শরদিন্দু সাহা
বাংলা কথা সাহিত্যের সুপরিচিত লেখক শরদিন্দু সাহা। লেখক সত্তা ও জীবনকে বিচ্ছিন্ন করে দেখতে তিনি অভ্যস্ত নন। নিছক লেখক হওয়ার জন্য তিনি কলম ধরেননি, সামাজিক দায়বদ্ধতাই তাঁকে সৃষ্টিকর্মে উদ্বুদ্ধ করে। শৈশব থেকে সৃষ্টিশীল মন লালন করে প্রস্তুতি পর্ব সারলেও নয়ের দশকের গোড়া থেকে তাঁর লেখালেখি শুরু। এ-পর্যন্ত শতাধিক গল্প, গোটা কয়েক উপন্যাস এবং অন্যান্য গদ্য মুদ্রিত হয়েছে। দশটি উপন্যাস আর সাতটি গল্পগ্রন্থ সহ মোট গ্রন্থের সংখ্যা ষোলো। ১৯৯৮ সালে ‘কাটোয়া মহকুমা গ্রন্থাগার পুরস্কার’ পান। ২০০৪ সালে ‘পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি প্রদত্ত সোমেন চন্দ পুরস্কার’ পান। ওই বছরেই কাটোয়া লিটল ম্যাগাজিন মেলা কর্তৃক সংবর্ধিত হন। ইন্ডিয়ান অয়েল কর্তৃপক্ষ তাঁকে ‘হল্ অব্ ফেম’-এ সম্মানিত করেন। ২০০৫ সালে ‘ভাষা শহিদ বরকত স্মরণ পুরস্কার’ পান। ২০০৭ সালে সাহিত্য আকাদেমি’র আমন্ত্রণে গৌহাটিতে বাংলা-অসমীয়া গল্পকার সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। ২০১৩ সালে ‘আমি’ পত্রিকা তাঁর সাহিত্যকর্মের জন্য বিশেষ সম্মান দেন। প্রসার ভারতী’র আমন্ত্রণে নানা সময়ে সাহিত্য-সংস্কৃতি অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহণ করেছেন। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, মিলিয়ে অনেক উল্লেখযোগ্য সাহিত্য পত্রে ও ওয়েব ম্যাগাজিনে লিখে চলেছেন। ইতিমধ্যেই নিজস্ব এক ঘরানা সৃষ্টি করে তিনি পাঠকের মন জয় করেছেন।
(নিত্য সমাজ সংসারের যে স্রোত আমরা চাক্ষুষ করছি তার অন্দরমহল জুড়ে ঘুমিয়ে রয়েছে কত তো কথাকাহিনী, যার পরতে পরতে তন্দ্রাচ্ছন্ন থাকে গোপনে কত তো নারীর জীবনযন্ত্রনা, ধারক বাহক হয়ে গোটা সমাজকে যাঁরা ছাতার মতো আগলে রেখেছে, নিজের পরিচয় খুঁজে নিয়েছে, সকল ঝড়ঝঞ্ঝা থেকে দিচ্ছে মুক্তি যুগ যুগ ধরে। কয়জনের কথাই বা আমরা মনে রাখি। তাঁদের গোপন ব্যথা, অনুচ্চারিত কথা গুমড়ে মরে যায়, চোখের জল কেউ মুছিয়ে দেয় না, গণ্ডীবদ্ধ শৃঙ্খলিত জীবনই তাঁদের বেঁচে থাকার একমাত্র ভরসা। এমনই এক সাধারণ গ্রাম্য নারীর কথকতা ও চেতনায় চেনা জীবন ও সমাজপিষ্ট অব্যক্ত যন্ত্রনার পাঁচালি ‘পঞ্চমীর বারমাস্যা’ উপন্যাস।)
কইলকাতা তুন চিঠি আইছে
হোলার দুঃখে মন কাঁদে
কইলকাতা তুন আঁর হোলার মনঃকষ্টের কথা হুনি কী করি স্থির থাইকতে হারি কন চাই। যন হেথে দেশ ছাড়ি চলি যার তন খালি চিন্তা হইত কেন্নে হেতেরে পাকিস্তানের সীমানা হার করি দিই জল্লাদদের হাত তুন রক্ষা করুম। আমরা মরি মরি, একটা হোলা তো এই পিথিবীর বুকে বাঁচি থাউক। বুকের মধ্যে পাথর চাপা দিই রাইখছিলাম। যতদিন হার হই যার, যন্তন্নাটা এখন থাকি থাকি চাগাড় দিই উঠের, নাড়ী কাটার ক্ষণের চাই কম কিছু নয়। হোলার মুখটা ঝাপসা হই যার দিন দিন। হোলারে যে এমন করি হারাইত হইব সে আর বুইঝছি নি। আইজ হোলার চিঠি হাইলাম। কত ঘুরি ঘুরি এই চিঠি আইছে। এই চিঠি নাকি চাইর নম্বর চিঠি। বাকি চিঠিগুন কনডাই যাই হড়ি রইছে, কে জানে, না জানি কেউ কুটি কুটি করি ছিঁড়ি হালাইছে। আঁই নিজেও জানি না কেন্নে এই চিঠি আই আঁর হাতে হইড়ল। বড় আশ্চর্যের কতা, একটা শব্দও কাটাকুটি নাই, ক্যামনে আঁর হোলা এত সোন্দর চিঠি লেখা শিখছে। এই দুই তিন বছরে নতুন দেশে ওর মনটাও অন্যরকম হই গেছে নিশ্চয়ই। হইবার তো কতা। কত লোকের লগে জানাশোনা, মিশিমিশি। চাপা রাগের হোলা, এমনে যন কতা কয়, কতার ফুলঝুরি ছোটে। অল্প রাগ দেখাই ওর বাবা কইত টন্নি, বাক্যবাগিশ আর অন হেইসব কতা মনে করি চোয়ের জল মোছে, কয় ‘কতদিন হই গেল হোলাটার মুখ দেই না, আঁর হোলাঢারে আঁর কাছে আনি দ।’ মা বাপের লাই ওর কষ্ট আঁই বুঝি। হেথের একখান ছবি লই বার বার করি চাই থায়। একখান প্রশ্ন কইরতে ইচ্ছা করে এই জন্য দায়ী যেনারা, তেনারা কি কষ্টের ভাগ লইবার লই রাজি হইব? আঁর হোলার দুঃখটা বড্ড জ্বালায় হোড়ায়, কতদিন হই গেল বাপ মায়ের মুখ দেখে না। যারাই দেশ তুন যায়, লিশ্চয়ই জনে জনে জিগায় ‘আঁর বাপ মা ভাই বইনরে দেইখছনি তোমরা? কেমন আছে ওরা?’ চোয়ের দেয়া দেইখবার আর তো কোনো উপায় নাই। চিঠিতে হোলার কত সুখ দুঃখের কথা। মনের কথা মনেই থাই যায়।
‘মাগো মা, আজ বাদে কাইল ইয়ানে আঙ্গরে লই এক সভা হইব। আঙ্গ ইয়ানে নতুন নামে ডাকে রিফিউজি ইংরেজি নাম, আর আমরা যিয়ানে থাই, হিয়ানের নাম রিফিউজি কলোনী। কেউ বাংলা নামেও ডাকে ‘শরণার্থী’। অন্য দেশের লোক বলি লোকে অন্য চোয়ে চায়। কদ্দিন ধরি আঁই আর কাকা স্টেশনে ছিলাম, গাড়ির তুন নামি যাত্রীরা ফিরেও তাকাইত না, মানুষ বলি গইনত না, মাড়াই চলি যাইত, গরু যেইমনে ধান মাড়ায়। কারা আই খিচুড়ি দিই যাইত। পায়খানা পেচ্ছাপের গন্ধে টিকতাম হাইরতাম না। শেষমেশ কাকা আরও কজনের লগে হরামর্শ করি আমরা ইয়ান তুন অন্য জায়গায় আই উইঠলাম। ইয়ানে হোগলার ঘর বানাই অন আমরা মাথা খুঁজি রইছি। হেট ভরি খাইতাম হাই না। কনডাই যে চান করুম। কত দূরে যাই দেই রাস্তার ধারে চৌবাচ্চার জলে অনেকে চান করের। হেথাগরে কইলাম একটা মগ দিবা নি, চান করুম। মুখ ঘুরাই দেখি কইল ‘ও রিফিউজি! শহরটার বারোটা বাজিয়ে দিল। আমাদেরই থাকার জায়গা নেই, উটকো ঝামেলা এসে জুটেছে। দেশের ভাগাভাগি হওয়াতে এই দশা।’ আচ্ছা দেশটা ভাগ হইছে আঙ্গ কী দোষ। কারা ভাগ কইরছে এই দেশ, কিয়ের লাই কইরছে! জিগাইলাম দুই তিন জনেরে। আঁর কথা হুনি হাঁটা দিল। হারাদিন ধরি এর উত্তরই খুঁইজলাম। আচ্ছা, আমরা কী ইচ্ছা করি আইছি, ওরা আঙ্গরে থাইকত দিত ন, আমরা কনডাই যামু কন। কইল, ‘জাহান্নামে যাও।’ আচ্ছা, এইটা একটা কথার মতো কথা হইল। ভিজা কাপড়ে এমাথা ওমাথা কইরলাম। একটা রাস্তার হোটেলের মালিককে কইলাম, ক্ষুধা লাগছে, দুইডা ভাত দিবা নি।’ ‘ শরণার্থী শিবিরে যাও না।’ কন্নাই কন না। ‘ জানি না।’ শেষে আবার চাইতে দুমুঠো দিল। হেথাগো দোষ নাই। আঙ্গ মতো অনেক রিফুয়িজিরা ঘুরি বেড়ার। ইয়ানের পেল্লাই বাড়িঘর দেই মাথা ঘুরি যাইবার জোগাড়। উঁচা উঁচা দালানবাড়ির দরজা জানালা, এলাহি ব্যাপার । দারোয়ানের পাকানো গোঁফ, হাতে বন্দুক। সাহস করি উঁকি দিছিলাম, এমন হাঁক মাইরল, দৌড়ি হালাইতে গেলে কুকুর কামড়াই হায়ের মাংস খাবলাই নিল। বুইঝলাম এই জায়গা আঙ্গ লাই নয়। কাকা হক্বাইল হইলে কামের খোঁজে বার হইছে। হারাদিন ঘুর ঘুর করে এমাথা তুন ওমাথা কোনো কাম জোটে না। কেন জানি বাঁচার লাই আর বাঁচাইবার লাই এই দেশে আইলাম, অন উপাষ করি না মইরতে হয়। আঙ্গ দেশখানই না ভালা ছিল। কেন নিজের গ্ৰামে আঙ্গ জায়গা হইত ন, ভিটামাটি উচ্ছেদ করনের লাই উঠিপড়ি লাইগছে, ওরা সব ছোলাই ভোলাই খাইত চায়। কইলকাতার লোকেরা রোজ হোনায় ওগো ভাগে ভাগ বসাইয়ের, রাস্তাঘাট নোংরা করিয়ের। কাউরে দোষ দিই না, হয়ত ঠিকই কয়, বেবাক আঙ্গ কোয়ালের দোষ। আইজ দুইখান রুটি জুটছে কোনোমতে। থানার তুন হুলিশ আইছে। কয় আমরা নাকি জবরদখলি জমিতে ঘর বানাইছি। হক্বলে লাঠিসোঁটা লই একত্র হইলে তাড়াইত হারে ন। জমির মালিকও গুন্ডা পাঠাইছিল,মারিধরি উঠাই দিবার লাই, সুবিধা কইরত হারে ন, আঙ্গ মারকাটারি অবস্থা দেই ফেরত চলি গেছে। সাপের কামড়ে ভেদবমিতে শয়ে শয়ে লোক মারা যার, আঙ্গ হাশের ঘরের হুরা পরিবার কাইল মরি গেছে, জানি না আমরাও কবে মরি যাইয়ুম।
আঙ্গ দেশে কনও এরুম দেই ন। কাতারে কাতারে লোক। হাঁঢি হাঁঢি লোক আইয়ের। লোকের হাতে হাতে লাল রঙের ফেলাগ, কতগাইন লেখা, কতকটা হইড়তাম হারিয়ের, বাকিটা হারিয়েন না – ‘আমাদের দাবি মানতে হবে, না হইলে গদি ছাড়তে হবে।’ ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ।’ ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও।’ অবাক হই খানেক চাই থাইকলাম। লোকের আওনের কোনও বিরাম নাই। হামনের লরিতে কত বড় বড় নেতা। রাস্তার দুই হাশ তুন কত লোক বড় বড় ক্যামরা লই ছবি তোলের। এরা এসবেরে কয় শ্লোগান। এক এক জনের কথায় কত রাগ। একজন দুইজনে কয়, বাকিরা তাল দেয়। রাস্তার উপরে রেললাইন হাতা, দুই বগির গাড়ি চলে, এরা কয় ট্রামগাড়ি, বিদ্যুৎ-এ চলে। টিকিটের হয়সা নাই বিধায় কনডাক্টর ধাক্কা দিই নামাই দিছে। রাস্তার ধারে একখান বই হইড়েছিল, কে হালাইদিছে। আমনে তো জানেন, আঁই বই হইড়তে কত হছন্দ করি। বইটার হাতা উলটাই চমকাই গেছি। নামখানা বাইরের দেশের মানুষের। হইলে কী হইব। বাংলাতে লেয়া। কথাগাইন এমন করি লিখছে, যেন আঙ্গ দেশের সমইষ্যার কতা লিখছে। অত দূরের মানুষ, আঙ্গ মনের কথা জাইনল ক্যামনে! জাদু জানে মনে হইতেছে। আহা! মানুষটার যদি একবার দেখা হাইতাম। কথাগুলা বুকের মধ্যে তীরের ফলার মতো যাই বিঁধে। হুইনবেন, তবে কই – এমন এক দক্ষিণ আফ্রিকার স্বপন দেহেন তিনি, যিয়ানে সকল জাতি, হকল বর্ণের মানুষ হমান সুযোগ লই এক লগে থাইকত হাইরব। আমরা থাইকত হারি ন কিয়ের লাই কইত হারেন?
আর একখান কথা কই, কাইল এক জায়গায় গেছিলাম। কারে দেইখছি আমনে হুইনলে তাজ্জব বনি যাইবেন। কবি কাজী নজরুল ইসলামেরে দেইখলাম সামনাসামনি। কেমনে যে ঢুকি হইড়লাইম, কইতাম হাইরতাম ন। এক ইসকুলের হোলামাইরা দলবাঁধি যায়ের। জিগাইতে কইল, ‘কবিরে দেখতে যাচ্ছি।’ ভিড়ি গেলাম ওগো দলে। ওরা যাই পেন্নাম কইরল, আঁইও কইরলাম। কবি কোনও কথা কইল না, উদাস হই চাই রইল হক্বলের দিকে। ওরা আবৃত্তি কইরল ‘কান্ডারী হুঁশিয়ার’ – … অসহায় জাতি মরিছে ডূবিয়া, জানে না সন্তরন, কান্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তি পন। হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন? কান্ডারী! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার…। কবির সামনে তুন বাইরে আসি কাঁইদলাম। কেউ তো ইয়ানে নাই যে আঁরে সান্ত্বনা দিব। কইলকাতায় শয়ে শয়ে লোক, কারে মনের কথা বুঝাই কমু। হিন্দুরাও যার, মোসলমানরাও যার, সাহেব মেমরাও যার, আঙ্গ গায়ের রঙ আর হেথাগো গায়ের রঙ ধলা, আর বেবাক মাইনষের গায়ের রঙ এক রঙের। আকবরের মা চাচীর মতো কারে যেন দূর তুন দেইখলাম, হাঁঢি চলে যার গটগট করি হোলার হাত ধরি, কত ডাইকলাম, হুইনল না। দেশের কতা মনে হড়ের খুব আইজ। এই শহর জমজমাট কিন্তু আমি কাঁঠালের বাগান দেইখতাম হাই না, হাখির বাঁক হুনি না, খাল বিল কন্নাই আর দেইয়ুম। বড্ডা এক নদী আছে গঙ্গা, মেঘনা নদীর লাই হরান কাঁদে। গাছগাছড়া অলিগলিতে আছে ইয়ানে হিয়ানে ছড়াই ছিটায়, চোখ জুড়ায় না। নাই মাঠ ভর্তি সোনার ধান, মনটা হু হু করে গো মা। আমনেগো ভাইয়ের বইনের মুখ দিন দিন মুছি যার। কাকা কইছে একটা বন্দোবস্ত হইলে ইসকুলে ভর্তি করি দিম। রিফিউজিদের কষ্টের শেষ নাই। কে কারে দেয়ে। রাজশাহী খুলনা সিলেট তুন কত লোক হলাই আইছে। কত কাহিনী ওদের মুয়ে হুনি। এত অমানুষ মাইনষে ক্যামনে হয়। এক এক জনের এক এক রকম যন্তনা। আবার জায়গা লই মারামারিও হর।
মাইনষে ওই দেশ তুন এই দেশে আইছে। অনও আমরা বেড়াল কুত্তার মতো ঘুরিয়ের। ইয়ানের কারও চিন্তাধান্তা নাই। ঘর ছাড়ি হেথাগো অন্য জায়গায় থাকনের দরকার হড়ে ন। আঙ্গ লগে যারা এক লগে আইছে হেথাগো আত্মীয়দের বাড়িতে থাইকবার জায়গা জুইটছে। কাকা এক হোটেলে কাম করের। এক বাবুর হাতে পায়ে ধইরলে উনি ব্যবস্থা করি দিছে। আঁই যদি চেষ্টা চরিত্র করি কিছু জোটাইতাম হারি, কাকার চিন্তা কমে। কাকা কয় আঁরে ইসকুলে ভরতি করাইব। এত খাটাখাটনি করি কাকার শরীল ভাঙি গেছে। দিন রাইত হোগলার ঘরে মশামাছি ভ্যানভ্যান করে। আঙ্গ চেনা দুগা মাইয়া কন্নাই যে চলি গেছে, কেউ আর খুঁজি হায়েন না। কত জনে মন্দ কতা কয়। নেতারা আয় আর যায়, কত ভালা ভালা কতা হোনায়। কয় মিছিলে যাইত হইব, তার হইলে আঙ্গ ভাগ্য হালটাইব। কিছুই তো বুঝি না, একটা সমিতি হইছে, কাকারে সদস্য বানাইছে, অধিকার নাকি বুঝি নিত হইব। কই এদেশের মাইনষের তো মিছিলে যাইতে হয় না, যত দোষ আঙ্গ বেলায়! এক দেশেই তো জন্মাইছি, আঙ্গ কি দোষ? আমনে কইছেন আঁর বাবা কইলকাতায় হড়ালেখা কইরছে, অন হরদেশ হই গেল রাতারাতি। রোজ লোক মরি তার না খাই, না দাই। কী একটা চোরা জ্বর আইছে, এনারা কয় এই সকল অসুখ বিসুখ আঙ্গ লাই হর। আঙ্গ ভাষা লই এরা হাসাহাসি করে, শুদ্ধ ভাষায় কথা কয় কিনা। হুইনতেছি আঙ্গরে জমি তুন উৎখাত করনের লাগি ওরা লোক লাগাইছে। কতাটা যে হাঁচা টের হাইলাম যন লাঠিসোঁটা লই হত্যেক দিন আট দশ জন গুন্ডা আই শাঁসাইতে লাইগল, কয় উডি না যাইলে মাজা ভাঙি দিব, ঘরদোর তছনছ করি দিব। দেশ তুন ইয়ানে আইছি দাঁড়াইবার লাই, এনারা আঙ্গরে অন্য চোয়ে দেয়ের, উড়ি আই জুড়ি বইছি, আমরা এনাদের ভাগে ভাগ বসাইছি। অকথ্য গাইল দেয়। আঙ্গ মতো কত লোক, কোনো দিশা নাই, যে যিয়ানে রাস্তা হার, ঐদিকে ছোটে। খালি বাড়ি দেইখলে জোর জবরদস্তি ঢুকি যার, সরকারি জমি, মিলিটারি ব্যারাকে মাথা গোঁজের। আঙ্গরে এরা কয় বাস্তুহারা, উদ্বাস্তু, শরণার্থী, যার যেমন খুশি ডাকে, আঙ্গরে কেউ মানুষ বলি জ্ঞান করে না, বাঁকা চোয়ে চায়। সরকার আঙ্গরে ফেরত পাঠাইতে হারালে বাঁচে। একবারের লইও কারো মাথাব্যাথা নাই যে হিন্দুরা ওইদেশে থাইকত হাইরত ন, থাইকলেও হরান হাতে করি বাঁইচত হইব, আইজ না হয় কাইল দূর দূর করি তাড়াইব। মাথা নিচু করি, গলা নামাই থাইকত হইব। কানাকানি করের মাইনষে যতদিন হারের খাইবার লাই কিছু পয়সাকড়ি দিব, হরে হরে দণ্ডকারণ্যে হাডাই দিব, আবার কেউ কর বিহার, উড়িস্যা, আসামে ঠেলি দিব, এত লোক পশ্চিম বঙ্গে রাইখা হাইরত ন। স্থানীয় লোকেরা এমনিতেই মাড়াই চলি যার, ওর কর এই ভিখারির দলেরে, কদ্দিন ধরে খাওয়াইতে হইব। এই কদিন আগেও ছিলাম গঙ্গা পদ্মা মেঘনা যমুনার হক্বলে এক দেশের মানুষ, আর আইজ হই গেলাম হর, হৈর। আঙ্গ ব্যথাখান কেউ বুইঝল না মা, পূর্ব বঙ্গ না পশ্চিম বঙ্গ।
আঙ্গ কলোনীর মধ্যে একখানা ইসকুল হইছে। জায়গায় জায়গায় থাইকবার ঘর বানাই নিছে জোর করি। ইয়ানের লোকেরা নাম দিছে উদ্বাস্তু কলোনী, গালভরা নামও দিছে। মাইনষে গিজগিজ করের। খাইবার জলের দু’একখান টিউবওয়েল, খাটা পাইখানা, ছিঁড়া জামাকাপড় হরি ঘুরি বেড়ায়। বড়লোকদের বাড়িতে ফাইফরমাস খাটে, চুরিচামারি আর রোগশোকের ভয়ে কামে নিতে ভয় পায়। হেটব্যথা, জ্বরজারি, আমাশা, দাস্তবমি ঘরে ঘরে। ডাক্তার দেখাইব যে হয়সা কন্নাই। খাইবার হয়সা জোগাড় কইরত হারেন না, চিকিৎসা তো দূর অস্ত। কী কইব মা, হক্বলটাই একটা নরককুণ্ড। এখন তো হক্বলে কোমর বাঁধের সরকারের কাছে দাবিদাওয়া জানাইব। অনেক নেতা হইছে কলোনীর মাইনষে তুন বাছি বাছি নেতা বানাইছে। বাইরের নেতারা ওদের কানে মন্ত্র দেয়। ওরা ওই মন্ত্র জনে জনে হোনায়। তেনাদের হাতে পোষ্টার, ফেলাগ, ফেষ্টুন। বেড়ায় সাঁটাই দিই গেছে। এক নতুন উপদ্রব আই হাজির হইছে। সিলেট, যশোর, খুলনা, রাজশাহী, বরিশাল, নোয়াখালী আরও জেলার লোকজনের মধ্যে কেমন একটা রেষারেষি, এ ওরে কয় ছোট, ও এরে কয় বড়, বীদেশ বিভুঁইয়ে ভাষা লই, খানা লই আগ বাড়াই ঝগড়াঝাঁটি, কিলাকিলি, বড় ঘর ছোট ঘর লই ঠেলাঠেলি হাতাহাতি। কনডাই গেলে যে শান্তি হামু, বুইঝতাম হারিয়েন না। কদিন আগে কলোনীতে মিটমাট করার লাই সভা হইছে, লম্বা চওড়া ভাষণ। হেডে ভাত না থাইকলে, পায়ের তলায় স্থায়ী জমি না থাইকলে, কে আর কার কথা হোনে, আর হুইনলেও কজন আর মনে রায়, পিছনে পিছনে নানা টিপ্পনী কাটে। নেতারা তো ভাবে কত লোক ওদের কতা হোনে। আসলে যে বেগ্গাইন হুদা হুদা, বোঝেন না। আঙ্গ ভাগ্যে কবে যে ফিরব, কে জানে। কাকা আই কয়, ‘একটা খবর আছে, তোর ইসকুলে হড়ার একটা বন্দোবস্ত করি আইলাম। মন দিই এবার হড়ালেখা কইরত হইব। আঁর মালিকরে হাতে পায়ে ধরি কইলাম আঁর ভাইপোগার ইসকুলে ভর্তি করি দেন না, মাথা ভালা, আমনের বদনাম হইত ন। মনে দয়া হইল, এক কতায় রাজি হই গেল। ওঁনার হোলার ইস্কুলের হেডমাষ্টারের লগে খাতির আছে, মনে হয় হই যাইব, আর চিন্তা নাই। কোনদিকে না তাকাই লাগি হড়। মালিকের হোলার হুরান বইগুলান তোরে দিব কইছে।’ মা, চিন্তা করিয়েন না, আঁই হাশ করি চাকরি লইয়ুম। এই জঞ্জাল তুন মুক্তি হইলে বাইরে কোনো হাড়ায় একখান ঘর ভাড়া লই ভাইরে লই আইয়ুম, বোনেরে আনি ভালা একখান হোলা দেই বিয়া দিমু। আমনেগো কোনো কষ্ট হইত ন আর।’
হোলার চিঠিখান হড়ি চোয়ের জল হড়ে টপ টপ করি। ক্যামনে যে ওরে সান্ত্বনা দিই দিন রাইত খালি ওই কতাই ভাবি। ওর এত বছরের স্মৃতি মনের মধ্যে ওঠে আর হড়ে। হোলা আঁর কী খাইতে ভালোবাইসত, কেমন করি চোখমুখ কুঁচকাই কথা কইত, মিষ্টি মিষ্টি সেসব কতা। আঁই যন সিদ্ধ ধান ছড়াই উঠানে এদিক তুন ওদিক যাইতাম আঁর হোলাঢা হিছন পিছন ঘুইরত, আঁর গা ঘেঁষি ঘেঁষি হাত বুলাই দিত। ওর ওই কচি হাতের ছাপ হড়ি থাইকত ধানের গায় গায়। হেথে যন একটু বড় হইল ওই ধানের বস্তা লই চলি যাইত আধ মাইল হাঁঢি ধান কলের মিলে। ওর মনের মধ্যে কী আনন্দ ধানের মিল তুন চাল গুন যন বার হই বস্তা ভর্তি হয়। মাথায় চাপায় ঘর দূয়ারে রাখি কইত, ‘মা এই চালগুন দিই আঙ্গ কদিন যাইব?’ মাথায় কত চিন্তা ওর বাবার রোজগার নাই, বাকিদেরও ব্যবসাপাতি ভালো চইলছে না, মা কত কষ্ট করি সংসার চালায়। এমন দিন কেন আইছে, সেই কথা সময় হইলে কমু। উনুনে আঁচ দিই আঁই বই থাই, মুড়ি খই ভাজা হয়, ফটাস ফটাস ফাটে। ওর কী মজা, ভাইগোর লগে বই থায় কন বাটি ভর্তি খইমুড়ি দিমু, কম হইলে কয় ‘মা আর চাট্টি দাও’। হোলার যে আঁর হেট ভরে ন, মুখ দেইখলে বুইঝতে হাইরতাম। খাই দাই দৌড়ি চলি যাইত। ও কনডাই রাইত হারে আঁই ভালা করে জানি। বনবাদাড় গাছগাছালি ঝোপ জঙ্গলের মধ্যে ঘুরি বেড়াইতে কী রে ভালোবাসত। হিয়ালমুত্রা আদামনি গাছ তুলি আনি দিত। ও জাইনত ইদানিং হেট খারাপ হইলে খায়, এইসব জ্ঞানগম্মি বিদ্যাবুদ্ধি আঁর তুন শিখছে। পোলারে বেশিক্ষণ না দেইখলে চিন্তা হড়ি যাই কি জানি কোনো গাছের আগায় উডি দুই ডাইলের মাঝখানে মাথা দিই হুই আছে কিনা, ধড়াস করি হড়ি যাইব হুইড়ের জলে, সাপখোপে কামড়াইব, নাকেমুখে জল ঢুকি জ্বরজারি বাঁধাইব, বার্লি তো খাইতই চায় না, এই হোলারে লই আঁই কী হড়ুম। আইজ বড় দুঃখ লাগে মনে হইড়লে, এমন দিনও গেছে হোলা আঁর নাড়া কাইটত যাই মাঠ তুন ফিরি আয় ন, আঁই তো এদিকে ভাত লই বই রইচি। এই হোলারে লই আঁই কী হড়ুম। কনডিয়ার হুইড়ের হার বরাবর যে রাস্তাখান চলি গেছে, কত দিকে যে মোড় নিচ্ছে, এক মোড় যাই ধাক্কা খাইছে নমঃশূদ্র হাড়ায়, আর একটু হাঁটলেই কবিরাজ বাড়ি, আঁর ভিতর দিই একটা রাস্তা সোজা চলি গেছে অধিকারী বাড়ির দিকে। হোলাঢা যে কোনো দিকে চলি যাইত হারে, বিশ্বাস নাই। ওর ভাবুক মনে কত রে জীবন আগাপাশতলা ঘুরি ফিরি বেড়ায় আঁই কইতাম হারাতাম না। কত কিছুই না ভাবে কনডাই তুন কনডাই চলি যায় বুঝা যায় না। এইজন্যই তো ভাই বইনরা কয় ‘হাগলা ভাই’। এই হোলাডারে আঁই হাতে ধরি বনবাসে হাডাই দিলাম। মইরতাম মইরতাম, এইদেশে এক লগেই মইরতাম, মোসলমানদের হাতে, নিজের দেশের মাটিতে অস্তি মিশি গেলে যাইব। এতই যখন ঘেন্না, মারি হালাক, মনের জ্বালা জুড়াক, ওরাই ভোগ করুক হুরা দেশ। কারা চাইছে ভেন্ন দেশ, রাতারাতি যে ভাগ কইরছে, আঙ্গরে একবারের তরেও জিগাইছে আঙ্গ মত কী! কে ওদের অধীকার দিছে আঙ্গ ঘর ভাঙার, ভিটা ছাড়া করার, আঙ্গ বাপদাদার আঁর দশ পুরুষের হৌরবাড়ির ভিটা, এমন করি ভাঙ্গা যায় না ভাঙ্গা উচিত। হাতের মুঠায় হাইলে ওই নেতাগুলোর গলা টিপি দিতাম। হুনে রাখ, তোরা আঁর হোলার তুন আঁরে আলাদা কইরছস, দেশতুন কোনদিন হাইরতি ন, বাধি গাছের লাছার মতো আঁর মনের মধ্যে জোড়া লাগি আছে এই দেশ, এই গ্ৰাম, সত্য ত্রেতা দ্বাপর কলি, ঘোর কলি, কোনো কালেই হাইত্তি ন। ধম্ম লই কামড়াকামড়ি যত করবি কর, জল ধুই খা, মাইনষের মা আর দেশের মা একই, নাড়ীর টান, ছিঁড়তে হাইরতি ন, দেশের নেতারা হুনি রাখ, হিরি হিরি আইবই আইব একদিন, ভূমিকম্পে হোক, মাটি হাঁঢি হোক, কই দি গেলাম, ছোট মুয়ে বড় কতা।
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)