তাপস সরকার

লেখক পরিচিতি 

( সৃজনশীল সাহিত্য কর্মে নিয়োজিত কিশোর  বয়স থেকেই। প্রথম পঠিত গ্রন্থ রামায়ণ, মহাভারত ও গীতা। গদ্যসাহিত্য ও উপন্যাসেই সাবলীল। যদিও শতাধিক গল্প ও দশ-বারোটি উপন্যাসের রচয়িতা কিন্তু সেসব হারিয়ে গেছে অপ্রীতিকর কারণে। প্রিয় বিষয় মহাকাশবিদ্যা। কল্পবিজ্ঞান ও কিশোর সাহিত্য প্রিয় লেখা।কিছু গল্প নব্বইয়ের দশকে বাণিজ্যিক ও অবাণিজ্যিক পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত। উন্মীলন নামে প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকায় নিজের গল্প ও দুটি উপন্যাস ছাপা হলেও সেই উদ্যোগ থেমে যায়।প্রতিভাস সাহিত্য ম্যাগাজিন চলছে পনের বছর যা মায়ের নামে। সেখানে মায়ের উদ্দেশ্যে নিবেদিত লেখা স্মৃতিচিত্রণ ও বেশ কিছু ছোটগল্প। নব্বইয়ের দশকে কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে কিছুদিন লিটল ম্যাগাজিন গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত থেকে জেলায় জেলায় সাহিত্য আসরে ঘোরাঘুরি। বিশ্বকে নিজের ঘর বলে ভাবতে অভ্যস্ত। মায়ের মৃত্যুর পর অবসাদে দীর্ঘদিন লেখায় বিরত। তারপর আবার লেখা শুরু কিশোর সাহিত্য ‘গাছবাড়ির বাসিন্দা ‘ দিয়ে। পাঁচ বছরের প্রচেষ্টায় কোভিড পরিস্থিতিতে লেখা ইংরেজি ভাষায় ‘ইটস মাই আইল্যান্ড ‘ প্রকাশের অপেক্ষায়। স্বউদ্যোগে প্রকাশিত একমাত্র উপন্যাস ‘অন্তরালোকে ‘ নিজের জীবনের এক বিশেষ অধ্যায় ও মাকে নিয়ে লেখা। ভারতীয় প্রাচীন দর্শনের ওপর একনিষ্ঠ বিশ্বাস ও আধুনিক প্রযুক্তির ওপর বিরক্তি  ‘অনন্ত জীবন ‘ উপন্যাসের পাতায় পাতায় প্রতিফলিত। পেশায় অর্থনীতি বিষয়ের অধ্যাপক। ) 

মূলাংশ       

(মরজগতে মানুষ চলেছে অমরত্বের সন্ধানে। অনাদি অতীত থেকে তার এই যাত্রারম্ভ। অনন্ত জীবন তারই এক প্রকাশ। তাই অমৃতের অধিকার নিয়ে সুরাসুরে এত অশান্তি, কারণ অমৃত নাকি অমর করে। অমরত্বের ব্যাখ্যা আবার দ্বিধাবিভক্ত, দৈহিক অমরত্ব এবং আধ্যাত্মিক অমরত্ব। দানব ও সর্বসাধারণ বোঝে প্রথম মতবাদটিকেই। কোনটি সঠিক? সবাই ছোটবেলায় হারিয়ে যায় মানুষের মেলাতে, সেখানে সে বন্ধু খুঁজে পায় যাকে সে তাকে হাত বাড়িয়ে দেয়, বোঝাতে চায় মানুষ ও বিশ্বজগতের উদ্দেশ্যবিধেয়। যে তাকে চেনে সে বোঝে সব। শৈবাঙ্কন আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর সভ্যতাকে অস্বীকার করে চলে যায় স্পিতি ভ্যালিতে। সেখানে সে আবিষ্কার করে সর্বজনীন ভাষা যাতে বাক্যালাপ চালাতো সনাতন মুনি-ঋষিরা কীটপতঙ্গ, পাহাড়-পর্বত, নদী-জঙ্গল, পাথর-প্রান্তর এবং অদৃশ্য দেবতাদের সঙ্গে। স্পিতি ভ্যালির পটভূমিকায় স্পিতি নদী ও প্রাকৃতিক উপাদানসমূহ এবং মানুষের সঙ্গে কথোপকথনে সে খুঁজতে থাকে অনন্ত জীবন বা অমরত্ত্বের ব্যাখ্যা। কী পেল সে শেষ পর্যন্ত ? )

 অধ্যায়: বারো  

স্পিতি নদীতে তরঙ্গ নেই, কেবলই স্রোত। সেই নিম্নগামী স্রোতের বিপরীতে তার উৎসস্থলের দিকে যাত্রায় তাবো আর সুমদো অঞ্চলের মাঝামাঝি গিউ গ্রামের কাছাকাছি নদীকে পেল সে নিজের পাশে। গিউ গ্রাম তাবো থেকে চল্লিশ কিলোমিটার দূরে, ভারত-চীন সীমানা থেকে যা মাত্র কয়েক কিলোমিটার এবং জাতীয় সড়ক থেকে অনেকটা ভিতরে গিয়ে এর অবস্থান একেবারেই দুর্গম বন্য এলাকায় যেখানে পাহাড়ি জংলি ফুলের মেলা হেসে অভ্যর্থনা জানাতে প্রস্তুত পাথুরে চড়াই ও খাদের পাশ ডিঙিয়ে বুনো পথ ধরে আসা পরিশ্রান্ত পথিককে। চারদিকে দূরে দূরে সমুদ্রতল থেকে দশ হাজার ফিট উচ্চতায় পাহাড়ের ঢালে ও কোলে আশ্রিত এই মনোরম বাসভূমিকে ঘিরে রেখেছে স্থায়ী বরফে ঢাকা অপরূপ সব গিরিচূড়া, সবাই হিমশৈল তারা। স্পিতি অববাহিকার নদী গ্রামকে পাশে রেখেছে পরম যত্নে। অধিবাসীদের পাথুরে ঘরগুলির পাথুরে দেয়ালে সাদা চুণকাম, ছাদগুলি যেমন-তেমন আচ্ছাদন যেহেতু বৃষ্টি নেই। এই গ্রামে এসে স্পিতি নদীকে হাতের কাছে পেয়ে মৃদু সম্ভাষণে সে জিজ্ঞেস করেছিল, 

‘অনন্ত জীবনের রহস্যটা কী, জানো যদি বলতো আমাকে।’

স্পিতি পাথরের দলবদ্ধতায় সাড়া তুলে বয়ে যাচ্ছিল প্রবল ছন্দে। জলে তার প্রবল প্রগলভতার উদ্দামতা। পাশে উপবিষ্ট ধ্যানস্থ তার অন্তরে শোনা গেল নদীর কণ্ঠস্বর, নীরবে, 

‘অনন্ত জীবন তোমার সামনেই উপস্থিত, কেবল তোমাকে দেখে নিতে হবে, বুঝে নিতে হবে। তোমার সামনে তাকিয়ে দেখ, যতদূর চোখ যায় তার বাইরেও জগৎ রয়েছে, যত তুমি এগিয়ে যাবে সেই না দেখা জগৎটার পরিধি ক্রমশ বাড়তে থাকবে, যত এগোবে তত বাড়তেই থাকবে, না দেখা জগৎটাকে তত তুমি জানতে পারবে, তোমার জ্ঞানের পরিধিও বেড়ে যাবে। তবুও তুমি জগতের শেষ দেখতে পাবে না, তোমাকে কেবল এগিয়ে যেতেই হবে, যত নতুনকে দেখছ তাদের স্বাদ ও মর্মার্থ উপলব্ধি করতে করতে পরম নিষ্ঠায়। ধৈর্যচ্যুতি ঘটলে চলবে না। কেবল এগিয়ে যেতে যেতে একসময় অনন্তকে অনুমান করতে পারবে, তখন তোমার ক্ষুদ্র জীবনকালেই পেয়ে যাবে অনন্ত জীবনের ব্যাপ্তি। মূলকথা হল, অনন্তকে উপলব্ধি করা আর সেটা সম্ভব সমস্ত জীবন ধরে এগিয়ে চলার প্রক্রিয়াতেই। তাই বলা হয়েছিল, চরৈবেতি। সেটা ভুলে যাওনি নিশ্চয় ?’

তার প্রাসঙ্গিক কিছু প্রশ্ন ছিল, সেসব সে তুলে রাখল ভবিষ্যতের জন্য তখনকার মত, কারণ গ্রাম্য অধিবাসীদের কয়েকজন এসে গিয়েছিল তাকে আপ্যায়নের জন্য। তারা তাকে চেনে, জানে যেহেতু সে আগেও এসেছিল এখানে। এখানকার তিন ছাদওয়ালা বৌদ্ধ গুম্ফার পিছনে রয়েছে পাহাড়ের গা, সেখানে কিন্তু আছে জঙ্গুলে পরিবেশ। হিমশীতল হাওয়া ছুটে আসছিল দূরের বরফে ঢাকা পাহাড়চূড়াগুলি থেকে, স্নিগ্দ্ধ প্রশান্তি বিলিয়ে দিচ্ছিল অঞ্চল জুড়ে। অনেকদিন আগে একটি বরফ চিতাবাঘের আগমন গ্রামে আতঙ্ক এনেছিল, বনদপ্তর আসরে নেমে তাকে শেষপর্যন্ত সরিয়ে দিতে বাধ্য হয়। গ্রামের মূল আকর্ষণ বৌদ্ধ মঠের পবিত্র আধারে সংরক্ষিত প্রায় ছ’শ বছরের পুরোনো তিব্বতের বৌদ্ধ ভিক্ষু সংঘ তেঞ্জিন-এর মমিকৃত দেহ যা বিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশক পর্যন্ত অন্যত্র একটি সমাধির অভ্যন্তরে ছিল। ওই সময়ে প্রবল ভূমিকম্পে সেই সমাধি ভেঙ্গে গেলে উদ্ধারকাজে আসা ইন্দো-টিবেটান বর্ডার পুলিশ বা আই টি বি পি বাহিনী এই দুর্মূল্য সম্পদটিকে পেয়ে ওপরে তুলে মঠের ওই পবিত্র আধারে স্থাপন করে। তারপর এই মমি চুরি হয়ে যায়, হয়তো তাকে সীমান্ত পার করে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য ছিল চোরের, সরকারের তৎপরতায় সেই দুষ্কর্ম রুখে মমিটিকে যথাস্থানে রাখা হয় আবার। সেই মমি সে দেখেছে, পবিত্র আধারে উপবিষ্ট অবস্থায় রয়েছে সে, তার চুল ও দেহত্বক এখনও একই রকম নিখুঁত রয়ে গেছে।  

গিউ গ্রাম থেকে নদীর সঙ্গে চলতে চলতে সে হাজির হয়েছিল কাজা শহর পেরিয়ে কুঞ্জুম পাহাড়ে। ওই অঞ্চলে সে নিয়মিত ঘোরাঘুরি করে হেন স্থান নেই যেখানে যায়নি। মোটরপথ আছে এমন সর্বোচ্চ গ্রাম কমিক এবং কিবের ছাড়াও সে হিকিম আর লোসার গ্রামগুলিতেও গেছে একাধিকবার। একবার বৌদ্ধ সন্ন্যাসী জীবাক্ষ থেকেছিল তার সঙ্গে। তার ব্যাখ্যা অনুযায়ী এলাকার এইসব দুর্গম গ্রামগুলিতে ঘুরে ঘুরে সে অনন্ত জীবনকে বুঝতে পারছিল। হিকিম আর লাঙ্গজা গ্রামেও সে গিয়েছিল। কাজা থেকে সর্বোচ্চ মোটরপথ থাকা গ্রাম কমিক যাওয়ার দু’টি উপায়ের একটি হল লাঙ্গজা এবং অন্যটি হিকিম ধরে যাওয়া। দু’টি পথেই গেছে সে একাধিকবার। লাঙ্গজা গ্রামের অন্য একটি বিখ্যাত নাম হল জীবাশ্ম গ্রাম, কারণ এখানে অ্যামোনাইট নামে জীবাশ্ম পাওয়া যায় গ্রামের যত্রতত্র। কেউ কোদাল দিয়ে মাটি খুঁড়লে মাটির সঙ্গে উঠে আসবে চক্রাকার শঙ্কু আকৃতির জীবাশ্ম যারা সমুদ্রের গভীর তলের বাসিন্দা। সেইসব জীবাশ্ম রাখা হয়েছে স্থানীয় ভাষায় ‘চৌদুয়া’ বলে একটি কেন্দ্রে যার অর্থ হল জীবাশ্ম। গ্রাম দেখতে ইদানীং পর্যটকরা আসছে প্রায়ই, তাদের জন্য ছোট ছেলেমেয়েরা থেকে বড়োরা পর্যন্ত বসে থাকে দোকানের পসরা সাজিয়ে, পঞ্চাশ-একশ’ টাকায় নানান জীবাশ্ম স্মারক হিসেবে কিনে নেয় বহিরাগতরা, সেটা তাদের আয়। যদিও এখান থেকে এভাবে ফসিল কিনে বাইরে নিয়ে যাওয়া নিষিদ্ধ, কারণ এভাবে নিতে নিতে সমস্ত জীবাশ্ম একদিন ফুরিয়ে যাবে, সেটা পুরাতাত্ত্বিকদের জন্য সুখকর হবে না, তেমনি গ্রামেরও প্রাচীন সংগ্রহশালার বিপদ ঘটবে। সেকথা কে আর ভাবে ! আসলে কুড়ি কোটি বছর আগে এখানে ছিল টেথিস মহাসমুদ্র। এখন তা দেখে কল্পনা করা যায় না। পাঁচ কোটি বছর আগে ভূগর্ভস্থ গাঠনিক প্লেটগুলির সংঘর্ষে মাথাচাড়া দিয়ে উঠল হিমালয়, টেথিস সমুদ্র হারিয়ে গেল, বিশাল সমুদ্র পরিণত হল হিমালয় পর্বতমালায়, যার একাংশ এই স্পিতি উপত্যকা। সমুদ্রের তলায় যে ছিল সব তার প্রমাণ উপত্যকা জুড়ে প্রাপ্ত জীবাশ্মের নিদর্শন, যাদের চূড়ান্ত আধিক্য দেখা গেছে লাঙ্গজা গ্রামে। সর্বমোট প্রায় দেড়শ’ লোকও নেই গ্রামে, আছে পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশটি বাড়ি বড়জোর। প্রত্যেকটি বাড়ি তৈরি কাদা, ইট আর কাঠ দিয়ে তিব্বতীয় নকশা মেনে। দেয়ালে হোয়াইটওয়াশ, জানলায় লাল বর্ডার দেওয়া নীল রঙ। প্রত্যেক বাড়িতে আছে বড় একটি রান্নাঘর, সেখানে সবসময় জ্বলছে আগুনের কুণ্ড, তার পাশে বসে তারা আদা-চা বা মিন্ট টি বা বার্লি চা খেতে খেতে গল্পগুজব করে। রান্নাঘর আসলে বসার ঘরও বটে। বাড়িতে একটি ঘর থাকে গৃহপালিত পশুদের জন্য। থাকে সেখানে চমরী গাই ও ভেড়া। বাদামি পাহাড়ের দেয়াল দিয়ে ঘেরা গ্রামটিতে এলাকার অন্যান্য গ্রামের মত দু’টি অংশ আছে, লাঙ্গজা ইয়ংমা বা নিম্ন লাঙ্গজা এবং লাঙ্গজা গোঙমা বা উচ্চ লাঙ্গজা। নিম্নভূমিতে বাদামি পাহাড়গাত্র এবং বরফসাদা চূড়াগুলির পটভূমিকায় রয়েছে সবুজ ফসলজমি, দেখলে মনে হবে ঈশ্বর স্বয়ং এখানে থাকেন। গ্রামের লোকরাও তেমনই ভাবে। ল্যাং নামে গ্রামের উচ্চাংশে যে মন্দির অবস্থিত তারা মনে করে ওই মন্দির উপত্যকার সমস্ত দেবদেবীদের বাসস্থান। গ্রীষ্মে তারা জমি চাষ করে ফসল ফলায়। আগে কেবল আলু চাষ হত, এখন তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বার্লি, মটরশুঁটি ও অন্যান্য সবজি। বার্লি দিয়ে রুটি বানায় তারা, দুগ্দ্ধজাত খাবারদ্রব্যও তৈরি করে। চাউ  চাউ কাং নিলডা পাহাড়চূড়া বরফে ঢাকা, কুড়ি হাজার ফিট উঁচু ওই পাহাড়চূড়ার ছায়ায় সবুজ ফসলজমি অপরূপ দৃশ্য, চড়ে বেড়াচ্ছে জমির আশেপাশে ইয়াক বা চমরী গাই ও ভেড়া। কাজা থেকে প্রায় উনিশ কিলোমিটার দূরে পাহাড়ি দেয়ালে ঘেরা এই গ্রামে ঢোকার প্রায় এক কিলোমিটার আগে থেকেই দেখা যাবে গ্রামের উর্ধাংশে স্থাপিত বিশাল সোনালি বর্ণ বুদ্ধমূর্তি যা এই গ্রামের গৌরব। এই নির্জন পাহাড়ি  গ্রামে ঢোকার মুখে ওই সুবিশাল বুদ্ধমূর্তি সবাইকে অভিভূত করে। চাউ  চাউ কাং নিলডা মানে হচ্ছে বরফে ঢাকা সূর্য ও ভোরের রাজকন্যা, ওই পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝরণার জলে তারা কৃষিকাজ করে। শীতকালে প্রবল বরফপাত ঘটলে ঝরণার জলপ্রবাহ গ্রীষ্মে বেড়ে যায় ও ফসলজমি ভালো জল পায়, ফসলও ভালো হয়। শীতকালের জন্য ফসল, খাবারদাবার মজুত করে রাখে তারা সমস্ত গ্রীষ্মকাল জুড়ে এবং গোটা শীতকাল ঘরে বসেই কাটায়, কোন কাজকর্ম থাকে না। গ্রাম ওইসময় বাইরের পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। মাইনাস কুড়ি ডিগ্রি তাপমাত্রা তখন, পুরু বরফে ঢেকে যায় চারপাশ। সকালে উঠে তখন তাদের দু’টো কাজ, কোদাল ও বেলচা দিয়ে বাড়ির দরজা-জানলা ও উঠোন থেকে বরফ পরিষ্কার করা এবং তারপর গৃহপালিত পশুগুলিকে খাওয়া-দাওয়া করানো ও যত্ন নেওয়া। আর কোন কাজ নেই তাদের সারাদিন। এভাবেই জীবনযাপন করে আসছে বছরের পর বছর, দশকের পর দশক ধরে লাঙ্গজা গ্রামের মানুষজন যাদের মূল জীবিকা এখন কৃষিকাজ। আর হালে যুক্ত হয়েছে ভ্রমণসংক্রান্ত আয়। পর্যটকরা আসছে বলে গ্রামে। যদি আরও প্রাচীন যুগে যাওয়া যায় তো দেখা যাবে গ্রামের মানুষ ঘরে বসে মৃৎপাত্র তৈরির কাজে ব্যস্ত যাকে বলা হয় জামাশিল্প। এখানকার হলদে ও কালো কাদামাটি দিয়ে তৈরি সেসব মৃৎপাত্র বেশ বিখ্যাত ছিল একসময়, বংশ পরম্পরায় চলত সে কাজ। উপত্যকার অন্যান্য গ্রামে সেসব অপূর্ব মৃৎপাত্রের ছিল প্রবল চাহিদা। এখন স্টিল ও অন্য ধাতব পাত্র এসে তাকে হটিয়ে দিয়েছে, গ্রামে অল্প কয়েকজন লোক কেবল আছে এই প্রাচীন পেশায়। ভালো কার্পেট, পোশাক ও মাদুর বানাতেও পটু তারা। তবে হাতের কাজও এখন বিলুপ্ত প্রায়। 

গ্রামের আরেকটি অবিস্মরণীয় মুকুট হল চাউ চাউ কাং নিলডা চূড়া, যার রাজকীয় উপস্থিতি এ গ্রামে যে আসবে তাকেই মুগ্দ্ধ করে দেবে। সে অনন্ত জীবনের স্বাদ অনুভব করে বিশ্বনিয়ন্তার এইসব প্রাকৃতিক গৌরবগুলির দর্শন পেতে পেতে। কিছু কিছু মানবিক কর্মকাণ্ডও তাকে বিস্মিত করে। যেমন, পাহাড়চূড়া ঘুরে ঘুরে চলা বা অতল খাদের পাশে পাহাড়ের গা কেটে বা ঝুলন্ত পাহাড়ি গুহাকৃতি পরিসরের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যাওয়া এই আশ্চর্য জাতীয় সড়ক। সে এখানে মানুষের দুর্দান্ত মনোভাবের পরিচয় পায়, যেমন সে আবার তার সন্ধান পায় যখন হাজার বছর পুরোনো বৌদ্ধ গুম্ফাগুলি দেখে। তার বিস্ময়ের সীমা-পরিসীমা থাকে না তখন। এমনই বিস্মিত সে হয়েছিল আবার কাজা থেকে লোসার গ্রামে যাওয়ার পথে, চিচাম ব্রিজ দেখে। তখনও পর্যন্ত এশিয়ার সর্বোচ্চ এই ব্রিজটি কিবের গ্রামকে চিচাম গ্রামের সঙ্গে যুক্ত করেছে এবং মানুষের তৈরি এক অক্ষয় কীর্তি। তেরো হাজার পাঁচশ’ ছিয়ানব্বই ফিট উচ্চতা এই সেতুর, এর ওপর দাঁড়িয়ে নিচে তাকালে বুক কেঁপে উঠবে গভীরতা দেখে, মনে হবে সত্যিই ক্ষুদ্র জীবনের পরিসরে ঘটছে অনন্তকে দর্শন এবং এই দর্শনই জীবনকে অনন্ত করে তুলছে। হাজার ফিট নিচে গিরিখাত ধরে বয়ে যাচ্ছে ক্ষীণতনু সাম্বালাম্বা নালা, কী অপরূপ ভয়াল রুদ্ররূপ প্রকাশ করে। এখান থেকে এগিয়ে গেলে কাছেই লোসার গ্রাম। 

এই গ্রামে এসে সে চাউ চাউ কাং নিলডা চূড়ার পাদদেশে পাহাড়ি দেয়ালের আশ্রয়ে শিলাখণ্ডের আসনে বসেছিল একটু নিচে উপত্যকার সবুজ ফসলজমির মুখোমুখি। স্পিতি নদী এই গ্রাম থেকে অনেকটা দূরে, অনেক গিরিশিরার ওপাশে সংকীর্ণ এক গিরিখাতের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত নিজের পথ খুঁজে নিয়ে। লাঙ্গজা গ্রামের মনোরম পরিবেশ তার মন ভালো করে দিয়েছিল। সেই বিপুলায়তন বুদ্ধমূর্তিকে এখান থেকে দেখা যায় না, তবে দেখা যায় গ্রামের সাদা সাদা বাড়িঘর, আনত  ঢালের অনেকটা ওপর থেকে নিম্নাংশের সমতলীয় ভূখণ্ড পর্যন্ত। এখানে কুড়ি কোটি বছর আগে মেসোজোইক যুগে দাপিয়ে বেড়াত আদিম টেথিস মহাসমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গমালা, সেই তরঙ্গমালাকে কোন্ অদৃশ্য জাদুকর স্থাণু করে দিয়েছে, তরঙ্গমালা এখনও বর্তমান তবে তাতে কোন চলাচল নেই, নিশ্চল পার্বত্য চূড়া হয়ে সুসজ্জিত হাত ধরাধরি করে বরফমুকুট মাথায় চাপিয়ে। কার জাদুদণ্ডের ছোঁয়ায় উত্তাল মহাসমুদ্র হয়ে যায় মহাপর্বত ? তার মনের এই প্রশ্ন কে শুনবে, কে শুনে উত্তর দেবে ? সেই অনন্ত অস্তিত্বের কি নাগাল পাওয়া সম্ভব এক জীবনে ? তাই কি তাকে জানার জন্য অনন্ত জীবনের আকাঙ্খা ? কিন্তু সে জানে না অনন্ত জীবন মানে কতদিনের জীবনকাল। তারাওতো একটা হিসেব থাকতে হবে ? অমরত্বের পিপাসা ছিল বা আছে যাদের, যারা বিজ্ঞানকে হাতিয়ার করে বলছে অদূর ভবষ্যতেই তারা মানুষকে দীর্ঘজীবন দান করতে পারবে, তারা কেউ কি জানে এই অমরত্ব বা এই দীর্ঘজীবন ঠিক কতোটা সময়কে বোঝায় ? দু’শ’-তিনশ’ বছর, নাকি হাজার বছর, নাকি লক্ষ বছর, নাকি কোটি কোটি বছর ? অমরত্ব বা দীর্ঘজীবন বলতে যদি এক কোটি বছরকে বোঝায় তো অতদিন সত্যিই কোন জীবদেহ টিকতে পারবে ? টিকে যদিওবা থাকে সে কী করবে ? গোটা আধুনিক মানবসভ্যতার আয়ুও আজ পর্যন্ত দশ হাজার বছর নয়। তার মধ্যেই কত কাণ্ড ঘটে গেল। কত যুদ্ধবিগ্রহ, কত উত্থান-পতন, কত আবিষ্কার, কত বিপ্লব, কত উন্নয়ন। একটা অমর মানুষ এই সমস্ত বিষয়ের সঙ্গে জড়িয়ে আজ পর্যন্ত বেঁচে আছে ভাবা যায় ? কোটি কোটি বছর আগে জন্ম নেওয়া কোন মানুষ বা জীব একদিন দেখেছিল এখানে টেথিস মহাসমুদ্র, দেখেছিল হিমালয়ের জন্ম সেটা কি অতিকল্পনা নয় ? তাহলে অমরত্ব বলতে কী বোঝায় ? অনন্ত জীবনের আসল অর্থ কোথায় ? সর্বসাধারণের প্রচলিত ধারণা, অমরত্ব মানে লক্ষ লক্ষ বা কোটি কোটি বছর বেঁচে থাকা, এমন ব্যাপারটাকে তার কাছে অযৌক্তিক বলে মনে হল।  অনন্ত জীবন মানে কত বছর টিকে থাকা তার তো একটা ধারণা থাকা দরকার ? স্পষ্ট কোন ধারণাই নেই করোও মধ্যে। তাহলে অনন্ত জীবন মানে দৈহিক পরমায়ু ব্যাপারটা একেবারেই উদ্ভট, ভ্রান্ত। মুখে আসে তাই মানুষ বলে যায়, বস্তুনির্ভর বিজ্ঞানও অন্ধভাবে এই ধারণাকে আশ্রয় করে চলছে, কিন্তু এমন ভাবনা একেবারেই অর্থহীন। অনন্ত জীবন মানে অন্যকিছু, যা কখনোই নির্দিষ্ট কোন সময়কালকে বোঝাতে পারে না। সেটা সময়ের হিসেব অনুযায়ী নয়। সময়কালের উর্ধে কোন বিষয়, সময়-কাল নিরপেক্ষ, এক আদি ও অন্তহীন বিচরণশীলতা বা স্থিতি যা আধুনিক মানুষের বা বিজ্ঞানের জানার পরিধির মধ্যেও নেই। সেটা এক সম্পূর্ণ অন্য বিষয় যা আজ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি। সেটা কী ? সে তার উত্তর জানবে কী করে ? জানে না তা কোন মানুষ। সে যে বিশ্বকে দেখছে বুঝছে জানছে তা তো এখন পর্যন্ত মানুষের অধীত বিষয়কে ভিত্তি করেই। যার উত্তর কোন মানুষের জানা নেই, সে তা জানবে নিজের দক্ষতায় এতবড় জ্ঞান সে অর্জন করতে পারেনি। কোনদিন কি পারবে ? তার নিজেকে খুব অসহায় মনে হল। সে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল। 

কিছুটা সময় পাহাড়ি দেয়ালের ছায়ায় বসে এইসব ভাবনায় আক্রান্ত থাকতে থাকতে তার মনে হল, চারদিকটা ঘুরেফিরে দেখা যাক, এভাবে এক জায়গায় স্থিত হয়ে যাওয়া মনে নানা বিষণ্ণতা জাগিয়ে তোলে। সে উঠে দাঁড়াল, হেঁটে হেঁটে গ্রামের উচ্চাংশে উঠে গেল পাহাড়ের দেয়াল বেয়ে বেয়ে। হাজির হল গিয়ে সেই বিশালকায় বুদ্ধমূর্তির পাদদেশে। পদ্মাসনে আসীন ঋজুদেহী সেই মূর্তির বাঁ হাত কোলের ওপর এক নীল পাত্র ধরে রেখেছে, ডান হাত সরাসরি উপবিষ্ট পায়ের হাঁটুর ওপর প্রসারিত। সোনালি কারুকাজ করা বর্গাকার সুবিশাল পুরু শ্বেতশুভ্র পাটাতনের ওপর ধ্যানগম্ভীর সেই মূর্তি অবস্থিত, সেই বেদি স্থাপিত আবার চৌকোণা আরেকটি সুউচ্চ স্তম্ভের ওপর, সেই স্তম্ভের গায়ে নানা মূর্তি আঁকা আর নানা চিত্রকলা। সর্বোচ্চ বর্গাকার পাটাতনটির ওপর আবার আরেকটি গোলাকৃতি স্তম্ভ, তার ওপর বুদ্ধদেব। সেই মূর্তির পাদদেশে সে বসে রইল নিজেও ধ্যানস্থ হয়ে, আবার চোখ খুলে দেখছিল সেই বিপুলায়তন স্থাপত্যের অপরূপ গাম্ভীর্য। এই নির্জন শৈলমালার শিখরে অবস্থিত এই বুদ্ধমূর্তি তাকে আপ্লুত নির্বাক করে দিয়েছিল। 

সন্ধে নামে এখানে খুব দ্রুত। তাকে গ্রামের বাড়িঘরের কাছাকাছি ঘোরাফেরা করতে দেখে বিকেলবেলায় কয়েকটি বাড়ির মালিক রাতের জন্য তাদের বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করতে বলল। আন্তরিকতা ছিল তাদের আমন্ত্রণে, সবাই তো বুদ্ধকেই তাদের দেবতা বলে মানে , তাই তারা অতিথিপরায়ণ ও বন্ধুবৎসল। অবশ্য তারা স্পিতি উপত্যকার অধিকাংশ গ্রামের মত বজ্রযান ধারার নয়, তাদের ধারাটির নাম সংকায়াপা। কাছাকাছি তিব্বতের কিছু অঞ্চলে এই ধারা প্রচলিত থাকায় তারাও তাতে প্রভাবিত। সে একজন গ্রামবাসীর আতিথ্য গ্রহণে রাজি হয়ে তার বাড়িতে গেল। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন উঠোন, একটু দূরে গোশালায় রয়েছে তার কয়েকটি ইয়াক ও কিছু ভেড়া। তার একটু কাছাকাছি চার দেয়ালে ঘেরা একটি বাথরুম। খাদ্যশস্য বা খাবার ইত্যাদি উপকরণ সঞ্চয় করে রাখার জন্য একটি ঘরও নির্দিষ্ট ছিল মজুতভাণ্ডার হিসেবে। বাড়ির দেয়াল যথারীতি কাদা-ইট ও কাঠ দিয়ে গড়া কাঠামো, গায়ে হোয়াইটওয়াশ। এতে দরজা বন্ধ করে ঘরে থাকলে ঠাণ্ডার প্রকোপ শীতকালেও তেমন কাবু করে না যখন বাইরে চলতে থাকে প্রবল শৈত্যঝড় ও বরফবর্ষণ। সেসময় কিন্তু তাপমাত্রা হিমাংকের অনেক নিচে নেমে যায়। 

রাতে আগুনের কুণ্ড অঙ্গিথার সামনে বসে রান্নাঘরে তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল বাড়ির লোকজন। লোক বলতে বাড়ির মালিক, তার বৃদ্ধা মা, তার বউ ও দু’টি ছোট ছোট ছেলেমেয়ে। তার বেশভূষা দেখলে তাকে সবাই বিশ্বপর্যটক বা সাধুসন্নেসি ভাবতে বাধ্য। তাকে দেখলে সবাই কী কারণে মনে করে সে মহাজ্ঞানী কোন মহাপুরুষ তা সে নিজেও জানে না। তার চেহারায় কী যে আছে কে জানে, বাচ্চারা তাকে নিজেদের খুব আপনজন বলে ভাবে। এখানেও গৃহমালিকের ছোট ছোট দু’টি বাচ্চা এসে তার কাছে বসে ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিন্দিতে যা বলল তার মানে হল, গল্প শোনাও আমাদের। এই গ্রামবাসী ও তার পরিবারের নিস্তরঙ্গ জীবনযাত্রায় তার মত একজনের একরাত থাকা মানে বিরাট এক ঘটনা, একটা বড় বিনোদন বা আমোদ। সে বাচ্চাদু’টিকে তার কোলের কাছে টেনে এনে সাদরে তাদের কপালে চুমু খায়, তাদের শোনায় স্পিতি ভ্যালিতে তার জীবনযাপনের গল্প, স্পিতি নদীর চলনপথ ধরে নদীর সঙ্গে কথা বলতে বলতে তার পথ পরিক্রমা, পাহাড়-পর্বত বা প্রান্তর বা শিলারাশি বা রাতের আকাশভর্তি তারকাদের সঙ্গে তার কথোপকথন, আর উপত্যকায় অদৃশ্য কোন দৈবশক্তির অস্তিত্ব সম্পর্কে তার উপলব্ধি। সে সরল-সহজ ভাষায় সব ব্যাখ্যা করে, বাচ্চাগুলি মন্ত্রমুগ্দ্ধ  হয়ে শোনে, শোনে গৃহকর্তা নিজে ও তার বৃদ্ধা মা। তার বউ তার জন্য বার্লি চা নিয়ে আসে একবার, আবার দেয় অদা চা। রাতে তাকে খাওয়ায় তারা ভাত, ডাল, রাজমা ও একটি মিশ্র সবজি। চা খাওয়ার সময় গৃহকর্ত্রী তাকে বার্লি দিয়ে বানানো লাড্ডু খেতে দিয়েছিল। আর এখন খাওয়ার পর গৃহকর্তা তাকে জিজ্ঞেস করল বার্লি থেকে বানানো মদ সে খাবে কিনা ঠাণ্ডার প্রকোপ কাটাতে যা দরকার। সে সবিনয়ে তা প্রত্যাখ্যান করল। এমনই ছিল তার বিনীত প্রত্যাখ্যান যে গৃহস্বামী তাতে ক্ষুণ্ন হল না, বরং নিজে তার মত একজন জ্ঞানী সন্ন্যাসীসদৃশ মানুষকে এমন প্রস্তাব দেওয়ার জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করল। পরদিন সে যখন বিদায় নিচ্ছে তখন বাচ্চাদু’টি তাকে বলল আবার আসতে, গৃহকর্তা নিজেও তাই বলল। তারও যেন মন একটু বিষণ্ণ হয়ে গেল, সে ভাবল যে চোদ্দ হাজার পাঁচশ’ ফিট উচ্চতায় পাহাড়ের শিখরে অবস্থিত এই লাঙ্গজা গ্রামে বুঝি সে স্বজনসঙ্গ ছেড়ে চলে যাচ্ছে।  

সকালেই সে লাঙ্গজা গ্রাম ছেড়ে বেরিয়ে আসে। তার যাত্রাপথ এখন কাজা শহরের দিকে, দূরত্ব প্রায় আঠেরো কিলোমিটার। সে ঠিক করে সেইদিনটা সে কাজাতেই কাটাবে, অথবা আরও খানিকটা গিয়ে রংরিক পৌঁছে যাবে যা খুব বেশি হলে সাত-আট কিলোমিটার। কাজার কাছাকাছি স্পিতি নদী জাতীয় সড়কের বাঁ ধার থেকে ডানদিকে প্রবাহিত প্রায় সমান্তরালে। যদিও নদীখাত গভীর তবুও তা মূল রাস্তা থেকে খুব একটা দূরে নয়, স্থানে স্থানেই দু’-আড়াই হাজার ফিট মাত্র। তার মানে নদীকে পাশে নিয়েই চলতে পারবে সে, জানতে পারবে তার মতিগতি। তার লক্ষ্য কুঞ্জুম পাহাড়, যেখান থেকে জন্ম নিয়েছে স্পিতি নদী। কিন্তু কাজা থেকে তার দূরত্ব কম করেও সত্তর-পঁচাত্তর কিলোমিটার। গোটা পথ হেঁটে যেতে তার হয়তো দু’ থেকে তিনদিন লেগে যেতে পারে, পথে কিছু না কিছু জনপদ পেয়ে যাবেই সে। রাত কাটাবে সেইসব স্থানে। অবশ্য কোন পর্যটকের যানবাহনেও সে ভাগ্য সহায় হলে চড়ে বসতে পারে। তবে সেই ইচ্ছে তার নিজেরই নেই। সে চায় নদীকে পাশে নিয়ে চলতে চলতে তার সঙ্গে কথোপকথন চালিয়ে যেতে। এই যাত্রায় কুঞ্জুম পাসের কাছাকাছি জনপদ হল লোসার গ্রাম। সেখানে এক রাত থাকার ইচ্ছে আছে তার। যাই হোক, বিশেষ ভাবিত নয় সে কোন বিষয়েই। সে এখন চলেছে চলার পথে সাজিয়ে রাখা ঈশ্বরের মনোরম বাগান দেখতে দেখতে। অবিশ্রাম হেঁটে যাওয়ার অভ্যেস আছে তার এবং সে দেখেছে তার যাত্রাপথে দিনের শেষ বেলায় সে কোন না কোন জনপদ ঠিক পেয়ে যায়। যে গ্রামেই সে যাক না কেন এই উপত্যকায় কেউ তাকে আতিথ্যদানে অসম্মত হওয়া তো দূরের কথা, সে বলার আগে নিজেরাই তাকে যেচে এসে অতিথি হতে বলে। প্রকৃতির এও যে কী বিচিত্র খেলা সে বোঝে না, কেন এই সরল-সাদামাটা গ্রামগুলির বাসিন্দারা তাকে এমন আপন মনে করে তা এক বিস্ময় তার কাছে। আর পর্যটকদের যানবাহনেও সে ঠিক দরকারে জায়গা পেয়ে যায়। সে জানে, কুঞ্জুম গিরিদ্বার যাওয়ার পথে কোন পর্যটকের গাড়ি সে চাইলেই তাকে তুলে নেবে। সবই তার নিজের ইচ্ছের আওতায়। দেখা যাক কী হয়। তবে তার চূড়ান্ত লক্ষ্য, কুঞ্জুম গিরিদ্বার যা কুঞ্জুম পাহাড়ের পূর্বাংশে। সে জানে, স্পিতি নদীর সূচনা হয়েছে এই কুঞ্জুম পাহাড় থেকেই, যা গিরিদ্বারের খুব একটা দূরে নয়। কুঞ্জুম পর্বতমালার ঢাল থেকে কুঞ্জুম লা তোগপো এবং কাবজিমা ও পিংলাঙ্গ ঝরনা দু’টির মিলনস্থল থেকে জন্ম নিয়েছে নদীটি, তারপর উপত্যকার লম্বা পথ পাড়ি দিয়েছে বরফগলা জলে পুষ্ট হয়ে, দু’ধারের মালভুমি থেকে নানা উপনদীর বন্ধনে জড়িয়ে জড়িয়ে, তাদের আনা বরফগলা জলের ধারাস্রোত হয়ে। 

কাজাতে পৌঁছে গেল সে দুপুরের আগেই। সেখান থেকে ব্রিজ পেরিয়ে সে আবার চলা শুরু করে। আর খানিকটা গেলেই রংরিক। সেখানে ইচ্ছে হলে থাকবে বা আরও এগিয়ে যাবে। এখন নদী তার ডান ধারে, প্রায় নাগালের মধ্যেই। এখানে সড়কপথ ওপরে বেয়ে উঠছে না তেমন, চলেছে নিম্ন উপত্যকার গা ধরে পাহাড়চূড়াগুলির তলদেশের প্রশস্ত ভিতের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে আঁকাবাঁকা হয়ে। কোথাও পাহাড়গাত্রের ছায়ায় আচ্ছাদিত শীতল, কোথাও বা নরম রোদের ছোঁয়ায় প্রাণিত। সে চলে আপনমনে এই প্রকৃতির সঙ্গে কথা বলতে বলতে। ঈশ্বর বা প্রকৃতি যেই হোক, সে তার সুবিশাল থালায় সাজিয়ে রেখেছে পরম যত্নে এইসব পাহাড়, ঝরনা, উপত্যকা, মালভূমির গা দিয়ে সাজানো অপরূপ নৈবেদ্য। সে এই নৈবেদ্যের সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে করতে আত্মহারা হয়ে চলেছে। তার সমস্ত মনে এক স্বর্গীয় আনন্দ। সে যত চলে তত দেখে পথ চলেছে তার শেষ না দেখিয়ে, তার শুরু কোথায় তাও দেখা যাবে না এখান থেকে, সেই অর্থে পথও অন্তহীন অনন্ত যেহেতু সে লম্বা পথের মাঝখানে দাঁড়িয়ে তার শুরু বা শেষ দেখতে পাবে না। আর এইযে উপত্যকার দু’ধারে পাহাড়ের চূড়াগুলি দেখা যাচ্ছে একের পর এক, দেখে মনে হচ্ছে তাদেরও কোন শুরু বা শেষ নেই। মাথার ওপর ওই যে ঘোরতর বিশুদ্ধ নীলবর্ণ আকাশ সুশোভিত খণ্ড খণ্ড শ্বেতশুভ্র মেঘের নীরব চলাচলে বা দাঁড়িয়ে থাকায় তারও তো কোন আদি বা অন্ত পাওয়া যাবে না। তার মনে হতে থাকে, ক্ষুদ্র জীবনের পরিসরে সে প্রকৃতির সাজিয়ে রাখা থালার নৈবেদ্যে অনেকগুলি অনন্তের উপস্থিতি দেখতে পাচ্ছে। এতসব মহিমামণ্ডিত অনন্তকে উপলব্ধি করাই বোধহয় অনন্ত জীবন। আসলে অনন্ত জীবন কোন মানুষ পেতে পারে না। মানুষ তার ক্ষুদ্র জীবনে যেসব প্রভূত অনন্ত বিষয়সমূহের সন্ধান পায় সেসবের সমাহারই তাকে অনন্ত জীবন দেয়। তার মনে পড়ে জীবাক্ষর কথা। এত জ্ঞানী হয়েও সে অনন্ত জীবনের সঠিক অর্থ বুঝতে পারেনি। অনন্ত জীবন বলতে সে বুঝেছে ব্যক্তির জীবনে দীর্ঘকাল বেঁচে থাকা। সেই দীর্ঘকাল কতটা সময়ের ব্যাপ্তি তা কি সে বলতে পারবে ? কতকাল একজন মানুষ বেঁচে থাকলে তাকে অনন্ত জীবনের অধিকারী হয়েছে বলা যাবে ? 

আপনমনে আত্মবিস্মৃত হয়ে পথ চলতে চলতে সে খেয়াল করে না একটা শক্তপোক্ত এস ইউ ভি গাড়ি এসে কখন থেমে যায় তার পাশে। এমনিতে এই সময়টায় আজকাল দেশি-বিদেশি পর্যটকরা দলে দলে আসতে থাকে উপত্যকায়। এতকাল এই উপত্যকার দুর্গমতা বেশি পর্যটককে এখানে আসার উৎসাহ দিত না। এখন জাতীয় সড়ক হয়ে যাওয়ায় দুর্গমতা অনেক কেটে গেছে, জনপ্রিয়তা বেড়ে গেছে বহির্বিশ্বে। এটা একটা বিপদও বটে। বেশি লোক আসা মানেই উপত্যকার স্বর্গীয় সভার ওপর অত্যাচার, হাজার বছরের পুরোনো গ্রামগুলিতে এসে ঢুকবে সমতলীয় মানুষের কলুষিত আচার-আচরণ। জীবনযাপন প্রণালী পাল্টে যাবে মানুষগুলির। সমতলের মানুষ চলে তাদের নিয়মে, এই অঞ্চলের নিয়মকানুন তারা মেনে চলবে না। এই উপত্যকার মানুষগুলির জীবনে লোভ ও উচ্চাকাঙ্খা এসে হানা দেবে। তাদের সংস্কৃতি আর বজায় থাকবে না। তাদের ঐতিহ্য তারা হারিয়ে ফেলবে। আধুনিক নগরসভ্যতার বিষাক্ত প্রভাব যদি এখানে আসতে থাকে অহরহ তাহলে সত্যিই সর্বনাশ। দেবতাদের বিচরণক্ষেত্র স্পিতি ভ্যালিতে একদিন হয়তো গড়ে উঠবে কলকারখানা। সেই অশুভ কার্যকলাপ হতে থাকে যদি এখানে তো বড়োই আতঙ্কের কথা। 

তার পাশ দিয়ে একটি-দু’টি পর্যটকের গাড়ি যাতায়াত করছিল মাঝেমধ্যেই। সে পাশে সরে গিয়ে পথ ছেড়ে দিচ্ছিল। এখন এই গাড়িটি এসে দাঁড়িয়ে পড়ায় তার আত্মমগ্নতা ভাঙ্গল। সে একটু অবাক হল। কী উদ্দেশ্যে গাড়িটি থামল তার পাশে ? সে দাঁড়িয়ে দেখছিল ব্যাপারটা, কৌতূহল ছিল তার মধ্যে। থেমে যাওয়া গাড়ির দরজা খুলে যে ব্যক্তি বেরিয়ে এলো তাকে দেখে সে অবাক হয়ে গেল। সে ভাবেনি আবার এভাবে এই ব্যক্তিটির সঙ্গে দেখা হবে তার কোনদিন। সে জার্মান পর্যটক গেরহার্ট। গত বছর এমনই সময়ে স্পিতি ভ্যালিতে তার তখনকার বাসস্থানের কাছে দেখা হয়েছিল তার সঙ্গে। এতো তাড়াতাড়ি আবার সে আসবে এখানে, আবার তার সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে এভাবে চলার পথে এটা ভাবাও বিস্ময়কর। সে আশ্চর্য হয়ে দাঁড়িয়ে রইল নির্বাক। গেরহার্ট তার কাছে এসে হাত বাড়াল মুখে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে, 

‘এখানে এভাবে তোমাকে পেয়ে যাব আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। গতবছর যেখানে তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল সেখানে তোমাকে অনেক খুঁজেও দেখতে পাইনি। ভেবেছিলাম তুমি অন্য কোথাও চলে গেছ। তখন মেষপালকদের সঙ্গে দেখা হল। তারা জানাল যে তুমি ওখানেই থাকো, তবে ক’দিনের জন্য কোথাও বেরিয়ে পড়েছ ঘুরতে। কোথায় গেছ তারা বলতে পারল না। আমার বেশ মনখারাপ হয়ে গিয়েছিল। দেখ, ঠিক দেখা হয়ে গেল তোমার সঙ্গে।’

গেরহার্টের বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা সে অগ্রাহ্য করে যুক্তকরে তাকে নমস্কার জানাল। গেরহার্টও তার মত উপায়ে তার উদ্দেশ্যে প্রতিনমস্কার জানিয়ে জিজ্ঞেস করল, 

‘তুমি এখানে হেঁটে হেঁটে কোথায় চলেছ ?’

‘কুঞ্জুম পাস্।’

সংক্ষেপে উত্তর দিল সে। গেরহার্ট উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল,

‘আরে আমরাও তো ওখানেই যাচ্ছি। চল তুমি আমাদের সঙ্গে, আমাদের গাড়িতে।’

সে এই আমন্ত্রণ অগ্রাহ্য করার কারণ দেখল না। তাতে অবশ্য তার পরিকল্পনা অনেকটাই পাল্টে যাবে। তা হোক, তার গেরহার্টের সঙ্গ অপছন্দ হয় না। লোকটাও তাকে খুব মর্যাদা দেয়, বন্ধু হতে চায়। বিমুখ করতে নেই কাউকে। সে গিয়ে গেরহার্টের গাড়িতে চেপে বসল। মাঝখানের আসনে সে আর গেরহার্ট পাশাপাশি। ছিল সেখানে আরেক ব্যক্তি। এবার গেরহার্টের সঙ্গী আরও চারজন, সবাই পুরুষ। সে জিজ্ঞেস করল, 

‘তুমি কি প্রত্যেক বছরই এখানে আসো ?’

‘আরে না। গতবছর কী কাণ্ড হল বলছি শোন। আমরা তো হিসেবে-টিসেব করে গেলাম, গিয়ে দেখি কুঞ্জুম পাস্ তখনও খোলা হয়নি। বরফ জমে আছে ওখানে, সেসব তখনও সরাতে পারা যায়নি। ওদিকে ল্যান্ডস্লাইড হয়ে কুঞ্জুম পাসের পর বাটাল পর্যন্ত রাস্তা আটকে আছে। কবে সেসব সরিয়ে রাস্তা খোলা যাবে কেউ বলতে পারল না। আমাদের সমস্ত প্ল্যানটা মাঠে মারা গেল। চন্দ্রতাল লেকে যাওয়া হল না। আমরা লোসার পর্যন্ত গিয়ে আবার যে পথে এসেছিলাম সে পথেই ফিরে গেলাম। ফেরার পথে তোমাকে খোঁজ করে দেখা পাইনি, তুমি অন্য কোথাও চলে গিয়েছিলে। তাই এবার আসা, অসম্পূর্ণ ভ্রমণটা সম্পূর্ণ করতে। তাছাড়া তোমার সঙ্গে দেখা করারও একটা ইচ্ছে ছিল। দেখ, ইচ্ছেটা ঠিক পূরণ হল। আসলে দেখেছি, মানুষ যদি অন্তর দিয়ে কিছু পেতে চায় তাহলে সেটা যেভাবেই হোক পায়। এর পিছনে কি কোন রহস্য আছে ? আমি ঠিক জানি না।’

গেরহার্টের এই স্বভাবটার জন্যই তাকে প্রথমবার দেখে খারাপ লাগেনি এবং এবারও তার সঙ্গ পেয়ে সে খুশিই হয়েছে। সে অন্য আর দশজন বিদেশির মত উন্নাসিক ও অপদার্থ নয়। আসলে সে উচ্চশিক্ষিত গবেষক অধ্যাপক। শিক্ষার একটা মূল্য আছে। আর যে দশটা বিদেশির সঙ্গে আমাদের দেখা হয় তাদের বেশির ভাগই অল্পশিক্ষিত এবং তাদের অনেকের সঙ্গই বেশিক্ষণ সহ্য করা যায় না। 

গাড়ি চলছিল বাঁক খাওয়া পথ ধরে শৃঙ্গগুলির তলদেশ ঘুরে ঘুরে। হালকা ঢাল ছিল বা ছিল না। এমনিতে পথ অনেকটা নেমেই গিয়েছিল, তবে খানিকটা পরই উঠতে লাগল। গেরহার্ট প্রশ্ন করল,

‘তুমি কি কুঞ্জুম পাস্ দেখতে যাচ্ছ ?’

‘না। কুঞ্জুম পাস্ আমি আগেও দেখেছি কয়েকবার। আমি আসলে যাচ্ছিলাম স্পিতি নদীর সঙ্গে সঙ্গে। তার উৎস থেকে যাত্রা শুরু করে সঙ্গম পর্যন্ত। তুমি হয়তো বিশ্বাস করবে না, তোমাকে কী করে বোঝাব জানি না, আমি স্পিতির সঙ্গে কথা বলতে বলতে যাচ্ছিলাম। তার সঙ্গে চলছিল আমার প্রাণের আলাপ।’

কথাগুলি বলতে গিয়ে তার গলায় খানিকটা কুণ্ঠা ছিল, কারণ কেউ যে নদীর সঙ্গে কথোপকথন চালাতে পারে একথা বুঝতেই পারবে না সাধারণ মানুষ। তারা ভাববে লোকটা বদ্ধ উন্মাদ। নদী কি মানুষ যে তার একটা ভাষা আছে ? যার ভাষা নেই সে কথা বলবে কী করে ? কিন্তু এই উপত্যকায় বসবাসের কল্যাণে সে জানে, মানুষ বা জীবজন্তু কেন, প্রকৃতির প্রতিটি বস্তুরই রয়েছে নিজেকে প্রকাশ করার তাগিদ, আর তা দেখা যায় তাদের স্থির অবস্থানে বা গতিশীলতায়। সেটাই তাদের প্রকাশিত ভাষা, একে ধৈর্য ধরে বুঝে নিতে হয়। যে যত বেশি বুঝতে পারবে তার জ্ঞানভাণ্ডার সমৃদ্ধ হবে। এভাবে প্রকৃতির ও পৃথিবীর বুকে আছে অনন্ত বস্তুসমূহ। তারা সতত নিজেকে ব্যক্ত করার জন্য অপেক্ষারত। তাদের এই ব্যগ্রতাকে অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করাই হল মানব মস্তিষ্কের প্রধান কাজ। যে ব্যক্তি এই অনন্ত বস্তুগুলির নীরব প্রকাশের ভাষা বুঝতে পারবে তার কাছেও জীবন অনন্ত হবে। জীবাক্ষ এই গূঢ় তত্ত্বটা বুঝতে পারেনি অত জ্ঞানী বৌদ্ধ ভিক্ষু হয়েও। সে যে পথে এগোচ্ছে তা সঠিক নয়, আধুনিক মানুষেরই মত মনোবিকার, যারা ভাবে মরদেহ দীর্ঘকাল টিকিয়ে রাখাই অনন্ত জীবনের লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়া। তারা ভাবে, যদি আমার অস্তিত্ব না থাকল তাহলে আমার কী থাকল ? সময়ের চলন তো থামাতে জানে না কেউ। যদি সময় না দাঁড়ায় তো জীবনও দাঁড়াতে পারবে না, অনিবার্য ধ্বংসের দিকে এগিয়ে চলবেই। এই ধ্বংসকে রোধ করার উপায় হস্তগত হলেই মরদেহ এবং তার মধ্যে বাস করা মানুষের নিজস্ব স্বত্ত্বাকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে। সেই লক্ষ্যে চলেছে বর্তমান কালের জীববিজ্ঞানী, গবেষক ও চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা। কিন্তু তারা কি ভাবে অনন্তকাল মানে কতটা সময় ? তাদের লক্ষ্য আশি পেরিয়ে একশ’ বা বড়জোর দেড়শ’ বছর পরমায়ু বাড়িয়ে দেওয়া। সাধারণ মানুষেরও এই একই ভাবনা। জীবাক্ষও এই সর্বসাধারণের দানবিক বা আসুরিক ভাবনা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারেনি। তার অত জ্ঞান কী কাজে লাগল ? তার সঙ্গে যখন তার আবার দেখা হয়েছিল তখন কথায় কথায় বলেছিল যে প্রকৃতির জয়ধ্বজা নীরবে উড়িয়ে যাচ্ছে প্রাকৃতিক সম্পদস্বরূপ যেসব নির্বাক বস্তুসমূহ তাদের সঙ্গে বাক্য বিনিময়ের উপায় সে জানে, তখন সেই জ্ঞানী ভিক্ষুর চোখেও দেখেছিল অদ্ভুত দৃষ্টি। সে পর্যন্ত তার ব্যবহারে বুঝিয়ে দিয়েছিল যে এসব প্রকৃতিস্থ মানুষের কথা নয়, এবং সে বলেছিল যে যদি সে এরকম ভাবনা করে তো তার মধ্যে বাসা বেঁধেছে মানসিক রোগ, আর সেটা সারাবার উপযুক্ত উপায় হচ্ছে সদাসর্বদা ধ্যানমগ্ন হয়ে থাকা। সে আর কথা বাড়াতে চায়নি এই বিষয়ে বলে তাকে বলেনি যে ধ্যানমগ্ন হয়ে থাকলেই তার কাছে চলে আসে পাহাড়-উপত্যকা-নদীর নির্বাক কলরব, সে তখন তাদের আলাদা আলাদা কণ্ঠস্বর শুনতে পায়, কান দিয়ে নয়, অন্তর আর আত্মা দিয়ে। জীবাক্ষ যখন বিশ্বাস করেনি এই জার্মান লোকটি কি বিশ্বাস করবে ? কথাটা বলে তাই সে মনে মনে যখন গূঢ়তত্ত্ব এভাবে হঠাৎ প্রকাশ করে দেওয়ার জন্য নিজেকে তিরস্কার করছে তখন তাকে অবাক করে দিয়ে গেরহার্ট বলল,

‘বিশ্বাস করব না কেন ? আমি জানি, নদীর সঙ্গে কথা বলা যায়। অন্তত তাকে দিয়ে তার ভাষায় কথা বলানো মোটেই অস্বাভাবিক কাজ নয়। যদি তাই না হবে তাহলে ভূবিজ্ঞানীরা কোন নদীর আদ্যোপান্ত জানতে পারে কিভাবে তার মধ্যে অভিযান চালিয়ে ? নদীর সঙ্গে কথা বলা যায়, তার জন্য ভূবিজ্ঞানীও হতে হবে না, থাকতে হবে যে মানুষ কথা বলবে তার উপযুক্ত জ্ঞান ও মনোভাব।’

গেরহার্ট কথা থামিয়ে এস ইউ ভি-তে পিছনের আসনে বসে থাকা ব্যক্তিবর্গকে দেখিয়ে বলল,

‘এই যে মানুষগুলিকে দেখছ এবার আমার সঙ্গে এরা কেউ আগের স্পিতিভ্যালি ভ্রমণে ছিল না। তখন যারা ছিল তারা কেবলই পর্যটক, এসেছিল আমার সঙ্গী হয়ে কোল্ড ডেজার্ট মাউন্টেনকে কেবলই উপভোগ করার জন্য। দার্শনিক বা জ্ঞানপ্রাপ্ত ব্যক্তির চোখ দিয়ে নয়, কেবলই পর্যটকের চোখ দিয়ে। তাই তাদের সঙ্গে গোটা ট্রিপটাতেই কিছু না কিছু খিটিমিটি লেগেই থাকত। তাদের কেবলই আক্ষেপ ছিল, কুঞ্জুম পাস্ ধরে গিয়ে চন্দ্রতাল দেখে মানালি পর্যন্ত যাওয়ার পথটিকে দেখা হল না বলে। তারা জানো, এর সমস্ত দায় আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছিল ? স্পিতিভ্যালির এই অপার্থিব সৌন্দর্য্য দেখেও তারা খুশি হয়নি, তাদের কেবলই আপসোস ছিল আবার স্পিতিভ্যালির রুক্ষ-শুষ্ক পথ ধরে যাওয়ার জন্য। তারা কেউ একবারও বলেনি যে এই উপত্যকাকে দু’-দু’বার দেখা সৌভাগ্যের ব্যাপার, আমি নিজে তো দশবার দেখেও একে আবার দেখতে চাইব। তাই এবারের ট্রিপে যারা আমার সঙ্গে রয়েছে তারা কেবলই দেখার জন্য আসেনি, এসেছে দেখে তাকে অন্তরস্থ করার জন্য। এদের কেউ আমার ছাত্র বা গবেষক, কেউ বা আমার সহকর্মী, সারা পৃথিবীর বিখ্যাত বিখ্যাত শিক্ষাকেন্দ্রের সঙ্গে সবাই যুক্ত। এরা কেউ নিজে বিজ্ঞানী বা দার্শনিক। আমরা কেবল স্পিতি ভ্যালি দেখতেই এসেছি।এখান থেকে মানালি বা শিমলা যাওয়া আমাদের লক্ষ্য নয়। সে তো সাধারণ বেড়াতে আসা লোকরা করে, এক ট্রিপে যতটা পারা যায় দ্রষ্টব্য স্থান কভার করে নেওয়া, জন্মে আর সেখানে যাবে কিনা সন্দেহ। আমরা একদমই তেমন নই। আমাদের দ্রষ্টব্য স্থান কেবলই স্পিতি ভ্যালি। আমাদের কেবলই আকর্ষণ স্পিতিভ্যালিকে বারবার দেখা, যতবার খুশি।’

গেরহার্ট আবার কথা বলা থামাল, তারপর পিছনের আসনে বসে থাকা এক ব্যক্তিকে দেখিয়ে বলল, 

‘এই যে দেখছ, এর নাম সাইমন। মার্কিন মুলুকে এক নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বিজ্ঞানী।’

সে তাকাল সাইমনের দিকে। পঞ্চাশোর্ধ এক ব্যক্তি, বোধহয় মিশ্ররক্ত গায়ে। সে তাকাতে সাইমন অমায়িক হাসল, তার দেখানো পদ্ধতিতে যুক্তকর করল। মুখে কিছু বলল না। গেরহার্টই কথা বলে চলল, 

‘ওর জীবনের অভিজ্ঞতা শুনবে ? ও জাগতিক ও মহাজাগতিক বস্তুসমূহের বার্তা পায়, আর পায় বেশ বিচিত্র উপায়ে, স্বপ্নে। কতকিছু, কত বার্তা সে জেনেছে এভাবে ভাবতে পার ? সাইমন বল না। শোনাও ওকে তোমার সেসব বিচিত্র বার্তাবহ ঘটনাগুলির কথা।’

গেরহার্ট তাকালে সাইমন মৃদুভাষ্যে জানালো,

‘তুমিই বল না। তুমি তো সব জানো। আমার চেয়ে ভালো বলতে পারবে।’ 

‘একবার কী হয়েছিল, শোন।’ গেরহার্ট শোনাতে লাগল, ‘সাইমন সারা রাত তার বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণাগারে কাজ করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছিল। সে তার আগে গবেষণা করছিল সৌরজগতের অ্যাস্টরয়েড বেল্ট নিয়ে। ঘুমের মধ্যে সে কী স্বপ্ন দেখল কল্পনা করতে পার ? সে দেখল, ওই বেল্টের একটি মাঝারি আকৃতির গ্রহাণু, যার পুরোটা দেখতে কোন মানুষের মুখমণ্ডলের মত, সে তাকে স্বপ্নে বলছে, আমি আসছি তোমাদের ছুঁয়ে যেতে। তার পরদিনই বিজ্ঞানীরা জানতে পারল,       অ্যাস্টরয়েড বেল্টের একটি গ্রহাণু কোনক্রমে তাদের কক্ষপথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসছে। যদিও দেখা গেল যে বায়ুমণ্ডলে ঢুকে মাটিতে নামার আগেই প্রবল ঘর্ষণে তার অধিকাংশটা পুড়ে ছাই হয়ে যাবে, তবুও কিছুটা তো এসে ভূপৃষ্ঠে আঘাত করবে। কোন জনবহুল শহরে পড়লেই সর্বনাশ। ব্যাপারটা কেবল বিজ্ঞানীরাই জানত, সাংবাদিকদের জানানো হয়নি, বিশ্বজনতা ব্যাপারটা জানলে ত্রাস ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে বলে। এখন পৃথিবীর অনেক জনবর্জিত এলাকা সভ্যতার অগ্রগতিতে এবং জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ার জন্য জনপদ হয়ে গেছে। তবুও ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে ভূপৃষ্ঠের স্থলভূমির অধিকাংশ এলাকা এখনও জনবর্জিত আছে। বিজ্ঞানীরা গ্রহাণুটির গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করে দেখতে পেল যে কোন জনপদে পড়ার সম্ভাবনা আশি শতাংশও নেই। সাইমনও ছিল তাদের দলে। স্বপ্নটি দেখার পাঁচদিনের মাথায় দক্ষিণ আমেরিকার এক জনবর্জিত এলাকায় রাতে গ্রহাণুটির অবশিষ্ট অংশ এসে আঘাত করল। সাইমনের সঙ্গে আমি গিয়েছিলাম পরে ওই জায়গাটাতে। যা দেখেছিলাম তা সত্যিই শিউরে ওঠার মত ব্যাপার। গ্রহাণুটির আঘাতে ওই জায়গাটাতে একটা বিশাল গর্ত হয়ে গিয়েছিল এবং সেই গর্তের চারপাশে কয়েক কিলোমিটার ব্যাসযুক্ত ভূত্বক ছিন্নভিন্ন অবস্থায় ছিল, আর এলাকাটার আধ কিলোমিটার ব্যাসার্ধে ভূপৃষ্ঠের মাটির গা পুড়ে কালোবর্ণ দেখাচ্ছিল। বিশাল এক পারমাণবিক বোমাও এতটা প্রভাব ফেলতে পারে না। যদি ওই গ্রহাণু জনপদে এসে পড়ত তো কী হত ভাব ?’

গেরহার্ট কথা থামাল। গাড়িতে যারা বসে ছিল তারা কেউ আর কিছু বলছিল না। তার মুখেও কোন কথা ছিল না, ভাবছিল সাইমনের অদ্ভুত অভিজ্ঞতার কথা। একটি গ্রহাণু যদি বার্তা পাঠাতে পারে এভাবে, মানুষের জানা মনস্তত্ব তার হিসেব দিতে মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য। গেরহার্ট আবার বলতে লাগল,

‘নদীর সঙ্গে কথা বলা মানুষের পুরোনো অভ্যেস। পৃথিবীর সমস্ত সভ্যতাই নদীমাতৃক। নদীর কণ্ঠস্বর মানুষের প্রাণে বাজে। যারা শোনার তারা শোনে, তারা বোঝে। মানুষ কথা বলে মুখে, তার সেই মুখের ভাষা বোঝে মানুষই। অন্য প্রাণিরাও সেই ভাষায় সাড়া দেয়। কিন্তু সেই ভাষায় কথা বলা যায় না সর্বক্ষেত্রে। প্রয়োজন সেসব ক্ষেত্রে অন্তরের ভাষা। তুমি যখন নদীর সঙ্গে কথা বলতে পার ব্যাপারটা নিশ্চয় জানো। নদীর কণ্ঠ বাজবে তোমার অন্তরে। আবার তোমার কথাও নদীকে শোনাবে অন্তর দিয়েই। এটা এক বিচিত্র উপলব্ধি, যে বোঝে সেই বোঝে, অন্য কেউ নয়। কিন্তু আমার একটু কৌতূহল হচ্ছে। জানিনা তুমি উত্তর দেবে কিনা। তুমি এভাবে চলতে চলতে স্পিতিনদীর সঙ্গে কোন বিশেষ প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলছিলে কি ? যদি হয় কী সেটা ?’ 

অন্যক্ষেত্রে সে জানাত না। কিন্তু গেরহার্টের কথা তার হৃদয় ছুঁয়ে গেছে। সে তাই বিনা দ্বিধায় বলল,

‘আমি নদীর সঙ্গে কথা বলছিলাম অনন্ত জীবন নিয়ে।’

‘ওটা আমারও জিজ্ঞাসা। আমার গবেষণার বিষয়।’

তার কথার জবাবে গেরহার্ট কথা বলতে বিন্দুমাত্র দেরি করল না। 

(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *