তুষার বরণ হালদার
লেখক পরিচিতি
(তুষার বরণ হালদার নদীয়ার আড়ংঘাটা গ্রাম থেকে স্কুল শিক্ষা শেষ করে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করেন। পি.এইচ.ডি. ডিগ্রি পান নদীয়া জেলার অসংগঠিত শিল্প ও শ্রমিকদের ওপর গবেষণা করে । গবেষণা কর্মের ওপর ভিত্তি করে দুটি বই এবং বিভিন্ন গ্রন্থ ও জার্নালে বহু প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদ কর্তৃক প্রদত্ত শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধের জন্য তিন বার পুরস্কৃত হন। এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য। বর্তমানে তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত দক্ষিণবঙ্গের একটি কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপক।)
শরচ্চন্দ্র দাশ (১৮৪৯ – ১৯১৭)
একাধারে তিনি ছিলেন তিব্বত বিশেষজ্ঞ, বৌদ্ধধর্ম অনুরাগী, পালি ও সংস্কৃত ভাষায় পন্ডিত। তিনি হলেন শরচ্চন্দ্র দাশ। তবে তাঁর প্রথম জীবনের দিকে তাকালে তাঁর পরের জীবনের কার্যক্রমকে মেলানো যায়না। জন্ম হয়েছিল অবিভক্ত বাংলার চট্টগ্রাম শহরে। পিতা ছিলেন দীন দয়াল দাশ। শরচ্চন্দ্র এন্ত্রাস ও লোয়ার আর্টস পাশ করে করে প্রেসিডেন্সী কলেজে পূর্ত বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন।ওই বিভাগে শেষ পরীক্ষার সময় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে ডাক্তারদের পরামর্শে তাকে স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য দার্জিলিং নিয়ে যাওয়া হয়। সেই সময়ে ভুটিয়া বোর্ডিং স্কুল নামে একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল তৈরী হলে, সেখানে ইংরেজি ভাষা শেখানোর জন্য একজন মাস্টারের প্রয়োজন হয়। সে সময় প্রেসিডেন্সী কলেজের অধ্যক্ষ আলফ্রেড ক্রফট তাঁর ছাত্র শরচ্চন্দ্রকে সেই দায়িত্ব অর্পণ করেন। শরচ্চন্দ্র সেই দায়িত্ব গ্রহণ করে তিনি ছাত্রদের ইংরেজী শেখাতে থাকেন, অন্যদিকে দার্জিলিংয়ের তিব্বতি পরিবারগুলির কাছ থেকে তিব্বতি ভাষা রপ্ত করেন।
সেই শুরু, পরে তা আরো গভীর ভাবে তিনি আত্মস্থ করেন। ক্রমে তাঁর মনে হলো, অতীত ভারতে অতীশ দীপঙ্করের মতো মনীষীরা কত কষ্ট করে তিব্বত গিয়ে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার ও প্রসার ঘটিয়েছিলেন। তাঁর সেই তিব্বতী স্কুলের এক শিক্ষক শরচ্চন্দ্রএর তিব্বতী অনুরাগে খুশি হয়ে তাকে তিব্বতে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। মনে রাখতে হবে সে সময়ে তিব্বতে যাওয়া চারটে খানি কথা ছিল না। যাইহোক অনুমতি পত্র যোগাড় করে ১৮৭৯ সালে শরচ্চন্দ্র তাঁর স্কুলের সহকর্মী লামা উগায়েনকে সঙ্গে নিয়ে পদব্রজে তিব্বত পাড়ি দিলেন। দীর্ঘদিন বাদে তিব্বতের তাসিলুঁনপো মঠে উপস্থিতি হলেন। ছয়মাস সেখানে ছাত্র হিসাবে থেকে অনেক দুর্লভ বৌদ্ধ গ্রন্থ পাঠ করেছিলেন এবং মূল্যবান পুঁথি ও অন্যান্য তথ্য সংগ্রহ করে দেশে ফিরেছিলেন। তাঁর এই তিব্বত ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে ‘Narrative of a Journey to Tashilumpo in Tibbet in 1979’ নামে এক অনবদ্য গ্রন্থ প্রনয়ণ করেছিলেন। এই ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন স্বযং আলফ্রেড ক্রফট। এই বইতে কাঞ্চনজঙ্ঘা পর্বত শৃঙ্গের উত্তর ও উত্তর – পূর্ব দিকের প্রকৃতি ও পরিবেশ নিয়ে যে বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছিলেন তা আজও প্রাসঙ্গিক।
এরপর ভারত সরকার তাঁর তিব্বত সংক্রান্ত জ্ঞানে মুগ্ধ হয়ে দ্বিতীয় বার তিব্বত যাওয়ার অনুমতি প্রদান করেছিলো। তিনি ১৮৮২ সালে আবার তিব্বত যাত্রা করেন। এবার তিনি অনেকটা সময় লাসা তে অতিবাহিত করেন। সেখানে তিনি চোদ্দ মাস থেকে তিব্বতি ও বৌদ্ধ বিষয়ক জ্ঞান আহরণ ও তথ্য সংগ্রহ করে দেশে ফিরে আসেন। এর ফলশ্রুতি হলো তিব্বতের অজানা ভৌগলিক তথ্য নিয়ে ১৯০২ সালে রচনা করেন ‘Journy to Lasha and Central Tibbet ‘ নামক আর একটি মূল্যবান গ্রন্থ। এই গ্রন্থগুলির মধ্যে দিয়ে তাঁর প্রচ্যবিদ্যাচর্চা বিকষিত হতে থাকে। সেই বহু যুগ আগেই ভারত সংস্কৃতির সঙ্গে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির সাথে সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। আর সেই গড়ে ওঠার কাজে শরচ্চন্দ্র দাশের মতো ভারততত্ত্ববিদদের অবদান অনস্বীকার্য।
তিনি শুধু তিব্বতেই নয় বৌদ্ধশাস্ত্র বিশারদ হিসাবে চিনেও গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি ” কাচেন লামা” হিসাবে সমাদৃত হয়েছিলেন। এর অর্থ কাশ্মীর থেকে আসা বৌদ্ধপন্ডিত। ১৮৮৭ সালে
শরচ্চন্দ্র গিয়েছিলেন থাইল্যান্ডে বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার সম্পর্কে জানতে। তাঁর পাণ্ডিত্য ও অধ্যবসায়ে মুগ্ধ হয়ে থাই রাজা তাঁকে সেখানকার সর্বোচ্চ উপাধি ‘ তুষিতমত ‘ পদক দিয়ে সম্মানিত করেন। তাঁর আর একটি অন্যতম কীর্তি ভারত থেকে হারিয়ে যাওয়া মহাকবি ব্যাসদাস খেমেন্দ্রের লেখা ‘ বোধিসত্ত্বাবদান কল্পলতা ‘ নামক অমূল্য সংস্কৃত গ্রন্থ তিব্বত থেকে ভারতে ফিরিয়ে আনেন। পরে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের অনুরোধে চার খন্ডে এর বাংলা অনুবাদ করেছিলেন। সমকালীন অনেক ইংরেজী ও বাংলা সাময়িক পত্রে তিনি ভারতবিদ্যাচর্চা বিষয়ক বহু প্রবন্ধ লিখেছিলেন। ১৮৯৩ সালে তিনি বৌদ্ধশাস্ত্র ও গ্রন্থ প্রচারের জন্য কলকাতাতে Buddhist Text and Research Society নামে সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
বৌদ্ধপন্ডিত শরচ্চন্দ্র দাশ সম্পর্কে আলোচনায় একটি কথা খুবই জরুরী তা হলো লুপ্ত বৌদ্ধ গ্রন্থ উদ্ধার ও প্রচারের কাজে তিনি প্রায় সারা জীবন অতিবাহিত করে ফেললেও , তিনি নিজে কিন্তু বৌদ্ধ ছিলেন না। আজীবন বৌদ্ধ সংস্কৃতি কেন্দ্রিক ভারতবিদ্যা চর্চায় রত থেকে তিনিই প্রথম তিব্বতের সুমহান সৌন্দর্য ও সুমহান সংস্কৃতির কথা বিশ্ব মানবের কাছে উন্মোচিত করেছিলেন। ১৯১৭ সালের জানুয়ারি মাসে বিশ্বখ্যাত এই বাঙালি বৌদ্ধপন্ডিত ইহলোক ত্যাগ করেন।