মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস
ষষ্ঠ পর্ব
পুরোনো ছবি ব্যস্ততার সময়েও কখনও চোখের ওপর ভেসে আসে বানের মত৷ কত দরকারি কথা ভুলে গেছি, অথচ কত তুচ্ছ স্মৃতি মনে জেগে আছে, ভাবলে অবাক হতে হয়৷ আর শীত আসি আসি করতেই কালনার আর এক অনুষঙ্গ বার বার মনের থেকে জিভ অব্দি উঠে এসে সাড়া দিয়ে যাচ্ছে। সেই অপূর্ব মাখা সন্দেশের স্বাদ গন্ধ অন্তরে চাখতে চাখতে এই পর্বটা লিখে ফেলি।
আমাদের সেই বাড়ির বাঁ দিক ঘেঁসে আজও যেমন আছে সেদিনও তেমন ছিল তিনতলা বাড়িটা৷ তার একতলাতে আজও তেমনি আছে মিষ্টির দোকান৷ সত্যি কথা বলতে কি, হাঁদা ভোঁদার কথা গল্পেই শুধু পড়েছি তা নয়, ভোঁদা নামক কাউকে ছোট থেকেই জলজ্যান্ত দেখেছি৷ তবে সে ভোঁদা মোটেই হাফপ্যান্ট পরা ছোট্ট ছেলে নয়৷ তিনি কালনার নামকরা মোদক৷ ভোঁদা ময়রার দোকানের খ্যাতি কালনার বাইরেও তখন প্রসারিত ছিল৷
একতলার বড় অংশ জুড়ে দোকান ঘর৷ বারান্দায় বড় বড় মাটির উনুন৷ উহু বাবা! এখনকার মত ভসভস করে গ্যাসে চলত না মোটেও৷ কাঠখেকো ছিল সেগুলো৷ ভেতরে কারিগররা সর্বদা ব্যস্ত৷ সকাল সকাল কাঠের রেকাবি ভরে ভরে গরমাগরম সিঙারা, নিমকি তৈরি হয়ে যেত৷ গরম জিলিপি, আর গজা হত আর একটু বেলায়৷ ঘরের সামনে কেউ তখন সাইকেল চেপে কচুরি ডালপুরি বলে হেঁকে যেত না, ম্যাগি তখন জাতীয় খাবারে পরিণত হয় নি, পাড়ায় পাড়ায় তেলেভাজা বা জলদিখাবারের দোকানও চোখে পড়ত না৷ তাই যে সব কালনাবাসীর সকালের বাসি কাজ আর পুজোর পর পান্তা কি গরম সেদ্ধভাতে রুচি ছিল না, তারা অবশ্যই হাতেগোণা কয়েকটি ময়রা দোকানে এক চক্কর লাগিয়ে নিমকি সিঙারার জোগাড় করতেন দুটি মুড়ি খাবার আশায়৷
তাই সকাল থেকে দোকানে লাইন পড়ত৷ এক ক্ষেপ ভাজা শেষের মুখে কেউ চারটে সিঙারা চেয়ে দুটো আছে দেখে মন খারাপ করে আর এক ক্ষেপ ভাজার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতেন রাস্তার রোদ উপেক্ষা করে। যেন ব্যাচে ব্যাচে অষ্টমীর অঞ্জলির প্রতীক্ষা৷
যাইহোক, এই দোকানের আসল খেল শুরু হত গয়লারা সন্ধ্যে সন্ধ্যে ছানার বালতি নিয়ে হাজির হতে৷ মাখা সন্দেশ, রসগোল্লা, রাজভোগ, পান্তুয়া, ল্যাঙচা…ওফ্ এখনও আমি যেন চোখের সামনে দেখছি বিশাল কড়াইয়ে লম্বা খুন্তির খেলায় ছানা থেকে সন্দেশের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাওয়ার দৃশ্য৷ ছোটবেলায় কত দিন পড়ার পাট শেষ করে দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম, কড়াই থেকে গরম সন্দেশ নামলে কিনে নিয়ে যাব৷
ভাজা ল্যাঙচার গন্ধ কেমন জানো? পেটুক মন পড়া ভুলে কেমন লাফ মেরে হারিয়ে যেত ঐ গন্ধের পিছে পিছে তা সামনে বসা কেউ বুঝতেও পারত না৷ ল্যাংচা বা পান্তুয়া যখন সদ্য সদ্য রসে পড়ে অথচ পুরোপুরি রসাল হয় না, একটা ভাজা ভাজা ভাব থেকে যায়, অথচ রস রসও হয়েছে, সে ল্যাংচার জন্য আমি এখনও একশবার ভোঁদা ময়রার দোকানের পাশের বাড়িতে জন্মাতে পারি৷ সে সময়ে কালনায় মিষ্টি ভ্যারাইটিতে নয়, কোয়ালিটিতে কাটত৷ জোড়া সন্দেশ, জিভেগজা, দানাদার শো কেসে ট্রেতে খদ্দেরের অপেক্ষায় সেজে থাকত৷ এই দোকানের মিষ্টি বড় বড় মাটির ভাঁড়ে শুয়ে শালপাতায় মাথা ঢেকে সুতুলির প্যাঁচে ঝুলে ঝুলে দূরের আত্মীয় বাড়ি পাড়ি জমাত৷ বড় বড় কাগজের বাক্সে মাখা সন্দেশ বিদেশ ভ্রমণে যেত৷ শ্বশুরবাড়ি বা বেয়াইবাড়ি ভোঁদা ময়রার দোকান ফেরতই যেতে হত৷ শীত পড়তে নলেন গুড়ের সন্দেশ বানানো শুরু হলে তো কথাই নেই। গরম সন্দেশের মন মাতানো গন্ধের থেকে ঠাণ্ডা সন্দেশের স্বাদ বেশি ভালো কিনা সে রহস্যর সমাধান করার জন্য আমি দুটোই যথেচ্ছ খেতাম।
দোকানঘরের পাশ দিয়ে মূল বাড়িতে প্রবেশ করা যেত একতলার একটা ঘর দিয়ে৷ পুরো একতলাটা মিষ্টি কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত৷ ছোট বড় কত ধরণের নতুন ভাঁড় ধুয়ে ধুয়ে রাখা থাকত৷ খাবার ঢাকা দেবার জন্য বা খদ্দেরকে খেতে দেবার জন্য শালপাতা জড়ো করা থাকত৷ ভোঁদাদাদুর নাতি নাতনিরা আমার ছিল খেলার সাথি তাই ঐ বাড়িতে অবারিত আনাগোণার দরুণ আমি এসব দেখতে পেতাম৷ দাদুর মেয়ের ঘরের বড় নাতনি টুম্পা মামাবাড়ি এলেই দাদু আমায় ডেকে জানিয়ে দিতেন৷ আমরা সমবয়সী বলে দারুণ জমত৷ একতলার ভেতরের একটা ঘরে বাড়তি মিষ্টি ঢাকা থাকত৷ অনুষ্ঠানের বায়না থাকলে বা নববর্ষের দু এক দিন আগে কারিগরদের ব্যস্ততা চরমে উঠত৷ পুরো একতলাটায় কেমন একটা রসমাখা গন্ধ যেন জড়িয়ে থাকত৷ এই গন্ধ আমার মনে মনে চিটে হয়ে আজও আটকে আছে৷ এই চিটচিটে ভাব আমি হয়ত মৃত্যু পর্যন্ত সঙ্গে রেখে দেব৷ বাড়িতে তৈরি করা টিফিনের বদলে প্রায়শই এক দু’টাকা পেতাম স্কুল যাবার আগে৷ টিফিন কৌটো বাড়িয়ে পছন্দ মত মিষ্টি দিতে বলতাম দাদুকে৷ বেশিরভাগ দিন মিষ্টি টিফিন দেখে বন্ধুরা হাসাহাসি করত৷ কিন্তু আমি নির্বিকার৷ মুড়ি বা ফলের থেকে মিষ্টি আমার কাছে বেশি লোভনীয় ছিল৷ আর মোহনবাগান জিতলেই দাদু হাঁক দিত রেডিও বন্ধ করে। টাকা বাড়িয়ে দিয়ে বলত সন্দেশ কিনে আনতে। আমিও এক লাফে রাস্তায়।
ভোঁদাদাদুর দোকানের সাথে আরও একটা স্মৃতি জড়িয়ে আছে৷ তখন আমি কলেজ৷ আমাদের বাড়িতে বিড়ালের কমতি কোনো কালেই ছিল না। তখন একটা আদুরে বিড়াল ছিল৷ পটকা৷ ও যেমন আমার ন্যাওটা ছিল তেমনি আমার মত মিষ্টিখোর ছিল৷ সন্দেশ বানানোর গন্ধ পেলে ও বাবার ডিসপেনসারির সামনের বারান্দায় এসে বাঁদিকে গলা ঘুরিয়ে দোকানের দিকে চেয়ে থাকত৷ যতক্ষণ না বাবা বা অন্য কেউ গিয়ে দোকান থেকে মিষ্টি আনতাম ও ঘরে আসত না৷
ভোঁদাদাদুর মৃত্যুর পর দাদুর ভাইপোরা এই দোকানের দায়িত্ব নিয়েছেন৷ ততদিনে কালনায় মিষ্টি দোকান হুহু করে বেড়েছে৷ রকমারি নানা মিষ্টিও তৈরি হচ্ছে৷ তবে পুরোনো মানুষদের কাছে আমাদের পাড়ার দোকানের কদর এখনও কমেনি৷
এই বাড়ির লাগোয়া বাড়িগুলো ছিল ভোঁদাদাদুর ভাই ভাইপোদের। মূল রাস্তা থেকে গঙ্গার দিকে যাবার গলিতে ঢুকলেই সেই বাড়িগুলোতে প্রবেশের দরজা পাওয়া যেত। এই সব বাড়িগুলো ভেতর থেকে উঠোনে উঠোনে পরস্পরের সাথে যুক্ত। আর আমাদের ছোটদের কাছে পুরো জায়গাটা ছিল লুকোচুরি খেলার স্বর্গরাজ্য। বাড়ির সকলের কাছে অত্যন্ত স্নেহ পেয়েছি। বিশেষ করে বুলিপিসি, খুকু পিসি, স্বপ্নাপিসি ছাড়াও ঠাকুমাদের কাছে।
মোজাইক করা মেঝে, সিঁড়ি আর ছাতের ওপর সিমেন্টের অনেক টব, মরশুমি ফুলের বাহার, চারতলাতে চিলেকোঠার ঘর…সেই শৈশব কৈশোরটা সত্যিই ছিল মায়াবী একটা স্বপ্ন যেন!
ভোঁদাদাদুদের বাড়িটা একটু এল প্যার্টানের হওয়ায় আমাদের একটা ঘর থেকে ওনাদের রান্নাঘর দেখা যেত। একটা শোয়ার একদম আমাদের শোয়ার ঘরের লাগোয়া ছিল। দুটো বাড়ির মাঝে শুধু জমাদার যাওয়ার রাস্তা। দুই ঘরের জানালা খুলে দিয়ে ওদের ঘরের টিভি দেখা যেত। কত হরেকরেকম্বার মতো অনুষ্ঠান এ ভাবে দেখেছি। আর মিনির বিয়ের দিন কাবুলিওয়ালার ফিরে আসা দেখে চোখের জল ফেলা আজও ভুলিনি।
আবার পেছনে বুলিপিসিদের বাড়িতে ছিল সিমেন্টের লাল মেঝেতে নানা রঙের বিরাট ফুল আঁকা। তাকে বোধ হয় ফুলকারি কাজ বলে।
বুলিপিসিদের এক তলার ঘরে টিভিতে নাম না জানা সিনেমায় ‘আয় খুকু আয়’ শুনছিলাম স্পষ্ট মনে আছে আজও।
আর এক জেঠুর বাড়ির কিছু অংশ ভাড়া দেওয়া ছিল তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরকে। হাতের আঙুলে যখন ইন্টারনেট ছিল না তখন অনেক প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার্থীকে দেখতাম রোজকার খবরের কাগজ আর নানা পত্র পত্রিকার সন্ধানে এখানে আসতে। বিভিন্ন ম্যাগাজিন সরকারি বিজ্ঞাপন পেত এই অফিসের হাত ধরে, তাই পত্রিকা সম্পাদকদের আনাগোনা লেগে থাকতো। খুব বেশি দিনের কথা নয়, লোকশিল্পীদের ভাতা দেবার আয়োজন হলো সরকার থেকে। শিল্পীদের যোগ্যতা বিচারের ভার পড়ল তথ্য দপ্তরের। লাইন পড়ে গেল কদিন অফিসের সামনে, বড় রাস্তায়। আর অফিসে অত জায়গা কোথায়! শিল্পীদের কলা প্রদর্শনের জায়গা হলো বুলিপিসিদের উঠোনে।
সেই উঠোন জুড়ে জামরুল, আমড়া, নারকেল আর ফলসা গাছ। আমাদের রান্নাঘরের ছাতে উঠে সেই জামরুল গাছের নাগাল মিলত বলে দুপুর দুপুর চুপি চুপি কত দুষ্টু ছেলে জুটতো। আমারও কম যেতাম কি!
গাছপালাগুলো আজ বাড়ির বেশিরভাগ মানুষগুলোর মতোই শুধু স্মৃতি। এক অন্যরকম হাওয়া হঠাৎ যেই মনের মাঝে বয়ে যায় সব নেই হয়ে যাওয়া দৃশ্যপট, কথার টুকরো এমনই একান্তে খেলা করতে ভালোবাসে। সত্যিই গাইতে ইচ্ছে করে
“সেই যে হলুদ পাখি
বসে জামরুল গাছের ডালে
করতো ডাকাডাকি
আমার শৈশবের সকালে
একদিন গেল উড়ে
জানি না কোন সুদুরে…
ফিরবে না সেকি ফিরবে না
ফিরবে না আর কোনদিন”
গানের বদলে কান্নার বাষ্প গলাটাকে স্তব্ধ করে দেয়।
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)