তাপস সরকার
লেখক পরিচিতি
( সৃজনশীল সাহিত্য কর্মে নিয়োজিত কিশোর বয়স থেকেই। প্রথম পঠিত গ্রন্থ রামায়ণ, মহাভারত ও গীতা। গদ্যসাহিত্য ও উপন্যাসেই সাবলীল। যদিও শতাধিক গল্প ও দশ-বারোটি উপন্যাসের রচয়িতা কিন্তু সেসব হারিয়ে গেছে অপ্রীতিকর কারণে। প্রিয় বিষয় মহাকাশবিদ্যা। কল্পবিজ্ঞান ও কিশোর সাহিত্য প্রিয় লেখা।কিছু গল্প নব্বইয়ের দশকে বাণিজ্যিক ও অবাণিজ্যিক পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত। উন্মীলন নামে প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকায় নিজের গল্প ও দুটি উপন্যাস ছাপা হলেও সেই উদ্যোগ থেমে যায়।প্রতিভাস সাহিত্য ম্যাগাজিন চলছে পনের বছর যা মায়ের নামে। সেখানে মায়ের উদ্দেশ্যে নিবেদিত লেখা স্মৃতিচিত্রণ ও বেশ কিছু ছোটগল্প। নব্বইয়ের দশকে কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে কিছুদিন লিটল ম্যাগাজিন গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত থেকে জেলায় জেলায় সাহিত্য আসরে ঘোরাঘুরি। বিশ্বকে নিজের ঘর বলে ভাবতে অভ্যস্ত। মায়ের মৃত্যুর পর অবসাদে দীর্ঘদিন লেখায় বিরত। তারপর আবার লেখা শুরু কিশোর সাহিত্য ‘গাছবাড়ির বাসিন্দা ‘ দিয়ে। পাঁচ বছরের প্রচেষ্টায় কোভিড পরিস্থিতিতে লেখা ইংরেজি ভাষায় ‘ইটস মাই আইল্যান্ড ‘ প্রকাশের অপেক্ষায়। স্বউদ্যোগে প্রকাশিত একমাত্র উপন্যাস ‘অন্তরালোকে ‘ নিজের জীবনের এক বিশেষ অধ্যায় ও মাকে নিয়ে লেখা। ভারতীয় প্রাচীন দর্শনের ওপর একনিষ্ঠ বিশ্বাস ও আধুনিক প্রযুক্তির ওপর বিরক্তি ‘অনন্ত জীবন ‘ উপন্যাসের পাতায় পাতায় প্রতিফলিত। পেশায় অর্থনীতি বিষয়ের অধ্যাপক। )
মূলাংশ
(মরজগতে মানুষ চলেছে অমরত্বের সন্ধানে। অনাদি অতীত থেকে তার এই যাত্রারম্ভ। অনন্ত জীবন তারই এক প্রকাশ। তাই অমৃতের অধিকার নিয়ে সুরাসুরে এত অশান্তি, কারণ অমৃত নাকি অমর করে। অমরত্বের ব্যাখ্যা আবার দ্বিধাবিভক্ত, দৈহিক অমরত্ব এবং আধ্যাত্মিক অমরত্ব। দানব ও সর্বসাধারণ বোঝে প্রথম মতবাদটিকেই। কোনটি সঠিক? সবাই ছোটবেলায় হারিয়ে যায় মানুষের মেলাতে, সেখানে সে বন্ধু খুঁজে পায় যাকে সে তাকে হাত বাড়িয়ে দেয়, বোঝাতে চায় মানুষ ও বিশ্বজগতের উদ্দেশ্যবিধেয়। যে তাকে চেনে সে বোঝে সব। শৈবাঙ্কন আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর সভ্যতাকে অস্বীকার করে চলে যায় স্পিতি ভ্যালিতে। সেখানে সে আবিষ্কার করে সর্বজনীন ভাষা যাতে বাক্যালাপ চালাতো সনাতন মুনি-ঋষিরা কীটপতঙ্গ, পাহাড়-পর্বত, নদী-জঙ্গল, পাথর-প্রান্তর এবং অদৃশ্য দেবতাদের সঙ্গে। স্পিতি ভ্যালির পটভূমিকায় স্পিতি নদী ও প্রাকৃতিক উপাদানসমূহ এবং মানুষের সঙ্গে কথোপকথনে সে খুঁজতে থাকে অনন্ত জীবন বা অমরত্ত্বের ব্যাখ্যা। কী পেল সে শেষ পর্যন্ত ? )
অধ্যায়: চোদ্দ
তাদের গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছিল স্পিতি নদীর চলন যেদিকে তার উল্টোমুখে। এই অঞ্চল নদীর ঊর্ধ্বগতির আওতায়, জাতীয় সড়ক পাঁচশ’ পাঁচের ডান দিক ধরে চলেছে প্রায় সমান্তরালে। কাজা থেকে নদী চলে গেছে রাস্তার ডানধারে, ব্রিজ পেরোতে হয় সেখানে। রাস্তা পিচ ঢালা হলেও ভাঙাচোরা, ক্রমাগত ধ্বস নেমে আর ভঙ্গুরতার জন্য।
‘তুমি স্পিতি নদীর সঙ্গে গল্প করতে করতে এসেছ এতটা পথ। নদীর সঙ্গে কী গল্প হল তোমার যদি বল জানার খুব ইচ্ছে।’
গেরহার্ট আগ্রহ প্রকাশ করল। তারও গবেষণার বিষয় অনন্ত জীবন নিয়ে জানার পর থেকে সে-ও বেশ উৎসাহিত হয়েছে। নদীর গল্প তাই তাকে জানাবার কোন অনিচ্ছে হলো না তার।
নদীর গল্প শোনাতে গেলে বলতে হয় সমগ্র শীতল পার্বত্য মরুভূমির কথা যার গোটাটাই স্পিতি অববাহিকা, যেখানে নদী রচনা করেছে হিমবাহ গলা জলে পুষ্ট উপত্যকা। নদীর গল্প মানে এই গোটা পথ পরিক্রমা। কুঞ্জুম লা থেকে বেরিয়ে নদী চলেছে বিনুনি পাকিয়ে, তারপর তার গতিপথ বহু বাঁকসম্পন্ন, গভীর খাদ ধরে এগিয়ে গেছে একসময়। তার নিম্নভূমি পাথুরে হ্রদের সঞ্চয়জাত পদার্থে পরিপূর্ণ, উচ্চগতিতে নদীজাত চত্বরের গা লক্ষণীয়, ধ্বংসস্তূপের গচ্ছিত বা জমা বস্তুসমষ্টির অবশিষ্টাংশে ভরা। উপত্যকার পর্বতগাত্রের দেয়ালেও দেখা যায় নদীজাত ভূমিধসের জমাবস্তু। নিম্নগতিতেই নদীপ্রবাহে বাঁকের আধিক্য যেখানে পাথরশয্যা কেটে গভীর গিরিখাদ বানিয়ে সে প্রবাহিত ক্ষীণ ধারায়। নদীর দু’ধারে বহু উপনদী ও নালা মূল নদীতে যুক্ত হয়েছে সমকোণে যা নদীর গতিপথে গাঠনিক নিয়ন্ত্রণের নির্দেশক এবং এটাই জানায় যে নব্যগাঠনিক ক্রিয়াকলাপ চলছে এখনও এই অস্থির উপত্যকার প্রাঙ্গণ জুড়ে। ভূমিধস বা ভূমিকম্প তারই প্রমাণ।
‘নদী তোমাকে অনন্ত জীবন সম্পর্কে কী জানিয়েছে ?’
গেরহার্টের প্রশ্নের উত্তরে সে বলল,
‘নদী বলেছে অনন্ত জীবন মানে হল কেবলই এগিয়ে যাওয়া।’
‘ওটাই আসল কথা, কারণ এগিয়ে যাওয়ার কোন অন্ত নেই। যে কোন বিষয়কে কেন্দ্র করেই এগিয়ে চলা যায় যত খুশি।’
নদীর গল্প বলতে বোঝায় নদী-অববাহিকা, নদী-উপত্যকার পরিচয়। স্পিতি শুষ্ক পাথুরে মালভূমি ধরে এগিয়ে চলেছে, নদী বরাবর বিশাল সমস্ত পাথরের খন্ডাকার শঙ্কু আকৃতির গঠন, পাললিক শিলা দিয়ে গড়া বড় বড় পাখা, গভীর গিরিখাত, ঝুলন্ত পাথরের আচ্ছাদন, জীবাশ্মের ভান্ডার এবং এ সমস্তই উপত্যকার মূল বৈশিষ্ট্য। প্রশস্ত চত্বর জুড়ে ভূবৈচিত্র্যে পলি জমে পাথর হয়ে পাখনা মেলা, নদীজাত অবশেষ থেকে গঠিত হ্রদের খাত। পাললিক নিদর্শন জলে পরিবর্তন ঘটায় দ্রবীভূত হয়ে। নদী ও সংশ্লিষ্ট এলাকার নব্যগাঠনিক সক্রিয়তা বোঝা যায় বৃষ্টিপাত সম্পর্কিত জলবিজ্ঞানে। এসব তার গল্পের অংশবিশেষ। নদীজাত চত্বরের নানাস্তরে দেখা যায় হ্রদজাত জমাবস্তুর অবশেষ যাতে আছে হালকা বর্ণের পলিমাটি, পলিসমৃদ্ধ ও ধূসর কাদাযুক্ত সমান্তরাল স্তরসমূহ যা এক চরিত্র থেকে অন্য চরিত্রে পাল্টে যেতে থাকে।
নদীকে সে দেখেছে তার এইসব সামগ্রিকতাকে নিয়ে, নদীর শয্যা বিচ্যুতিজাত ও ভাঁজযুক্ত যেখানে ওইসব সমান্তরাল স্তরের কোন কোন অংশে রয়েছে ভূকম্পজনিত বিকৃতি। রয়েছে বালির বাঁধ ছদ্মবেশী পিণ্ড বা ডেলা হয়ে। প্রাকৃতিক ও পাললিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নদীর অববাহিকা চার পর্যায়ের।প্রশস্ত উপত্যকা জুড়ে বেণীপাকানো নদীখাত একটি ধরন। কুঞ্জুম লা থেকে বেরিয়ে অন্য উপনদীদের যুক্ত করে তৈরি এই অঞ্চল দু’ থেকে তিন কিলোমিটার চওড়া। চুলের বিনুনি সদৃশ তার গঠন এখানে এবং রয়েছে পাথুরে হ্রদের অবশেষ। দ্বিতীয় ধরনটি নিম্নগতিতে দেখা যায় যেখানে নদী খাত বাঁকে বাঁকে বয়ে চলেছে সংকীর্ণ গিরিখাত ধরে। অন্য ধরন দু’টির একটি হচ্ছে প্রাচীন হ্রদজাত প্রস্তুরীভূত পলি বা পাললিক শিলা এবং অন্যটি নদীজাত জমা অবশেষ। উপত্যকার পাহাড়ি দেয়ালে নিম্নগতিতে দেখা যাবে মিহি পলিজ ঢাকনা আর দিগন্ত জুড়ে বিছিয়ে থাকা বোল্ডার। পলির স্তর চার ফিট পর্যন্ত পুরু এবং নদীখাত থেকে ষাট-সত্তর ফিট ওপরেও রয়েছে। পলিশয্যাতে আছে প্রশস্ত পার্শ্বীয় ও উল্লম্ব বিস্তার। পাহাড়ি দেয়ালের গা থেকে খসে পড়া শিলাখণ্ড ও ধ্বংসস্তূপ জমে রয়েছে স্থানে স্থানে। কাজা অঞ্চলে উপত্যকা বেশি চওড়া, তারপর যত এগিয়ে গেছে ক্রমশ সঙ্কীর্ণ হয়ে চলেছে।
পোহ্ থেকে চলনের পর খাব অঞ্চলে নিজেকে শতদ্রুর বুকে সমর্পণের আগে পর্যন্ত নদী উপত্যকা দশ-বিশ ফিটও চওড়া নয় অঞ্চলবিশেষে। ঝুলন্ত খাত বাঁকে ভরা, ভূমিধসের কারণে ধ্বংসস্তূপ জমে রয়েছে স্থানে স্থানে। এখানেই নদীর নিম্নগতি। পাড়ে রয়েছে স্তরযুক্ত ঢাকনা যার ওপর অন্তত বারো ফিট হ্রদসৃষ্ট কাদার জমাট বস্তু। সুমদো এলাকা পর্যন্ত অত্যন্ত সংকীর্ণ উপত্যকায় নদী চলেছে পাথর কেটে খরস্রোতে। নব্যগাঠনিক অস্থিরতার প্রমাণ রয়েছে অববাহিকার সর্বাংশে যা সামগ্রিকভাবে হেলানো। এই সমস্ত চরিত্র নিয়েই রচিত হয়েছে নদীর গল্প।
অনন্ত প্রবাহ নদীর, কুঞ্জুম লা থেকে জন্ম নিয়ে চিরস্থায়ী হিমবাহের কল্যাণে সে পেয়েছে অফুরন্ত জল। এখানে তার যে কাহিনী উপত্যকা জুড়ে বর্ণিত হয়ে চলেছে চলনে-বলনে তাতেও দেখা যায় অনন্ত জীবনেরই স্রোত, হাজার হাজার বছরের পুরনো সমস্ত জনপদে আর বৌদ্ধ গুম্ফাতে। সেই অর্থে গৌতম বুদ্ধ গত হলেও তাঁর ধর্মমত অমর হয়ে রয়েছে এবং থাকবে। অনন্ত জীবনকে এই ধার্মিক আবহের প্রেক্ষিতেও উপলব্ধি করা যায়, যার ঘোষণা আপন প্রবাহের আঙ্গিকে জানিয়ে চলেছে স্পিতি নদী হাজার হাজার বছর ধরেই। এর পরেও অনন্ত জীবনকে না বোঝার কোন কারণ থাকতে পারে না, বোঝে না সেজন যে মোহাচ্ছন্ন থেকে দানবিক মনোভাবাপন্ন। এগিয়ে চলার যেমন কোন অন্ত নেই, অবিশ্রাম জলপ্রবাহেরও অন্ত খুঁজে পাওয়া যায় না। মানুষের ইচ্ছের মতোই সমস্ত কিছু অনন্ত যাত্রায় সামিল। সীমায়িত পরিসরেও অন্তহীন। গ্রীষ্মকালে জলপ্রবাহ বেড়ে যায় নদীর, হিমবাহগুলি উত্তাপে গলে জল ঢালে যত পারে, অন্য সময় প্রবাহ ক্ষীণ এবং শীতে জমাট বেঁধে যায়। বৃষ্টিচ্ছায় শুকনো শীতল মরু পর্বতকে প্রাণবন্ত করে রেখেছে স্পিতি সযত্নে যুগ যুগ ধরে। কুঞ্জম রেঞ্জ থেকে বেরিয়ে শতদ্রুতে গা ঢালার আগে পর্যন্ত দু’ধারে বহু উপনদী এসে তাকে আরো প্রাণবন্ত করে রেখেছে। পিন ভ্যালি থেকে সমস্ত জল বয়ে এনে পিন উপনদী তার সঙ্গে সমকৌণিকভাবে মিলেছে ডানধারে।সেই একই ধারে অন্য আরও উপনদীগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য চিওমো, গিয়ুন্ডি, রাহটাং, উলাহ্, লুংজা, পোমোগ্র্যাঙ, মামড্যাং ইত্যাদি। বামধারেও রয়েছে এমনই অনেক উপনদী। এদের নাম থামার, হানসে, থুমনা, তাগতিং, থুরপা, লুমোয়া, সিলা, কাজা, লিংতি, পোহ্, তাবো, কারাতি, গিমদো, পারেচু প্রমূখ। মালভূমির বুকে কঠিন পাথর কেটে এইসব উপনদী বয়ে আনছে অবিরাম ধারায় হিমবাহ গলা জল। এত জল বইতে গিয়ে স্পিতির কূল ছাপিয়ে যায়, সে আরও খরস্রোতা হয়ে ওঠে। এত তীব্র জলপ্রবাহ তাই নদীর বুকে কোন জৈবকণা জমতে দেয় না, শিলারাশিও উৎক্ষিপ্ত হয়ে যেতে থাকে, তলদেশে তাই কেবল কঠিন পাথরের শয্যা। প্রচণ্ড খরস্রোত বলে জৈবকণা তো বটেই অন্য কোন বস্তুও জমে থাকে না নদীর বুকে। নদীর জলে তাই মাছ বা অন্য জলজ প্রাণি থাকার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তবুও কিছু প্রজাতির মাছ পরিযায়ী হয়ে উজিয়ে আসে নিম্নধারা থেকে বিশেষত বর্ষাকালে বংশবিস্তারের জন্য। এদের মধ্যে প্রধান হল স্নো ট্রাউট মাছ। উপত্যকায় জেলে সম্প্রদায়ের কেউ না থাকলেও বাইরে থেকে আসা ক্ষণস্থায়ী শ্রমিকের দল বঁড়শি বা জাল ফেলে সেসব মাছ ধরে খায়।
এ সমস্ত কিছুই হল স্পিতি নদীর গল্প যাকে সে দিনের পর দিন ধরে দেখেছে উপত্যকায় থাকার সুবাদে।এই গল্প দেখারও কোন অন্ত নেই, শুরু হয়তো আছে এই অর্থে যেদিন থেকে দেখার সূত্রপাত। মোটকথা এই যে নদী তার গল্প অন্তহীন ধারায় শুনিয়ে চলেছে সতত সঞ্চরণশীল থেকে। হয়তো শীতকালে বুকের জল জমাট বেঁধে বরফ হয়ে যাওয়ার কারণে প্রবাহের গল্প থেমে থাকে কিছুকাল, কিন্তু নদী যেহেতু বিলুপ্ত হয় না তার গল্পও বজায় থাকে অন্য আঙ্গিকে। দু’ধারে ক্ষণস্থায়ী হিমবাহ জন্ম নিয়ে বানিয়ে দেয় অন্য গল্প। থাকে প্রবল শৈত্যপ্রবাহ আর বরফপাত। সেই অপরূপ রূপকথাও কম আকর্ষণীয় নয় যদিও সাধারণ মানুষেরা তখন আর আসে না সেখানে ওইরকম রূপ উপভোগ করার টানে।
পর্যটকদের গাড়ি এগিয়ে চলছিল জাতীয় সড়ক ধরে কুঞ্জুম গিরিদ্বার অভিমুখে। নামেই অবশ্য জাতীয় সড়ক, ক্রমাগত ধস নেমে আর ভূখণ্ডের ভঙ্গুর চরিত্রের কারণে তাকে নিজস্ব চরিত্র বজায় রাখতে দেয় না। যদিও রাস্তা মেরামত করার কাজ চলতেই থাকে নিরলসভাবে। সবাই মিলে আলোচনা করে ঠিক হল যে আজই কুঞ্জুম গিরিদ্বারে যাওয়ার দরকার নেই, কারণ যেতে যেতে বিকেল হয়ে যেতেও পারে। এদিক থেকে রাস্তা যতটা মন্থরভাবে খাড়াই হয়েছে লাহুলের দিকটাতে মোটেই তেমন নয়। বাত্তাল পর্যন্ত ন’ কিলোমিটার রাস্তা হঠাৎ নেমে গেছে অনেকটাই যেখানে আছে পনেরোটি কঠিন বাঁক। সে পথে বিকেলের পর না যাওয়াই ভালো, বিশেষত অনবরত জলধারা বয়ে চলেছে স্থানে স্থানে রাস্তার ওপর দিয়ে। পাগলা ঝোড়া বলে একটি প্রবাহ তো বলতে গেলে নদীর মতোই প্রবল এবং দুপুরের পর থেকে জলপ্রবাহ ভয়ানক আকার ধারণ করে। সবাই মিলে তাই ঠিক করল যে আজ রাতটা লোসার গ্রামে থেকে কাল ভোর ভোর রওনা দিয়ে গিরিদ্বারে পৌঁছনোই যুক্তিযুক্ত হবে।
চলতি পথে তার সঙ্গে গেরহার্টের কথাবার্তা হচ্ছিল অনন্ত জীবন নিয়ে। সে জিজ্ঞেস করল,
‘তুমি কি বিশ্বাস কর মানুষ অনন্ত জীবনের অধিকারী হতে পারে ?’
‘নিশ্চয় পারে।’ জার্মান পর্যটক জানাতে লাগল, ‘আমার গবেষণার সূত্রে আমি বলতে পারি, প্রত্যেকটি মানুষই অনন্ত জীবন পেয়ে থাকে। তোমাদের দর্শনে তাই বলা হয়, মানুষ অমৃতস্য পুত্রা। অমৃতের অধিকার রয়েছে মানুষেরই হাতে, তুমি তা কাজে লাগাতে পারো কিনা সেটা তোমার ব্যাপার।’
‘অনন্ত জীবন অন্যকথায় অমরত্বকে বোঝায়। তার কি কোন সময়সীমা আছে ? বিজ্ঞান আর দর্শন দেখেছি ভিন্ন কথা বলে।’
‘ভিন্ন নয়, দু’টোরই বক্তব্য এক। বিজ্ঞানকে বাদ দিয়ে যেমন দর্শন হয় না, তেমনি দর্শন ছাড়াও বিজ্ঞান অচল। প্রশ্ন হল কোন্ দর্শন বা দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তুমি বিজ্ঞানকে বিচার করছ বা দেখতে চাইছ। তুমি যে ভিন্ন বক্তব্যের কথা বলছ সেটা দেখতে পাবে যদি আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিষয়টাকে ব্যাখ্যা করতে চাও। তাহলে অমরত্বের সংজ্ঞা পাবে একেবারেই অন্যরকম। তাতে অমরত্ব মানে সময়ের সাপেক্ষে তোমার চলাচল থেমে যাওয়া, মানুষের স্বাভাবিক বৃদ্ধি সেখানে একই বিন্দুতে দাঁড়িয়ে থাকবে, তুমি কোনোদিনও বার্ধক্যে উপনীত হবে না। ইচ্ছে অনুযায়ী তোমার অবস্থান হবে চিরশৈশবে বা চিরযুবা হিসেবে।’
‘সময় এগিয়ে যাবে অথচ আমি থেমে থাকব জীবনের এক বিন্দুতে। এটা কতটা বাস্তব বা গ্রহণযোগ্য ? প্রকৃতির কোথাও এই নিয়ম চলে বলে তুমি জানো কি ?’
‘জানিনা। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে কোন অস্তিত্ব সময় নিরপেক্ষ হয়ে থাকতে পারে কতদিন আমার ধারণায় নেই। শুনেছি এমন ঘটনা ব্ল্যাক হোলগুলিতে হলেও হতে পারে। কিন্তু সে তো অন্য মাত্রাধীন ঘটনা।’
‘অন্য মাত্রাধীন কোন বিশ্ব আছে কিনা বা থাকলেও সেখানে কী ঘটছে তা জানার কোন আগ্রহ নেই আমার।’
‘সুযোগও নেই। মাল্টিভার্স তত্ত্ব একটা ধারণামাত্র।’
পিছন থেকে জানাল সাইমন। সে বলল,
‘ঠিক। আমি যা দেখছি তা সবই আমার চলতি বিশ্বের সাপেক্ষে। আমি যে অমরত্বের কথা ভাবছি তাও এই বিশ্বকে ভিত্তি করেই। এখানে কোন বস্তুর জীবনকাল সময়ের সাপেক্ষে বিচার না করে উপায় নেই। কতকাল কোন বস্তু টিকে থাকলে তাকে তার অমরত্ব বলা যেতে পারে, এই প্রশ্নটাই বিবেচ্য।’
‘এ বড়োই জটিল প্রশ্ন। এর কোন উত্তর আমার জানা নেই। তবে আমি বুঝি, অমরত্ব মানে জীবনকাল দীর্ঘায়িত হবে ভাবনাটা পাগলামি। অমরত্ব বল বা অনন্ত জীবন, তা তোমার যতটা জীবনকাল সেই পরিসরের মধ্যেই তুমি আয়ত্তে পেতে পার। আমি জানি, অনন্ত জীবন মানে জীবনের অনন্ত বিকাশ ও অনন্ত প্রকাশ। কোন এক মানুষ তার দশ বছরের জীবনকালে যা করতে পারে অন্য অনেকেই হয়তো তাদের পঞ্চাশ বা একশ’ বছরের জীবনকালেও তার এক শতাংশ করতে পারে না। সেই অর্থে অনন্ত জীবনকে তুমি মানুষের জীবনে প্রাপ্ত সাফল্যকে দিয়েও বিচার করতে পার। যে জীবনে যত সফল সে তত অনন্তকে মুঠোয় পাবে যত ক্ষুদ্র হোকনা কেন তার জীবনকাল। সাফল্য ও শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন মানুষকে অমর করে রাখে। অবশ্য তারও সময়সীমা নির্দিষ্ট হতে বাধ্য। মনে কর, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, মানুষ তাঁকে আজও মনে রেখেছে, মনে রাখবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মও। কিন্তু যদি মানুষের সভ্যতা কোন কারণে বিলুপ্ত হয়ে যায় আর হারিয়ে যায় মানুষের সব নিশানা তো ভিঞ্চির নামও কি মুছে যাবে না ?’
‘তার মানে যতই দীর্ঘ হোক জীবনকাল, অমরত্বের সীমানা থাকতে বাধ্য। আর মানুষের সভ্যতায় মানুষ অমর হতে পারবে যদি সভ্যতা টিকে থাকে।’
‘সেটাই প্রথম কথা। আমি তাই অনন্ত জীবনকে অন্য এক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করে থাকি। তোমাকে তার কথা বলতে পারি। হয়তো তুমিও একমত হবে। জীবনকে তুমি ভাবতে পার ঘটনার সাপেক্ষে। প্রত্যেক মানুষের জীবন হল অজস্র ঘটনার সমাহার। তার কোন অন্ত নেই। গোটা জীবনকে দেখার দরকার নেই, জীবনের এক ক্ষুদ্র সময়কে দেখ। ধর, এক মিনিট। কোন মানুষ তার জীবনের কোন এক মিনিট সময়ে অনন্ত ঘটনা ঘটতে দেখে, জ্ঞাত বা অজ্ঞাতভাবে। সারা পৃথিবী জুড়ে কোটি কোটি মানুষ, তাদের প্রত্যেকের জীবনে কোন এক মিনিটে ঘটে কোটি কোটি ঘটনা। তাহলে কোন একজন মানুষ সেই মিনিটে সেইসব কোটি কোটি ঘটনাকে সরাসরি প্রত্যক্ষ না করতে পারলেও পরোক্ষভাবে তাদের সঙ্গে যুক্ত থাকতে বাধ্য যেহেতু প্রত্যেকটি মানুষই সমাজের বা এই অখণ্ড ঘটনামাধ্যমের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। সেই অর্থে প্রতিটি মানুষের জীবনে জড়িয়ে থাকছে অনন্ত ঘটনা, প্রতি মিনিটে। গোটা জীবনকে ভেবে দেখ তাহলে, ঘটনা কত পরিমাণে অনন্ত হয়ে যায় প্রত্যেকের জীবনে। সেইসব ঘটনা দিয়ে সাজাও তোমার জীবন, তুমি অনন্তকে পেয়ে যাবে হাতের নাগালে। মানুষ এই অর্থে অনন্ত জীবনের অধিকারী বলে আমি মনে করি। জীবনের এক ক্ষুদ্র পরিসরে এভাবে যে অনন্তের সন্ধান পেলাম আমি তা আমার জীবনকে অনাদি কালের আয়তনে পৌঁছে দেবে অবশ্যই। আমি অনাদিকাল বেঁচে থাকব না ঠিক, কিন্তু যে অনন্ত ঘটনা আমার জীবনকালে ঘটবে আমার জন্য, সেসব অনন্ত ঘটনার সঙ্গে আমি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত হয়ে যেতে থাকব, তারা আমাকে অনন্ত জীবন দিয়ে দেবে। আমার ক্ষুদ্র পরিসরের জীবনে এভাবেই দেখা যাবে অনন্তের বিকাশ ও প্রকাশ। আমার ধারণায় এটাই হল অনন্ত জীবনের যথার্থ ব্যাখ্যা।’
এই ব্যাখ্যা মেনে নেওয়ার ক্ষেত্রে কোন সমস্যা তার নজরে এলো না। প্রকৃতই প্রত্যেকের জীবন গঠিত অনন্ত ঘটনাসমূহের সমন্বয়ে। জীবনের পরিসর যেটুকুই হোক না কেন সেখানেই অনন্তের সন্ধান পাওয়া সম্ভব। এভাবে অনন্তকে উপলব্ধি করতে পারে যেজন তার কাছে জীবন অনন্ত অবশ্যই। আমি হাজার হাজার বছর বেঁচে না থাকলেও কোটি কোটি ঘটনা ঘটে গেল আমার যে জীবনে তাকে অনন্ত বলে কেন ভাবব না আমি ? তার মনে হল, গেরহার্টের এই ব্যাখ্যা খুবই যুক্তিযুক্ত। আর একটু আগে সাফল্যের সাপেক্ষে অনন্ত জীবনের যে ব্যাখ্যা দিয়েছিল সে তাকেও গ্রহণযোগ্য বলেই মনে হল। জীবনকে তুমি কোন্ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছ সেখানেই রয়েছে তুমি অনন্ত জীবন পেলে কি পেলে না তার জবাব। তোমার বয়স না বেড়ে গেলে অথবা স্বাভাবিক বৃদ্ধি না থেমে গেলেও তুমি অনন্ত জীবনকে করায়ত্ত করতে পারবে যদি তুমি খুঁজে পাও জীবনের অনন্ত বিকাশকে বা অনন্ত প্রকাশকে। তার মনে হল, এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী জীবন অনন্ত হতে পারে আরও বহু বহু বিষয়ের সাপেক্ষে। তাদের মধ্যে অবশ্যই একটি হবে অনন্ত চাহিদা। প্রত্যেকের জীবনেই রয়েছে এই বিষয় এবং পূর্ণ হোক বা অপূর্ণ থাকুক, জীবনের সমস্ত চাহিদাসমূহের ভিত্তিতে বিচার করলেও অনন্তকে দেখতে পাবে যে কেউ তার জীবনে। এছাড়াও মানুষের জীবন গঠিত অনন্ত কাজকর্ম, অনন্ত আবেগ, অনন্ত মেলামেশা, অনন্ত জ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ের সমন্বয়ে। এই সমস্ত বিষয়ের ভিত্তিতেও জীবনকে অনন্ত বলে ভাবা যেতেই পারে যত ক্ষুদ্র হোক না কেন জীবনকাল। তাছাড়াও আছে প্রতিটি মানুষের জন্যই অন্যান্য মানুষ ও বস্তু বা বিষয়সমূহের সঙ্গে অনন্ত সম্পর্ক। এর ভিত্তিতেও বলা যেতে পারে যে একজন মানুষ অনন্ত জীবনের অধিকারী। অনন্ত জীবনের ধারণাতে যে এতো বৈচিত্র্য রয়েছে সে এতদিন একা ভেবে বুঝতে পারেনি। সেদিক থেকে গেরহার্টের সঙ্গে এই যে দেখা সেটা সত্যি উপকারে লাগল।
লোসার গ্রামে যেতে যেতে বিকেল হয়ে এলো। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এই অঞ্চলটির উচ্চতা প্রায় তেরো হাজার ফিট। এখান থেকে কুঞ্জুম পাসের দূরত্ব পনের থেকে আঠেরো কিলোমিটারের মধ্যে এবং এই দূরত্ব উঠে গেছে আরও প্রায় দু’হাজার ফিট ক্রমান্বয়ে। গ্রামে ঢোকার মুখে লোসার এবং পিনো ঝরনাদু’টি মিলিত হয়েছে, ওপর দিয়ে রয়েছে ব্রিজ। রাত্রিটা তারা সেখানেই কাটাল। সঙ্গে তাদের খাবার-দাবার ছিল যথেষ্টই, তবে খাবারের দোকান পেয়ে গেল তারা। পরদিন সকাল-সকাল উঠেই যাত্রা শুরু হল কুঞ্জুম গিরিদ্বার অভিমুখে। পথ ক্রমশ উঠে যাচ্ছিল ঘুরে ঘুরে। ধূ-ধূ মরুপ্রান্তরের মধ্যে দিয়ে পথ, ডানধারে ছিল স্পিতির একটি উপনদী। গতিবেগ তেমন ছিল না গাড়ির, তবুও কুড়ি-পঁচিশ মিনিটের মধ্যেই কুঞ্জুম গিরিদ্বারে পৌঁছে গেল তারা। এখানে রাস্তা বলে নেই কিছু তেমন, অনেকটা প্রায় মেঠো পথের মত অবস্থা, তাও আবার ভাঙাচোরা। বরফের চাঙড় পড়ে আছে স্থানে স্থানে। তিব্বতীয় বৌদ্ধ পতাকা সারি সারি ঝুলছে গিরিদ্বারে সর্বত্র রঙিন শোভা হয়ে। আর রয়েছে সেখানে কুঞ্জুম মাতার মন্দির, দেবী দুর্গারই এক বিশেষ রূপ। তাদের গাড়ির ড্রাইভার মায়ের মন্দিরে গিয়ে পুজো দিল, কারণ এই দুর্গম পথের যাত্রায় মায়ের আশীর্বাদ অবশ্য কাম্য। গিরিদ্বার উচ্চতায় চোদ্দ হাজার ন’শ একত্রিশ ফিট। তার তুলনায় বড়া ভাঙ্গাল যেতে সে যে কালিহানি পাস্ পেরিয়েছিল তা আরও বেশি উঁচু। সেই কালিহানি পাস্ উচ্চতায় ছিল পনের হাজার সাতশ’ আটচল্লিশ ফিট। তবুও কুঞ্জুম গিরিদ্বারের শোভা ও বৈচিত্র্য কোন অংশেই কম নয়। তার একদিকে রয়েছে স্পিতি উপত্যকার শুষ্ক রুক্ষ পরিবেশ এবং অন্যদিকে লাহুল অঞ্চল। সেদিকে দেখা যাচ্ছিল বিশাল বিশাল হিমবাহগুলিকে। পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম হিমবাহ বড়া সিগ্রি ছাড়াও ছিল চন্দ্রভাগা হিমবাহের জৌলুষ। যেদিকে চোখ যাচ্ছিল মনে হচ্ছিল বুঝি এ পৃথিবীর বাইরে কোন পরিবেশ।
গিরিদ্বার পেরিয়ে গাড়ি চলল লাহুলের দিকে। পনেরোটি চুলের কাঁটা সদৃশ তীক্ষ্ণ বাঁক পেরিয়ে ন’ কিলোমিটার যাওয়ার পর বাত্তাল। সেখানে চন্দ্রভাগা নদীর ব্রিজ পার হয়ে গ্রামফু পর্যন্ত চলে গেছে রাস্তা। একের পর এক ঝরনা চলেছে রাস্তার ওপর দিয়ে। পাগলা ঝোড়া পড়ল একসময়। তার উত্তাল জলস্রোতে সাঁতার কেটেই পার হতে হল গাড়িকে। যথেষ্ট উঁচু চেসিস হওয়ার জন্য আটকে গেল না গাড়ি। তাদের লক্ষ্য এবার চন্দ্র লেক বা চন্দ্রতাল।
চন্দ্রতাল সে আগেও দেখে গেছে, বাদামি পাহাড়ের দেয়াল দিয়ে ঘেরা বর্তুলাকার স্বচ্ছ নীল জলের নীরব সরোবর, সবাই ভাবে এখনও গভীর রাতে দেবকন্যা আর পরীদের দল এখানে জলবিহার করতে চলে আসে। সে যাই হোক, সরোবরের শোভা মনোমুগদ্ধকর। চারপাশ ঘুরে পর্যটকের দল দেখল ওই হ্রদ, ছবি তুলে নিল নানা দৃষ্টিকোণ থেকে। তাদের কাছে নিশ্চুপ গম্ভীর পাহাড়ের বর্ণমাধুর্য দিয়ে ঘেরা এই হ্রদের অবস্থান দৃষ্টিনন্দন উপস্থিতি। নানা ভাঁজে উঠে গেছে পাথুরে পাহাড়ের দেয়ালগুলি, তৈরি করেছে ঢেউখেলানো পাষাণের সোপান ও সংকীর্ণ চত্বর। দেয়ালের খাঁজে খাঁজে জমিয়ে তুলেছে রহস্যময় আলিঙ্গন।
‘এখন থেকে আমরা কিন্তু আর এগিয়ে যাচ্ছি না। ফিরে যাব ফেলে আসা রাস্তা ধরে। সবাই নিশ্চয় রাজি ?’
সে ভাবল, যদি সবাই রাজি না হয় তো তাকে কোথায় ছেড়ে দেবে পর্যটকরা। তার অবশ্য আপত্তি নেই কোনকিছুতেই। যদিবা এখানেও ছেড়ে দেয় তাকে তো সে এখান থাকে হেঁটেই চলে যাবে কুঞ্জুম গিরিদ্বারে, খুব বেশি হলে যা চল্লিশ কিলোমিটার হবে। দু’দিনও লাগবে না তার। সেখান থেকে কাজা যেতে তার লাগবে আরও দু’দিন। পথে পেয়ে যেতে পারে অন্য পর্যটকের গাড়িও। সে না চাইলেও তাকে কেউ না কেউ যেচে তুলে নিতে চায় তাদের সঙ্গে। না নিলেও তার ক্ষতি নেই, কারণ এই রুক্ষ ভূখণ্ড ধরে সে যেতে থাকবে স্পিতি নদীকে পাশে নিয়ে, তার সঙ্গে গল্প করতে করতে। পথে সে পেয়ে যাবে নানান জনপদ, দশ-বিশ কিলোমিটারের মধ্যে। রাতের আশ্রয় মিলবে সেখানেই। কিন্তু তাকে আর বেশি ভাবতে না দিয়ে আগে বলা কথার রেশ ধরে গেরহার্ট যোগ করল,
‘যদি আমরা এখান থেকে ফিরে না গিয়ে এগিয়ে যেতে চাই তো আমার মনে হয় খানিকটা পিছিয়ে যেতেই হবে, কারণ ওকে কাজাতে রেখে আসা আমাদের কর্তব্য।’
সে জানাল যে তার দরকার নেই। তার মনোভাব স্পষ্ট করে জানিয়ে দিলেও সে কথা মানল না কেউ। দলের অন্য একজন বলল,
‘আমরা তো আগেই ঠিক করেছিলাম যে এখান থেকে আবার ফিরে যাব। সেই সিদ্ধান্ত পাল্টাবার কারণ কোথায় ?’
‘সেজন্য আমরা আসার পথে তাবো ঘুরে দেখিনি, যেহেতু ফেরার পথে দেখব বলে ঠিক করেছিলাম।’
অন্য এক সদস্য মতামত জানাল। সাইমন বলল,
‘ তাছাড়া আমরা পিন ভ্যালি জাতীয় উদ্যানও দেখিনি, যাইনি ধনকর গ্রামে।’
‘শোন, আমাদের হাতে কিন্তু সময় খুব কম। আমরা কাজা, কিবের, লাঙ্গজা, হিক্কিম থেকে শুরু করে অনেক জায়গা দেখে অনেকটা সময় শেষ করে ফেলেছি। দেখেছি কি মনাস্ট্রি ও কিবের জাতীয় উদ্যানও। স্পিতি ভ্যালিতে কি মনাস্ট্রি আর তাবো গুম্ফা, এ দুটিই প্রধান বৌদ্ধ পীঠ। পিন ভ্যালি ন্যাশানাল পার্ক এবং তার পাশে পিন নদীর ধারে মাড ভিলেজও অবশ্য দ্রষ্টব্য স্থান। আর বাকি থাকল ধনকর গুম্ফা। কিন্তু সবক’টি আমরা এবার কিছুতেই দেখার সময় পাব না। ধনকরে থাকতে হবে অন্তত একরাত, পিন ভ্যালি আর মাড ভিলেজে দু’রাত, এতো দিন তো আমাদের হাতে নেই। তাবোতেও থাকা উচিত একরাত। আর এক করা যায়, একদিনেই পিন ভ্যালি আর ধনকর ছুঁয়ে আসা যায়, কিন্তু তাবোতে একরাত থাকতেই হবে যদি সব দেখতে চাও। কী করবে বল ?’
গুঞ্জন তুলে পরামর্শ করতে লাগল বাকি সদস্যরা। সে চুপচাপ দেখে যাচ্ছিল সব। এদের সঙ্গ তার বেশ ভালোই লাগছিল এই কারণে যে দলের সবাই মার্জিত ও ভদ্র। দীর্ঘ আলোচনার পর একজন মুখপাত্র হিসেবে বলল,
‘দেখ, পিন ভ্যালি দেখার ইচ্ছে আমাদের যথেষ্ট। শুনেছি কুড়ি হাজার ফিট এই আলপাইন অরণ্যের সর্বোচ্চ উচ্চতা, রয়েছে দুর্লভ প্রজাতির নানান প্রাণি। তবুও আমরা ভাবছি এটাকেই বরং বাদ দেওয়া যায়, কারণ আলপাইন অরণ্যের সঙ্গে আমাদের পরিচয় আছে। আর ধনকর গুম্ফার তুলনায় তাবো অনেক বেশি আকর্ষণীয় যেহেতু তাবোকে বলা হয় দ্বিতীয় অজন্তা, বৌদ্ধ সংস্কৃতির অন্যতম সেরা পীঠস্থান। তাই আমরা ঠিক করলাম যে তাবোকেই দেখব।’
কিন্তু সেদিন তাবো যাওয়া হল না। ফেরার পথে কুঞ্জুম যেতে লেগে গেল অনেকটা সময়, সেখানে আবার থাকা হল কিছুক্ষণ। তারপর রওনা দিয়ে কাজা যেতে যেতে প্রায় বিকেল। তাবোতে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল দুপুরের মধ্যে। তা না হওয়ার কারণে সে রাত কাজাতেই থেকে গেল সবাই। ঠিক হল, পরদিন সকাল-সকাল তাবোর উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়া যাবে।
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)