মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস

তৃতীয় পর্ব 

আমাদের ছাত থেকে দৃশ্যমান তিনতলা বাড়িতে প্রবেশের সরু গলি

আমাদের বাড়ির উল্টো দিকের যে তিনতলা বাড়ির কথা আগের পর্বে উল্লেখ করেছি, তার একতলার সামনের অংশে ছিল তিনটি দোকান ঘর। পাশের সরু গলিপথে ভেতর বাড়িতে প্রবেশ করা যেত। সেই বাড়ির নানা তলায় নানা পরিবারের বাস ছিল।  

রণজিৎ জেঠার চায়ের দোকানের পাশে ছিল সুরেশ জেঠার সোনার দোকান, যেটা এখন জেঠার ছেলের হাতে ৷ ওই দোকানেও মাঝে মাঝে ক্রেতা বিক্রেতার মধ্যে ঝামেলা লেগে থাকত৷ সেটা আমাদের মতো অল্পবয়সীদের মাথা ঘামাবার বিষয় ছিলনা।আমার উৎসাহ বরং তার পাশের দোকানটি নিয়ে ৷ অনেক ছোটবেলায় দেখেছি মনিজেঠাকে ওই দোকানে রেডিও বিক্রি করতে ও সারাতে ৷ মনে পড়ছে, তারপর চা পাতা বিক্রি করতেও দেখেছি ৷ তারপর দেখলাম জেঠা মাইক ও সাউন্ড সিস্টেম ইত্যাদি ভাড়া দেবার ব্যবসাতে নামলেন ৷ তখন বেশ সকাল সন্ধ্যে পাড়া মুখরিত হত নানান গানে ৷ ততদিনে স্কুল ছাড়িয়ে কলেজ প্রায় ৷ মনে রঙ ধরছে ৷ রোমান্টিক গানগুলো যে স্বাভাবিক ভাবেই বড় ভাল লাগত বলাই বাহুল্য ৷ পরবর্তী কালে মনিজেঠা আবার ব্যবসা পাল্টাতে ওই বক্স মাইকদের চুপচাপ পড়ে থাকতে দেখেছি।

অল্প বয়সের দুষ্টু বুদ্ধিতে একটা ছড়া নিজের ডায়েরিতেই চুপচাপ লিখে রেখে ছিলাম। 

‘ননীর মাইক ভারি অমায়িক,

বাজে না কখনও ভুলে,

সেই দেখে ভাই, ননী বড় রেগে

মাইকটা রাখে তুলে ৷’

এরপর দীর্ঘদিন দেখেছিলাম জেঠা লটারি টিকিটের ব্যবসা করতেন ৷ ওই বাড়ির‌ই এক তলায় ভেতরের অংশে সপরিবারে থাকতেন অনেক অনেক বছর। পরে ওখানের বাস উঠিয়ে কাছাকাছি অন্য বাড়িতে চলে যান‌।

ওই বাড়ির‌ই তিনতলার এক বাসিন্দার সাথে আমার প্রথাগত শিক্ষারম্ভের যোগ, যে শিক্ষা আমায় আজ স্বনির্ভর ও‌ চিন্তাশীল করেছে।

কল্যাণী মৈত্র যে হিন্দু বালিকা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা ছিলেন তা আমার জানা ছিল কি না মনে নেই, তবে পাড়ার সব ছোটরা তাঁকে দিদুভাই বলতাম। সেই যে কবে স্বামীকে হারিয়ে সাদা শাড়ি ধরেছিলেন জানি না। প্রাইমারি স্কুলে পড়াতেন, দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছিল। একা মানুষটি তিনতলার একটি ঘরে ভাড়া থাকতেন। আটপৌরে শাড়ি পরা, হাতে থাকতো গোল হ্যান্ডেল‌ওয়ালা কাপড়ের ব্যাগ না কি বটুয়া, তাও আজ ঝাপসা। কিন্তু ঝাপসা নয় তাঁর অগাধ স্নেহ আমাদের সব ছোটোদের জন্য।

তখনকার দিনের বাড়ি যেমন হতো আর কি, মূল ঘরগুলোর দুদিকেই লম্বা চ‌ওড়া টানা বারান্দা। সেই সামনের বারান্দা সব ভাড়াটের। কিন্তু পেছনের অংশটা দুভাগে পার্টিশন করা। দুই ভাড়াটের রান্নার ব্যবস্থা যার যার দিকে। দিদুভাইও তাঁর একখানা ঘর আর পেছনের বারান্দার অংশে পরিপাটি করে থাকতেন। বাসিন্দাদের পেছনের দিক হলেও আসলে সেটা কিন্তু বড় রাস্তার দিকে ছিল। আমাদের বাড়ি থেকে রাস্তার উল্টো দিকে এই রান্নাঘরের দিকটা দেখা যেত। 

একটা খাট, ঠাকুরের আসন, একটা টিভি নিয়ে কি অনাড়ম্বর জীবন ছিল তাঁর ! বারান্দার অংশে কাঠের একটা ছোটো ঘেরাটোপে তাঁর তোলা জলে হাত মুখ ধোয়ার, স্নানের ব্যবস্থা ছিল। কারণ পাঁচ ছয় ঘর ভাড়াটের জন্য এক তলায় কুয়োতলা ও বাথরুম ছিল। ওনার পক্ষে বারবার ওঠানামা বোধ হয় সম্ভব হতো না‌।

যাই হোক, একদিন বাবা বা মা জানালো দিদুভাইয়ের কাছে আমাকে স্লেট পেন্সিল আর বর্ণপরিচয় নিয়ে যেতে। আমার না কি পরীক্ষা হবে। 

ততদিনে ঘরে অক্ষর পরিচয়, বানান আর নামতা শেখা হয়ে গেছে। গুটি গুটি পায়ে দিদুভাইয়ের কাছে গেলাম। আমাকে কয়েকটা বানান লিখতে দিলেন, আর নামতা বোধ হয়। তারপর বাড়ি চলে যেতে বললেন। পরে বুঝলাম আমাকে হিন্দু বালিকা প্রাথমিকে পড়তে যেতে হবে। দিদুভাইয়ের কাছে admission test দিয়ে পাশ করে গেছি। এখনকার দিনে এমন test কারো হয় কি না জানি না। তবে আমার এমনই হয়েছিল। 

ভোর ভোর উঠে স্কুলে যাওয়া। কয়েকদিন মায়ের সাথে যাওয়ার পর দিদুভাই মাকে বারণ করে দিলেন যেতে। ওনার সাথে তারপর অনেক দিন স্কুলে গেছি, যতদিন না যথেষ্ট বন্ধু বান্ধব জোটে, আর আগে আগে পৌঁছে প্রেয়ারের আগে কুমীরডাঙা খেলার ঝোঁক চেপে ধরে। তখন পাড়ার বন্ধুরাই লাফিয়ে লাফিয়ে স্কুলে চলে যেতাম।

দিদুভাই স্কুলে দিদিমণি। বাড়িতে কিন্তু দেদার প্রশ্রয়ের মানুষ। ওনার ঘরে যখন তখন টিভি দেখার ভিড়ে আমিও থাকতাম। এই নেশার জন্য বাবার কাছে যথেষ্ট তিরস্কার সহ্য করতে হয়েছিল। 

ওনার নাতনিরা এলে আরও মজা হতো। পাড়ার সত্যময় পাঠাগারে ওনার কার্ড ছিল। ও বাড়ির আরেক বাসিন্দা ছোড়দির সাথে সেই কার্ড নিয়ে প্রথম লাইব্রেরি যাওয়া আর ব‌ই তুলে পড়া অন্যতম সুখস্মৃতি।

কল্যাণী দিদিমণি ভক্তিমতি নারী ছিলেন। দীর্ঘদিন হিন্দু বালিকা বিদ্যালয়ের সরস্বতীর পূজার ভোগ, আর গোপালবাড়ি দুর্গা মায়ের ভোগ রাঁধার দায়িত্ব মাথায় তুলে নিয়ে নিষ্ঠার সাথে পালন করেছেন। অবশ্যই এইসব ছবি আমার মনে আজ‌ও ভাসে।

খুব বেড়াতে ভালোবাসতেন। নানা তীর্থ ভ্রমণ করে এসে সেই সব গল্প শোনাতেন। স্বভাবতই তখনকার সাধারণ গৃহস্থের এত ঘোরার সুযোগ ছিল না। তাঁর এই গল্প মা কাকীমারা খুব উপভোগ করতেন।

অনেক বয়স হয়ে যাবার পর স্বাভাবিক ভাবেই দিদুভাইয়ের বড় মেয়ে যিনি নিজেও হাসপাতালের নার্স ছিলেন, মা কে নিজের বাড়ি নিয়ে গিয়ে রাখেন। সেই বাড়িতে অন্নপূর্ণা পূজায় বছর বছর এ পাড়ার সকলেই পাত পেতে ভোগ খেতাম। তা ভোলার নয়। 

সকলের প্রিয়জন কল্যাণী দিদিমণির কোনো ছবি আমার কাছে নেই। সাদা সুতি বা অরগ্যান্ডির সুতোয় ফুল তোলা শাড়িপরা সেই স্নেহময়ী নারী আজ‌ও আমার মনের সিন্দুকে পোর্ট্রেট হয়ে আছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *