাবে ! বুঝলাম বছরের বেশিরভাগসময়ই বরফ ঢেকে থাকে সেই কারণে বরফের নীচে ঘাসগুলি মরা মরা। খুব সম্ভবত সপ্তাখানেক হয়েছে হয়তো বরফ গলে আলগা হয়েছে ঘাসের স্তর।

মুহূর্তেই কে যেন সারা পাহাড় জুড়ে কুয়াশা ছড়িয়ে গেল। ঘন ভারী শীতল মেঘে ছেয়ে গেল। কিছুই দেখা যাচ্ছে না; না নীচে না ওপরে, না সামনে না পিছনে। বৃষ্টি এল বলে। মুখের কথা মুখেই রয়ে গেল, ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল। পুনরায় জ্যাকেট টা পরে নিলাম। পঞ্চুটা ব্যাগের সাইড পকেটেই ছিল, সেটাও গায়ে জড়িয়ে নিলাম। আর যাই হোক বৃষ্টি থেকে রক্ষে পেতে হবে, তা না হলে ট্রেকিং এর সমস্ত অ্যাডভেঞ্চার মাটি হয়ে যাবে। বৃষ্টির জল হাতে, চোখে-মুখে বরফের টুকরোর মতো ঠোকর মারছে। কয়েক মিনিট আগেই চারপাশের পাহাড়, গাছপালা কত হাস্যোজ্জ্বল লাগছিল, মেঘেদের অত্যাচারের কাছে তারা আর পেরে উঠল না। বৃষ্টিভেজা মাটির সোঁদা সোঁদা গন্ধের সাথে মেঘেদের বিবর্ণ গন্ধ মেখে এক অদ্ভুত সুন্দর অতিপ্রাকৃত গন্ধে পাহাড়ের সর্বত্র ম-ম করছিল। মাঝে মাঝে কচি আখরোটের গন্ধের সঙ্গে ফার গাছের সবুজ ঝাঁঝালো গন্ধ ভেসে আসছে। এই হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি তো এই ঝিরিঝিরি। ঘণ্টাখানেক এভাবেই চলছে বৃষ্টি। বৃষ্টিতেই চওড়া-দীর্ঘ বরফের পথ অতিক্রম করা চলছে। তাওজি এবং বুদ্ধজি এসকটের কাজ করছেন। মনোজ দা আইস কুঠার দিয়ে পথ বানিয়ে দিচ্ছে, বাকিরা সেই পথ অনুসরণ করছে। তবে, সকলেই একেবারে তেঁতে উঠেছে, মনে মনে বোধহয় বৃষ্টিকে চাইছেনা কেউই। অগত্যা পবনদেব ভক্তের কথা না শুনে আর থাকেন কি করে ! তিনি ঝোড়ো হাওয়া দিয়ে প্রথমে মেঘেদেরকে স্নানান্তরিত করলেন, বৃষ্টি থেমে গেল নিমেষেই। ঝলমলিয়ে রোদ উঠল। আগের থেকে তার তেজ দ্বিগুণ, শোভা মনোমুগ্ধকর, লাবণ্য অতুলনীয়, যেন সদ্য অন্ধকারের মধ্য থেকেই জন্ম নিয়েছে সমস্ত বিশ্বব্রক্ষ্মাণ্ডকে তার রূপে দৃশ্যমান করতে। কতশত বছর ধরে এভাবেই হাজার হাজার পাহাড়ের সৌন্দার্য পরিপূর্ণ হচ্ছে সূর্যের লাবণ্য মেখে; সূর্যের কণা থেকে বিন্দু বিন্দু সোনা নিয়ে সোনালী হয়েছে রোদ, সোনালী হয়েছে পাহাড়; সূর্যের তেজ মেখে তেজস্বী হয়েছে বাতাস; —কেউ কি তার হিসেব রেখেছে কখনো।

শীতল ঠাণ্ডা হাওয়া বয়ে চলেছে অনবরত। কিছু পথ চলার পর গরমের পোষাক পরে পথ চলতে পারছি না। এক এক করে শীতের পোষাক খুলে ফেলতে হল। ঘামে ভিজে গিয়েছে ভেতরের পোষাকগুলো। তবে, তাপমাত্রা আন্দাজ মতো নয়-দশ ডিগ্রী হবে হয়তো, তথাপি একটি মাত্র টি-শার্ট গায়ে গলিয়ে দিব্যি পথ অতিক্রম করা যাচ্ছে। মনে মনে ভাবলাম আর বৃষ্টি আসবে না। বাকি পথ রোদের সাথে হেঁটে পৌঁছে যাব। চলতে চলতে পৌছালাম এক সাদা চাদরের মতো বিস্তির্ণ জায়গায়। রোদে আলোতে তাকে তুলোর বিছানা বললে নেহাত ভুল হবে না। কাছে পৌঁছতেই বুঝতে পারলাম বরফের পথ। পাহাড়ের ঢালে প্রায় নব্বই একশো মিটার লম্বা হয়ে পড়ে আছে বরফ, সেই দিকেই আমাদের গন্তব্য। তবে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেল বরফের গভীরতা কম করে তিন চার ফিটের মতো হবে, কোথাও কোথাও তার থেকে বেশিও হতে পারে। এরূপ পথ খুবই বিপজ্জনক। বুদ্ধিজি এক এক করে ঘোড়া ও খচ্চর কে পাঠিয়ে দিলেন সেই পথে। তাদের পথের চিহ্ন দেখে উপলব্ধি করা গেল যে কোনদিকে বরফ বেশি শক্ত হয়ে জমাট বেঁধে আছে আর কোনদিকে আলগা হয়ে আছে। বুদ্ধিজির দেওয়া কৌশল অবলম্বন করে সেই দিকেই এগোলাম। দিব্যই এগিয়ে যাচ্ছি, কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। হঠাৎ কিংশুক দা, বাবাই দা আমাকে ঝেড়ে দিল, “তোমাকে বারণ করেছি নিজের ইচ্ছেমত বরফের ওপর দিয়ে যেতে। বেশি বাড়াবাড়ি কোরো না, হিরোগিরি বেরিয়ে যাবে।” অথচ ততক্ষণে আমি ধাতস্থ হয়ে গেছি বরফের ওপর দিয়ে পথ চলতে। আনন্দ করতে এসে এভাবে যে হিউমিলিয়েট হতে হবে ভাবিনি কখনো। সত্যি বলতে এমন হয়েছে যে প্রায় সকলেই বরফের পথ অতিক্রম করতে গিয়ে টলে পড়ে গিয়েছে বা পিছলে পড়েছে, কিন্তু আমার ক্ষেত্রে একবারও এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি বলেই, আত্মবিশ্বাস প্রবল বেড়ে গিয়েছিল। এমনকি আমাদের সঙ্গে যে ডাক্তার ম্যাডাম ছিলেন তিনি তো সাংঘাতিক ভাবে পিছলে পড়ে যাচ্ছিলেন, বুদ্ধিজি এবং আমি দ্রুত সেই দিকেই ছুটে গেছিলাম, তাওজি অনতিদূরেই ছিল, সে যাত্রাই ম্যাডামকে পাকড়াও করতে পেরেছিলেন। ভয়ে সকলের গলা শুকিয়ে গিয়েছিল, হৃদস্পন্দন বেড়ে গিয়েছিল। যে মুহূর্তে তাওজি তাকে আটকাতে পেরেছিল তখন যেন ধড়ে প্রাণ পাই। যাইহোক বড়ো দাদা, তাছাড়া প্রো ট্রেকার বলে কথা, তাদের কথা না শুনলে হয়। কাজেই কারো মুখের ওপর তর্ক না করে বুদ্ধিজির সাথে পা মিলিয়ে এগিয়ে গেলাম।

রানিসুই হ্রদকে পিছনে ফেলে সামনের দিকে হেঁটে চলেছি। সঙ্গে রাখা জল শেষ হয়েছে অনেক আগেই। বুদ্ধিজিকে জিজ্ঞেস করলাম, “বুদ্ধিজি লেক কে পানি পিনে কা লায়েক হ্যায়?” বুদ্ধিজি বললেন, “ইধর যাহা যাহা পানি মিলে সব শুদ্ধ পানি হি হ্যায়। বরফ্‌ পিঘলকে জমীনকে তরফ বহে গয়ে। নীচে গাঁওকি লোক এই পানি পিতে হ্যায়। আপ আঁখ বন্ধ করকে পি লো, জিতনা চায়ে পি লো। ইস তরফ শুদ্ধ পানি অউর কহি নহি মিলেগি।” মনের আনন্দে হাতের কোশে করে রানিসুই হ্রদের জল পান করে পিপাসা মিটিয়ে আবার পথ চলতে শুরু করলাম। সামনেই একটা ছোট্ট ঢিবির মতো জায়গা দেখা যাচ্ছে, সেখানেই তাঁবু ফেলতে হবে। বুদ্ধিজি ঝড়ের গতিতে হেঁটে চলেছেন তার পিছনে আমি, আমার পিছনে মনোজ দা, দেবব্রত দা, অনিরুদ্ধ দা এবং বাকিরা। ঢিবিটা দেখে মনে হচ্ছে এই তো একটুখানি রাস্তা বাকি একছুটে পৌঁছে যাব। কিন্তু মিনিট দুয়েক ছোটার পর গলা শুকিয়ে এল। মনে পড়ে গেল ভ্যালি অব ফ্লাওয়ার্সে ঘটে যাওয়া কাণ্ডের কথা। কাজেই সে ভুল দ্বিতীয়বার করলে চলবে না। পায়ের গতি কমিয়ে কোনোক্রমে ঢিবিটার কাছে পৌঁছতেই দেখতে পেলাম বরফের বিছানার তলা দিয়ে স্বচ্ছ কা৬চের মতো জল সশব্দে নীচের দিকে বয়ে গেছে ঝরনার হয়ে। লোভ সামলাতে পারলাম না, সেই ঝরনার জলে চুমুক লাগিয়ে আবার জল খেলাম কিছু মুহূর্তকে মুঠোফোনে বন্দি করে নিলাম। চোখে পড়ল সামনেই এক তাঁবু, ঐদিকে এগোতে যাব দেখি এক সাধুবাবা সেই তাঁবু থেকে বাইরে বের হলেন। বুদ্ধিজি তাঁর সাথে হিমাচলি ভাষায় কিছু আলাপ সেরে নিলেন। অঙ্গভঙ্গিতে বুঝলাম ভালোমন্দের শুভেচ্ছা বার্তা জ্ঞাপন করে তাঁর এখানে থাকার কারণ জানতে চাইলেন বুদ্ধিজি। তিনি উত্তর দিলেন জড়িবুটি, গাছগাছড়া ওষুধ সংগ্রহ করতে এসেছেন। আমার মতো বুদ্ধিজিরো প্রথমে ভ্রম হয়েছিল যে সেটাই আমাদের আশ্রয়স্থল। ঐ ঢিবির পাশেই আর একটি ঢিবি ছিল। দুইয়ের মিলনস্থলে এক বরফের বিছানা যার নীচে বরফ গলে গিয়ে সশব্দে ঝরনা ধারণ করে নিম্নে প্রবাহিত হয়ে গিয়েছে। চট্টান পার হয়ে ঢিবির কাছে যেতেই দেখি সুরেশ জি ঘোড়া খচ্চর নিয়ে আমাদের আগেই পৌঁছে গিয়েছে। মালপত্র আলগা করার কাজ চলছে। মনোজ দা পৌঁছানোর সাথে সাথে দুজনে তাঁবু খাটাতে লাগলাম। সন্দীপনও হাতাহাতি করে এগিয়ে আসল। একে একে বাকিরাও আসল। তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রী থেকে ৫/৬ ডিগ্রী হবে। বাইরে বেশিক্ষণ থাকলে ঠাণ্ডাতে সমস্যা হয়ে যেতে পারে। সেজন্য সকলকে অনুরোধ করা হল তারা যেন তাঁবুর ভেতর থেকে বাইরে না বেরোয়। ফোন অনেক আগেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছে। এদিকে ঘড়িতে চার্জ দিতে ভুলে গেছিলাম কাজেই সময় তখন দুপুর আন্দাজ মতো দুটো-আড়াইটে বা তিনিটা হবে। কিন্তু চারিদিকে গাড় মেঘ এমন ভাবে ঢেকে রেখেছে যেন ভোর ভোর অনুভূত হচ্ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় সাড়ে তেরহাজার ফুটেরও বেশি ওপরে। সামিট থেকে মাত্র আধা ঘণ্টার পথ। কিন্তু সেখানে জল পাওয়া যাবে না বলে এখানেই এই ঢিবির ওপর আশ্রয়স্থল।

একদিকে রান্নার আয়জন চলছে অন্যদিকে কিংশুক দা, বাবাই দা ও মনোজ দা- মিলে মানালি পাস পাসের কাছে অন্তিম গন্তব্যস্থল খানপাড়ি ডিব্বা ভ্রমণ করে দেখতে গেল সেখানকার অবস্থা কেমন, কতটা বরফ জমে আছে ইত্যাদি। এদিকে প্রবল বেঘে শীতল বাতাস বইছে। সকলে দুটো তিনটে যে যেকটা পারছে গরমের পোষাক চাপিয়ে ঠাণ্ডাতে কাঁপছে। যেখানে তাঁবু ফেলা হয়েছে তার দুদিকেই দুট বরফের বিছানা পাতা আছে। তা থেকে ধোঁয়ার মত জলীয়বাষ্প ওপরের দিকে নির্গত হচ্ছে। দেখতে দেখতে চা পকোড়া চলে এল। খানিক পর সূয্যিমামা টুঁকি দিয়ে ঝলমলিয়ে তাকাল। বাইরে খোলা আকাশের নীচে বসে খাওয়া চলছে, গল্পগাছা চলছে। এভাবে প্রায় আধাঘণ্টা কেটে গেল, কিন্তু না কিংশুক দা, না মনোজ দা-য়েরা এসে পৌঁছাল। চারিদিকে খোঁজাখুঁজি শুরু হয়ে গেল।

(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *