শরদিন্দু সাহা
বাংলা কথা সাহিত্যের সুপরিচিত লেখক শরদিন্দু সাহা। লেখক সত্তা ও জীবনকে বিচ্ছিন্ন করে দেখতে তিনি অভ্যস্ত নন। নিছক লেখক হওয়ার জন্য তিনি কলম ধরেননি, সামাজিক দায়বদ্ধতাই তাঁকে সৃষ্টিকর্মে উদ্বুদ্ধ করে। শৈশব থেকে সৃষ্টিশীল মন লালন করে প্রস্তুতি পর্ব সারলেও নয়ের দশকের গোড়া থেকে তাঁর লেখালেখি শুরু। এ-পর্যন্ত শতাধিক গল্প, গোটা কয়েক উপন্যাস এবং অন্যান্য গদ্য মুদ্রিত হয়েছে। দশটি উপন্যাস আর সাতটি গল্পগ্রন্থ সহ মোট গ্রন্থের সংখ্যা ষোলো। ১৯৯৮ সালে ‘কাটোয়া মহকুমা গ্রন্থাগার পুরস্কার’ পান। ২০০৪ সালে ‘পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি প্রদত্ত সোমেন চন্দ পুরস্কার’ পান। ওই বছরেই কাটোয়া লিটল ম্যাগাজিন মেলা কর্তৃক সংবর্ধিত হন। ইন্ডিয়ান অয়েল কর্তৃপক্ষ তাঁকে ‘হল্ অব্ ফেম’-এ সম্মানিত করেন। ২০০৫ সালে ‘ভাষা শহিদ বরকত স্মরণ পুরস্কার’ পান। ২০০৭ সালে সাহিত্য আকাদেমি’র আমন্ত্রণে গৌহাটিতে বাংলা-অসমীয়া গল্পকার সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। ২০১৩ সালে ‘আমি’ পত্রিকা তাঁর সাহিত্যকর্মের জন্য বিশেষ সম্মান দেন। প্রসার ভারতী’র আমন্ত্রণে নানা সময়ে সাহিত্য-সংস্কৃতি অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহণ করেছেন। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, মিলিয়ে অনেক উল্লেখযোগ্য সাহিত্য পত্রে ও ওয়েব ম্যাগাজিনে লিখে চলেছেন। ইতিমধ্যেই নিজস্ব এক ঘরানা সৃষ্টি করে তিনি পাঠকের মন জয় করেছেন।
(নিত্য সমাজ সংসারের যে স্রোত আমরা চাক্ষুষ করছি তার অন্দরমহল জুড়ে ঘুমিয়ে রয়েছে কত তো কথাকাহিনী, যার পরতে পরতে তন্দ্রাচ্ছন্ন থাকে গোপনে কত তো নারীর জীবনযন্ত্রনা, ধারক বাহক হয়ে গোটা সমাজকে যাঁরা ছাতার মতো আগলে রেখেছে, নিজের পরিচয় খুঁজে নিয়েছে, সকল ঝড়ঝঞ্ঝা থেকে দিচ্ছে মুক্তি যুগ যুগ ধরে। কয়জনের কথাই বা আমরা মনে রাখি। তাঁদের গোপন ব্যথা, অনুচ্চারিত কথা গুমড়ে মরে যায়, চোখের জল কেউ মুছিয়ে দেয় না, গণ্ডীবদ্ধ শৃঙ্খলিত জীবনই তাঁদের বেঁচে থাকার একমাত্র ভরসা। এমনই এক সাধারণ গ্রাম্য নারীর কথকতা ও চেতনায় চেনা জীবন ও সমাজপিষ্ট অব্যক্ত যন্ত্রনার পাঁচালি ‘পঞ্চমীর বারমাস্যা’ উপন্যাস।)
দেশের যন ভাগ হই গেছে
মনের ভাগ আর কে দেইখছে
সংসারটা কন যে এত বড় হই গেছে উপর উপর না হোক মনে মনেও টের হাই ন। কনও বুঝি নি, বুইঝবার দরকারও হড়ে নি, মা বুঝাই দিছিল সংসারটা এরমই হয়, জড়াই জড়াই ছিলাম। দুই একবার হোঁচট যে খাই নি এমনঢা নয়, গায়ে মাখি নি। কনও মিষ্টি, কনও ঝাল, কনও টক হইব, এই লই ভাইববার তো কিছু নাই, আছেই বা কী! হোঁচট খাইছি, উডি দাঁড়াইছি, কেউ আবার টানি তুইলছে, পট্টি বাঁধি দিছে, ফের গটগট করি হাঁডি চলি গেছি, গড়গড়াই চইলছে সব। এইটা বুইঝলাম যে দড়ির গিঁট দিই সংসারটা বাঁধা ছিল, গিঁটগুলা খুলি যার দিন দিন, কারন আছে, আবার কারন নাইও। কারে আর কইয়ুম। স্বামীর মাথায় তের চিন্তা। দেশটা ভাঙি খান খান। বড় হোলার ভারতে চলি যাওয়াটা মন তুন মাইনত হারে ন। গোপনে গোপনে চোয়ের জলও হালায়। মানুষটা কেমন যেন একা হই গেছে। অন আঁর ভাবনা হেতেনের কানে তুইললে মনের শান্তির জলাঞ্জলি হইব, তার চাই দেই না কতটা ধরি রাইখতাম হারি। হক্কলে যার যার মতো চলে। কেমন যেন নতুন নতুন মানুষ হইতে চায়। এমন ভাবগতিক জম্মে দেই ন। ওরা কতা কয়, ভাঙা ভাঙা, হুনিওনি কোনোদিন। মেজ দেওরের রকম সকম উলটাপালটা লাগে। হোলামাইয়ার বাপ হইছে, ঘরের দিকে নজর নাই, খেয়ালখুশি মতো চলে। এমনিতে হোমিওপ্যাথির বাক্স আর লগে হোমিও মেটেরিয়া মেডিকা লই বাড়ি বাড়ি ঘোরে। কী যে আয় করে ঈশ্বর জানে। রোজগার করি দুপয়সা সংসারে যে দিব তা আর কয় কে। আর জা ভালা মানুষ। দুকতা কইত গেলে উলটা ওরে গালমন্দ করে। হোলাগুন হড়ালেখা করের, না হান্ডাগুলি মারের কে কইব। বাপ যেমন বন্ধুবান্ধব লই গপ্প মারে হোলারাও বাপের ধাঁচ হাইছে। হরের ধনে পোদ্দারি করি কদিন চলে। হুকুর তুন ডুব দিই আয় কয়, ‘ বৌদিরে কোও ভাত দিত, আঁর হেঢে ছুঁচো ডন মারে।’ এই তো মেজ দেওরের কীর্তিকলাপ, আঁর স্বামী হিগাইন কানে তোলে না। আঁর ছোট দেওর ফর্সা টুকটুকে ছোটমোডো, কতা কম কয়, সাত চড়েও রা কাড়ে না। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা বিদ্যায় হড়ালেখা শেষ করি ওর ইচ্ছা হইল গ্ৰামের পাঠ চুকাই শহরে যাই ডাক্তারি কইরব। ওই কথা জানাবার হর মনে ভারি দুঃখ হইল। কী আর করুম। ওর দাদাও সায় দিল। ছোট ভাইটারে হরান দিই ভালোবাইসত। ভেন্ন সংসার পাতার কতা হুনি যেন গাছ তুন হইড়ল। শেষমেশ ভাইয়ের ইচ্ছার কাছে হার মাইনল। বুইঝলাম জীবনটা কেমন যেন শোধবোধের খেলা খেইলতেছে। এইটারেই কি কয় সময়ের ভাঙন, না ভাঙনের সময়। আঁই আর স্বামীরে একদিন কইলাম আমনের মেঝ হোলারে আমনের লগে শহরে লই যান, হরানটা একটুখানি হইলেও জুইড়াব। উনি তাতে মোটেও অমত করেন ন। হোলাও আহ্লাদে আটখানা, নতুন জায়গায় যাইব, নতুন ইসকুলে হইড়ব, ওর বাবার মুয়ে কত গল্প হুইনছে, হুনি হুনি ওর মনে কত ভাব আসি জড় হর, জাইনত চায় ‘কবে যামু, কবে যামু।’ হোলার খুশি দেই আঁর হোলারে ছাড়ি থাওনের মনের কষ্টটা কিছুটা কইমল যেন। কইলাম তো বটে, কিন্তু আঁর মনটা তো মানেন না। বড় হোলা চলি গেছে, মেঝ হোলারেও ছাড়ি থাইকত হইব, ভাইবলেও কষ্টে মনটা ভার হই যার। ঠাকুরপো ঘর ছাড়ি নতুন বাসায় যাই উইঠছে। কারে কি কমু, সময়ের ধাক্কায় সব উলটি পালটি যার। কোনও কিছুই আঁর আর বশে নাই। অদৃশ্য শক্তি কী এমনটাই হয় !
হোলা হইলা হইলা কাঁদাকাটি কইরত। দু’তিনবার ঘর চলি আইছে। অন মন বই গেছে। ওর বাবা কয়, দুষ্টর একশেষ। হড়ালেখায় মাথা ভালা। ইসকুলে মাষ্টাররা আদরও করে। হিংসাহিংসি একটু আধটু আছে। এবার বৃত্তি হাইছে। খুশিতে ডগমগ। ওর বাবা চায়, হোলারে এমন করি মানুষ কইরব, যাতে করি কোথাও ঠেইকত না হয়। উনি বারে বারে কয়, ‘আঁই তো চিরকাল বাঁইচতাম ন, লোকে তন কইত হারে, মাইনষের মতন মানুষ হইছে অমুক বাবুর হোলারা।’ আঁর মাইয়াটার বোধবুদ্ধি ছুরিকাঁচির মত চকচকে, ধার আছে। আঁই তো চব্বিশ ঘন্টা ওর লগে থাই, বুইঝতাম হারি, একবার কানে ঢুকাই দিলে আর ভুইলত ন। মাইয়াটার যত্মআত্তি কইরতাম হারি না, কামকাজ ঠিকমতো না কইরত হাইরলে বকাঝকা করি। এমনিতে মাইয়ার চোপা আছে কিন্তু ঐটুকানি মাইয়ার কর্তব্যজ্ঞান আছে। বাপ-ভাইদের লাই মন হড়ি থায়। ওরা বাড়ি আইলে ভালামন্দ রাঁধেবাড়ে। কিছু কইবার আগেই মুয়ের সামনে হাজির করে। এই মাইয়াটা বড় অর। বেঢিরে লই আঁই কী করুম, চিন্তায় আঁর ঘুম আয়ে না। আঁর স্বামীর এসবের লাই কোনো চিন্তা নাই। মাইয়াটা হাওয়া খাই বড় হই যাইব, হরে একটা ভালো হোলা চাই বিয়া দিতে হাইরলে সাত কুল রক্ষা। উনি আইন ঘাটাঘাটি করি, মুসাবিদা করি, মার্কেল মুহুরি কোর্ট-কাচারি করি সময় হাইলেই কত রকমের বই লই
যে হড়ি থাই উনিই জানেন। ওনার এমনিতে পানসুপারি বাদে কোনও পান চুরুটের নেশা নাই। সখের মধ্যে কেবল ওই মাখনজিনের প্যান্ট হরি কোর্টে যাইবার সখ। গুনের কথা বলি শেষ কইরতাম হাইরতাম ন। ওনার মুখ দিই একটা কথাও আইনের বাইরে কেউ কথা বলাইতে হাইরতেন ন। সাদাসিধা লোক, খড়ের ছাউনির মুলি বাঁশের বেড়ার ঘরে থায়। সময়ের লড়চড় নাই ঘুম তুন রাতের হোয়নের ইস্তক। সময়ের লগে ছোটে ওনার শরীল আর মন। নিজের হাতে আলু বাইগুন ছিম মরিচ আরো কত জাতের গাছ যে লাগায় হারা বছর ধরি উনিই জানে। কাচাকাচি ধোয়াধুয়িতে আপনার হাত জগন্নাথ। যত কই হক্কল কাম নিজের হাতে কইরতে যান কেন, হোনে কে ? চৌদ্দ বার কইলে একবার উত্তর দিই কয়, ‘ তুঁই এই সবের মানে বুইঝতা ন।’ হাঁচা কথা, ওনার ভাবসাব আঁই বুইঝতাম হারি না, এতদিন ঘর কইরলাম এর হরেও। সার কথাখান হইল এই, মানুষটা অন গোত্রের। না হইলে বড় ঝড় তুফানের রাতে যন একটা মানুষও ঘর তুন বার হন না, ঘরের মধ্যে রই ভয়ে কাঁপে, উনি কেমনে খালি ট্রেনে চড়ি হাই কোর্টে যাই জজের সামনে সওয়াল করি হারা মামলা জেতাই আনে। ট্রেনখান উল্টই হালার, মরিই তো যাইতে হাইরত। কথার দাম রাইখব বলেই না জীবন বাজি রাখা। স্বামী হইল তো কী হইছে, এমন মাইনষের বিচার করা কি আর সাজে ? কখন যে কি সিন্ধান্ত লইব, কে জানে।
কত মানুষ তো ভয়ে আতঙ্কে গ্ৰাম ছাড়ি কইলকাতা চলি গেল, উনি কেন রই গেল। কি জানি হয়তো কারও কারও মতো ভাইবল, এ আবার কেমন কথা, দেশ আবার ভাগ হয় নাকি, নাকি ভিটামাটির জন্য মায়া ? হিন্দু মুসলমানের গন্ডগোল থামি গেলে দু’দিন বাদে যেমন দেশ তেমন হই যাইব। আমার স্বামী বইলছিল, কোন সাহেব নাকি ম্যাপ বানাই সীমানা ভাগাভাগি করি দিছে, আঁই বিশ্বাস করি ন। দূর অ, এই আবার ক্যামনে হয় ! দেশ আবার ভাগাভাগি হয়?
যত সব আজগুবি কথা। ভারত, আঙ্গ কত বড় দেশ, এও কি সম্ভব! কার ঘাড়ে কটা মাথা, মাইনষের মনে কী মায়াদয়া নাই, যা খুশি তাই কইরব। হরে হরে হুইনলাম দুই দেশে পাসপোর্ট ভিসা চালু হইছে। নিজের বিশ্বাসটা নড়িচড়ি উইঠল। ঘরের কোনে বই ফোঁপাই ফোঁপাই কাঁইদলাম। তাহলি কি ব্যথা যায়? কত বছর ধরি এই ভালোবাসা জমা হইছে, শুধু চোখের জলে কী কইরে ধোয়ামোছা যায়? তাহইলে দেশটা কি ছোট হই গেল ? আঁর স্বামীর মনের অবস্থাখান আগের মতো নাই, দিনে দিনে কিরকম যেন হই গেছে। কী কারণ বুইঝতাম হারি না। মন খুলি কথা বইলতে যেন ভয় হায়। যে ওজনের মানুষ, চোখ তুলি কথা বইলতে যারা একসময় কাঁচুমাচু খাইত, হেতাগো বোধবুদ্ধি সব লোপ পাইছে, মুয়ের উপর কথা কয়, কথার মইধ্যে কথার কোনো ভাইল নাই, কথা হুইনলে গা’র ভেতরে জ্বালা ধরে, আকথা কুকথায় ঠোঁটের ডগায় ঠেলি বার হয়। টিটকারি মাইরতে ছাড়ে না। কনডাই ছিল এগুন এদ্দিন? অন্য দেশ তুন আইছে ? হেই দেশের কি নাম ? আঁর হোলা শহর তুন বাড়ি আইলে কত কথা বলে। হোলাপাইন মানুষ, সাদা মনে কাদা নাই, হেগের ভিতর রাখইত হারে না, গড়গড় করি বলি দেয়। আঁই আঁচ কইরতাম হারি, কী কষ্টে ওরা আছে। কারও কারও মনে বাসা বাঁইধছে যেন কোন তুন যেন হিন্দুরা উড়ি আই জুড়ি বইছে। হিন্দু হাড়ার মুয়ে বই গা জোয়ারি করে। কতক্ষণ আর চুপ করি থাওন যায়। অপমানের জ্বালা সহ্য না কইরত হারি মুসলমান বন্ধুদের কি হালায় মনের কথা – কী হইতে আছে গোলাম ভাই, আমাগো লগে ক্যান এরকম ব্যবহার করের, কয়েন চাই। এত পুরুষ ধরি বাস করি এই দেশে, রাতারাতি আমরা হর হই গেলাম। আমনেগো কোনো ক্ষতি তো করি নি। আঁর কাছে আমনেগো ধর্মের কতো মক্কেল আইছে গেছে, কোনো তফাৎ তো করি নাই, মুসলমান না হিন্দু। তবে আইজ ক্যান মোসলমানের দেশ, মোসলমানের দেশ বলি হক্কলে চেঁচার। ‘আমনেরে আর কি কমু, আমনে তো মান্যিগন্যি মানুষ, এই শহরে ব্যাক লোক আমনেরে এক ডাকে চেনে, আমনের লগে এই ব্যবহার হইতে আছে, আঙ্গ কি ভাল্ লাগের কন চাই। দুনিয়াদারি হক্কলখান পালটি যার। কেউ যেন উপর তুন চাঁপাই দের।’ ‘গোলাম ভাই, আমনে একখান কথা কন চাই, হাঁচা করি কইবেন। পশ্চিম পাকিস্তান আঙ্গ দেশ শাসন কইরব, এই কেমন কথা। ওরা কী বাঙালিদের চেনে না জানে, আমরা কী খাই, কী হরি, কেমন করি কথা কই, কেমন ভাষায় কথা কই, আঙ্গ মধ্যে কেমন সম্পর্ক, মিলমিশ, ওরা এসবের কি বুইঝব, ধর্মের নামে আগুন জ্বালাই দিলেই হইল। আচ্ছা কন তো পশ্চিম পাকিস্তানের মোসলমান আর পূর্ব পাকিস্তানের মোসলমানরা কি এক হাতে কনও হারে! এইযে এই দেশের মুসলমান ভাইরা আঙ্গরে তাড়াইতে চায়, ওরা কি একটুও বোঝে না, আমনেরা আমরা প্রতিবেশী, হেথারা নয়। ঝগড়াঝাঁটি করি, মারামারি করি, আমরাই দোসর,হেথারা নয়। একটু বোঝান দয়া করি এই দেশের লোকদের সুখ দুঃখের অংশীদার ওরা হইত হারে না। হায়ে হা মিলানোর নামই জীবন, বাকিটা মরণ।’
কে কার কথা কানে তোলে। হক্কলের কথার মধ্যে ফিসফিসানি ভাব। আঁর স্বামীর হাশ কাটাই দু’তিন জন চলি যাইবার সময় খোঁচা দিই চলি যায়। উনি একটু রাগি মানুষ, বেয়াদবি মাইনত হারে না। অন্য সময় হইলে জবাব দিতে ছাইড়ত নি, অন আর কী কইরব, কথা হজম করি চলি আইয়ে। ওরা পিছন পিছন আই আবারও টিটকারি মারে। এতদিনের চিনা হরিচিত শহরটার হালটা যে এমন করি হালটাই যাইব, জম্মেও ভাবে নাই। উনি জোরে হা চালায় চলি আইয়ে। হেথারা ছড়া কাটি কাটি ভ্যাংচায়। বয়ষ্ক মানুষটারে ওরা টিকতে দেয় না। এক আধা পাগলেরে উসকায়। ঘরে চলি আইলেও রক্ষা নাই। ওনার নামের বিকৃতি করি দরজার সামনে ঘাসের উপর বই তালি মারে। উনি বুঝি হালায়, ওর একার সাহসে কুলাইত ন এমন করার, কেউ না কেউ পেছন তুন ঠেলা মারের। উনি তাড়াই দিলেও হাগলটা আবার আই আরও জোরে জোরে নাচি নাচি গানের সুরে মত হারে ওনার চেহারা লই কথা কর। জালালুদ্দিন, এলাকার মুরুব্বিরে নালিশ কইরলে কয়, ‘ দাদা, মানাই গুনাই নেন, ‘কী আর কমু। একটা কথা কইতাম হারি, ইচ্ছা করি কইরছে, এরকমটা নয়, এটা নিশ্চিত, কলকাঠি নাড়ের অন্যলোকে।’ ‘এটা কী বাছি বাছি হিন্দু বাড়ির সামনেই করের !’ ‘অনুমান আমনের বেঠিক নয়।’ কথাটা হুনি উনি মুচড়ি হড়ে। বুইঝত হারে, গোলমালটা বড় রকমের লাইগব। খনিক বই থায়। হুইরের দিকে তাকায়। জলের তুন মাছেরা উঠি ঘাই মারে, আবার জলের তলায় চলি যায়। বুঝি হালায়, আঙ্গ অন এমন করিই বাঁইচত হইব, না হয় এক কোপে হক্কলে শেষ, কেউ বাঁচাইত হাইরত ন। ঠিক করি হালায়, আরও তো শহরের আনাচ-কানাচে হিন্দু হাড়াহড়শি আছে, ঘুরি ঘুরি দেইখব, আসল ব্যাপারখানা কি ? বাজার সারি ঘরমুখো হর ব্রজেন ডাক্তার, কানে কানে কয়, ‘বুইঝলেন দাদা, হিন্দুদের ওরা কালে কালে কচুকাটা কইরব। গোপনে শলা পরামর্শ করের মিউনিসিপ্যাল বাজারে আর হিন্দুদের দোকানপাট রাইখত দিত ন। কী করন চাই, কন ত। চিঠিচাপাটি কইরলে কোন কামে আইব ?’ ‘চেয়ারম্যানেরে আমরা চিঠি লেই দেইখতাম হারি যদি কোনও কামে আইয়ে।’ ‘দাদা, উনি তো মুসলিম লীগের সদস্য, উনি কি আর হিন্দু দোকানদারদের লাই লইড়ব, কী কন আমনে ? পাকিস্তানি পুলিশ সুযোগ হাইলেই বাছি বাছি হিন্দুদের ঠ্যাঙানি দের। উপায় নাই দেখে, মুখ বুঝি সহ্য করের। মুদি দোকানি কাজল ব্যবসাপাতি গুটাই হালাই গেছে। ভিটামাটিরে আঁকড়াই আমরা আর কয়দিন থাইকত হারুম, কন চাই। আমনে বুদ্ধিমান মানুষ, একটা উপায় বাতলাই দেন না।’ ‘গান্ধিজীর কথায় এখানের হিন্দুরা তো বিশ্বাস রাইখছিল, কী হলো? আঁর বড় হোলার কইলকাতায় কী দুর্দশা, আঁই তো জানি। রিফিউজি কয় ওদের, এট্টু থাইকবার জাগার লাই কী মারামারিটাই না করের। ওদের ধরি ধরি ক্যাম্পে, দন্ডকআরণ্যে, আন্দামানে হাডাই দের। কন্নাই গেলে যে আঙ্গ একটু ঠাঁই হইব।’ ‘তাইলে হিন্দুরা কি এইদেশে থাইকত হাইরত ন আর?’ ‘এ কথার উত্তর হাওন খুব শক্ত। মুক্তিহাড়ার সুজিত মন্ডলের মাইয়ার ইজ্জত লই কি টানাটানি হইল, মাইয়ার মা কি কাঁদাকাটিটাই না কইরল। আঁর হাখান জড়াই ধরি কইছিল, ‘কন চাই এই মাইয়া লই আঁই কনঢাই যাই। লজ্জ্বায় মাথা কাটা যায়, কাউরে মুখ দেয়াইতে হারি না। ওগো ঘরে কি বউঝি নাই, কন চাই দাদা ? ধম্ম ধম্ম লই এই দেশটা উচ্ছনে যাইব, আঙ্গরে তাড়াই, আঙ্গ জমি বাড়িঘর কব্জা করি ওরা কি সুখে থাইকত হাইরব? আরে, মুসলমানের দেশ লই কি জল ধুই খাইব ? হেথাগো খোদার কাছে কি জবাব দিতে হইত ন।’ মাথা নিচু করি চলি আইলাম। জবাব দিবার মতো কি ছিল আঁর কাছে যা দিই ওই মাইয়ার মা’র চোখের জল মোছাই দিমু। বুইঝছেন, তবে কিনা একটা আশার কথা আছে মনে হর, সময়টা আস্তে আস্তে ঘোরের। আঁর মোসলমান বন্ধু কবীর,বড় দরাজ মনের মানুষ, কইল, ‘দাদা, আমনে আঁর বেশি চিন্তা করিয়েন না। আল্লার ওয়াস্তে এমন দিন আর রইত ন। আঙ্গ লোকেরা বুইঝত হারের পাকিস্তান পাকিস্তান কই চেঁচাইলে আর কিছু লাভ হইত ন। পশ্চিম পাকিস্তানিরা দেশভাগের নাম করি বকলমে আঙ্গ দেশের সম্পদ চুইসবার ফাঁদ পাঁতা শুরু করি দিছে। ঢাকা রাজশাহী চাঁটগার নেতারা সব বলাবলি করের। হোনা যার ওরা নাকি বাংলা ভাষা উঠাই দি উর্দু চাপাইব। অন বুইঝত হারেনের ওদের মতলব খানা। দেড় হাজার কিলোমিটার দূরে সিংহাসনে বই জিন্নাহ সাহেব আঙ্গ দেশেরে আসলে উপনিবেশ বানাইব। আঙ্গ নেতাদের আসলে হাত্তাই দের না। আঙ্গ দেশের লোকজন মরুক বাঁচুক ওদের কি আওন যায়। তাই কইতে আছি, দেইখবেন ধর্মের জিগির কমি যাইব, আবার সব এক হইব।’ ‘তা হইলে তুমি কইতে আছ কবীর আমরা এই দেশে নিশ্চিন্তে থাকতে হারুম, আঙ্গ আর ভিটামাটি ছাড়ি যাইতে হইত না। যারা চলি গেছে ওগো ভিটার মুই চাইতাম হারি না, খাঁ খাঁ করের। মনটা আঁর হু হু করের। ‘আমনের মতো শক্ত মনের মানুষ উকিল বাবু, এমন কথা কইলে আমরা যাই কোথায়। সারদা উকিলের মুয়ের দিকে তাকাইতে হারি না। আল্লাহ আঁর জবান যেন কাড়ি নিছে। দুঃখ করি কর, হেথেনের কাঁচারিবাড়ি ভাঙচুর হইছে। ওনার মেধাবী হোলা দেশ ছাড়ি চলি গেছে। কত মেধাবী হিন্দু হোলারা চলি যার, এই দেশের কোয়ালে অনেক দুঃখ আছে।’
আঁর স্বামীর মনঃকষ্টটা আঁই বুঝি। হেথেনের মনের যন্তনাটা আঁই দূর কইরতে হাইরতাম ন। কিন্তু ভাগাভাগি করি লইতে দোষ তো নাই। তাইতে শহর তুন বাড়ি আইলে খোঁচাই খোঁচাই জিগাই – আমনে চুপচাপ হই গেছেন কিয়ের লাই? শহরে গোলমাল চইললে বাড়ি চলি আইয়েন, আঙ্গ গ্ৰামের দলিল মিঞা, মুস্তাক আলীরা আমনেরে কত সন্মান করে, জেঠা জেঠিমা ছাড়া কথা কয় না। হুইনতাম হাই হেথাগরে কারা আই ফুসলাইতে আছে। হেথারা সত্য মিথ্যা বুইঝত হারে না। মাথা চুলকাই আঁর কাছে আয় কয়, ‘আমনেই অন কি কইরতাম কন। কোনোদিন এমন কথা মনেও আইও ন, অন মুসলিম লীগের লোকজন আই আঙ্গ ঘর দূয়ারে শলা পরামর্শ করের কেমনে হিন্দুদের বাড়িঘর তুন উচ্ছেদ কইরত হইব। তওবা তওবা, এতদিন আমনেগো নুনভাত খাইছি, জমি-জিরাত চাষবাস কইরছি, এইসব কথা হোনাও পাপ। আমরা কই দিছি মৌলবী সাবদের, এইসব আকাম-কুকাম আঙ্গ দ্বারা হইত ন, এর হরেও যদি কুমতলব করেন, তবে আঙ্গ লাশের উপর দিই কইরত হইব। হেথাগো গায়ে হাত হইরলে জ্যান্ত হুঁতি হালাইয়ুম, ভাবি চান, কোনটা কইরবেন। ওরা কয়, ‘বলদ, তোমরা চাও না, পূর্ব পাকিস্তান শুধু, মোসলমানের জন্য হোক। বুইঝলা না, ওরা কাফের, বিধর্মী, বোঝ না, হুতলা হুজা করে। ওদের মাইয়াদের মোসলমান কইরত হাইরলে বেহেশতে যাইবা। কও, কোনটা চাও, বেহেশত না দোজখ। কইলাম, দোজখ। চোখ বড় বড় করি কইল, নেক কামটা কইরলা না, তোঙ্গ শাস্তি উপরওয়ালা দিব।’ এই কথা হুনি আঁর স্বামীর মনটা একটু হইলেও শান্ত হইল। তবু কথার কথা একটু কইতেই হয়। হোলাগা আঁর উঠানের মাঝখান দিই দৌড়াদৌড়ি করে। বড় হইছে তো। বাবা মা কি কথা কয়, হুইনবার লাই ছটফট করে। হেতেরও মনের মধ্যে থাকি থাকি নানা প্রশ্ন আই ঘোরে। শহরের ইস্কুলের ক্লাসে সহপাঠীদের মুয়ে অবাক হই কথা গাইন হুইনলে উত্তর খুঁজি মরে। বাবারে ডরে কিছু কয় না, যদি ধমকাই দুই একটা চড় থাপ্পর লাগাই দে। বাড়ি আইলে চোখ মুখ হুকনা দেই বুকে জড়াই ধরি জিগাই কীরে বাবা, তোর মন খারাপ কিয়ের লাই ? ঝরঝর করি কাঁদি হালায়। ওরা কয়, ‘ইয়ান তোগ দেশ ন, জানস নি।’ ‘কেন কয় এমন কথা মা ? তা হইলে আঙ্গ দেশ কোনটি ? আঁই তো ইয়ানেই জন্মাইছি। দেশ হইতে গেলে আরও কি লাগে ? ওর কথা হুনি আঁই তো খেই হারাই হালাইছি। বাবা হোলা কারে শান্ত্বনা দিমু বুঝি উইঠতেই সময় লাগি যাই। হোলারে বুঝাই দেশ ক্যামনে হয় আঁই তো জানি না বাপ, তবে এইটা জানি দেশ হইত গেলে একটা শিকড় চাই, আর সেই শিকড় উপড়ান এত সহজ কথা না, ধম্ম দিই তারে যেমন বিচার করা যায় না আর কোনো সাহেবের কলমের লাগে নাড়ি কাইটত হারা যায় না। হেইঢা তো আঙ্গ মনের মধ্যেই গাঁথি আছে। আঁর হোলার আঁর কথার মর্ম কি বুইঝল জানি না, আঁর চোয়ের দিকে চাই কইল, কী কইলা মা, ‘আমরা যিয়ানে যাই, দেশ আঙ্গ হঙ্গে হঙ্গে চলে ?’ ঠিক কথা কইছস । যিয়ানে আকাশ যায়, যিয়ানে নদী যায়, যিয়ানে বাতাস যায়, মাটিও যায় জলের লগে মিশি, এক সুঘ্রাণ শাস নিবার সময় নাকে আঁই মন লাগে, তন বুইঝবি এইটা আঙ্গ দেশ। কত দূরে তোর মামার বাড়ির দেশ কুমিল্লার সংরাইশ, বেড়াইত গেলে মনে হয়নি তোর দেশ ন, ত্রিপুরা ছিল এককালে, মনটা তো হড়ি আছে হিয়ানেই।
নৌকা চলি যায়। গাঙে নৌকা ভাসে। বুক হাঁঢি যায়। সকাল হইতে তনও অনেকেই বাকি। কারা যায় ? আমের পাতা জামের পাতা কুড়াইবার লাই নারিকেলের ঝাঁটা লই উঠান ঝাড় দিই। ধুল উড়ি যার আর ছুঁই হালার কত গাছের ডাল, কত হাতা, ধুলের লগে মিশি থায় হুকনা ধান, লাফাই লাফাই ঢুকি যার খড়ের গাদার নিচে। ভিজা খড়ের পচা গন্ধে কিলবিল করে কেঁচো ক্যারা দলে দলে। তুরুল পোকা জায়গায় জায়গায় গর্ত করে মাটি তুলি। কলকল কলকল শব্দ কানে আয়ে দূর তুন। আঁই ঝাঁটা হালাই ছুটি চলি যাই সদর দরজায় নাক বরাবর। পাখিরা বাকের মগডালে বই। কি জানি কে চলি যার ঘরবাড়ি ছাড়ি। এমন দশা দেই স্থির থাওন যায়! হেথেনগো ঘর তুন বার করি দিই বাড়ির সামনে লিখি রাইখছে কাইল তুন এই বাড়ির মালিক অমুক শেখ তমুক রহমান। কী আনন্দ, কী আনন্দ, আনন্দে হেট হুলায় নাচে। চোয়ের জলে বুক ভাসি যায়। কী মজা ঠ্যাঙানি দিই জবরদখল। কয়, বিবি বালবাচ্চা লই যদি স্থানে বাঁইচতে চাস, এক কাপড়ে পালা। কোনও শব্দ নাই। বাচ্চা কাঁদি উইঠলে মুখ চাপি ধরি থায়। কথা কই জিগাইবার আগেই পগারপাড়। যদি ধরা খাই যায় এই ভয়ে দিশাহারা। যাগো কোয়ালে এমন দুঃখ নামি আইছে, তাগো আর নিস্তার নাই। কোনো অজানা ঘাটে নামি যাই হাঁঢা শুরু কইরব। কার কাছেই বা দরবার কইরব। যদ্দুর চোখ যায় হাঁটাই সার। এসব কথা ভাইবতে ভাইবতে আকাশের এক কোনে সূর্য আই উঁকি মারে। আলো আই হইড়লে কাকভোরের ছায়া এট্টু এট্টু করি দূরে চলি যায়। আঁই খালের পাড় তুন ঘোমটা টানা ভিতর বাড়ির দিকে চলি আই। কি জানি দেখি হারাই যদি জিগায় ‘কনডাই গেছিলা ?’, তন কি জবাব দিমু। বাড়ির পুরুষ মাইনষে তন বদনা লই টাট্টির দিকে ছোটে। দেশের মধ্যে যে এত কআন্ড ঘটি যার, হিয়ানে লই হেথাগো কোনো হুঁশ নাই। হেথেনরা ভাবে, আঙ্গ গ্ৰামে কত দূরের ঘটনার কোনো আঁচ লাইগত ন। আঙ্গ গ্ৰামের মানুষগুন নিজের মতো চলে। হক্কলে সকলের সুখ দুঃখে ঝাপাই হড়ি ভাগাভাগি করি লয়। ওই তো আমিন চাচা কই গেল, ‘মগের মুল্লুক নি, যা খুশি তাই কইরব, আঙ্গ গ্ৰামে কি কোনো মুরুব্বি নেই? হেথাগো মতের বিরুদ্ধে যাই কোনো কথা হইত ন।’ উপস্থিত একজনে কয় ‘ হেথাগো মনের মধ্যে যদি ঘুণে ধরে।’ ‘হেরও দাওয়াই আছে।’ এসকল কথা হইতেছিল আঙ্গ কাচারিবাড়িতে বই। ‘উকিলবাবু, আমনে কোনো চিন্তা করিয়েন না। আমনেগো দেশ ছাড়ি কুথায়ও যাইতে হইত ন, আল্লার কসম।’
আঙ্গ হাশের বাড়ির রমেশ আই খবর দিল মুস্তাক মাষ্টারের ইন্তেকাল হইছে। বাংলার মাষ্টার খালি নয়, মিউনিসিপ্যাল বোর্ডের চেয়ারম্যান। দশ গ্ৰামের লোক এক ডাকে চেনে। এই মানুষটার জুড়ি নাই। আঁর স্বামীর লগে খাতির ছিল। এত দরদী মানুষ কী কমু। আঙ্গ বাড়ি আইলে গালগল্প কইরলে বুইঝত হাইরত না কেউ কোন ধম্মের মানুষ। কত আবদার করি কইত, ‘ ভাবী আঙ্গ বাড়িতে একবার আপনার পায়ের ধুলো হইরলে খুশি হইতাম।’ কইছিলাম, ‘যামু একদিন ভাইসাব।’ কেন যে কথা রাইখতাম হারি ন, ভাইবলে ভারি দুঃখ হয়। কেন মনে হয় এই মানুষটার এই দুঃসময়ে বাঁচি থাইকলে সকলের কামে আইত। আঙ্গ মনের মধ্যের এই কাঁটাই কি থাকি থাকি খোঁচা মারে, নাকি সাঁকোর খুঁটিগুন এত নড়বড়ে, খাল পার হইতে গেলে মড়মড় করি ভাঙি হড়ি যাইব এই ভয়। নাকি হেচন তুন কেউ টানি ধরি থাকে, হা বাড়ালেই হ্যাঁচকা টান মারে আর হোনায়, ‘হেথারা অন্য দুনিয়ার মানুষ।’ তাইলে মাষ্টার কী মনের এই কিন্তু কিন্তু ভাবখানা গুছাইতে চাইছিল ! আমরা বুইঝতাম হারি ন। অন মনে হইতেছে পাপ করি আইছি। বড় ভুল হই গেছে, ভালো মন্দ বুইঝতাম হারি ন। ভুলের মাশুল দিতে হইব অন। আমরা যন চিনতাম হারি না, হেথেনরা বা আঙ্গরে চিনব কেমনে ? মুস্তাক মাষ্টার চিনাতেই চাইতো, মিলাইবার লাই জানহরান দি হালাইত। মানুষজন বলাবলি কইরত, রসিকতা করি কইত, মাষ্টার হিন্দুর ঘরে না জন্মাই ভুল করি মুসলমানের ঘরে জন্মাই গেছে, হেথাগো হোলাগো লাই এত দরদ। কথাটা ভুল কয়নি, ক্লাসেও হিন্দু মুসলমানে কোনও তফাত করে না, শাস্তি দিবার বেলাও হমান দৃষ্টি। পরীক্ষার খাতায় নম্বর দিতেও চোট্টামি করে না। মৌলবীরা কয় তুমি কোন ধাতুতে তৈরি মাষ্টার। এমন একজন মাইনষের চলি যাওয়াতে শোক সামলাইতে কয়দিন কষ্টই হইল। তাহলে কী দ্যাশের ভিতর এবার আগুন জ্বইলব।
মাইনষে বাঁচে ক্যামনে? খাই দাই হুতি বই আর রোজের কেত্তন করি না এমন কিছু আছে যা আমরা দেখইতে হাই না, ফুঁড়ি ফুঁড়ি বাইর হয়। কত কিছুই তো ঘটে, আমরা ধার ধারি না। হক্কলে ভাবে এমন ত কত ঘটে, ফের ঠিক হই যায়, তা লই এত মাথা ঘামানোর কি আছে ? কাল যন চলি গেছে কালের নিয়মে হরের দিনের কথা ভাইবলেও তো চলে, কালকে দুষে আর লাভ কি। কত কিছুই তো পঞ্চাশ বছর ধরি ঘটি গেছে, তার কি আমরা ফেরত আইনত হাইরছি। ইংরাজরা আঙ্গ দেশ শাসন কইরছে একশো নব্বই বছর ধরি। আঙ্গ গ্ৰামের লোকের বোধ হয় নো, এই দ্যাশটা কে চালার, ক্যামনে চলের, দশ গ্ৰামের জোতদাররা খড়গহস্ত লই মাথার উপর ছড়ি ঘোরার, কেউ তো মুখ খোলে ন। তাইলে দোষটা কার ? কত কথা মাথায় ধরি রাইখছে। বোতলের ভুত বার হই আইলে ঘাড় মটকআই দিব, এমন ভয়ও হাইছে। দলিল মিঞা কি চুপ করি থাইকত হারে ! হায়ের নিচের মাটিটা সরাই আগাই যায়। মাঠে যাওনের তাগিদে জোরে জোরে হা ফেলে। কাঁচা মাটির দুই হাশে সবুজ ঘাস খাড়া হই, আবার হেলিদুলি লুটাই হড়ে। এত দিকে নজর দিবার সময় কোথায়। গট গট করি চলি যায়। আঁর মেলা কাম, নজর দিবার সময় হাই না। তবুও নজর চলি যায়। গরমের ছ্যাঁকা ধান গাছগুনের গায়ে জ্বালা হয়। হুধু দেওন যায় চাষীদের মাথা। বোরো ধানের চারাগুন চোয়ের নিমিষে বাড়ি যায়। ইদ্রিশ মিঞা বর্গায় চাষ করে। মাথার ঘাম হায়ে হেলি দিনের হর দিন খাটি মরে। ইদ্রিশ মিঞার মুয়ে রা-টি নাই। গরু দিই মাড়াইবার সময় হ্যাট হ্যাট করে। খুঁটির চারধারে ঘুরনের সময় যত সময় গড়ায় কথার বাঁধনটাও হাল্টায়, গরুও দৌড়য়, ইদ্রিশ মিঞা গরুর লগে লগে ঘোরে। ওই সময়ে ইদ্রিস মিঞারে আঁই চিনতাম হারি ন। মাঠের তুন লই আঁই আঁটি আনি স্তূপ করি রায়, পালা বাঁধে। ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি আইয়ে। কে যে কোনদিকে দৌড়াই কাঁচারি বাড়িতে ঢুকি যাইব। হিয়ানে রইছে খড়ের গাদা। ইদ্রিশ মিঞা আরও দু-তুন জন হোলারে লই খড়ের গাদায় হেলান দেয়। ওরা মাঠ তুন দৌড়ি চলি আইছে। কড়কড় আওয়াজ করি বাজ হড়ের। আর কিছুক্ষণ হরেই যেন আকাশ ভাঙি হইড়ব। কতদিনের জমানো খড়ে বৃষ্টির জল লাগি বাসি গন্ধ। ওরা শোঁকে আর গপ্প জুড়ি দেয়। আঁর কানে আয়ে সেসব কথা। গরুটা খুঁটির গায়ে কল্লায় দড়ি পেঁচাই ঠাঁয় দাঁড়াই দাঁড়াই বিষয়টির জলে চুপচাপ হর, হেইদিগে কারও খেয়ালই নাই। গরুগোতানের কথা কে আর চিন্তা করে। হেথাগো কথার মাঝখানে মাঝখানে একটা হব্দে আয় বার বার করি আঁই আঁটকি যাই। আঁই রসিঘরের এক কোনায় বসি বসি চুলার আঁচটা উসকাই দি। কাইলেও তো আম বাগান তুন মড়াৎ মড়াৎ করি যে ডাইলটা ভাঙি হইড়ছে, টুকরা হুকনা ডালগুন কুড়াই লই আইছি, একটু হইলেও আঁর মাথার উপর হইড়ত। ঈশ্বরের কৃপায় বাঁচি গেছি। আগুনটা গনগন করি উপরের দিকে উডের। ধানগুন বড় ড্যাগে সিদ্ধ করি আর এক চুলায় কাপড় সিদ্ধ করি ধোঁয়া উঠের দেই উঠানের দিকে তাকাই। আঁরে হক্কলে কয়, আমনের থাকি থাকি উদাস হয়নটাই একদিন কাল হইব। আঁই কিঅরুম। আঁর মনটাই এমন ধাতুতে বানাইছে ভগবান। এর তুন বেইরুম কেমনে !
মাটি ভিজি গেলে, হাঙ্গইল, গয়াম,গাব, ঢেউয়া গোলাবজাম,বেতৈন কাডল ককিয়া গাছের পাতা তুন জল গড়াই হইড়লে, কবুতর, চড়ুই শালিখরা ডানার জল ছিটাইলে ইদ্রিস মিঞা, দলিল মিঞা বিড়ি ফোকে, ধানক্ষেতের দিকে চাই থায়। উত্তর বাড়ির মৌলীনাথ ছাত্র হড়ায়, সদর দরজা পার হই যার কবিরাজ বাড়ির দিকে। ঝড়ের তান্ডবে দৌড়াই আই মন্দিরের হাশ দিই কাঁচারি বাড়িতে ঢুকি হড়ে। হায়ের মধ্যে হাঁটু সমান কাদা লাগি কী যে দশা হইছে, দাঁড়াই থাওন যায় না বেশিক্ষণ। ফুডা চাল দিই হোডা হোডা জল গড়াই হড়ি মেঝে বেগ্গাইন ভিজি এমন হইছে দাঁড়াইবার জায়গা নাই। কী আর করে মৌলীনাথ। আকাশের দিকে চাই কত কথাই না ভাবে। ইদ্রিস মিঞা বিড়ি ফুকে, ধোঁয়ার গন্ধে ভুত হালায়। বিষ্টি কী আর থামে, সনের ছাউনির তুন জল হড়ে গড়াই গড়াই। এই সময়ে কত কথাই না মনে হড়ে। চিল্লাই চিল্লাই কয় ‘মাষ্টার আমনে তো কত বড্ডা বড্ডা বই হইড়ছেন, জানেন নি কেন্নে তৈরি হইছে দেশ গাঁ। হুইনছিলাম আঙ্গ বাপদাদারা কয়েক যুগ আগে হিন্দু ছিল, আওলীয়া আর পীরের অলৌকিক ক্ষমতার হরিচয় হাই মোসলমান হয়।’ ‘বেগ্গাইন সোনা কথা। প্রমান তো নাই। খাদেম মুরিদরা কইত পাঁচশ বছর আগে পীর আওলীয়ারা মাছের পিঠে চড়ি, কেউ ভূঁই ফুঁড়ি, কেউ আকাশ তুন নামি আইত। পীর আওলীয়া ফকিরের ভক্ত হই গরীব নিরক্ষর হিন্দুরা বএহএস্ত যাওনের লোভে মুসলিম ধর্ম লইছিল। আঁই তো এইঢা জানিনা তোঙ্গ পূর্ব পুরুষরা কেমনে কবে তুন মুসলমান হইছিল।’ ‘মাষ্টার কইতাম হারেন নি আমরা গরীব কেন হইলাম ?’ ‘ এর উত্তর দিতাম হাইরতাম ন। তবে এইটা কইতাম হারি নোয়াখালীর ধন সম্পত্তি ছিল বৈশ্য-বারুজীবী, সাহা ও নারীদের হাতে। চাষবাস ছিল মাহিষ্য ও মুসলমানদের হাতে, বামুনদের সম্বল ছিল তালপাতার পুঁথি আর কায়স্থদের হাতে কলম।’ ইদ্রিস মিঞা গালে হাত দিই সকল কথা শুইনল আর দুই হাত উপরে তুলি কইল, ‘আল্লার কেরামত’। হরে মেঘের গজরানি থাইমলে যে যার হত ধরি যাইত চাইলে দলিল মিঞা কয়, ‘ মাষ্টার আর একটু দাঁড়াই যান না। একখান কথা জিগাইবার ছিল। জানি আমনের মেলা কাম। মাঠে লাঙ্গল চালাইতে চালাইতে কথাখান চাগাড় দিল। হুইনছি আঙ্গ জেলার নাম ছিল ভুলুয়া, হাঁচা কথা না ?’ হেথাগো কথাগাইন হুইনতে আঁর খুব ভালা লাগে। কান হাতি হুনি। মাষ্টার কয়, ‘ ভুল হোননি দলিলদা। হক্কল দেশেরই একখানা ইতিহাস আছে। আঙ্গও আছে।’ বিষ্টিটা আবারও যেন আকাশ ভাঙ্গি হড়ে। রাইক্ষুসি ঝড়ও উড়ই আই জুড়ি বয়। আঙ্গ ঘড়ের সামনের হাইঙ্গল গাছের ডালটা মড়াৎ করি চালের উপরে উড়ি আই হড়ে। হেথাগো গালগপ্পো জমি উডে। মাষ্টারেরও হুনাইত হারি চোয়েমুয়ে আনন্দের ফোয়ারা ছোঢে। ইদ্রিস মিঞাদের স্কুল, মাদ্রাসা, মক্তবে যাওনের সুযোগ হয়নি। জীবনের আনন্দ উল্লাস হক্কলটাই দোয়া, দরুদ, ওয়াজ, মিলাদ মাহফিলকে ঘিরে। লুঙ্গি আর চাদর আড়াল দিই আমাগো যাত্রায় আর কবির আসরে বই শাস্ত্রের গান শোনে। মাইনষের জানার ইচ্ছা দমানো কেমনে রাখিব ? মাষ্টার শিকড়ের গল্প হুনিয়েই চলে। ‘ভুল হুয়া ভুল হুয়া। মাটির গব্বের তুন উডি আইল বুঝি আবাজ। শোরগোল শোরগোল। বারাহী দেবীর কন্ঠে ধ্বনি প্রতিধ্বনি। রাজা বিশ্বম্ভর শূর নাম দিল ভুলুয়া। আঙ্গ পূর্বপুরুষের জীবন আর আঙ্গ ভবিষ্যতের চিহ্ন আঁকা হই গেল কইতে কইতে। দেইখতে দেইখতে বারশো খ্রীষ্টাব্দ পার হই কত ভাঙচুর হইল, জলের তলায় চলি গেল কত দ্বীপ, আবার চর গজাইল, রাজা বাদশাহর আক্রমণে রক্তারক্তি হইল, জমি দখল হইল, খুনখারাবি হইল। বিদেশি জমিদারের প্রতাপে দেশি জমিদার তালুকদার হইল। অন্য জেলার কত হিন্দুরা বসতি গইড়ল। ঢাকা, বরিশাল, চট্টগ্রাম, যশোর, হুগলি, সিলেট,পাবনা, মুর্শিদাবাদ জেলার, রাঢ় দেশের কত হিন্দুই তো বসত গইড়ল। পরে পরে হিন্দুর হোলামাইয়া পীর আউলিয়াগো কেরামতি দেই মুসলমান হইল। ভালা মন্দ জানি না। ভুলুয়া রাজ্য ভাগাভাগি হই পরগনা হইল, নতুন নতুন খাল বিল জলা মিলে হইল নতুন এক বালুচর, হেঁকে মাখামাখি। বঙ্গোপসাগরের কোলের তুন উডি আইল নোয়াখালী। সেই সকল গল্প কইত যাই মৌলীনাথ উদাস হই গেল। ‘কী মাষ্টার কও না ভালা করি। তোঁর বিদ্যাবুদ্ধির তো মাপজোক নাই। কন তুন কনে আই হাজির হই যায়, কে কইব। মাষ্টার আমনে যাই কন, আমরা হক্কলে মিলাই তো অন নোয়াখাইল্লা, হিন্দু মুসলমান। কী ভুল কথা কইছিনি।’ ‘ ইতিহাসের তলায় তলায় কত ইতিহাস। যুদ্ধের পর যুদ্ধ। পাঠান, পর্তুগিজ, মগ আর মোগলরা এই মাটির অধিকার লই কম কাড়াকাড়ি তো করে নি। মেঘনার জল হইছে রক্তে রক্তে লাল। হক্কলে হইত চায় রাজা। কারোগো ক্ষমতা হয়নি এগুনেরে আটকাইবার। হিন্দু মুসলমান হক্কলেরে খাঁচায় হুরি ডেকের নিচে বাঁধি লই যাইত পর্তুগিজরা আর দাস দাসী বানাইত। এরমই শোচনীয় দশা ছিল আঙ্গ দেশের। আর কত কমু, কই শেষ কইরতাম হাইরতাম ন। অনও কি আমরা ভালা আছি, ধম্ম ধম্ম করি আগুনে হুড়িয়ের। বাকিটা ভবিষ্যত জানে।’ ‘মাষ্টার আমনের মতো করি কয়জন ভাবে, সকলের তো ভাগাভাগিতে আনন্দ।’
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)