শান্তনু ভট্টাচার্য

সত্যি কথা বলতে কী, কথাগুলো বলার প্রয়োজনই পড়ত না, যদি না আজ ভোররাতে ঘটনাটা ঘটত! তৎক্ষণাৎ বুঝতে না পারলেও পরে বুঝেছি, ভোররাতে ঘটা ঘটনার পূর্বাভাস আগেই আমার কাছে এসে পৌঁছেছিল; কিন্তু আমি উপলব্ধি করতে পারিনি তা। উপলব্ধি করার জন্য তৈরি ছিল না আমার মন, অন্য কাজে ব্যস্ত ছিল সেই দেহাংশটি।

          গত মধ্যরাত অবধি আমার ধারণা ছিল, মানুষ প্রাকৃতিকভাবে তার মনটাকে পেয়েছে স্মৃতি সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে। একটি মানুষের আজন্মের স্মৃতি সংগ্রহ ও সংরক্ষণই মনের প্রধান কাজ।

          গত কয়েকদিন, গত কয়েক সপ্তাহ, গত কয়েক মাস বা গত কয়েক বছর আমার মন নিজেকে ভীষণ সচল রেখেছে আমার নিজের হাতে তৈরি স্মৃতিগুলিকে পাটে-পাটে গুছিয়ে রাখতে। ক্রমিক সংখ্যা বসিয়ে সে সংরক্ষণ করে ফেলেছে আমার অজস্র স্মৃতি, সেগুলো আমার পছন্দের হোক আর না-হোক!

          আমি জানি, আমার জমিয়ে রাখা স্মৃতির ব্যাপারে কারও কোনো আগ্রহ নেই। কিন্তু আমার ভীষণ আগ্রহ সেগুলো সবার সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার। সকলের স্বাভাবিক অনাগ্রহই আমাকে নির্মমভাবে আগ্রহী করে তুলেছে বলে আমার ধারণা। কিছু স্মৃতি উচ্চারণ না করে আজ আমি পারছি না—

          স্মৃতি ১ : ঠিক ২৪ বছর আগে, মানে দুই যুগ! শীত পড়েছে খুব। রাতের আকাশ থেকে নেমে আসা কুয়াশায় ঝাপসা হয়ে আসছে পৃথিবীটা। আমি ধীর পায়ে নেমে গিয়েছিলাম নির্জন নদীতে। গা থেকে খুলে, ঘন অন্ধকার মিশে থাকা জলে ছুড়ে দিয়েছিলাম রক্তের ছিটে লেগে থাকা সাদা জামাটা। দু-হাতে ঘষে তুলে নিতে চেয়েছিলাম শরীরের সব ময়লা। মুছে দিতে চেয়েছিলাম শরীরের প্রত্যন্ত প্রান্তে রক্তের ছিটে লেগে থাকার সামান্য সম্ভাবনা। জল থেকে উঠে মেঠোপথ ধরে আমি দ্রুত হেঁটে গিয়েছিলাম। হাঁটতে-হাঁটতে মনে পড়েছিল, একটু আগে আমার হাতে চূড়ান্তভাবে ক্ষিপ্ত লোহার তীক্ষ্ণ অস্ত্রটার কথা। এতক্ষণে অস্ত্রটা নিশ্চয়ই তলিয়ে গেছে নদীর কালো জলের অতলে। ধুয়ে গেছে তার শরীরে লেগে থাকা কাঁচা রক্তের বর্ণ-গন্ধ। যার রক্ত গায়ে মেখেছে সে, সে তার ক্ষতবিক্ষত শরীরটা নিয়ে ভেসে যাচ্ছে নদী-জলে। যেমন শরীরজোড়া শীত নিয়ে আমি হেঁটে যাচ্ছি এক উষ্ণ আশ্রয়ের খোঁজে।

          স্মৃতি ২ : বারো বছর আগে! বোধহয় দোকানে মাংস কিনতে গিয়ে, ঝুলিয়ে রাখা মাংসে আঙুল চেপে পরখ করে আমার মনে হচ্ছিল, এ-মাংস নরম হবে না। সেকথা চপার হাতে আমার দিকে চেয়ে থাকা মাংসওলাকে বলতে সে বলেছিল, দারুণ নরম মাংস, আপনি বুঝতে পারছেন না—কথাটা আমার আত্মসম্মানে লেগেছিল। যে আমি সারা জীবন শুধু রক্ত-মাংস নিয়েই ভেবে গেলাম সেই আমি মাংস চিনতে পারছি না! আমি তাকে পাল্টা প্রশ্ন করলাম, এই পশুটা কাটার সময় কতটা রক্ত বেরিয়েছিল? সে বলেছিল, যতটা বেরোনোর কথা ততটাই বেরিয়েছিল। বেশিও না, কমও না। বুঝলাম, লোকটা আমাকে ঠুকছে। আমি কিছুটা মাংস কিনে বাড়ি ফিরে রান্না করে খেয়ে বুঝেছিলাম মাংস বিষয়ে আমি কোনো অভিজ্ঞতাই সংগ্রহ করতে পারিনি। মাংস-বেচা কসাই লোকটাই ঠিক; এ-মাংস দারুণ নরম, দারুণ এর স্বাদ।

          স্মৃতি ৩ : প্রায় বছর পাঁচেক আগে। স্টেশনের পাশে সরু, নির্জন রাস্তাটা ধরবো বলে রেললাইন পেরোলাম। দুপাশে সবুজ ঝোপের মাঝখান দিয়ে এগিয়ে যাওয়া রাস্তাটা আমাকে ভীষণ টানতো। অনেক মধ্য ও শেষ রাত আমি পায়ে পায়ে পেরিয়ে গিয়েছি এ-রাস্তা। তপ্ত দুপুরে শব্দহীন মেঠোপথে নিজের সঙ্গে বলতে থাকা কথার মাঝে ভীষণ ঝাঁকুনি লাগলো শরীরে। মাটিতে পড়ে থাকা পাথরে মর্মান্তিক এক হোঁচটের পরেও আমি সামলে নিলাম নিজেকে, যেমন যেকোনো আঘাতেই সামলে নিই। পায়ের যে-জায়গায় তীব্র যন্ত্রণা, সেখানে তাকিয়ে দেখলাম ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসছে। থেঁতলে গেছে ডান পায়ের তিনটি আঙুল। আমি আঙুল থেকে দৃষ্টি তুলে হেঁটে চললাম। ক-পা এগিয়ে গিয়ে চোখে পড়ল রাস্তার ডান পাশে পড়ে থাকা এক মৃত কুকুরের দেহ। থেঁতলে গেছে তার মুখের একটা পাস, বেরিয়ে এসেছে দাঁতগুলো, হিংস্রভাবে। থেঁতলে যাওয়া মাংস চামড়ায় লেগে আছে শুকিয়ে যাওয়া রক্ত। মৃত পশুটার আরো কাছে এগিয়ে গেলাম আমি। ভালো করে দেখলাম তাকে, কিন্তু বুঝতে পারলাম না কুকুরটার এই অবস্থার কারণ। কেউ কি খুন করেছে কুকুরটাকে? না-কি কোনো প্রবল প্রতিপক্ষের সঙ্গে লড়াইয়ে মেতে এই অবস্থা হয়েছে ওর? আমি ধীর পায়ে এগিয়ে চললাম। আমার সদ্য ক্ষত আঙুলে তীব্র যন্ত্রণা, গড়িয়ে আসছে রক্তধারা—আমি আমাকে নিয়ে ভাবলাম না। আমার মনে হচ্ছিল এই পথে আমি আরো অন্তত একটা মৃত পশুর শরীর দেখতে পাবো। কিন্তু তা হয়নি, কিছুটা হাঁটার পর দেখলাম রাস্তার ঠিক মাঝখানে পড়ে আছে একটা সাদা পালক। হাতে তুলে দেখলাম তাতে টাটকা কাঁচা রক্ত লেগে আছে। আমার মনে হল কাছাকাছি কোথাও বক হাঁস বা মুরগির একটা রক্ত মাখা নিথর শরীর পড়ে থাকতে দেখব। কিন্তু কিছুই দেখিনি। আমার শরীর থেকে সেদিন অনেকটা রক্ত বেরিয়ে গিয়েছিল।

          এভাবেই ক্রমিক সংখ্যা ধরে স্মৃতিগুলো সংরক্ষিত আছে আমার ভেতরে। কিন্তু আমার কাছে যেটা আশ্চর্যের, তা হল—ক্রমিক সংখ্যার ওপর দিকে রয়ে যাচ্ছে সেই স্মৃতিগুলো, যেগুলোর গায়ে রক্ত লেগে আছে!

          সেদিন আমার এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলো গোরস্থানের রাস্তায়। গোরস্থানটির মতোই পুরোনো আমাদের বন্ধুত্ব। বেঁচে থাকার অভিজ্ঞতায় বুঝেছি, যেকোনো ‘পুরোনো’-ই খুব দামী ও ভারী, এবং খুব যত্নে বহন করতে হয় তাকে। তাতে মূল্যের সঙ্গে মসৃণতাও বাড়ে তার। ফুরিয়ে আসা বিকেলে ধুলোর ওপর দাঁড়িয়ে দুই বন্ধুর মধ্যে কিছু কথা হলো—

          বন্ধু : অনেক দিন পর তোমার সঙ্গে দেখা হল, তাইনা?

          : দেখা না হলেও কি খুব ক্ষতি কিছু হয়!

          বন্ধু : একটা ক্ষতি তো হয়ই, নতুন করে আমরা পরস্পরকে চিনতে পারতাম না।

          : আমরা কি আদৌ কোনোদিন একে অপরকে চিনেছিলাম!

          বন্ধু : চিনেছিলাম। কিন্তু সেই চেনাটুকু ধরে রাখতে পারেনি আমাদের মন। আমরা একে অন্যের কাছে ক্ষয়ে এসেছি। সেজন্যই আজকে আমাদের দেখা হওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল। এইসব কথার মধ্যে দিয়ে আজ থেকে আবার আমরা পরস্পরকে চিনব।

          : যদি আমাদের আর কখনও দেখা না হয়!

          বন্ধু : তাহলে আজ থেকে শুরু হওয়া এই চেনাটাই রয়ে যাবে। যদিও ক্ষয় হতে হতে সেটাও একদিন মিলিয়ে যাবে আমাদের ভিতর থেকে। যেকোনো সম্পর্কের প্রধান শর্তই এটা— কথাগুলো এবং ব্যথাগুলো মিলিয়ে যায়। পড়ে থাকে শুধু মানুষটা। কারণ খোলটা তৈরি হয় রক্তজালিকা দিয়ে।

          আবার সেই রক্ত—আমার সেই অনেক পুরোনো বন্ধু চলে গিয়েছিল। সে চলে যাওয়ার পরেও আমি ওই জনবহুল রাজপথে তারা ভরা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ তার কথাগুলো ভেবেছিলাম। ভাবতে-ভাবতে মনে হয়েছিল, সে-ই ঠিক—আমাদের চিনতে পারাটা আমরা ধরে রাখতে পারিনি নিজেদের ভেতর। কিন্তু প্রশ্ন হল, আমি নিজেকে যেটুকু চিনেছি, তা কি ধরে রাখতে পেরেছি আমার ভেতরে? আমি কি আদৌ চিনেছি নিজেকে?—পরে এ-প্রশ্ন নিয়ে বারবার আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছি। নিজেকে দেখেছি, প্রশ্ন করেছি কত কী? কিছু প্রশ্নের উত্তর পেয়েছি, কিছু প্রশ্নের সামনে আঁতকে উঠেছি। হিমরক্ত বয়ে গেছে শরীরজুড়ে।

          নির্মম প্রশ্নগুলো নিয়ে আমি জলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছি। মনে হয়েছে, আয়নার সামনে যে-প্রশ্নের উত্তর পাইনি, তা জলের সামনে দাঁড়িয়ে পাব। নদীর অস্থির তরঙ্গের সামনে এগিয়ে দিয়েছি মুখ। কিন্তু জলের বুকে কাঁপতে থাকা আমার মুখ আমার একটাও প্রশ্নের উত্তর জানাতে পারেনি। বুক ভরা বিপন্নতা নিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছি। যদিও সে-বিপন্নতা কেটে গিয়েছিল একটা সময়। আমার চারপাশে উড়তে থাকা একটা-দুটো-তিনটে স্মৃতিই পুড়িয়ে দিয়েছিল সমস্ত বিপন্নতাকে। কিন্তু কী আশ্চর্য, সে-স্মৃতিগুলোই আমার বিপন্নতা মুছে দিল, যেগুলোতে লেগে আছে রক্তের ছিটে!…

          আজ অতি ভোরে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল এক নোনা গন্ধে। বিছানা থেকে নেমে বড়ো আলো জ্বেলে নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে চমকে গিয়েছিলাম, আমার দু-তালুতে কাঁচা রক্ত! নিজেকে খুঁটিয়ে দেখতে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম আমি। চমকে উঠেছিলাম—আমার সামনে, আয়নার ভেতর বুকময় রক্ত নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা মানুষ। শুধু বুকে নয়, তার কপালে, চিবুকে, গালে, হাতের তালুতে টাটকা রক্তের অসংখ্য ফোঁটা। আমার দিকে তাকিয়ে সে হো হো করে হেসে উঠল।‌ হাসি থামিয়ে তারপর প্রশ্ন করল, চিনতে পারছ?…এ-প্রশ্নের উত্তরে ‘হ্যাঁ’ ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। আমি চুপ করে থাকলাম, শ্বাস পতনের শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ বের করতে পারলাম না নিজের ভেতর থেকে। আয়নার বুকে দাঁড়িয়ে রক্তমাখা মানুষটা আবার আগের মতোই হাসতে শুরু করল। আমি দৌড়ে বাথরুমে চলে গেলাম। চান করলাম নগ্ন হয়ে। বাড়তি শক্তিতে দুটো হাত ঘষতে লাগলাম শরীরের প্রান্তে প্রান্তে। সতর্ক দৃষ্টিতে দেখলাম বাথরুমে নালা দিয়ে তুমুল গতিতে বেরিয়ে যাচ্ছে সাবানের ফেনা জড়ানো সাদা জল, কোথাও এতটুকু লালের ছোঁয়া নেই সেখানে। তবু আমার মনের এখানে-ওখানে সন্দেহ লেগে থাকল। ঘরে গিয়ে পুনরায় আয়নার সামনে দাঁড়ালাম। আয়নার বুকজুড়ে দাঁড়িয়ে আছে এক পুরুষ। যার ত্বক গমবর্ণ, মাথা ভরা কোঁকড়ানো চুল, চোখের তারা পিঙ্গল। যার শরীরে কোথাও লেগে নেই এতটুকু রক্তচিহ্ন। শরীরের প্রান্ত-প্রান্তরে ছড়িয়ে আছে সদ্য চানের জলবিন্দু।

          আয়না থেকে ফিরে আমি বিছানায় তদন্ত করলাম—কোথাও রক্তের চিহ্ন নেই।…তার মানে সবটাই আমার মনের ভুল, আজ কোনো রক্তপাত হয়নি। আলো-অন্ধকার মেশানো বাকি সময়টাতে আর ঘুম এলো না আমার। স্মৃতিতে একজনকে দেখতে পাচ্ছিলাম আমি। যে তুমুল আক্রোশে ফালাফালা করে দিয়েছিল তার ভাইয়ের শরীরটা। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে জন্মানো সেই ভাইয়ের শরীরটা তারপর সে ঠেলে দিয়েছিল উজানে—একটা গমবর্ণের পুরুষ্ট শরীর, মাথা ভরা কোঁকড়ানো চুল, পিঙ্গল চোখের তারা। কুয়াশা আর রক্ত মেখে ভেসে যাচ্ছিল গাঙে।

          কিন্তু কেন আমি খুন করেছিলাম আমার ভাইকে? ধনদৌলতের লোভে? রাজনৈতিক টানাপোড়েনে? ত্রিকোণ প্রেমে জিতে যাবার চেষ্টায়?—এইসব প্রশ্নের উত্তর একটাই—না।… কোনো প্রশ্নেরই উত্তর আমার কাছে নেই। আছে একজনের কাছে। যে তার রক্তে-ঔরসে আমাদের দুজনকে পৃথিবীতে এনে ফেলেছে।

          বহু বছর আগে আর একজন দূর থেকে আমায় চিনিয়ে দিয়েছিল তাকে। ওই একবারই, তার মুখ আমি দেখেছিলাম। আর কখনো তার সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। তবে একদিন নিশ্চয়ই দেখা হবে আমাদের। সযত্নে সাজিয়ে রাখা স্মৃতির মধ্যে নিশ্চয়ই আমি তাকে আর একবার খুঁজে পাব। তখনই তাকে প্রশ্নটা করব—কেন তিনি তার ভ্রাতৃহত্যার বীজটি আমার শরীরে দিয়ে গেছেন?

        —এই একটাই প্রশ্ন, যারজন্য আজও আমি বারবার পাঁজর ভাঙছি। সব কথাই যে জড়িয়ে আছে আমার সোনার পাঁজরে! সেখান থেকে কিছু কথা ছিঁড়ে এনেই তো আজ শোনালাম  আপনাদের! 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *