মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস

দ্বিতীয় পর্ব 

চায়ের দোকানের পুরোনো ছবি। কালো দরজাওয়ালা দোকান

আমাদের বাড়ির ঠিক উল্টো দিকে অর্থাৎ মিউনিসিপ্যাল রোডের অপর দিকে একটা তিনতলা বাড়ি৷ সে সময় বাড়ির নানা তলায় নানা প্রকারের ভাড়াটের বাস৷ একতলার সামনের অংশে ছিল তিনটে দোকান৷ এর মধ্যে একটি দোকানের মালিক ছিলেন রণজিৎ সেন৷ জেঠার দোকান মূলত চায়ের৷ এখনকার মত এত অসংখ্য চায়ের দোকান কালনাতে ছিল না৷ আর রণজিৎ জেঠার দোকান ছিল যথেষ্ট বড় পরিসরে৷ দোকানে বড় ডেচকিতে দুধ ফুটতে থাকত৷ রকমারি পাউরুটি, হরেক বিস্কুট, পান, বিড়ি, সিগারেট, দেশলাই ….কি না ছিল!

ভোর চারটে নাগাদ দোকানের ঝাঁপ খুলে যেত৷ উনুনে আঁচ পড়ত৷ রোজ‌ই এ সময় রাস্তায় নাম সংকীর্তন শোনা যেত৷ আধো ঘুমে আধো জাগরণে বুঝতাম দোকান খুলে গেছে৷ জেলের দল নদী বা পুকুরে জাল নিয়ে যাবার আগে দোকানের সামনে জড়ো হত চায়ের আশায়৷ তাদের চাপা গলায় আলাপের আভাষও পেতাম৷ 

উঁচু ক্লাসে পড়ার চাপ বাড়লে এই সময় উঠে ছাদে চলে আসতাম৷ পূব আকাশ লাল হয়ে উঠতো৷ দোকান আরও সরগরম হয়ে উঠতো। প্রথম ভাড়া নিয়ে বের হবার আগে রিক্সাকাকুরা, ভ্যানকাকুরাও চায়ে গলা ভেজাতে আসতো। বেলা বাড়ত৷ বেকারি থেকে সম্ভার নিয়ে ফেরিওয়ালা নামিয়ে যেত দোকানে৷ দুধ আসত ৷ কলাও ৷ আমার বড্ড লোভ হত যখন ওই ডেচকিতে ফুটে ফুটে ঘন হওয়া দুধে পড়া সর পাউরুটিতে লাগিয়ে খদ্দেরকে জেঠু দিতেন৷ মা রুটি আনিয়ে বাড়িতে তখন সরের টোস্ট করে দিতেন৷ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বিস্কুট কিনে আনতাম আর আনতাম ‘হেমা মালিনীর খোপা’৷ ভগবান জানে বানরুটির ও রকম অদ্ভুত নাম ছিল কেন! দোকানের বেঞ্চ ভরে উঠত খদ্দেরে৷ তাদের চাপা আলাপ কখনও কখনও অশান্তির চিৎকারে ফেটে পড়ত৷ দোকানের কাজে সাহায্যকারী কিশোর বান্টা গামলার জলে ধুয়ে চলত কাপ, গ্লাস৷ কাঠের খোপ করা ট্রেতে চা দিয়ে বেড়াবার ফাঁকে ফাঁকে আমাদের বল বা রান্নাবাটি খেলায় যোগ দিয়ে যেত৷ দুপুরে ধার বাকির হিসাব মেলাতে বসত জেঠা৷ কোনোদিন হয়ত বা চান খাওয়া করতে বাড়ি যেত৷ তখন জেঠার ছোটভাই দোকান সামাল দিত৷ আশাপাশে অনেক দলিলখানা ছিল বাড়িগুলোর এক তলার খোলা রোয়াকের সংলগ্ন ঘরে৷ এই সব দলিলখানা, এস ডি ও অফিস আর আমার দাদু বাবার ডাক্তারখানায় লোকের ভিড় থাকত বলে চায়ের দোকানটিও জমে উঠত৷ মাঝে মাঝে বাকিতে খাওয়া খদ্দেরের সাথে লেগে যেত হিসাব নিয়ে মার মার কাট কাট৷ 

বন্ধ হয়ে যাওয়া চায়ের দোকানের বর্তমান ছবি

তবে এমন মগ্ন পাঠক চা দোকানের মালিক আমি আর কখনও দেখব কিনা জানি না৷ লাইব্রেরি তো বটেই পাড়ার নানা জনের বাড়ি থেকে বই সংগ্রহ করে বই পড়ে চলতেন জেঠু ক্রেতা আসার অবসরে৷ বৃদ্ধ হয়ে যাবার পর জেঠু দোকানের পাট গুটিয়ে ছিলেন৷ তবু মাঝে মাঝে দেখতে আসতেন পুরোনো স্হান৷ আজ সেই জেঠুও নেই৷ বাড়ির মালিকানাও বদলে গেছে৷ সে দোকানঘর বন্ধ পড়ে আছে৷ তার দরজা খোলে শুধু আমার মত আরও অনেকের মনে৷

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *