তুষার বরণ হালদার
লেখক পরিচিতি
(তুষার বরণ হালদার নদীয়ার আড়ংঘাটা গ্রাম থেকে স্কুল শিক্ষা শেষ করে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করেন। পি.এইচ.ডি. ডিগ্রি পান নদীয়া জেলার অসংগঠিত শিল্প ও শ্রমিকদের ওপর গবেষণা করে । গবেষণা কর্মের ওপর ভিত্তি করে দুটি বই এবং বিভিন্ন গ্রন্থ ও জার্নালে বহু প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদ কর্তৃক প্রদত্ত শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধের জন্য তিন বার পুরস্কৃত হন। এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য। বর্তমানে তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত দক্ষিণবঙ্গের একটি কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপক।)
প্রমথনাথ বসু (১৮৫৫ – ১৯৩৪)
সত্যেন বসুর বিজ্ঞান সাধনাকে যাঁরা এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন বিজ্ঞানী প্রমথনাথ বসু। বিজ্ঞান সাধনার মধ্যে দিয়েই তিনি স্বদেশের শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রসারে যে অবদান রেখেছিলেন তার মধ্যে অভিব্যক্ত তাঁর ভারতবোধ, স্বদেশ ভাবনা। জন্মেছিলেন বর্তমান উত্তর ২৪ পরগণা জেলার গোবরডাঙ্গায় ১৮৫৫ সালের ১২ মে। স্থানীয় হাই স্কুলে তাঁর প্রাথমিক পড়াশোনার সূচনা। মেধাবী প্রমথনাথকে মাত্র নয় বছর বয়সে ঠাকুরদা নবকৃষ্ণ বসু কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি করে দেন।
১৮৭০ সালেই তিনি এন্ট্রান্স এ বসার যোগ্য হয়েছিলেন কিন্তু বয়স কম হওয়ায় তাঁকে এক বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিলো। ইত্যবসরে তিনি লিখে ফেলেন তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ আকাশ কুসুম ‘। এটা ছিল সত্যিই অভাবিত। এর পর এন্ট্রান্স পরীক্ষার সময় শারীরিক অসুস্থতা নিয়েও তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছিলেন। অর্থাৎ তাঁর মেধার স্বাক্ষর তিনি একদম প্রথম থেকেই রেখেছিলেন। সেইসঙ্গে তিনি মনস্থ করেছিলেন বিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশোনার জন্য বিলেতে যাবেন। এরই ফলশ্রুতি, তিনি সেই সময়ের কঠিন বৃত্তি পরীক্ষা গিলক্রিস্ট স্কলারশিপ লাভ করেছিলেন। এর আগে মাত্র দুই জন এই বৃত্তি পেতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি. এস. সি. ডিগ্রী লাভ করেন।
লন্ডনে থাকাকালীন তিনি রয়াল স্কুল অফ মাইনস এ ভর্তি হয়েছিলেন। এই বিষয়ে পাঠ নেওয়ার সময় তিনি ভারতের আর্য সভ্যতা নিয়ে মূল্যবান প্রবন্ধ লিখে ইতালী সরকারের কাছ থেকে পুরস্কার প্রাপ্ত হয়েছিলেন। এই সময় থেকেই তাঁর মনে ভারতচর্চার আগ্রহ জাগে। একদিকে বিজ্ঞান সাধনা অন্যদিকে স্বদেশবিদ্যাচর্চা পাশাপাশি চলতে থাকে। বিলেতে ভারতবর্ষের উন্নতির জন্য গঠিত ইন্ডিয়া সোসাইটির সম্পাদক মনোনীত হয়েছিলেন মাত্র ২৪ বছর বয়সে। সেখানে তিনি ব্রিটিশ শাসনের কু দিক গুলি সম্পর্কে তাঁর বলিষ্ঠ বক্তব্য তুলে ধরতেন। এই জন্য ব্রিটিশরা তাকে ভূতত্ত্ব বিভাগে চাকরি দিয়ে ভারতে পাঠিয়ে দিয়েছিল।
ভূতাত্বিক প্রমথনাথ ১৮৮০ সালে জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়াতে যোগদান করেছিলেন। এই চাকরি করার ইত্যবসরে লিখে ফেললেন তিন খন্ডে বিখ্যাত গ্রন্থ A History of Hindu Civilization Under British Rule. এই গ্রন্থ ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির এক আকর হিসাবে বিবেচিত। এই গ্রন্থের মধ্যে দিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল ভারতবিদ্যাচর্চায় তাঁর অসাধারণ দক্ষতা।
এর পাশাপাশি দেশব্রতি হিসাবেও তিনি ছিলেন এক অসাধারন মানুষ। এশিয়াটিক সোসাইটির শতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে সোসাইটির ১০০ বছরের মূল্যায়ন করে যে স্মরণিকা প্রকাশিত হয়েছিল তার বিজ্ঞানখন্ডটি রচনার দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন এই বিজ্ঞান সাধক। বিজ্ঞান লেখনীর মধ্যে দিয়েও তিনি স্বদেশ ব্রতের দীক্ষা দিয়েছিলেন। দেশের কারিগরী শিক্ষা প্রসারেও তিনি ছিলেন অগ্রনী পুরুষ। বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট গড়ে তোলার কাজেও তাঁর অবদান সর্বজন বিদিত।
সফল কর্মজীবনের নানা জায়গায় তাঁর স্মৃতি জড়িয়ে থাকলেও সাধারণ বাঙালির কাছে তিনি আজ প্রায় বিস্মৃত। এই মহান ব্যাক্তিত্ব ১৯৩৪ সালে ইহলোক ত্যাগ করেন। তাঁর সম্পর্কে বিজ্ঞানাচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু যা বলেছিলেন তা আজও প্রাসঙ্গিক: ” জগদীশচন্দ্র ও প্রফুল্লচন্দ্র দেশ বিখ্যাত বিজ্ঞানী। এদের আগে আর একজন বাঙালি বিলেত থেকে কৃতবিদ্য হয়ে দেশে ফিরে আসেন। তিনি ভূতত্ত্ববিদ প্রমথনাথ বসু। প্রমথনাথের জীবনধারা কালে কালে তাঁকে বাঙলা দেশের পূর্বাচার্যদের সমআসনে উঠিয়েছিল। ”