বিদ্যুৎ মণ্ডল
তৃতীয় পর্ব
কোটলা কাণ্ড
ভোর থেকেই তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল। রাইসান থেকে কিছু দূরে পাতলীকুল। পাতলীকুল থেকে দুটি রাস্তা বেরিয়ে গেছে যার বামদিকে চলে গেছে সাংচার এবং ডানদিকেরটা সোজা মানালি। পরিকল্পনামাফিক আমাদের ট্রেকিং শুরু হবে সাংচার থেকে। আবহাওয়া সাথ দিলেই ভালোই ভালোই ট্রেকিং-এর আনন্দ উপভোগ করা যাবে। সাড়ে পাঁচটার মধ্যে সকলের প্রাতরাশ সম্পূর্ণ হওয়া চাই। ঘড়ির শেষ সীমা বাঁধা আছে ছটা থেকে সাড়ে ছটা। তারমধ্যে কেউ যদি প্রস্তুত হতে না পারে তাহলে তাকে ছাড়াই যাত্রা শুরু হবে। কিংশুক দা রাতে খাবার পর এবিষয়ে সকলকে সচেতন করে দিল।
আগামী পাঁচ দিন পাহাড়েই থাকতে হবে। প্রত্যেকদিন কম করে ৭/৮ ঘণ্টা পাহাড়ে অবরোহণ চলতে হতে পারে। কাজেই পিঠের বোঝা অতিরিক্ত না হওয়াই কাঙ্খিত। প্রয়োজনের অতিরিক্ত জিনিস একদম নেওয়া যাবে না। যে যে জিনিসগুলো অপ্রয়োজনীয় সেগুলো বুদ্ধিজির বাড়িতেই ছেড়ে যাওয়া হবে। পাঁচদিনের জন্য তেমন বিশেষ কিছুর দরকার হবে বলে মনে হয় না। স্নান করার কোনো প্রশ্ন নেই। তাপমাত্রা ৬ থেকে ৮ ডিগ্রী-এর মধ্যেই ঘোরাফেরা করবে প্রথম দু তিন দিন। প্রয়োজনে বরফের পথ অতিক্রম করতে হতে পারে। বর্ষাকালের ট্রেক। তাই বৃষ্টির আসার সম্ভবনা প্রবল। পাহাড়ে এই রোদ তো এই বৃষ্টি। ঠাণ্ডার কারণে ভালো শীতরোধক পোষাক নিতে হবে। এরপর টুকিটাকি জিনিসপত্র ছাড়া আর তেমন বিশেষকিছু নেবার দরকার নেই। সেইমতো সকলে ব্যাগপ্যাক করে নিল। যাদের ট্রেকিং পোল, প্যান্ট, রেইন কভার ইত্যাদি ছিল না কিংশুক দা জোগান দিয়ে দিল। আমার শুধু দরকার ছিল একটা স্টিক বা লাঠি জাতীয় কিছু। ভাবলাম যাত্রাপথেই গাছের ডাল বানিয়ে কাজ চালিয়ে নেব।
খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেল। সকালের নিত্যাদি ক্রিয়া শেষ করে একে একে সব প্রস্তুতি নিচ্ছে। আগামী পাঁচদিন স্নান করতে পারবো না ভেবে ঐ কনকনে ঠাণ্ডাজলে স্নান করে ফ্রেশ হয়ে গেলাম। কয়েকটা খুমানি ফল সংগ্রহ করলাম এবং সাটিয়ে দিলাম সকাল সকাল। বুদ্ধিজির স্ত্রী রুটি আর সব্জি বানিয়েছেন। ভাতও পাওয়া যাবে। যার যেটা খেতে মন চাইবে সে সেটা খাবে। বেশিরভাগ সকলেই রুটি খেল। আমি দুটোই সাটালাম; একটা রুটি আর অল্প একটু ভাত। এদিকে বেলা বাড়তে না বাড়তেই আবহাওয়ার পরিবর্তন হতে লাগল। আকাশ ঘনিয়ে এসেছে। জমকালো মেঘে আকাশ ঢেকে রয়েছে। বেগতিক দেখে আনপ্যাক করে বেশ কিছু জিনিসপত্র রিসাফল করে নিলাম। বৃষ্টির আশঙ্কা করে দুটো প্যাণ্ট এক্সট্রা নিয়ে নিলাম। সাড়ে ছটা থেকে পৌনে সাতটার মধ্যেই যাত্রা শুরু হল বুদ্ধিজির বাড়ি থেকে। রাইসানকে পেছনে ফেলে গাড়ি ছুটছে আঁকাবাঁকা পথে। জানালা দিয়ে হু হু করে ঢুকছে ঠাণ্ডা বাতাস। রীতিমত দাঁত শিলিয়ে যাচ্ছে। সূর্য অনেক আগেই নাম সাক্ষর করে মেঘেদের আড়ালে নিখোঁজ। পাতলীকুল থেকে পাঁচদিনের প্রয়োজনীয় জিনিস উঠিয়ে নেওয়া হল। আমাদের রথ ছুটে চলেছে সাংচার-এর দিকে। পাতলীকুল ছেড়ে পাহাড়ে ওঠার রাস্তা ধরতেই গোলযোগ। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। ঠাণ্ডাটা হুস করে বেড়ে গেল। পাহাড়ের ওপরে উঠছি আর নীচের মানালিকে এক অদ্ভুত লাগছে, কুয়াশায় ঢেকে গেছে। মুষলধারে বৃষ্টি হয়ে চলেছে। রাস্তার বাঁক এত ভয়ানক সেদিকে তাকালেই আত্মারাম ফুড়ুৎ। অন্ততপক্ষে ৩৪০ থেকে ৩৫০ ডিগ্রী কোণে রাস্তাগুলো এঁকেবেঁকে ওপরে উঠে গিয়েছে। রাস্তার দুপাশের খুমানি, আপেল, ন্যাসপাতি ইত্যাদি ফলের গাছগুলো যেন সবে স্নান করে উঠেছে। বৃষ্টি পড়ার থামা নেই। বদ্ধ জানালা থেকে উপভোগ করছি পাহাড়ি বৃষ্টি। এর বহু আগেই অভিজ্ঞতা হয়েছে যে পাহাড় বড্ড বেখেয়ালি, এই ঝকঝকে রোদ্দুর তো পরক্ষণেই বৃষ্টি। আগ্রহ হারিয়ে ফেলছি আর মনে মনে ভাবছি শেষমেষ বৃষ্টিতেই ট্রেক করতে হবে। তাছাড়া মেঘ পাহাড়ের সৌন্দর্যকে ঢেকে রেখে দিলে তাঁকে দেখে দুচোখে জুড়াবো কিভাবে?
ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আমরা সাংচার গ্রামে উপস্থিত হলাম। গাড়ি দুটো আনলোড করা হল। ইতিমধ্যে কিংশুকদার কথা মতো স্থানীয় রমেশ তাওজি তাঁর তাগড়াই ছটা খচ্চর আর একটা মাদি ঘোড়া নিয়ে হাজির। সাংচার গ্রামের যেখানে রাস্তা শেষ হয়েছে সেখানে একটি বাড়ির ছাদের ছাওনিতে আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। এদিকে বৃষ্টি পড়ে চলেছে একটানা। বৃষ্টির গতি কমা তো দূরের কথা বরং ক্রমশ বেড়েই চলেছে। একদিকে ঘোড়ার পিঠে মালপত্র গোছানো চলছে, অন্যদিকে বৃষ্টির মোকাবিলা করে ট্রেক করার প্রস্তুতি চলছে। বিশ ত্রিশ মিনিট অপেক্ষা করার পরও যখন বৃষ্টি থামছে না তখন অগত্যা উপায় নেই ঝমঝমে বৃষ্টির মধ্যেই যাত্রা শুরু হয়ে গেল। ভাবলাম এই ট্রেকে হয়তো কোনো ট্রেকিং পোলের দরকার নেই। মিনিট দশেক পর যখন সাংচার গ্রাম ছেড়ে পাহাড় চড়া শুরু হয়ে গিয়েছে তখন অনুভব করলাম যে রাস্তা একদম খাঁড়াই ওপরে উঠে গেছে, বৃষ্টিতে পিছলে যাওয়ার সম্ভবনা প্রবল। ইতিমধ্যে দু চারজন পিছলেও গিয়েছে। বেগতিক দেখে আখরোট গাছের ছোট একটা ডাল ভেঙে নিয়ে ট্রেকিং পোল বানিয়ে নিলাম। বুদ্ধিজির সাথে সাথে হাঁটতে লাগলাম। ছেলেবেলা থেকেই দ্রুত হাঁটি। বংশগত বললে ভুল হবে না। আমার বাবা এখনও এত দ্রুত হাঁটেন যে পাশ দিয়ে গেলে না তাকিয়ে উপায় নেই। যে কেউ দেখলে ভাববেন যে বাড়িতে হয়তো কোনো জরুরী তলব পড়েছে। কিন্তু বাবার ওটাই স্বাভাবিক। জিনেটিকালি সেই ধারা আমার মধ্যেও বর্তমান। রানিং ওয়াকিং বিভিন্ন অ্যাপ্সে পরিমাপ করে দেখেছি স্বাভাবিক হাঁটলে এক কিলোমিটার অতিক্রম করতে আমার সময় লাগে প্রায় ৯ মিনিট।
যাইহোক, পাহাড়ে হাঁটা আর সমতলে হাঁটা আসমান জমিন ফারাক। বুদ্ধিজি, মনোজদা আর আমি আগে আগে হেঁটে চলেছি, মাঝে মাঝে সকলের জন্য অপেক্ষা করছি। বৃষ্টি পড়ে চলেছে মুষলধারে। দেবব্রত দা আর অনিরুদ্ধ দাদাদ্বয় পরে আমাদের সাথে যোগ দেয় এবং টীমটা তিনটা দলে ভাগ হয়ে যায়। প্রথমদিকে অমরা চার পাঁচজন মাঝখানে সপ্তর্ষী, সন্দিপন এবং মহুল আর পেছন দিকে চার-পাঁচজনকে নিয়ে কিংশুকদায়ের টীম। টি-শার্টের ওপরে একটা সোয়েটার তার ওপর পঞ্চু। ভেতরটা ঘেমে সেদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। এদিকে বৃষ্টির জলে চশমার কাঁচ অস্বচ্ছ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে, দু চার মিনিট অন্তর অন্তর চশমার কাঁচ পরিষ্কার করে নিচ্ছি। ভাগ্যিস একটা তোয়ালে ছিল পকেটে। বাইরের তাপমাত্রা ১০ থেকে ১২ ডিগ্রী হবে। কিন্তু শরীর দিয়ে ঘাম ঝরছে। ঘাম ঝরা যেন আমার জন্মগত অধিকার। অফিসে এসির নীচে বসেও আমার মাঝে মাঝে ঘাম ঝরে। ট্রেকিং শুরুর আধাঘণ্টা পরেই মথার টুপি খুলে দিতে হল। তার আরো কিছু পরে সোয়েটার ঝেড়ে ফেলতে হল।
প্রথমদিকে টানা দেড় দু ঘণ্টা বৃষ্টি পড়ার পর, একটু মোড়বদল হল। খানিক বৃষ্টি তো কিঞ্চিৎ বিরতি। তবে বৃষ্টির মধ্যে পাহাড়ে ট্রেকিং এর অনুভূতি যে কি অপূর্ব তা বলে বোঝানো যাবে না। রোদ্দুর থাকলে পাঁচমিনিট হাঁটলেই অবস্থা কাহিল হয়ে যেত, কিন্তু বৃষ্টির কারণে অনেক সহজেই অনেকটা পথ অতিক্রম করা সম্ভবপর হল। ঘণ্টা তিনেক কেটে গেল, জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পাহাড়ে ওঠা চলতে লাগল একই ছন্দে। সঙ্গে জমানো জল শেষ। এদিকে পেটে ক্ষুধার দেবী ভর করে বসল, তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে গেছে। আগেপিছে বহু ঝর্ণাধারা বয়ে গেছে কিন্তু সেগুলো খাওয়া স্বাস্থকর কিনা ইতস্তত করছি বুদ্ধিজি আমার অভিপ্রায় বুঝতে পেরে বললেন, “ঝর্নাকা পানি বহুত মিঠাস হোতি হ্যায়। আপ আঁখ বন্দ করকে পি সকতে হো বাবু। বরফ্ পিঘলকে উপরসে পানি আ রহা হ্যায়। ইস পানি বহুত শুদ্ধ অউর সেহেদ কে লিয়ে আচ্ছা ভি হ্যায়।” বুদ্ধিজি আরও কিছু বলতে চাইছিলেন আমি তাঁর কথায় আগ্রহ না দেখিয়ে ঢক ঢক করে ঝর্ণার জল খেয়ে পিপাসা মেটালাম। খিদেই পেটে আগুন জ্বলছিল, সেই আগুনের লেলিহান শিখাকে কিছুক্ষণের জন্য শান্ত করলাম বটে কিন্তু দুধের স্বাদ কি আর ঘোলে মেটে। অগত্যা উপায় নেই যে।
পরিকল্পনামাফিক কোটলাতেই প্রথম দিনের ক্যাম্প করা হবে। শুনেছি কিংশুকদা যতবারই মানালি পাশ ট্রেক করিয়েছে ততবারই কোটলাতেই তাঁবু গেড়েছে। এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না। কত চড়াই উৎরাই পেরলে তবে কোটলাতে পৌঁছবো তা ঠিক ঠাওর করতে না পেরে বুদ্ধিজিকে শুধালাম, “বুদ্ধিজি কোটলা পৌছনে মে অউর কিতনা অয়াক্ত লাগেগা?” বুদ্ধিজি হেসে হেসে বললেন, “পাহাড়ো চড়নে মে তকলিফ হো রহা হে বাবু? এইসাহি চলতে রহোগে তো অউর বিশ ত্রিস মিনিটো মে পৌঁছ যাওগে।” আমি প্রত্যুত্তরে বললাম, “মেরা কোহি দিক্কত নহি হ রহা হ্যায়, লেকিন বহুত ভুক লাগা। অউর পিছে জো লোগো রহে গহি উনলোগোকে লিয়ে বারবার রুকনা পড় রহা হ্যায়, এ ঠিক নহি লগ রহ হ্যায়।” বুদ্ধিজি কিছু বললেন না শুধু মৃদু হাসলেন।
বৃষ্টি ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরে যেতেই হাল্কা রোদের আভা ঠিকরে বেরিয়ে আসছে মেঘেদের আড়াল থেকে। কি ভীষণ স্বর্গীয় অনুভূতি তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। একটা ঢালু জায়গা দেখে সকলে বিশ্রাম নেওয়া হল। একটা গাছের ডাল শুকনো হয়ে ভেঙে পড়ে ছিল সেখানেই বসে পড়লাম। পঞ্চু/রেইন কোট ছাতা যার যা ছিল সব পুনরায় রুকস্যাকে প্যাক করে নেওয়া হল। সঙ্গে যেসব শুকনো ফল ছিল তা থেকে অল্প অল্প খাওয়া হল। রূপালি আকাশের দিকে তাকিয়ে কত কথা ভেসে আসছে। কত স্মৃতিকে পিছনে ফেলে রেখে অপ্রত্যাশিতভাবে এখানে চলে আসা। যতক্ষণ না কোটলাতে তাঁবু গাড়া হচ্ছে এবং তারপর উনুনে চাল চাপানো হচ্ছে ততক্ষণ পেটে খিল দিয়ে বসে থাকতে হবে সকলকে। সময় অতিবাহিত করে কোনো লাভ নেই, বরং লস আছে; তাহলে দেরিতে খাবার জুটবে। সামনের রাস্তা একেবারে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলে গেছে। দূরে থেকে দেখলে ভয়ানক ভয়ানক লাগে। যে কারো মনে হতে পারে নানা বন্য প্রাণি হয়তো আড়ালে লুকিয়ে আছে শিকারের খোঁজে। ইদানিং কোনো জংলী জানোয়ারের সন্ধান পাওয়া যায়নি যদিও। অথচ মনটা কেমন যেন ব্যাকুল হয়ে উঠেছে তাদেরকে দেখার জন্য। বুদ্ধিজি বলে চলছিল যে এই অঞ্চলে গোট্টু নামক বন্য পশুদের উৎপাত সাংঘাতিক রকমের। তবে একসঙ্গে এতজনকে দেখে কোনো বন্য প্রাণীই কাছে ঘেঁষতে সাহস করবে না। তাদেরও প্রাণের ভয় আছে। মনকে সান্তনা দিলাম যে বন্য জন্তুর দেখা না হোক, পাহাড়ি সাপের দেখা নিশ্চয় পাবো। কিন্তু কৈ কারোরই দেখা পেলাম না যে। না পাহাড়ি চিতা, না গোট্টু, না কোনো সাপখোপ।
নয় নয় করে বিশ ত্রিশ নয়, প্রায় একঘন্টা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পাহাড়ে উঠে চলেছি। পাহাড়ি রকমারি অদ্ভুত সুন্দর ফুল ছাড়া কোনো বন্য প্রাণি চোখে পড়ল না। মনোজ দার থেকে শুনলাম যে রমেশ তাও জি তাঁর ঘোড়া এবং দলবল নিয়ে আগে পৌঁছে যাবেন কোটলাতে পৌঁছে একটা ঝর্ণা দেখে তাঁবু খাটিয়ে রান্না শুরু করে দেবেন। সেইমতো সকলে মহানন্দে হেঁটে চলেছে। প্রথম দিনের যাত্রা এতটা খাড়াই হবে বুঝে উঠতে পারিনি। জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে উপরে বিস ত্রিশ গজের মধ্যে পাহাড়ের ঢালে একটা টিনের ছাওনি দেখা যাচ্ছে। সম্ভবতঃ সেটাই আমাদের আজকের যাত্রা সীমা। যদিও কিংশুক দা বলেছিল যে প্রয়োজন পড়লে পরিস্থিতি বুঝে রাত্রেও ট্রেক করতে হতে পারে। সকলে সেই মতো প্রস্তুতি নিয়েই এসেছে। যাইহোক, অন্তিম সীমা দেখতে পেয়ে যেন সকলে জোর পেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা কোটলাতে পৌঁছে গেলাম। কিন্তু কোথায় কোটলা, কোথায় তাঁবু খাটানো ! কোথায় রমেশ তাওজির তোড়জোড় !
পাহাড়ের ঢালে একখানা টিনের ছাওনি ছাড়া কাউকে কোথাও দেখতে পাওয়া গেল না। পাহাড়ের ওপর থেকে একটা সরু সুতোর মতো ঝর্ণা নীচে বয়ে চলেছে। এখানে জলের কোনো অসুবিধা হবে না। তাঁবু খাটানোর জন্য এর থেকে ভালো জায়গা আর হয় না। টিনের ছাওনির পাশেই একটা ছোট্ট ঘরও আছে। তবে সেটা অবশ্য তালাবন্ধ। ওপর থেকে নীচের মানালি শহর কে ছবির মতো লাগছিল, ঠিক যেন কোনো শিল্পি তাঁর নিপুণ তুলির টান দিয়ে যেখানে যে বিষয়ের সমাবেশ ঘটানোর প্রয়োজন সেভাবেই এঁকে দিয়েছেন। কুল্লু উপত্যকার সৌন্দর্যে সিক্ত হয়ে আছে হিমাচলের পদতলে থাকা এই ছোট্ট শহর মানালি। আয়তনে বড় না হলেও বেশ সাজানো গোছানো পরিপাটী। দূষণ কম ও শুদ্ধ বাতাসের কারণে পেঁজা পেঁজা তুলোর মতো মেঘেদের যাওয়া আসা অনুভব করা যাচ্ছে। কোটলা থেকে মানালিকে দেখা এক স্বর্গীয় অনুভূতি, এক অপার আনন্দ। বিশাল বিশাল অট্টালিকা, বিরাট বিরাট বিল্ডিং, বিধ্বংসী বিপাসা নদী কোটলা থেকে যেন মনে হচ্ছে সবুজের মাঝে বিন্দু বিন্দু ছোপ ছোপ। কিংশুকদা, মনোজ দা এবং বুদ্ধিজি ছাড়া বাকিরা আমার মত নতুন। হা করে তাকিয়ে আছে সবাই নীচের শহরের দিকে। এত নৈসর্গিক শোভা মুহূর্তেই বশ করে নিয়েছিল। দূরে কালিয়াণি পাশ, হনুমান ডিব্বা ও আরো বেশ কয়েকটা পাহাড়, সবকটির মাথায় বিরাট বিরাট বরফের মুকুট। রোদের আলো পড়তেই সেগুলো থেকে এমন জ্যোতি বেরিয়ে আসছে যে সকলেই অভিভূত হয়ে সেই দৃশ্যহরণকারি পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে। এ যেন এক মহাকাশসম সার্থকতা। প্রথমদিনেই এই দৈবিক পার্থিব মুগ্ধতা হাসিল হয়ে যাবে বোধহয় কারোরই প্রত্যাশাতে ছিল না। একেই বলে মেঘ না চাইতেই জল।
একে একে সকলে কোটলাতে পৌঁছল কিন্তু রমেশ তাঁওজিদের কোনো দেখা নেই। ঘোড়ার দলেরও পাত্তা নেই কোনো। এদিকে খিদের চোটে পেটে ছুঁচো ডন দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়েছে, বোধহয় মরে গেছে। ভাগ্যিস সকলের কাছে কিছু না কিছু খাবার ছিল, সেই খাবারেই কমবেশি সকলের আপাতকালীন ক্ষুধার নিবৃত্তি হয়। ঘড়িতে সময় বলছে দুপুর দুটো, আকাশের দিকে তাকিয়ে তার কিচ্ছুটি আন্দাজ করা যায় না, ঘন জমাটবাঁধা মেঘদের দল একবার বামে থেকে ডাইনে তো ডাইনে থেকে বামে ভেসে বেড়াচ্ছে। ইতিমধ্যে ভেজা জুতো, পোষাক পাল্টে রীতিমত শীতের পোষাক পরে জোরকদমে গল্প চলছে। তাপমাত্রা আন্দাজমতো ৮ ডিগ্রি থেকে ৯ ডিগ্রি হবে। তার বেশি হবে না। এভাবে ঘণ্টাখানেক পেরিয়ে গেলেও ঘোড়াসমেত মালপত্র নিয়ে তাওজি আসছে না দেখে কিংশুক দা মনোজদাকে নীচে পাঠাল। মনোজ দায়ের স্টামিনার দাগ দিতে হয়। তার বয়স ৪২+ হলেও বুদ্ধিজির সাথে পা মিলিয়ে হাঁটার ক্ষমতা রাখে। বেগতিক দেখে বেচারাকে আবার নীচে নামতে হবে। মালপত্র না আসলে তাঁবু খাটানোও সম্ভব নয়। ক্লান্তি গ্রাস করে ফেলেছে সকলকে। মাঝে মাঝে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি টুঁকি দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। ভাগ্যিস ছাওনিটা ছিল বলে এ যাত্রায় রেহাই।
সকলে অপেক্ষা করে ক্লান্ত অবসন্ন। শুধু যে শারীরিক অবসাদ গ্রাস করেছে তা নয়, এই বুঝি ওরা এল এই ভাবতে ভাবতে মনও অবসন্ন হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছে। এভাবে আরো ত্রিশ মিনিট অতিক্রম হয়ে গেছে। কারও কোনো পাত্তা নেই। না আসছে ঘোড়া না আসছে সারথি তাওজি। তাহলে না খেয়েই কি মরতে হবে? নাকি আশ্রয়ের অভাবে এই কনকনে ঠান্ডায় বেঘোরে মরতে হবে সকলকে? অথবা কি আমাদের ফিরে যেতে হবে? আমরা কি পারবো এই অবসন্ন বিধ্বস্ত শরীরটাকে টেনে নিয়ে নীচে যেতে?
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)