পাঠক মিত্র

মৌনতা ভাঙে শব্দের কোলাহল

‘যখন মৌনতা ভাঙে’-শব্দগুলো শুনলেই অনেক কথাই মনে এসে যায় । যদিও মন ও মৌনতা শব্দের ফারাক আলোচনার বিষয়বস্তু নয় । তবে মৌনতার বিষয় সবার কাছে সমান নয় । আর সেই মৌনতা ভাঙার কারণও এক নয় । বিরহের মৌনতা সহজে ধরা দেয় সবার কাছে । আবার পরাজিতের মৌনতা কখনো লড়াই করার জেদ তৈরি করে । তাই মৌনতা ব্যক্তিবিশেষের বিশেষ অবস্থান।  এই মৌনতা যখন কবির ক্ষেত্রে হয়, তখন তা তাঁর সৃষ্টিকে সমৃদ্ধ করে । আর মৌনতা ভেঙেই তাঁর সৃষ্টি হয় মুখর । আসলে কবি মৌন হয় প্রকৃতির মুগ্ধতায়, মানুষের দুঃখে কষ্টে, মানুষ ও সমাজের সংকটে । যদিও কবির মৌনতা মানুষের হয়ে কথা বলার প্রাক মুহুর্ত । কবিতার শরীরে কবি মৌনতা ভেঙে তৈরি করেন শব্দের সিঁড়ি । সেই সিঁড়ির প্রতিটি স্টেপে কবির মৌনতা শব্দ তোলে । যে শব্দে ভাঙে কবির মৌনতা। 

‘আমার কবিতা রাজপথ ছেড়ে 

আবর্জনার স্তূপে, দেখা দিয়ে বলে 

হাত ধরো আজ–

কথা জমে আছে বুকে ।

আমার কবিতা কথা হারিয়েছে 

অনেক কথার মাঝে,

না’বলা কথারা কথা হয়ে বাজে

নীরব নিরন্তরে–

আমার কবিতা নগ্ন শরীরে 

দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে–

বিছানায় তার ক্লান্তি ঝরিয়ে

ফিরতে চেয়েছে নেড়ে ।

আমার কবিতা শাড়ির ভাঁজে

ছন্দ রেখেছে ভ’রে,

চোখে চোখ রেখে আমার কবিতা

কথাকলি হয়ে ঝরে–‘

কথাকলি নিয়ে কবি মানস দলপতি তাঁর শব্দে মৌনতা ভাঙেন সত্যের গান ভালবেসে । কবির জীবনের চারপাশের সত্যে সেই ভালবাসার দলিল ‘যখন মৌনতা ভাঙে’ কাব্যে ।

কবি তাঁর ভালবাসায় নীল স্বপ্নের দেশে যেতে নয়, সেই ভালবাসা দিয়ে আগুন জ্বালাতে চান । যে আগুনের স্পর্শে আসে কন্ঠে সুর, সত্যের গান । পৃথিবীর সন্ত্রস্ত সময়েও এই গানেই ভালবেসে যেতে পারে ।

 ‘পৃথিবীকে সন্ত্রস্ত করেছে ধ্বংস ভয়–

 তিনভূমিতে পশু-পথযাত্রী তবু মানুষের সিংহভাগ !

চতুর্থ ভূমিতে ধর আলো –প্রেমের আগুন জ্বালো বক্ষময়

 কন্ঠে দাও সুর–সত্যের গান গাই তোমায় ভালবেসে ।’

সত্যের গানে ভালবাসা বিকশিত হয় সকল সময়কে অতিক্রম করে । কারণ এই ভালবাসা কবির একান্তই । যেখানে কোনকিছু ফিরে পাওয়ার অভিলিপ্সা থাকে না প্রকৃতির মত । এমনকি প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কাও থাকে না । 

‘আমার ভালোবাসাকে তুমি ফিরিয়ে দিতে পারবেনা,

ওটা একান্তই আমার

বৃষ্টি ধোঁয়া আকাশ,

আমার মানবিকতার,

যেখানে অনুরাগ-অভিমান-ভালোবাসারা পুনর্বিকশিত হয়–

প্রতারিত হতে নয় ।’ 

‘নিজে না পুড়লে–অন্যকে আলো দেবে কিভাবে ?’ যে কবি এমন কথা বলেন, প্রতারণা কখনোই কোন ছাপ ফেলতে পারে না । তিনি মনে করেন ‘প্রেমই সত্য হয়ে রয় অহঙ্কারশূন্য অন্তরালে’। তাই নির্দ্বিধায় তিনি বলতে পারেন–

‘আমার হাতে দাও বাড়িয়ে হাত

শূন্যতা যত জমা আছে চার হাতে

সঞ্চিত সব ব্যাথা-বেদনা-আঘাত

অসীম শূন্যে পাঠিয়ে একসাথে ।’

আসলে কবির কাছে ভালবাসার প্রকাশ শিশু যেমন তার মায়ের ভালবাসা বোঝে ঠিক সেই রকমই । তাঁর এক কবিতায় বলছেন–

‘শিশুটাও কোল বোঝে–

হাত বাড়ালেই যায় না সবার কাছে

ভালবাসা পেলে–

ভালবাসা শিশুর মত নাচে ।’

ভালবাসা যখন শিশুর মত নাচে তখন সময়ের নানা জটিল আবর্তে ভালবাসার পথে ডাক এলেই ছুটে যেতে হয় তাঁকে আজীবন । 

‘বেঁচে থাকল–বিদ্বেষ-বিষে জারি বর্তমান 

ভবিষ্যত শুধু আশঙ্কা ভরা

অকারণ হারানোর ভয় !

এখন তুমি ডাকলেই আসতে হয় ।’

আসতে হয় । সব বৈপরীত্য যখন এক হয়ে যায় । দিন,রাত, প্রহর একাকার হয়ে যায় । সব একাকার হলেও কখন যেন রাত্রি জড়িয়ে যায় । নিঃশব্দ শব্দের কোলাহলে সকল বৈপরীত্য একাকার হয়ে যায়।

‘তারপর, রাত্রির সাথে সহবাস 

শব্দেরা কিলবিল করে–দ্বিতীয় প্রহরের পাখিটা নির্দিষ্ট 

লয়ে বারবার বলে ‘ঘুমিয়ে পড়’

ঘুম আসে না তবু..

ভোর চাই না, রাত্রিকেই জাপটে রাখি ধরে 

চরম বৈপরীত্যে প্রেম আর যন্ত্রণা–

কেমন সমার্থক হয়ে যায় !-‘

নিঃশব্দ শব্দের কোলাহলে শব্দে মাতাল বা মাতাল শব্দে কবি খেলা করে সহস্র শব্দে । সেই খেলা চলবে তখনই যখন থাকে চোখের মত মুক্ত আকাশ ।

‘মাতাল হতে পার শব্দ নেশায়

শব্দ নেশায় সাথী হতে পারি আমিও 

আমিও খেলতে পারি সহস্র শব্দে–

তোমার এক আকাশ চোখে ।’

শব্দ খেলার মাঠে কবি বিশ্বাস ভাঙার শব্দকে অনুভব করতে পারে । তবুও শব্দের মধ্যেই সমঝোতা করে অন্তর-ভাঙা আর্তনাদ ।

‘বিচিত্র সব শব্দ সমারোহে 

শব্দকে ধরে রাখি শব্দের এককে ।

মিশ্র সব শব্দের সমঝোতা হয়ে যায়,

কেবল অন্তর-ভাঙা আর্তনাদে–

বিশ্বাস ভাঙার-শব্দ লুকিয়ে থাকে নৈঃশব্দের ভিতরে ।’

বিশ্বাস ভাঙার শব্দকে আরো বাড়িয়ে তোলে কাম-মোহ-মাৎসর্যের দাপট । সেই দাপটে ধ্বংস হয়ে যায় প্রেমনীড় যা প্রেমকে বিদ্রুপ করে । প্রেমকে যতই ধ্বংস করুক না কেন, সমস্ত ভাঙা-গড়ার দ্বন্দ্বে কবি নিজেকে আমিত্বহীন করতে পারেন যা কবিকে অনায়াসে অবসাদহীন করে তোলে । 

‘ভাঙা গড়ার দ্বান্বিক প্রক্রিয়ার পথে 

আমার আমি যখন মুহূর্তে আমিত্বহীন 

তখনই আমি যথার্থ অবসাদহীন-‘

অবসাদহীন অবস্থায় পরস্পরের ভালবাসা দিতে পারে অনেককিছু যেমন তৃপ্তি থাকে নদী ও সাগরের মোহনায় । কবি বলছেন–

‘সাগরের কাছে সবকিছু বিলিয়ে দিতে–

মোহনায় মিশে যায় নদী ।

ভালবাসা দিতে পারে অনেককিছু, নিঃশর্তে নীরবে নিভৃতে 

পরস্পরে ।’

নিঃশর্ত নীরব ভালবাসা সত্য । সত্য সুন্দর কিন্তু কঠিন । সত্য জানান দেয় তার উপস্থিতি কখনো সময়ের আপেক্ষিক অন্তিম অবস্থানে ।  

‘সত্য বড় কঠোর কঠিন, সত্য বড় সহ্যের গুন

সত্য বড় সুন্দর বটে, সত্য তুমি সৃষ্টি আগুন!

সেই সৃষ্টির আগুনে তুমি থেকো–

থেকো গল্পের উপসংহারে ।’

মৌনতা ভাঙে সব গল্পের উপসংহারে । জীবন গল্পের পর্বে পর্বে প্রতিটি খন্ড সময়ের খন্ডিত ধারাবাহিকতায়  জড়িয়ে থাকে ভালো মন্দ । মন্দ সময় মানেই দুঃসময় তা কিন্তু কবি মনে করেন নি । তিনি মনে করেন সব ঘটনায় প্রকৃতি তার সাক্ষ্য বহন করে । কবি মনে করেন প্রকৃতি ও পৃথিবীর মৌনতা বলে কিছু নেই। সবই ত চলমান । চলমান পৃথিবীর কাছে স্থির হয়ে মাটির কাছে থাকাটাই মৌনতা ভাঙার পথ তৈরি হয় । কবি সেই পথেই সময়কে দেখতে পান । কবির কথায়–

‘এই তো সময় ! না, একে দুঃসময় ভেবো না

বরং সবসময়ই জেনো, পৃথিবী স্তব্ধ নয়–

ঘূর্ণায়মান সেই বৃত্তে তুমিও আছো

ঘাম রক্ত শ্রমে সিক্ত একমুঠো মাটি হাতে 

শুধু স্থির হয়ে থেকো–

সবুজের মাটি, ফসলের মাটি, সৌরভের মাটি ।’

যখন মৌনতা ভাঙে

মানস দলপতি 

আর্টিস্টিক ইম্প্রেশন 

কলকাতা-৯

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *