তুষার বরণ হালদার
লেখক পরিচিতি
(তুষার বরণ হালদার নদীয়ার আড়ংঘাটা গ্রাম থেকে স্কুল শিক্ষা শেষ করে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করেন। পি.এইচ.ডি. ডিগ্রি পান নদীয়া জেলার অসংগঠিত শিল্প ও শ্রমিকদের ওপর গবেষণা করে । গবেষণা কর্মের ওপর ভিত্তি করে দুটি বই এবং বিভিন্ন গ্রন্থ ও জার্নালে বহু প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদ কর্তৃক প্রদত্ত শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধের জন্য তিন বার পুরস্কৃত হন। এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য। বর্তমানে তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত দক্ষিণবঙ্গের একটি কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপক।)
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী (১৮৫৩-১৯৩১)
ভারতবিদ্যা চর্চার বহু উল্লেখ্য কাজের মধ্যে একটি গুরুত্বপুর্ন অবদান হল বাংলা ভাষার প্রাচীন পুঁথি চর্যাপদ আবিষ্কার, যে মহৎ কাজটি করেছেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয়। আদি নিবাস ছিল অবিভক্ত বাংলার খুলনা জেলার কুমিল্লা গ্রামে। পারিবারিক পদবী ছিল ভট্টাচার্য্য। পাণ্ডিত্যের জন্য তিনি ‘ শাস্ত্রী’ উপাধি অর্জন করেছিলেন। হরপ্রসাদ এর জন্ম অবশ্য উত্তর ২৪ পরগনার নৈহাটি তে ১৮৫৩ সালে। এই নৈহাটিতেই জন্মেছিলেন আরেক বিখ্যাত ভারতবিদ বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।হরপ্রসাদএর পিতা ছিলেন পন্ডিত রমকমল ন্যায়রত্ন । অর্থাৎ পারিবারিক সূত্রে পাণ্ডিত্যের ঐতিহ্যের ধারা বহমান ছিলো তাদের। তাঁর বরদাদাও ছিলেন ন্যায়শাস্ত্রে পারদর্শী। অল্প বয়সে পিতৃ বিয়োগ হলে তিনি এই দাদার কাছেই মানুষ হয়েছিলেন। পরবর্তী কালে তিনি শুধু বাংলার নন সমগ্র ভারতের মুখ উজ্জল করেছিলেন।
হরপ্রসাদ শিক্ষার প্রাথমিক পর্বে হরপ্রসাদ বিদ্যাসাগর মহাশয়ের টোলে অধ্যয়ন করে ছিলেন। তিনি অল্প বয়সেই ইংরেজি ভাষা রপ্ত করেছিলেন। ১৮৬৬ সালে বিদ্যাসাগর মহাশয় হরপ্রসাদকে কলকাতায় নিয়ে এসে সংস্কৃত কলেজে ক্লাস সেভেনে ভর্তি করে দেন। এই সময় তিনি থাকতেন বিদ্যাসাগরের বাড়ির ছাত্রাবাসে। কিন্তু সেই ছাত্রাবাস বন্ধ হয়ে গেলে লোকের বাড়ি ছাত্র পরিয়ে অনেক কষ্টে নিজের থাকা খাওয়ায় ব্যবস্থা করতে হয়েছিল। তাঁর কৃতিত্বের পরিচয় পাওয়া যায় তিনি সংস্কৃত কলেজ থেকে বৃত্তি সহ এন্ট্রান্স এবং প্রথম শ্রেণীতে বি. এ. পাশ করেছিলেন। এরপর ১৮৭৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম. এ. সংস্কৃতে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন। ওই একই বছরে তিনি ‘ শাস্ত্রী ‘ উপাধি প্রাপ্ত হন।
তিনি তাঁর পেশাগত জীবন শুরু করেছিলেন হেয়ার স্কুলের শিক্ষক তা দিয়ে। এরপর তিনি কিছুদিন লক্ষ্ণওনের ক্যানিং কলেজে কিছু দিন অধ্যপনা করে আবার কলকাতায় ফিরে আসেন। ১৮৯৫ সালে তিনি প্রেসিডেন্সী কলেজে সংস্কৃতের অধ্যপক নিযুক্ত হয়েছিলেন। সেই সঙ্গে তিনি সরকারের একাধিক শিক্ষা সংক্রান্ত ব্যাপারের দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন এবং সেই দায়িত্ব তিনি সফলতার সঙ্গে পালন করেছিলেন। কলকাতার বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সঙ্গেও তিনি গভীর ভাবে যুক্ত ছিলেন। এর আগে তিনি পড়াশোনা শেষ করে এশিয়াটিক সোসাইটির কর্ণধার রাজেন্দ্র লাল মিত্রের সংস্পর্শে আসেন। তাঁরই সাহচার্যে তিনি প্রাচ্যবিদ্যা অন্বেষণে বের হয়েছিলেন। রাজেন্দ্রলালএর প্রয়াণের পর তিনি পুঁথি দেখাশোনার দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। ওই সূত্র ধরে তাকে দেশের নানা জায়গায় যেতে হয়েছিলো। এইরকমই একদিন সন্ধান করে নেপালের রাজ দরবারে উপস্থিত হন। রাজার গোয়াল ঘর থেকে উদ্ধার করেন লুপ্তপ্রায় সংস্কৃত টিকা সহ ‘ চর্যাচর্যর্বিনিশ্চয় ‘। এটিই বাংলা ভাষার প্রাচীনতম গ্রন্থ।
১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে , সেখান থেকে হরপ্রসাদশাস্ত্রীর ডাক আসে। তিনি সেখানে একই সঙ্গে সংস্কৃত ও বাংলা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। বলে রাখা ভাল যে ইতিপূর্বেই ১৮৯৮ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববি দ্যালয়ের থেকে ‘মহামহোপাধ্যায় ‘ উপাধি লাভ করেছিলেন। তিনি সমসাময়িক বঙ্গদর্শন, কল্পনা, নারায়ণ, প্রবাসী, ভারতী, ভারতবর্ষ, সাহিত্য প্রভৃতি পত্রিকার নিয়মিত লেখক ছিলেন। ঐ পত্রিকা গুলোতে তিনি ভারতবিদ্যাচর্চার নানান দিক নিয়ে আলোচনা করতেন। যে গুলি সমৃদ্ধ করেছিল ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে। দুরুহ জ্ঞানের বিষয় কে সাহিত্যের সিগ্ন্ধ রসে জড়িত করে প্রকাশিত করে প্রকাশের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান লেখক। তাঁর লেখালিখির বিস্তৃত বিবরণ এ সল্প পরিসরে অসম্ভব। শুধু একটা কথা – সাহিত্যের ও সংস্কৃতির সমস্থ বিভাগই তিনি তাঁর উজ্বল মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন। এই বিশিষ্ট ভারততত্ত্ববিদ ১৯৩১ সালে দেহত্যাগ করেন।