তুষার বরণ হালদার
লেখক পরিচিতি
(তুষার বরণ হালদার নদীয়ার আড়ংঘাটা গ্রাম থেকে স্কুল শিক্ষা শেষ করে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করেন। পি.এইচ.ডি. ডিগ্রি পান নদীয়া জেলার অসংগঠিত শিল্প ও শ্রমিকদের ওপর গবেষণা করে । গবেষণা কর্মের ওপর ভিত্তি করে দুটি বই এবং বিভিন্ন গ্রন্থ ও জার্নালে বহু প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদ কর্তৃক প্রদত্ত শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধের জন্য তিন বার পুরস্কৃত হন। এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য। বর্তমানে তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত দক্ষিণবঙ্গের একটি কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপক।)
রমেশ চন্দ্র দত্ত (১৮৪৮-১৯০৯)
ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস এর উজ্জ্বল নক্ষত্র, ব্রিটিশ শাসনে ভারতীয় দের মধ্যে প্রথম বিভাগীয় কমিশনারের মতো উচ্চপদে দায়িত্ব পাওয়া ব্যক্তি, ব্রিটিশ ভারতের উচ্চশির জাতীয়তাবাদী অর্থনীতিবিদ ও ঐতিহাসিক, ভিনসেন্ট স্মিথের সহপাঠী এবং ভারতবিদ্যাচর্চার অগ্রণী পুরুষ রমেশ চন্দ্র দত্ত, যিনি Dr. R.C.Dutt নামেই সারস্বত্ত সমাজে অধিক পরিচিত। আবার কর্মজীবনে ব্রিটিশ শাসনে বাঙালী প্রজাদের দুর্দশা দেখে তিনিই ছদ্মনামে ১৮৭৪ সালে লেখেন The Peasantry of Bengal. আবার স্বদেশ প্রেমে উদ্ধুদ্ধ এই রমেশচন্দ্র অবসরের নির্দিষ্ট সময়ের নয় বছরের আগেই সরকারী চাকরী থেকে অব্যাহতি নেন। কারণ সরকারি আমলা হিসাবে ইচ্ছামতো সাহিত্য চর্চা ও দেশের কাজ করা যাবে না।
এমনিই এক বিরাট চরিত্রের মানুষ রমেশচন্দ্র জন্মেছিলেন পুরনো কলকাতার রামবাগানের বিখ্যাত দত্ত পরিবারে ১৮৪৮ সালের ১৩ আগস্ট। পিতা ঈশান চন্দ্র ছিলেন ডেপুটি কালেক্টর। রমেশচন্দ্রের প্রথম পাঠ হেয়ার স্কুলে। মাত্র ১৫ বছর বয়সেই তিনি পিতা – মাতা উভয়কেই হারান। যাইহোক এন্ট্রান্স পাশ করার পর ১৮৬৬ সালে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফ. এ. পাশ করেন। প্রেসিডেন্সিতে পড়ার সময়ই তিনি বাড়ির রক্ষনশীলতাকে অগ্রাহ্য করে দুই বন্ধুর সাথে বিলেতে আই. সি. এস. পড়ার জন্য পাড়ি দিয়েছিলেন। ১৮৭১ সালে তিনি আই.সি.এস. শেষ পরীক্ষায় দ্বিতীয় হয়ে ছিলেন। একই বছরে তিনি ইনার টেম্পল থেকে বার এট ল হয়ে দেশে ফিরে এসে কিছু দিন নানা জায়গায় জেলা শাষকের দ্বায়িত্ব পালন করে বর্ধমান বিভাগের কমিশনার নিযুক্ত হন। কর্মজীবনে তিনি কিছুদিন উড়িষ্যা তে কমিশনার হিসাবে ছিলেন।
একথা মনে রাখতে হবে সরকারি চাকরি তাঁকে দেশের সাধারণ মানুষের অবস্থা, তাঁদের দুঃক্ষ – কষ্ট প্রভৃতি বুঝতে সাহায্য করেছিলো। অবসরের পর তিন বছরের জন্য তিনি লন্ডন ইউনিভার্সিটি কলেজ ভারতীয় ইতিহাসের অধ্যাপক পদে নিযুক্ত হয়ে ভারতবিদ্যাচর্চার সঙ্গে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ও সেখানকার জনসাধারনের মধ্যে ভারতবাসীরা যাতে নায্য অধিকার পান সে বিষয়ে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন।
১৯০০ সালে দেশে ফিরে এসে দুর্ভিক্ষ ও মহামারী প্রতিকারের আন্দোলন শুরু করেন। সরকারী আমলা হিসাবে তাঁর অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তিনি ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে দুটি তথ্য সমৃদ্ধ বই রচনা করেছিলেন, যার প্রচার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। একটি ছিলো Economic History of India: 1757-1837 এবং India in Victorian Age : 1837-1900. এছাড়াও পিতৃবন্ধু সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের উপদেশে বাংলা ভাষায় লিখেছিলেন: ‘ বঙ্গবিজেতা ‘, ‘ মাধবীকঙ্কন ‘, ‘ মহারাষ্ট্র জীবন প্রভাত ‘, ‘ রাজপুত জীবন সন্ধ্যা ‘ মতো অসাধারণ ঐতিহাসিক উপন্যাসগুলি। বিখ্যাত জার্মান ভারতবিদ্যাচর্চাবিদ মনিষী ম্যাকসমুলার দীর্ঘ চব্বিশ বছরের পরিশ্রমে সায়ন ভাষ্য সহ সমগ্র ঋকবেদ ছয় খন্ডে সম্পদনা করে প্রকাশ করেছিলেন। তারপর সেই মহাগ্রন্থ প্রথম ভারতীয় হিসাবে রমেশ চন্দ্র দুই বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমে বাংলা ভাষায় ‘ঋকবেদ সংহিতা ‘ নামে অনুবাদ করেছিলাম। এমনকি মহাভারতের সম্পুর্ন উপাখ্যান ইংরেজীতে রচনা করেছিলেন। যার ভূমিকা লিখেছিলেন স্বয়ং ম্যাক্সমুলার সাহেব। হিন্দুশাস্ত্রের মূল কথাগুলি সহজ করে জনসাধারনের মধ্যে প্রচারের জন্য তিনি ‘ হিন্দুশাস্ত্র ‘ নামে এক গ্রন্থমালা প্রবর্তন করে ছিলেন। এর পাশাপাশি তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের প্রথম সভাপতি নিযুক্ত হয়েছিলেন।
রমেশ চন্দ্র শেষ জীবনে বোরোদার মহারাজের আমন্ত্রণে সেখানকার রাজস্বমন্ত্রী হিসাবে নিযুক্ত হয়ে প্রশাসনকে জনউন্নয়নমুখী করে তুলতে অগ্রণী ভুমিকা পালন করেছিলেন। একই সময়ে ব্রিটিশ সরকারের নানা কল্যাণকর কাজে তিনি উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
এবারে এই বিশিষ্ঠ ভারততত্ববিদের গ্রহণযোগ্যতার একটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরা যেতে পারে,যে ব্যাপারটা আমরা অনেকেই জানি না। আমরা ইতিপূর্বেই তাঁর ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাসের উপর লিখিত বিখ্যাত বইয়ের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। যেখানে তিনি ব্রিটিশ সরকারের নীতিগুলো কে তীব্র সমালোচনায় জর্জরিত করেছেন। ভারতে ব্রিটিশ সরকারের অ – ব্রিটিশ সুলভ শাষনের যে তীব্র সমালোচনায় বিদ্ধ করেছিলেন তা বড়লাট লর্ড ন্যাথানিয়েল কার্জনের গোচরে আসে। তিনি রমেশচন্দ্র দত্তের লেখা গুলিকে ভালো করে পাঠ করেছিলেন। কার্জন সাহেব কিন্তু এই নেটিভ ইন্ডিয়ান এর প্রতি কোনো রকম বিষেদাগার প্রকাশ করেননি, বা তাঁকে কোনো রূপ শাস্তি দেননি ব্রিটিশ শাসনের তীব্র সমালোচনা করা সত্বেও। কার্জন একটি দীর্ঘ চিঠি লিখেছিলেন রমেশ চন্দ্র কে, যেখানে তিনি রমেশ চন্দ্রের বক্তব্যগুলিকে পাল্টা যুক্তি দিয়ে খন্ডন করেছিলেন। পাঠক ভাবুন, আজকের দিনে এমন ঘটনা কল্পনাও করা হয় না। এই রকম ঘটলে সেই ব্যক্তির সোজা হাজতবাস, নয়তো মন্তব্য প্রত্যাহারের জন্য হুমকি প্রদর্শন অনিবার্য। কিন্তু কার্জনের মতো একজন ঘোর সাম্রাজ্যবাদী শাসক গুণী মানুষের বক্তব্যের কদর করেছিলেন। সাহেবদের সবই যে খারাপ এমনটা যারা ভাবেন তারা ইতিহাস সম্পর্কে ওয়াকবহাল নন।এই বিশিষ্ট ভারতবিদ্যাবিশারদ আর. সি. দত্ত ১৯০৯ সালে ইহ জগত ছেড়ে চলে যান। প্রয়াণের পর তাঁর মানসকন্যাতুল্য ভগিনি নিবেদিতা তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে Modern Rivew পত্রিকাতে এক দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছিলেন। রবীন্দ্র নাথ যথার্থই লিখেছিলেন: ” তাহার চরিত্রে প্রাণের বেগের সঙ্গে অপ্রমত্ততার যে সম্মিলন ছিল তাহা এখনকার কাছে দুর্লভ। তাহার সেই প্রচুর প্রাণশক্তি তাহাকে দেশহিতকর বিচিত্র কর্মে প্রবৃত্ত করিয়াছে, অথচ সে শক্তি কোথাও অপনার মর্যাদা লঙ্ঘন করে নাই। কি সাহিত্যে, কি রাজকার্যে, কি দেশহিতে, সর্বত্রই তাহার উদ্যমপূর্ণ বেগে ধাবিত হইয়া গেছে ……।”