তুষার বরণ হালদার
লেখক পরিচিতি
(তুষার বরণ হালদার নদীয়ার আড়ংঘাটা গ্রাম থেকে স্কুল শিক্ষা শেষ করে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করেন। পি.এইচ.ডি. ডিগ্রি পান নদীয়া জেলার অসংগঠিত শিল্প ও শ্রমিকদের ওপর গবেষণা করে । গবেষণা কর্মের ওপর ভিত্তি করে দুটি বই এবং বিভিন্ন গ্রন্থ ও জার্নালে বহু প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদ কর্তৃক প্রদত্ত শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধের জন্য তিন বার পুরস্কৃত হন। এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য। বর্তমানে তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত দক্ষিণবঙ্গের একটি কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপক।)
স্বর্ণকুমারী দেবী (১৮৫৫-১৯৩২)
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চতুর্থ কন্যা, বাংলার সাহিত্যে ও সংস্কৃতিতে এক উজ্জ্বল তারকা স্বর্ণকুমারী দেবী আজ প্রায় বিস্মৃত এক নাম। কিন্তু ভারতবিদ্যাচর্চা তে তাঁর অবদান আলোচনা করলে বোঝা যাবে যে আজও তিনি কত প্রাসঙ্গিক। স্বর্ণকুমারীর জন্ম বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারে ১৮৫৫ সালে। স্বর্ণকুমারীর দাদা জ্যোতিরিন্দ্র নাথ তাঁর জীবনস্মৃতি তে বলেছেন, ” আমি সন্ধ্যাকালে সকলকে একত্র করিয়া ইংরেজী হইতে ভালো ভালো গল্প তর্জমা করিয়া শুনাইতাম – তাঁহারা সেগুলি বেশ উপভোগ করিতেন। ইহার অল্প দিন পর দেখা গেল আমার কনিষ্ঠা ভগিনী শ্রীমতী স্বর্ণকুমারী দেবী কতগুলি ছোটো ছোট গল্প রচনা করিয়াছেন। তিনি আমায় সেই গল্পগুলি শুনাইতেন। আমি তাহাকে খুব উৎসাহ দিতাম। …”
স্বর্ণকুমারীর স্বামী জানকীনাথ বিলেত গেলে তিনি ঠাকুর বাড়ীর পিত্রালয়েই থাকতেন। সেই সময় জ্যোতিদাদা পিয়ানোতে সুর তুলতেন, আর সেই সুরে গান গাইতেন স্বর্ণকুমারীর দেবী। ১৮৭৭ সালে ঠাকুর বাড়ীর ছত্রছায়ায় যে ‘ ভারতী ‘ পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল তার সম্পাদনা সহায়তা করেছিলেন স্বর্ণকুমারীর। পড়ে ভারতীর পূর্ন দ্বায়িত্ব তাঁর উপর এসে পড়ে। এরপর ১৮৮৪ থেকে ১৮৯৪ সাল পর্যন্ত তিনি সফল্যের সঙ্গে সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ভারতীর পৃষ্ঠায় স্বর্ণকুমারীর বহু গল্প, কবিতা, নাটক, উপন্যাস, প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। বাঙালী মহিলা সাহিত্যিকদের মধ্যে তিনিই উপন্যাস ও বিজ্ঞান বিষয়ক রচনার পথিকৃৎ ছিলেন। তাঁর রচিত গ্রন্থ গুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলো, ‘ দ্বীপ নির্বাণ ‘, ‘ ছিন্ন মুকুল ‘, ‘ মালতি ‘,’ স্নেহলতা ‘,’ ফুলের মালা’,’ বিজ্ঞান বিষয়ক নিবন্ধের মধ্যে ছিলো, ‘ পৃথিবী ‘,’ ঐতিহাসিক রচনার মধ্যে ছিলো, ‘ হুগলির ইমামবাড়া ‘,’ বিদ্রোহ ‘, রাজনৈতিক উপন্যাস ‘ মিবার রাজ ‘।
ইংরেজি সভ্যতা ও সাহিত্যের সাথে আমাদের যোগাযোগের পর বাংলার সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে যে নব জাগরণের সুচনা হয়েছিল তাতে দেশের মহিলা সমাজের মধ্যে অগ্রণী ছিলেন স্বর্ণকুমারী। তাঁর সাহিত্য চর্চার মধ্যে দিয়েই ব্যক্ত হয়েছিল ভারতবিদ্যার অনুষঙ্গ। সেই সূত্রেই ধরা পড়ে যে স্বদেশ প্রেমই ছিল তাঁর সাহিত্য সাধনার উৎস। সাহিত্য চর্চার পাশাপাশি তিনি জড়িত ছিলেন নানা সামাজিক কর্মকান্ডে। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘ সখী সমিতি ‘ ; এর দুটিই উদ্দেশ্য ছিলো: এক, বিধবা ও অনাথ বঙ্গললনাদের সাহায্য করা এবং দুই, তাঁদের শিক্ষার প্রাঙ্গণে নিয়ে আসা। শিল্পক্ষেত্রে নানান কাজ কর্মের মধ্যে তাঁদেরকে নিয়োজিত করতে তিনি সচেষ্ট ছিলেন। একথা বলা হয়তো অত্যুক্তি হবে না যে বঙ্গজাগরণের মূল স্রোতে বঙ্গরমনীদেরকে আনার ব্যাপারে তাঁর অবদান নি:সন্ধেহে অনস্বীকার্য।
তাঁর দীর্ঘ কর্মবহুল জীবনের অবসান ঘটে ১৯৩২ সালে। সাহিত্য ও সংস্কৃতির সব দিক নিয়ে আলোচনা করতে গেলে একথা বলা যেতেই পারে যে সে কালের নারী সমাজের সাহিত্য ও সংস্কৃতির কীর্তি বিষয়ে তিনি শুধুমাত্র অগ্রণীই ছিলেন না, ছিলেন শ্রেষ্ঠও। আসলে রবীন্দ্রনাথের প্রতিভার প্রখর দীপ্তির কাছে তাঁরই জেষ্ঠা ভগিনীর কীর্তি কিঞ্চিৎ ম্লান হয়ে পড়েছিল, তা অস্বীকার করা যায়না।