অরিত্রী দে

চতুর্থ পর্ব

রবীন্দ্রনাথের পল্লী উন্নয়ন ও পরিবেশ ভাবনা : প্রসঙ্গে ‘পল্লীপ্রকৃতি’

ক. 

শুরুর কথা:

চতুর্দিকে ঘন জঙ্গল এবং অন্ধকারের মধ্যে জল প্রবেশ করে সমস্ত পাতা লতা পচতে থাকে, গোয়ালঘর এবং মানব গৃহের আবর্জনা সমস্ত চারদিকে ভাসতে থাকে, পাট পচা দুর্গন্ধ, জলের রঙ নীল হয়ে ওঠে, উলঙ্গ পেট মোটা পা সরু ছেলে মেয়েরা যেখানে সেখানে জল কাদায় মাখামাখি ঝাপাঝাপি করতে থাকে, মশার ঝাঁক স্থির পচা জলের উপর একটি বাষ্প স্তরের মতো ঝাঁক বেঁধে ভন ভন করতে থাকে— এ অঞ্চলের বর্ষার গ্রামগুলি এমন অস্বাস্থ্যকর আরামহীন আকার ধারণ করে যে তার পাশ দিয়ে যেতে ভয় হয়। 

২০ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৪ সালে কবি ‘দিঘাপাতিয়া জলপথ’ থেকে ইন্দিরা দেবীকে এক গ্রামের দুরবস্থা প্রসঙ্গে এমন কথা লিখেছিলেন। এই পরিবেশের মধ্যে গৃহস্থের মেয়েরা একখানা ভিজে শাড়ি গায়ে জড়িয়ে বাদলার ঠাণ্ডা হাওয়ায় বৃষ্টির জলে ভিজতে ভিজতে হাঁটুর উপর কাপড় তুলে জল ঠেলে সহিষ্ণু জন্তুর মতো ঘরকন্যার নিত্যকর্ম করে। প্রতি ঘরে ঘরে বাতে ধরছে, পা ফুলছে, সর্দি হচ্ছে, জ্বর হচ্ছে, পিলেওয়ালা ছেলেগুলো অবিশ্রাম ঘ্যান ঘ্যান করে কাঁদছে- মানুষের আবাসস্থলে এই অবহেলা, অস্বাস্থ্য অসৌন্দর্য, দারিদ্র্য, বর্বরতা কবিকে চিন্তিত করেছিল। বছর দশেকের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রচলিতের তুলনায় চলাফেরার ভৌগোলিক পরিধিগত দিক থেকে অনেকটাই সীমাবদ্ধতা অনুভব করতেন। জোড়াসাঁকোর অবরুদ্ধ গতানুগতিক জীবনের অভ্যস্ত ধারা থেকে মুক্তি পেয়ে যেদিন পেনেটিতে ছাতুবাবুর বাগানে সপরিবারে আশ্রয় নিতে হয়েছিল (ডেঙ্গু জ্বরের ভয়ে), সেটি তাঁর স্মরণীয় দিন হয়ে থেকেছে। পেনেটির বাগানে এসেও চলাফেরার নিষেধ শিথিল হলো না, কাছেই বাংলার পল্লীগ্রাম অথচ সেখানে প্রবেশের অনুমতি নেই। পল্লীজীবনকে নিতান্ত কাছ থেকে দেখা বা জানার অবকাশ তখনও সেভাবে আসেনি। আরো বেশ কয়েক বছর পরে তা আসে যখন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের বড়জামাতা সারদাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়ের মৃত্যুতে ও স্ত্রী-বিয়োগ পরবর্তী সাংসারিক কাজকর্মে বীতস্পৃহ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরকে পেরিয়ে জমিদারি তত্ত্বাবধানের ভার দ্বিজেন্দ্রনাথ এবং কনিষ্ঠ রবীন্দ্রনাথের উপর বর্তায়। দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর আবার দার্শনিক ও কবি, তাঁর পক্ষে বৈষয়িক কাজকর্ম দেখাশোনা করা প্রায় অসম্ভব। সুতরাং পরিচালনার যাবতীয় রবীন্দ্রনাথের উপর এসে পড়ল। ১৮৮৯ সাল থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত সুদীর্ঘ একত্রিশ বছর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এস্টেটের বেতনভোগী হিসাবে জমিদারি দেখেছেন। এই জমিদারির সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল সর্বমোট পঞ্চাশ বছরের। পদ্মা সংলগ্ন জনপদে পরবর্তী সময়ে যখন রবীন্দ্রনাথ স্থায়ী বাসা বাঁধেন, তখন পল্লীর প্রাণস্পন্দনকে নিতান্ত কাছ থেকে অনুভব করেছেন। 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কার্যতই তাঁর ‘জমিদার’ পরিচয়কে অতিক্রম করে পল্লীগ্রামকে তন্ন তন্ন করে জানার চেষ্টা করেছিলেন। জমিদারির কাজকর্ম, হিসাবপত্র, খাজনা আদায়, জমা-ওয়াশীল— এতে কোনোকালেই অভ্যস্ত ছিলেন না…কিন্তু কাজের মধ্যে যখন প্রবেশ করেন, কাজ তাঁকে পেয়ে বসে। এমনকি পার্শ্ববর্তী জমিদারেরাও তাঁর কাছে কর্মচারী পাঠিয়ে দিতেন, কী প্রণালীতে তিনি কাজ করেন তাই জানার জন্যে। এখন প্রশ্ন- যে কাজ কবিকে পেয়ে বসল, তা ঠিক কি? এই কাজ পল্লী-উন্নয়নের কাজ, বলা ভালো পল্লী পুনর্গঠন ও তার প্রকৃতি পরিবেশের আনুকূল্য ফিরিয়ে আনার কাজ; প্রসঙ্গক্রমে কবির ‘দেশ’ সম্পর্কিত চিন্তাভাবনার সুপরিকল্পিত প্রয়োগ প্রচেষ্টা। মৃত্যুর মাত্র এক বছর আগে কবি বাঁকুড়ায় যান (১ মার্চ ১৯৪০) বাঁকুড়ার ম্যাজিস্ট্রেট সুধীন্দ্রকুমার হালদার (আই.সি.এস) ও তাঁর পত্নী কবির স্নেহাস্পদা উষাদেবীর আগ্রহ ও ব্যবস্থাপনায়। পৌঁছনোর পরদিন কবি ‘বাঁকুড়া- প্রদর্শনী’র দ্বার উদ্ঘাটন করেন। এর আগে মণ্ডপে নানা প্রতিষ্ঠান তাঁর প্রশস্তি পাঠ করে। সকল অভিনন্দনের উত্তরে কবি একটি ভাষণ দেন, যেখানে প্রতিবাদ করে বললেন- ধনীবাড়ির সন্তান হওয়া সত্ত্বেও পল্লীগ্রামকে নিরন্তর ভালোবাসার যে দৃষ্টি দিয়ে দেখেছেন তাতেই তাঁর হৃদয়ের দ্বার খুলে গেছে। বৈশাখ ১৩৪৭ সংখ্যা প্রবাসীতে মুদ্রিত হয় ভাষণটি। কবির মৃত্যুর পর, তাঁর জন্ম শতবর্ষে প্রকাশিত ‘পল্লী প্রকৃতি’ গ্রন্থের সর্বশেষ রচনা এই অভিভাষণ। ‘পল্লী প্রকৃতি’ গ্রন্থে সংকলিত রচনার সংখ্যা উনিশ। এর মধ্যে পল্লীর উন্নতি, ভূমিলক্ষী, শ্রীনিকেতন, পল্লীপ্রকৃতি, দেশের কাজ, উপেক্ষিতা পল্লী, অরণ্যদেবতা, হলকর্ষণ, পল্লীসেবা, সমবায়ে ম্যালেরিয়া নিবারণ, বাঙালির কাপড়ের কারখানা ও হাতের তাঁত, জলোৎসর্গ প্রভৃতি কয়েকটি রচনা খেয়াল করলেই পল্লী গ্রামের সার্বিক উন্নয়ন বিষয়ে ভাবিত রবীন্দ্রনাথের মনোভাব স্পষ্ট হবে। ১৯১৫ সাল থেকে ১৯৪০ সালের মধ্যে লেখা প্রবন্ধগুলি থেকে মনে হয় যেন দক্ষ  পরিবেশবিদ সূত্রাকারে রচনা করছেন রুটিন। এই সময়পর্বেই আসলে পল্লী গ্রামের সঙ্গে কবির অন্তরের যোগ আক্ষরিক অর্থেই নির্মিত হয়েছিল। এইখানে বলে রাখার যে বিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকে ‘কালচার’ শব্দটি নিয়ে বিদ্বজ্জনেরা বিবিধ চিন্তাভাবনা করছিলেন (আচার্য যোগেশচন্দ্র রায়, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ)। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ‘কালচার’কে সবিশেষ ব্যাখ্যা করা ও নির্মাণ করার প্রয়োজনীয়তা বোধ হতে থাকল। এর আভিধানিক অর্থ ঠিক হল ‘রিফাইনমেন্ট’ (Refinement), ‘কাল্টিভেশন'(Cultivation), ‘ডেভলপমেন্ট’ (Development)। ঐ শতকের তিনের দশক জুড়ে রবীন্দ্রনাথ বিব্রত ছিলেন কালচারের সমার্থক ‘কৃষ্টি’ শব্দটি নিয়ে। এটি একটি বৈদিক শব্দ, তথা কর্ষিত ক্ষেত্র বা ভূমি। সেই অর্থে কালচারের সঙ্গে দেশ বা দেশের মানুষ, জাতি- বলা ভালো যে জাতি কৃষিকর্ম জানে, তার সম্পর্ককে বোঝাল। কৃষি ক্ষেত্রে যেমন বীজ বপনের মাধ্যমে এক থেকে বহুর সৃষ্টি হয়, ভূমিক্ষেত্রের কর্ষণ হয়, তেমনি মানুষের সমাজবদ্ধতার সজ্ঞান প্রচেষ্টায় তার বেঁচে থাকার যাবতীয় কিছুর সংস্কার সাধন ও গুণগত মান বৃদ্ধি ঘটে; এও ‘কর্ষণ’। প্রাকৃতিক নিয়মশাসিত জীবনকে সজ্ঞান সচেতন চেষ্টায় বিচিত্র কর্মের বিচিত্রতর নিয়ম সংযমের শাসনে ক্রমশ সংস্কৃত করে তোলাটাই সংস্কার সাধন করা। কবির কাছে কালচার বলতে এই কর্ষণ ও সংস্কার (to improve), সেখান থেকে ‘সংস্কৃতি’। শান্তিনিকেতন-শ্রীনিকেতন পর্বে ‘পল্লীপ্রকৃতি’র প্রতিটি প্রবন্ধেই, গ্রামের স্বাস্থ্য-শিক্ষা-পরিবেশ-রাজনীতি বা স্বদেশী ব্রত প্রসঙ্গে এই কালচারে’র কথা এসেছে। 

খ.   

সাংস্কৃতিক পুনরুজ্জীবন গ্রামশহরের প্রভেদ দূরীকরণ:

পল্লীপ্রকৃতির প্রথম প্রবন্ধ ‘পল্লীর উন্নতি’তে কবি পল্লীকেই ‘দেশ’ বলতে চেয়েছেন। কেননা অন্নকে কেন্দ্র করে অন্নসংস্থান করার সুযোগে একত্রিত হওয়ার সামাজিক মনোবৃত্তি থেকেই জনপদ ‘পল্লী’র জন্ম। পল্লীর অন্নভান্ডার ও অন্ন-সংস্কৃতির প্রাঙ্গণে বাঁধা হয়েছিল গ্রাম। এখানে সেই অন্নব্রহ্মের তত্ত্ব (প্রবন্ধ: পল্লীপ্রকৃতি), যার আশ্রয়ে নবান্ন, ধানের সাধ ভক্ষণ, স্বর্গদীপ প্রভৃতি পার্বণ পিড়ি পেতে দেয়। নেপথ্যে বাঙলার নিজস্ব সংস্কৃতিটি চিরবিরাজমান। একে কেন্দ্র করে আস্তে আস্তে সঙ্গীত, শিল্পকলা, সাহিত্য, ধর্মনীতি ইত্যাদি বিচিত্র আয়োজনপূর্ণ আচার-অনুষ্ঠান হয়ে উঠেছে। এহেন পল্লীর অন্ন-জল-চিকিৎসাব্যবস্থা-শিক্ষা ও অর্থনৈতিক সুষ্ঠু কাঠামো গড়ে তুলতে হাত লাগাতে হবে সকলকেই, এই ত ‘দেশের কাজ’। ‘পল্লী’ই আসলে সমাজ, বৃহদর্থে দেশের জনসাধারণ, যারা একইসঙ্গে ধনের উৎপাদক ছিল, ভাগীও ছিল আর পরস্পরের প্রতি সামাজিক কর্তব্য সাধনে একটা সমগ্র (Total) ব্যাপার। কবি খেয়াল করেছেন শিক্ষিত মানুষ ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের লোভে, অতিরিক্ত অর্থের লোভে অস্বীকার করে গ্রাম আর তার পরিবেশকে। ঔপনিবেশিক পর্যায়ে ব্যবসা বাণিজ্যের প্রয়োজনে যখন শহর গড়ে উঠতে থাকল, অর্ধেকের বেশি মানুষ গ্রাম ছাড়ল কাঁচা টাকা হাতে হাতে পাওয়ার জন্য। শুরু হল চাকরি জীবন, তৈরি হল কলকারখানা, বন্দর, কলোনি; ক্রমাগত বেড়ে চলল শহর। অন্যদিকে গ্রামের পরিসর কমতে থাকল, কর্ষণযোগ্য জমিও তাই। অর্থাৎ শহুরে জনসংখ্যা নাগাড়ে বৃদ্ধি পেলেও বরাদ্দ ভূমিলক্ষ্মী তথৈবচ। আবার ফলানো ফসল বাইরে যায় বিদেশীদের খিদে মেটাতে। পুরনো চাষপদ্ধতি ও চিরাচরিত প্রচলিত জ্ঞান খাদ্যশস্য জন্মানোর হার বাড়াতে অক্ষম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বিশ্বায়ন- নগরায়ণের যে জোয়ার সবকিছুকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে, ‘আধুনিক যুগ’ বলে যে সময়কাল চিহ্নিত হবে, তার প্রাক্কালে দাঁড়িয়ে কবি বুঝেছিলেন গ্রাম যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের সামূহিক অবস্থিতি আর অন্ন-জল-বায়ুর সরাসরি সংযোগ নষ্ট হচ্ছে। গ্রাম উৎপাদন করছে আর শহর নির্বিশেষে ভোগ করছে। গ্রাম থেকে যা একবার শহরে যাচ্ছে তা আর গ্রামে ফিরে আসছে না, পূর্ণ হচ্ছে না সুষ্ঠু বিপাকীয় চক্র (প্রবন্ধ: ভূমিলক্ষ্মী)। ‘উপেক্ষিতা পল্লী’তে এটাই আরো স্পষ্ট করে বলছেন, শহর যেন চাঁদের একপিঠের আলো আর আর গ্রাম অন্য পিঠের অন্ধকার। মনে রাখতে হবে কবি কিন্তু শহর বিরোধী নন, শুধু যান্ত্রিক শহর ও গ্রামের মধ্যে পারস্পরিক সেতুবন্ধনের যে অভাব, তার বোধ থেকেই পল্লী পুনর্গঠনের কথা বলেন, মনে করান সমাজ-স্বার্থের কথা। স্পষ্টতই বলছেন- “দায়ে পড়ে নিজের সকলপ্রকার অযোগ্যতা সত্ত্বেও কাজে নামতে হল। যাতে কয়েকটি গ্রাম নিজের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আর্থিক উন্নতি প্রভৃতির ভার সমবেত চেষ্টায় নিজেরা গ্রহণ করে আমি সেই চেষ্টায় প্রবৃত্ত হলুম। দুই-একটি শিক্ষিত ভদ্রলোককে ডেকে বললুম, তোমাদের কোনো দুঃসাহসিক কাজ করতে হবে না—একটি গ্রামকে বিনা যুদ্ধে দখল করো।” এক একটা গ্রামের দায়িত্ব অবস্থাপন্ন ব্যক্তিবর্গের প্রত্যেকে যেন নেন। পরে যদিও এই ভাবনা থেকে সরে আসবেন ‘শ্রীনিকেতনের ইতিহাস ও আদর্শ’ প্রবন্ধে। তাঁর শান্তিনিকেতন আত্মশক্তি, সাহস, ভিত্তি স্তরে কাজ করার প্রবণতা দিয়ে নির্মিত হয়েছিল। ১৯২২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারিতে পল্লী উন্নয়ন বিভাগের কেন্দ্র সুরুল স্থাপিত হয় শান্তিনিকেতন কুঠিতে। ১৯২৩ সালে শান্তিনিকেতনে বৃক্ষাবাস স্থাপিত হয়। এরও পাঁচ বছর পরে ১৯২৮ এ বৃক্ষরোপণ ও হলকর্ষণ অনুষ্ঠিত হয় শান্তিনিকেতনে। ১৫ জুলাইতে নন্দলাল বসু প্রাচীরগাত্রে হলকর্ষণ উৎসবের ফ্রেসকো রচনা করেন। ১৩৩৬ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ মাসের এই উৎসব ‘সীতাযজ্ঞ’ নামে পরিচিত হয়েছিল। 

স্বায়ত্তশাসিত গ্রাম পরিকল্পনায় সমবায়নীতি প্রণোদিত এক অর্থনৈতিক বন্ধন:

ধনীদের কল্যাণে গ্রাম ভালো ছিল- এই ব্যবস্থা স্বীকার করলেও তা কার্যকর হোক, কিছু পরে নিজেই আর চাননি কবি। পরিবর্তে তিনি সমবায়িক শক্তির কথা বললেন। সকলের যা সম্বল আছে সামর্থ্য আছে তা একত্র করলে অনায়াসে ট্রাক্টর দিয়ে সকলের জমি চাষ করা চলবে। সকলে একসঙ্গে কাজ করলে জমির সামান্য তারতম্যে কিছু যায় আসে না। এতে করে লভ্যাংশ যেমন ভাগ করে নেওয়া যাবে তেমনি সমস্ত ফসল গ্রামের একটি জায়গাতেই রাখা সম্ভব হবে এবং সেখান থেকে মহাজনেরা প্রয়োজনে উপযুক্ত মূল্য দিয়ে কিনে নিয়ে যেতে পারবে। এধরনের সমবায়িক বিকেন্দ্রীকরণ পদ্ধতির সাহায্যে অর্থনীতিতেও স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তুলতে প্রকৃতির দান আর মানুষের জ্ঞান- এই দুইকেই সহযোগী রূপে চেয়েছেন। একসময়ে মাড়াই কল আর তার যন্ত্রের মাধ্যমে গ্রাম দেশ দেশান্তরকে চিনি আর কাপড় জুগিয়েছে। কবির কথায়- “তখন শ্রী ছিল তার ঘরে, কল্যাণ ছিল গ্রামে গ্রামে।” যেখানে অন্ন আর ধন পরস্পর হাত ধরাধরি করে আছে, তাকেই গ্রহণ করতে পরামর্শ দিয়েছেন। এমনকি শহরের যন্ত্রদানব এই সুসম্পর্কের দিকে রক্তচক্ষু পাকালে দেশের মানুষকে নিজেদের উদ্যোগে নিজের অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা বজায় রাখতে হবে। ‘অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা’ অর্থে কিন্তু সংস্কৃতিকে ধারণ করেই খাওয়া-পরার যে স্বচ্ছলতা, সেই বিশেষ সামঞ্জস্যপূর্ণ অবস্থান। যারা বিলাতের আমদানি কোন কল চালিয়ে কাপড় না বুনে নিজেদের হাতের শ্রম ও কৌশলকে প্রধান অবলম্বন করে তাঁত বোনে, সেই দেশি তাঁত শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। বোঝাতে চেয়েছেন যে বাংলার শিল্প আপনাকে তুলে ধরতে অপর কোনো দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ছিনিয়ে নিয়ে ব্যবহার করেনা। যেমনটা ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে বোম্বাইয়ের কারখানায় দক্ষিণ আফ্রিকার কয়লায় কল চালিয়ে কাপড় তৈরি হয়। কুটির শিল্পের উন্নতি চিন্তাও তাঁর মাথায় ছিল। বয়নশিল্প শেখাতে শ্রীরামপুরে নিয়ে যান একজন তাঁতিকে, স্থানীয় একজন মুসলমান জোলাকে পাঠানো হয় শান্তিনিকেতনে তাঁতের কাজ শিখতে। তিনি এসে খোলেন তাঁতের স্কুল। পুত্র রথীন্দ্রনাথকে লিখছেন- বোলপুরের ধান-ভাঙা কলের মত একটা কল পতিসরে আনতে পারলে বিশেষ কাজে লাগবে। এখানকার চাষীদের কোন ইন্ডাস্ট্রি শেখানো যেতে পারে সেই কথা ভাবছিলেন। ভাবছেন পটারি শিল্প গ্রামে তৈরি করা যায় কিনা, ছাতা তৈরির শিল্প চাষীদের শেখানো যায় কিনা অথবা টালি বা খোলা তৈরির কারখানা। দেশের কাজের কথা বলতে গিয়েও পল্লী কেন্দ্রিক উন্নয়নকে লক্ষ্যে রেখে নানান কর্মসূচি নির্দেশ করেছেন। দেশব্যাপী মানুষের নিজেদের মধ্যে আত্মীয়তা বাড়ানোর স্বার্থে কবি দেশের উৎপাদিত পদার্থই ব্যবহার করতে বলেন৷ ১৯০৬ সালে কৃষিবিদ্যা ও গোষ্ঠ বিদ্যা শেখাতে পুত্র রথীন্দ্রনাথ ও বন্ধু সন্তোষ চন্দ্র মজুমদারকে আমেরিকা পাঠান, উদ্দেশ্য গোপালন ও দুগ্ধ শিল্পকে মজবুত করে গড়ে তোলা। পরের বছর মীরাকে বিয়ে দিয়ে জামাতা নগেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলীকেও কৃষিবিদ্যা পড়ার জন্য পাঠান। ১৯০৯ সালে রথীন্দ্রনাথরা বিদেশ থেকে ফিরে কবির তত্ত্বাবধানে শুরু করেন বৈজ্ঞানিক প্রথায় চাষ, সার, পাম্প ইত্যাদির ব্যবহার। কৃষি বাড়ি সংলগ্ন আশি বিঘা খাস জমিতে চালু হয় সুদূর ভবিষ্যৎ মুখী কৃষি গবেষণাগার। ভাবলে বিস্মিত হতে হয় যে জমিদারী এস্টেটকে ওয়েলফেয়ার এস্টেটে রূপান্তরিত করতে পেরেছিলেন কর্মযোগীর মত। কবিবন্ধু এলমহার্স্ট কৃষি বিষয়ক বহু গ্রন্থ, যন্ত্র-সরঞ্জাম ও অর্থ নিয়ে শ্রীনিকেতনে এসে পল্লী উন্নয়ন পরিকল্পনাকে গতি দেন। সুরুল গ্রাম পুনর্গঠন কেন্দ্রের নাম হয় ‘স্কুল অফ এগ্রিকালচার’। রবীন্দ্রনাথকে চ্যান্সেলর করে এলমহার্স্ট, সন্তোষচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ ও গৌর গোপালকে নিয়ে কর্ম সমিতি তৈরি হয়। ঐসময়ে নতুন ‘ইন্ডিয়ান অ্যাক্ট’ অনুযায়ী গ্রামে যে পঞ্চায়েত গঠিত হয়েছে তার দ্বারা গ্রামের কতটা উন্নতি হবে এ বিষয়ে সন্দিহান ছিলেন কবি। তাই ঐ পঞ্চায়েত শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শান্তি রক্ষা ও কর আদায়ের দায়িত্ব পেলেও রবীন্দ্রনাথ নিজেদের নির্দিষ্ট এলাকার প্রায় স্বয়ম্ভর গ্রাম পরিকল্পনার কাজে আত্মনিয়োগ করেন, গড়ে তোলেন পল্লি সমিতি। পল্লীর মানুষের নানা অর্থনৈতিক প্রয়োজন পূরণকল্পে সমবায় ব্যাঙ্ক এবং বিপর্যয় কিংবা প্রয়োজন ভিত্তিতে তাদের কৃষিঋণ দেওয়ার জন্য কো-অপারেটিভ লোন সোসাইটি স্থাপন করেন। ইতিমধ্যে মিতব্যয়িতা, সংঘকর্ম ও সঞ্চয় অভ্যাস শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। টাকায়, মনে, শিক্ষায় একজোট হয়ে জীবন ও জীবিকানির্বাহ করার যে উপায় ‘কো-অপারেটিভ’ প্রণালী বলে পরিচিত, ‘সমবায়’ শক্তি বলতে কবি তা’ই বুঝিয়েছেন।

স্বাস্থ্য, শিক্ষা পরিবেশ সচেতনতা:দেশের অন্যতম প্রধান কাজ গ্রামে গ্রামে স্বাস্থ্য ফিরিয়ে আনা, তা করতে গিয়েও সমষ্টিগত প্রচেষ্টায় সেই মিলিত হবার আনন্দকে বৃত্তের কেন্দ্র করছেন। প্রসঙ্গক্রমে ‘সমবায়ে ম্যালেরিয়া নিবারণ’ প্রবন্ধে ডাক্তার গোপাল চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সহযোগিতায় বঙ্গে যে রোগের প্রাদুর্ভাবে একসময়ে গ্রামকে গ্রাম উজাড় হয়ে যেত, তা নির্মূল করার কথা উল্লেখ করেন- “গোপালবাবু যে ব্যবস্থা করেছেন, যাকে পল্লীসেবা বলা হয়েছে, তার অর্থ তোমরা একত্র সমবেত হয়ে তোমাদের নিজের চেষ্টায় তোমাদের দুঃখ দূর করো।”  লক্ষণীয়, ম্যালেরিয়া নিবারণী কর্মদ্যোগ গ্রহণে আহ্বান জানিয়ে আসলে বিদ্বান মূর্খ সকলের মিলিত হওয়ার এক সহজ ক্ষেত্র তৈরি করতে চেয়েছেন। ইউরোপ ঘুরে দেখেছিলেন সেখানকার গ্রাম আর শহরের মধ্যে শিক্ষাগত অদ্ভুত ও প্রকট প্রভেদ নেই। সেখানে গ্রামবাসীরা  নিজেদের মনের স্বাস্থ্যকর পুষ্টি সম্পর্কে সচেতন থাকে; যোগ্যতা থাকলে তাদের কর্মসংস্থানের অভাব হয়না। কিন্তু নিজের দেশের পল্লী আর শহরে জ্ঞানের পার্থক্য দেখে ব্যথিত হয়েছিলেন কবি। দরকার গণশিক্ষা, এর কানটি ধরে টানলেই পিছে পিছে আসে স্বাস্থ্যসচেতনতা, সাংস্কৃতিক ও আর্থিক স্বনির্ভরতা। এই শিক্ষা যেন ‘দান’ না হয়, বরং গ্রামবাসী আর শহুরে সবজান্তা শিক্ষকের মধ্যে যে যোজন দূরত্ব, তাকে নির্মূল করতেই এক সার্বিক মিলনক্ষেত্রের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি বাংলার জলকষ্ট বিষয়ে বিশেষত মেয়েদের যন্ত্রণা অনুভব করেছিলেন, যেহেতু ঘর-গেরস্থালি, রান্না, খাবার খাওয়ানো মেয়েদের দায়িত্বে। গ্রামবাংলা ভোগে হয় জলের অভাবে নয় বাহুল্যে। তার প্রধান কারণ পলি ও পাঁকে নদীগর্ভ আর জলাশয়তল বহু কাল থেকে অবরুদ্ধ আর অগভীর হয়ে পড়ে থাকে। বিশ্বভারতীর সেবাব্রতী গণের মধ্যে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের নাম উল্লেখ করে বলেছেন যে তিনি পাঁক তুলে বহু জলাশয় পুনরুদ্ধার করেছিলেন। কার্যত গ্রামবাসীদের মধ্যে কৃষিপ্রধান ও রোগমুক্ত পল্লী পুনর্গঠনে পরিষ্কার জলের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করতে কম চেষ্টা চালাননি কবি নিজে ও তাঁর সহকারীবৃন্দ। কূপ খনন, নলকূপ স্থাপন, নতুন পুকুর খনন ও পুরনো পুকুর সংস্কার করে গেছেন বিভিন্ন সময়ে। শ্রীনিকেতনে ছাত্রদের খাবার ঘর ও রান্নাঘরে বর্জ্য দূষণ আর জল দূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে পাকা ড্রেনের নকশা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ এন্ড্রুজের সঙ্গে বিজ্ঞানসম্মত পর্যালোচনা চালিয়েছিলেন। স্নানের জল নষ্ট না করে আশ্রমের সব্জির বাগানে পাইপলাইনে নিয়ে আসা হতো। বলা বাহুল্য এই বাগান থেকেই আশ্রমের রান্নাঘরের খাদ্য আসত। জলের এই ‘রি-সাইকেলিং’ পদ্ধতি গুরুত্বপূর্ণ। নিজে হোমিওপ্যাথি ও আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা রীতিমতো অভ্যাস করেছেন। এও বলছেন যে কৃষি থেকে প্রকৃতির সঙ্গে সখ্যতা, সেখান থেকে জনসমবায় এবং ধর্ম ও ঐক্যবন্ধনে বাঁধা যে পল্লীপ্রকৃতি, সময়ের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তাকেও শিখতে হবে যন্ত্রবিদ্যা। তবে হয়ে উঠবেনা যন্ত্রসর্বস্ব, বরং সনাতন জ্ঞানের সঙ্গে আধুনিক যন্ত্রের (মানবকল্যাণের অনুকূল যন্ত্র) জ্ঞানও এসে মিশবে, ছুটবে উন্নয়নের রাজরথ- এমন স্বপ্নই ছিল কবির। নববাবুদের নাগরিক উন্নাসিকতা দিয়ে যে গ্রামের তথা দেশের উন্নতি হবে না একথা মানতেন রবীন্দ্রনাথ। ‘হলকর্ষণ’ ও ‘অরণ্যদেবতা’ প্রবন্ধে বলছেন সুস্থ প্রতিবেশ, বাস্তুতন্ত্র নির্মাণের কথা। নিজেদের খিদে মেটাতে বসুধার প্রাণরস সিঞ্চন করে মাটিতে হলকর্ষণ করে যে ফসল আদায় করি, তার বিনিময়ে বৃক্ষরোপণ করে মাটিকেও যেন কিছু ফিরিয়ে দিই- এ শিক্ষা চিরন্তনী। কার্যত পল্লীর উন্নয়নপন্থায় কল্যাণকারী অরণ্যের ক্ষতি না করে তার সঙ্গে সহনশীল পারস্পরিক সহাবস্থানের কথা সর্বত্র ব্যক্ত হয়েছে। সমাজ-অর্থনীতি কেন্দ্রিক পরিবেশভাবনা এখানে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হয়ে থেকেছে। এমনকি কথকতা, কীর্তন, যাত্রাপালা প্রভৃতির মধ্য দিয়ে পল্লীর যে নিজস্ব সংস্কৃতির ধারাটি প্রবাহিত, ইউরোসেন্ট্রিক কালচারের দুনিয়ায় তাকে বাংলার নিজস্ব মেরুদন্ড হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন কবি। বহুজাতিক সংস্থা ও বিশ্ব বাণিজ্যের ব্যবস্থার দ্বারা যখন আমাদের বাণিজ্য ও কৃষি, নগর ও গ্রাম সার্বিকভাবে আক্রান্ত তখন এই পল্লী উন্নয়ন চিন্তার চর্চা আমাদের নতুন এক পথ দেখাতে পারে বলে মনে হয়। কৃষি-সমবায়, শিক্ষা-সমবায়, স্বাস্থ্য-সমবায় ও শিল্প-সমবায়ের আন্দোলনকে পরিব্যাপ্ত রূপ দিয়ে তার প্রধান অবলম্বন রূপে গ্রাম-মন্ডলী গঠনের যে মডেল তিনি উপস্থাপিত করেছিলেন, তা আজও শিক্ষণীয়। যে শ্রেষ্ঠত্বের দিকে লক্ষ্য রেখে চর্যার সামূহিক উত্তরোত্তর কর্ষণে সকল মানুষের জন্মগত অধিকার, সেই অধিকার যে পল্লীবাসীর উপরেও বর্তায়, এই বার্তাটি প্রায়োগিক ভাবেই ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এক অর্থে এই আলোচনা পল্লী আর পরিবেশ-প্রকৃতির স্বাধিকারের স্বার্থও ঘোষণা করে। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *