অরিত্রী দে

তৃতীয় পর্ব

পরিবেশের অর্থনীতি, কৃষিনির্ভরতা ও 

আধুনিক সাহিত্যের কথকতা

জোনুই এ নেজনা জুড়্যা বুড়্যা রাখে আল।

ঈষ ধর‍্যা পাশি সষ্যা পরাইল কাল।।

বাঁট দিয়া কোদালে জুয়ানে দিয়া মলি।

পুরস্কার পায়্যা চলে লৈয়া পদধূলি।।

-কবি রামেশ্বর কৃষিকাজের বিস্তৃত বিবরণ দিয়েছিলেন শিবকে কেন্দ্র করে। মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্যগুলিতে দেবখণ্ডে শিব-পার্বতীর কোন্দলের মূল বিষয় হয়েছে অন্নাভাব৷ ‘শিব সংকীর্তন’ কাব্যে শিবকে সাংসারিক অভাব দূরীকরণে চাষ করতে দেখা যায়। আমাদের অর্থনীতি যে কৃষিপ্রধান, সেই বাস্তবতাই রুদ্র শিবের মিথকে শস্যের সঙ্গে জুড়েছে। কুবেরের কাছে বীজধান সংগ্রহ করে দেবীচক দ্বীপে শিব কৃষিকার্যের সূচনা করেন, সঙ্গে ভীম। চাষের পদ্ধতি বর্ণনা ছাড়াও বিভিন্ন রকমের চালের কথা পাই। অনুমিত হয় কবির উদ্দেশ্য ছিল চাষের গৌরব বৃদ্ধি। ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে দেবী অন্নদাকে দেখি শিবের সঙ্গে ঝগড়া করে শিবকে বিপদে ফেলার জন্য দেশে দুর্ভিক্ষ তৈরি করায়। আবার তিনিই পাত পেরে সবাইকে চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয় খাইয়ে শান্ত করেন। বিজয়াতে দশমীর সকালে দুচোখ ভরে যারা মাঠের ধান দেখে তারা জানতে পারে মায়ের সর্বব্যাপী অন্নপূর্ণা রূপ। দেবী আরাধনায় যে নবপত্রিকা বরণ রয়েছে, তা দেবী দুর্গার শাকম্ভরী রূপটিকে পরিস্ফুট করে। রম্ভা, কচ্চী, হরিদ্রা, জয়ন্তী, বিল্ব, দাড়িমৌ, অশোক, ধান প্রভৃতি নবপত্রিকার কথা আছে। পরিবেশের অর্থনীতি যে কৃষিনির্ভর, তার পরিবর্তনে পল্লীপ্রকৃতির সুষম চেহারা ধসে যেতে পারে- এই সাবধান বাণী কথাসাহিত্যের বিবিধ ক্ষেত্রে চর্চিত হয়ে চলেছে। অনিতা অগ্নিহোত্রীর ‘সুখবাসী’ উপন্যাস বন পাহাড় মালভূমির সঙ্গে মিশে থাকা জনপদ, হাট, গঞ্জ, চষা মাঠ, রোদে পোড়া ধান আর অঙ্কুরে বিনষ্ট শস্যের এক অভিনব বারোমাস্যা। এখানকার আদিবাসী মিথ অনুযায়ী শিব আর ভীমই তাদের মাটিতে বীজ বুনতে বা কৃষিকাজ করার প্রত্ন-জ্ঞান শিখিয়েছে। বিশ্বদরবারে অর্থের লোভে এই কৃষিজ্ঞান, প্রাসঙ্গিক লোকগান বিক্রি করতে চায় কুচক্রী দালালেরা। গ্রামের কেউ কেউও কাঁচা টাকার ফাঁদে পা দিয়ে ফেলে। তবু গোষ্ঠীস্মৃতির চলমান প্রক্রিয়া থেমে থাকেনা। 

‘মা মেয়ের ঘর’ আখ্যানে লেখিকা বিশ্বেশ্বরী পঞ্চাধ্যায়ী  ১৯৮৩ সালে তাঁর মায়ের মৃত্যুর পরে যে স্মৃতিকথা লিখছেন, তাতে গ্রামকে পরিবেশ প্রকৃতি আর পরিচর্যায় ‘সমগ্র’ হয়ে থাকতে দেখি। পূর্ব মেদিনীপুরের কোনো এক গ্রামে জন্মানো লেখিকার মায়ের শিক্ষাগত দৌড় দ্বিতীয় শ্রেণি অবধি। সেই মেয়ে স্বামীর মৃত্যুর পর কেবল সংসার আগলায়নি, মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন, সতীনকে আর তার ছেলেকে খাইয়েছেন-পরিয়েছেন। বলতে গেলে জীবনযুদ্ধে একাই আত্মশক্তিতে টিকে থেকেছেন। কিন্তু এই শক্তিই বা কিসের জোরে? বিশ্বেশ্বরীর মায়ের বিয়ে হয়েছিল গ্রামের জমিদারের সঙ্গে। দু বিঘে জমির উপরে বাড়ি আর ছিল আশি বিঘে জমি, তিনশো নারকেল গাছ, আম গাছ, গ্রামের পুকুর৷ পুকুরে মাছ, কাঁকড়ার অভাব ছিল না। তখন জমিদারির প্রাচুর্য বলতে এই সম্পদকেই বোঝানো হত। অর্থাৎ ঘর-মাঠ-ক্ষেত-গরু-চাকর পরিবৃত সমৃদ্ধ সংসার। আখ্যানের ঘটনাকাল যে সময়পর্বকে চিহ্নিত করে, তাতে প্রেক্ষাপটে ছিল ভারত ছাড়ো আন্দোলন (১৯৪২), দুর্ভিক্ষ (১৯৪৩), আইন অমান্য আন্দোলনের মতো রাষ্ট্রীয় ঘটনা। ব্রিটিশ সরকারের রোষে গ্রামের অনেকের সঙ্গে জমিদারবাবুও তাঁর জায়গা জমি হারান। সেই বছরেই ভয়াবহ বন্যায় সমুদ্রে এসে পড়ে গোটা সংসার। কেবল চার বিঘে জমি বেঁচে ছিল, জমিদারবাবুর ছোট গিন্নি তথা বিশ্বেশ্বরীর মা সেই জমির কিয়দংশে পেট ভরানোর ব্যবস্থা করেছিলেন।  কোনোমতে একচালা ঘর বেঁধে একটুও সময় নষ্ট না করে মাঠে যাওয়া, ফসল রোয়া, গরু-বাছুর প্রতিপালন করা, আনুষঙ্গিক দ্রব্য উৎপাদন করে বাজারে বিক্রি করা প্রভৃতি নিয়ম করে করেছেন। লেখিকার কথায়, গরু-ঘাস-হাট-দোকান -কাঠকুটো জ্বালন। কৃষি আর ঘর-গেরস্তির যে সংস্কার বিশ্বেশ্বরী, তার মা আর আরো আগে পূর্বমাতৃকারা অর্জন করেছিলেন সেসবের জ্ঞানই টিকে থাকতে শিখিয়েছে। এক বিঘে মত জমিতে জৈষ্ঠ্য মাসের বৃষ্টিতে ধানের বীজ বুনে দিতেন মা, আষাঢ়ে তার কল বেরিয়ে যেত। বৃষ্টিতে গাছ বেড়ে যেত বহুগুণ, তারপর জল দাঁড়ানো জমিতে কাদা করে ধানচারা তুলে বসাতেন। আগাছা তুলতে নিড়ানি দিতে ভুলতেন না। আশ্বিনে নল সংক্রান্তি, ভোরে পুকুরে ডুব দিয়ে বালিতে বানানো মাঙ্গলিক পুতুল ব্রত কিংবা তুলসিবেদীর উপরে স্বর্গদীপ দেওয়ার উপাচার- প্রভৃতি ব্রত’র প্রতিটি পালন করতেন। গ্রামে কার্তিক-অঘ্রাণে ধান কাটা হতো, তখন শুরু হতো ভিন গ্রাম থেকে মজুর আসার পালা। মজুর পেলে ধান তোলার পর রোদ খাইয়ে আঁটি বাধা আর ধান ঝাড়ার পর্ব চলত।

ধান থেকে চাল বের করার নিয়মনীতি বিশেষ করে জানত মেয়েরাই। আঁটিগুলো ঝাড়া হতো। উঠোনের চারদিক ঝাড়ানো আঁটি দিয়ে ঘিরে দেওয়া হতো। নাহলে ‘হেস’ মানে ভালো খড় দিয়ে হাতে বানানো মাদুরের মতো দেখতে জিনিস দিয়ে খুঁটি পুঁতে তা দিয়ে উঠোনের চারিদিক ঘিরে নিতো যেন ধানগুলো চারিদিকে ছড়িয়ে না যায়। আঁটিগুলো পিটিয়ে ঝাড়ানো হয়ে গেলে দু চারটে কুলো দিয়ে বাতাস করে তার থেকে খড়কুচি ধুলো উড়িয়ে দিয়ে পরিষ্কার করতে হয়, পরে সেই পরিষ্কার ধান ধামায় ভরে ভরে মরাইতে তুলে দেওয়া হতো। এসব তো দীর্ঘদিনের চর্যায় পূর্বনারীরাই জেনে এসেছেন।  খাওয়ার জন্য মাঝে মাঝে দু-চার মণ ধান বের করে চাল তৈরি করা হতো। এই প্রক্রিয়াকরণের কোনো একটি ধাপেও কিচ্ছুটি অপচয় হত না। যেমন কুলোয় বাছার সময় চাল হয়নি এমন আগড়া ধান বের করে জ্বালানি, তেল তৈরির কাজে লাগানো হয়। খড়ের আঁটি গরু দিয়ে ভালো করে মাড়িয়ে কিছুটা বিচালি করা হয় আর ভালো খড় মানুষের ঘরে ছাউনি দেওয়ার কাজে লাগানো হয়। ধান মরাই থেকে বার করে তাকে বড়ো বড়ো মেচলায় জল দিয়ে ভেজাতে হতো। তারপর কাঠের উনুনে ধান সেদ্ধ করা থেকে শুরু করে আবার জল ঢেলে একদিন ভিজিয়ে রেখে পরের দিন সেদ্ধ করা পর্যন্ত আরো এক ধাপ চলতো। ধানকে ভালো করে রোদ্দুর লাগিয়ে শুকিয়ে ঠিকমতো তৈরি করা হয়েছে কিনা সেটা মা-মাসিমারা পরীক্ষা করে দেখতেন, তারপরে ঢেঁকিতে দিয়ে ভাঙা হতো। তখন তো কোথাও ধানভাঙা কল বসেনি। এই কাজের জন্য বাড়ির শাশুড়ি বৌমা-রা থাকতই, তাছাড়া পাড়ার মেয়েদের কাউকে ডেকে আনা হতো যারা কাজটা খুব ভালো জানে। বেঁচে ছিল ধান কাটার গান, ঢেঁকিতে পাড় দেওয়ার গান। কুলোয় করে ঝাড়তে গিয়ে চাল আর চালের খুদ মানে ভাঙা দানাগুলো আলাদা করে রাখা হতো। দেখতে গেলে কৃষিকাজের কৃষ্টি শীতের সময়কার আচরণীয় কাজকে অবলম্বন করে থাকে। শীতের সকালে গ্রামবাসীদের প্রায়ই খুদের জাউ খেতে দেখা যায়। ওই সময়েই বাগানে নতুন আলুও উঠত। ছোট ছোট আলু মাঠ থেকে তুলে ধুয়ে ঝাঁটার কাঠিতে গেঁথে জাউয়ের মধ্যে ফেলে দেওয়া হতো। নারকেল কোরাও দিত, অল্প লবণও। এরপর ওই খুদ সেদ্ধ হয়ে গেলে যে  ফেণাভাতের মতো তৈরি হতো, তা খেয়েই কাজের লোকজন মাঠে যেত ধান কাটতে বা ঝাড়তে। বিশ্বেশ্বরীর মা জানতেন মাঠ থেকে সদ্য তোলা শাক-সব্জির কোনটা কেমনভাবে কতটুকু মশলায় রান্না করলে, এমনকি কতটা আঁচে ফোড়ন দিলে রান্না ভালো অথচ সুপাচ্য হয়। তিনি বুঝতেন গ্রামের ঘরে ঘরে দুধের অভাব নেই, সুতরাং মাখন-ঘি-দই তৈরি করলেই একমাত্র দুধের সদ্ব্যবহার করা যাবে আর ঘরে অর্থও আসবে। এই নারীরা বাস্তববাদীও তো ছিলেন। নারকেল গাছ থেকে তেল বানিয়ে রান্না করার পাশাপাশি বাড়তি তেলের বিনিময়ে হয়তো খানিক সর্ষের তেল বা অন্য কিছু কিনে কাঁচা টাকার বাজারি ব্যবস্থার উল্টোদিকে নিজের মত করে সুস্থিত বিনিময় ব্যবস্থা বানিয়ে নিতেন। তেলের অভাবে খড়, খোসা দিয়ে লম্ফো জ্বালিয়ে বিশ্বেশ্বরীদের পড়ার ব্যবস্থাও করতেন। তিনি জানতেন মাঠ থেকে ধান ওঠার পর জমির সাদাটে মোলায়েম মাটিই ঘর লেপার উপযুক্ত। পিতৃতন্ত্র বা পুরুষের শাসন ব্যবস্থাকে আমরা নারী-পুরুষ মিলেই শক্ত করেছি দীর্ঘদিন ধরে। স্বামীর আশ্রয়ে, অধীনে থাকা মেয়েরা সৌভাগ্যবতী বলে বিবেচিত হয়। কিন্তু সাবেক সমাজে খেটে খাওয়া বিধবা মেয়ে ‘বেচারা’ অভিধা প্রাপ্ত আজও। বিশ্বেশ্বরীর ছেলেবেলা আর তার মায়ের জীবনচর্যা কোনোদিক থেকেই পাঠকের মনে তাদের সম্পর্কে কোনোরকম অসহায়তার বোধ জাগায় না, আমরা পাঠচর্বণায় জিভ চুক চুক করে ‘আহা রে’ও বলতে পারিনা। বরং পেছনে এক মেরুদন্ডের উপস্থিতি টের পাই, যা আমাদের বাংলার নিজস্ব পরিবেশের সংস্কৃতি তৈরি করে দেয়। 

বিশ্বায়ন-উত্তর যুগ যত পুঁজি আর পণ্যকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে মেয়েদের জ্ঞান তত অকাজের বলে পরিগণিত হয়েছে। শাক-সব্জি উৎপাদন করা, ফসল তোলা, মুরগি প্রতিপালন, খই-চিঁড়ে-মুড়ি ভাজা প্রভৃতি কাজ নারীরা করলেও হাতে হাতে বিক্রি করে মূলধন পুরুষ জোগাড় করে আনে বলে সে হয় ‘কর্মী’। অথচ যুগ-যগান্ত ধরে আমাদের ঠাম্মা, দিদিমা, জেঠিমা, মায়েরা জানেন কি করে ছোটখাটো অসুখ গাছগাছড়া মশলা দিয়েই সারিয়ে দেওয়া যায়। কিভাবে বাজার না করেও কটা দিন চালিয়ে নেওয়া যায় শাকপাতায়। সাহিত্যিক ও সমাজকর্মী জয়া মিত্র এই সনাতনী জ্ঞানকে ব্যাখ্যা করেছেন ‘উত্তরকন্যা’র ধারায়। পূর্বপুরুষ থেকে উত্তর-পুরুষ পর্যন্ত যে ইতিহাস রক্ষিত হয়, নারী সেখানে ‘অপর’ হয়ে থাকে। নারীর নিজের জ্ঞানের ইতিহাস নথিবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজন। ‘অকাজের বউ’ গল্পের উদ্দিষ্ট নারী চরিত্র শহরে বাড়ি-বাড়ি কাজ করে পেট চালাতে গিয়ে একমাত্র বুঝেছিল- পাকা বাড়ি আর কাঁচা টাকার লোভে পুকুরের মাছ, উর্বর জমি, নিজের গ্রাম ছাড়লে কি ক্ষতি হতে পারে। নিজের ঘরের আম-কাঁঠাল, পেয়ারা, লেবু, ফসল থাকতে শহরে কাঁচালঙ্কাটুকুও কেন কিনে খেতে হবে তার যৌক্তিকতা সে বোঝেনি। নারীকে তার পরিবারের কথা ভাবতে হয়। স্বামী, সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখতে এক-আধটা মাছ চুরির জন্য অসহায়তা প্রকাশ করে- “এখনও তো ভয়ে ভয়ে চুপি চুপি নিইছি, কেড়ে নিইনি। মাথায় পা দিয়ে আরও বেশি চেপে দিলে শেষে হয়তো একদিন সেও করব। মরতে আর কে চায় বলো মা।” ক্ষমতার আধিপত্য আর তার পাল্টা বয়ান এভাবেই সাহিত্যে হয়ে উঠতে চায় পল্লীপ্রকৃতিকে কেন্দ্র করে। 

ঊষালতাও জানে ভাত, জমি, নিজের একটা গ্রাম থাকার  মর্ম (‘উন্নয়ন ও গ্রামের লক্ষ্মী’ গল্প)। সে তার পরিবারসহ উদ্বাস্তু হয়েছে পরপর দু’বার। প্রথমবার তথাকথিত উন্নয়নের স্বার্থে গরমেন্টের রাস্তা তৈরির জন্য জমি দখলের কারণে, দ্বিতীয়বারে বিদ্যুৎ বিভাগের হাইটেনশন তার তৈরির কারণে। স্পষ্টতই তথাকথিত উন্নয়নের মডেলে জায়গা হয়নি ঊষালতা, অকাজের বউ-এর পরিবারের মত বহু পরিবারের। ঊষা যখন তেরো বছরের, তখন মহাজনের জমিতে মা ধান রোয়ানোর কাজ করত। সাপে কাটলে মেয়েকে এসে সেই খবর না দিয়ে প্রথমে সজনে শাক আর কুচো মাছ দিয়ে ভাত খেয়ে নিতে বলেছিল। দুমুঠো ভাতের মূল্য বুঝেছিল বলেই। সেই গ্রামেই ঊষার বিয়ে হয়, সে দেখেছে কিভাবে গ্রামগুলো আর গ্রাম থাকে না, গ্রামের গোটা অর্থনীতি পাল্টে যায় তার পরিবেশের চরিত্র বদলে। বদলে যাচ্ছিল গ্রাম, পুকুর-ডোবার তলা ফেটে চাকলা মাটি উঠে আসে, শামুকের চিহ্ন থাকে না, মাঠে একগাছা শাক মেলে না। তার শাশুড়ি না খেতে পেয়ে মরে। প্রথমবারে তারা ভেবে পায়নি বসত বাড়ির পাশে এত বড় মাঠ থাকার সত্ত্বেও রাস্তা কেন তাদেরই বাড়ি উঠিয়ে যাবে। বর্ধমান না দুর্গাপুর থেকে যেন সব গাড়ি-ট্রাক সাঁই সাঁই করে বিহারে দিল্লিতে পৌঁছে যাওয়ানোর জন্য এই রাস্তা হচ্ছিল। ঊষালতাদের দলিল ছিলনা বটে কিন্তু বাড়ি-ঘর সেই কবে করেছে বাপ-ঠাকুরদারা। বুড়াবাটি, জোড়গাছা, বালিডি সহ ছয় গাঁয়ের লোকজনের বসতজমি খেয়েছিল গরমেন্টের উন্নয়ন। নতুন গ্রাম জোড়বাড়িতে ভালো লাগেনা। রাস্তার ধারে চাপাচাপি, মাটি প্রায় নেই বললেই চলে, সোজা রাস্তা, সারাদিন গাড়ি চলে। যাদের বাড়ি ভর্তি গাছ ছিল, জমির ফসল ছিল, আজ অন্যের বাড়ির আগাছা কাটতে হয়। ঊষালতার স্বামী এই করে, মাসের এক দু’দিন বাদ দিয়ে বাকি দিন বেকার থাকে। ঊষালতারা মাঠ পেরিয়ে কাজে যেত, সেই মাঠেও নতুন খুপরি কোয়ার্টার তৈরি হয়েছে। বোঝেনা সে- ইট, কাঠ কি খাওয়া যাবে? ধান চাল লাগবে যে! নতুন গ্রামকে আর গ্রাম বলা যায়না, কারখানা-ফ্যাক্টরি হয়, গায়ে লেপ্টে থাকা ঘরবাড়ি হয়। তবু সুবালা, আশা, শিবানী, উষালতা ২০০ টাকা করে গ্রাম প্রধানকে দিয়ে একফালি জমিতে নিজেদের ফসলটুকু ফলানোর ব্যবস্থা করেছিল। ধান কাটার মরশুমে ফসল কেটে নেওয়ার আর তিন দিন বাকি- এমন সময়ে গরমেন্টের ট্রাকে আসা ‘স্টোনচিপস’ ক্ষেত ঢেকে দেয়। ধানলক্ষ্মীর বুকে পাথর চাপাতে নেই, কিন্তু সরকারি বাবুর স্পষ্ট কথা- “তোমাদের মত লোকেদের বেআইনি কাজের জন্য দেশের উন্নতির কাজ আটকে থাকবে?” পেট পুরে দুটো ভাত, ছেলেপিলের সামনে ভাতের থালা ধরা- এর চেয়ে বেশি সুখ চায়নি ওরা। তবু পরিবেশ, কৃষি আর উন্নয়ন পরস্পর বিরোধী হয়ে যায়। নব্য প্রযুক্তি আসার আগে সেই কোন ভুলে যাওয়া কাল থেকে বাঙালি নারী ধানের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি যুক্ত পরিশ্রমসাধ্য প্রক্রিয়ায়।    শস্যের সঙ্গে নারীর সম্পর্ক যে অনেক পুরনো, তার খবর মায়েদের কাছ থেকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছয়৷ 

‘সূর্যের নিজের গ্রাম’ (জয়া মিত্র) কেবল সুরজের ত নয়, আমাদের ভেতরেও ‘নিজের একটা গ্রাম, নিজের একটা নদী’র জন্য আকুতি জাগিয়ে তোলে। এই ‘নিজের গ্রাম’ নিছক শব্দবন্ধ মাত্র নয়, বরং এমন কিছু যাকে আঁকড়ে থাকা যায়। এ হল এমন এক আশ্রয় যেখানে সকলেই ‘হড়’ (মানুষ), সকলের মধ্যে ‘কথাকথি’ আছে, আছে প্রচুর ‘কাঁদর’ আর ‘বতর’ হওয়া মাটি, খেজুরগাছ অবধি কানকো দিয়ে হেঁটে যাওয়া কৈ মাছ আর কাদা থেকে মাছ ধরার জন্য ফাঁদ বানানোর সংস্কৃতি। সেখানে নিয়ম করে পুকুর কাটা হয়, মাটি লেপে কাঠ দিয়ে ঘষে সুন্দর ছবি-নকশা করা হয়, সে জীবনে থাকে কৃষিসংক্রান্ত ডাকের বচন- ছড়াকাটা- গোলা থেকে ধান ঝরার কোমল দৃশ্য, কৃষি আর গো সংস্কার, এমনকি গৃহপালিত পশুগুলির খুঁটিনাটি জানার সপ্রেম আগ্রহ। কিন্তু ঘন জঙ্গল থেকে ক্ষেতজমি, ক্রমে খাদান হল। অথচ কথা তো ছিল মাটির নীচে পাথর থাকবে, মাটির ওপরে থাকবে ক্ষেত-গাছপালা-গ্রাম-নদী-পুকুর; এইরকম থাকাটাই তো নিয়ম। এরপর বহুকাল হল গাঁদাপাতা, কালমেঘের গুণ কিংবা লেবুকাঁটার গাছ তুলে তার শেকড় থেঁতো কাটা জায়গায় লাগানোর জ্ঞান মান্যতা হারিয়েছে। এযাবৎ আমাদের অভ্যাসের বদল ঘটেছে বিপুল, চাষের খরচ বেড়ে গেছে, জমিতে আর লাভ নেই। তবু আকলা, মিলিন্দ, সুরজ, তার দীনুদা আর সৈকতদা’রা জানে এমন আকালে আধশুকনো পুকুর, খেত, ঐ কাঁদর, বাঁধাঘাট, হাওয়া দেওয়া বাঁশঝাড় হারিয়ে ফেলতে নেই। সুরজ দিব্যি শুনতে পায় তার গাঁয়ের সেই ডাক ” ও সুরজ, দোতলায় কাপড়গুলো তুলে নে বাবা, ঝড় আসছে।” এই সমস্ত আখ্যান আমাদের স্মৃতি খুঁড়ে তোলা মাটির ঢিপি আর বিরাট বিরাট গর্ত ভরানোর গল্প। 

স্বয়ং সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও সংস্কৃতির এই গর্ত ভরানোর আকুতি বুঝেছিলেন। পল্লীপ্রকৃতি নিয়ে তাই তাঁর বাস্তবসম্মত চিন্তা-ভাবনা কর্মকুশলতার দিকে এগিয়েছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *