সোমেন চন্দ
ঠান্ডাটা আজ একটু বেশিই পড়িয়াছে, বাহিরেও কনকনে বাতাস, বেড়ার ফাঁক দিয়া সে বাতাস আসিয়া সকলের গায়ে লাগে। একপাশে একটা কুপি জ্বলিতেছে – প্রচুর ধোঁয়ায় মেশানো লাল শিখা। বাতাসে কড়া তামাকের গন্ধ। রাত এখন কটা হইয়াছে কেউ বলিতে পারে না। মাঝে মাঝে কেবল কুকুরের ডাক ছাড়া গভীর নিস্তব্ধতা চারিদিকে।
কলকেটি উপুড় করিয়া আর এক ছিলিম তামাকের আয়োজন করিতে গিয়া কানাই দেখিল, কৌটাতে তামাক নাই। হাতের কাছেই ভেজানো দরজার দিকে চাহিয়া বলিল, ‘একটু তামাক দে তো রে, দামি?’
দামিনী কানাইয়ের মেয়ে। কেবলমাত্র বাবার মুখের অদ্ভুত গল্পটার আকর্ষণেই এতরাত অবধি জাগিয়াছিল। বলিল,’তামাক তো নেই বাবা!’
– ‘সে কী, কালই না অতগুলো পাতা কাটলাম?’ খাওয়ার মালিক যদিও কানাই একাই, তবু সে আশ্চর্য না হইয়া পারিল না। সঙ্গে সঙ্গে আর সকলেও। ভয়েরও তাদের সীমা নাই; আহা, অমন গল্পটি মাটি হইয়া যাইবে।
কিন্তু দামিনী রক্ষা করিয়াছে। কোথা হইতে খুঁজিয়া পাতিয়া এক ছিলিমের উপযোগী তামাক আনিয়া বাবার হাতে ফেলিল। মেয়েটার বুদ্ধি আছে।
বিষয়টা আগে কী ছিল বলা যায় না, বর্তমানে স্বপ্নতত্ত্বে পরিণত।
অবশেষে হউঁকওটই বৃদ্ধ আদিনাথের হাতে বাড়াইয়া দিয়া কানাই বলিল, ‘ওরকম স্বপ্ন কখন দেখে বল দিকি মামা? সবকিছুই ফলবে কেন? হাতের পাঁচটা আঙুল কী সমান? আমরা যে বাপদাদা-চৌদ্দ পুরুষ ধরে চাষ করে আসছি, সব সময়েই কী ভালো ফসল পাচ্ছি? তেমনি, যা দেখবো তাই ফলতে হবে, ওরকম যে বলে, সে একটা আস্ত বোকা ছাড়া আর কী, তোমরাই বলো! আরে বাপু, এ যে আমার আর তোমার মুখের বানানো কথা নয়, এমন-এমন বই আছে যে গো! তাতে ফলাফল আছে স্পষ্ট। যা লিখেছে সব সত্যি, কিছু মিথ্যে হবার নয়, এতটুকু মিথ্যে হবার নয়।’
নির্মীলিত চক্ষু আদিনাথ সায় দিল – ‘দূর? মিথ্যে কেন হবে? যা লিখেছে সব সত্যি। তাহলে আমি একটা গল্প বলি শোনো। সেবার __’মনে মনে সকলে শঙ্কিত হইয়া উঠিল: ‘তোমারটা এখন থাক মামা, পরে শোনা যাবে। কানাইদা তারপর কী হলো?’
আদিনাথ বলিল, ‘দূর!’
চারদিকে চোখ বড় করিয়া চাহিয়া কানাই বলিল,’তারপর লোকটা নদীর পাড়ে এসে দাঁড়ালো, হুঁ, এখন পার হবে কী করে? মহামুশকিল! অথচ সেখানে বসে থাকলেও চলবে না, পার হতে হবে। কী আর করা, বসে রইলো। সময় যায়–’সময়ান্তরে কানাইর একটা অভ্যাস, দু’মিনিট চলিয়া চার মিনিট বিশ্রাম করা – এমনভাবে সে কথাটি বলিয়াছে, সকলে সমস্বরে বলিয়া উঠিল, ‘নৌকো!’
– ‘হ্যাঁ। লোকটা চেঁচিয়ে বললে, ও মাঝি, আমায় পার করে দেবে? মাঝি বললে, পারবো না। দাও না একটু? না, না, আমাদের অনেক কাজ, নলহাটির হাটে ভোরবেলাতক না পৌঁছুলে চলবে না। দাও না গো। এই ভর সন্ধেয় ঠেকেছি বলেই না। পয়সা দেবে? হুঁ মাঝি বললে কিনা, পয়সা দেবে? তা ছাড়া আর উপায় কী? সে বললে, দেবো। তখন তো পাড়ে ভিড়লো এসে। আর –’ উপসংহার করিবার মতো অত্যন্ত নীচু স্বরে কানাই বলিল, ‘আর লোকটা গিয়ে উঠলো সেই নৌকোয়।’
সব চুপচাপ। কেউ একটি কথা বলিতেছে না। সকলেই তাহার মুখের দিকে হা করিয়া তাকাইয়া রহিল। বুঝি কানাইয়ের এই বিরতি আর সহিতে না পারিয়াই একজন বলিয়া উঠিল, ‘তারপর’? কানাইয়ের মুখে এবার হাসি – বাঁ দিকের চোখটি ছোট হইয়া আসিয়াছে, বাঁ দিকের গালে রেখা আঁকিয়া গিয়াছে। সকলে জানে এ ধরনের হাসি, তাহার খারাপ। সেই উপসংহারের কথা কানাই কখন বলিবে কে জানে। হুঁকাটা আর একজনের হাতে দিয়া বৃদ্ধ আদিনাথ বলিল, ‘দূর!’
কিছুক্ষণ পরে কানাইর নীরব হাসি থামিয়াছে। সুতরাং আশা করা যায়, এবার কিছু সে বলিবে। আর বলিল ঠিকই। – ‘তারপর, বুঝলে মামা, ঠিক এমন সময় স্বপ্নটা গেল ভেঙ্গে আর তার কদিন পরেই লোকটা মারা গেল।’
–’মারা গেল!’
–’হ্যাঁ সামান্য জ্বর হয়ে মারা গেল। নৌকোর স্বপ্ন এমনি খারাপ। কেউ একবার দেখলে তো রক্ষে নেই, বুঝতে হবে, একদিনের মধ্যেই তার ভবলীলা শেষ।’
সুতার দল ভয়ে স্তব্ধ। পরস্পরের প্রতি চাহিবার সাহসও আর নাই। স্বপ্নে নৌকা দেখিলে আর রক্ষা নাই, দু’একদিনের মধ্যেই মৃত্যু। সেই লোকটার মৃত্যুর সাক্ষী ওই বয়োবৃদ্ধ কানাই নিজে, তা ছাড়া বইতেই যে লেখা আছে। অথচ এখন কানাই – কী রকম হাসিয়া হাসিয়া আলাপ করিতেছে দ্যাখো, যেন কিছুই হয় নাই তাহার, ভয় বা অস্বস্তির চিহ্ন মাত্র নাই।
শঙ্কর বলিল, ‘কানুদা, লোকটা মারাই গেল!’ কানাই তখন অন্যকথা বলিতেছে, শুনিতে পায় নাই। উত্তর দিল আদিনাথ, শঙ্করের দিকে চাহিয়া বলিল, ‘দূর’।
অর্থাৎ তোমরা ছেলেছোকরার দল এসব বিশ্বাস করবে কেন!
আঘাতটা সবচেয়ে বেশি লাগিয়াছিল, শঙ্করের মনেই। সারাক্ষণ সে প্রায় চুপ করিয়া শুনিয়াছিল, উঠিয়াও আসিল নিঃশব্দেই। কৃষ্ণপক্ষের রাত্রি, চারদিকে পিটপিটে অন্ধকার, বাতাসের শন্ শন্ শব্দ। দুইপাশে ঝোপঝাড়, গাছপালা, অন্ধকারের সঙ্গে উহাদের পার্থক্য ধরা যায় অল্প। একটি আলো দেখা যায় না কোথাও। সাপ-টাপ পড়িয়া থাকে, অন্ধকারে পা ফেলিয়া শেষে কামড় খাইয়া মরা – নাঃ এত রাত করাটা ভাল নয়। মালা হয়তো শঙ্কায় রাত্রি জাগিতেছে, নাঃ এত রাত – ! কিন্তু এত রাত কী সে আর ইচ্ছা করিয়া করে? কে জানে, নৌকার স্বপ্ন অত খারাপ। ইস লোকটা মারাই গেল শেষে!
তাহার বাড়ি যাইতে একটা জায়গা আছে, খুব নিচু, উঁচু আলে পথ সঙ্কীর্ণ, শঙ্কর সেখান দিয়াই পথ হাঁটিতেছিল। বর্ষাকালে এখানে জল হয়, এমন কী নৌকা চলাচল করে – নৌকা? স্বপ্ন দেখিতেছে না তো! নিজের চোখে মুখে গায়ে একবার হাত বুলাইয়া দেখিল শঙ্কর। না, স্বপ্ন নয়, ভাবিতেছিল শুধু। চাহিয়া দেখিল, দুইপাশ খালি, কোন ঝোপ-ঝাড় নাই, পায়ের নীচে পথের সঙ্কীর্ণতা অনুভব করা যায়।
বাড়ির একেবারেই কাছে আসিয়া পড়িয়াছে, কোথা হইতে কান্নার রোল ভাসিয়া আসিতেছে শোনা গেল। কে মারা গেল কে জানে! যে কলেরা আরম্ভ হইয়াছে, এবার গ্রামশুদ্ধ উচ্ছন্ন করিয়া দিবে। কোন সময় কার পালা আসে কে বলিতে পারে। সাপের দেহের মতো পিচ্ছিল নিস্তব্ধ রাত্রি, গাঁয়ে চৈত্রের বাতাসে আজ কান্নার সুর।
মালা ঘুমাইয়াছিল। কয়েক ডাকেও উঠিল না। মেয়েটা অমনি ঘুমকাতুরে, বেহুঁশ হইয়া ঘুমায়। এখনো শিশুসুলভ অভ্যাসটি যায় নাই, কোনোদিন যাইবে কিনা সন্দেহ। অন্যদিন হইলে শঙ্কর কতো ডাকাডাকিই করিত। দরজা ধাক্কাইয়া, চেঁচাইয়া, তারপর দরজা খুলিলে একটা যা-তা কান্ড করিয়া ছাড়িত। মালা তাহার সেই বর্বরতাকে বরং ভালবাসে, তাই বুঝি তাহার জন্য অপেক্ষা না করিয়া সকাল সকাল ঘুমায়। কিন্ত্ত আজ শঙ্করের কী জানি কেন ভালো লাগিল না, আর ডাকাডাকি না করিয়া দাওয়ার মেঝেতে নিজের গামছাখানা পাতিয়া এক ছোট পিঁড়ি শিয়রে লইয়া শুইয়া পড়িল। একটু পরেই না হয় ঘরে গিয়া শোয়া যাইবে। চৈত্রের বাতাস হা হা করে নারকেল গাছে শির্ শির্ শব্দ। মুঠা মুঠা অন্ধকারের রাশি শঙ্করকে ঘিরিয়া ধরিল। শঙ্কর ভাবিতেছিল….. কয়েকদিন পরেই চৈত্রসংক্রান্তি, সেই উপলক্ষে যে বিরাট মেলা হয় পলাশপুরে, তেমন মেলা নাকি এ অঞ্চলে আর হয় না। এবার যাওয়া যাইবে বাহিরে, মালার অনেক দিনের ইচ্ছা। কিন্তু নৌকা? নৌকা সে পাইবে কোথায়? ও পাড়ার সরকাররা তো প্রত্যেক – যারই রায়, নেহাত ধরিয়া পড়িলে তাহাদের দুজনের একটু জায়গা দিবে নাকি! দুইজন বই তা নয়। তাহাদের যে প্রকাণ্ড বড় ছয় মাল্লার নৌকা – নৌকা? দূর! কানাইদার ওটা গল্প, ওরকম স্বপ্ন তো সে কতই দেখিয়াছে, দূর! নাঃ, নৌকার স্বপ্ন তো সে কোনকালেই দেখে নাই, দেখিলে নিশ্চয়ই মরিত, তখন কোথায় থাকিত ওই মালা, কোথায় থাকিত এই ঘরবাড়ি। কিন্তু লোকটা? লোকটা মারাই গেল শেষ পর্যন্ত? সামান্য জ্বরে আবার মারা যায় নাকি কেউ? আর সামান্য জ্বর। কপালে ছিল মৃত্যু, কে ঠেকাইবে তা? নৌকা না, তেমন স্বপ্ন সে কখনও দেখে নাই, কানুদা মিথ্যা বলে না, দেখিলে নিশ্চয় সে মরিত। দূর তাহার আবার ভয় কেন? ওসমিন কালে স্বপ্নই সে দেখে না, তার – আবার – দূর!
তখনো খুব ভালো করিয়া ভোর হয় নাই। ঘুম ভাঙ্গিলে শঙ্করকে পাশে না দেখিয়া মালা আশ্চর্য হইল; কাল রাতের কথা তাহার মনে পড়িল – শঙ্কর আর বাড়ি আসে নাই। কী বুদ্ধি দ্যাখো, আমাকে একা ফেলিয়া – মালার রাগ হইল: এমন লোক লইয়া সংসার করা যায় না, নিজের স্ত্রীকে যে একা ঘরে ফেলিয়া বাহিরে কীর্তনের আসরে রাত কাটায়, তাহার সঙ্গে ঘর করা যায় না – মালা একজন পাকা গৃহিণী মতো বুদ্ধিমতী হইয়া উঠিল। কিন্তু বাহিরে আসিয়াই দুই চক্ষু স্থির। এবার হইল ভয়; হঠাৎ কী করিবে ভাবিয়া পাইল না। কিছু পরে অত্যন্ত সাহসে ভর করিয়াই তাহার গায়ে হাত দিয়া ডাকিল, ‘কত ঘুমুচ্ছে? ওঠো? আর কত ঘুমুবে?
– ‘হুঁ? কে?’ ধড়মড় করিয়া উঠিয়া শঙ্কর মালার দিকে চাহিল।
– ‘কেন ডাকছো? আমি তোমায় ডাকতে বলেছি নাকি?
কেন আমার ঘুম ভাঙালে? ঘরে খিল দিয়ে জন্মের মতো ঘুমুতে পারিসনি? কেন আবার দরদ দেখাতে এলি?
মালা ভয় পাইয়া গেল, শঙ্করের এমন মূর্তি সে কখনো দেখে নাই। একদমে অতগুলি প্রশ্ন করিয়া শঙ্কর আবার স্তব্ধ হইয়া গেল, মাটির দিকে চাহিয়া রহিল, কী এক অজানা ভয়ে সর্বাঙ্গ তাহার অবশ হইয়া আসিতেছে।
– ‘আমায় ডাকনি কেন?’
শঙ্কর আবার জ্বলিয়া উঠিল : ‘হারামজাদী, ডাক দিইনি – কে বললে? ডেকে ডেকে হয়রান হয়েছি, তবু সাড়া দিসনি, নাক ডেকে ঘুমিয়েছিস? কেন এত হেলা-ফেলা? তোর আমি সোয়ামি নই নাকি? হারামজাদী, যা আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে –’
চুপ করিয়া স্থূল ভর্ৎসনা শুনিবার মতো স্বভাব মালার নয়, রাগিয়া বলিল, ‘একা একা বাড়ি পাহারা দেবো কেন, আমার ভয় করে না বুঝি? আর এমন রাতবিরেতে বাড়ি ফিরবেন, তার জন্যে দরজা খোলা রেখে ভূতের মতো বসে থাকব আমি, ভারী মজা রে! যেন আমি একটা মানুষ নই, আমার চোখে ঘুম নেই। ‘আরও কী যেন বিড় বিড় বকিতে বকিতে সশব্দ পদক্ষেপে মালা চলিয়া গেল।
তেমনি মাটির দিকে চাহিয়া শঙ্কর বসিয়া রহিল, ভয়ে আড়ষ্ট হইয়া তাহার এমন কি কথা বলিবার শক্তিও যেন নাই। এই তো শেষ রাতে একটু ঘুম আসিয়াছিল, তাতে আবার কী স্বপ্ন – ভাবিতেও
সারা শরীর ভয়ে অসাড় হইয়া আসে। কানাই যা বলিয়াছে, তা সত্যি? সত্যি হইলে তো – শঙ্করের চিন্তার পথ রুদ্ধ হইয়া আসে। সে তো যাইতে চায় নাই, তবু জোর করিয়া লইল। কোথা হইতে আসিল নদী, কোথা হইতে আসিল নৌকা, আর সে-ও বা কী করিয়া ঠিক সেইখানেই গিয়া পড়িল, আর যত ষণ্ডা-গুন্ডা মাঝিগুলি জোর করিয়াই তাহাকে নৌকায় উঠাইয়া লইল, সে তো যাইতে চায় নাই। এখন সে মরিবে, এ তো জানা। ওমা গো, ওদিকে যে কলেরা লাগিয়াছে সারা গাঁয়ে। ভয়ে আরও সঙ্কুচিত হইয়া গেল শঙ্কর।
জল আনিতে গিয়া মালা ভাবিল, অন্যায়টা তাহার নিজেরও কম হয় নাই। সারারাত একটা লোক বাহিরে কাটাইয়াছে, শুধু তাহারই দোষে। এই ঘুমের জন্য তাহাকে আরও যে কতো কষ্ট পাইতে হইবে, তাহা সে ছাড়া আর কেহ বলিতে পারে না। তা ছাড়া, শুনিলে লোকেই বা কী বলিবে? ঘর থাকিতে এমন ভাবে সারারাত বাহিরে কাটাইতে কার না রাগ হয়, শঙ্করেরও বা দোষ কী? মনটা হয়ত আজ কিছু খারাপ কিন্তু সেই বা কেমন করিয়া অতশত বুঝিতে পারে? ওরকমভাবে গালমন্দ করিলে কার না রাগ হয়? আজ কতো বছর হইল বিবাহ হইয়াছে, অন্য স্বামীর মতো হাত তোলা দূরের কথা, একদিনের জন্যে একটু তিরস্কারও শঙ্কর তাহাকে করে নাই। এই লইয়া মনে মনে সে কতো গর্ববোধ করে, সমবয়সি বন্ধুদের কাছে সালঙ্কারে বলিয়া বেড়ায়, অথচ তাহাদের স্বামীরা, সেই তো শুনিয়াছে, তাহাদের কাছে এমন অনেক কিলটা-লাথিটা সকলেই আশা করে। নিজের বিচারে মনে মনে অপরাধ স্বীকারের গৌরবে মালার দুটি অভিমান কাতর চক্ষু উজ্জ্বল হইয়া উঠিল।
বাড়ি গিয়া বলিল, ‘কী হয়েছে তোমার আজ? মনটা ভাল নেই জানি, কেন বলবে?’
শঙ্কর তেমনি মাটির দিকে চাহিয়া আছে একদৃষ্টে, কোনো উত্তর দিল না, কেবল মুক্তি একবার উঠিইয়া তাহার দিকে ক্ষণেক চাহিয়া আবার নীচের দিকে তাকাইয়া রহিল। কলেরা যার নাম, ওরে বাবা। জীবনের প্রদীপটি সেখানে নিরাশায় তাকে তুলিয়া রাখিতে হয়। তাহার এই জীবনে সে স্বপ্ন দেখিয়াছে নাকি? সেই ব্যায়ামের কবলে পড়িয়া আবার সারিয়া উঠিয়াছে, এমন তো মনে পড়ে না। তাহার এখন উপায়? সত্যিই কী সে মরিতে চলিয়াছে? একটু নড়িয়া চড়িয়া বসিল শঙ্কর: না, কলেরা তো তাহার হয় নাই; কিন্তু আজ না হয় কাল, কাল না হয় পরশু তো হইতে পারে? তখন ঠেকাইবে কে? কেহ না। কার সাধ্য বাধা দেয়। সে যাইতে চায় নাই, তবু তাহাকে জোর করিয়া উঠাইয়া লইল। আর ভাবিতে পারে না শঙ্কর। এখন উপায়? কলেরা দিনে পেট খালি রাখিতে নাই, একথা সে কার মুখে যেন শুনিয়াছে। পেটে ক্ষুধা রাখিতে নাই? এখনও তো খায় নাই সে।
শঙ্কর উঠিয়া দাঁড়াইল।
– ‘কোথায় যাচ্ছো?’
– ‘আমায় খেতে দিবিনে? আমার খিদে পায় না?’
অন্য সময় হইলে নিজের কণ্ঠস্বরের অস্বাভাবিকতায় নিশ্চয় বিস্মিত হইত শঙ্কর।
– ‘ সে কী দেবো না কেন? রাতেও যে খাওয়া হয়নি।’
– ‘বলতে লজ্জা করে না? তুই বেশ খেয়ে আছিস, আর আমি খাইনি; তুই আমায় খেতে দিসনি – লজ্জা করে না বলতে?’
শুধু বলিতে কেন, এবার প্রতিবাদ করিতেও মালার লজ্জা করে, দুঃখ হয়, নিজের উপর রাগ হয়।
পরম তৃপ্তি সহকারেই শঙ্কর অনেকগুলি বাসি ভাত তরকারি খাইল, (ডাক্তারের নির্দেশে তো নানারকম খাদ্যাদির জাতি নিরূপণে কোনো ভেদাভেদের প্রশ্ন তাহার কাছে নাই, অথবা থাকিলেও কেহ তাহাকে সে কথা বলে নাই, তাহার কী দোষ, সে সব কথায় কে গান দিতে যায়!) যাই বলো, মালাটা রাঁধে ভালো।
মালা বলিল ‘তোমার খুব খিদে পেয়েছিলো, না?’
সজোরে মাথা নাড়িয়া এই প্রথম একটু হাসিতে গিয়া শঙ্কর কী জানি কেন হাসিতে পারিল না।
অন্য দিনে বাড়ি ফিরিতে বেলা দুটা-আড়াইটার কম হয় না, কিন্তু আজ শঙ্কর বারোটার আগেই ফিরিল। মালা রাঁধিতেছিল, উনানের আছে মুখ তাহার রাঙা ঘর্মাক্ত।
রান্নাঘরে উঁকি দিয়া শঙ্কর বলিল, ‘আব্দুল এসেছিলো?’
তাহাকে এই অসময়ে আসিতে দেখিয়া মালা তো অবাক, কিন্তু সে বিস্ময়ের ভাব চাপিয়া বলিল, ‘হ্যাঁ। কিন্তু কেন এসব।’
– ‘বারে, খাবো। অনেকদিন পরে আব্দুলের সঙ্গে যখন দেখা হল, বললাম, আজ দুধ যা হয় দিয়ে এসো আব্দুল, যা লাগে দেবো। ভাবলাম, গাই আমাদের কবেই বা বিয়োবে, কবেই বা সে দুধ খাবো? তাই কিনলাম, ভালো করিনি।’
মাথা নাড়িল মালা।
– ‘দুদিনের জন্যে সংসারে আসা, কেন খামোকা কষ্ট করতে যাবো? কষ্ট করে লাভ? আজ বাদে কাল যাবো মরে; কেউ থাকবে না –’জীবন সম্বন্ধে পরম দার্শনিক হইয়া উঠিল শঙ্কর, বলিল, ‘তবু কষ্ট করে লাভ! পরানটাকে দুঃখু দিয়ে লাভ! চাচা আপন পরান বাঁচা।’নিজের রসিকতায় নিজেই হো হো করিয়া হাসিতে লাগিল শঙ্কর, কিন্তু কতোটুকু হাসিয়াই আর পারিল না। আপন পরান বাঁচা।’ কেন? সে কী মরিতে চলিয়াছে নাকি? কে বলে সে মরিবে? লোকটা কে? কেন?
ইস্ কী রোদ! মাথা ঘুরাইয়া দিবে যেন।
শঙ্কর তাড়াতাড়ি দাওয়ায় গিয়া বসিল, হাত-পা তেমনি অসাড় হইয়া আসিতেছে, যেন বাকি নাই তাহার। রৌদ্রে খাঁ খাঁ করিতেছে সামনের উঠানটি। গাছপালা সব নেশায় বুঁদ, উহাদের পাতায় পাতায় ঝিম্ ঝিম্। নেহাৎ কিছু না হইলে মানুষ সুস্থ মস্তিষ্কে আর এরূপ বদলায় না। মালা তাহার কাণ্ড দেখিয়া আশ্চর্য হয়, আগের মতো তেমন কথা বলে না, কেবল চুপ করিয়া বসিয়া থাকে, চোখ দুটি মাঝে মাঝে দারুণ কাতর হইয়া ওঠে, কিন্তু কী খাওয়া রে বাপু! দিন নাই রাত্রি নাই – কেবল খাওয়া। দুইজনে তাহারা আর কতো খাইবে! এই তো লইয়া আসিয়াছে সেদিন এক মস্ত বোয়াল মাছ, মালা সারা জীবনেও অমন একটা আস্ত বোয়াল আর দেখে নাই, দেখিয়া সে তো অবাক, সেটা কেমন করিয়াই বা কুটিবে, অত মাছ দিয়া কী-ই-বা করিবে।
কলেরার মতো অসুখ আর আছে? শঙ্কর কোনরকমে দেহ রক্ষা করিয়া ভাবে: অতি বড়ো শত্রউরও যেন তেমন অসুখ কখনো না হয়। অথচ দ্যাখো প্রত্যেক বছরই এ গাঁয়ে তা হওয়া চাই, মজা মন্দ নয়। যাতে না হয় সেই তথ্য কী তাহারা জানে না, ইহাও আবার বলিয়া দিতে হইবে নাকি? এই তো দ্যাখো বাপু, আমার কিছুই হয় নাই, আমি সেই আমিই আছি– কেন! সেই তথ্য কী তোমাদের একবারও জানিতে ইচ্ছা হয় না? আমি সেই আমিই আছি: কিন্তু হইতে কতক্ষণ। আজ না হয় কাল হইবে। কাল না হয় পরশু। সময় তো আর উত্তীর্ণ নয়, স্বপ্নে যার সূচনা, তার শেষ নিশ্চয় আছে। সেই শেষ কখন আসিবে কে জানে। তবে আসিবে ঠিক, কানাইয়া মিথ্যা বলে না। অত কথার প্যাঁচ কেন বাপু? মৃত্যু, অর্থাৎ আমি মরিব – এই তো বলিতে চাও।
কি একজন আসিয়া খবর দিল ওপাড়ায় দীননাথ গিয়াছে মারা। সেই বৃদ্ধ দিননাথ, বুড়া বলিয়া সম্বোধন করিলে যে লোকটা লাঠি লইয়া দৌড়াইয়া আসিতো। যা মুখে আসে তাই বলিত। সেই দিননাথ গিয়াছে মারা; মড়া পুড়াইতে লোক দরকার, সে যাইবে না কী?
এতখানি বলিবার সাহস যার আছে, তাহাকে খুব একচোট মার দেওয়াই উচিত, গায়ে শক্তি থাকিলে শঙ্কর তাহাই করিত। কিন্তু উঠিবার মতো শক্তিও তাহার কোথায়? এতটুকু নড়িতে পারিতেছে না, মাথায় হাত দিয়া দেখিল, সেখানে আগুনের তাপ। শঙ্কর চেঁচাইয়া উঠিল, ‘মড়া পোড়াতে এ গাঁয়ে আর লোক নেই, আমায় কেন? ভারি দায়ে ঠেকেছি আর কি? বুড়ো যখন মরেছে, সম্পত্তি তো আর আমি পাবো না, যারা পাবে তাদের গিয়ে বলগে, যা। আমার এখানে কেন? মা এখান থেকে – দীননাথ মণ্ডলের মড়া পুড়ালে চৌদ্দ পুরুষ উদ্ধার হবে আমার। ভারী তো দায় ঠেকেছে।’
মালা তো অবাক।
দুইদিন পরের কথা। সেদিন হাটবার। এ অঞ্চলে এখানকার হাটই সবচেয়ে বড়ো। ভোর হইতে নৌকা ভিড়িতে থাকে, দুপুর বেলা হাট জমে। অজস্র লোক সমাগমে সেদিন সমস্ত গ্রামখানা গম গম করিতে থাকে।
একবার হাট করিয়া দিয়া শঙ্কর সেদিন খুব ঘুরিয়া বেড়াইল। ঘুরিয়া ঘুরিয়া কতো জিনিস খাইল। তেলেভাজা, জিলিপি, বেগুনী, ফুলুরি – সে আরও অনেক খাইয়াছে বটে, আজকার মতো আর কোনদিনও এত ভালো লাগে নাই তো, চমৎকার। পেট ভরিয়া শঙ্কর সেগুলি খাইল, কোঁচরে ভরিয়া আরও কয়েক পয়সার লইতে ভুলিল না। তারপর এক প্যাকেট সস্তা সিগারেট কিনিয়া একটি টানিতে টানিতে যখন বাড়ির পথে রওনা দিল, তখন বিকাল। সবচেয়ে ভালো লাগে বেগনী, বাড়ি গিয়া একটা সিগারেট জ্বালাইয়া শঙ্কর কোঁচরে খুলিয়া বলিল, বাঃ, একদিকে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়িয়া খাইতে তো আরও চমৎকার।
দেখিয়া মালার জিহ্বায় জল, লোভ আর সে সামলাইতে পারে না। হাত পাতিয়া বলিল, ‘আমায় দাও না?’
বিস্ময়ে শঙ্কর তাহার দিকে চাহিল, মনে হইল, মালা যেন কোনো একান্ত পরনির্ভর শিশু, আর সে তার প্রভু। মনে হইল, এমনভাবে যেন মালা তাহার কাছে কোনোদিন কিছু চায় নাই। শঙ্কর দেখিল, অল্প ঘোমটার ছায়ায় মালার দুই চোখ কোন নূতন রহস্যে ভরা।
– ‘আমাকে দেবে?’
মুচকি হাসিয়া শঙ্কর বলিল, ‘কেন দেবো? তুমি কে?’
সে কথার কোনো উত্তর না দিয়া মালা বলিল, ‘দাও না?’
– ‘ইস্ তুই আমার কে, যে তোকে দেবো?’
– ‘দাও না।’
আবার মুচকি হাসিয়া শঙ্কর সিগারেট আর বেগনী নিজের মনে খাইতে লাগিল।
মালা দেরি সহিতে পারে না, যা চায় তা না পাইলে তাহার সয় না, হঠাৎ নীচু হইয়া সে শঙ্করের কোঁচরে হাত দিয়া ফেলিল, ‘আরে, আরে’ – অমনি শঙ্কর ধরিয়া ফেলিয়াছে।
খিল্ খিল্ করিয়া মালা হাসিয়া ফেলিল।
নিজের দিকে টানিয়া শঙ্কর বলিতে লাগিল: ‘চোর ধরেছি, এখন থানায় খবর দিতে হবে। এখন কোথায় যাবি, চোর? চোর ধরেছি, চোর।’
চারিদিকে চাইয়া মালা বলিল, ‘বারে ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও বলছি। বারে।’
শঙ্কর হাসিতে লাগিল, কিছুতেই ছাড়িল না। – ‘আরও চুরি করবি, আরও?’
– ‘বারে, ছাড়ো?’
শঙ্কর হাসিতে লাগিল।
হঠাৎ ছুটিয়া গিয়া আবার কিছু দূরে দাঁড়াইয়া মালা বলিল, ‘দাও না?’
এবার শঙ্কর কোঁচরটা ভালো করিয়া খুলিয়া দিল – ‘নে নিয়ে যা।’
মালা জানে এখন তাহার চোখের যে চাউনি, সেখানে আগের দুষ্টুমি নাই তাই নির্ভয়ে অগ্রসর হইল।
শঙ্কর নাকে-মুখে ছাড়িতে লাগিল ধোঁয়া।
একটি দুটি নয়, দশ-দশটা সিগারেট। ব্যাটারা ভারী সস্তা দেয় তো।
তখন অনেক রাত্রি। চারিদিক নিস্তব্ধ।
আড় হইয়া শুইয়া হাসিতে হাসিতে মালা বলিল, ‘ভারী বাবু হয়ে গেলে যে গো,’
নাকে মুখে ধোঁয়া ছাড়িয়া শঙ্কর বলে, ‘ওটা আমার অনেক দিনের অভ্যাস, তোর জন্যেই তো বাবু হই মালা।’
– ‘আমার জন্যে’ অন্যমনস্কভাবে এই কথা বলিয়া মালা ধোঁয়ার কুন্ডলীর দিকে চাহিয়া রহিল।
তারপর হঠাৎ এক কাণ্ড।
শংকর বলিল ‘খাবি?’
– ‘কী?’ মালা আশ্চর্য।
জ্বলন্ত সিগারেটটি তাহার মুখের কাছে বাড়াইয়া শঙ্কর বলিল, ‘খা?’
মালা এবার না হাসিয়া আর পারে না। খিল্ খিল্ করিয়া হাসিয়া উঠিল। হাসিতে হাসিতে বলিল, ‘আমিও তাহলে বাবু হে যাবো নাকি গো?’
– ‘বাবু নয় বিবি।’
– ‘বিবি?’ প্রথম আস্তে তারপর খুব জোরে এক টান দিয়া মালা সিগারেট ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিল, কাশিতে কাশিতে বালিশে মুখ গুঁজিল।
শঙ্কর হাসিয়া উঠিল। হাসি থামিলে ডাকিল, ‘মালা’।
– ‘কেন গো?’
তাহার মুখের উপর আরও ঝুঁকিয়া পড়িল শঙ্কর, বিকাল, ‘মালা?’
তখন রাত শেষ হইয়া আসিয়াছে। একটু শীত শীত করে। শঙ্করের হঠাৎ ঘুম ভাঙ্গিয়া গেল, দম যেন তাহার বন্ধ হইয়া আসিতেছে। মাথার ভিতর বোঁ বোঁ করে, সেই স্বপ্নের কথা মনে পড়িয়াছে, তাড়াতাড়ি বাহিরে আসিল সে। – খামোখাই নদীর ধারে সে গিয়াছিল আর দেখা দিয়াছিল নৌকা, সে তো যাইতে চায় নাই, তবু তাহাকে জোর করিয়া উঠাইয়া লইয়াছিল।
হাত-পা তাহার দারুণ হিম হইয়া আসে, শঙ্কর আর একটু নড়িতে পারে না। এতটুকুও নড়িতে পারে না, এতটুকু শক্তি তাহার শরীরে এখন নাই। তবু তো দেখা দিল সেই মস্ত নৌকা, আর সেই মিশকালো রঙের ষণ্ডাগুণ্ডা মাঝিগুলি তাহাকে জোর করিয়াই উঠাইয়া লইল। এখন জোর করিয়াও নিঃশ্বাস ফেলিতে কষ্ট হয় তাহার : কানাই মিথ্যা বলে না, সে স্বচক্ষে দেখিয়াছে সেই লোকটাকে – সে-ও তেমনি মরিতে বসিয়াছে নাকি। সত্যি তো তাই। চেষ্টা করিয়াও শঙ্কর উঠিতে পারিল না। চীৎকার করিতে গেল, পারিল না, গলার স্বরও আজ ভয়ে পালাইয়াছে। নইলে সে চীৎকার করিয়া বলিত: ‘মালা, ও মালা, স্বপ্ন দেখে আমি মরছি, আর তুই বেঘোরে ঘুমুচ্ছিস? হারামজাদী, শীগগির আয় বলছি : আমায় মরতে দেখে তোর খুব হাসি পাচ্ছে, না। এলি।’
শঙ্কর কাঁদিয়া ফেলিল, চোখের জলে তাহার বুক ভাসিয়া গেল।
– নৌকায় সে তো যাইতে চায় নাই, তবুও তাহাকে জোর করিয়া উঠাইয়া লইয়াছিল।
চারিদিকে ভয়ংকর নিস্তব্ধতা, মাঝে মাঝে কেবল কুকুরের ডাক শোনা যায়।
মালার ঘুমটা একটু বেশীই বটে, সে এখনও বেঘোরে ঘুমাইতেছে।
মড়া পোড়ানোতে সাহায্য করিতে, আর মালাকে এই দুঃসময়ে সান্ত্বনা দিতে পরদিন সন্ধ্যায় কানাই, বৃদ্ধ আদিনাথ, আরও অনেকেই একবার আসিয়াছিল।
(পুনর্মুদ্রিত)