পাঠক মিত্র

পাঠকের চেতনায় ফুটে উঠবে সমাজ বাস্তবতার চিত্র

রূপকথার গল্প, নীতিকথার গল্প ছাড়া শৈশব কাটেনি এমন মানুষ হয়তো পাওয়া যাবে না । কিন্তু পরবর্তী সময়ে গল্পের সাথে পরিচয় অন্যভাবে ঘটে । সবার সাথে সেই পরিচয় ঘটে তা কিন্তু নয় । সাহিত্যের প্রতি ভালবাসার টানে গল্প, কবিতা বা উপন্যাসের পাঠক কত বা কেমন, তার পরিসংখ্যানে বিচারের মাপকাঠির বিজ্ঞানভিত্তিক পরিসর নিয়ে  আলোচনার দ্বান্দ্বিক ব্যাখ্যা এ লেখার উদ্দেশ্য নয় । তবে গল্পের বর্ণনা থেকে আমরা চিহ্নিত করে দিই, কোনটা দেশ ও দেশভাগের গল্প, সমাজের গল্প, প্রেমের গল্প, জীবনের গল্প, আবার কখনও বলে থাকি কোন গল্প চিরায়ত । আসলে কোনো গল্প ও কাহিনী সময় বা গল্পকারের ব্যক্তিকালকে অতিক্রম করতে পারে না । সেই সময়ের সমাজে গল্পকারের চারপাশে থাকা মানুষের জীবনের গল্পই তাঁর কলমে ধরা দেয় । প্রতিটি মানুষের জীবনে অনেক গল্প তৈরি হয় । জীবনের স্রোতে জীবনের গল্পের শাখা-প্রশাখা ভেসে চলে । সেই ভেসে থাকা গল্প যখন গল্পকারের ক্যানভাসে ভেসে ওঠে তাঁর নিজস্ব ভাষার স্রোতে, আর সেই স্রোতে পাঠকের নিমগ্নতা ভেসে যায়; পাঠক সেই স্রোতে ভাসতে ভাসতে চারপাশের মানুষের দুঃখ-কষ্ট, আনন্দকে তখন নতুন করে আবিষ্কার করতে পারে । গল্পের চরিত্রগুলিকে চেনা মনে হলেও নতুন করে আবার চিনতে পারে । আর তখনই গল্পকারের নির্মাণ সার্থক হয়ে ওঠে । 

গল্পকার তপনকুমার দাসের এমন সার্থক নির্মাণ ‘চারুবালার আশা ভরসা’ । এই গল্পগ্রন্থের তেরোটি গল্পের চরিত্ররা অচেনা নয় । সুরমা, শান্তা, ফুল্লরা, প্রফুল্লবাবু, কল্পনা, চারুবালা – এ চরিত্রগুলো আজকের সমাজের চারপাশে কোন না কোনভাবেই দেখছে সবাই। অথচ অনুভবের তরঙ্গ কেবল সময়ের কুলুঙ্গিতে রেখে শান্ত থেকে যায় ।  

‘শান্তি পারাবার’ গল্পের সুরমা স্বামী ও শাশুড়ির হাতে অগ্নিদগ্ধ হয়েও ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে তাঁদের শাস্তি দেওয়ার কথা ভাবেনি । কিন্তু ছেলেকে বুকে আগলে ধরে তিলতিল করে বড়ো করে তুলেছে । এমনকি মা তাঁর সর্বস্ব দিয়ে সেই ছেলের নিজস্ব ঘর-সংসার গুছিয়ে দিয়েছে । সেই ছেলে মাকে দেখভাল করতে না পারার অছিলায় বৃদ্ধাশ্রমে থাকাটাই শ্রেয় বলে মাকে বোঝায় । সুরমা চোখের জল চেপে জানতে চায়, মা বুড়ি হয়ে গলে কি ভারি হয়ে যায় ? পাল্টা যুক্তিতে কোন অসুবিধে হবে না বলে ছেলে জানিয়ে দেয় । সুরমাকে মেনে নিতে হয় । সুরমার মত এই মেনে নেওয়া মানুষের সংখ্যা একটা শ্রেণীর মধ্যে বাড়ছে আজ । যাদের শুষ্ক চোখে ধরা পড়ে না তাদের মেনে নেওয়ার গল্প । সুরমার শুষ্ক চোখে তার প্রতিফলনের ঢেউ তুলেছেন গল্পকার ।

‘শান্তার অভিনন্দন’ গল্পে শান্তার চরিত্রও একটি নয় । সমাজের চারপাশের একটি চরিত্র । কৈশোরে পা-দেওয়া সন্তানের সামনে শান্তার যেদিন ডিভোর্স হয়ে যায়, সেদিন সন্তানের মুখে যে-কথাগুলো শুনেছিলো শান্তা তা তাকে অনেকটা শান্তি দিয়েছিলো । তখন মনে হয়েছিল সন্তান যেন এক লহমায় বেশ বড়ো হয়ে গেছে । মায়ের কতকিছু সে খেয়াল রাখে । ছেলের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেনি কখনো । কিন্তু ছেলের মা-অন্ত প্রাণ । বিদেশে চাকরি নিয়ে গেলে মাকে নিয়ে যেতে চেয়েছে । প্রতিদিনই মায়ের ডাক পড়ে ফোনের ও প্রান্ত থেকে । মাকে চাকরি ছেড়ে দিতে বারেবারে বলেছে । কিন্তু সেই ছেলে মেঘবালিকার সঙ্গে লিভ-টুগেদারে থাকতে চায় বলে মায়ের অনুমতি চায় একদিন। শান্তা চায় ছেলে বিয়ে করুক । বিয়ে একটা ব্যাকডেটেড চিন্তা বলে মায়ের সাথে সে প্রসঙ্গে কথা বলেছে । শেষে মায়ের অনুমতির প্রয়োজন মনে করেনি সে । অবশেষে ছেলের জন্মদিনে যখন বিদেশ থেকে দেশে ফেরে । মেঘবালিকাও ফেরে । কিন্তু বিমানবন্দর থেকে মায়ের সাথে বাড়ি আসেনি । সে মেঘবালিকা ও তার পরিবারের সাথে চলে যায় । কষ্ট তার বুকে জমতে শুরু করেছিল । সেদিন যে ছেলের জন্মদিন । বাড়ি এসে দেখে জন্মদিনের পায়েস বিড়াল খেয়ে যায় । এ কাহিনীর বিন্যাসে মায়ের পরিসর ছেলের কাছে যখন গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে তখন পায়েস খেকো বিড়াল ভেংচি কাটে সময়কেই।   

সন্তানের অবহেলায় সুরমা বা শান্তার জীবনের তুলনায় কল্পনা ও চারুবালার জীবন এক নয় । কিন্তু সন্তানের অবহেলায় ‘স্বার্থ সুখ’ গল্পের কল্পনা ও চারুবালা নামাঙ্কিত গল্পের চারুবালার জীবন সুরমা ও শান্তার জীবনের মধ্যে পার্থক্য নেই।  পার্থক্য তাদের শুধু আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যে। সুরমা ও শান্তা আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী । তাদের স্বচ্ছল আর্থিক আবহাওয়ায় তাদের সন্তানরা মানুষ হয়েছে । কিন্তু কল্পনা ও চারুবালা । দারিদ্রতার সাথে লড়াই করে সন্তানদের মানুষ করেছে তারা । এই লড়াইয়ে তারা তাদের সন্তানদের জিতিয়ে দিয়েছে, কিন্তু নিজেরা জিততে পারেনি । সন্তানকে জিতিয়ে দিতেই যেন তাদের জীবন । সন্তান তার স্বার্থ সুখে যখন মায়ের পরিচয় মৃত বলে প্রকাশ করে, তখন কল্পনা নিজের নামের পরিচয়ে সদ্যজাত নাতনির মুখ না দেখেই আশীর্বাদ পাঠিয়ে দিতে ভুল করে নি । নিজের সন্তানের মুখে নিজের পরিচয় মৃত ঘোষণা শোনার পর সেই মায়ের মনের গভীরের ঢেউ কল্পনার এই জীবন পাঠককে নাড়া দেবে । আর চারুবালা তার বড়ো ছেলেকে নিয়ে শুধু স্বপ্ন দেখেনি, সেই স্বপ্ন বাস্তবের মাটিকে স্পর্শ করেছে । ছেলে ইঞ্জিনিয়ার। বড়ো চাকরি করে । বেশ ভালোই কাটছিল তার সংসার । কিন্তু সেই ছেলে বিয়ের পর পুরোটাই বদলে গেল । যে ছেলেকে মানুষ করার জন্য ছোটছেলের পড়াশোনা ঠিকভাবে হয়নি । এমনকি তার উন্নতির জন্য নিজেদের একচিলতে বাস্তুভিটেও মর্টগেজ রাখতে হয়েছে । যে ছেলের জন্য মায়ের জীবনটাই লড়াই,  সেই ছেলে হাসপাতালে মায়ের মরণবাঁচন লড়াইয়ে বেকার ভাইয়ের পাশে মায়ের জন্য সময় পায় না । এমনকি মায়ের জীবনের লড়াইয়ে মাকে জিতে নেওয়ার তাগিদ দেখায় না । দারিদ্রতার লড়াইয়ে জয়ী জীবন যখন দারিদ্রতাকে হেয় করে, এড়িয়ে যায়, তখন সে নিজেকেই অপমান করে । কিন্তু সেই অপমানটা স্বার্থঘোরে বুঝতে পারে না । আসলে মাটিকে ভুলে যাওয়া এখন সময়ের সংস্কৃতি । তাই চারপাশে মা বাবা সন্তানের সম্পর্ক থেকে সমাজের সমস্ত সম্পর্ক যেন স্বার্থের সুতোয় ঝুলছে । স্বার্থের সুতোয় বাঁধা সম্পর্কের টানাপোড়েনের আর এক গল্প ‘সময়ের খেলা’ । অবসরপ্রাপ্ত প্রফুল্লবাবুর জীবন ছেলে ও বৌমার কাছে তাচ্ছিল্যের জীবন যত্নে ভরে ওঠে তার অফিসের বকেয়া টাকা পাওয়ার চিঠি আসার পরেই । স্বার্থের সুতোয় বাঁধা থাকে যেন সব সম্পর্ক। স্বার্থ সুখে এগিয়ে যাওয়া । সম্পর্ককে পিছনে ফেলে । স্বার্থ না থাকলে তাই মা-বাবা স্বামী-স্ত্রী-সন্তানের সম্পর্ক ভেঙে যায় । একই পরিবারের মধ্যে সম্পর্ক ভেঙে পড়ছে । ভেঙে যাওয়া সম্পর্কের সাথে যখন কোনো শিশু-সন্তান থাকে, তখন সেই সন্তানের মনের গভীরে এক গভীর প্রভাব পড়ে । ‘লড়াই’ গল্পে ফুল্লরার সন্তান টাবুনের চরিত্র বলে দেয় সেই কথা । বড়োদের সম্পর্কের টানাপোড়েনে শিশুর মনে যে আঘাত তৈরি করে তারই প্রতিফলন এই টাবুন । সব পরিবারেই যেন সম্পর্কের টানাপোড়েন এক অদৃশ্য স্বার্থে । আর সেই স্বার্থের চেহারা যখন সামনে চলে আসে, সম্পর্ক ভেঙে যায় তখন । গল্পকারের প্রতিটি গল্পের চরিত্রগুলো এমন জীবন্ত যেন মনে হবে প্রতিবেশী । গল্পগুলোর মধ্যে পাঠক তার চারপাশকে অনুভব করবে । গল্পের চরিত্রগুলোর মধ্যে প্রাণ খুঁজে পাবে পাঠক ।

‘ছেলের বাবা, ছেলের মা’ গল্প অবশ্য অন্য কথা বলে । এ গল্পে চাঁদুর পরোপকারিতা তার পিতার কঠিন হৃদয়কে জয় করেছে যা চারপাশের স্বার্থপরতার পরিবেশে এক সুস্থ হাওয়া । আর ‘সংক্রান্তির মেলা’ গল্প এক গ্রাম্য মেলার গল্প যা তার গ্রামীণ ঐতিহ্য নিয়েই বাঁচিয়ে রাখতে চান গ্রামের মাতব্বররা । কোনভাবেই শহুরে সভ্যতার বিজ্ঞাপনে তার চরিত্র যেন নষ্ট না হয় । গ্রামীণ ঐতিহ্য মানেই তার আলাদা সংস্কৃতি । সেই সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখার এক আবেদন যেন এ গল্প । গল্পগ্রন্থের তেরোটি গল্পের মধ্যে  ‘ছেলের বাবা, ছেলের মা’ ও ‘সংক্রান্তির মেলা’  গল্পদুটি আলাদা বার্তা দেয় যা বর্তমান স্বার্থ-সভ্যতার খাপে বেমানান । অথচ সমাজকে ভাল রাখার জন্য চাঁদুর মত, মাতব্বরদের মত লোভহীন স্বার্থহীন হওয়া প্রয়োজন । এ গল্পদুটি তারই প্রতিচ্ছবি ।  

প্রতিটি গল্পে গল্পকারের সহজ ভাষার শিল্প এক আলাদা মাত্রা তৈরি করেছে । মানুষের জীবনের দুঃখ-কষ্ট-আনন্দের রোজনামচার সেই শিল্পে পাঠকের চেতনায় ফুটে উঠবে সমাজ বাস্তবতার চিত্র। 

সর্বোপরি মানুষের জীবনের টানাপোড়েনের এই কাহিনীবিন্যাস পাঠককে টেনে রাখার সার্থক জাদু গল্পকারের ভাষাজালের প্রাঞ্জলতা ।  

‘চারুবালার আশা ভরসা’-

তপনকুমার দাস

অক্ষর প্রকাশন 

কলকাতা–৯

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *